নড়াইল নড়াইলের শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সলেমান মাওলানার নির্দেশে
সাজেদ রহমান/ রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল থেকে ॥ একাত্তরের কুখ্যাত রাজাকার, নড়াইল জেলা পিস কমিটির চেয়ারম্যান, জামায়াত নেতা সলেমান মাওলানা এখন। অঢেল সম্পত্তির মালিক। অভিযােগ রয়েছে, ‘৭১-এর লুটের টাকায় ঢাকার কাছে বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়ে বসবাস করছে। তার আরেক ভাই রাজাকার কমান্ডার রুহুল কুদুস বর্তমানে যশাের জেলা জামায়াতের ‘পলিটিক্যাল সেক্রেটারি’। তাদের অত্যাচারনির্যাতনের কাহিনী আজও ভুলতে পারেননি নড়াইলবাসী। এখনও এই দুই পাকি বাহিনীর কুখ্যাত দালাল গ্রামে যেতে পারে না। নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর গ্রামের দু’ভাই সলেমান ও রুহুল ‘৭১-এ তৎকালীন নড়াইল মহকুমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিল। তাদের কলমের লাল কালির নির্দেশে। নড়াইলের শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মে মাসের মধ্যেই মহকুমা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজাকারদের তৎপরতা জোরদার করতে সলেমান কমিটি গঠন করে। নিজে নড়াইলের পিস কমিটির চেয়ারম্যান হয়। তার ভাই রুহুলকে দায়িত্ব দেয় জেলা কমান্ডারের। ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে দু’ভাই মিলে নড়াইল ভিক্টোরিয়া স্কুলের সহকারী শিক্ষক আতিয়ার রহমানের গ্রামের বাড়ি তুলারামপুরে হামলা চালায়। ধরে আনে আতিয়ার রহমানসহ তরফদার বাড়ির নয়। জনকে। এরা হলেন আব্দুস সালাম, তুলারামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আলতাফ হােসেন, ব্রহ্মডাঙ্গা তহসিল অফিসের তহসিলদার রফিকুল ইসলাম, ভিক্টোরিয়া কলেজের বিএ’র ছাত্র মহাতাপ উদ্দিন, ইপিআর-এ কর্মরত মকবুল শিকদার, কায়জার মােল্লা, মােকাম মােল্লা ও মনসুর মােল্লা এঁদেরকে তারা নড়াইলের রূপগঞ্জ এলাকার পানি উন্নয়ন বোের্ডর অফিসে আটকে রাখে।
এরপর তাদের দিয়ে কবর তৈরি করা হয় পানি উন্নয়ন বাের্ডের অফিসের উত্তর পাশে। নির্মম নির্যাতনে হত্যা করার পর আটজনকে মাটি চাপা দেয়া হয় সেখানে তবে মনসুর মােল্লাকে মাটি দেয়া হয় তার বাড়িতে। শুধু তাই নয়, সলেমানের নির্দেশে নড়াইলের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ নিরীহ মানুষকে ধরে এনে হত্যার পর চিত্রা নদীতে ফেলে দেয়া হতাে। হত্যার আগে। বন্দীদের নাম একটি খাতায় লেখা হতাে। নড়াইল পানি উন্নয়ন বাের্ডের অফিস ছিল। তাদের ক্যাম্প। এখানে নির্যাতন করা হতাে বন্দীদের ওপর। ঘাতক সলেমান এসে প্রতিরাতে ওই খাতায় তােলা নামের পাশে লাল কালি দিয়ে টিক চিহ্ন দিত এবং লিখত ৗণফণট্রণ এমরণশণর, এরপর বন্দীদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করার জন্য জল্লাদদের বুঝিয়ে দিত। জল্লাদরা রাত ২টা থেকে ৩টার মধ্যে চিত্রা নদীর ফেরিঘাটে বন্দীদের নিয়ে গিয়ে। প্রাণদণ্ড কার্যকর করত। জল্লাদরা এসব কাজের জন্য সলেমানের কাছ থেকে মাথাপিছু ১০ টাকা পেত। এই সময় রাজাকার আওয়াল মণ্ডল, মান্নান ও ফুলদহের ইউসুফ খুবই প্রভাবশালী ছিল।
রাজাকার কুদুস একাত্তরের আগস্ট মাসের দিকে তুলারামপুর ব্রিজের কাছে ১৭ ধান। ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দু’ভাই মিলে নড়াইলের মুক্তিযােদ্ধা ও হিন্দুদের বাড়ি লুট করে বহু সম্পত্তির মালিক হয়। অভিযােগ রয়েছে, সলেমান নড়াইলের হিন্দু এলাকা থেকে লুট করে ২ বস্তা টাকা ও ২ বস্তা সােনার গহনা। যুদ্ধের পর সলেমান ও রুহুল অন্যান্য রাজাকারসহ আটক হয়। ১৯৭৩ সালের শেষের। দিকে তারা কারাগার থেকে মুক্তি পায় সাধারণ ক্ষমার আওতায়। এরপর সলেমান ঢাকায় এবং রুহুল যশােরে আত্মগােপন করে। বর্তমানে একটি উগ্রপন্থী মৌলবাদী দলের সাথে সলেমানের রয়েছে সম্পর্ক। কক্সবাজার জেলার উখিয়া সীমান্তের গভীর অরণ্যে ঐ উগ্রপন্থী দলের সদস্যদের সে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়। নড়াইলের কয়েক মুক্তিযােদ্ধার সাথে সলেমানের দেখা হয় ঢাকায় দু’বছর আগে। ওই মুক্তিযােদ্ধারা তাকে সে সময় উত্তম-মধ্যম দিয়েছিল। রুহুল কুদ্স বর্তমানে যশােরে আইন ব্যবসা করে। সে জামায়াতের জেলা পলিটিক্যাল সেক্রেটারি’। যশােরবাসী তার অতীত সম্পর্কে ততটা অবগত নন। সলেমান এবং রুহুলকে নড়াইলবাসী ঘৃণা করেন। এখনও পর্যন্ত তারা কোনদিন নড়াইলের গ্রামে যেতে পারেনি।
জনকণ্ঠ ॥ ১৫-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন