You dont have javascript enabled! Please enable it!

আদমদীঘির সব হত্যা লুণ্ঠন অগ্নিসংযােগের হােতা মজিদ তালুকদার তিন বার এমপি

মােঃ হারেজুজ্জামান, সান্তাহার থেকে ॥ বগুড়ার পশ্চিমাংশে সান্তাহার আদমদীঘিদুপচাচিয়া এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে হানাদার পাকি বাহিনীর দোসর এক রাজাকার এখন জনপ্রতিনিধি। বিএনপিতে যােগদান করার পর তিনবার সে নির্বাচিত হয়েছে সংসদ সদস্য। অথচ এই রাজাকারের নৃশংসতার কথা আজও ভুলে যায়নি ওই এলাকার মানুষ। তার নাম আব্দুল মজিদ তালুকদার। ‘৭১ সালে সে ছিল কথিত পিস কমিটির চেয়ারম্যান। পাকি সেনারা সান্তাহারে প্রবেশের পর তাদের সহায়তা করার অপরাধে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদারের বিরুদ্ধে দায়ের হয় দালাল আইনে মামলা। বিএনপি শাসনামলে দালাল আইনে দায়ের করা মামলার নথিপত্র সে উধাও করে দেয়। এই রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদার তার অপকীর্তিগুলাে এতটাই কৌশলে করত যে এলাকার মানুষ প্রথম দিকে বুঝতেই পারত না এই মজিদ তালুকদারই নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ছে। পরে অবশ্য সব কিছুই ফাস হয়ে যায়। “৭১ সালের ২২ এপ্রিল রেলপথে হানাদার পাকি সেনারা আগ্নেয়াস্ত্রের ভাণ্ডার নিয়ে আসে আদমদীঘি থানার সান্তাহারে। এর পর পাকি সেনাদের দোসর আব্দুল মজিদ তালুকদার হয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান। এর পর এক সাথে ২১০ বাঙালীকে ধরে ব্রাশফায়ারে হত্যা করার পর শুরু করে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ। স্থানীয়দের মধ্যে হত্যা করা হয় শহরের মালশন গ্রামের শহীদ মুক্তিযােদ্ধা আজিজার রহমানের পিতা উমিশাহ ও আবুল হােসেন মােল্লাকে। এর পর তিয়রপাড়ার ডাঃ শাহাদত মল্লিক, বাদেশ মুন্সি, নিজাম উদ্দিন, হযরত আলীসহ ৯ জনকে পরিবার-পরিজনের সামনে গুলি করে হত্যা করে।

সপরিবারে হত্যা করে শহরের রথবাড়ীস্থ জমিদার সুরেন্দ্র নাথ এবং বাজার এলাকার লতিফ সওদাগরকে। হত্যা করা হয় একই এলাকার মােহাম্মদ পাগলা, নূর চৌধুরী, শফি। খলিফা, অর্জুন ধােপাসহ স্বাধীনতাকামী বহু বাঙালীকে। জংশন শহরটাকে ধ্বংসস্তুপে।  পরিণত করার পর পাকি সেনাদের নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পিস কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ তালুকদার ছিল অতি । ধূর্ত। মুক্তিযােদ্ধাসহ শত শত স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে সকল ধ্বংসযজ্ঞের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী হয়েও সে রয়ে যায় অন্তরালে। সেই ধূর্ততা হলাে পাকি সেনাদের বিফ্রিং দিয়ে, টার্গেটপূর্ণ করা। গ্রাম, বাড়ি ও রাস্তা চেনে এমন বাঙালী রাজাকারকে সেনাদের সাথে দিয়ে সে বাইসাইকেল  অথবা মােটর সাইকেলযােগে ঘটনাস্থলে পৌছত ঘটনার কিছু পূর্বে অথবা পরে।  রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদারের নৃশংসতার বর্ণনা দেন এলাকার কোমারপুর গ্রামের ৮০ বছর বয়সী হাজী ফজর আলী আখন্দ, যার মুক্তিযােদ্ধা ছেলে আব্দুল জলিলকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। আব্দুল জলিল ও তার সঙ্গী মুক্তিযােদ্ধা আলতাফকে ধরে নিয়ে যায় রাজাকাররা। থানায় নিয়ে খেজুর কাটা দিয়ে অত্যাচার চালানাে হয়। এ খবর পেয়ে ফজর আলী ছুটে যান কথিত পিস কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ তালুকদারের কাছে। গিয়ে কোন লাভই হয় না। ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক ফজর আলী স্থানীয় পুরনাে বাের্ড অফিসের মাঠে গিয়ে দেখেন তার ছেলে আব্দুল জলিলসহ ৪ মুক্তিযােদ্ধাকে কোমরে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে মাঠে আর আব্দুল মজিদ তালুকদার হানাদার পাকি সেনাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল।

তার ছেলেসহ ৪ মুক্তিযােদ্ধাকে মেরে ফেলা হবে বুঝতে পেরে তার ২০ বিঘা জমি লিখে দিতে চেয়ে হাতে-পায়ে ধরেন মজিদ তালুকদারের। কোন লাভ হয় না। উল্টো বলা হয়, একটু পর  তাের ছেলের লাশ নিয়ে যা।’ হাজী ফজর আলী পাকি সেনা এক মেজরের কাছে গিয়ে  আকুতি জানায়। মেজর আধাে বাংলায় বলে, ‘বাঙালী মারতে বাঙালী নেতা (মজিদ তালুকদার) হুকুম দিয়েছে। শেষ পরিণতি বাবা হাজী ফজর আলীর কাধে ছেলের লাশ। ঐ দিন আরও যে ৩ মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করা হয়, তাদের পরিচয় কাঞ্চনপুর গ্রামের  মনসুরুল হক, আব্দুস সাত্তার ও আলতাফ হােসেন।  যুদ্ধ চলাকালে আব্দুল মজিদ তালুকদার নিজে প্রথম প্রকাশ্য অভিযান চালায় ছাতিনগ্রাম হাটখােলায় (ইউপি কার্যালয় প্রাঙ্গণ)। সে মস্তিষ্ক বিকৃত চান মােহাম্মদকে ধরে গাছে বেঁধে হত্যার প্রস্তুতি নিলে এলাকাবাসীর প্রতিরােধে তা ব্যর্থ হয়। পরে সেই পাগল চান মােহাম্মদকে হত্যা করা হয় অন্যদের সাথে । ১৪ আগস্ট, ‘৭১ আব্দুল মজিদ তালুকদার পাকি সেনাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাতিনগ্রামের কলােনিতে। অনেকের সাথে হত্যা করা হয় কলােনির মকবুলের স্ত্রী রূপবানু ও পুত্র মঞ্জুরুল হককে। স্ত্রী ও পুত্র হত্যার | অভিযােগে মকবুল ২৭ আগস্ট ‘৭১ আদমদীঘি থানায় মামলা করেছিলেন। আর এই মামলাটি ছিল যুদ্ধকালীন পাকি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে প্রথম। মামলা। তৎকালীন ওসি হাবিবুর রহমান অপারগতা প্রকাশ করেও মামলা গ্রহণ করতে  বাধ্য হয় বগুড়ার ডিসি এবং এসডিও’র অনুমােদন (২৩ আগস্ট) থাকার কারণে যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিযােদ্ধারা ছাতিনগ্রামের অদূরে রেললাইন তুলে ফেলে।

এ ঘটনায় আঃ মজিদ গং পাকিদের নির্দেশ দেয় ওই স্থানের চারপাশের ৪ মাইল এলাকা ঝাঝরা করে দেয়ার। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। যারা ঘরে  ছিল তাদের ২৩ জনকে রাজাকাররা ট্রেনে করে সান্তাহার এনে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। যুদ্ধ চলাকালে রাজাকারদের রােষানলে পড়ে সান্তাহার শহরের মালশন, তারাপুর, পাথরকুঠা, কাজীপুর, সান্দিড়া, দমদমা, তিয়রপাড়া, পৌতা ও বশিপুর গ্রাম। তারা পাকি সেনাদের নিয়ে কয়েক দফা হামলা চালিয়ে লুট এবং অগ্নিসংযােগের পর হত্যা করে ২ শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে শুধু সান্দিড়া গ্রামেই হত্যা করা হয় ৯০ জনকে। কোমারপুর গ্রামে গিয়ে জানা যায়, আঃ মজিদ পাকি সেনাদের নিয়ে ওই গ্রামের। মুক্তিযোেদ্ধা মহাতাব আলীকে ধরতে গিয়ে না পেয়ে ঘড়বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং বড় ভাই। আইনুলকে ধরে নিয়ে যায়। আজও তার লাশের সন্ধান মেলেনি। একইদিন ওই গ্রামে ধরা পড়ে থানার পশ্চিম সিংড়া গ্রামের সেনা সদস্য মােঃ অফির উদ্দিন। তালুকদারের নির্দেশে পাকিরা তাকেও হত্যা করে। এ রকমভাবে নাম পরিচয় না জানা বহু নিরপরাধী মানুষকে হত্যা করিয়ে নিয়েছে রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদার। বিজয় অর্জনের মাত্র ৬ দিন আগে ধূর্ত আব্দুল মজিদ তালুকদার সমস্ত দামী আসবাবপত্র পাড়া-প্রতিবেশীদের বাড়িতে রেখে ১০ ডিসেম্বর বিকালে সপরিবারে পালিয়ে যায় । কিন্তু পলাতক অবস্থায় রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদারের বিরুদ্ধে সরকার দালাল। আইনে মামলা করে। তাদের বিরুদ্ধে আরও মামলা হয় ছাতিনগ্রামে অগ্নিসংযােগ, সান্তাহারস্থ বিএডিসির সার গুদাম লুট, হেমন্ত বসাক ও পুত্র সােমন্ত বসাক, মুক্তিযােদ্ধা জলিল, আলতাফ, টুলু, ছাত্তারসহ বহু খুন ও লুণ্ঠনের। সাধারণ ক্ষমা লাভসহ সকল মামলা থেকে সে খালাস পেয়ে যায় বেয়াই আর চাচা শ্বশুরের বদৌলতে।

স্বাধীনতার ২৯ বছরের মাথায় দৈনিক জনকণ্ঠের যুগান্তকারী পদক্ষেপ ‘সেই রাজাকার’ শিরােনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপানাে শুরু হলে গত ১৫ দিন ধরে এই জনপদের গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধার সাথে কথা বলে তথ্য সংগ্রহের সময় মুক্তিযুদ্ধকালীন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, শহীদদের পিতা-পুত্র-স্ত্রী, ভাই-বােন, ছেলেমেয়েরা জনকণ্ঠকে বলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর যারা মামলা করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছিল, কিছু দিন পর তারাই রাতের আঁধারে নিজে এবং অস্ত্রধারী লােক পাঠিয়ে আপােস করা ও মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে চাপ প্রয়ােগ করে। ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি’র পর সেনাবাহিনী আব্দুল মজিদ তালুকদারকে ‘৭১ সালে পাকিদের থেকে উপহার পাওয়া অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রসমূহ উদ্ধার করার জন্য আটক করে। থানা সদরে সেনা ক্যাম্পে তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে তার বড় ভাই রহিম উদ্দিন মাস্টার পাশের গায়ে। ছুটিতে আসা সেনা কর্মকর্তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। ফলে এ দফাও মাফ পেয়ে যায়। রাজাকার আব্দুল মজিদ তালুকদার হয়ে যায় এলাকার সকল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। জিয়াউর রহমানের বিএনপির টিকিটে ‘৭৯ তে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়। এর পর ‘৯১ ও ‘৯৬ তেও এমপি নির্বাচিত হয়।

জনকণ্ঠ ॥ ০১-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!