You dont have javascript enabled! Please enable it!

সর্ষিনার পীর আবু জাফর সালেহ – দু’বার স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তিনি

শওকত মিলটন ॥ একাত্তরের ঘাতক ও রাজাকার যদি স্বাধীনতার পদক পায় তবে সেই পদকের কোন মূল্য থাকে কি? প্রশ্নটি দেখা দেয় সর্ষিনার পীর আবু জাফর সালেহর দু’দু’বার স্বাধীনতার পদক প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে। বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান, “বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা সেবক’ এইচএম এরশাদ দেশের এই ঘৃণিত ঘাতক-রাজাকার পীরকে দু’দু’বার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছিলেন। এ পদক দু’টি কি প্রত্যাহার করা যায় ? স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী ব্যক্তিবর্গের পক্ষে প্রশ্নটি তােলা হয়েছে। সর্ষিনার পীর ১৯৭১ সালে তাঁর বিশেষ ফতােয়ায় বলেছিলেন, বাঙালী হিন্দু মেয়েরা হচ্ছে গনিমতের মাল। তাদের ভােগ করা জায়েজ। ভােগকে পীর অভিহিত করেছিলেন মূতা বিবাহ’। স্বরূপকাঠির ভারতী রানী বসু সেই ভয়াবহ দিনগুলাের স্মৃতি ভুলতে পারেননি। ৬ মে পাকিস্তানী বাহিনী আসে স্বরূপকাঠিতে। সেখান থেকে থানায় যাবার পথে সর্ষিনার পুল থেকে সাহাপাড়া পর্যন্ত সব বাড়িঘরে প্রথমে লুটপাট চালায়। তার পর সবকিছু জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। পর পর সাতদিন ধরে চলে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে এই বর্বরতা। ঢাকায় লালকুঠিতে পীরের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাজাকারবাহিনী গঠন, মাদ্রাসার ছাত্রদের রাজাকারবাহিনী, পুলিশে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।

স্বরূপকাঠির সব বর্বরতায় তখন পাকি বাহিনীর সঙ্গে অংশ নিয়েছে সর্ষিনার তথাকথিত মুরিদ নামধারীরা। তারা ওই এলাকার কমপক্ষে ৩০টি গ্রামকে তখন বর্বরতাধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বিরানভূমিতে পরিণত করেছিল। স্বরূপকাঠির প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ইন্দেরহাট বাজার পীরের নির্দেশে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। পাকি সেনা আর রাজাকাররা ৬ দিক থেকে একযােগে হামলা চালায় ইন্দেরহাটে। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে ৯ মাস সর্ষিনার পীরের বাড়ি ছিল পাকি বাহিনীর দুর্ভেদ্য ঘাটি, শলাপরামর্শকেন্দ্র। সেখানে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। এমনকি মুক্তিযােদ্ধাদের মুহুর্মুহু আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য স্বরূপকাঠি থানা অফিসটিও পীরের বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরােজপুর জেলা সীমান্তে অবস্থিত বিশাল বিখ্যাত পেয়ারাবাগান ছিল তখন মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। সর্ষিনার পীরের বাহিনী, পাকি বাহিনী মিলে পেয়ারাবাগান ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। তারা গাছ কেটে আগুনে ভস্মীভূত করতে চায় পুরাে পেয়ারাবাগান। স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলের ৮ম খণ্ডে সেই ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা আছে। প্রত্যক্ষদশী ভারতী রানী চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, “খান সেনারা বাগান কাটা শুরু করল। আমরা বাগানের খালের ভিতর বেলা ১০টায় নামতাম। বেলা ৪/৫টার দিকে জল থেকে উঠে বসতাম বাগানের উঁচু জায়গায়। সকালে এসেই খান সেনারা গুলি চালাত। যারা একআধটু মাথা তুলেছে তাে তাদের গুলির শিকার হয়ে মারা পড়েছে। কিন্তু সর্ষিনার পীরের কোন জারিজুরিই কাজে আসেনি। ১৯৭১ সালের ১১ নবেম্বর ৫ শতাধিক রাজাকার, দালালসহ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়সর্ষিনার পীর।

আত্মসমর্পণের পর তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়। খবর পেয়ে বরিশাল থেকে মুজিববাহিনীর একটি দল এই রাজাকার ঘাতক পীরকে হত্যার জন্য রওনা হয়েছিল। ৯। নম্বর সেক্টরের বেসামরিক প্রধান নূরুল ইসলাম মঞ্জুর তখন তার প্রাণ রক্ষা করেন। নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের নির্দেশে পীরকে গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয় । এই নির্দেশদাতা ব্যক্তি এখন জেলহত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত অবস্থায় কারাগারে আছেন। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের পর সর্ষিনার পীরের কর্মকাণ্ড অত্যন্ত গতিশীল হয়। স্বাধীনতার মাত্র ৯ বছর পর ১৯৮০ সালে জনসেবার(!) জন্য তাকে স্বাধীনতা পদক দেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮৫ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে(!) বিশেষ অবদানের জন্য আবার তাকে স্বাধীনতা পদক দেন এরশাদ। সর্ষিনার পীরের অন্যতম প্রধান সিপাহ শালার ঘাতককুল শিরােমণি মাওলানা এমএ মান্নানের তৎপরতায় এসব পদক তাকে দেয়া হয়েছিল। সাধারণ নাগরিকদের বাড়িঘর পােড়ানাের নাম যদি জনসেবা হয়। সে ক্ষেত্রে তাঁর মতাে সমাজসেবী খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে দুষ্কর! আর মাদ্রাসা ছাত্রদের ঘাতকবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে কৃতিত্বের(!) স্বাক্ষর রেখেছেন। এখন এসব পদকবৃত্তান্ত পুনর্বিবেচনা করার দাবি উঠেছে।

জনকণ্ঠ ॥ ১৮-১২-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!