You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাগেরহাটের সিরাজ মাস্টার কুড়াল দিয়ে দিনে ১০ মুক্তিযােদ্ধা হত্যা করত

গৌরাঙ্গ নন্দী, খুলনা অফিস ॥ পাকিস্তান রক্ষা করার নামে সে মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের নির্মমভাবে কুড়াল দিয়ে হত্যা করত। জনশ্রুতি রয়েছে, সে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ জনকে এভাবে হত্যা করত। স্বাধীনতা-উত্তরকালে এই কুখ্যাত রাজাকারকে সাধারণ মানুষ হাতের নাগালে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু পায়নি। পেলে সম্ভবত গণরােষে তার মৃত্যু ঘটত। এ কারণে খাচায় বন্দী করে এই দুর্ধর্ষ রাজাকারকে প্রদর্শন করা হয়েছে মানুষের সামনে। কিন্তু আজও সে বহাল তবিয়তে আছে। জমিজমা, চিংড়ি ঘের প্রভৃতি দেখাশােনা করে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এই ঘাতক সিরাজ মাস্টার নিজ গ্রামে না থাকলেও বাগেরহাট শহরের অদূরেই বসত গেড়েছে। বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার রজব আলীর দু’জন বিশ্বস্ত ঘাতক রাজাকার ছিল। এদের একজন হচ্ছে এই সিরাজ মাস্টার। অন্যজন আফিজউদ্দিন। এদের দু’জনের নামেই হত্যাকাণ্ড ঘটানাে সম্পর্কে নানা গল্প চালু আছে। এক পর্যায়ে এরা নাকি মুক্তিযােদ্ধাদের না হত্যা করে নাস্তা করত না। কুড়ালের কোপে গলার নলি কেটে সিরাজ মাস্টার পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠত। মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের আর্তনাদ, বাঁচার আকুতি তার পৈশাচিক উল্লাসভরা হাসিতে চাপা পড়ে যেত। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ তার কাছে ছিল খুবই মামুলি বিষয়। একাত্তরে সিরাজ মাস্টার খুলনা শহরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চলে যায় নিজ গ্রাম বাগেরহাটের গােটাপাড়ায়। কয়েক দিন পরেই সে যােগ দেয় রজব। আলীর বাহিনীতে। বাগেরহাট তখন ছিল মহকুমা। মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত তথাকথিত শান্তিবাহিনীর মহকুমা কমিটির অন্যতম নেতা ছিল এই রাজাকার রজব আলী। নৃশংস ও পাশবিকতায় অচিরেই সিরাজ মাস্টার তার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করতে সে হয়ে ওঠে বিশেষ পারঙ্গম। একবার নাকি পাকি সেনাদের সঙ্গে তার বিশেষ সমঝােতা হয়।

সে পাকি হানাদারদের নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ জন মুক্তিকে জবাই করবে। এ কারণে সে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতাে হন্যে হয়ে ওঠে। ধরতে থাকে মুক্তিসেনা, না পেলে নির্বিরােধী সাধারণ মানুষও তার প্রতিহিংসার কবল থেকে রেহাই পেত না। এ কারণে সে হয়ে ওঠে মূর্তিমান আতঙ্ক। বাগেরহাটের বীর মুক্তিযােদ্ধা মােঃ আসাদুল হক আসাদ এই দুর্ধর্ষ রাজাকারের কথা। উঠতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি বলেন, এই রাজাকার কান্দাপাড়া এলাকায় একদিনে ১৯ ব্যক্তিকে জবাই করে। সবাইকে সে মেরেছিল কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে সেই আক্রমণ থেকে একজন বেঁচে যায়। এর পর মুক্তিযােদ্ধারা সিরাজ রাজাকারের বাড়িঘর তছনছ করে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে এই খুনী রাজাকার সিরাজ মাস্টারের বিচার না হলেও সে তার নিজ গ্রামে আজও যেতে পারে না। থাকে ডেমা এলাকায়। মুক্তিযােদ্ধা আসাদ তাঁর স্মৃতি হাতড়ে ধরা গলায় বলেন, গােটা পাড়াগ্রামটি বাগেরহাট শহরঘেঁষা নদীটির ওপারে। এর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে হচ্ছে বিষ্ণুপুর, কান্দাপাড়া, দেপাড়া প্রভৃতি। এই গ্রামগুলােয় মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি গড়ে ওঠে। আর রাজাকারদের ঘাটি ছিল বাগেরহাট শহরে। বিষ্ণুপুর এলাকার দুই মুক্তিযােদ্ধা পদ এবং গােবিন্দ এসেছিলেন শহর এলাকায়। নিত্যপ্রয়ােজনীয় কিছু সামগ্রী সংগ্রহ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু রাজাকার সিরাজ মাস্টারের শকুনিদৃষ্টি তারা এড়িয়ে যেতে পারেনি। এলাকার ছেলে হওয়ায় সিরাজ রাজাকার খুব সহজেই তাদের চিনে ফেলে এবং ধরে। নিয়ে যায়। তাদেরকে দীঘিরপাড়ে নিয়ে গিয়ে এই রাজাকার ‘কাঠচেরাই করার মতাে করে তাদের হত্যা করে বলে তিনি শুনেছেন।

জনকণ্ঠ। ২৬-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!