You dont have javascript enabled! Please enable it!

হবিগঞ্জ

অসংখ্য খুন ধর্ষণ ও লুটের হােতা হবিগঞ্জের কায়সার এখন শিল্পপতি ও রাজনৈতিক নেতা

রফিকুল হাসান তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে ॥ হবিগঞ্জের নােয়াপাড়ার সেই রাজাকার কমান্ডার ও স্বাধীনতা পরবর্তী একটি শিল্প গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি, এরশাদ সরকারের কৃষি প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপি নেতা সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সার ও তার বাহিনীর হাতে একাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন ও লুটপাটের কাহিনী দেশের। নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা হলেও মাধবপুরবাসী আজও তা ভুলতে পারেনি। শিল্পপতি কায়সার তার সকল অপকর্মকে মুছে ফেলতে এখন জনদরদী ও সমাজসেবক হয়ে উঠেছে। এমনকি বিভিন্ন জাতীয় ও সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিকদের করায়ত্ত করার চেষ্টা চালানােসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলােকে অর্থ দিয়ে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কায়সার বাহিনীর অপকর্মের কাহিনী জনকণ্ঠের কাছে বর্ণনা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, কায়সারের বিরুদ্ধে সেই অপকর্মের ঘটনা নিয়ে কেউ আলােচনা বা সমালােচনা করতে চাইলে তার বাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়। এ কারণে কেউ মুখ খােলার সাহস পায় না। মাধবপুর উপজেলার নােয়াপাড়া নিবাসী সৈয়দ সঈদ উদ্দিনের বড় ছেলে সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সার ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকি বাহিনী নিয়ে জগদীশপুর ও আন্দিউড়া হাইস্কুলে নির্যাতন ক্যাম্প গড়ে তােলে। তখন কুলাউড়া নিবাসী ক্যাপ্টেন সুজাত আলীর ছেলে মেজর মানিক ঐ বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে ক্যাম্প তদারকি। করত ।

যুদ্ধের সময় ঐ সব ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতগামী হিন্দু পুরুষ-মহিলাদের কায়সার বাহিনী’ ধরে নিয়ে এদের হাতে তুলে দিত। ওদেরকে পরবর্তীতে নির্যাতন, ধর্ষণ ও গুলি করে হত্যা করা হতাে। জানা গেছে, এজন্য পাকি বাহিনীর পক্ষ থেকে তখন সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারকে পুরস্কার হিসাবে ১টি পিস্তল উপহার দেয়া হয়। রাজাকার-আলবদরদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই কায়সার বাহিনী’ই উক্ত উপজেলার আন্দিউরা, মারিয়ারা ও বেজোড়া গ্রামের স্বাধীনতাকামী অসংখ্য লােকজনের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং নারী নির্যাতন ও লুটপাট চালায়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের অপরাধে সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারের নির্দেশে ছাত্র হত্যার মতাে নৃশংস ঘটনাও সংঘটিত হয়। এমনি একটি আলােচিত ঘটনা হচ্ছে, এই উপজেলার শাহাপুর গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের (২য় বর্ষ) ছাত্র নাজিমউদ্দিন (১৯) হত্যা। সে ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করত। স্বাধীনতা যুদ্ধ। শুরু হলে নাজিমউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চলে যায়। সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা শফিক চৌধুরীর হাত ধরে নাজিম বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং রঘুনন্দন পাহাড়ে আশ্রয় নেয়।

পরে তৎকালীন পঞ্চবটিতে ক্যাপ্টেন (সাবেক সেনাপ্রধান) মােঃ নাসিম ও তার অধীনস্থ কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাজী কবির উদ্দিনের অধীনে নাজিম মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। শাহজীবাজার বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের অভ্যন্তরের পাকি সেনা ও রাজাকারদের আস্তানা উড়ানাের জন্য নাজিম ও তার সাথী ফারুককে পাঠানাে হলে ক্ষুধার্ত নাজিম ভাত খাওয়ার জন্য বাড়ি যায়। এ খবর। পেয়ে কায়সার বাহিনী নাজিমকে ধরে শাহজীবাজার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে একটানা ২১ দিন অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে নাজিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া মাধবপুর উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের মৃত সুরুজ আলী পাঠানের ছেলে। হাবিলদার (অব) অহিদ হােসেন পাঠান (৫৫) ও ঘিলাতলী গ্রামের মৃত আবদুল মতিনের ছেলে পুলিশ (অব) দেওয়ান সফু মিয়া (৬০), মৌজপুর গ্রামের মৃত সরউদ্দিনের ছেলে। সরকারী কর্মচারী আক্কাছ আলী (৫৫) ও তেলিয়াপাড়ার মৃত জগন সরদারের ছেলে সুরমা চা বাগানের চা শ্রমিক মনিলাল ঘাটুয়াল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখিতারা গ্রামের শেখ আবুল খায়েরের ছেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের (২য় বর্ষ) ছাত্র ফারুক মিয়া (২২)সহ বহু নাম না জানা লােক ও মুক্তিযােদ্ধা এই রাজাকারদের সহযােগিতায় পাক সেনাদের হাতে নিহত হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ও তৎকালীন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার, বর্তমানে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর এ্যাডভােকেট মােহাম্মদ আলী পাঠান বলেন, কায়সার বাহিনী ‘৭১ সালের ২৭ এপ্রিল মাধবপুর বাজারের বাড়িঘরে লুটপাট করার পর অগ্নিসংযােগ করে। এ ব্যাপারে তৎকালীন ওসি জয়নাল আবেদিন বাদী হয়ে কায়সারসহ তার বাহিনীর বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ ও লুটপাটের অভিযােগে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারসহ তার মামা মঞ্জু মিয়া (গুনিয়াউক), ইউপি চেয়ারম্যান মতিমিয়া চৌধুরী ও লাল খান (মেম্বার) রাজাকারের বিরুদ্ধে তখন বহু মামলা-মােকদ্দমা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে কায়সার তেলিয়াপাড়া, সুরমা চা বাগান, জগদীশপুর, ঐকন্তপুর ও নােয়াপাড়া চা বাগানের চা উৎপাদনে ব্যবহৃত মেশিন ও যন্ত্রপাতি লুট করে ঢাকায় বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে লন্ডনে চলে যায়। মাধবপুর উপজেলার মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডার বিএনপি নেতা ইউপি চেয়ারম্যান শফিক চৌধুরী অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে একমত পােষণ করে বলেন যে, রাজাকার-আলবদরদের সমন্বয়ে গঠিত কায়সার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাধবপুরের সর্বত্র হত্যা, নির্যাতন ও লুটপাট চালায়। মুক্তিযােদ্ধা ইয়াকুব আলী বলেন, সৈয়দ মােহাম্মদ কায়সারের নেতৃত্বে গঠিত কায়সার বাহিনী আমার বাড়িঘরে ঢুকে লুটপাট করে এবং আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া এলাকার বহু বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন (অব) কাজী কবির উদ্দিন বলেন, রাজাকার কায়সার ও তার বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডবের আমি একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুটপাটের অজস্র ঘটনার কথা হৃদয়ে আজও নাড়া দেয়। কায়সার বাহিনীর এসব অপকর্মের ঘটনা লিখে শেষ করা যাবে না। অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন ও লুটপাট করে কায়সার এখন ধন-সম্পদের মালিক হয়ে সমাজসেবক সেজেছে।

সরকারের উচিত, তার এই ধন-সম্পদ গড়ে তােলার পিছনের ইতিহাস তলিয়ে দেখা। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন হলে ‘৭৮-এ কায়সার লন্ডন থেকে। দেশে ফিরে আসে। পরবর্তীতে ‘৭৯-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী লেঃ কর্নেল (অব) কাজী কবির উদ্দিন ও আওয়ামী লীগ প্রার্থী মৌলানা আসাদ আলীর | বিরুদ্ধে কায়সার মাধবপুর-চুনারুঘাট আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এরপর এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হয়ে আরও প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়। শুধু তাই নয়, মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ব্যাংক থেকে কোটি | কোটি টাকা লােন নিয়ে একটি টেক্সটাইল মিল গড়ে তােলে। এভাবে সায়হাম নগরীর আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এলাকাবাসী জানায়, সায়হাম নগরীর নামকরণের মধ্য দিয়ে কায়সার চেয়েছিল নােয়াপাড়া নামটি চিরতরে মুছে দিয়ে তার সেই অপকর্মকে লােকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যেতে। কিন্তু এখনও নােয়াপাড়া নামটি টিকে রয়েছে। মুক্তিযােদ্ধা নাজিম হত্যার কারণে তার বিরুদ্ধে ‘৭১-এর পর পরই দায়েরকৃত একটি মামলা আজও হিমাগারে পড়ে রয়েছে।

জনকণ্ঠ ॥ ০২-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!