ঢাকা
বুদ্ধিজীবী হত্যার এক হােতা মওলানা মান্নানের বিচার আজও হয়নি
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তর সালেদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম এক নায়কের নাম মওলানা মান্নান। জাতি আজও ঘটা করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে। কিন্তু মওলানা মান্নানদের আজও বিচার হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এই পরাজিত শত্রু এবং বুদ্ধিজীবী। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নায়করা এখনও ঠিক আগের মতােই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণতদন্ত কমিশনের ধারাবাহিকতায় গণতদন্ত আদালত গঠিত হয়েছিল। গণতদন্ত কমিশন মুক্তিযুদ্ধবিরােধী, পাক বাহিনীর দালাল, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নায়ক ঘাতকদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে ৮ ঘাতক ও দালালকে চিহ্নিত করেছিল। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ গণতদন্ত কমিশন এই ৮ ঘাতক দালাল ও যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের জন্য নাম প্রকাশ করে। এদের মধ্যে মওলানা আব্দুল মান্নান একজন। মওলানা মান্নান বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকার মালিক। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনীর এক প্রধান সহযােগী এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত থেকেও স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে মওলানা মান্নান ক্ষমতার বৃত্তে এসে যান। পঁচাত্তর-পরবর্তী দু’টি সরকারেরই তিনি মন্ত্রী হন এবং মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন জমিয়তে মুদারেসিনের সভাপতি হন। সেই রাজাকার মওলানা মান্নানের কুকীতির বিবরণ রয়েছে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন রিপাের্টে। সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের তত্ত্বাবধানে এই রিপাের্টটি প্রণীত হয়। রিপােটে সেই রাজাকার মওলানা মান্নান সম্পর্কে বলা হয়, একাত্তরে তিনি পাক হানাদার। বাহিনীর একজন প্রধান সহযােগী ছিলেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে তিনি জড়িত এবং বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরীকে তিনিই পল্টনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
চাদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার দেবীপুর গ্রামের মওলানা মান্নানের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরােধী তৎপরতা রাজধানী ঢাকা থেকে ফরিদগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একাত্তরে তিনি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযােগী সংগঠন শান্তি ও কল্যাণ। কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন। মওলানা মান্নান পাক বাহিনীর গণহত্যাকে। সমর্থন জানিয়ে বেশ কয়েকটি বিবৃতিও দেন, ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই বিবৃতিতে মওলানা মান্নান বলেন, “সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমূলে উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান দেশপ্রেমিক জনগণ আজ জিহাদের জোশে আগাইয়া আসিয়াছে।” মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মওলানা মান্নান মাদ্রাসা শিক্ষকদের নিয়ে জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলেন। জেনারেল নিয়াজীকে এক কপি কোরান শরীফ উপহার দিয়ে মওলানা মান্নান বলেছিলেন, “পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও ইসলামের গৌরব বৃদ্ধির জন্য আমরা সৈনাবাহিনীকে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত।” নিয়াজীর সঙ্গে এই বৈঠকের পর মাদ্রাসা শিক্ষক ও ছাত্রদের রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ আলীম চৌধুরী হত্যার পিছনে মওলানা মান্নানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। ছিল। একাত্তরে মওলানা মান্নান থাকতেন আলীম চৌধুরীর বাসার নিচতলায় । আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও ছােট ভাই আব্দুল হাফিজ চৌধুরী গণতদন্ত কমিশনকে জানান, একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আলবদররা তাদের বাসায় আসে।
তারা প্রায় ৪৫ মিনিট মওলানা মান্নানের বাসায় ছিল। সেখান থেকে এসে তারা ডাঃ আলীম। চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আব্দুল হাফিজ চৌধুরী রমনা থানায় এ ব্যাপারে এফআইআর করেন। তারা আজিমপুরের একটি বাসা থেকে পলাতক। মওলানা মান্নানকে ধরে পল্টনে নিয়ে যান। সেখানে মওলানা মান্নান স্বীকার করেছিলেন, তার সরাসরি ছাত্র এমন তিনজন আলবদরই ডাঃ আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেছে। মওলানা মান্নানের সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নায়ক ব্রিগেডিয়ার কাশেম ও ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আলীম চৌধুরী হত্যার মাসখানেক আগে ঈদের দিন রাত আড়াইটায় এ দু’জন অফিসার মান্নানের বাসায় দাওয়াত খেতে এসেছিলেন। একাত্তরের ডিসেম্বরে দৈনিক বাংলায় সেই তিন শয়তান কোথায়’ শিরােনামে রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। একাত্তরে ফরিদগঞ্জে খলিলুর রহমান চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মওলানা মান্নান কর্তৃক সংগঠিত রাজাকার বাহিনী এলাকায় হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজসহ নিরীহ মানুষের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। ফরিদগঞ্জে তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক মাস্টার, সংগ্রাম পরিষদ সদস্য আব্দুল । জব্বার পাটোয়ারা ‘এবং আব্দুল আওয়াল এসব ঘটনার তথ্য গণতদন্ত কমিশনকে জানান। লিখিত সাক্ষ্যে তাঁরা জানান, মওলানা মান্নান ফরিদগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা।
আব্দুল মজিদ পাটোয়ারী, হায়দার বক্স পাটোয়ারী, আহমদ উল্লাহ খান, ইছহাক খান, সুলতান খান, আমিন উল্লাহ খান, প্রাইমারী শিক্ষক নিবারণ চন্দ্র দাস, হরেন্দ্র চন্দ্র দাস, আনসার আঃ রব, আব্দুর মতিন সাউত, সেকান্দার ভূঁইয়া, আঃ সাত্তার ভূইয়া, উপেন্দ্র চন্দ্র কর্মকার, যজ্ঞেশ্বর ভৌমিক, মইনুদ্দিন খান, আঃ অদুদ খান, হাবিব উল্লাহ, এছহাক। মীর, আক্কাস মিয়া, আবু তাহের, আয়াত উল্লা, হাশিম খান, হরে কৃষ্ণ দাস, জগদ্বন্ধু দাস, মদন কৃষ্ণ দাস, নগেন্দ্র চন্দ্র কবিরাজ, গােবিন্দ চন্দ্র দাসসহ ফরিদগঞ্জের অসংখ্য বাঙালীকে হত্যা করেছে। প্রত্যাশী গ্রামের হাসমতি বেগম ও আরফতি বেগমকে তাদের। নিজ বাড়িতে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। গণতদন্ত কমিশনকে ফরিদগঞ্জের কেরােয়া গ্রামের শহীদ হায়দার বক্স পাটোয়ারীর ছেলে আব্দুল কাদের পাটোয়ারী জানান, মৌলিক গণতন্ত্রের সময় মেম্বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নিয়ে তার বাবার সঙ্গে মওলানা মান্নানের বিরােধের সূত্রপাত। একাত্তরে মওলানা মান্নানের রাজাকার বাহিনী তাকে খুঁজতে এসে না পেয়ে তার বাবা হায়দার বক্স। পাটোয়ারী, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। স্ত্রী এবং ছেলেমেয়ে ছাড়া পেলেও তার বাবা ছাড়া পাননি। তিন দিন নির্মম নির্যাতনের পর হায়দার বক্স পাটোয়ারীকে খুন করা হয় মওলানা মান্নানের নির্দেশেই। একাত্তরের ২৭ ডিসেম্বর মওলানা মান্নানকে রমনা থানায় সােপর্দ করা হয়। ১৯৭২ সালের ৭ মে দৈনিক আজাদ পত্রিকা মওলানা মান্নানের ছবি ছেপে নিচে এই নরপিশাচকে ধরিয়ে দিন’ শিরােনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
জনকণ্ঠ ॥ ১৩-১২-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন