রামপালের ডাকরা বধ্যভূমি শেখ আব্দুস সালামের নৃশংসতার সাক্ষী
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তরে সে ছিল খুবই দুর্ধর্ষ। বয়সে কম হলেও নৃশংসতার অন্য অনেককে সে ছাড়িয়ে যায় । বহু হত্যা, লুণ্ঠনের সঙ্গে সে জড়িত ছিল। আজও সে সমান দুর্ধর্ষ বহু অপকর্মের নায়ক। তার নাম শুনলে ভয়ে সবাই আঁতকে ওঠে। কেউ নিজের পরিচয় প্রকাশ করে কিছুই বলতে চায় না। একাত্তরে সে ছিল রাজাকার। বর্তমানে সে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় অবস্থান করছে। অথচ স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরােধী এই ব্যক্তিটি ১৯৮৬ সালে জাতীয় পতাকায় গুলিবর্ষণ। করে। পুলিশ এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এই দুর্ধর্ষ রাজাকারের নাম শেখ আব্দুস সালাম। বাড়ি বাগেরহাট জেলার রামপাল। উপজেলাধীন বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। বর্তমানে থাকে মংলায়। একাত্তরে বহু অপকর্ম, হত্যা, লুণ্ঠনের হােতা হিসাবে নিজে পরিচিতি পাওয়ায় দেশ স্বাধীনের সঙ্গে সঙ্গে সে আত্মগোপন করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সে লুকিয়ে ছিল। ১৯৭৫ সালের পর সে আবার। আবির্ভূত হয়। তবে নিজ গ্রামে নয়। ঘাটি গড়ে তােলে মংলায় । আজ সে মংলার বিশাল এক ক্ষমতাধর মানুষ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে অন্যান্য এলাকার মতাে বাগেরহাটেও শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির নেতৃস্থানীয় সদস্যদের মধ্যে ছিল তার পিতা আফসারউদ্দিন; সে রামপাল থানা ‘পিস’ কমিটির সভাপতি ছিল।
পিতার অনুপ্রেরণায় ও উৎসাহে ভাই শেখ কামাল ও সে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দেয়। বয়সে কম এই সাহসী রাজাকার অল্পদিনেই রাজাকার নেতাদের প্রিয়পাত্র হয় এবং মুক্তিকামী মানুষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে দেখা দেয়। তার নৃশংসতার অন্যতম সাক্ষী রামপালের ডাকরা বধ্যভূমি। ডাকরা একটি গ্রামের নাম। এখানে একটি মন্দির আছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রায় সাত শ’র মতাে নরনারী এখানে সমবেত হয়েছিল। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময় । রাজাকার-আলবদরদের ছােবল থেকে মুক্তি পেতে তারা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। এ কারণে মন্দির প্রাঙ্গণে ডাকরাসহ আশপাশের কালিগঞ্জ, কাশিপুর, বেতকাশী, ফতেপুর। প্রভৃতি গ্রাম থেকে এরা এসে জড়াে হয় প্রার্থনার উদ্দেশ্যে। খবর পেয়েছিল রাজাকাররাও। কমান্ডার রজব আলীর নেতৃত্বে ২৩ জন রাজাকার লঞ্চযােগে ডাকরা এসে পৌছায়। এই দলে দুধর্ষ রাজাকার শেখ আব্দুস সালামও ছিল। রাজাকার দলটি সেদিন সমবেত জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এক জন মানুষও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। রাজাকার সালাম সেদিন উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মানুষকে হত্যা করে। যা সেখানকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ভয়ে-আতঙ্কে তাদের গা আজও শিউরে ওঠে। কারণ রাজাকার সালাম রামপালে না থাকলেও নিকটবর্তী মংলায় থাকে। তার চাচাত ভাইয়েরা রামপালেই থাকে। তারা আওয়ামী লীগের নেতা। মংলায় ডেরা বাঁধবার পর ধীরে ধীরে রাজাকার সালাম তার খােলস ছেড়ে বের হয়ে আসে। ১৯৮৬ সালে সে ছিল এরশাদের দল জাতীয় পার্টির অঙ্গসংগঠন জাতীয় যুব সংহতির মংলা থানা সভাপতি। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সে মংলা শ্রমিক সংঘের কার্যালয়ের সামনে উড়তে থাকা জাতীয় পতাকায় গুলি করে ছিন্নভিন্ন করে দেয় । জনতার ওপরও সে গুলি চালায়। তার অত্যাচারের চিহ্ন নিয়ে আজও এক নরসুন্দর বেচে আছে। ১৯৮৮ সালের পৌর নির্বাচনে নিজের ভাই শেখ আব্দুল হাইকে জয়ী করানাের জন্য নিজ কর্মচারী মনাকে গুলি করে হত্যা করে বলে ব্যাপকভাবে প্রচারিত।
১৯৯০-এর এরশাদবিরােধী গণআন্দোলনের সময় স্কুপের ধর্মঘট চলাকালে মিছিলের ওপর সে গুলি ছােড়ে। বিগত বিএনপি আমলে সে দ্রুত তার অবস্থান পরিবর্তন করে মংলা থানা যুবদলের সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে সে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা গাজী আবু বকরের পক্ষে ভােট প্রার্থনা করে। বর্তমানে সে আওয়ামী লীগার। মংলা শহরের নিকটবর্তী কাইনমারী গ্রামের অন্যের জমি দখল করে সে চিংড়ি চাষ করছে বলে অভিযােগ রয়েছে। উপরন্তু সে স্টিভেডরিংয়ের ব্যবসায় যুক্ত । খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যতম প্রধান সংগঠক, বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, মুসলিম লীগার আফসারউদ্দিন ছিল রাজাকারদের অন্যতম প্রধান সংগঠক। তার ছেলে রাজাকার সালামের দুর্ধর্ষতার কাহিনী এবং ডাকরার গণহত্যার কথা তিনি শুনেছেন। যেহেতু তারা সবসময় ক্ষমতাসীনদের। পৃষ্ঠপােষকতা পায়; এ কারণে কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না।
জনকণ্ঠ ০৭-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন