You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজশাহী রাজশাহীর সব হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের নেতৃত্বে ছিল কমান্ডার আয়েনউদ্দিন

আনিসুজ্জামান, রাজশাহী থেকে ॥ বৃহত্তর রাজশাহীর কুখ্যাত রাজাকার, তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আলবদর বাহিনীর কমান্ডার আয়েনউদ্দিন এখন হাইকোর্টের দালালী ব্যবসা করে ঢাকায় পুনর্বাসিত। একই সাথে সে ঢাকাস্থ আরব-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের পদ ব্যবহার করে বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে। ঢাকা শহরে গড়ে তুলেছেন আলিশান বাড়ি-গাড়ি। এছাড়া রাজশাহীতেও রয়েছে তার দু’তিনটি বাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। একাত্তরে এই রক্তপিপাসু নরঘাতক তার রাজশাহীস্থ বাড়ির সামনে নিজ হাতে গুলি করে দু’জন মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করে। শুধু তাই নয়, একাত্তরে বৃহত্তর রাজশাহীতে মুক্তিযােদ্ধা, বুদ্ধিজীবীসহ নির্বিচারে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন প্রভৃতি জঘন্য কাজের নেপথ্য কাহিনীর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত পাকি জেনারেলদের খেদমতগার আয়েনউদ্দিনের নাম। রাজশাহীর মানুষ এখনও তার নাম শুনলে ঘৃণায় থু থু ফেলে। তার নৃশংসতার কাহিনী রাজশাহীর মানুষ আজও ভুলতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাজশাহীর রাজাকারদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, একাত্তরে এই নরঘাতক ও তার দলের সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসে শত শত মানুষ খুন ও জবাই করেছে। কিন্তু তার সে সব নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কোন রেকর্ড নেই।

তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আলবদর কমান্ডার আয়েনউদ্দিন এখন ঢাকায় পুনর্বাসিত। হাইকোর্টের দালালী ব্যবসা এবং ঢাকাস্থ আরব-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ঢাকাতেই আস্তানা গেড়ে বসেছে। একাত্তরে বৃহত্তর রাজশাহীর এই শীর্ষ খুনী। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দীর্ঘদিন মুসলিম লীগের রাজনীতির কলকাঠি নেড়ে সর্বশেষ ‘৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (কুষ্টিয়া- দুর্গাপুর) আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু প্রতিবারই এখানকার জনসাধারণ গণধিকৃত এই রাজাকারকে ভােট না দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর পাকিপন্থী আয়েনউদ্দিন অতিরিক্ত পাকিস্তান প্রীতির কারণে দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং তখন এই অঞ্চলের মুসলিম লীগের সভাপতি থাকার সুবাদে ‘৭১-এর এপ্রিল মাসে নিজ উদ্যোগে গঠন করে তথাকথিত জেলা শান্তি কমিটি। নিজেই ওই কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে নিজেকে নিয়ােজিত করে জেলার বিভিন্ন স্থানে শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। ২৫ মার্চ পাকি জেনারেলরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরে প্রবেশ করলেও মুক্তিযােদ্ধা, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর প্রতিরােধে সুবিধা করে উঠতে পারেনি। ১৩ এপ্রিল শেষ বিকাল নাগাদ ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনীর বিরাট বহর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে মুক্তিযােদ্ধা, পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী পিছু হটে নতুন অবস্থান গ্রহণ করে। আর পাকি হানাদার বাহিনীর বিরাট বহর আসার পরপরই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েনউদ্দিন বেপরােয়া হয়ে ওঠে। শুরু করে তার নৃশংসতা। পাকি ক্যাপ্টেন ইলিয়াসের সাথে আয়েনউদ্দিন গড়ে তােলে সখ্য।

এই পাকি সেনাকর্তার সহায়তায় রাজশাহী হােমিও কলেজ মাঠে শান্তি কমিটি এবং আলবদর বাহিনীর সদস্যদের সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে গড়ে তােলা হয় সশস্ত্র শান্তি বাহিনী এবং আলবদর বাহিনী। বিভিন্ন বাহিনী ও কমিটির সমন্বয়ে গঠিত রাজাকারদের হেডকোয়ার্টার ছিল শহরের রানীবাজারস্থ মুসলিম সাহেবের দ্বিতল বাড়ি। এখানে প্রতিদিন বহু মুক্তিযােদ্ধা, বুদ্ধিজীবী এবং নিরীহ বাঙালী নারী পুরুষকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করেছে রাজাকার বাহিনী। আয়েনউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার বাহিনী সমগ্র রাজশাহী খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগসহ নৃশংস তাণ্ডব শুরু করে। রাজাকার আয়েনউদ্দিনের নির্দেশে তার অন্যতম সহযােগী তানাের থানা আলবদর কমান্ডার সামসুদ্দিন, ইউসুফ মিয়া (রাজশাহী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান), তৈয়ব খান, আফাজ মােক্তার তানােরের জমিদার লােলিত মােহন মৈত্র’র বাড়িতে অসংখ্য নারী, শিশু ও মুক্তিকামী বাঙালীকে পাশবিক নির্যাতনের পর হাত-পা কেটে চোখ উপড়ে ফেলে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর এখান থেকে ১২৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এই রাজাকার ‘৭১-এর ১৪ নবেম্বর ১৪ মুক্তিযােদ্ধাকে পাকি জেনারেলদের হাতে তুলে দেয়। এছাড়া পাক-বাহিনীর সকল কর্মকাণ্ড তারই নির্দেশে পরিচালিত হতাে। রাজাকার কমান্ডার আয়েনউদ্দিনের নির্দেশে বৃহত্তর রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে যে সব রাজাকার নির্বিচারে গণহত্যা চালায় তারা হলাে ঃ জসিম উদ্দিন আহমদ, জিয়াউল আলম, মােসলেম চেয়ারম্যান (হরিয়ান ইউপি), কোরবান মােল্লা, কাশেম সর্দার, আলীমুদ্দিন, মােঃ গনি, মােঃ খলিল শেখ, মােঃ ফজল মিয়া, মােঃ মােজাহার, মােঃ সাত্তার, এহছান আলী, হামিদ আলী, করিম হােসেন, মােঃ কালাম ও ছালাম, কাশেম  আলী, মােঃ মান্নান, মােঃ ইদ্রিস, মােঃ সাইফুল্লাহ (রেডিও পাকিস্তানের রিজিওনাল ডিরেক্টর), গােলাম রব্বানী, এএইচএম কামাল, আনােয়ার হােসেন, জমিরুল হক চৌধুরী।

এদের সকলের বাড়িই রাজশাহী জেলায়। এছাড়া মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও ডঃ ইরিতিজা (শিবগঞ্জ, চাপাইনবাবগঞ্জ), আফাজ উদ্দিন ও আঃ সাত্তার খান চৌধুরী (নাটোর), মীর মৌলবী ওবায়দুল্লাহ (বানচাল), মীর তায়েব আলী (চাপাইনবাবগঞ্জ শহর), ফরাজ উদ্দিন মােল্লা (শেখপাড়া নওগাঁ), মুন্তাজ আলী ও মােসলেম মােল্লা (নাচোল, চাপাইনবাবগঞ্জ)। এরা নিজ নিজ এলাকায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে আবির্ভুত হয়ে নির্বিঘ্নে চালায় গণহত্যা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বৃহত্তর রাজশাহীর মানুষ এবং মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার কুল শিরােমণি আয়েন উদ্দিন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নাম ভুলে যাননি। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়ে এখনও অনেকে বেঁচে আছেন। রাজশাহী শহরের অদূরে শ্যামপুরে রূপচাদ মন্ডল (৮৩) ‘৭১ সালে রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সামসুজ্জোহা হলের পিছনের গণকবর থেকে উঠে আসেন অনেকটা ভাগ্যের জোরে। জুন মাসে পাক বাহিনী জোহা হল সংলগ্ন বধ্যভূমিতে বহু  বাঙালীর সাথে ব্রাশফায়ার করে মাটিচাপা দিয়েছিল তাকেও। অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে  যাওয়া রূপচাদ মন্ডল বহু কষ্টে উঠে আসেন সেখান থেকে রাতের অন্ধকারে গণকবরের মাটি, গাছপালা আর ঝােপ জঙ্গল সরিয়ে। রূপচাদ মন্ডল তার চাক্ষুস স্মৃতির কথা বলেছেন জনকণ্ঠকে। ওই সময় তাকে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা শ্যামপুরস্থ নগরপাড়ার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসে কাটাখালী ইউপি কার্যালয়ে। সেখানে পূর্ব থেকে বসেছিল রাজাকার মােসলেম চেয়ারম্যান, কোরবান মােল্লা, কাশেম মাস্টার ও আলীমুদ্দিন।

কিছুক্ষণ পর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েনউদ্দিন এসে তাকেসহ আরও কয়েক জনকে মুক্তিবাহিনীর লােক বলে চিহ্নিত করে। রাত ৮টার দিকে শান্তি কমিটির লােক দ্বারা তাদের বেদম মারপিটের পর ১০টার দিকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। পাকবাহিনী তাকেসহ অন্যদের জোহা হলে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে তার সাথে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতনের পর ব্রাশফায়ার করে গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। রূপচাদ মন্ডল কান পাতলে আজও জোহা হলের সেই বর্বর নির্যাতনের আর্তনাদ শুনতে পান বলে জানান। আজও তার নাকে ভেসে আসে মানুষের তাজা। রক্তের গন্ধ। রাজাকার আয়েনউদ্দিন তার রক্তের তৃষ্ণা মেটাতে কত মানুষ যে হত্যা করেছে এবং করিয়েছে তার কোন হিসাব নেই। রাজশাহী মহানগরীতেই স্বাধীনতার পর আবিষ্কৃত হয় অন্তত ২০টি গণকবর। বর্তমান রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় আবিষ্কৃত হয় আরও ১৫টি গণকবর। রাজশাহী শহর যখন হানাদারমুক্ত হয় তখন রক্তপিপাসু নরখাদক আয়নউদ্দিন ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ রাজাকাররা গণরােষের ভয়ে আত্মগােপন করে নিজেদের রক্ষা করে। রাজাকার কমান্ডার আয়েন উদ্দিন পাক হানাদার। বাহিনীর সাথে পাকিস্তানে পাড়ি দেবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়।

জনকণ্ঠ ॥ ০২-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!