চাঁপাইনবাবগঞ্জ এক দুর্ধর্ষ খুনী ধর্ষক এখন সাবেক সাংসদ পরিচয়ে প্রতারণা করছে!
আহমেদ নুরে আলম ॥ “মুক্তিপণের দাবিতে সন্ত্রাসীরা অপহরণ করেছিল জাতীয় পাটির সাবেক এক সংসদ সদস্যকে। দাবি করেছিল ৩৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ”। ইংরেজী নতুন বছরের প্রথম দিনে এটা ছিল রাজধানীর প্রধান দৈনিকগুলােতে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত একটি খবরের অংশ। কিন্তু ঘটনার তদন্তে জানা গেছে, বিস্ময়কর এক বিপরীত কাহিনী। জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বলে দাবিদার এমএ হান্নান (৫১) নামের এই লােকটি সাবেক সংসদ সদস্য তাে নয়ই সে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরােধী এক দুর্ধর্ষ খুনী ধর্ষক রাজাকার! চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বজনের কাছে ‘চিটার’ বা প্রতারক হান্নান। একাত্তরে সে ছিল গােটা চাপাইনবাবগঞ্জের ত্রাস। সে নিজ হাতে হত্যা করেছে বহু মুক্তিযােদ্ধাকে। গ্রামের পর গ্রামে আগুন লাগিয়েছে। ধর্ষক এই নরপশু বহু নারীকে তুলে দিয়েছে তার প্রভু পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে। তার নামে আতঙ্কিত হতাে শিশুরাও। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এই হান্নান এখন শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের এক কোটিপতিই নয়, মন্ত্রী। এমপিদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে অনাচার-প্রতারণা-দুনীতি অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর মেজর, সংসদ সদস্য, ডাক্তার, শিল্পপতিসহ সে বিভিন্ন ভুয়া পরিচয়ে পরিচিত। অনেক সময় তার বাড়ি রাজশাহী বলে জানিয়ে থাকে। হান্নানের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, আত্মসাত, নারী পাচারসহ বহু অভিযােগ রয়েছে পুলিশের খাতায়। মন্ত্রী এমপিরা তার রক্ষকই নয়, তাঁদের সঙ্গে হান্নানের ঘনিষ্ঠ দহরম-মহরম তদন্তকারী পুলিশের জন্য নিরুৎসাহজনক। পুলিশ তাকে সমীহ করে চলে। কারণ তার জন্য তদ্বির করেন মন্ত্রী-এমপিরা। তার বােন বলে পরিচিত এক মহিলা এই হান্নানের বিভিন্ন অপকর্মের সাথী। গত ১ জানুয়ারিতে জনকণ্ঠসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের পর বিভিন্ন মহলের অভিযােগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে লােকটির স্বাধীনতাবিরােধী কালাে অতীতের পাশাপাশি কুৎসিত চরিত্রও উদ্ঘাটিত হয়।
উল্লেখ্য, খবরটি পাওয়া গিয়েছিল পুলিশের কাছ থেকেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, উচ্চ মহলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এই যুদ্ধাপরাধী নরপশু নিজ স্বার্থ উদ্ধারে বিবেকহীনতার চরম পর্যায়ে যেতেও দ্বিধা করে না। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই হান্নানের আসল বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর থানার ইসলামপুর ইউনিয়নের দশরসিয়া গ্রামে। ছাত্রাবস্থায় সে ছিল জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। ‘৬৯ সালে মওলানা মওদুদী ঢাকায় এলে হান্নান চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কিছু কর্মী নিয়ে আসে। কিন্তু কর্মীদের অর্থ আত্মসাত করলে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে পিতা মৌলভী জিল্লুর রহমানের সাথে হান্নান ও তার কয়েক ভাই পাকিস্তানীদের দালালীর খাতায় নাম লেখায়। শান্তি কমিটির সদস্য তার পিতাও ছিল এক জঘন্য নির্মম স্বভাবের দালাল। এখনও হান্নান পরিবারের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের স্মৃতি এলাকার মানুষ ভুলতে পারেনি। একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিদের পতনের পর মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় জনগণ জিলুর মৌলভীকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। হান্নানের এক ভাইকেও গুলি করা হয়। ধূর্ত হান্নান পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু পরে ধরা পড়ে জেলে যায়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর সে রাজশাহী কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধকালে হান্নান চাপাইনবাবগঞ্জে “পাক গার্ড” নামে পাকিদের একটি দালাল বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার ছিল। এ সময় সে ছিল স্বঘােষিত ‘মেজর’। সে রাজাকার, আলবদর বাহিনীকেও ট্রেনিং দিত। এক মুক্তিযােদ্ধা জানান, মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে হান্নান যে কত মানুষকে হত্যা করেছে তার হিসাব হয়ত সে নিজেও দিতে পারবে না।
কাউকে মুক্তিযােদ্ধা বলা হলে তাকে সে নির্মমভাবে হত্যা করত। লক্ষ্মীপুর, পােড়াগ্রামসহ সাতআটটি গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি সে পাক গার্ড বাহিনী নিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সে ছিল ভয়ঙ্কর নারীমাংসলােভী। জেল থেকে বেরিয়ে ঢাকায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেক কুখ্যাত রাজাকার বনবাসী। মান্নান”-এর সঙ্গে এক হয়ে পাত্রপাত্রীর মধ্যে ঘটকালির একটি অফিস খােলে ফার্ম। গেটে। অনেক নিরীহ নিস্পাপ নারীর সর্বনাশ ঘটায় প্রতিষ্ঠানটি। লােক ঠকানাে ও প্রতারণায় ভরা তার জীবন। ঘটকালি অফিস ছাড়াও সর্বরােগহর একটি দাওয়াই তৈরির কারখানাও তার ছিল। আদম ব্যবসার নামে বহু লােককে ঠকিয়েছে বলে অভিযােগ রয়েছে। সম্প্রতি তাকে অপহরণের ঘটনাকে সাজানাে এবং বিদেশ পাঠানাের নামে পাওনাদারদের শায়েস্তা করার একটা ফন্দী বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি হাজী। পাঠানাের নামে প্রতারণার অভিযােগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ভিশন নামে একটি এনজিও’র নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেকার যুবকদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। মেরে দিয়েছে সে। এ ছাড়া চাকরি দেয়ার নামে অনেক নারীকেও পাচার করেছে বলে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়। জেল থেকে বেরােনাের কিছুদিন পর সে রাজনীতিতে যােগ দেয়। প্রথমে ফ্রীডম। পার্টিতে, তারপর বিএনপি ও শেষে জাতীয় পাটিতে। সে পতিত জেনারেল এরশাদের খুব প্রিয়পাত্র ছিল। তার বিরুদ্ধে উচ্চমহলে নারী-উৎকোচ দেয়ার বহু অভিযােগ রয়েছে। ১৯৯১ সালে হান্নান চাপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে জাতীয় পার্টির মনােনয়ন পায়। নাচোলভােলাহাট-গােমস্তাপুর নির্বাচনী এলাকা নিয়ে গঠিত এ অঞ্চলে কুখ্যাত এই স্বাধীনতাবিরােধীকে জনগণ ঢুকতেই দেয়নি। নির্বাচনী পােস্টার নিয়ে এলাকায় গেলে সাধারণ মানুষের ধাওয়া খেয়ে সে কোনমতে জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসে। এমপি নির্বাচিত হওয়া দূরের কথা ‘৯১-এর নির্বাচনে সে জামানতও হারায়।
কিন্তু হান্নান নিজেকে ঐ আসনের সাবেক এমপি বলে সর্বদা পরিচয় দিয়ে থাকে। গত ৩১ ডিসেম্বর খিলগাঁও পুলিশ তার সম্পর্কে সাংবাদিকদের যে তথ্য দেয় তাতে তাকে সাবেক এমপি বলে পরিচয় দেয়া হয়। উল্লেখ্য, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে ‘৯১ সালে ও ‘৯৬ সালে বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ মনজুর হােসেন নির্বাচিত সদস্য। বর্তমানে সে মৌলবাদী গােপন সন্ত্রাসী একটি সংগঠনের সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলে বলে পুলিশের সন্দেহ। এই সংগঠনের কর্মীরা কবি শামসুর রাহমানের প্রাণনাশের অপচেষ্টা চালিয়েছিল। কিছুদিন সে পলাতকও ছিল। কিন্তু জনৈক মন্ত্রীর মদদে প্রকাশ্যে ফিরে আসে। হান্নানের পৈতৃক বাড়ি ইসলামপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ। নেতা নাসিরুদ্দিন আহমদ জানান, হান্নানকে তিনি সম্প্রতি এক প্রতিমন্ত্রীর বাসভবনে মােবাইল হাতে দেখতে পেয়ে সেখান থেকে বের করে দেন। হান্নান সম্পর্কে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী থেকে যে সব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়, এ পর্যন্ত সে চারটি বিয়ে করেছে। বর্তমানে তার দুটি স্ত্রী রয়েছে। প্রথমা স্ত্রী তার দুটি সন্তান নিয়ে রাজশাহীতে থাকে। বাড়িটি হান্নানের। আরেকটি বাড়ি ছিল তার। ওখানে, যা সে বিক্রি করে দিয়েছে। চাপাইনবাবগঞ্জ শহরেও তার দুটি বাড়ি ছিল। একটি বাড়ি সে বিক্রি করে দিয়েছে। তবে বেচেল পুকুরের দোতলা বাড়িটি ভাড়া দিয়ে রেখেছে। হান্নান দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকে উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরের একটি বাড়ির দোতলায়। ভাড়াটে হিসাবে এই স্ত্রীর ঘরে তার দুই পুত্র রয়েছে। একটি পুত্র ভারতে পড়ালেখা করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সাত আট দিন যাবত হান্নান বা তার স্ত্রী-পুত্র কেউ বাসায় নেই। হান্নান এই বাসায়ও খুব বেশি আসে না। তাকে আদম ব্যবসায়ী বলে।
লােকে জানে উত্তরায় হান্নানের ডিশ কানেকশনের ব্যবসা রয়েছে। অতি চালাকের গলায় দড়ির ঘটনার মতাে হান্নানের অতীত কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়ে গত ৩০ ডিসেম্বর তাকে তথাকথিত অপহরণের ঘটনা থেকে। পুলিশ জানায়, “মৌচাক মার্কেট থেকে সাবেক সংসদ সদস্য এমএ হান্নানকে তিন সশস্ত্র সন্ত্রাসী অপহরণ করে নিয়ে যায়। ঐ সময় তিনি তার বােনের বাসা থেকে উত্তরায় নিজ বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। মারধর করে চুল দাড়ি গোঁফ কেটে সন্ত্রাসীরা ঐদিন রাতে তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে রেখে যায় কমলাপুর স্টেশনে। তারা মােবাইল ফোন, স্বর্ণের চেন আর নগদ ষােলাে হাজার টাকা নিয়ে গেছে… মুক্তিপণের জন্যই তাকে অপহরণ করা। হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।…সন্ত্রাসীরা তার বােন হােসনেআরার কাছে ৩৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল”। প্রশ্ন জাগে , মুক্তিপণের জন্য হান্নানকে অপহরণ করা হলে তাকে ছেড়ে দেয়া হলাে কেন? অপহরণের ঘটনাটা বানােয়াট বলে পুলিশেরই সন্দেহ। কিন্তু প্রভাবশালীদের পক্ষপুটে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সত্য কথাটি বলার সাহস পুলিশের নেই। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হােসনেআরা বলে তার কোন বােন নেই। তার তিন বােনের মধ্যে দু’জন গ্রামে থাকে ও এক জন চাপাই নবাবগঞ্জ শহরে থাকে। তাহলে। এই হােসনেআরা কে?
জনকণ্ঠ ॥ ৩১-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন