You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

জেনারেল জিয়ার রাজত্ব
অধ্যাপক আবু সাঈদ

প্রথম অধ্যায়

জিয়াউর রহমান ও মেজর রিট্রিট

জিয়ার কথা ১. কোলকাতার হেয়ার স্কুলে জিয়াউর রহমানের ছাত্র জীবন শুরু। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভাগের সুবাদে চাকুরীজীবী পিতা মনসুর রহমান সপরিবারে পূর্ব বাংলায় ‘অপশন’ না দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী চলে যান। জিয়ার বয়স তখন মাত্র বারাে বছর। পূর্ব বাংলায় যখন ভাষা আন্দোলন একটি বিশেষ পর্যায় অতিক্রম করছে, ‘৫২ সনের ২১শে ফেব্রুয়ারী সালাম বরকত রফিক জব্বার ভাষার লড়াইয়ে যখন বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, সারা বাংলায় ভাষার লড়াই যখন গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত, তখন উঠন্ত কিশাের জিয়াউর রহমানকে এর কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি। শ্যামলঘন বাংলাদেশের আবহাওয়া পরিবেশের বাইরে উষর রুক্ষ ধূসর করাচীর একাডেমী স্কুলে আবশ্যিক ভাষা উর্দু রপ্ত করার চেষ্টায় রত জিয়াউর রহমানের পক্ষে ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মর্মবাণী ধারণ করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিলােনা। ১৯৫২ সনে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ডি,জে, কলেজে। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে একজন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে তিনি বিশেষ কমান্ডাে ট্রেনিং লাভ করেন। ঐ কলেজে ও একাডেমীতে পরিবেশগত পরিমন্ডল এমনই ছিলাে যে, “খাটি পাকিস্তানী’ না হলে ঐ কলেজে ঢােকা একজন বাঙালীর পক্ষে সম্ভব ছিলাে না। জিয়াউর রহমানের সুবিধা ছিলাে এই যে, তাকে কখনাে বাংলা বলতে হয়নি এবং বাঙালী বলে পরিচয় দেওয়াকে তার একেবারেই ছিলাে অপছন্দ। এই অপছন্দের দিকটিই তার চাকুরীর ক্ষেত্রে পদোন্নতির বিশ্বস্ত মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। একজন ‘খাটি পাকিস্তানী” হিসেবে তার গায়ে ‘বাঙালী’ বা ‘প্রাদেশিকতার গন্ধ’ না থাকায় পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের পছন্দের লােক হতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। অনেকেই তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে উর্দু বাচন ভঙ্গীর যে আমেজ লক্ষ্য করেন, তাদের হয়ত অজানা যে, জিয়াউর রহমান যে স্কুলে বা কলেজে অধ্যয়ন করেছেন, সে সব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা তার পাঠক্রমে অন্তর্ভূক্ত ছিলােনা। কিশাের জীবনের মানস গঠনের প্রাক্কালে পিতার চাকুরীসূত্রে বাঙালী সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন, আত্মীয় পরিজন হতে ছিটকে পড়া এবং বাংলাদেশের নিসর্গ চেতনার বিপরীতে একটি ভিন্ন পরিবেশ

ও পরিস্থিতির মধ্যে জিয়াউর রহমানের শৈশব জীবন শুরু। করাচী একাডেমী স্কুলে ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন আচরণগত দিকের সঙ্গে খাপ খাইতে গিয়ে এবং তাদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলার প্রতিযােগিতায় জিয়ার কিশাের জীবনে বাঙালীত্বের মানস গড়নে গড়ে ওঠেনি। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠছে এবং আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে – সেই সময়ে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী  অঞ্চলে ছহি উর্দু শিক্ষার অনুশীলন করতে হয়েছে এবং রপ্ত করতে হয়েছে ছহি উর্দু জবান। অর্থাৎ বাঙালি হয়েও বাংলা ভাষার পাঠ তার পক্ষে গ্রহণ সম্ভব হয়নি, বাঙালির মানস চেতনার মর্মবাণী উপলদ্ধি হতে দূরে থাকতে হয়েছে। করাচী একাডেমী স্কুলের পরিমন্ডলে বাঙালী সংস্কৃতি সম্পর্কে নেতিবাচক ব্যতীত ইতিবাচক ধারণা পাওয়া সম্ভব ছিলাে না। সেই অবস্থায় জিয়াউর রহমান পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানান সই করতে গিয়ে বেশী করে বাঙালিদের এড়িয়ে চলেছে, বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবন চর্চার বাইরে তাকে দূরে থাকতে হয়েছে । অদৃশ্য ভিলেনের সুবিধাবাদী ভূমিকাই বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তার ভাগ্য উন্নয়নের পশ্চাতে কাজ করেছে। সুযােগ বুঝে নিজের জুৎসই অবস্থান নিতে তার ভুল হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষের গৌরবময় আত্মত্যাগ এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্টিত হওয়া এক বিস্ময়কর ঘটনা ! আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, জিয়াউর রহমানের উথান আকস্মিক ঘটনাসমূহের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি। মনে হতে পারে, নীরব দর্শক, ক্ষমতার পরিমন্ডল হতে দূরে থাকা নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক জিয়াউর রহমানকে আকস্মিক ঘটনার ঘনঘটা ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে টেনে এনেছে, এতে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নেই, যতটা না আছে ঘটনাসমূহের সক্রিয়তা। এক কথায় বিষয়টি এরূপ নয়। জিয়াউর রহমানের জীবনাচারণ, তার কর্মপদ্ধতি, পেশাগত প্রশিক্ষণ আচরণগত দিক বিশ্লেষণ করলে এবং ভিন্ন ভিন্ন বিভক্ত ঘটনাসমূহের যােগফল ধারণাকৃত কথার সত্যতা প্রমাণ করেনা। বরং গভীর পর্যবেক্ষণে ঘটনার পরম্পরার মধ্যে তার বিশেষ ভূমিকা-যা সূক্ষ, অথচ কার্যকর, কখনও সরব এবং নীরব উপস্থিতি ঘটনাসমূহের জন্ম দিয়েছে এবং একটি মােক্ষম সময়ে ঘটনার অঙ্গনে তিনি নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বল্পবাক, নেপথ্যচারী এই মানুষটি ঘটনা সংঘটনের পূর্বে ‘অদৃশ্য ভিলেনের ভূমিকায় অবতীর্ণ এবং ঘটনার সফলতায় ‘নায়কের বীরােচিত ভঙ্গিমায় দর্শকদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন; কৈশােরের পরিবেশ ও প্রাথমিক চাকুরী জীবন তাকে এই মানসিকতায় ঠেলে দিয়েছে।

কর্মজীবনের প্রাথমিক অবস্থায় এমনকি, স্বাধীনতার যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত জিয়াউর বহমান তার সম সাময়িক বাঙালী অফিসারদের সচেতনভাবে এড়িয়ে চলার অভিযােগের উত্তর তার প্রাথমিক জীবন গড়নের মধ্যেই ছিলাে নিহিত। বাঙালী অফিসারদের এড়িয়ে চলার মধ্যে এটাও স্বাভাবিক কারণ হয়ে থাকবে যে, সামরিক কমান্ডে এবং সামরিক জীবনে চাকুরী এবং বৈষয়িক সুযােগ-সুবিধা প্রাপ্তির সােনার চাবি’টি ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের হাতে। সেই কারণে জিয়াউর রহমান তার চলনে বলনে আচার আচরণে চিন্তা চেতনায় একজন ‘শুদ্ধতম পাকিস্তানী’ হিসেবে গড়ে ওঠার সামান্য সুযােগটুকুও হাতছাড়া করেননি। পাকিস্তানী সামরিক কর্তাদের আস্থাভাজন হওয়ার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের নিরলস প্রচেষ্টার ‘দাসানুগ আচরণ’ তদানন্তিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালী সামরিক অফিসারদের অনেকের নিকট দৃষ্টিকটু হলেও এ ক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই ছিলনা। বাঙালীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ প্রভুভক্ত গর্বোন্ধ এই তরুণ সামরিক অফিসারটি গােপন সার্ভিস রেকর্ডের মাধ্যমে অতি স্বল্প সময়েই কর্তাব্যক্তিদের নজরে আসতে সমর্থ হন। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠীও বাঙালি রাজনীতিবিদ, আমলা, সামরিক অফিসারদের মধ্যে হতে তাদের একান্ত অনুগত’ ‘বাধ্যানুগত’ ‘বিশ্বস্ত’ ‘বশংবদ সৃষ্টি চেষ্টায় সর্বদাই তৎপর ছিলাে। সামরিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের এডুকেশান ব্যাকগ্রাউন্ড ও পাকিস্তানী প্রীতির দৌলতে এবং সামরিক কর্মকান্ডে তার স্বাভাবিক নিয়মনিষ্ঠ আচার আচরণ ইত্যাদি মিলিয়ে ক্যাপ্টেন জিয়া অচিরেই পাকিস্তানী সামরিক অধিনায়কদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। সেজন্য লক্ষ্যণীয়, ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর পর পরই বাঙালি রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছাত্রদের সম্পর্কে গােপন রিপোের্ট প্রদানের দায়িত্বে জিয়াউর রহমানকেই জেনারেল আইয়ুব খান বেছে নিতে ভুল করেনি। ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারীর পর ১২ই অক্টোবর মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ হলেন এবং ১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ধানমন্ডির আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাড়িতে তাকে অন্তরীণ রাখা হলাে। তার স্ত্রী ও সন্তানগণ সরকারী খরচে তার সঙ্গেই থাকেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে দেশরক্ষা আইনে তাঁকে নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ করা হয়। তার বিরুদ্ধে একের পর এক নয়টি মামলা সাজানাে হয়। সবগুলােতে বেকসুর খালাস পেয়ে ১৯৫৯ সালের ১৭ই ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। তবুও তার উপর কড়া বিধি-নিষেধ আরােপিত থাকে। সামরিক শাসন জারী হওয়ায় পরপরই হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ থাকে।4  ৫. এই অবস্থার মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান বিশ্ববাসীকে ধােকা দেবার লক্ষ্যে ১৯৫৯ ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। কেননা ঐ নির্বাচন জেনারেল আইয়ুব খানের জন্য বিশেষ জরুরী ছিলাে। সেটা হলাে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের আস্থাভােট লাভ। সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী ভােটদাতাদের কেবলমাত্র হা বা না বলার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলাে। সামরিক শাসনে গণভােট-এর তালিম জিয়াউর রহমান-এর মানসপটে অংকিত হয়ে যায় । এই প্রেক্ষিতে সামরিক গােয়েন্দা দপ্তরকে আইয়ুবের পক্ষে কাজ করার দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। জিয়াউর রহমান এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা হয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পােস্টিং পান। সামরিক গােয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের কর্মকান্ডের সফল বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেন। ‘৫৫ সনে কমিশন প্রাপ্ত হয়ে জিয়াউর রহমান প্রায় দু বছর পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্তব্যরত থাকা কালে পাঞ্জাবী সামরিক কর্তৃপক্ষের আরাে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ‘৫৯ সনে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে তাকে বেশ কিছুদিন দিনাজপুরে অবস্থান করতে হয় । দিনাজপুরেই অষ্টম শ্রেণীতে স্কুলগামী বেগম খালেদার সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরিণয়। বিয়ের বেশ কিছু মাস পর তদানীন্তন শাহবাগ হােটেলে (এখন পিজি) বৌ-ভাত অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনের অধীনে অতিথি আপ্যায়নের বিধি জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয়নি। ‘৫৯ সন ৬৪ সন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান তদানন্তিন পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার কর্তা ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। ৬২-৬৪ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখার জন্য বাঙালী হয়ে বাঙালীদের বিরুদ্ধে এক পােক্ত পেশাদার গােয়েন্দা ব্যক্তিত্ব হিসেবে জিয়াউর রহমান সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন সন্দেহ নেই। রঙিন চশমার অন্তরালে নিজের চোখকে অন্যের থেকে আড়াল করে অন্যকে দেখার মধ্যে যে চৌর্য-চাতুরতা নিহিত সে সময় হতেই জিয়ার নিকট ছিলাে ‘উপভােগ্য এবং সমগ্র জীবনে তার এই অভ্যাসের ছেদ পড়েনি। ‘৬৫ সনে পাকভারত যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। ঐ রেজিমেন্টের কমান্ডার অফিসার ছিলেন কর্ণেল এ,টি, কে, হক। তার অধীনে। ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান একজন কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ঐ যুদ্ধে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয় এবং পদাতিক বাহিনীর উপসকে বীরত্বের জন্য পদক দেয়া হয়। জিয়া অনুসারীরা পাক ভারতের যুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বীরত্বের কথা মাঝে মধ্যে টিভিতে প্রচার করার প্রয়াস নিলেও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জিয়াউর রহমান ঐ যুদ্ধে তেমন কোন কতিত্বের দাবীদার ছিলেন না। বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য জিয়া বীরত্বপূর্ণ পদক পাননি। নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য সার্ভিস এওয়ার্ড পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল সাদেক যিনি সেদিন ছিলেন কোয়ার্টার মাস্টার । ১০. যুদ্ধের পরে জিয়াউর রহমান মেজর পদে উন্নীত হন এবং ৬৬-এ কাকুলে পাকিস্তানের মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক নিযুক্ত হন। ৬৭-সনে পি এস সি প্রাপ্ত হন এবং ৬৯ সনে সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান করেন।। মেজর সফিউল্লাহর কারনে জিয়ার সেকেন্ড বেঙ্গলে যােগদান দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্যাটেলিয়ানে থাকার চেয়ে রহস্যময়তার হাতছানি জিয়াউর রহমানকে পুনরায় টেনে নিয়ে যায় । ৬৯ সনে জার্মানীতে তিন মাসের ট্রেনিং-এ চলে যান। সি আই এ নেট ওয়ার্কের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রিটিশ অফিসার রেভারাইন ট্রেনিং জিয়াউর রহমানের মানসে গােয়েন্দা চেতনা পূর্ণতা লাভে সহায়তা করে। ৪ ১১. প্রশিক্ষণের পর জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে বদলি হন এবং ৮ম বেঙ্গলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমানের জন্য এই বদলী তার ভবিষ্যৎ জীবন রচনার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের শীর্ষস্থান দখলের ক্ষেত্রে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। ‘৭০ অক্টোবরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয় এবং একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানও বদলীর আদেশ প্রাপ্ত হন। ৭০-এর জাতীয় নির্বাচনের পর পরই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রায় অর্ধেক সংখ্যক সেনা অফিসার করাচীর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম ত্যাগ করে। জিয়াউর রহমানের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, বাকী অর্ধেক অর্থাৎ মাত্র ৩০০ মত সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ত্যাগের প্রস্তুতি সম্পন্ন। সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নির্বাচনের পর পরই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর জেনারেলগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, কোনভাবেই বাঙালীদের হাতে, বিশেষ করে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তানে নয়, সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্টতা অর্জন করে। নির্বাচনী রায় বানচাল করার লক্ষ্যে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ১৩. পাশাপাশি বাঙালী জাতির অবিসংবাদী নেতা ও জাতীয় আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্ক ও কৌশলের মাধ্যমে জনগণের হত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ষড়যন্ত্র মােকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ১৪. জিয়াউর রহমান মেজর খালেদ মােশাররফ ও মেজর রফিককে বারবার নিরস্ত

করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবেনা। অর্থাৎ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাঙালী সেনা অফিসারদের উপর আক্রমণ করবে না। অথচ মেজর খালেদের কথা ছিলাে, ওরা আমাদের উপর আঘাত হানবেই। আমাদের উপর আঘাত আনার আগেই আমাদেরকে তাদের উপর আঘাত হানতে হবে-তা না হলে ওরা সবাই আমাদেরকে জবাই করে ফেলবে।৭ জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসই ছিলােনা যে, সত্যি সত্যি পাকিস্তানীরা তাদের উপর আক্রমণ করতে পারে। সেজন্য ২৬শে মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সােয়াত থেকে অস্ত্রসস্ত্র গােলাবারুদ নামানাের কাজে সাহায্য ও তদারকি করার জন্য রওনা হন। পথিমধ্যে জানতে পারেন পাকিস্তান আর্মি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে বহু সেনা অফিসার হত্যা করেছে। তখন জিয়াউর রহমান সটকে পড়েন। জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রাম হতে পটিয়ার দিকে রিট্রিট করেন সে সময় মেজর রফিক বিপদ ও ঝুঁকি সত্ত্বেও বীরত্বের সঙ্গে চট্টগ্রামে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সনে ২৫শে মার্চ জিয়াউর রহমান প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে হিরাে বনে যান। জিয়ার কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না। ১৫. ২৪ শে মার্চ হতে পি-আই-এর বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা ঢাকা ত্যাগ করতে থাকেন। জেনারেল ফরমান আলী ও জেনারেল খাদেম রাজা দুটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকার বাইরে বিগ্রেড কমান্ডারদের, ‘অপারেশন সার্চলাইট। ‘সম্পর্কে ব্রিফ করার জন্য বেরিয়ে পড়েন। সামরিক বাহিনীর বটল গ্রীন কালারের একটি হেলিকপ্টার নিয়ে জেনারেল খাদিম রাজা চট্টগ্রাম নামলেন। বললেন ঃ জয়দেবপুর সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে এক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার জন্য ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে জয়দেবপুর যাওয়া। বিশেষ প্রয়ােজন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলাে। তাকে নজরবন্দী রাখা হলাে। চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেয়া হলাে লেঃ কর্ণেল ফাতমীর উপর এবং বিগ্রেডিয়ার ইকবাল শাফীকে দায়িত্ব নেবার জন্য অর্ডার দেয়া হলাে। তার আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। কেননা তিনি তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু তার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেই ১৭শে মার্চ অপারেশন সার্চ লাইটের গ্রীন সিগন্যাল চলে

এলাে। তখন চট্টগ্রামে ই বি আর, ই পি আর, নতুন ই বি আর সি ও পুলিশ মিলিয়ে বাঙালীর সশস্ত্র শক্তি প্রায় ২০ হাজার। অন্যদিকে চট্টগ্রামে বিশ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্য সংখ্যা মাত্র ৬০০ জন। বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় আনার পর ৮ম। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ মেজর জিয়াউর রহমান সেকেন্ড ইন কমান্ড। এত বড় সৈন্য শক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদানের পূর্ব ইচ্ছা, পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এবং সমন্বয়ের অভাবে চট্টগ্রাম দখল করা ‘বীর’ জিয়াউর রহমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এমনকি এই বিরাট শক্তি সমন্বয়ে যেভাবে প্রতিরােধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিলাে তা হয়নি। ক্যাপ্টেন রফিক ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে জংগী জনশক্তি তৈরী হয়েছিলাে সামরিক নেতৃত্বের অভাবে তাদের দ্বারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তবুও চট্টগ্রামের যুদ্ধ পাকিস্তানী সামরিক জেনারেলদের বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাে। রিজার্ভ পুলিশ লাইনে বিশ হাজার রাইফেল রক্ষিত ছিলাে, জনগণ তা নিজের হাতে তুলে নেয় । জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৮ম ইবি বি আর পাকবাহিনীর সংগে সরাসরি যুদ্ধ মােকাবিলার। সময়, সুযােগ ও সমন্বয়ের সময় পায়নি।

রাতারাতি মুক্তিবাহিনী। ১৬. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী একান্ত সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধ চিত্তে বলেছেন, “পাকিস্তানীরা যদি তাদের আক্রমণ কেবল মাত্র নির্দিষ্ট কয়েক জন রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সীমিত রাখতাে তাহলে বাঙালী সৈনিক ও পুলিশরা হয়তাে নিরপেক্ষ ভূমিকাই পালন করতাে। যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্বিচারে বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী সদস্যদেরও হত্যা করার খবর ছড়িয়ে পড়লাে, কেবলমাত্র তখনই আমরা একদেহে প্রতিরােধ গড়ে তুললাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের মাধ্যমে রাতারাতি

এভাবে মুক্তি বাহিনীর সৃষ্টি করলাে।” বস্তুতঃ বাঙালী সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করাে ও আঘাত করাে নীতিতে পাকিস্তানী কার্যক্রম

শুরু হলে বাঙালী সেনা অফিসারগণ আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে, সংগ্রামী জনতার চাপে ও জনগণের আকাঙ্খার সংগে সংগতি রক্ষার্থে কার্যক্ষেত্রে তাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ ব্যতীত বিশেষ কোন উপায় ছিলাে না। পাকিস্তানী সেনা কাঠামাের মধ্যে বেড়ে ওঠা বাঙালী সেনা আফসার ও অধিকাংশ সদস্যদের মনে পাকসামরিক বাহিনীর নৃশংসতা, শক্তি *নতা সম্পর্কে কোনই অস্পষ্টতা ছিলাে না, ফলে ধরতে গেলে অসম যুদ্ধের। পারণত সম্পর্কে তারা ছিলেন সতক ফলে সীমান্তের দিকে দ্রুত গতিতে ধাবিত। হতে তাদের সিদ্ধান্তে অস্পষ্টতা ছিলাে না। চট্টগ্রামের জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব,

স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিএলএফ সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, প্রাক্তন সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ যখন সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত তখন মেজর জিয়া যুদ্ধে ময়দান ছেড়ে ও সামরিক দায়িত্ব পালন না করে রাজনীতিবিদদের ন্যায় আচরণ প্রদর্শন করেন। কালুরঘাটে বেতার ভাষণে নিজেকে হেড অবদি স্টেট হিসেবে ঘােষণা করছেন এবং অবস্থার বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘােষণা দিয়ে পরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। যখন কালুর ঘাটে যুদ্ধ হচ্ছে জিয়াউর রহমান তখন কক্সবাজারের ট্রেজারী হতে মাসমাহিনার প্রাপ্ত টাকার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। যখন কক্সবাজারে যুদ্ধ জিয়া তখন রামগড়ে, যখন রামগড়ে যুদ্ধ তখন জিয়াউর রহমান ভারতীয় সীমান্ত অভ্যন্তরে নির্বিঘ্নে অবস্থান নিয়েছেন। সেজন্য যুদ্ধের সময় জিয়াকে অনেকেই ‘মেজর রিট্রিট’ হিসেবে সম্বােধন করতেন। ১৭. ২৫মে মার্চ বেলা একটা। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আরাে দুটি প্লাটুনকে সােয়াত নামের জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়। আগের দিন ৫০ জন বাঙালী সৈন্যকে নিরস্ত্র অবস্থায় অস্ত্র খালাসের জন্য পাঠানাে হয়েছিলাে। ২৬শে মার্চ সকাল ১০টা পর্যন্ত তাদের দিয়ে মাল খালাস করা হয়। তাদের খাবার দেয়া হলাে না। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার অনুমিত দেয়া হলাে না। সােয়াত জাহাজে তাদের আটকিয়ে রাখা হলাে। বন্দী। তার পরের ঘটনা২৭শে মার্চ ১৯৭১। হতভাগ্য বন্দী বাঙালী সৈন্যদের সােয়াত জাহাজ থেকে বের করে এনে দাঁড় করানাে হলাে জেটির প্লাটফর্মে। সবাই দু’হাত তুলে আত্মসমর্পনের ভঙ্গীতে দাড়ালাে। তবু চালানাে হলাে গুলি। মুহুর্তে লুটিয়ে পড়লাে। বাঙালী সেনা সদস্যদের দেহ। থকথকে রক্তে সূর্যের বিদায় আভায় কর্ণফুলী ও ভৈরব নদীর জলরাশি উদ্বেল হয়ে উঠলে ।।

পাকিস্তানী সমর পরিকল্পনাবিদের নিষ্ঠুর নির্দেশ বাস্তবায়ন ও বাঙালী সেনা অফিসারদের দোদুল্যমানতা ও সিদ্ধান্তহীনতা এ সব হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। ২১শে মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ দীর্ঘ সময়। পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালী সৈন্যদের উপর আক্রমণ করবে এ কথা জিয়াউর রহমান নিজ কানে শােনার পরও সশস্ত্র প্রতিরােধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি অথবা আক্রমণের এই পূর্ব পরিকল্পনা আন্দোলনকারী জনশক্তিকে জানাননি।

জিয়ার চালে ভুল ১৮. এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদ্রোহী বাঙালী সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের নিকট পরিষ্কার হয়ে আসে যে, পাকসামরিক

বাহিনীকে প্রতিরােধ ও হটিয়ে দেবার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্যবল, অস্ত্রশস্ত্র ও লজিষ্টিক সাপাের্ট তাদের নেই। পরিকল্পনাবিহীন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাঙালি সশস্ত্রবাহিনী ক্রমশই ভারত সীমান্তের দিকে দ্রুত ভীড় জমাতে থাকে। সীমান্ত অঞ্চলের সর্বত্রই ঐ একই অবস্থা লক্ষ্যণীয় ও দৃষ্টিগােচর হতে থাকে। ৪ঠা এপ্রিল। বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, ক্লান্ত ও নুয়ে পড়া সামরিক অধিনায়কগণ তেলিয়াপাড়ার হেড কোয়ার্টারে সমবেত হন। কর্ণেল ওসমানী, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, লেঃ কর্ণেল সালাউদ্দিন মােঃ রাজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী, লেঃ কর্ণেল আব্দুর রব কতিপয় বাঙালী সামরিক অধিনায়ক ঐদিন কর্ণেল ওসমানীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাঙালী সামরিক অফিসারদের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পকাশ্যতঃ কোনরূপ জটিলতা না থাকলেও ভেতরে ভেতরে কোন কোন অফিসারের মধ্যে এ বিষয়ে স্পষ্টতঃই দ্বিমত ছিল।

মেজর শফিউল্লাহ মনে করেছিলেন যেহেতু এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল তার দখলে এবং তার অধীনস্থ বাহিনী অত্যন্ত বীরত্বের সংগে পাক হানাদার বাহিনীর সংগে সংঘর্ষে প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছে, সেজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তার। উপর অর্পিত হওয়া উচিত। খালেদ মােশাররফও অত্যন্ত সাহসী, পরিকল্পিতভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধ পরিচালনায় পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন। সে জন্য যুদ্ধের প্রধানতম দায়িত্ব তার উপর অর্পিত না হলেও সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একটি বিশিষ্ট ভূমিকা থাকবে এটা তার মনে স্বাভাবিক আকাঙ্খ হিসেবেই কাজ করে থাকবে। অন্যদিকে গােয়েন্দা কার্যক্রমে দক্ষ ও পটু জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষী ঘােষণায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ইতিপূর্বেই প্রচারিত হয়ে পড়েছিলাে। জিয়াউর রহমান কোনরূপ যুদ্ধ বা সশস্ত্র প্রতিরােধে অংশগ্রহণ না করে অত্যন্ত দ্রুততার সংগে বিপ্লবী সরকারের প্রধান বলে নিজেকে ঘােষণা করেন এবং প্রায় একই সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়করূপে নিজেকে উপস্থাপিত করেছিলেন। তেলিয়াপাড়া সামরিক নেতৃবৃন্দের বৈঠকে উপস্থিত হয়ে জিয়াউর রহমান অতি সহজেই উপলব্ধি করেন যে, সামরিক বাহিনীর সেনাপতিরূপে তার বেতার ঘােষণা তার জন্য শুভ প্রতিক্রিয়া বয়ে আনেনি। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন তার পক্ষে সশস্ত্র বাহিনী পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অথচ আকাঙ্খত পদটি দখল করা সম্ভব হবে না। কেননা ইতিমধ্যেই মেজর সাফল্লাহ-খালেদ মােশাররফ সমঝােতামূলক ঐক্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মেজর সফিউল্লাহ ছিলেন খালেদ মােশাররফের কাছাকাছির লােক। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে চাকুরীরত অবস্থায় জিয়াউর রহমানের বাঙালীদের প্রতি অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় রাজনীতি সচেতন খালেদ মােশাররফের নিকট স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র নেততুদানে জিয়াউর রহমান ছিলেন অগ্রহণযােগ্য। সফিউল্লাহ – খালেদের সমঝােতায় ক্ষুব্ধ জিয়াউর রহমানের নিকট ঐ অবস্থায় কর্ণেল ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সামরিক নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়টিতে সম্মতি জ্ঞাপন ব্যতীত অন্য কোন পথ খােলা ছিলাে না। সফিউল্লাহর চেয়েও কর্ণেল ওসমানীই ছিলেন ঐ প্রেক্ষিতে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য ব্যক্তিত্ব। উপরে উপরে কর্ণেল ওসমানীর প্রতি আনুগত্য দেখালেও জিয়াউর রহমানের মনে সব সময়ই একথা জাগরূক ছিলাে উঠতি সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে তিনি সিনিয়র ও যােগ্য এবং যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব তারই প্রাপ্য। তরুণ মেজরদের চাপ ছিলাে প্রচন্ড ১৯. সামরিক বাহিনীর এসব তরুণ মেজরগণ প্রায় প্রত্যেকেই যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় সামরিক নেতৃত্ব গ্রহণের বিষয়টিকেই মৌলভাবে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। সামরিক প্রাধান্যের ঐক্য ফর্মুলায় শেষ পর্যন্ত কণল ওসমানীর নেতৃত্ব টেকনিক্যাল কারণে মেনে নিলেন। তাদের চাপে বলতে গেলে তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য দুর্বল চিত্ত বাহ্যতঃ ‘পাপা টাইগার’ কর্ণেল ওসমানী তাদের নামে তিনটি বিগ্রেড গঠন করতে বাধ্য হন। মেজর খালেদ মােশাররফের নামে কে ফোর্স, মেজর সফিউল্লাহর নামে এস ফোর্স এবং জিয়াউর রহমানের নামে জেড ফোর্স গঠন করতে হয়। কে ফোর্স, এস ফোর্স ও জেড ফোর্স এই মেজরদের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত বিগ্রেড। ব্যক্তি বিশেষের নামে গঠিত এসব বিগ্রেড গঠন যেমন ছিল অভিনব, তেমনি সামরিক বাহিনীর ইউনিফাইড ‘কমান্ড পরিচালনায় তা ছিলাে প্রতিবন্ধক। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত এসব বিগ্রেড বাহিনী সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে যা বাংলাদেশ বা সেনাবাহিনী কারাের জন্যই মঙ্গলজনক হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে পরবর্তীকালে ক্যু, কাউন্টার ক্যু এবং সেনাশূঙ্খলা বিরােধী কার্যক্রম সংঘটনে প্রমাণিত হয়েছে এসব বিগ্রেড গঠনের সিদ্ধান্ত ছিল মারাত্মক রকম ভুল সিদ্ধান্ত। তাছাড়া এই তিন অধিনায়কের কারােই ইতিপূর্বে বিগ্রেড পরিচালনার কোন অভিজ্ঞতা ছিলােনা। প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী ‘অপারেশন প্ল্যান তৈরী করার মূল্যায়নে এইসব বিগ্রেড সম্পর্কে বলেছেন, “যে  কাজের জন্য বিগ্রেড গঠন করা হয়েছিল, ৩। অর্জনের ক্ষেত্রে এ যাবত বিগ্রেডকে ব্যবহার করা যায়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও করা যাবে বলে মনে হয় না।”১০

ওসমানীর পদত্যাগ ঃ জিয়ার চালে আবার ভুল ১. বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতি, ওয়ার প্লান, টেকটিক্যাল এবং লজিস্টিক সাপাের্ট ইত্যাদি

বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছিলাে। ১৬শে মার্চে পর হতে যে স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের জোয়ার শুরু হয়েছিলাে। বাস্তব অবস্থায় ৭ সপ্তাহের মধ্যেই তা ক্রমাগত শুকিয়ে আসছিলাে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সমন্বিত তৎপরতা, আক্রমণ চালনার দক্ষতা এবং পরিচ্ছন্ন ও নির্ভল টার্গেট অর্জনে লক্ষ্যবদ্ধতা অচিরেই বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকা থেকে বাঙালী সেনাবাহিনীকে সীমান্তের ওপারে প্রতিবেশী ভারতে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। এ কাজটি করতে তাদের সময় লেগেছিল মাত্র তিন সপ্তাহ। ভারতে তাড়িত বাঙালী সেনা সদস্যদের সংখ্যাল্পতা, বিপর্যস্ত মানসিকতা এবং অশেষ দৈহিক ক্লেশের চাপে হঠাৎ মনে হলাে বাংলাদেশের যুদ্ধ যেন থেমে গেছে! বাংলাদেশের ভেতরেও এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হতে থাকে যে, পাক বাহিনীর এ বিজয় যেন চিরস্থায়ী, বাঙালী সেনাবাহিনী, যুব-তরুণ এবং দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের দালাই লামার মতাে আমৃত্যু ভারতের মাটিতেই যেন থেকে যেতে হবে। অবস্থার এই নাজুকতায় বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারগণ প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীর দক্ষতা এবং ক্ষমতার উপর প্রশ্নবােধক চিহ্ন অংকনে কুণ্ঠিত হননি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক রণক্লান্ত সৈনিকদের মনােবল, ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং রণকৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার উদ্যোগকে প্রধান সেনাপতি প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করেননি, সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠক আহ্বানকে তিনি তার ব্যক্তিগত সনের সংগে জড়িয়ে ফেলেন। সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এই বৈঠকের দিনগুলাের মধ্যেই কলকাতার পার্কস্ট্রীটে আনু মামার বাসায় কতিপয় সেক্টরের অধিনায়কগণ বেশ কয়েকটি বৈঠকে বসে তাদের সমন্বয়ে একটি ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীকে ‘দেশরক্ষামন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করার প্রস্তাব বিবেচনা করেন। তরুণ অথচ এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অধিনায়কদের সমন্বয়ে উক্ত যুদ্ধ কাউন্সিল হতে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাদের উপর দেয়া হােক এই প্রস্তাব সরাসরি বৈঠকে উত্থাপিত হয়। যুদ্ধ কাউন্সিল’ গঠনের এই প্রস্তাবের পেছনে মূল ব্যক্তি ছিলেন জিয়াউর রহমান। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশাররফ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই প্রস্তাবের বিরােধীতা করলে সামরিক নেতৃত্বের দ্বিধাবিভক্তির পরিণামে ‘যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের ? প্রস্তাবটি তেমন ‘জোর’ পায়নি। ১১-১৭২ জুলাই পর্যন্ত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে নেন। কর্ণেল ওসমানী তার পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করে দ্বিতীয় দিন হতে অধিবেশনে যােগদান করেন। এই বৈঠকেই যুদ্ধের খুঁটিনাটি দিক, সমস্যাসমূহ, ভবিষ্যৎ কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়। এই বৈঠকে লেঃ কর্ণেল এম, এ, রবকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ, কে, খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তার মধ্যে ক. বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা নির্ধারণ, খ. গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, গ. নিয়মিত হিনীকে ব্যাটালিয়ন, ফোর্স ও সেক্টর টুপসের ভিত্তিতে সংগঠিত করা।।

সক্টর কমান্ডারের বিলম্বিত শপথ। ১. ২৫শে মার্চের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রাথমিক সাফল্য ও উল্লাস অপসৃত হতে

বেশী দিন লাগেনি। সীমান্তের ওপারে তাড়িত সেনাবাহিনীকে প্রথম দিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কমান্ডারগণ গােলাবারুদ ও যুদ্ধ রসদ দিয়ে সাহায্য সহযােগিতা করলেও মে মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালী সেনাবাহিনীর প্রতি বি,এস, এফের উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে। ভারতীয় সমর পরিকল্পনাবিদগণ ঐ সময় ‘টোটাল ওয়ার প্ল্যান নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে দিল্লীর কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ উহ্যই থেকে যায়, ফলে ভারত থেকে পর্যাপ্ত অস্ত্র পাবার আশা ভঙ্গ হয়ে পড়লে সামরিক অধিনায়কগণ অসহায় বােধ করতে থাকেন। প্রথম দিকে রাজনৈতিক নেতত্বকে তােয়াক্কা না করার যে উগ্র মানসিকতা এই সব ‘ক্ষুদে মার্শালদের মধ্যে গড়ে উঠেছিলাে বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে তাদের এই সুপ্ত আকাক্ষা শীতল হতে থাকে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে তাদের যুদ্ধ পরিচালনা করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প ছিলােনা।

জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং বাস্তব অবস্থার কারণে অনন্যোপায় হয়ে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণার ১১৪ দিনের মাথায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অধিনায়কগণ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ই জুলাই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করেন।  ১. স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে জিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। একদিকে মানসিকভাবে যুদ্ধ করার পূর্ব প্রস্তুতি যেমন তাির ছলাে না-তেমিন অস্ত্রশস্ত্র ছিলাে না। ১৫০টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ১০৬ এম আর আর এবং দুটি ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিলাে। এ সবের কোন গুলি পর্যন্ত ছিলাে না। ৮ম বেঙ্গর রেজিমেন্টের সমস্ত অস্ত্র গােলাবারুদ সব পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্বেই পাঠানাে হয়েছিলাে।১১ সেজন্য যারা বলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং ঐ ঘােষণা পাঠের পূর্ব হতেই জিয়াউর রহমান যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন- একথা তথ্য সমৃদ্ধ নয়। প্রচারণা ও বানােয়াট। যুদ্ধকালীন সময়েও জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের কোন গৌরবজনক ও বীরত্বপূর্ণ ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায় না। ১২ 

Reference list for the 1st chapter:

দ্বিতীয় অধ্যায়।

চক্রান্তের কুটিলতা: জিয়ার তিন চেহারা

১. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সনের ৬ই ফেব্রুয়ারী জেনারেল পদে উন্নীত করেন। ৭ই এপ্রিল জেনারেল এম,এ,জি, ওসমানী সি এন সি হতে পদত্যাগ করেন গণপরিষদ সদস্যপদ বহাল রাখার লক্ষ্যে।। ৮এপ্রিল সম্মিলিত আর্মড ফোর্সেস-এর পরিবর্তে সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধান ও নতুন চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান হন কে, এম, সফিউল্লাহ। ১২ ই এপ্রিল জেনারেল ওসমানীকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। কে, এম, সফিউল্লাহকে চীফ অব স্টাফ নিয়ােগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বলতে গেলে অপ্রকাশ্য অন্তর্দ্বন্দ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান মনে করতেন সেনাবাহিনীতে তিনিই সিনিয়র অফিসার এবং দক্ষ। এ ব্যাপারে তার অনুগত অফিসার ও জে.সি.ও এন সিও-দের দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করেন খােলাখুলিভাবে। ২. বঙ্গবন্ধুর সরকার ডেপুটি চীফ অব স্টাফ পদ সৃষ্টি করে জিয়াউর রহমানকে উক্ত

পদে নিয়ােগ দান করেন। এই পদে নিয়ােগ প্রাপ্তির জন্য কর্ণেল জিয়ার তদবীরের অন্ত ছিলােনা। চট্টগ্রামের এমপিগণের নিকট ধর্ণা দিতেও তার বাধেনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব উদীয়মান তরুণ নেতা তােফায়েল আহমদ-এর বাড়িতে তদবীরের জন্যও কয়েকবার গেছেন, ধর্ণা দিয়েছেন জনাব আবদুর রাজ্জাকের কাছেও।২

৩. স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার রেকর্ড পর্যালােচনা করে বঙ্গবন্ধু কে, এম, সফিউল্লাহকেই সেনা বাহিনীর প্রধান নিয়ােগ যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। এ সম্পর্কে একজন সামরিক অফিসারের সুচিন্তিত অভিমত হলাে, জিয়াউর রহমানকে ডিঙ্গিয়ে কে, এম, শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়ােগ করা সঠিক হয়নি, যা সঠিক ছিলাে 

তা হচ্ছে, অতঃপর জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে রাখা। ৪. সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন ছিলাে তখনকার পরিস্থিতিতে এক দুরূহ ব্যাপার।

স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব যেমন ছিলাে, তেমনি পরস্পরকে টেক্কা মেরে এগিয়ে যাবার প্রবণতাও লক্ষ্যণীয়।

মেজর সফিউল্লাহ ,মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর খালেদ মােশাররফের নামে ‘এস’ ‘জেড’ ও ‘কে’ ফোর্স গঠন করে মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ব্যক্তি কেন্দ্রিক বিভক্তির সুযােগ করে দেয়া হয়। আপাতত কেন্দ্রীয় কমান্ডের আনুগত্য প্রদর্শিত হলেও এই তিন ব্রিগেডের প্রধানদের মধ্যে বিশেষ করে শফিউল্লাহ ও জিয়াউর রহমানের মধ্যে সামরিক নেতৃত্বের প্রশ্নে ঠান্ডা লড়াই সর্বদাই কাজ করেছে। এর উপর সেনা প্রধান ও উপ সেনা প্রধানের পদ সৃষ্টি সেনা শৃঙ্খলা ও প্রশাসনের বিষয়টি আরাে জটিল হয়ে পড়ে। সফিউল্লাহকে সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকটি মৌলিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১০ হাজার সেনা সদস্যের আবাসিক বাসস্থানের সুযােগ ছিলাে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ে সেনাবাহিনীর সংখ্যাই ছিলাে প্রায় ২০ হাজার। তার উপর পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর আরাে প্রায় ২৫ হাজার সদস্য সেনাবাহিনীতে যােগদান করে। এরূপ অবস্থায় রাতারাতি প্রায় ৪০/৪৫ হাজার সৈন্য বাহিনীর আবাসিক সুবিধা প্রদান শুধু মাত্র কথার কথা ছিলােনা। কিন্তু সেনা প্রধান হিসেবে এ দায়িত্ব তার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলােনা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশােহর, সৈয়দপুর, রংপুর এবং কুমিল্লায় সেনানিবাসগুলিতে তাদের আবাসিক সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়। সে ব্যবস্থা সুব্যবস্থা নয়, সাময়িক ব্যবস্থাপত্র। এ

নিয়েও কথা ছড়ানাে হয়। ৬. সমস্যা ছিলাে ইউনিফর্মের। তদানন্তিন পূর্ব পাকিস্তানে ইউনিফর্ম তৈরীর জন্য এমনকি, বুট, বেল্ট, ফিতা ক্যাপের কারখানা পর্যন্ত ছিলােনা। সবই আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে তখনাে এসব সংগ্রহের সুযােগ ছিলােনা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে জলপাই রঙের যে খাকি কাপড় উৎপন্ন হতাে তার গুণগত মান উন্নত ছিলােনা। ভারতে ঐ ধরনের খাকি কাপড় বর্ডার সিকিউরিটি বা সি, আর, পি-র জন্য ব্যবহৃত হতাে। সেই বিবেচনায় ভারত থেকে সেনাবাহিনীর জন্য ইউনিফর্মের কাপড় সংগ্রহ করাও সমীচীন মনে হয়নি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সামনে বিষয়টি পেশ করা হলে বঙ্গবন্ধু দেশেই সামরিক বাহিনীর ক্যামােফ্লেজ ড্রেস তৈরীর জন্য রাষ্ট্রায়াত্ত দুটি কাপড়ের কলে তা উৎপাদনের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যে ক্যামােফ্লেজ ড্রেস তৈরী হবে তা যেন বাংলাদেশের নিসর্গ এবং ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোন মিলেই এই ধরনের কাপড় উৎপাদনের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলােনা। মিলে বিশেষ ধরনের সুতা তৈরী, রং মিলানাে, রঙের টেকসই এবং গুণগতমান বজায় রেখে উৎপাদন পর্যায়ে যাওয়া ছিল সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এমনি অবস্থায় সেনাবাহিনীর মধ্যে যথাযােগ্য ইউনিফর্ম প্রদানে বিলম্বিত হয়।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গেরিলা যুদ্ধ কৌশলে ইউনিফর্ম কোন ফ্যাক্টর ছিলােনা কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি সুশৃংখল সুসজ্জিত বাহিনীর জন্য ইউনিফর্ম ছিলাে বিশেষ একটি ফ্যাক্টর।। ৭. এই অবস্থায় সেনাবাহিনীর মধ্যে ইউনিফর্ম সমস্যা ছিলাে প্রকট। এডহক ভিত্তিতে সেনা প্রধান-উপ প্রধান সবাইয়ের ঐক্যমতের সিদ্ধান্তে প্রতিরক্ষা ক্রয় বিভাগ জরুরী ভিত্তিতে ভারত থেকে কিছু খাকি কাপড় আমদানী করে। জিয়াউর রহমান এব্যাপারে দ্বৈত ভূমিকা পালন করেন। সেনা সদস্যগণ ড্রেস না পাওয়ায় তাদের জন্য দুঃখে বিচলিত হন আর যারা ড্রেস পেয়েছিলাে তাদের মধ্যে ড্রেসের গুণগত মান এবং ভারতীয় কাপড় ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাতে তৎপর ছিলেন। প্রকৃত পক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আবাসিক সমস্যা, তাদের ইউনিফর্ম, তাদের বুট, বেল্ট, ক্যাপ, এমনকি উপযুক্ত অস্ত্রের অভাব ছিলাে প্রকট। ৮. ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে যাদের অবস্থান ছিলাে প্রায় ৯৩ হাজারের মত, তাদের আত্মরক্ষার জন্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র রাখার অনুমতি পায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের যুদ্ধবন্দী অবস্থায় ঐ অস্ত্রসহ ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর প্রায় ৮২ টি ট্যাংক ছিলাে। যুদ্ধে এর সব গুলােই প্রায় ধংস হয়ে যায়। মাত্র ৪/৫টি ট্রাংক সচল ছিলাে। ভারী অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলােনা।

৯. অথচ পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত সামরিক অফিসার ও সদস্যগণ বাংলাদেশে এসে প্রত্যাশিত অস্ত্র না পাওয়ায় মানসিকভাবে বিরূপ হয়ে পড়ে। সর্বদা অস্ত্র ব্যবহারকারী সেনাসদস্যদের নিকট হঠাৎ অস্ত্র না থাকার প্রতিক্রিয়া হয়েছিলাে মারাত্মক। তারা নিজেদের নেগলেক্টেড ফিল করে। জিয়াউর রহমান তার বিশ্বস্ত অনুচরদের দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সূক্ষ্মভাবে ভারত বিদ্বেষী প্রচারণা চালান। বিষয়টি এরূপ হয়ে দাড়ায়, সেনাপ্রধান অকেজো এবং অযােগ্য। সকল যােগ্যতার ধারক এবং আকর জিয়াউর রহমান। এই ধারণাটি সেনা সদস্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়।।

১০. জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এমন এক সময়ে হত্যা করা হলাে যখন দেশে স্থিতিশীলতা এসেছে, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে, উৎপাদন বেড়েছে, বিনিয়ােগের প্রসার ঘটছে, দ্রব্যমূল্য হ্রাস পেয়েছে। সামরিকবাহিনীর জন্য আর্টিলারী ও আর্মড কোর গঠিত হয়েছে। ট্যাঙ্ক এসেছে। যুদ্ধ বিমান এসেছে।

নৌবাহিনীর জন্য আধুনিক যান সংগৃহীত হয়েছে। সৈন্যদের পাকিস্তানী আমলের অনুরূপ রেশন প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে।৪ এমনি অবস্থার প্রেক্ষিতে সেনা প্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ সামরিক বাহিনীর পাঁচ

ডিভিশন সেনাবাহিনীর একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট টিটো বাংলাদেশে আগমন করলে বঙ্গবন্ধু তার নিকট সেনাবাহিনীর উপকরণগত বিষয়ের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেন। প্রেসিডেন্ট টিটো এক ডিভিশন সেনাবাহিনীর জন্য সাজ-সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র দেবার প্রতিশ্রুতি দেন এবং সে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবরুদ, সাঁজোয়া গাড়ী আসছিলাে। এরূপ অবস্থায় জেনারেল সফিউল্লাহ ৫ ডিভিশন সেনা বাহিনীর একটি পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর টেবিলে অনুমােদনের জন্য ছিলাে। পরিকল্পনাটি যাতে অনুমােদন না হয় তার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিকট গিয়ে এর বিরুদ্ধে বিরােধীতা করছিলেন জিয়াউর রহমান।৫ কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেনা প্রধানের পদ হতে সফিউল্লাহকে বিদায়

করে জেনারেল জিয়া ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেন। ডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১২. পাঁচটি ডিভিশন গঠনের ক্ষেত্রে জিয়ার বিরােধীতা এবং জিয়া সেনা প্রধান হয়ে পরবর্তীকালে তা বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়ে একথা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, জিয়া ঘনিষ্টভাবে জানতেন বঙ্গবন্ধু ও সফিউল্লাহ আর বেশী দিন নেই। চক্রান্ত

চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে। ১৩. জিয়াউর রহমানও ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাজিত অসন্তোষ প্রশমনে সদা সর্বদাই বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। পাকিস্তান হতে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের প্রত্যাবর্তন এবং তাদের সেনাবাহিনীতে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত জিয়াউর রহমানের কূট কৌশল বাস্তবায়নের সুযােগ এনে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী অফিসারদের মধ্যে যুদ্ধকালীন সময়ে রিক্রুট কৃত অফিসার ব্যতীত প্রায় সকলেই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমিশন প্রাপ্ত

অফিসার। ১৪. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযােদ্ধা সেনা অফিসারদের দু’ বছর সিনিয়রিটি প্রদান করেন। ইতিমধ্যেই পাকিস্তান হতে বাঙালী সেনা অফিসারদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান ফেরৎ সেনা অফিসারদের সাথে চাকুরীর মেয়াদ, পদোন্নতির বিষয়, বেতন ভাতা ও চাকুরীতে সুযােগ সুবিধা ইত্যাদির কারণে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর পেশাগত কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনে জুনিয়র-সিনিয়র সম্পর্ক একটি ছকবাধা এবং বিধি সিদ্ধ যে,এতে প্রত্যাহিক জীবনে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করে।

পাকিস্তান ফেরৎ অফিসারদের মধ্যে লেঃ জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন, মেজর জেনারেল করিম ও ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান যখন পাকিস্তানি সেনা বাহিনীতে যথাক্রমে কোর কমান্ডার, ডিভিশন কমান্ডার ও ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব ছিলেন, তখন মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর জিয়াউর রহমান একজন কোম্পানী কমান্ডার মাত্র। ঐসব মেজর ও কোম্পানী কমান্ডার যখন স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রধান ও উপ-প্রধান পদে সমাসীন সেই অবস্থায় ঐ সব প্রত্যাগত সিনিয়র অফিসারদের অবস্থান ও তাদের মানসিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।৬ ১৫. জিয়াউর রহমান পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসারদের সঙ্গে দ্রুত সুসম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং তাদের একজন প্রিয়পাত্র হয়ে দাড়ান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারগণই ছিলাে মেজরিটি। এই মেজরিটি অংশের এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বেশ কিছু অফিসারদের দলে টানতে জিয়াউর রহমান তেমন কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত গােপনে, অথচ ধূর্ততার সঙ্গে পাকিস্তান ফেরৎ অফিসার ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী অফিসারদের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ কে ‘উত্তপ্ত করার কাজে সর্বদা নিয়ােজিত ছিলেন।৬ ১৬. আভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত ‘রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়ে সামরিক বাহিনী সদস্যদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিকে জিয়াউর রহমান একে হাতিয়ার হিসেবে নির্ভুলভাবেই ব্যবহার করেছেন। ৭  ১৭. এই দৃশ্যপটের সঙ্গে জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন যে, ১৫ই থেকে ১৮ই আগষ্ট পর্যন্ত তাকে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকতে হয়। সফিউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন ট্রুপসের কাছে তাকে যেতে না দেওয়ার জন্য তাকে অহেতুক বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের পাশে আটকে রাখা হয়েছে। ১৮ই আগস্ট রাতে খন্দকার মােশতাক সামরিক শাসন জারী করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানান এবং ড্রয়ার থেকে সামরিক শাসন সংক্রান্ত একটি কাগজ বের করেন। সেনা প্রধান সফিউল্লাহ যেহেতু সামরিক শাসন জারী করা হচ্ছে সেহেতু আইনগত খুটিনাটি দিকের পরীক্ষার কথা বলতে খন্দকার মােশতাক রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন, “তিনমাস ধরে কাগজটি তৈরী করেছি। দেখার তেমন কিছু নেই।” ৮ 

১৮. জিয়াউর রহমান মুক্তিযােদ্ধার পােশাকে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব নিতেন, অপরদিকে ‘পাকিস্তানী’ মানসিকতার জন্য পাকিস্তানী অফিসারদের নিকট প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠার কৌশল গ্রহণ করেন। একই সাথে পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মনােরঞ্জন করতে তৎপর ছিলেন। বাকশাল সদস্য হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। এ সবই ছিল জিয়ার ধূর্ততা, প্রতারণা ও শঠতার তিন চেহারা।। 

তৃতীয় অধ্যায়

জিয়ার পথের কাঁটা

১। খুনী রশিদ-ফারুকের হস্তক্ষেপে জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধান পদে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল এ,কে, খােন্দকারকে বিদায় দিয়ে ১৭ই অক্টোবর এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তােয়াবকে উক্ত পদে বসানাে হয়। ২৪ শে আগস্ট জেনারেল (অবঃ) এম,এ, জি, ওসমানীকে ‘ডিফেন্স এডভাইসার’ করা হলাে। ওসমানীর উপদেশ মতাে তিন বাহিনীর উপর, কর্তৃত্ব করার জন্য ডিফেন্স ষ্টাফ প্রধান পদ সৃষ্টি করে বিডিআর এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়ােগ করা হয়। কেননা, জেনারেল ওসমানী কোনদিনই জিয়াকে বিশ্বাস করেনি। সেনা প্রধান পদে তাকে বসানাে হলে তার মাথার উপরে ওসমানী ও খলিলুর রহমান এবং তার নিচেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে চীফ অফ জেনারেল স্টাফ করে রাখা হলাে। ২. ১৭ই আগস্ট রাতে আর্মি হেড কোয়ার্টারের একসভা জেনারেল কে,এম,

সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ, কে, খােন্দকার, নৌবাহিনীর প্রধান এম,এইচ, খান, পুলিশের আই জি, পি এস ও ব্রিগেডিয়ার রউফ, খালেদ মােশাররফ, ডি এ এম, কর্ণেল মালেক, জি এ, ও ওয়ান লেঃ কঃ নূরুউদ্দিন আহমেদ ঐ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হলাে, সামরিকবাহিনীর ‘চেন অফ কমান্ড’ ফিরিয়ে আনা হবে। অভ্যুত্থানকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার। সভায় প্রতিজ্ঞা করা হলাে বিষয়টি গােপনীয় থাকবে।১ কিন্তু এই গােপনীয় সিদ্ধান্তটি জানাজানি হয়ে যায়।। ৩. জিয়াউর রহমানের নিস্পৃহ এই মনােভাব দেখে সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অফ

কমান্ড’ ঠিক করার জন্য খালেদ মােশাররফ শাফায়াত জামিল এক মত হলেন। জিয়াউর রহমান সার্বিক ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন ভিন্নভাবে। তার সামনে বাধা ফারুক-রশীদ ছিলােনা। ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক থাকাকালে ঐ সময়ে ফারুক-রশিদ তার ছাত্র ছিলাে। পথের বাধা ছিলাে ওসমানী-খলিল, খালেদ, শাফায়াত গং। মেজরদের অপসারণ করলেই বা তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনলে অথবা চেইন অফ কমান্ড ঠিক হয়ে গেলে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হচ্ছে না। সেজন্য জিয়া তার নিজস্ব পরিকল্পনায় কাজ করছিলেন গােপনে। জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদটি দখল করে এ অবস্থায় সুযােগের জন্য ওৎ পেতে থাকেন। ৪. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বসে ছিলেননা। যার যার ছক নিয়ে তারা কাজ

করছিলেন।২ ভিন্ন ভিন্নভাবে। ৫. ২রা নভেম্বর ‘৭৫ গভীর রাত। ওসমানী, খলিল, এমনকি মােশতাক জিয়া ও খালেদের দ্বন্ধের কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। রশিদের আপত্তি আগ্রাহ্য হলে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলাে জিয়া খালেদ দুজনকেই সরিয়ে দেয়া হবে। ২রা নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এসে কমান্ড গ্রহণ করেন। রাত ১টায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন ঝটিকার বেগে জিয়াকে গৃহবন্দী করে। তার টেলিফোনের তার ছিড়ে ফেলে। কিন্তু তাদের জানা ছিলনা টেলিফোনটি ছিল বেডরুমে। এটা তার এক্সটেনশন মাত্র। বঙ্গ ভবনে অভ্যুথানের খবর এসে পৌছে। রশিদ জিয়াকে ফোন করে। রশিদ তাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করে। রশিদ জেনারেল ওসমানীকে ফোন করে। ওসমানী জিয়াকে ফোন করেন। জিয়া ফোন ধরে জানালেন, সে বন্দী। সেনা অভ্যুথানের সংবাদ শুনেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রিসালদার খুনী মােসলেম উদ্দিন কয়েকজন সৈন্যসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাভ্যন্তরে ঢুকতে চাইলে ডি আই জি প্রিজন তাদের বাধা দেন। তখন কেন্দ্রীয় কারাগার হতে মােসলেহ উদ্দিন টেলিফোন করে রশিদকে। রশিদ ডি,আই, জি প্রিজনকে মােসলেউদ্দিনের কথা মত কাজ করতে বলেন। ডি আই, জি প্রিজনের অস্বীকৃতিতে মােসলেউদ্দিন ক্রোধে ফেটে পড়ে। ডি, আই, জি প্রিজন প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সাথে কথা বললে মােশতাক মােসলেহ উদ্দিনের কথামত কাজ করতে নির্দেশ দেয়। মােসলেহউদ্দীন গং জেলের মধ্যে ঢুকে সবাইকে তাজউদ্দিনের সেলে নিয়ে এসে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম, মুনসুর আলী ও এ, এইচ এম, কামারুজ্জামানকে হত্যা করে। সম্প্রতি জাতির জনক বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বীকৃত খুনীদের অন্যতম কর্নেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, ৩রা নভেম্বর জেল হত্যার জন্য খন্দকার মােশতাক আহমদ ও কর্ণেল (অবঃ) রশিদ দায়ী। খন্দকার মােশতাক প্রসঙ্গে কর্ণেল (অবঃ) ফারুক বলেছে যে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন একটা গন্ডগােল হচ্ছে। এ সময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেঁচে থাকলে তার জন্য সমস্যা হবে। এ কারণেই মােশতাক জেল হত্যা ঘটিয়েছে। ৩

মােশতাক ও ৪ জাতীয় নেতাকে সরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক শূণ্যতার মধ্যে নিজেকে একক ব্যক্তিত্বরূপে থেকে যেতে চাইলে জিয়াউর রহমান নিষ্ক্রিয় থেকে খালেদ মােশাররফকে এগিয়ে দিলেন। জিয়া জানতেন, খালেদ মােশতাককে রাখবেনা। মােশতাককে সরাতে পারলে ওসমানী খলিলের খবরদারী থাকবে না। সামরিক বাহিনীতে তখন তিনি হবেন সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী। জিয়ার এটা বঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে মােশতাক-রশিদ ফারুক প্রথম রাউন্ডে খেলছে, তারা যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার সফলতা অর্জন করে তখন সুযােগ বুঝে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান পদটি দখল করে। খালেদ মােশাররফের অভ্যুথানের সময় জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পূর্বে প্রায় আধা ঘন্টা সময় পায়। জিয়া খালেদের অভ্যুত্থান ঠেকাতে চেষ্টা করেনি কিংবা রশিদের অনুরােধে তাদের পক্ষও নেয়নি। বরং খালেদ-জামিল বনাম রশিদ-ফারুকের সংঘাতে সে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে খালেদ তাকে প্রাণে মারেনি, বন্দী করেছে মাত্র। খালেদ মােশাররফ-এর ক্ষমতা দখলের পর জিয়ার পরিকল্পনা

ভেস্তে যেতে বসে। ৮. এ রকম একটা পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের-এর স্মরণাপন্ন হন। সি আই, এ ডকুমেন্টে পরিলক্ষিত হয় যে, জিয়া ও মেজর তাহের এর মধ্যে পূর্বে হতেই সুসম্পর্ক ছিল।৪  স্বাধীনতার পর কর্ণেল তাহের ও জিয়াউদ্দিন সেনাবাহিনী হতে পদত্যাগ করেন। জিয়াউদ্দিন সর্বহারা পার্টিতে যােগদান করে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নেয় । তাহের ও জিয়াউদ্দিনের চিন্তা ছিলাে অভিন্ন। জিয়াউর রহমান গােপনে সর্বহারা পার্টির নেতাদের প্রতি সমর্থন দেন এবং তাদের গ্রেফতারে নমনীয়তা প্রদর্শন করেন।৫  সেনাবাহিনী থাকাকালীন অবস্থায় তাহের ও জিয়াউদ্দিন জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ব্যাপকভাবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ট। সৈনিকদের মধ্যে তাহেরের বৈপ্লবিক সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কেও জিয়ার অজানা ছিলােনা। ৯. সেজন্য বন্দী অবস্থায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকেই জিয়াউর রহমানের মনে

পড়েছে। কারণ তার প্রাণ বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের এবং জাসদ ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প তখন তার হাতে ছিলনা।৬ তাহেরের জবানবন্দীতে একথা তাহেরও উল্লেখ করেছেন।৭ ১০. ৩রা নভেম্বর ‘৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী রশিদ-ফারুক গং দেশ ত্যাগ করলে

মােশতাক অসহায় হয়ে পড়ে। কোনক্রমেই মােশতাক প্রেসিডেন্ট হতে রাজি হলােনা। শাফায়াত জামিলের প্রস্তাবে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট বানানাে হয়।

১১. ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশের ৫ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খালেদ মােশাররফ ইতিমধ্যেই নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করে সেনা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ই নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। নতুন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ দেন। জাতীয় সংসদ ভেংগে দেন। বললেন, তার সরকার নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী কালীন সরকার। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিবরের হত্যায় সেনাবাহিনী জড়িত ছিলােনা। তিনি বলেন, আইন শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা হবে। এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারীতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। ১২. ৩ থেকে ৬ই নভেম্বর ‘৭৫। তিন দিন। জিয়াউর রহমান ৪ তারিখে সেনাবাহিনী প্রধান হতে ইস্তাফা দান করেন এবং ইস্তেফা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না। সেজন্য তিনি সেনা প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করছেন।৮ পদত্যাগ পত্র দিয়ে তিনি খালেদ মােশাররফকে আশ্বস্ত করলেন। জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ গৃহীত হলে খালেদ জিয়াউর রহমান অধ্যায় শেষ হয়েছে বলে ধরে নেন। খালেদ মােশাররফ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। দেশের রেডিও টিভিতে কি ঘটছে তার খবর দেয়া হলাে না। জনমনে সন্দেহ দানা বাধতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, খালেদ ভারতের দালাল। ভারতের এজেন্ট হিসেবে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতা দখল করছে। প্রমাণ হিসেবে পূর্ব ঘােষিত ৪ঠা নভেম্বর ‘মুজিব দিবস’ পালনে আওয়ামীলীগ, ন্যাপ, কম্যুনিস্ট পার্টি ছাত্র ও নেতৃবৃন্দের মিছিল কাজে লাগায়। সাম্প্রদায়িক শক্তি উঠে পড়ে লেগে যায়। বাংলাদেশে ছদ্মবেশে ভারতীয় সৈন্যও ঢুকে পড়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়।৯

১৩. কর্ণেল (অবঃ) তাহের ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে কুমিল্লায় ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। কর্নেল তাহের ও কর্ণেল জিয়াউদ্দিন ব্রিটিশ আর্মি পদ্ধতির পরিবর্তে চাইনিজ স্টাইলে উৎপাদনমুখী পিপল আর্মি গঠনের ইচ্ছা বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা পদত্যাগ করে। বঙ্গবন্ধু তাহেরকে ড্রেজার অর্গনাইজেশন এর পরিচালক পদে নিয়ােগ করেন। বাংলাদেশের জন্য যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে থেকেই কর্ণেল (অবঃ) তাহের গােপনে জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যােগসূত্র রক্ষা করে আসছিলেন। গােপনে সেপাইদের নিয়ে সেল গঠন করেন এবং অফিসারদের বিরুদ্ধে তাদের লেলিয়ে দেন।

১৪। ৪ এবং ৫ নভেম্বর দু’দিন। বেঙ্গল ল্যান্সার আর সেকেন্ড ফিন্ড আর্টিলারীর সৈন্যরা দেখতে পেলাে যাদের নেতৃত্বে তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেই সব নেতৃত্ব দেশছাড়া, ওসমানী ও মােশতাক ক্ষমতাচ্যুত। এবং জিয়া বন্দী। এসময় ১০ম ও ১৫ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় আনা হলাে। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার নিয়ােজিত ট্যাংক ও আর্টিলারী বাহিনীর সৈন্যরা প্রেসিডেন্ট সায়েমের বক্তৃতায় বুঝতে পারল সেনাবাহিনী নয় একটি ‘ক্ষুদ্র গােষ্ঠী’ হিসেবে তাদের জঘণ্য কৃৎকর্মের শাস্তি আসন্ন। এই অবস্থায় মরিয়া হয়ে তারা জেনারেল জিয়াকে তাদের একমাত্র পরিত্রাণ কর্তা হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি। অন্যদিকে ডানপন্থী মুসলিমলীগ ও ‘বামপন্থী’ জাসদ ক্যান্টনমেন্ট সহ রাজধানীতে হাজার হাজার প্রচার পত্র বিলি করে। একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের এজেন্ট এবং পরাজিত শক্তির প্রতিভূ খালেদ মােশাররফকে উৎখাতের জন্য জনগণ ও সেনাবাহিনীর প্রতি আহবান জানায়। সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের সিপাইদের জন্য ১২টি দাবী পেশ করে। এতে সাধারণ সিপাইগণের স্বার্থরক্ষার বিষয়গুলাে ছিলাে মুখ্য। (পরিশিষ্ট-২) ট্যাংক রেজিমেন্ট, আর্টিলারী বাহিনী এক যােগে অফিসারদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে। দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই সুবেদারের উপর অফিসার নাই” ইত্যাদি শ্লোগানে ক্যান্টনমেন্ট মুখরিত করে তােলে। অফিসারদের খুন করা হয়। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী ব্যারাকের কাছে অফিসার্স মেসে একজন তরুণ আর্মি অফিসারকে তারা হত্যা করতে এলে তারা পালিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার ছােট ভাই সেকেন্ড লেফটেনেন্ট সৈয়দ ইস্কান্দার সাঈদ। ১০ ১৬। জিয়াউর রহমানের অনুরােধে এবং বিশেষ লক্ষ্যকে সামনে রেখে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে সিপাহী বিপ্লবের নির্দেশ দেন। তার পূর্বে ৪ঠা নভেম্বর জিয়াউর রহমান আবারও তার জীবনকে বাঁচানাের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের নিকট আবেদন করেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের মেসেঞ্জারকে একথা বলে পাঠান যে, শীঘ্রই তিনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। জিয়া যেন সাহস সঞ্চয় করেন।এন সিও ও জেসিওদের সঙ্গে বৈঠক করে সেনাবাহিনীর সকল ইউনিটের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের পর কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের ৬ই নভেম্বর শেষ প্রহরে বিভিন্ন সেনা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক থেকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন। ৭ই নভেম্বর রাত ১টার সময় সিপাহী বিদ্রোহ ঘটানাের নির্দেশ দেয়া হয়। এ লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়—

১, খালেদ মােশাররফ চক্রকে উৎখাত, ২. বন্দী দশা থেকে জিয়াউর রহমানের মুক্তি, ৩. রেভুলেশনারী মিলিটারী কমান্ড কাউন্সিল গঠন, ৪. রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিপ্রদান, ৫. সকল হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার, ৬. বাকশাল ব্যতীত সকল দলকে নিয়ে অল পার্টি সরকার গঠন, ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২-দফা বাস্তবায়ন। 

১৭. সফল অভ্যুত্থানের এক পর্যায়ে জিয়াকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারী হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হয়। রাত তিনটায় কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের তার ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গমন করেন। জিয়া নাইট ড্রেস পরেছিল আর পাশে বিগ্রেডিয়ার মীর শওকতসহ কিছু অফিসার ও সৈন্যরা ছিলাে। জিয়া কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। তার ভাইয়ের সঙ্গেও কোলাকুলি করেন। এবং অশ্ৰুচোখে তার জীবন বাঁচানাের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। এমনকি জিয়া এ পর্যন্ত বলেন যে, জাসদ এবং তাদের জন্য তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত আছেন।১১ জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে কর্ণেল তাহের বাংলাদেশ বেতারে আসেন। জিয়া বেতার ভাষণে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা দেন। ঐ সময়ে ঠিক হয় জিয়া এবং তাহের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সিপাহী জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ৮-৩০ মিনিটে খন্দকার মােশতাক রেডিওতে ভাষণ দিতে এলে তাহের তাকে বের করে দেন এই বলে যে চক্রান্তের রাজনীতির দিন শেষ হয়ে গেছে।” ১৮. কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের শহীদ মিনারে পূর্ব নির্ধারিত ভাষণ দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমানকে আনতে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দেখতে পেলেন পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। শহীদ মিনারে যাওয়ার জন্য বললে, জিয়াউর রহমান তাহেরকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলেন যে, তিনি একজন সৈনিক, পাবলিক প্লেসে মিটিং করা তার ঠিক হবেনা। জিয়া সেভ করে ড্রেস পরেছেন, মনে হলাে বন্দীস্মৃতি ভুলে গেছেন। ১৯. বেলা ১১ ঘটিকায় সেনা সদরে মিটিং অনুষ্ঠিত হয় জেঃ ওসমানী, জিয়া, তােয়াব,

এম,এইচ খান, খলিলুর রহমান, আবু তাহের এবং প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী মাহবুব আলম চাষী উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট রাখার বিষয়টি পুনঃসিদ্ধান্ত হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অধীনে রাখার জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের প্রস্তাব করলে আলােচনার এক পর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার খলিলুর রহমান ও ওসমানী বিরোধিতা করেন। এ পর্যায়ে সেনা, বিমান, নৌবাহিনী প্রধানদের উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে নিযুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় আরো স্থির হয় বাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া হবে। রাজনৈতিক কার্যক্রম চলতে দেয়া হবে এবং মােশতাক এবং সায়েমের প্রদত্ত নির্বাচনী তারিখের পূর্বেই সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। বিচারপতি সায়েম উপদেষ্টা পরিষদের সাহায্যে কেবলমাত্র অন্তবর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করবেন। ১২ ৭ই নভেম্বর সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিনিটে জিয়াউর রহমান বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার উত্থাপিত ১২- দফা দাবী স্বাক্ষর করেন।১৩ ২০. ৮ই নভেম্বর হতে ১১ই নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার কাজে জিয়াউর রহমান বারংবার কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের সাহায্য গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী সৈন্যরা অফিসারদের হত্যা শুরু করে এবং ৮ তারিখ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ক্যাপ্টেন সিতারা, মেজর করিম, ক্যাপ্টেন আনােয়ার, লে মুস্তাফিজ, মেজর আজিম, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন খালেক ও লেঃ সিকান্দার উত্তেজিত সিপাইদের হাতে নিহত হন। সেনানিবাসগুলিতে ক্ষমতা সংহত করার পর পরই জিয়াউর রহমান ২৪ নভেম্বর কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতার করে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেয়। একই সঙ্গে রব, জলিল ও অন্যান্য জাসদ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ২১. ১৯৭৪ সনের জুলাই মাস থেকে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উস্কানী ও বিশৃংখলামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা এবং ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের জন্য কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৪ উল্লেখ্য যে, ২১ শে জুন ৭৬ কর্ণেল (অবঃ) তাহের-এর বিচার শুরু হয়। ১৭ই জুলাই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার তাহেরের ফাঁসির আদেশ দেন। ২২. প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম তাহেরের মূত্য দন্ডাদেশ রহিত করে ক্ষমা প্রদর্শন করেনি। তাহেরকে অভিযােগপত্র পূর্বে দেয়া হয়নি। তাকে আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দেয়া হয়নি। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুযােগও দেয়া হয়নি। তাহের তার বিরুদ্ধে অভিযােগের সত্যতা সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী মেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান, এম, জি, তোয়াব, এম, এইচ খানকে সাক্ষ্য হিসেবে ট্রাইব্যুনালে আনার দাবী জানান। তাও গৃহীত হয়নি। ১৫

বিচারপতি থাকাকালীন সময়ে সায়েম পূর্ণচন্দ্র মন্ডলের ফাঁসির আদেশ ছুঁড়ে ফেলেছিলেন এই বলে যে, কোন বন্দীকেই আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়ােজনীয় সুযােগ না দিয়ে তাকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া যাবেনা। কিন্তু বিচারপতি সায়েম যখন প্রেসিডেন্ট হলেন তখন তার প্রদত্ত রায় উল্টে দিয়ে তাহেরকে ক্ষমা প্রদর্শনের সুযােগ দিতে ব্যর্থ হলেন। ১৬ কেননা, সামরিক শাসনে সায়েম নয়, জিয়াই ছিলেন মূল প্রশাসক। ২৩. উল্লেখ্য যে, কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে গ্রেফতারের কয়েকদিন পর তাকে রাজশাহী কারাগারে নেয়ে যাওয়া হয়। ২২ শে মে রাজশাহী হতে তাকে পুনরায় ঢাকা আনা হয়। ১৫ ই জুন ১৯৭৬ সনে বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক অফিসার কর্ণেল ইউসুফ হায়দার চেয়ারম্যান ও প্রসিকিউটর হিসেবে এটি এম, আফজাল দায়িত্ব পালন করেন। তাহেরের ফাসির পর বিচারপতি হিসেবে পুরস্কৃত হয়ে এ,টি,এম, আফজাল বলেছেন যে, আমি তাহেরের মৃত্যুদন্ডের খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। তিনি দাবী করেছেন, প্রসিকিউটার হিসেবে তিনি তাহেরের মৃত্যুদন্ড দাবী করেননি।১৭ প্রকৃত প্রস্তাবে ‘লিগ্যাসী অফ ব্লাড’ বইতে এন্থনী মাসকারানহেস যথার্থই বলেছেন,

তাহেরের মৃত্যু একটি হুকুমের হত্যা। হুকুমদাতা মেজর জেনারেল জিয়া।১৮ ২৪. খালেদ মােশাররফকে দিয়ে রশীদ-ফারুককে হটিয়ে, মােশতাককে তাড়িয়ে, ওসমানী -খলিলকে সরিয়ে এবং খালেদকে হত্যা করে, সর্বোপরি কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে ফাসি দিয়ে জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার সিঁড়িতে ওঠার কাটা দূর করেছেন নির্ভুল ব্লু-প্রিন্টে। এক্ষেত্রে তিনি অনন্য ও অসাধারণ।।

Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ

Reference list for this chapter

চতুর্থ অধ্যায়

দরখাস্তের রাজনীতিঃ চক্রান্ত

১। পাকিস্তান সেনা কাঠামাের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণা ও আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। পাকিস্তানী রাজনীতির প্রাসাদ চক্রান্তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা ১৯৫৮ সনের ৭ই অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ ভেংগে দেন। রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত এবং ১৯৫৬ সনে রচিত শাসনতন্ত্রের মৃত্যু বলে ঘােষণা করেন। একই সাথে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ২৭শে অক্টোবর অস্ত্রের মুখে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার নিকট হতে পাকিস্তানের পেসিডেন্ট পদটি গ্রহণ করে একাধারে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, প্রধান সামরিক প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেন। বলাবাহুল্য জেনারেল আইয়ুবের এ ধরনের অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রতিটি অফিসার ও সেনা সদস্যদ্বারা ব্যাপক ভাবে সমর্থিত হয়েছিল। ‘নিজের রাষ্ট্র দখলের’ আনন্দে পাকিস্তানী অফিসার ও সেনা সদস্যগণ প্রকাশ্যতঃ গর্ববােধে উল্লাসিত হয়ে উঠেছিলাে।জেনারেল আইয়ুবের এই ধারা ও পরবর্তী পদক্ষেপের মাধ্যমে এক দশকের বেশীকাল ধরে তিনি ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। 

২। জেনারেল আইয়ুবের এই পদক্ষেপগুলাে সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে তদানীন্তন ক্যাপ্টেন জিয়ার মনে স্বাভাবিকভাবেই গভীর রেখাপাত করে থাকবে। জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসনের পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহণের পর তার বিশেষভাবে প্রয়ােজন হয়ে পড়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা প্রবাহের নিখুঁত তথ্য প্রাপ্তির। জেনারেল আইয়ুবের একথাও অজানা ছিলনা যে তার কাঙ্খিত শাসন ক্ষমতার প্রতিবন্ধকতা আসবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে। সেজন্য পূর্ব পাকিস্তানে উপর তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত জরুরী ছিলাে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেসরকারী প্রশাসনের উচ্চপদসমূহে যেমন পরিবর্তন সাধন করেন, তেমনি গােয়েন্দা সংস্থাগুলিতে বিশ্বস্ত লােক নিয়ােগের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বাঙালী সেনা অফিসারদের মধ্যে জিয়াউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দাবাহিনীতে নিয়ােগ প্রাপ্ত হন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিলগ্নে জিয়াউর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগে পাঠান যখন সামরিক শাসনের উচ্ছাস কেটে গেছে। মওলানা ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল খালেক, হামিদুল হক চৌধুরী প্রমুখ কে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যাতে জেনারেল আইয়ুবকে ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন তার জন্য ‘পােরাে’ জারী করে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের যখন রাজনৈতিকভাবে ‘জবাই’ করার ব্যবস্থা জারী হয়েছে, যখন ছাত্র আন্দোলনে নতুন কৌশলে ও মাত্রায় ধূমায়িত হচ্ছে সেই মুহূর্ত পূর্ব পাকিস্তানের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য জেনারেল আইয়ুবের প্রশাসনে বিশ্বস্ত লােক প্রয়ােজন ছিলাে। সেই প্রয়ােজনের তালিকায় জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন খাটি বিশ্বস্ত এবং অনুগত ব্যক্তিত্ব। জিয়াউর রহমান জেনারেল আইয়ুব খানের ‘নেক নজরে’ ছিলেন। এ কারণে আইয়ুব খান তাকে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।১  

৩। সামরিক শাসনের আওতায় গােয়েন্দাগিরি করতে এসে সেদিনের তরুণ সামরিক অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা তাকে পরবর্তীকালে ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন পরিচালনায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। সন্দেহ নেই। 

৪। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট। জেনারেল সফিউল্লাহকে হটিয়ে জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতির পদ দখল করেন। ১৯৭৫ সনের ৩০শে আগষ্ট সামরিক ক্ষমতার বলে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। 

৫। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার ৫০ দিন পর ৩রা অক্টোবর ‘৭৫ লায়লাতুল কদরের পরম পবিত্র রাতে স্বঘােষিত প্রেসিডেন্ট খুনী খন্দকার মােশতাক : আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও টেলিভিশনে ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে ১৯৭৬ সনের ১৫ই আগস্ট থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা ও কাজকর্মের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ১৯৭৭ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করার কথা ঘােষণা করে।২  

৬। ৩রা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

এবং তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন করেন। খন্দকার মােশতাক সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি ছেড়ে  দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়ে বিচারপতি সায়েম জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। ভাষণে তিনিও জাতির সামনে দ্ব্যার্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, ১৯৭৭ সনে পূর্বঘােষিত ফেব্রুয়ারী মাসেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমনকি, সম্ভব হলে তার পূর্বেও নির্বাচন সম্পন্ন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়, ৭ই মার্চে সংঘটিত ঘটনাবলীর পরেও প্রেসিডেন্ট সায়েম পুনরায় জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা দৃঢ়তার সঙ্গেই ঘােষণা করেন। ১৯৭৫ সনের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত অপর এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট সায়েম জোর দিয়ে বলেন “বর্তমান সরকার অন্তবর্তীকালীন, অরাজনৈতিক এবং সম্পূর্ণ দল নিরপেক্ষ সরকার। সরকারের লক্ষ্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা”। 

৭. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাজনৈতিক দলবিধি জারী করেন। রাজনৈতিক দলবিধি জারী করার পূর্বেই ২৭শে জুলাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম ১৫ই আগস্টের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার ঘােষণা দেন এবং পূর্ব ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনরায় জোর দিয়ে বলেন। একই সাথে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি সায়েম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৩৮ জন নেতার ও উপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার উপস্থিতিতে একথা বলেন।৩  

৮। সরকারী সংবাদ সংস্থা বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়, উপস্থিত নেতৃবৃন্দ নির্বাচনের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিজ নিজ অভিমত ব্যক্ত করেন, তা থেকে সর্বসম্মত কিছু মত বেরিয়ে এসেছে যা সুষ্ঠু রাজনৈতিক আবহাওয়া ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হবে বলে মনে করা হয়। এই সভায় নির্বাচনের মাধ্যমে অতিসত্ত্বর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। সরকারও নিজেদের নিরপেক্ষ ও অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে যে ঘােষণা করেছে এবং সে ঘােষণার মর্যাদা রক্ষার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।৪  

৯। ২৮শে জুলাই সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে একটি ঘােষণা প্রচার করা হয় যে, রাজনৈতিক দল সমূহের গঠনতন্ত্র, তালিকা, ঘােষণা পত্র এবং কর্মসূচী সরকারের নিকট পেশ করার উদ্দেশ্যে আগামী ৩০শে জুলাই হতে ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলির কার্যক্রম ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই সরকারী বিধি ১৯৭৬ এর চতুর্দশ অনুচ্ছেদের (১) উপ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ক্ষমতা বলে সরকার এই বিজ্ঞপ্তি জারী করেছেন।

১০. লক্ষ্য করা গেল, কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে প্রেস সেন্সরশীপ আছে সত্বেও সরকারী প্রশ্রয়ে স্বাধীনতা বিরােধী গােষ্ঠী ঘরােয়া রাজনীতির নামে দেশের সংবিধানের মৌলনীতির বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করে দিয়েছে। এমনকি, প্রেস কনফারেন্স ডেকে সংবিধানের মূলনীতির বিরুদ্ধে প্রদত্ত বক্তব্য অদৃশ্য রহস্যজনক কারণে কিছু কিছু সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া শুরু হয়েছে। কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের বক্তব্য ও লক্ষ্য সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।৫  

১১. এক সময় ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ধারায় ছাত্রসংগঠন গড়ে তুলে দলীয় শক্তি বৃদ্ধির প্রাথমিক রিক্রুটমেন্ট হিসেবে ছাত্র সংগঠনকে বিবেচনা করা হতাে। ১৯৭৬ সালে সামরিক ফরমান বলে জিয়াউর রহমান ‘পলিটিক্যাল পার্টি রেগুলেশনস’ (পি পি আর) এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলােকে তাদের অংগ সংগঠনের নাম দলের সঙ্গে তালিকাভূক্ত করার নির্দেশ জারী করে। এর পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক দল সরাসরিভাবে অঙ্গ-সংগঠগুলােকে নিয়ন্ত্রণ করতাে না। জিয়ার আমলে পি,পি,আর-এর মাধ্যমে অঙ্গ-সংগঠনগুলােকে যুক্ত করার ফলে ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব মূল দলের উপরে এস পরে। ছাত্রদের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে টেনে আনা হয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

১২. প্রথম থেকে লক্ষ্য করা গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়া যেন সমান্তরালভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। অর্থ, তথ্য, শিক্ষা, বাণিজ্য এবং সামরিক শক্তির বদৌলতে জনগণ উপলদ্ধি করতে সক্ষম হলাে শাসনতান্ত্রিকভাবে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক যতই ক্ষমতাবান ব্যক্তি হন না কেন, মূল শক্তি জিয়াউর রহমান ও তার সেনাবাহিনী। তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। বিচারপতি সায়েম তার হাতের পুতুল মাত্র। কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির মাধ্যমে জিয়া তার ক্ষমতা জনগণের নিকট উলঙ্গভাবে প্রদর্শন করতে পেরেছে বিচারপতি সায়েম যথার্থ অর্থেই অন্তবর্তী কালীন সরকারের ভূমিকায় পার্লামেন্ট পদ্ধতির প্রতিশ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কার্পণ্য করেননি। ১৯৭৫ সনের ২২শে নভেম্বর রাজনীতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন যাতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যােগাযোগ ও পরামর্শ করে নির্ধারিত সময়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে পারেন। 

১৩। ২৫ ও ২৬ নভেম্বর ‘৭৫ এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ও তার সহকারীর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সংলাপ শুরু হয়। এর পাশাপাশি ২৪শে নভেম্বর রাত ১২টায় আকস্মিকভাবে মেজর জেনারেল জিয়া যে ভাষণ দেন তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। যে সময় প্রয়ােজন রাজনৈতিক সমঝােতা ও ঐক্য – যা প্রেসিডেন্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে সময় জিয়াউর রহমান আইয়ুব খানের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও দলকে দোষারােপ করে চরম ভাষায় কথা বলেন। [পরিশিষ্ট-৩] 

১৪. ঘরােয়া রাজনীতির সুবাদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পর্যালােচনা করলে স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল সরকারী নির্দেশের আওতায় একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছিল। রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী পুরাে আগস্ট মাস রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত থাকবে ঘরােয়া বৈঠকে। রাজপথে ময়দানে জনসভা, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দলের গঠনতন্ত্র, মেনিফেষ্টো দলিল দস্তাবেজ সহ দলগঠনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। সামরিক সরকার রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় যে সব দলের অনুমতি দেবেন তারা সেপ্টেম্বর হতে পুরােদস্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকান্ড পালন করতে এবং নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। রাজনৈতিক দল বিধিতে বহু কড়াকড়ি শর্ত ছিল। বিদেশী অনুপ্রেরণায় বা অর্থে কেউ দল গঠন করতে পারবে না। দলের নেতা দেশের নিরাপত্তা বা জনশৃংখলার পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ করতে পারবে না। দলের অর্থ তহবিল আয় ব্যয়ের উৎস প্রকাশ করতে হবে। কোন গােপন সংগঠন বা সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন বা রাখা যাবেনা। এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করতে পারবে না। সরকারী অনুমতি পাওয়ার পর কোন দল এ-ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে বা বিধি লংঘন করলে সরকার সে দলকে নিষিদ্ধ করতে পারবে।(পরিশিষ্ট-৪) 

১৫. রাজনৈতিক দলবিধির শর্তাবলী কড়াকড়ি ছিলাে। ছিলাে অঘােষিত ধমক। যদিও বলা হয়েছিলাে সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চালু করার জন্যেই এই দলবিধি। রাজনৈতিক দল বিধিতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় যে কথা বলা হয়েছিলাে তা ছিলাে অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। সামরিকশাসন জারীর থাকার প্রেক্ষিতে কতিপয় ধারা স্থগিত থাকলেও দেশের সংবিধানের মৌলনীতি নিয়ে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ নিয়ে তখন পর্যন্ত কোন বির্তক ছিলােনা। জাতীয়তা, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র সংবিধানের এই চার মৌলনীতি তখন পর্যন্ত সংবধানে সন্নিবেশিত ছিলাে। তখন পর্যন্ত সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা বিলুপ্ত করা হয়নি। 

১৬. এমন অবস্থায় রাজনৈতিক দলবিধি জারীর মাধ্যমে সংবিধান বর্ণিত ৪ মূলনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালার মধ্যেই দলগঠনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় এই যে, রাজনৈতিক দল গঠনকে সামনে রেখে কোন নেতা নতুন দল বা পুরনাে দলের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য কর্মসূচীর আকারে এমন কিছু কিছু বক্তব্য বাজারে প্রচার করেছে যা দেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। সংবিধানের মূলনীতিগুলিতে স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আশা আকাঙ্খার প্রতীকরূপে অলংঘনীয়তার দাবীদার। সংবিধান সংশােধনের ফলে সাবেক দলগুলির পুনরুজ্জীবন সম্ভব হলেও সংবিধানে বর্ণিত জাতীয় আদর্শ পরিপন্থী কোন দল গঠন করা যায়না। রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য ও ঘােষণাপত্র, কর্মসূচীকে রাজনৈতিক দলবিধির সাথে সাথে সংবিধানে উল্লেখিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল বিধিতে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন বিধান না থাকায় স্বাধীনতা বিরােধী জামাত মুসলিম লীগ নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে মাঠে নামানাের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার ফলে এই সব স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তিবর্গ প্রকাশ্যই যে ধরনের বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে, তা সংবিধানের লংঘন। 

১৭. ১০ই আগষ্ট ‘৭৬ বিকেলে পাকিস্তানী দালাল ও স্বাধীনতার বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা শফিকুর রহমানের বাসায় সাবেক নেজামে ইসলামী, সাবেক জামাতে ইসলামী, সাবেক পিডিপি ও সাবেক খেলাফতে রব্বানী পার্টির এক যৌথ ঘরােয়া বৈঠকে পাকিস্তানী দালাল মওলানা সিদ্দিক আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ‘ইসলামী আদর্শের’ ভিত্তিতে দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় স্বাধীনতা বিরােধী সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া ও জামাতের মওলানা আবদুর রহিমকে যুগ্ম আহবায়ক করে কমিটি গঠিত হয়। স্বাধীনতা বিরােধী শান্তি কমিটির নেতা সাদ আহমদকে আহবায়ক করে গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো কমিটি গঠন করা হয়। এর পাশাপশি আইয়ুব মােনায়েমের দালাল রসরাজ মন্ডলও তফশিলী জাতীয় ফেডারেশন পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবে রাজনৈতিক দলবিধি জরীর মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল গঠনের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হলাে। 

আওয়ামী লীগঃ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে 

১৮. জিয়াউর রহমান ও খুনী চক্রের নিকট স্বাধীনতার পক্ষের মূল দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার ক্ষেত্রে মূর্তিমান থ্রেট।  জিয়াউর রহমান  ও তার ‘অদৃশ্য চক্র’ আওয়ামী লীগকে ভেঙ্গে ফেলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ফেলার পূর্বে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট ভেংগে যায়। ১৯শে জুন বায়তুল মােকাররমে এক জনসভায় গজ দলের অন্তর্ভুক্ত ন্যাপ (মােজাফফর)-এর সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ বলেন, “দেশের গরীব মানুষ কেউ নৌকায় ভােট দেয়নি, তারা ভােট দিয়েছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা সমর্থন করে”। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট তার এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্যোগ করলে তিনি তার জীবনের বিনিময়েও সহযোগীতা করবেন।” ২১শে জুন পঙ্কজ ভট্টচার্য এবং মতিয়া চৌধুরী এক বিবৃতি দিয়ে বলেন, “ওই বক্তৃতা মােজাফফর আহমদের নিজস্ব, ন্যাপের নয়।”-এর পূর্বেই ন্যাপের ভাঙন শুরু হয়েছিল। সৈয়দ আলতাফ আর সুরঞ্জিত সেন সহ ৬ জনের প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়। ন্যাপ অনিবার্য ভাঙনের দিকে এগিয়ে যায়। শুরু হয় আওয়ামী লীগ নিয়ে চক্রান্ত। 

১৯. ‘৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়। জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাতিল ঘােষিত হয়। সামরিক শাসন জারী হয়। সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই সামরিক ফরমানের আওতায় সীমাবদ্ধভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার লক্ষে রাজনৈতিক দলগুলিকে রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় অনুমতি দেবার কথা ঘােষণা করা হয়। রাজনৈতিক ‘দলবিধি’র আওতায় আওয়ামী লীগ অনুমােদন লাভ করে এবং সংগঠনকে ঘরােয়া পরিবেশের মধ্যেও গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন ১৯৭৬ সনের ২১ নভেম্বর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করলে সামরিক শাসকগােষ্ঠী গণআন্দোলনের ভয়ে জনাব আবদুল মালেক উকিল, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রেফতার করে। কেননা আওয়ামী লীগ ছিলাে এমন একটি পার্টি, তৃর্ণমূল পর্যন্ত যার সংগঠন ছিল বিস্তৃত এবং যার ছিল লক্ষ লক্ষ ত্যাগী কর্মী। পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের শক্তি তখন পর্যন্ত কোনাে দলের ছিলাে না। উগ্রচীন, উগ্রডান, স্বাধীনতা বিরােধী দল ও চক্র আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার চাইতে নির্বাচন স্থগিতকে শ্রেয় মনে করে। এ পয়েন্টে জিয়াউর রহমান ও তাদের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। 

২০। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতক দল বসে ছিলােনা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার ব্লুপ্রিন্ট অনুসারে চার জাতীয় নেতা  সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ.এইচ, এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। 

 

২১. শুরু হয় অত্যাচার। নিপীড়ণ। নির্যাতন। গ্রাম বাংলার তৃর্ণমূল পর্যায় হতে শুরু করে সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে ৭৫-৭৬ সনের মধ্যেই গ্রেফতার করা হয়। দৈহিক অত্যাচারে অনেককে হত্যা করা হয়। গুম করা হয় লাশ। জিয়াউর রহমানের নির্দেশিত লেলিয়ে দেয়া সাদা পােষাকধারী গােয়েন্দা বাহিনী অনেক নেতা-কর্মীকে এত নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে দৈহিক অত্যাচার চালায় যার ফলে অনেক নেতা-কর্মী পঙ্গু হয়ে পরেন। অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। হিটলারের গােপন বাহিনীর মতাে এদের অত্যাচারের পন্থাও ছিল ভিন্ন ও নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। সামরিক শাসনের নিগড়ে শৃঙ্খলিত বাংলাদেশ। মৌলিক অধিকার নেই। বিচার নেই। শাসনতন্ত্র স্থগিত। মুখ বন্ধ। টু শব্দটি করার উপায় নেই। সামরিক শাসকগােষ্ঠীর এই নির্মম নিষ্ঠুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না। সামরিক ফরমানে ঘােষণা করা হয়েছে কথাবার্তা, আকার ইংগিত, চিহ্ন দ্বারা সামরিক শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে কিছু করলে বা বললে তার শাস্তি ৫ বছর কারাদন্ড হতে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত। জাতির জনক টুঙ্গিপাড়ার কবরে, সেখানে চব্বিশ ঘন্টা সশস্ত্র পাহারা। কেউ গেলে ধমকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। না মানলে গ্রেফতার করে। মােনাজাত করতে গিয়ে গ্রেফতার হন হাজী গােলাম মােরশেদ। বঙ্গবন্ধুর কবরে এই পাহারা ১৯৮০ সন পর্যন্ত বলবৎ ছিল।৯  ঢাকার ৩২নং বাড়ি ছিলাে তালাবদ্ধ। বাড়ির সামনে যেতে দেয়া হত না। বাড়ির সামনে দাঁড়ালে ধমক খেতে হতাে। কি নির্মম নিষ্ঠুর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন! 

২২. বিরাজমান এমনি ভয়াবহ অবস্থায় মুজিব অনুসারীদের বিভক্ত ও দুর্বল করার চক্রান্ত চলে। প্রাসাদ চক্রান্তের কুটিল খেলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। 

১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই। গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রচনার কথা বলে সরকার সামরিক ঘােষণায় রাজনৈতিক দলবিধি জারী করলেন। বললেন, যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করতে চায়, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায়, দল গঠন করতে চায় তাদের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় দল গঠনের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত জমা দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত। নিহত জেলখানায় চার জাতীয় নেতা। ১৯৭৫ সনের ২৫শে জানুয়ারী জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠনের পর আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আর ছিলাে না। আবদুস সামাদ আজাদ জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আমির হােসেন আমুসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ কারাগারে। এই অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিলাে পিপিআর-এর অধীনে আওয়ামী লীগ দল গঠন করবে কিনা? আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেদনাদায়ক ঘটনাবলীকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গােপন বৈঠকে বসলেন। ১৯৭৩ সনে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির মধ্যে মাত্র ৮ জন বর্তমান। এমতাবস্থায় মহিউদ্দিন আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, জহুরুল কাইয়ুম, আবদুল মান্নান, সালাউদ্দিন ইউসুফ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, সােহরাব হােসনে, কামরুজ্জামান ফনীভূষণ মুজমদার, লুৎফর রহমান, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, মােঃ হানিফ, সিরাজুল ইসলাম, ফজলুল হক ভূঁইয়া প্রমুখ বৈঠকে উপস্থিত হলেন। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে দল গঠন করা হবে। কেননা বঙ্গবন্ধুর বিশাল কর্মী বাহিনীকে সাংগঠনিক কাঠামােয় ধরে রাখতে হবে। 

২৩. ১৯৭৩ সনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির গঠনতন্ত্রের ক্রম অনুসারে সিনিয়র সহ-সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর উপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকার দায়িত্ব অর্পিত হলাে। বেগম সাজেদা চৌধুরী তখন হাসপাতালে অসুস্থ। তার মধ্যেও তাকে দায়িত্ব নিতে হল গঠনতন্ত্র মােতাবেক ও নেতৃবৃন্দের অনুরােধে। এবং সর্বোপরি দলের ধারাবাহিকতায় দল গঠনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে। 

 

২৪. কাজী জহিরুল কাইয়ুমের বাসায় প্রায় বৈঠক হতাে। আওয়ামী লীগ বৈঠকের জন্য জায়গা পাওয়াও ছিলাে দুষ্কর। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে না। জায়গা পাওয়া তাে দূরের কথা। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পেছনে ছায়ার মত গােয়েন্দা বাহিনীর লােক লেগে থাকতাে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির ২৬শে আগস্ট ৭৬ আনুষ্ঠানিক সভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সভার শুরু হয়। সভায় প্রথমেই সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর প্রস্তাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ও ওবায়দুর রহমানকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। দলের একটি অংশ আইনগত প্রশ্ন তুলে বহিষ্কারাদেশ না দিয়ে প্রাথমিকভাবে ‘শােকজ’ করার দাবী জানান। কিন্তু তা নাকচ হয়ে যায়। 


২৫. পরবর্তী মিটিংগুলােয় ঠিক হয় পিপিআর-এর অধীনে দলের গঠনতন্ত্র ও ঘােষণাপত্র জমা দিয়ে দল গঠনের অনুমতি নিতে হবে। সিদ্ধান্ত হয় ৪ মূলনীতি অক্ষুন্ন থাকবে। মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধু’ কথাটি সন্নিবেশিত হবে।

২৬. ৯ই অক্টোবর ৭৬ সনে চার মূলনীতি বাঙালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এই রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতি যা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শন তার আলােকেই ঘােষণাপত্র এবং ঘােষণাপত্রের নিরিখে গঠন ঠিকঠাক করে জমা দেয়া হয়। ঘােষণা পত্রের মুখবন্ধে ‘বঙ্গবন্ধ’-এর নাম উল্লেখ করা হলাে। এরই মধ্যে সামরিক ফরমানে বলা হলাে কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে দল গঠন করা যাবে না। (পরিশিষ্ট-৫)। 

২৭. কয়েক দিন পরেই আইন, বিচার ও সংসদ মন্ত্রণালয় হতে চিঠি এলাে “The very word ‘Banghbandhu’ should be omited.” ১৮ই অক্টোবর ৭৬ বেগম সাজেদা চৌধুরী এই পত্র হাতে পেলেন। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই ‘না-সূচক’ চিঠিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের দাখিলকৃত দলিলপত্রের বক্তব্য ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির (১০)নং ধারার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। (পরিশিষ্ট-৪)। 

২৮. দলে সংকট সৃষ্টি হলাে। ইতমধ্যে প্রায় এক ডজন দল অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলের একাংশ বললেন, নামে কী আসে যায়। বঙ্গবন্ধু তাে আমাদের হৃদয়ে আছেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ বঙ্গবন্ধু ব্যতীত দলের অনুমতি নেয়ার প্রয়ােজন নেই। শুরু হলাে দ্বন্দ্ব। 

২৯. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে জাতীয় অধ্যাপক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা হয়ে তিনি ক্ষমতায় বসেছেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে তিনি বললেনঃ বঙ্গবন্ধু, চার নীতি বাদ দিতে চাও না কেন? বাদ দিয়ে দলের অনুমতি নাও। সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী স্পষ্টভাবে মুখের উপর বলে এলেন ঃ আমি বিশ্বাসঘাতক নই। আবুল ফজল বললেন ঃ ঐ জন্যই তাে জিয়া তােমাকে দেখতে পারে না। 

৩০।তারপরেও চাপ অব্যাহত থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে বললেনঃ তুমি আমার মেয়ের মত। আমি পরামর্শ দিচ্ছি। কেন মাত্র ৪টি অক্ষর ব-ঙ্গ-ব-ন্ধু নিয়ে জেদ ধরছে। নামটি বাদ দিয়ে অনুমতি নাও। সাজেদা চৌধুরী পার্টির পক্ষ হতে বললেনঃ ‘বঙ্গবন্ধু’ ঐ চারটি অক্ষরের মধ্যেই বাংলাদেশ নিহিত।১১  

৩১. মিজান চৌধুরীর বাসায় চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠল। জোরেশােরে বলা হতে থাকলাে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়েই দলের অনুমতি নিতে হবে। মহিউদ্দিন আহমেদ ও সাজেদা চৌধুরী গ্রুপ বললেনঃ এটা হতে পারে না।

৩২। তখন মিটিং করার জায়গা ছিলােনা। ছিলােনা অফিস। খন্দকার হাবিবুর রহমান ৯১, নবাবপরের ৩ তলায় আওয়ামী লীগের অফিসের ব্যবস্থা করে দেন। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ২৫শে অক্টোবর ৯১ নবাবপুরে পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রস্তুতি কমিটির সকল সদস্য, সাবেক আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, বা তাদের অবর্তমানে প্রতিনিধি (কেননা বহু জেলা নেতৃবৃন্দ কারাগারে ছিলেন) গণপরিষদ সদস্য, সাবেক সংসদ-সদস্যদের সমন্বয়ে বর্ধিত সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরােধ জানান। অন্যদিকে ২৭শে অক্টোবর মিজান চৌধুরী তার ৩২নং ধানমন্ডি রােডের ৬৬০ বি নম্বর বাসভবনে অনুরূপ সভা আহ্বান করেন। 

৩৩. এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ২৫শে অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভা ৯১ নবাবপুরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিনের আহমদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংগঠনের নীতি আদর্শ লক্ষ্য এবং বঙ্গবন্ধুর নাম সংযুক্তকরণের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং মুজিব সৈনিকদের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানান হয়। এই জরুরী সভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক বেগম সাজেদা চৌধুরী একটি বিবৃতি প্রদান করেন— “গত ২৫ আগস্ট সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কর্মীদের সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত হয় তার ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার জন্য সাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীকে আহবায়ক করে একটি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে। কিছুদিন থেকে আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করে আসছি যে, এই প্রস্তুতি কমিটির দায়িত্বের পরিধির ব্যাপারে বেশ ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তব অবস্থা হচ্ছে এই প্রস্তুতি কমিটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। ইহা মূল কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির অধীনে একটি অস্থায়ী উপপরিষদ। কোন সাংগঠনিক সভা আহবান এবং তৎপরতা এই উপ-পরিষদের আওতায় বাইরে।”১৩ 

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর এই বিবৃতির পর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে বহু দেন দরবারের পর দু’টি সভাই বাতিল ঘােষিত হয়। ২৯শে অক্টোবর মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাসভবনে এক বৈঠকে স্থির হয় যে, ৩১শে অক্টোবর সকাল ১০ ঘটিকায় মতিঝিলের হােটেল ইডেনে সাবেক আওয়ামী লীগের প্রাক্তন গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য, সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। কোন কারণে কর্মকর্তারা উপস্থিত হতে না পারলে সংগঠনের পরবর্তী কর্মকর্তারা যােগ দিতে পারবেন। মিজান চৌধুরীর বাসায় সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-এর সভাপতিত্বে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ইতিমধ্যে পার্টির মধ্যে চক্রান্তের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে আইন সংসদ বিষয়ক তদানীন্তন সচিব অবগত করান। তদানীন্তন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব ২৭শে অক্টোবর রাতের অন্ধকারে লুঙ্গি পরে তেজতুরী বাজারে এসে মহিউদ্দিন আহমদ ও বেগম সাজেদা চৌধুরীকে গােপনে সংবাদ দেন যে, মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগের দল গঠনে অনুমতি পাওয়ার জন্য গােপনে আর একটি দরখাস্ত জমা দিয়েছে। 

৩৪. জনাব মহিউদ্দিন আহমদ-বেগম সাজেদা চৌধুরী হতবাক হয়ে যান। চক্রান্ত কোন পর্যায়ে গেছে জানতে পেরে কৌশল গ্রহণ করেন এবং ২৯ তারিখে মিজান চৌধুরীর বাসায় গিয়ে মিটিং করেন এবং ৩১ তারিখে আহুত সম্মেলন সাফল্যমন্ডিত করার ক্ষেত্র প্রশস্ত করেন। মহিউদ্দিন-সাজেদা চৌধুরী গ্রুপের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলাে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে দলীয় নেতা-কর্মীরা সমস্ত চক্রান্ত ভেঙ্গে ফেলতে পারবে। 

৩৫. ৩১শে অক্টোবর ‘৭৬। ঐতিহাসিক হােটেল ইডেন। হােটেলের মালিক দারােগা চাচা। একটি পয়সা নেননি। সম্মেলনের জায়গা দিয়েছিলেন। প্যান্ডেল করতে হবে। টাকা নেই। হাজী চাঁদ মিয়া সাধারণ সম্পাদিকাকে বললেন, “আমি আছি, আপনে আগাই যান।”- সে সময় এই ‘ছােট কথাটুকুর কি যে মূল্য ছিল’ আজকের পরিবেশে তা উপলব্ধি করা যাবে না! 

প্যান্ডেল হল। মঞ্চ হল। মঞ্চে একটি শূন্য চেয়ার। যে চেয়ারে বঙ্গবন্ধু ৭৩ সনে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে হাজী চাঁদ মিয়া সে চেয়ারটি রেখেছিলেন সযত্নে। সেই চেয়ার। সেই চেয়ারের দু’পাশে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা। আর চেয়ারে স্থাপিত হলাে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষন্ন অথচ দূত্যিময় এক ছবি। এসব দেখে মিজান গং বললেনঃ এখানে ছবি কেন? -আমাদের মারতে চাও নাকি।১৪ 

৩৬। সম্মেলন শুরু হলাে। রাস্তায় বিডিআর। পুলিশ। সাদা পােষাকে লােক এসে ইডেন হােটেলের মালিক চাচার নিকট জানতে চায়-হােটেল ভাড়া নেয়া হয়েছে কিনা। এসব আঁচ করতে পেরে দারােগা চাচা পূর্বেই সাদা কাগজে রেভিনিউ স্টাম্পের উপর সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীর স্বাক্ষর করে নিয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদিকার রিপাের্ট নিয়ে কথা উঠলাে। কথা হয়েছিলাে ঐ রিপাের্ট অধ্যাপক ইউসুফ আলী দেখে দেবেন। রাতে মহসীন আলীর স্ত্রী এলেন। বললেন, রিপাের্ট নিয়ে চলুন আমার বাড়িতে। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও অন্যান্যরা ওখানে আছেন। সাধারণ সম্পাদিকা বললেন ঃ চলুন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির ওখানে। ওনারা গেলেন। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব মহিউদ্দিন অসুস্থ ছিলেন। বললেন ঃ রিপাের্ট আমি দেখেছি। আর কাউকে দেখানাের প্রয়ােজন নেই। রিপাের্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকান্ডের নিন্দা ছিলাে।  

৩৭। ৩১শে অক্টোবর হােটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমদ। সভায় রাজনৈতিক দল বিধির শর্ত মােতাবেক দলের ঘােষণাপত্র সংশােধন করে পুনরায় তা দাখিল করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও চার নেতার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ভাষণ দেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী গত ২৫শে আগস্ট অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভা থেকে শুরু করে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সময়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ ঘটনাবলীর রিপাের্ট পেশ করেন। প্রায় ৮০% সংসদ সদস্য, জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত হন। বাইরে হাজার হাজার কর্মীকে অধীর আগ্রহে সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়। সভায় মিজান চৌধুরী, জহিরুল কাইয়ুম, মােমিন তালুকদার, মালেক উকিল, মােল্লা জালাল, সালাউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ বক্তৃতা করেন। ১৬ 

৩৮. ২রা নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা এক বিবৃতিতে বললেন, ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনা থেকে শুধুমাত্র ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দ বাদ দিয়ে সংশােধিত আকারে পেশ করার যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তা ঠিক নয়। সাজেদা চৌধুরী বলেন, ঘােষণাপত্রের পুরাে প্রস্তাবনাই বাদ দেয়া হয়েছে। কেননা বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলীয় অনুমতি নেয়া সম্ভব নয়, বিধায় আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ স্বরূপ মুখবন্ধ ‘ব্ল্যাংক’ রেখে ঘােষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র জমা দিয়েছে। 

৩৯. ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অনুমতি লাভ করে। ৯১ নবাবপুরে বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠানাে হলাে। আওয়ামী লীগের সাইনবাের্ড টানানাে হলাে। জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। সমগ্র নবাবপুর রােড স্তব্ধ। শােকাহত। নেতারা গেলেন না। কর্মীরা এলেন। এলেন মােল্লা জালাল ও ফনী মজুমদার। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মীরপুর বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়। ৯১ নবাবপুরে মিলাদের আয়ােজন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এ সকল অনুষ্ঠানে যােগ দেয়। 

৪০. ৪ ঠা নভেম্বর অনুমােদন লাভের পূর্বে মিজান চৌধুরী বললেন, যুবলীগ সংগঠনের দরকার নেই। দাখিলকৃত গঠণতন্ত্রে ছিল না। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদিকা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নতুন করে লিখে দিয়ে এলেন “আওয়ামী লীগের একটি যুব সংগঠন থাকিবে তাহা আওয়ামী যুবলীগ নামে পরিচিত হইবে।” আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জেলা শহরের ঘরােয়া পরিবেশে কর্মী সম্মেলনের কর্মসূচী দিলেন। ২১শে নভেম্বর প্রথম সভা হলাে ময়মনসিংহে। মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ছবি টানানাে হলাে। কর্মীসভা জনসভায় পরিণত হলাে। ২৫শে নভেম্বর টাঙ্গাইলে কর্মীসভার পূর্বে মিছিল সহকারে কর্মীসভার স্থানে গেলেন-মালেক উকিল, আব্দুল মান্নান, সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, ফারুক প্রমুখ। তারা বক্তৃতা করেন। ২১শে নভেম্বর তারিখে ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বন্ধ করা হলাে। ২৯শে নভেম্বর সাধারণ সম্পাদিকাকে গ্রেফতার করা হলাে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আত্মগােপন করলেন। মালেক উকিল গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হন আবদুল মমিন তালুকদার, সালাহউদ্দিন ইউসুফ প্রমুখ। ষড়যন্ত্র শুরু হলাে। শুরু হলাে ব্যাপক ধরপাকড়। কেবল মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, মােল্লা জালাল এদের গ্রেফতার করা হলাে না। 

৪২। আওয়ামী লীগ বিভক্ত করার চক্রান্ত দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হলাে। মিজান চৌধুরী মােস্লা জালাল প্রমুখ বিভিন্ন জেলায় কর্মী সমাবেশে যেতে লাগলেন। কর্মীরা প্রশ্ন করতে লাগলাে অন্য নেতারা জেলে, আপনারা বাইরে কিভাবে? কর্মীদের প্রতিরােধের মুখে ষড়যন্ত্র বেশী দূর এগুতে পারেনি। জহুরুল কাইয়ুম, ময়েজ উদ্দিন, কামরুজ্জামান, লুৎফর রহমান, ফজলুল হক বিএসসি, ফজলুল করীম, মফিজুল ইসলাম খান কামাল প্রমুখ উদ্যোগ নিয়ে বেগম জোহরা তাজুদ্দিনকে পার্টির আহবায়ক করা হয়। চক্রান্ত করা হয় সেখানেও। ‘নেপথ্য নায়ক’ বলে পার্টি কর্মীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়। আহবায়ক কমিটি তারপরেও দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে। ১৯৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আবদুল মালেক উকিল সভাপতি ও আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর পরও চক্রান্ত চলতে থাকে। সে চক্রান্ত পরবর্তী অধ্যায়ে আলােচিত হয়েছে।

একটি নামে এত ভয় 

৪৩. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা হতে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেবার চক্রান্ত, জারী হলাে সামরিক ফরমান। বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে রাজনৈতিক দলবিধি জারীর প্রাক্বালে বৈঠক করেন। বৈঠকে জিয়াউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি আওয়ামীলীগের নেতাদের সঙ্গে আলােচনা কালে বলেন, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি তাে আওয়ামীলীগেরই। আপনারা কাজ চালিয়ে যান। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় হলাে এইযে, গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো জমা দেবার কিছুদিনের মধ্যে এক সামরিক ফরমান জারী করা হয়। সামরিক ফরমানে ঘােষণা দেওয়া হয় যে, “জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কোন পারসােনালিটি ‘কাল্ট’ প্রচার ও প্রকাশ করা যাবে না।” পিপিআর-এ প্রথমে এ শর্ত ছিলােনা। 

৪৫. বলাবাহুল্য আওয়ামীলীগের গঠনতন্ত্র ও দলিলাদিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উল্লেখিত ছিলাে। জিয়ার সামরিক সরকার সামরিক ফরমান জারী করে নাম-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এই মর্মে আওয়ামীলীগের দলিলাদি সরকারী তরফ হতে ফেরত পাঠানাে হয়। কার্যনির্বাহী কমিটিতে ‘বঙ্গবন্ধু’ নাম থাকা না থাকার উপর আলােচনা হয়। আলােচনায় গঠনতন্ত্রে ও ঘােষণাপত্রে নাম রাখা না রাখা নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কে যে সব নেতৃবৃন্দ ‘বঙ্গবন্ধু’র নাম রাখার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন তাদের কিছুদিনের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর লিখিত একটি পুস্তক। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ-চক্রান্ত সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়।১৭ 

ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ব্যক্তি উচ্চাভিলাস চরিতার্য করার নিমিত্তে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের প্রথমার্ধেই ৬২,০০০ (বাষট্টি) হাজার রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের কারাগারে আটক রাখে, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিলাে আওয়ামীলীগ যুবলীগ ছাত্রলীগ শ্রমিক লীগের নেতা ও কর্মীবৃন্দ।১৮ 

৪৬. জিয়াউর রহমান আওয়ামীলীগে যােগদানের এবং বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের নিকট ইচ্ছা প্রকাশ করেন।১৯ যা ছিলাে সম্পূর্ণ প্রতারণাপূর্ণ এবং ক্ষমতা সংহত করার জন্য সময় ক্ষেপনের কৌশল।

Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব – অধ্যাপক আবু সাঈদ

Reference list:

পঞ্চম অধ্যায়

আমি সৈনিক ও রাজনীতিবিদ নই

আমি ব্যারাকে ফিরে যাবাে।

১. রাত ১২.১মিনিট। ১৯৭৬ সনের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারী। দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ। চারদিকে উদ্যত সঙ্গীণ। টিভি রেডিও-তে প্রায় প্রত্যহ প্রচার হচ্ছে সামরিক এলান। কেউ সামরিক প্রশাসক ও সামরিক শাসন সম্পর্কে কথা বললে বা আকারে ইঙ্গিতে এর বিরুদ্ধোচ্চারণ রাখলেও যাবজ্জীবন কারাদন্ড, এমনকি মুত্যুদন্ড। রাত দশটা থেকে ভাের পর্যন্ত কার্ফ্যু। রাতের ঢাকা নীরব,নিশ্চুপ স্থীর।এই অবস্থার মধ্যে রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে এলাে ট্রাক-শ্রমিকের মিছিল। চীনপন্থী নেতা কাজী জাফর এদের নিয়ে এসেছেন টঙ্গীর শিল্প এলাকা হতে। মুখে তাদের শ্লোগান ‘জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ। একুশে ফেব্রুয়ারী অমর হােক’।শহীদ মিনারের কাছাকাছি আসতেই ওয়াকিটকিতে সংবাদ চলে গেলাে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার নিকট। জিয়া হাসলেন মৃদু। সাফারী স্যুট ঠিক করে নিলেন। তারপর সামরিক প্রহরায় বের হলেন সদর্পে,শহীদ মিনারে পৌছলেন, দাঁড়ালেন চারদিকে তাকালেন। তখন শ্লোগান চলছে জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদমালা হাতে এগিয়ে গেলেন শহীদ মিনারের বেদীতে দাঁড়ালেন। আগত শ্রমিকদের মাঝে গিয়ে তাদের নিয়ে মালা প্রদান করলেন।

২. ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা। জনাব মতিউর রহমানের বাসা। একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন উপলক্ষ্যে এক বৈঠক। বৈঠকে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান শহীদ দিবস উদযাপন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। মহান শহীদদের প্রতি বাঙালী জাতির পক্ষ হতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটি গঠন করার প্রস্তাব উত্থাপন হয়। দেশের সাংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী ও বরণ্যে ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।এই কমিটির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হয়, কমিটির প্রায় সকলের বিরুদ্ধে জারী করা হয় গ্রেফতারী পরােয়ানা। জেনারেল আইয়ুব খানের আমলেও কড়া সামরিক শাসনের মধ্যে ২১শে ফেব্রুয়ারী মহান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এরূপ গ্রেফতার ও কড়াকড়ি আরােপ করা হয়নি। জেনারেল জিয়ার আমলে কেন্দ্রীয় শহীদ দিবস উদযাপন কমিটিকে কাজ করতে দেয়া হলাে না, নেতাদের গ্রেফতার করা হলাে, জারী হলাে গ্রেফতারী পরােয়ানা। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিলাে তারা শহীদ দিবস উদযাপনের নামে সমগ্র বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য উস্কানী দিচ্ছে।

৩. এ বিষয়ে পরবর্তীকালে হাইকোর্টে এক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘১৯৭৬ সনের ২১ শে ফেব্রুয়ারী শ্রমিকদের আইন শৃংখলা অবনতিতে কোন উস্কানী প্রদান করার সুযােগ ছিলােনা। মেজর জেনারেল জিয়া নিজে শ্রমিকদের নিয়ে এসে তাদের শ্লোগানের মধ্যে শহীদ মিনারে মালা দিয়েছেন,অন্যদের করেছেন গ্রেফতার। বলা হলাে  সাবেক মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস এবং জনাব নূরুল ইসলামকে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে গ্রেফতার করা হয়েছে। শনিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিযে বাসস একথা জানায়। এরা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও জন নিরাপত্তার প্রতি ক্ষতিকর তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাে। এভাবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনীতি আগমনের দ্বৈত কৌশল!

৪. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ

সায়েম বিচারপতি সাত্তারকে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক দেশে সাধারণ নির্বাচন (পার্লামেন্ট) অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, দলগঠন ও তৎপরতা চালানাের সহায়তা করার লক্ষ্যে উপদেষ্টার মর্যাদায় বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ে আন্তরিক ছিলেন না-যদিও প্রেসিডেন্ট সায়েম তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার পেসিডেন্ট সায়েম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করেন নি। তিনি জেনারেল জিয়া ও তার সহযােগী সামরিক জান্তার চক্রান্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করার পূর্বে এবং এ বিষয়ে সামরিক ফরমান জারী করার পূর্বেই নির্বাচন স্থগিত করার চক্রান্তের রপ্রিন্ট অনুযায়ী দেশের স্বাধীনতা বিরােধী দলসমূহের এবং চৈনিক পন্থী দলসমূহের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। নিরপেক্ষতা দেখানাের জন্য মাঝে মধ্যে এসব বৈঠকে আওয়ামীলীগের কোন কোন নেতৃবৃন্দকেও ডাকা হতাে। 

৫এমনি একটি বৈঠক ডাকা হয় ২৩শে জানুয়ারী ৭৬ সনে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে সন্ধ্যায়

বঙ্গভবনে এক বৈঠক মিলিত হন। বাসস জানায় যে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুসংহত করার জন্য নয়া ব্যবস্থাবলী পর্যালােচনা করা হয়। বৈঠকে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কেও ফলপ্রসূ আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব তােফাজ্জল আলী, জনাব আবদুস সবুর খান, জনাব হাসিমুদ্দিন আহমদ, ডঃ আলীম আল-রাজী, জনাব শফিউর রহমান, জনাব নুরুর রহমান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, জনাব সিরাজুল হােসেন খান, জনাব অলি আহাদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) আবদুল হালিম চৌধুরী, কাজী জাফর আহমদ, জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক (নান্নামিয়া) মওলানা সিদ্দিক আহমদ, মওলানা আশরাফ আলী, মওলানা আবদুর রহিম, জনাব আবদুল মান্নান, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মিসেস আমেনা বেগম।৪

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক খেলা

৬. স্বাধীনতা বিরােধী ও চৈনিকপন্থী রাজনীতিবিদগণ ভালাে করেই জানতেন

যথাসময়ে নির্বাচন হলে তাদের নেতৃত্বের মুখােশ খসে পরবে। সেজন্য তারা কৌশল হিসেবে ভারত বিরােধীতা ও আওয়ামী বাকশালীদের তাদের আক্রমণের মূল টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়। সীমান্ত অঞ্চলের কর্মকান্ডকে তারা ফঁাপিয়ে প্রচার করতে থাকে। যদিও সরকারী পত্রিকায় বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকায় দুস্কৃতকারীদের তৎপরতাসত্বেও সীমান্তের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক। সরকারীভাবে ভারত বিরােধী প্রচারণায় ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ভারতের প্রতিক্রিয়া এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মুখপাত্র বালাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)য় পরিবেশিত প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযােগ্যসম্প্রতি বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বিস্ময় ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বলে বাসসর খবরে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে বিবৃতি দিয়েছেন তার ওপর মন্তব্য করার অনুরােধ করা হলে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানান, সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ে প্রতিনিধিদলের দিল্লী সফরের সময় উভয়পক্ষ সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ব্যাপারে যে সমঝােতা হয়েছিলাে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা ভঙ্গ করা হয়নি।

সীমান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে পত্র পত্রিকায় যে খবর বেরিয়েছে তা জনসাধারণ ইতিমধ্যেই যা জানে তার অতিরিক্ত কিছু নয় বলেই মনে হয়। মুখপাত্র বলেন, প্রকৃতপক্ষে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে বিডিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল এবং বিএস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা বলেছিলেন। ভারত বিরােধী প্রচারণা ছড়ানােয় বালাদেশ সরকার জড়িত বলে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র যে ইঙ্গিত দিয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশ সরকারের নীতিই হচ্ছে তার সকল প্রতিবেশীর সাথে মৈত্রীবন্ধন দৃঢ় করা। মুখপাত্র বলেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা যা সারাদেশে বিরাজ করছে এবং জনসমর্থন যা সরকারের পক্ষে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলিতে যা স্বীকৃত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতার উল্লেখ বােধগম্য নয়। অন্য কোন কারণ অথবা উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে যে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

নয়াদিল্লী থেকে বাসস ও সমাচার পরিবেশিত খবরে বলা হয়, ভারতবিরােধী প্রচারণায় বাংলাদেশের পত্র পত্রিকা নতুন করে ফেটে পড়ায় ভারত বিস্ময় ও বেদনা প্রকাশ করেছে। পররাষ্ট্র দফতরের একজন সরকারী মুখপাত্র গত ২৯শে জানুয়ারী শুক্রবার বলেন, দুস্কৃতকারীদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, অর্থ অথবা আশ্রয়দানের অভিযােগ সর্ববৈ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, বিচারপতি জনাব এ সাত্তরের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের এক প্রতিনিধিদলের সম্প্রতি নয়াদিল্লী সফরকালে উভয় পক্ষ যে সমঝােতায় পৌছেছিলাে এবং যাতে উভয় পক্ষ বৈরী প্রচারণা হতে বিরত থাকা এবং তাদের জনগণের প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা উন্নয়নে কাজ করে যেতে সম্মত হয়েছিলাে তারই পরিপেক্ষিতে এই ভারতবিরােধী প্রচারণা পুনরুজ্জীবিত করার প্রচষ্টা একান্তভাবেই দুঃখজনক। তিনি আরাে বলেন, ভারত সরকার এই অপরিহার্য সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে যে, ঘরােয়া বাধ্যবাধকতা অথবা অন্য কোন কারণেই ভারতের জড়িত হওয়ার অভিযােগ করা হচ্ছে। তিনি অভিযােগ অস্বীকার করেন এবং এক শক্তিশালী, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ কামনা করেন। কারণ এটা ভারতের স্বার্থেই এবং উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও সহযােগিতার একটা কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য কাজ করে যাওয়ার ভারতীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্চস্যপূর্ণ।৬ 

ভুট্টোর উপছে পরা দরদ

৭. ভারত বাংলাদেশ এই ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সুযােগ নেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। তুরস্ক বসেই এক বিবৃতিতে তিনি বললেন ঃ ভারতবাংলাদেশ পরিস্থিতি অবনতি ঘটলে ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি নয়া অবস্থার সূচনা করবে। ৭ ঐদিন জিয়াউর রহমান জনাব ভুট্টো প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ একটি বক্তব্য। প্রদান করেন। সিলেট স্টেডিয়ামে এক জনসভায় বলেনঃ যদি বাংলাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হয় অবশ্যই তাতে গােটা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।৮ শুধু তাই নয়, এই সময়কালে জিয়াউর রহমান সরকারী অর্থ ব্যয়ে, হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে ও সামরিক বাহিনীর সমাগ্রিক সাহায্য নিয়ে সমগ্র দেশে আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করেন। একই সাথে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলখানায় চার জাতীয় নেতার হত্যার প্রতিবাদে দেশের সীমান্ত এলাকায় যারা প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলাে তাদের প্রতিরােধকে সামনে রেখেই জিয়া এসব ঘটনাকে ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে স্বাধীনতা গেল‘ ‘স্বাধীনতা গেলবলে সমগ্র দেশে ততালপাড় শুরু করেন।

প্রথম জনসভা ও রাজনৈতিক প্রতারণা

৮. ১লা মে ১৯৭৬। ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যান

রাজধানীতে মেজর জেনারেল জিয়ার প্রথম জনসভা। পূর্বেই চৈনিকপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতা ও শ্রমিকনেতাদের সর্বপ্রকার লজিস্টিক সার্পোটদেয়া হয়েছে। জনসভার সময় দুপুর ৩টায় ঘােষণা করা হয়েছে। প্রায় দুসপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শ্রমিক বেল্টে প্রতিনিধি পাঠানাে হয়েছে। যােগাযােগ করা হয়েছে। জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানার কর্মকর্তাদের ডেকে বলে দেয়া হয়েছে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনসভায় শ্রমিকদের নিয়ে আসতে হবে। তদানীন্তন এসব নির্দেশ সামরিক নির্দেশ বলেই বিবেচিত হতাে। ৫-২৩ মিনিট। মেজর জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীর বিরাট বহর নিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সজ্জিত মঞ্চে উঠলেন। চোখে চশমা। চারদিকে তাকালেন। হাত নাড়ালেন। শ্লোগান উঠলাে জেনারেল জিয়া, জিন্দাবাদ।সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনছার বাহিনী এবং সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় গঠিত ও

অর্থানুকূল্যে পরিচালিত তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধা সংসদ এবং স্বাধীনতা বিরােধী দল সমূহের কর্মী, চৈনিকপন্থী দলসমূহের শ্রমিক সংগঠন ও কর্মী এবং ঢাকার উত্মক জনগণ জনসভায় উপস্থিত। শ্লোগান ওঠে সিপাহী জনতা ভাই ভাই।প্রস্তুতি চলছিল পক্ষকাল ধরে। জনসভার আয়ােজকগণ পক্ষকালের একটানা পরিশ্রমে কর্মক্লান্ত, গলদঘর্ম। অথচ মাইকে বলা হলাে ঃ একদিনের ঘােষণায় এই বিশাল জনসভা। জনসভায় জেনারেল জিয়া সামরিক পােশাক পরে, প্রথমে বগলে ব্যাটন চেপে, পরে টেবিলে ব্যাটন রেখে জনসভায় উর্দুভাষী উচ্চারণে বাংলা জবানে ভাষণ দিয়ে বললেন ঃ বাংলাদেশের জনগণ বােঝে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বললেন ঃ যারা নতুন করে দেশ স্বাধীন করবে, প্রবাসী সরকার বানাবে এরা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবেনা। তিনি বললেনঃ ইনশাল্লাহ এদের ধংস করা হবে। তিনি বললেন, “আপনারা এদের ধংস করতে চান ? হাত তুলুন।তিনি আরাে ওয়াদা করলেন- জনগণের অধিকার তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। ন্যায় বিচার লাভের সুযােগ দিতেই হবে। কারণ ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আল্লাহ তাদের দিয়েছেন। তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবার অঙ্গীকার করেন।৯

৯. ১লা মে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করার ৯ দিনের মধ্যে ৮ই মে জনগণের অধিকারকে আরাে শৃংখলিত করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সমগ্র দেশকে ৯টি জোনে বিভক্ত করে ৯জন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ১৯৭৫ সালের ৮ই নভেম্বর ও ২০ শে আগষ্ট তারিখের ঘােষণা অনুসারে এবং ১৯৭৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী তারিখের আদেশ নং ১১৭-আইন রহিত করে আদেশটি জারি করা হয়। জোন-এ সমগ্র ঢাকা, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলাঃ ডিরেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ রাইফেলস; জোন বি-ঃসমগ্র সিলেট, কুমিল্লা ও নােয়াখালী জেলাঃ কমান্ডার, ৪৪-বিগ্রেড; জোন সি- চট্টগ্রাম বন্দর এলাকা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকা বাদে সমগ্র চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাঃ কমান্ডার ৬৫-বিগ্রেড; জোন-ডিঃচট্টগ্রাম বন্দর ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ কমোেডর কমান্ডিং চট্টগ্রাম; জোন-ইঃ সমগ্র খুলনা জেলা ও তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকাঃ ন্যাভল অফিসার ইনচার্জ; খুলনা জোন-এফঃ কমান্ডার, ৫৫ বিগ্রেড; জোন-জিঃ সমগ্র রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলাঃ কমান্ডার, ৯৩ সঁজোয়া বিগ্রেড; জোন-এইচঃ সমগ্র রংপুর ও দিনাজপুর জেলার কমান্ডার ৭২-বিগ্রেড; এবং জোন-আইঃ সমগ্র কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলাঃ কমান্ডার ১০৫-বিগ্রেড। এক সরকারী তথ্য বিবরণীতে একথা বলা হয়। ১০

১০. একই সময়ে চীনপন্থী বলে পরিচিতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে ফারাক্কা ইস্যুকে সামনে রেখে উসকে দেয়া হয়। মওলানা ভাসানীর পত্রের জবাবে মিসেস গান্ধী মাওলানা ভাসানীকে একটি পত্র দেন।১১ পত্রটি নিম্নরূপপ্রিয় মওলানা সাহেব, আপনার গত ১৯৭৬ সালের ১৮ই এপ্রিল লেখা চিঠি পড়ে আমি ব্যথিত ও মর্মাহত হয়েছি। এটা কল্পনা করাও কষ্ট যে, এক ব্যক্তি যিনি সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্গে কাধে কাধ রেখে সংগ্রাম করেছেন এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের নিজের জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে দুঃখ কষ্টে শরীক হয়েছেন, তিনিই আমাদের এমন গুরুতরভাবে ভুল বুঝবেন এবং এমন কি, আমাদের সম্পর্কে আন্তরিকতার প্রশ্ন তুলবেন। বরং আমি এটাই বিশ্বাস করবাে যে, আপনি প্রকাশ্য বিবৃতিতে ভারতের বিরুদ্ধে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রাসী উদ্দেশ্যের যে হুমকি দিযেছেন তা মুহূর্তের উত্তেজনাতেই। যে ভারত দৃষ্টান্তহীন দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে তার সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে তার প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বৈরী মনােভাব পােষণ করতে পারে বলে কোন বাংলাদেশী কি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন? ভারত সরকার ও জনগণ। এটা কামনা করেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তাদের সমর্থন ও সহযােগিতার আলােকেই তাদের দেখা হবে। আমাদের প্রয়ােজন অনেক বেশী এবং আমাদের জনগণের উপর বােঝাও অনেক। কিন্তু আমাদের উভয়দেশের জনগণের কল্যাণ পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। উভয়ের অভিন্ন স্বার্থেই এতদাঞ্চলে স্থিতিশীলতা এবং আমাদের দুদেশের মধ্যে সহযােগিতা ও বন্ধুত্ব থাকা প্রয়ােজন। আপনি তাে জানেন যে, ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ দীর্ঘদিন ধরেই পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা বন্দরকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় বলে বিবেচিত হয়ে আসছে, কাজেই এটাও ত্যাগ করা যায় না। আপনি এটাও জানেন যে, গ্রীষ্মকালে আনুমানিক দুমাসের মত সময়ে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যায়। আমাদের উভয়ের প্রয়ােজন মেটানাের ব্যাপারে ভবিষ্যতে কোন ঘাটতি দেখা দিলে পরস্পরের মধ্যে সমঝােতা ও সহযােগিতা থাকলে অবশ্যই একটা উপায় বের করা যাবে। হুগলী নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় ন্যূনতম পরিমাণ পানিও আমাদের জন্য রেখে আমরা বাংলাদেশের প্রবাহ ঠিক রেখেছি।

আমার মনে হয়, আপনাকে ঘটনার একটা দিক এবং বাংলাদেশে ফারাক্কা বাঁধের। ফিডার ক্যানালের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আপনি চাইলে, আমাদের হাইকমিশনার আপনাকে ঘটনার অপরদিক সম্পর্কে অবহিত করবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। সমঝোতা ও সহযােগিতার মনােভাব নিয়ে সমস্যার সমাধান কামনা করাটাই বড় কথা। মােকাবিলা ও বৈরীতার পক্ষ অনুসরণ করলে আমাদের উভয়ের ক্ষতি। আমি আবার। আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে চাই যে, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা সুসংহত করুক ও শান্তির মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধিশালী হােক। বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী ও অগ্রগতির সাথী হিসেবে আমরা আমাদের অবদান রেখে যাব। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে, খরা মওসুমে গঙ্গার পানি বরাদ্দ এবং এ সম্পর্কিত বিষয়টি নিয়ে আমাদের দুদেশের সরকার আবার আলােচনা শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে উভয়পক্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উৎসাহ ও সমর্থনের । প্রয়ােজন রয়েছে। আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, আমরা সঙ্গত যুক্তি ও ন্যায্য বক্তব্য মেনে নিতে রাজী আছি। কিন্তু কেউ যেন এটা আশা না করেন যে, ভারত হুমকি বা অযৌক্তিক অথবা অন্যায় দাবীর নিকট নতি স্বীকার করবে। শ্রদ্ধাসহ

ভবদীয়

ইন্দিরা গান্ধী

১১. ইন্দিরা গান্ধীর এই পত্র যখন মওলানার নিকট ভারতীয় দূতাবাসের থার্ড সেক্রেটারী হস্তান্তর করেন সেই মুহুর্তে কলকাতায় ভারত বাংলাদেশের কর্মকর্তারা দ্বিতীয় দফা কারিগরি পর্যায়ের আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের অতিরিক্ত সচিব শ্রী জে সি আজমানী বলেন, সাত ঘন্টা নৌবিহারে তারা পর্যালােচনা করেন। সেচ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বি, এম, আব্বাস বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠক চলতে থাকে। 

১২. ১৬ই মে প্রস্তাবিত ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা কমিটিতে ফারাক্কা লংমার্চ সংগঠন

পরিচালনার জন্য মওলানা ভাসানী পীর মােহসেন আলী দুদু মিয়া, মওলানা মহিউদ্দিন খান, সাবেক জমিয়ে ওলেমায়ে ইসলামী সর্বজনাব ইদু চৌধুরী, এটি বারী, এনায়েতউল্লাহ খান, শ্রী নির্মল সেন, গিয়াস শমাল চৌধুরী, কামাল লােহানী, মীর্জা গােলাম হাফিজ, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মওলানা

আবদুল সালাম ও মওলানা খন্দকার নাসির উদ্দিন, মওলানা সাইদুর রহমান, মওলানা শেখ ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদীকে অন্তর্ভূক্ত করেন।

১৩, স্বাধীনতা বিরােধী মুসলিম লীগ, জামাত ইসলামী, নিজামীইসলামী দলগুলােকে একদিকে, অন্য দিকে চীনপন্থী ভাসানী ন্যাপ, ইউ,পি,পি, সামাজবাদী দল-এর। নেতা-কর্মীদের ভারত বিরােধী অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মওলানার ভাসানীর। উদ্যোগ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বুপ্রিন্টের কার্যকর করার প্রাথমিক অথচ সচেতন উদ্যোগ। 

১৪. জিয়াউর রহমান ভারত বিরােধী প্রচারণাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে লক্ষ্যে ব্যবহার করতে সদা সর্বদাই সচেতন ছিলেন। চীনপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী জামাত ইসলামী, মুসলিমলীগ, নেজামে ইসলামী নেতা কর্মীদের নিকট ভারত বিরােধীতা তাদের নিজস্ব দলীয় দৃষ্টি কোণ হতেই সহজেই গ্রহণীয় হয়েছিলাে। চীনপন্থী রাজনৈতিক দল, গােষ্ঠি ও শক্তি তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য হিসেবেই কঠোর মার্শাল-র মধ্যে সামরিক সরকার অনুসৃত নীতির পাশাপাশি ভারতের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজে ওঠে পরে লেগেছে। 

১৫. পাকিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম দেশগুলি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চারণভূমিরূপে বাংলাদেশকে পুনরায় মুসলিম বাংলার আদলে পুনর্গঠিত করার লক্ষ্যে পরাজিত স্বাধীনতা বিরােধী চক্র এই অবস্থার সুযােগ নিতে এতটুকু সময় অপব্যয় করেনি। স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির অধিকারী ভারতের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ছিলাে দৃঢ়। ১৬. চীনপন্থীরা চীনের দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মােড় ঘােরাতে ছিলাে অত্যন্ত তৎপর। সেজন্য গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বা ব্যক্তি স্বাধীনতা, চলাফেরা, আইনে আশ্রয় লাভের মতাে মৌলিক এবং দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তাদের ভূমিকা ছিলােনা- যৌথভাবে তারা তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ভারতের দিকে। কামান তাক করেছিলাে। অবস্থান ভিন্ন লক্ষ্য অভিন্ন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে ভারত বিরােধীতাকে মুখ্য ইস্যু হিসেবে দাড় করালে চীনপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি দ্ব্যর্থহীনভাবে জিয়াউর রহমানকে সমর্থন প্রদান করে যদিও সে সময় তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও গণভিত্তি ছিলাে নগণ্য। ১৭. ভারত বিরােধীতার লক্ষ্যে সীমান্তের ছােট খাটো ঘটনাকে নিয়ে এসব দল ও রাজনীতিবিদগণ তিলকে তাল করে ছেড়েছেন। সীমান্তের তুচ্ছ ঘটনা, গরু নিয়ে যাওয়া, কাউকে অপহরণ বা পুলিশী ফাঁড়ি আক্রমণ ও দখলকে অথবা থানার পুলিশের মধ্যে থেকে কাউকে ধরে নিয়ে বংলাদেশের অভ্যন্তরেই ভিন্ন স্থানে নেওয়ার মতাে ঘটনাকেও তারা বিরাটকিছু করে ছেড়েছে একেই স্বাধীনতা। সার্বভৌমত্ব বিপন্ন বলে তারস্বরে উচুগলায় চিৎকার করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময় এরাই কয়েক ডজন পুলিশ ফাড়ি দখল, আইন প্রয়ােগকারী সংস্থার সদস্যদের হত্যা ও খতমের রাজনীতি চালু রেখেছিলাে।

১৮, ভারত ও বাংলাদেশ সরকার সীমান্তের ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এজন্য দুদেশের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। ১৯৭৬ সনের ১১-১৩ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তিন দিন ব্যাপী ঢাকায় এক বৈঠক হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে-যৌথ টীম সীমান্ত ঘটনা তদন্ত করবে। এবং ১৩ ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে একযুক্ত প্রেস বিবৃতি প্রদান করা হয়। বৈঠক শেষে যুক্ত প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশভারত যৌথটীম ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এলাকায় দুস্কৃতকারীদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ এবং থানা ও সীমান্ত ফঁাড়ি সমূহের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা সম্পর্কে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শুরু করবে। তিন দিনব্যাপী সীমান্ত বৈঠক শেষে ১৩ই ফেব্রুয়ারী ৭৬ বিকেলে ঢাকার রাষ্ট্রয় অতিথি ভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক যুক্ত প্রেস বিবৃতি হতে একথা জানা যায়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ডিরেক্টর ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ডি আইজি শিলং-এর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ তদন্ত টীম ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ । রাইফেলস্ ও ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেলের নিকট রিপাের্ট পেশ করবেন। প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়, তদন্তের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে টীম সীমান্তের দুপার্শ্বের এলাকাতেই পরিদর্শন করতে পারবেন। তিন দিনব্যাপী বৈঠকে বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল কাজী গােলাম দস্তগীর এবং বি এস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল মিঃ আসওয়ানী কুমার যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব করেন। বৈঠক শেষে ১৩ই। ফেব্রুয়ারী বিকালে ভারতীয় প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ বিমানে স্বদেশ যাত্রা করেন। বাসসর খবরে বলা হয়ঃ সমঝােতা ও সহযােগিতার পরিবেশে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সীমান্ত ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট অপরাপর বিষয়ে আলােচনা করা হয়। যৌথ প্রেস বিবৃতিতে বলা হয়ঃ দু দেশের মধ্যে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের স্বার্থে নিরুদ্ৰব সীমান্তের গুরুত্ব সার্বিকভাবে স্বীকৃত হয়। বিডিআর-এর ডিরেক্টর জেনারেল বি এস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেলকে জানান যে, সীমান্তপারের নিরাপদ আশ্রয় স্থান থেকে এসে দুস্কৃতকারীরা সম্প্রতি ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত এলাকায় লুটতরাজ অগ্নিসংযােগ এবং থানা ও সীমান্ত ফাঁড়ি সমূহের উপর পর্যাক্রমিক হামলা চালায়। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল সীমান্তফাঁড়ি বারােমারীর ওপর হামলা ও কলমাকান্দা থানার অফিসার ইনচার্জকে সপরিবারে অপহরণের ব্যাপারে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

বিএস এফ-এর ডিরেক্টর জেনারেল ভারতীয় এলাকার অভ্যন্তর থেকে কোন দুস্কৃতকারীদের নিরাপদ আশ্রয় দানের কথা বিশেষ জোরের সাথে অস্বীকার করেন। তবে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখতে জোরালাে প্রচেষ্টা নেয়া হবে। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়ঃ আরও ঐক্যমতে পৌছানাে হয় যে, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র সচিবদের সম্মেলনে সীমান্ত ঘটনা মােকাবিলার জন্য গৃহীত ঐক্যমতের নীতিমালার আদর্শ অনুসরণে সেক্টর কমান্ডার ও উইং কমান্ডারদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ভারত কর্তৃক নীতিমালাসমূহের অনুমােদনের জন্যও জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তার। অনুমােদনের বিষয় ভারত সরকারকে অবহিত করেছেন।” আলােচনাকালে ভারতীয় প্রতিনিধি গারােদের সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় এলাকায় গমনের বিষয় উল্লেখ করেন। বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল বলেন যে, দুস্কৃতকারীদের প্রলােভনে পড়ে কিছু সংখ্যক গরাি ভারতে গিয়ে থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের যে কোন প্রকৃত নাগরিক অবাধে ফিরে আসতে পারে। বিবৃতিতে বলা হয়ঃ সীমান্ত পারাপারে যাতে কোন বেআইনী চলাচল না হয় তার জন্য সীমান্তের উভয় পার্শ্বেই তেমন অবস্থার নিশ্চয়তার বিধানে উভয় পক্ষই তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে একমত হয়। এব্যাপারে বি এস এফ ও বিডিআর কড়া সতর্কতা পালন করবে।বিএসএফ -এর ডিরেক্টর জেনারেল আরও উল্লেখ করেন যে, সীমান্তের অপর পারে ভারতীয় এলাকায় বুলেট নিক্ষিপ্ত হওয়ায় সংলগ্ন ভারতীয় এলাকায় অসুবিধা সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয় লােকজন সীমান্ত এলাকা হতে অন্যত্র সরে যায়। বিডিআর এর ডিরেক্টর জেনারেল পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বিডিআর এর লােকেরা দ্রুত দুস্কৃতকারীদের পশ্চাদ্ধাধাবণকালে এসব বুলেট সীমান্ত পেরিয়ে গিয়ে পরতে পারে। আলােচনা বেঠকে উভয় পক্ষই সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ আসওয়ানী কুমার বলেন, “আমরা খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনােভাব নিয়ে আলােচনা করেছি। বাংলাদেশ। প্রতিনিধিদের নেতা মেজর জেনারেল কাজী গােলাম দস্তগীর উক্ত প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘চুক্তির ব্যাপারে তিনি খুশি হয়েছেন। তবে তিনি বলেন, এ চুক্তি যখন ফলপ্রসূ হবে তখন আমি আরও খুশি হব।বাংলাদেশ সীমান্তের অপর পাশে ভারতীয় সীমান্ত এলাকা বরাবর বিপুল সংখ্যক বিএসএফ মােতায়েনের বিদেশী সংবাদপত্রের খবরের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, বিএস এফ এর ডিরেক্টর

জেনারেল মিঃ আসওয়ানী কুমার এ ধরনের খবরকে জোরের সাথে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী কোথাও মােতায়েন করা হয়নি।১২

লাইফ ইজ নট আওয়ার্স।

১৮. বাংলাদেশের জন্য নিরবচ্ছিন্ন এবং উদ্বেগজনক ঘটনাটি ছিলাে পার্বত্য চট্টগ্রামের

দ্রুত ক্রম অবনতিশীল ঘটনাবলী। ১৯৪৭ সনে পাকিস্তান হওয়ার মুহূর্তে রাঙ্গামাটিতে ভারতীয় পতাকা এবং বান্দরবনে বার্মার পতাকা উত্তোলিত ছিলাে। ১৭ই আগস্ট র্যাডক্লিফ রােয়েদাদ প্রকাশিত হলে অঞ্চলটি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে, পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত থাকে। ১৯৭৫ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে সশস্ত্র জন সংহতি সমিতি এবং শান্তি বাহিনী গঠিত হয়। তারা স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানায়। ১৯৭৬ সনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আলােক দেওয়ানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পার্বত্য চট্টগ্রামকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবী জানালে জিয়াউর রহমান তাদের আশ্বস্ত করেন। বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে তাদের বিদায় দেয়া হয়। 

১৯. কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন ভারী ভারী সামরিক যান তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। লরী ভর্তি হয়ে সৈন্য নামছে। নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরী হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। মারমা ও চাকমাদের সব জায়গা থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। গভীর অরণ্যের দিকে নতুন নতুন রাস্তা তৈরী হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জিয়াউর রহমান সমতলের বাসিন্দা বাঙালীদের পাহাড়ী এলাকায় বসতি স্থাপনের উৎসাহ প্রদান ও তাদের যাতায়াতের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করেন। তাদের আবাদের জন্য জমি দেন। নগদ টাকা দেন। রেশন প্রদানের ব্যবস্থা করেন। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বাের্ড গঠন করেন। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক হতে টাকা আনেন। কিন্তু বাের্ডের চেয়ারমান এর দায়িত্ব দেন চট্টগ্রাম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসারকে। বেসরকারী প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। প্রশাসনের গােটাটাই সামরিকীকরণ হয়ে পড়ে। সামরিক বাহিনীর। হাতে রাস্তা ঘাট নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, ছাত্রদের বৃত্তি প্রদান, উপাসনালয় নির্মাণ স্থানীয় কুটির শিল্প এবং উন্নয়নের দায়িত্ব পর্যন্ত দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে খুন, নারী ধর্ষণ, লুটপাট, মন্দির পুড়িয়ে দেবার মতাে ঘটনা। ঘটতে থাকে। এ সময় বিশ হাজার অনুপ্রবেশকারীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। ১৩


২০. জিয়াউর রহমানের অনুসৃত নীতি ও পদক্ষেপের ফলে পাহাড়ী এলাকার চাকমা, মগ ও মারমা উপজাতিরা হত্যা খুন, নির্যাতনের শিকার হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই দেশ ত্যাগ করে। ভারত, বার্মা ও আরাকানে চলে যায়। অস্ত্র সংগ্রহ করে গেরিলা। যুদ্ধ শুরু করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫০৯৩ বর্গ মাইল এলাকা সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের ১০% ভাগ প্রায়। এত বিরাট এলাকায় সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর আক্রমণ এবং প্রতিনিয়ত খুন হত্যার ঘটনাবলী এবং একটানা সশস্ত্র সংঘটিত বিষয়টিকে জিয়াউর রহমান দেশবাসীর নিকট হতে আড়াল করে রাখেন। তিনি ময়মনসিংহ এলাকার ছােটখাট সীমান্ত ঘটনাকে বিরাট ব্যাপক করে দেখিয়েছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের মতাে বিশাল এলাকায় সশস্ত্র ঘটনাবলীর বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন রাজনৈতিক কারনেপার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয় নিয়ে হৈ চৈ করলে রাজনৈতিক সুবিধা বা ফায়দা লুটবার সম্ভাবনা হ্রাস পেত বলে জিয়ার নিকট মনে হয়েছে। অথচ এসব ঘটনা ছিলাে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত।

জিয়ার আরেক খেলা 

২১. ১৯৭৭ সনে জাতির নিকট প্রতিশ্রুত নির্বাচন যাতে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত না হয় তজ্জন্য জিয়াউর রহমান ধীর গতিতে, সতর্ক পদক্ষেপে নিজেকে আপাতঃ আড়াল করে অগ্রসর হয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি ব্যবহার করেছেন। ব্যাবহার করেছেন স্বীয় স্বার্থে চীনপন্থী তােয়াহা কাজী জাফর এদের। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে তােলপাড়, সীমান্ত ঘটনা নিয়ে লম্ফঝম্প, নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে ভারত, আওয়ামী-বাকশালী এদের একনম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে চীনপন্থী এসব নেতারা জেহাদ শুরু করে। তারা আওয়ামী বাকশালীকে এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এদের উৎখাত‘ ‘নিমূলপ্রতিরােধ করার আহবান জানিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। ৭৬ সনের ২৮শে জুলাই রাজনৈতিক দলবিধি জারী হওয়ার পর ঘরােয়া রাজনীতি শুরু হলে তারা সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিার লড়াইয়ের পরিবর্তে আওয়ামী বাকশালীস্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে উত্থাতনির্মূল করার অভিযান চালায়। পিপি আর-এর মাধ্যমে দলগঠন শুরু হলে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীগণ অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়ে আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীবন ঘটান। আওয়ামীলীগের পুনরুজ্জীনের পর আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ, বেগম সাজেদা চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, আব্দুল মমিন তালুকদার,

আবদুল মোেমন, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, সালউদ্দিন ইউসুফ, ফনীভুষণ মজুমদার, ফজলুল করিম, জহিরুল কাইয়ুম ফজলুল হক বিএসসি প্রমুখ নেতা কর্মী এবং পরবর্তীতে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘরােয়াভাবে কর্মী সভা ও দল গঠনের জন্য গিয়েছেন তখন হাজার হাজার কর্মী। সমাগম দেখে এসব উগ্রপন্থী চৈনিক নেতা-কর্মী এবং উচ্চাভিলাষী জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে যায়। আওয়ামী বাকশালী কে ঠেকানাের জন্য চীনপন্থী ও ডানপন্থী ১০টি দল এবং এদের ৫৪টি অঙ্গদলসমূহ একত্রে মিলে জাতীয় সংহতি ও প্রতিরােধ কমিটিগঠন করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হাসিলের জন্য জাতীয় ঐক্যের অঙ্গীকার ও আহবান নিয়ে তারা সংগঠিত হয়। ন্যাপের মশিউর রহমান, জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি পার্টির হাজী মােহাম্মদ দানেশ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টির কাজী জাফর আহমদ, সাম্যবাদী দলের তােয়াহা সহ এসব চৈনিকপন্থী দল একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ ঠেকাও রাজনীতিতে সামরিক সরকারের পক্ষে প্রকাশ সমর্থন জোগায়।

২২. তাদের বক্তব্য, প্রথমে আওয়ামী বাকশালীদের উচ্ছেদ করতে হবে, কেননা তারা দেশপ্রেমিক নন-স্বাধীনতা এরা চায়না। জনাব তােয়াহা ইতিপূর্বে ঘােষণা করেছিলাে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস নয় দখল দিবসসেই তােয়াহা গং জিয়াউর রহমানকে নসহিৎ করেন যে, আওয়ামী লীগকে নিমূল ও উচ্ছেদ করতে

পারলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব থাকবেনা। আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে জাতীয় সংহতি ও প্রতিরােধ কমিটিপ্রস্তাব দেয় যে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে দেশপ্রেমিক দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। এই দেশপ্রেমিক দলের মধ্যে মুসলিমলীগকে নিতেও তাদের আপত্তি ছিলােনা। 

২৩, তাদের বক্তব্য হলাে নির্বাচন পরে হােক, আগে দেশ বাঁচাও। সামরিক শাসন বহাল থাক। জনগণের মৌলিক অধিকার, ভাত ও ভােটের অধিকার না থাক, মিটিং মিছিল সমাবেশ জনসভা করার ও গণতান্ত্রিক অধিকার না থাক; এতে কি আসে যায়-আগে দেশ বাঁচাতে আওয়ামী-বাকশালীদের ঠেকাও। 

২৪.. তাদের মতে নির্বাচন এখন প্রয়ােজন নেই। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের প্রতিশ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দেশের ঐক্য ও সংহতিবিপন্ন হবে। সুতরাং নির্বাচন স্থপিত ঘােষণা করা হােক। জিয়াউর রহমান ও দেখলেন সাধারণ নির্বাচন অর্থাৎ পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সামরিক পােষাকে ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ তার স্বপ্নই থেকে যাবে।

২৫. ১৯৭৬ সালে ২১শে নভেম্বর জিয়াউর রহমান জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার্থে ১৯৭৭ সনের প্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহামদ সায়েমকে বাধ্য করেন।

নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়।

২৬. জাতীয় ঐক্য ও সংহতি‘, ‘স্বাধীনতা রক্ষাএসব ছিলাে জনগণের উদ্দেশে ছুঁড়ে দেয়া কথামালা। শ্লোগান। এর অন্তরালে ছিলাে ভিন্ন উদ্দেশ্য। ভিন্ন প্রক্রিয়া। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ এন,এস, এফ এবং প্রাক্তন ছাত্র শক্তির নেতৃবৃন্দ যারা বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ পােশায় নিয়ােজিত ও বিশেষজ্ঞ তারা একটি কার্যপত্র তৈরী করে এ কথা প্রমাণের চেষ্টা চালায় যে পার্লামেন্ট নয়, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারই বাংলাদেশে উপযােগী। তাদের রাজনৈতিক তত্ত্ব ও যুক্তি জিয়াউর রহমানের মানসিক চিন্তা ও ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়ে জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ বরাবরই ছিলাে বেপরােয়া। ১৯৭১ সনের ২৭শে মার্চ কালরঘাট বেতার কেন্দ্রে আকস্মিক এক ভাষণে তিনি নিজেকে হেড অব দি স্টেটবলে ঘােষণা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে পিছে এসে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। অনুরূপভাবে ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর ভােরে তিনি নিজেকে প্রধান সারিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা দেন এবং ঐদিন বিকেলে নভেম্বর উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিজেকে গুটিয়ে আনেন। কিন্তু মূল টার্গেটে পৌছতে বিরত ছিলেন না।

২৭. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের বক্তব্য ছিলাে স্পষ্ট এবং ঋজু। তিনি জাতিকে বারবার বলেছেন, তার সরকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে তিনি সাধারণ নির্বাচন দেবেন। জন প্রতিনিধিরা ঠিক করবেন সরকার পদ্ধতি কি হবে। এর পূর্বে তিনি তার উপদেষ্টা পরিষদে শাসনতন্ত্রের ৪র্থ সংশােধনী যেটাকে প্রচার করা হতাে অগণতান্ত্রিক তার পুরােটা বাতিলের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে জিয়াউর রহমান এ বক্তব্য একমত হতে পারেননি। তারপরেও প্রেসিডেন্ট সায়েম যখন সাধারণ নির্বাচনের জন্য এগুতে লাগলেন তখন ফারাক্কা সমস্যা, সীমান্ত সমস্যা, জাতীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব। রক্ষার ধূয়াতুলে এবং আওয়ামী বাকশালীদের দুঃশাসনের অজুহাত তুলে নির্বাচন বানচাল, স্থগিত করার কাজে চৈনিকপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী চক্রকে মাঠে নামান।

২৮. নির্বাচন স্থগিত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়া তার পকেটে। লুকায়িত অস্ত্র এবার সরাসরিভাবে বের করে আনলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে

সমন্বয় ও শৃঙ্খলাজনিত কর্মকান্ডের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুহাতে তিনি প্রেসিডেন্ট সায়েমের হাত থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেন। সামরিক ফরমানে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছিল এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটিই ছিলাে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামগ্রিক কর্মকান্ডের মূল শক্তি ও কেন্দ্র বিন্দু।

২৯. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি দখল করে সামরিক আইন কড়াকড়িভাবে বলবৎ করা হয়। ঘরােয়া রাজনীতির যে প্রক্রিয়া বিগত ২৮শে জুলাই হতে শুরু হয়েছিলাে অদৃশ্য শক্তি তাদের উপর খবরদারী শুরু করে। মৌলিক অধিকারের

ফাঁকফোকর গলে যাতে রাজনীতির বাতাস জনগণের মধ্যে সঞ্চালিত না হতে পারে – সে জন্য সুযােগের সামান্য বাতাবরণকে ঢেকে দেয়া হয়। নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ভীষণভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের সংখ্যা ৬২ হাজারকে ছাড়িয়ে যায়।

৩০. এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ৭৬এর ১লা ডিসেম্বর জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং অবিলম্বে নেতৃবৃন্দকে ছেড়ে দেবার আবেদন জানান। ১৬ জিয়াউর রহমান মুখে মিষ্টি কথা বললেও এসবের পাত্তা তার নিকট ছিলাে না। 

৩১. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে জিয়াউর রহমান সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচারকার্য অনুষ্ঠানের জন্য মার্শাল ল কোর্ট সমূহের কার্যপরিধি বাড়িয়ে দেন। এমনকি, সামরিক ফরমানে যে কোন অপরাধের শাস্তি এসব মার্শাল ল কোর্টে করা যাবে। বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা যাবে। গােপনে বিচার সম্পন্ন করা যাবে। সামরিক আদালতে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আদালতে আপীল করা যাবে না। আপীলের বিবেচনার ক্ষমতা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়া নিজের হাতে রেখে দেন। ১৯৭৬ সনের ১৮ই জুলাই কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়। বিশেষ সামরিক আদালতে গােপন বিচারে ২৯শে জুন ৭৬ সনে কর্ণেল তাহেরকে ফঁসি দেয়ার আদেশ দিলে প্রেসিডেন্ট বরাবর ক্ষমা প্রদর্শনের জন্য আবেদন জানান হয়। কিন্তু দেশবাসী আজো অজ্ঞাত, যে, কেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম তাহেরের ফঁসির আদেশ

রহিত করলেন না। ১৭ 

৩২. বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নির্বিচার গ্রেফতার, হত্যা ও নিপীড়ণে।

বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে-১৯৭৭ সনের ৪-১২ এপ্রিলে স্যান ম্যাক ব্রাইডের নেতৃত্বে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা দেশের আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে

সাক্ষৎ করেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করে মানবাধিকার লংঘন বিষয়ে ১৯৭৭ সনের ২৩শে জুন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান বরাবরে একটি বিস্তারিত রিপাের্ট পেশ করেন। উক্ত রিপাের্টে সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করার, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও তাদের উপর নিপীড়ণের বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। 

৩৩. এ্যামনস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধিদের নিকট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মৌখিক আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করে বলেন যে, শীগ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ছেড়ে দেবার বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। এবং গণতান্ত্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। জিয়াউর রহমান তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্বে। তার পক্ষ হতে প্রতিনিধিদেরকে বলা হয়, মাত্র দশ হাজার থেকে পনের হাজার রাজনৈতিক বন্দী কারাগারে আটক আছে। বছরের প্রথম দিকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে প্রকাশিত হয় যে, দেশে ৩৬,৬৮৫ জন রাজবন্দী কারাগারে আটক রয়েছে। ১৯ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী যে সমস্ত ব্যক্তি হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নি সংযােগের মত অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলাে তাদের কারাগারে হতে ছেড়ে দিয়ে প্রতিনিধি দলকে দেখানাের প্রয়াস পায় যে, রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বন্দীদের ছেড়ে দেবার বিষয়ে এটি ছিলাে ছলনাপূর্ণ কৌশল। ৩৪. এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধি বাংলাদেশ ত্যাগ করার ১০দিনের মধ্যেই অর্থাৎ ২১ শে এপ্রিল ৭৭ সনে জিয়াউর রহমান বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে প্রেসিডেন্টের পদটি পর্যন্ত কেড়ে নেন। প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২২শে এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ও টিভিতে ভাষণ দিয়ে বললেনঃ তার নীতির প্রতি দেশবাসীর আস্থা আছে কিনা-এই লক্ষ্যে ৩০শে মে ১৯৭৭ সনে হাঁ/না গণভােট অনুষ্ঠিত হবে।

.

গণভােট ঃ বাংলাদেশে ভােটজালিয়াতির প্রথম পাঠ। 

৩৫. প্রসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু এবং ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনুষ্ঠানে তাকে সহায়তা করার জন্য বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে উপদেষ্টা পদমর্যাদায় প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী নিযুক্ত করেছিলেন। জাতির নিকট প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি মােতাবেক নির্ধারিত সময়ে পার্লামেন্ট নির্বাচন করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট সায়েম ভােটার লিস্ট তৈরী করান, জাতীয় সংসদের সীমানায় নির্ধারণ এবং নির্বাচন বিধি জারী করেন, রাজনৈতিক দলবিধি জারী করে ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর

মাধ্যমে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ পর্যায়ে যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন, সেই সময় জিয়াউর রহমান চক্রান্তের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করেন। নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৯৭৬ সনের ৩০ নভেম্বর জিয়াউর রহমান সশস্ত্রবাহিনীর কতিপয় অধিনায়কদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে গমন করেন এ বং বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেন। মার্শাল ল জারী থাকায় সামরিক ফরমান বলে দেশ শাসিত হচ্ছিল এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকই ছিলেন প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের মুখ্য ব্যক্তি।

৩৬. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুবের পদাংক অনুসরণ করেন। জেনারেল আইয়ুব যেমনভাবে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলাে, ইতিহাসের গতিধারায় ২০ বছর পর বাংলাদেশে প্রাসাদ চক্রান্তের পালায় একই নাটকের পুনরাবৃত্তি ঘটলাে। ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সদল বলে বঙ্গভবনে ঢুকে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে বললেন যে, আপনি অসুস্থএবং রাষ্ট্রপতির পদ জিয়াউর রহমানের বরাবরে ছেড়ে দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম সংবিধানিক ও আইনগত বৈধতার প্রশ্ন তুললেন। তিনি পরিস্কারভাবে বললেন যে, যেহেতু তিনি এখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নন যে ফরমান জারী করে জিয়াউর রহমানের বরাবরে প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ করতে পারেন অথবা ভাইস প্রেসিডেন্টও নেই যার বরাবরে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত জটিলতার এই বিষয়টি সমাধান না করেই জিয়াউর রহমান বললেন যে, আপনার পদত্যাগে কোন অসুবিধা হবে না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পদত্যাগের এই সংকটকে আমি ম্যানেজ করে নেব।২০ 

৩৭. বলাবাহল্য, বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদ হতে পদত্যাগ করতে হলাে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একাধারে প্রধান সেনাপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রেসিডেন্ট-একাই এই তিনটি পদের অধিকারী হয়ে বাংলাদেশকে তার নিজস্ব জমিদারী হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এসব পদ একত্রে কবজা করে জিয়াউর রহমান ২২শে এপ্রিল ৭৭ সনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে বললেন ঃ ৩০শে মে সারা দেশে গণভােট অনুষ্ঠিত হবে। গণভােট হবে, জনগণ তাকে চায় কিনা। হাঁ বা না। তার প্রতি জনগণের সমর্থন আছে কিনা বা জনগণ তার অনুসৃত নীতি অনুমােদন করে কিনা?

গণভােট ঃ ভােটের তামাশাপত্র 

৩৮. দেশে মার্শল লরাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। প্রাসাদ চক্রান্ত। হত্যা খুনের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত বাংলাদেশ। সন্ধ্যা-প্রভাত নিরবচ্ছিন্ন কার্য্য। এর মধ্যে গণভোেট ভােটের তামাশা মাত্র। গণভােটের পক্ষে সাফাই গাওয়া হলাে। আতউর রহমান খান, ইউ পিপি নেতা ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, জাতীয় গণমুক্তির হাজী মােহাম্মদ দানেশ বিবৃতিতে বললেন গণভােট দিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্মম পরিহাস এই যে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে এই দোহাই তুলে এ ধরনের নেতৃবৃন্দই (!) ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচন স্থগিত ঘােষণাকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন মাস পর মে মাসে গণভােট অনুষ্ঠানে তারা সমর্থন করতে লজ্জা পান নি। 

৩৯. নির্ধারিত তারিখে গণভােট হলাে। ৩ কোটি ৮৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ৮৫৮ জন ভােটারের মধ্যে বৈধ ভােট পড়ল ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭৯ হাজার ৭৬৮ টি। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের পক্ষে হাঁ সূচক ভােট পরে ৩কোটি ৩৪ লক্ষ ৮৭০টি অর্থাৎ বৈধ ভােটের ৯৮.৮৮% ভাগ। এবং নাপরে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮৯৮ টি। যা বৈধ ভােটের ১.১২% মাত্র।

গণভোেট সম্পর্কে বিদেশী পত্রিকার মতামত

৪০. দি গার্ডিয়ান”-এর সংবাদদাতা সাইমন উইনচেস্টার বলেন, জিয়ার পক্ষে প্রদত্ত

ভােটের সংখ্যা ঢাকার কূটনৈতিক মহলে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। একটি পশ্চিমা দূতাবাস সুত্র থেকে বলা হয়, জিয়া সম্পর্কে উৎসাহ ভােটারদের কর্মরত সূত্র থেকে বলা হয়, নির্বাচনী অফিসারদের অনেকেই অব্যবহৃত ভােট দিয়ে “হ্যাচিহ্নিত বাক্স ভর্তি করেছে। একটি ভােটদান কেন্দ্রে জনৈক নির্বাচনী অফিসার। সবগুলি ভােটপত্র হ্যাঁচিহ্ন বাক্সে দিয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।২৪ বিবিসির সংবাদদাতা মার্ক টালী সাধারণতঃ জিয়ার সামরিক শাসনকে সমর্থন করেন তা সত্ত্বেও ৩১শে মে তারিখে প্রেরিত সংবাদে তিনি বলেন, সরকারী অফিসার ও দুর্নীতিপরায়ণ গ্রাম্য মাতব্বররা জিয়ার পক্ষে ভােট সংগ্রহ করে।

গণভােটে আর কারাে কোন ভূমিকা ছিলাে না।” ৪১. জেলা প্রশাসকদের বলে দেয়া হয় যেন ব্যাপক ভােটে জিয়াউর রহমান জয়যুক্ত হন। পাবনার নির্বাচনী এলাকার নাগডেমরা ভােট কেন্দ্রের একজন প্রিসাইডিং

অফিসারকে শতকরা ৯০%ভাগ প্রদত্ত ভােট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন ঃ গণভােট? জনগণ আসেনি, ভােটও দেয়নি। আমরাই ব্যালটে সিল মেরে ছিড়ে বাসে ঢুকিয়েছি। ভােটারদের কষ্ট করে আসতে হয়নি।বলা বাহুল্য গণভােটে-এ হাঁ-এ পক্ষে প্রচারণা চালানাে যাবে। কিন্তু নাএর পক্ষে প্রচারণা চালালে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানের পথ ধরে তার নিযুক্ত প্রধান সেনাপতি ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নিকট হতে প্রেসিডেন্ট পদ কেড়ে নেয় এবং ১৯৮৫ সনে ২১শে মার্চ জাতিকে পুনরায় জিয়ার অনুরূপ গণভােটের সামনে দাঁড় করায়।২৪

আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিক্যান্ট

গণতন্ত্রের গতিরােধ 

১. ১৯৭৬ সনের নভেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলবিধির শর্তমালা পূরণ করে ৫৬ টি দল অনুমােদনের জন্য আবেদন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিষ্ট পার্টি, ডেমােক্রেটিক লীগ, জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সহ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ঘােষিত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানাতে থাকে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম এই লক্ষ্যে ১৯৭৫ সনের ৮ই নভেম্বর জারীকৃত এবং জাতির নিকট ওয়াদা বদ্ধ ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। বিচারপতি সায়েম নিজেই বলেছেন যে, তার সরকার অন্তবর্তীকালীন সরকার। তঁাকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিলাে এবং তাদের দায়িত্ব ছিলাে সরকারের দৈনন্দিন কাজসমূহ এগিয়ে নেয়া মাত্র। তারা মন্ত্রীদের মর্যাদা এবং পতাকা বহন করতে পারতেন না। 

২. নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমানের সূক্ষ্ম, গােপনীয় ও লক্ষ্যাভিসারী পদক্ষেপগুলাে গণতন্ত্র উত্তরণের পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমান নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে প্রকাশ্যে ও বাহ্যতঃ যত অঙ্গীকারই করুন না কেন ৭ই নভেম্বর ৭৫ সনের ঘােষিত সামরিক প্রধানের পদটি পুনরায় দখল এবং সুযােগমত প্রেসিডেন্ট পদটিও করায়াত্ত বিষয়ে শিকারী বাঘের মতই এগিয়ে আসছিলেন। ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত অঙ্গীকার বানচাল করার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সর্পিণ সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অর্থ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্য, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সায়েম মােঃ সায়েমের ক্ষমতাকে সুপারসিড় করে

রাষ্ট্রপরিচালনায় মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে জাতির সামনে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও দিবসে প্রেসিডেন্টের ভাষণের পাশাপাশি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পৃথকভাবে রেডিও টিভিতে ভাষণ দান শুরু করেন। এমনকি, নীতি নির্ধারণী বিষয় যা রাষ্ট্রপতির ভাষণে প্রতিফলিত হওয়ার কথা। সে সম্পর্কেও প্রেসিডেন্টের আওতাকে অগ্রাহ্য করে বলতে গেলে চ্যালেঞ্জ করে, ভাষণ বিবৃতি প্রচার করতে থাকেন। যদিও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে দেশে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল ছিলাে।

৩. অত্যন্ত সূক্ষভাবে সামরিক এক ফরমান বলে সামরিক প্রধান ও প্রেসিডেন্ট আবু মােহাম্মদ সায়েমের বিদেশ ভ্রমণকালে কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন তাও ঘােষণা করা হয়। এবং জিয়াউর রহমান সে স্থলে স্থলাভিষিক্ত হবার পথ সুগম করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতার সীমাহীন স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হন। এরপর হতেই জিয়াউর রহমান প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হতে ওঠেন। ক্ষমতা দখলের জন্য স্বাধীনতা বিরােধী চক্র ও চৈনিকপন্থী উগ্র দলগুলােকে রাজনৈতিক দাবার ঘুটি হিসেবে রাজনৈতিক আসরে নামিয়ে দেন। ৪. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জাতীয় দল বাংলাদেশ শ্রমিক।

আওয়ামী লীগ ঘােষণা করলে মওলানা ভাসানী শশাষণ মুক্ত দেশ গঠনে শেখ। মুজিবের পদক্ষেপকে স্বাগত এবং বঙ্গবন্ধুকে দোয়া করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক ও নির্বাচিত সরকার প্রধান রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করলে মওলানা ভাসানী মােশতাককে অভিনন্দন জানান। মােশতাককে হটিয়ে প্রকাশ্যে বিচারপতি সায়েম নেপথ্যে কূটবুদ্ধি সম্পন্ন জিয়াউর রহমান ক্ষমতা প্রয়ােগের প্রধান ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ালে মওলানা ভাসানী জিয়াউর রহমানের দিকে ঝুঁকে পরেন। জিয়াউর রহমানের পৃষ্টপােষকতায় মওলানা ভাসানী দেশের মধ্যে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত বিদ্বেষকে উসকে দেবার কৌশল গ্রহণ করেন। এবং এই লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী ১৬ই মে ৭৬ ফারাক্কা মিছিলের আয়ােজন করেন। দেশে তখন সামরিক আইন ও শাসন বলবৎ। সর্বপ্রকার মিটিং মিছিল নিষিদ্ধ। তার মধ্যে মওলানা ভাসানী সামরিক ফরমান ভঙ্গ করে মিটিং মিছিল কিভাবে করতে পেরেছেন? সামরিক শাসক জিয়া চক্রের সহযােগিতা ব্যতীত এটি কি আদৌও সম্ভবপর ছিলাে? ফারাকা সমস্যা আমাদের জাতীয় সমস্যা সন্দেহ নেই, নির্বাচিত সরকারই কেবলমাত্র এই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুটি দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমাধান

করতে সক্ষম। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে এই জটিল সমস্যা সমাধান যে সম্ভবপর নয় একথা মওলানা ভাসানীর মতাে রাজনীতিবিদদের অজানা নয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারী হলে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র শ্লোগান ছিলাে- সবার আগে গণতন্ত্র চাই।সামরিক শাসনের অবসান চাই। মওলানা ভাসানী দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সামরিক শাসনের বলয় থেকে দেশকে উদ্ধারের পরিবর্তে জাতীয় জীবনের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে কেবলমাত্র। ফারাক্কা ইস্যুকে প্রধান ও একমাত্র ইস্যু করার ক্ষেত্র নির্ণয়ে রাজনৈতিক বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদনাই ছিলাে মুখ্য। ফারাক্কা ইস্যু ও মিছিলের মূল লক্ষ্য ছিলাে রাজনৈতিক। সে রাজনীতি স্বাধীনতা বিরােধী শক্তিকে প্রকাশ্য আসতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। ভারত বিরােধীতার আবরণে আওয়ামী লীগ বিরােধী রাজনীতিকে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের মনে এথিত করার সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ হিসেবে জিয়াউর রহমানের। ছকেই মওলানা ভাসানী পা দিয়েছিলেন- যেমন অতীতেও ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব বলে বাংলার জনগণের দাবীকে পাশ কাটিয়ে কাশ্মীর ইস্যুকেই বড় করে। ধরেছিলেন। ঘােষিত পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর। ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে তঁার উদ্যোগ ছিলাে অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে মওলানা ভাসানী। জিযার পরিকল্পিত প্রিন্ট অনুসারেই কাজ করেছেন মাত্র। জাতির জনক ও জাতীয় চার নেতার অবর্তমানে মওলানা ভাসানী জাতীয় নেতার গুরু দায়িত্ব পালনে সক্ষম। হলেন না। এটা ছিলাে জাতীয় জীবনে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ১৯৭৭ সনের। ফেব্রুয়ারী মাসের অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর মন্তব্য। ছিলাে দেশে অনুকূল পরিবেশ থাকলে নির্বাচন হবে। এটা ছিলাে প্রকৃত পক্ষে। নির্বাচন বিরােধী চক্রের প্রতিধ্বনি মাত্র। জিয়াউর রহমানের নির্বাচন স্থগিত প্রক্রিয়ায় সাহায্যে মওলানা ভাসানী অন্য এক বিবৃতিতে বললেন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বাচনী পরিবেশের উপযােগী নয়। বরং জনগণ এই মুহূর্তে নির্বাচন চায় না। জনগণ নির্বাচন চায় কি চায় না সে ব্যাপারে গণভােট অনুষ্ঠান নেয়া হােক। তাছাড়া অতীতেও জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন প্রকার লাভবান হয়নি। জিয়াউর রহমানের চীন সফরের ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়ে গেলে মওলানা ভাসানী আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, “তিনি এই মুহূর্তে জাতিকে বিভক্ত করতে চান না, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই জাতি বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই আপাততঃ নির্বাচন। স্থগিত রেখে সামরিক শাসন বজায় রাখা হােক।

৫. নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য প্রেসিডেন্ট সায়েম নির্বাচন কমিশনকে ভােটার লিস্ট তৈরি করার আদেশ প্রদান করেছিলেন। ভােটার লিস্ট তৈরীও হয়েছিলাে-যার ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিলাে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের গােপন রিপাের্টে জিয়ার নিকট পরিস্কার হয়ে গেলাে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরাই শতকরা ৬০%টি আসন দখল করেছে। ঐ নির্বাচনে বামডান চীনপন্থী ও মুসলিম লীগের গণভক্তির বিচ্ছিন্নতা প্রমাণ হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের নিকট ১৯৭৭ সনে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করা ব্যতীত অন্য কোন বিকল্প রাস্তা খােলা ছিল না।৬ ৬. গণবিচ্ছিন্ন চৈনিকপন্থী দল, গােষ্ঠী ও ব্যক্তি মিলে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটি গঠন করে এবং রুশ-ভারতের দালালদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিপ্লবী শ্লোগান তােলে। সামরিক শাসনের কড়া সেন্সরশীপের মধ্যেও আওয়ামী-বাকশালী ও রুশ-ভারতের কথিত দালালদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ বৈপ্লবিক লড়াইয়ের ভাষা প্রচারিত হতে বাধা পায়নি। স্বাধীনতার বিরােধীতাকারী এসব চৈনিকগ্রুপ আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনৈতিক নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে ৭৫ সনের ১৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সমগ্র দেশে খতমের রাজনীতি শুরু করে। মুসলিম বাংলারশ্লোগান তােলে। মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিকট অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য প্রার্থনা করে৭ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এসব চৈনিক পন্থী উল বিপ্লবীগণ প্রকাশ্য রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়। এবং ঘােষিত ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের নির্বাচনের বিরােধীতা করে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বৈঠক ও আঁতাত করে নির্বাচন বানচালের জন্য জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিনামে তথাকথিত কমিটি গঠন করে। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির শরীক দলগুলাে সর্বদা নির্বাচন বিরােধীতা করে এসেছে। আসলে তারা নির্বাচনেই বিশ্বাস করেন না। নির্বাচন এলেই তারা ভােটের বাক্সে লাথি মেরে ভাত দাবি করেন। এটাই তাদের রাজনীতি। জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিরুশ-ভারত ও আওয়ামী বাকশালীদের প্রতিরােধ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতন্ত্রকেই প্রতিরােধ করেছে। চীনপন্থী ও পাকিস্তান পন্থী গ্রুপ সামরিক সরকারের নেপথ্য শক্তিধর ব্যক্তি জিয়াউর রহামনের হাতের ক্রীড়নক হয়ে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রমূলক খেলায় উঠেছিলাে। নির্বাচনকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত জাতির জন্য, গণতন্ত্রে উত্তরণের প্রয়ােজনে নির্বাচন যে ক্ষেত্রে ছিল অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে জিয়ার ছকে পা দিয়ে মার্শাল ল প্রলম্বিত করার ঘৃণ্য তৎপরতায় তােয়াহা সাহেব, ছিলেন চক্রান্তে লিপ্ত।

৭. জনাব সায়েম বলেছেন, তার উপদেষ্টাগণ বিশেষ করে দেশে দ্রুত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, দলগঠন নির্বাচন ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে জন্য রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী হিসেবে বিচারপতি আবদুস সাত্তার যাকে বিশ্বাস ও আস্থার সঙ্গে উপরােক্ত লক্ষ্য সাধনের জন্য নিয়ােগ দান করেছিলেন তিনিও ঐ চক্রান্তের অংশীদার হয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার পক্ষে ছিলেন। রাষ্ট্রপতি বলছিলেন, দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। অন্যদিকে উপদেষ্টাদের মধ্যে অনেকেই তখন বলে চলেছিলেন দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা নেই। অর্থাৎ রাজনীতি বন্ধ করার পর সামরিক শাসনের মধ্যেও কি করে রাজনৈতিক শূন্যতা থাকে না তা বােধগম্য হলেও এটা পরিষ্কার হয়ে আসছিলাে যে জিয়াউর রহমান সরকারী খরচে হেলিকপ্টার, যানবাহন, টিভি, রেডিও-ও প্রচার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকায় জোরেশােরেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন। যদিও রাজনৈতিকভাবে নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছিল নির্বিচারে। ১৯৭৬ সনের ৮ই জানুয়ারি সামরিক ফরমান জারি করে বলা হয়েছিলাে, বক্তব্য, লেখনি, স্বাক্ষর বা প্রতীক দ্বারা যেভাবেই হােক না কেন সামরিক শাসন জারী, বলবৎ থাকা নিয়ে প্রধান সামরিক প্রশাসক বা ডেপুটি সামরিক প্রশাসক বা সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বললে দশ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে। [পরিশিষ্ট-৭] এই ফরমান জারির মূল লক্ষ্য ছিলাে, আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি যেন মাঠে নামতে না পারে। 

৮. দেশ গণতন্ত্রের পথে স্বাভাকিভাবে অগ্রসর হােত জিয়াউর রহমানের নিকট ছিল তা অনাকাঙ্খিত। গণতন্ত্রের গতিরুদ্ধ করা হয়েছে বারবার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ১৯৭৬ সনের ৩রা অক্টোবর জিয়াউর রহমান কড়া মার্শাল ল‘-এর মধ্যে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি মিঃ ওয়েন কোরকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। প্রচুর উপঢৌকন, খানাপিনা এবং হােটেল ইন্টারকনের আরামদায়ক কক্ষে অবস্থান করে তিনি ভােয়া থেকে প্রচারিত এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেন যে, “বাংলাদেশের জনগণ এক্ষুণি নির্বাচন চায় না, নির্বাচনের প্রয়ােজন নেই। প্রতিবেদনে বলা হয় সামরিক শাসনে জনগণ ভালাে আছে, জনগণ হারাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। ৯

৯. বিচারপতি সায়েম একাকী হয়ে পড়েন। তার উপদেষ্টাগণও বঙ্গভবনে আসার চাইতে আর্মি হেডকোয়ার্টারে দৌড়ানােতে স্বাচ্ছন্দ্যরােধ করেন। আওয়ামী লীগ ব্যতীত চীন-পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ক্যান্টনমেন্টের দিকে ছুটতে থাকেন। জিয়াউর রহমান দেখলেন নির্বাচন বন্ধ না করতে পারলে তার ক্ষমতার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে পড়বে। কালবিলম্ব না করে জিয়াউর রহমান ২৯শে

নভেম্বর ৭৬ সনে প্রধান সামরিক পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট কেড়ে নেন। অসহায় বিচারপতির করুণ নিঃশব্দ আত্মনা তার বইয়ের বিবরণীতে প্রকাশিত হয়েছে। ১০দেশে মার্শাল ল জারি থাকার প্রেক্ষিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নেওয়ার ফলে সায়েম ফুটো জগন্নাথ হিসেবে কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির পদটিতে বহাল থাকলেন মাত্র। 

১০, বিচারপতি সায়েম জিয়াউর রহমানের উচ্চাভিলাষ এবং দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে জেনারেল জিয়াকে। সরিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নতুন কোন সামরিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ােগ দানের কথা ভাবছিলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল বাশারেরও এতে সম্মতি ছিলাে। বলাবাহুল্য, এয়ার ভাইস মার্শাল বাশার বিমানবন্দরে এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধা মােহাম্মদ খাদেমুল বাশারের নিহত হওয়ার রহস্য। জিযার জীবদ্দশায় কেন, আজ পর্যন্ত জনসাধারণ জানতে পারেনি।

১১. ১৯৭৬ সনেই জিয়ার রহমান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তােয়াবকে সরিয়ে দেয়। কেননা সেনাবাহনিীর আর্টিলারী ফিল্ড রেজিমেন্ট ও ট্যাংক রেজিমেন্টসহ পদাতিক বাহিনীর উল্লেখযােগ্য অংশ তােয়াবকে সমর্থন করে যাচ্ছিলাে এবং তােয়াব ক্রমান্বয়ে তার অবস্থান দৃঢ় করতে প্রয়াস পাচ্ছিলাে। জিয়া অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নির্মম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তার পথের কাটা সরিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।১১

১২. এই অবস্থার মধ্যেও প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্ম। সায়েম দেশে দ্রুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সনের ১১ই আগস্ট সামরিক ফরমান জারি করে হাইকোর্ট বিভাগে সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের আইনে আশ্রয় লাভের অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করেন। সেই সুবাদে গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, আবদুল মমিন তালুকদারসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের মুক্তির লক্ষ্যে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলাে। যা ইতিপূর্বে সামরিক ফরমান বলে নিষিদ্ধ ছিলাে।

১৩, জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির নেতাদের দিয়ে নির্বাচন পিছানাের দাবি তুলে তাদের হাত থেকে নিজের হাতে বলটি তুলে নেন। ইতিপূর্বে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঘােষণার মাধ্যমে যা ছিলাে জিয়াউর রহমানের হাতের নাগালের বাইরে। জিয়াউর রহমান তার দক্ষ গােয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ভালাে করেই জানতেন প্রতিরােধ কমিটি নেতারা নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। সেজন্য নির্বাচন পেছানাের দাবি তাদের দ্বারা সহজেই গে নাে সম্ভব। ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের

সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষনার পর চৈনিকপন্থীদের মগজনামে খ্যাত জনাব এনায়েত উল্লাহ খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “জাতীয় প্রতিরােধ কমিটির আর প্রয়ােজন নাই।” “দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা চলছে।অপর এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব এনায়েত উল্লাহ খান বলেন, বর্তমান সরকারকে কোন অবস্থাতেই অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে উল্লেখ করা যায় না। কেননা, তারা এই মুহূর্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ও সিপিবি দেশের প্রধান শক্র। কেননা তারা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে আজো মেনে নেয়নি। তিনি বলেন, সরকার জাতীয় কনভেনশন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন।১২

১৪. জনাব আতাউর খানের জাতীয় লীগের পক্ষ হতে জাতীয় লীগের জনাব আবুল কাশেম নির্বাচন স্থগিত করার দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিটি সরকারী প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ৭৭-এর ফেব্রুয়ারীতে যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন হয়ে পড়বে‘- এ মর্মে জাতীয় প্রতিরােধ কমিটিও অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করে। জনাব আতাউর রহমান খান যথাসময়ে নির্বাচন প্রদানে দাবি এত বেশী করেছেন যে, এখন তিনি নিঃশ্রুপ। এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন-প্রদত্ত বিবৃতিই তার পার্টির মতামত।স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের অন্যতম হােতা মওলানা মতিন আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘নির্বাচন দিলে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করবেন১৩ জিয়াউর রহমান এসব রাজনীতিবিদদের কাজে লাগিয়ে কাগুজে পরিস্থিতি সৃষ্টিকরে ১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারীর মধ্যে অনুষ্ঠিতর ও প্রতিশ্রুত পার্লামেন্ট নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করতে বিচারপতি সায়েমকে বাধ্য করলেন। প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার গতিরুদ্ধ হয়ে গেলাে। 

১৫. বিচারপতি সায়েম ১৯৭৫ ১৯৭৫ সনের ৬ই নভেম্বর ক্ষমতা গ্রহণের পর নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন-যদিও এই জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিলাে আরাে ৪ বছর। সেই সময় তিনি প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করবেন। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে বিচারপতি আবু সাদতমােঃ সায়েমকে অস্ত্রের মুখে তাড়িয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও ক্ষমতা দখল করে ঘােষণা দেন যে, প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে এবং তার প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা? অর্থাৎ মেজর জেনারেল জিয়া দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে অগ্রসর হলেন

জিয়াউর রহমানের নির্বাচনীসার্কাস হাঁ/না ভােট শেষ হওয়ার পর পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু জিয়াউর রহমান সে পথে অগ্রসর হলেন না। অত্যন্ত গােপনে তিনি প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বহাল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জন্য অগ্রসর হতে থাকেন।

জাগদল হ্যাজ কাম টু স্টে 

১৬. ১৯৭৭ সনের জানুয়ারী মাসেই প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাগণ বলে বেড়াতে থাকেন জাতীয় সার্বভৌমত্ব সংহত করা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে একটি স্থিতিশীল ব্যবস্থা গড়ে তােলার জন্য একটি রাজনৈতিক কাঠামাে অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলিকে আগের চেয়ে আরাে বেশী তৎপরতা চালানাের সুযােগ দেয়া হবে। সার্বভৌমত্ব সংহত করা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকার একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। ১৪

১৯শে জানুয়ারী প্রেসিডেন্টর অন্য এক উপদেষ্টা বাগেরহাটে সর্বস্তরের জন সাধারণের সামনে ঘােষণা করেন যে, “প্রস্তাবিত ফ্রন্টের ম্যানিফেস্টো হবে পূর্ণ গণতান্ত্রিক।

১৭. মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহযােগী ও সেনা ছাউনির সহযােগিতায় ১৯৭৮ সনের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী জিযার ক্ষমতায় আগমনের গােপন ক্রীড়নক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে আহবায়ক করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠনের অনুমতি পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলবিধির নিয়ম অনুযায়ী ও রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ চালানাের উদ্দেশ্যে আইযুব খানের পেয়ারা এন.এস.এফ নেতা ব্যারিস্টার আবুল হাসানাত ৭ই ফেব্রুয়ারী প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র জমা দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী ৭৮ তারিখে দলটি সরকার কর্তৃক অনুমােদিত হয়। মেজর জেনারেল জিয়ার ও সেনা ছাউনির প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপােষকতা, সাহায্য সহযােগতািয় গঠিত জাগদল-এর মেনিফেস্টোতে ঘােষিত হলাে সরকার পদ্ধতি হবে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির।১৫ [৪ঠা ফেব্রুয়ারি ৭৮ অবজারভার) আমলা, জেনারেল এবং বিদেশী কোম্পানীর বেতনভােগীরা উচ্চস্বরে ঘােষণা

করতে থাকেন, ‘আফ্রিকা-এশিয়ার বৃহত্তম দল হিসেবে জাগদল টিকে থাকবে।১৮

২৭শে ফেব্রুয়ারী জাগদলের ১১ দফার মূল লক্ষ্য ও কর্মসূচী প্রদান করা হয়। ১৬

জাগদলের ঘােষণাপত্রে প্রেসিডেন্টশিয়াল পদ্ধতির সরকারকে জোড়ালােভাবে সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য করা হয়-রাষ্ট্রপতি জনগণের দ্বারা পরিচালিত হলে। স্বাভাবিকভাবেই গণবিমুখ ও স্বৈরতন্ত্রের পথ রদ হবে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে আইন।

ও জাতীয় নীতি প্রণয়নে সহায়তা করার জন্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ থাকবে। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে আইন প্রয়ােগ ও নীতি বাস্তবায়নে সুষ্ঠুভাবে করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীমন্ডলীর ব্যবস্থাও থাকবে।

জাগদেল আহবায়ক কমিটি জিয়ার উপদেষ্টা 

১৯. ২৩শে ফেব্রুয়ারী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-এর ১৬ সদস্যের আহবায়ক কমিটির নাম ঘােষিত হয়। দলের আহবায়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, সদস্যগণ হলেন পেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা সর্বজনাব সৈয়দ আলী আহসান, আব্দুল মমানেম খান, শামসুল হুদা চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নূরুল হক, এনায়েত উল্লাহ খান, মওদুদ আহমদ, জাকারিয়া চৌধুরী, এম আর খান, আবুল হাসানাত, এম এ হক, ক্যাপ্টেন (অবঃ) সুজাত আলী, আলহাজ্ব এম এ সরকার, আবুল কাশেম।

সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকে না। 

২০. জাগদল সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় শুধু নয় সরকারী অর্থে ও সহায়তায় গড়ে তােলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়। প্রতিবাদে বলা হয় উপরাষ্ট্রপতি ও উপদেষ্টামন্ডলী সরকারী কর্মচারী। সরকারী কর্মচারী হিসেবে তারা কোন দলের সদস্য হতে পারেন না। ১৭ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি উপরােক্ত মন্তব্য করে। জেনারেল ওসমানী জিয়াউর রহমানের সুরকারকে সামরিক সরকার হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এই সরকারের কোন কর্মকর্তা, উপদেষ্টা কোন রাজনৈতিক দলে যােগ দিলে কেবল সরকারের দল নিরপেক্ষ চরিত্র নষ্ট হয় না, এর ফলে বর্তমান সরকারের ভিত্তি সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জাতির প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারের বরখেলাপ করা হয়।১৮ জাগদলের কাগজপত্র তৈরী, এমনকি সাংবাদিক সম্মেলনের কাজেও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ করা হয়েছে। সরকারী স্টেশনারী ব্যবহার করে আমন্ত্রণ জানানাে ইত্যাদি সরকারী অর্থে দল গঠনের নজির কেবলমাত্র জেনারেল আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের সঙ্গেই তুলনীয়। অথচ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিবেশী ভারতে একটি জনসভার কাজে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরাগান্ধীর ব্যক্তিগত সচিবের জড়িত থাকার অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ায় বিচারপতি জগলােছন তার নির্বাচনই বাতিল করে দিয়েছিলেন।

অনিয়মের চ্যালেঞ্জ 

২১. দেশে সামিরক আইনের অধীনে জারীকৃত রাজনৈতিক দল বিধির ৬ ও ৭ নং ধারায়।

দলের তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে চাদা গ্রহণ, রশিদ প্রদান, ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে তার পরিচালনার জন্য যে সমস্ত শর্ত যােগ করে দেয়া হয়েছিলাে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ১ম রাজনৈতিক সন্তান জাগদল তার কিছুই পালন। করেনি। তাছাড়া সামরিক সরকারের বেতনভুক্ত উপদেষ্টা হিসেবে রাজনৈতিক দল গঠনে তাদের নৈতিক ও আইনগত অধিকার ছিলােনা। এ অবস্থায় জাগদল গঠিত হলে ঢাকা মুন্সেফ কোর্টে ১৯৭৮ সনে ৪ঠা মার্চে জাগদল গঠনের আইনগত দিক চ্যালেঞ্জ করা হয় কিন্তু সামরিক ফরমানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে রাজনৈতিক দল হিসেবে জাগদলকে অনুমতি দেবার ফলে কোর্টের করার কিছুই ছিল। মামলাটি বর্তমান আকারে ও প্রকারে অচল বলে কোট রায় দেয়। ১৯

২২. মামলার রায় যাই হােক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে উপদেষ্টাগণ ছিলেন বাস্তব অর্থেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। সংবিধানে উপদেষ্টা পরিষদ বলে কিছুই ছিলাে না। এটা ছিলাে নিছক সাময়িক ব্যবস্থা, সামরিক ফরমানের মাধ্যমে গঠিত। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে জাগদল গঠন করলেও এর উপর ভরসা করতে পারছিলেন না। সরকারী সুযােগ-সুবিধা যানবাহন, হেলিকপ্টার, এমনকি সরকারী তােষাখানা হতে বিপুল অর্থ ব্যয়, প্রশাসন, সেনা চাউনি এবং গােয়েন্দা বাহিনীকে ব্যবহার করেও জিয়ার সামনে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ও গ্রাম পর্যন্ত বিপুল অগণিত কর্মীবাহিনী জিয়ার হিসেবী মস্তি ক্ষকে গরম করে রেখেছিলাে। জিয়াউর রহমানের হিসেবের যােগফলে বাম, ডান, স্বাধীনতা বিরােধী, মুক্তিযােদ্ধা সবকে মিলিয়ে একটি সুবিধাজনক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তাছাড়া এ সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত নেতাদের গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। যাদের সংখ্যা ছিল অর্ধ লক্ষাধিক। ২০ 

১৩, এমনি অবস্থায় জিয়াউর রহমানের সবুজ সংকেত পেয়ে জাগদল-এর আহবায়ক

কমিটির এক জরুরী সভা ১৯শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারের বাসভবনে। সভায় প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির নির্বাচন ঘােষণাকে অভিনন্দন জানানাে হয়। এবং ঐ ঘােষণার আলােকে অবিলম্বে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার অনুরােধ জানানাে হয়। সভায় রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশ গ্রহণ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের যে ধারা রাজনৈতিক দল গঠন এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিপন্থী তা অবিলম্বে বাতিল করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানানাে হয়। অপর এক প্রস্তাবে রাজনৈতিক

ক্রিয়াকে সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক করার জন্য সকল রাজনৈতিক দলকে অবাধ ও প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার প্রদানের অনুরােধ জানানাে হয়।২১ 

২৪. জাগদল কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার নির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার দাবীর মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান টেলিভিশন ও রেডিওতে এসে ভাষণ দিলেন। ২১শে এপ্রিলের এই ভাষণে ঘােষণা করলেন, দেশে ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১লা মে থেকে ঘরােয়া রাজনীতির পরিবর্তে খােলা রাজনীতি শুরু হবে। সভা সমিতির করা যাবে। তবে মিছিল করা চলবে না।।

২৫. ২৬শে এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ চতুর্থ সংশােধনী বাতিলের দাবী

জানান। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েম চতুর্থ সংশােধনী বাতিল করে দেশে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি প্রচলনের জন্য মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তার ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেদিন এই বলে বাধা দিয়েছিলেন যে, নির্বাচিত সংসদই ঠিক করবে সরকার পদ্ধতি কি হবে। কিন্তু ৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে নির্ধারিত সে নির্বাচন হয়নি। জিয়া ক্ষমতা দখল করে বিচারপতি সায়েমকে বঙ্গভবন হতে বের করে দিয়ে নির্বাচিত সংসদের উপর সরকার পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা হরণ করে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করেন। এই অবস্থায় ২৬শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ ৪র্থ সংশােধনীর বাতিল এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করে। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখলের পর টেলিভিশন, বেতার ভাষণে মে মাসে তার প্রতি আস্থাসূচক গণভােট অনুষ্ঠানের কথা ও ১৯৭৮ সনের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ঘােষণা করে। কিন্তু জিয়া দেশবাসীকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি বরখেলাপ করে ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বানের ঘােষণা দেন।

ইলাবরেড ফ্রড 

২৬. প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘােষণার পর ৭ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে আতাউর রহমান খান এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে, তাদের জনগণের সামনে হাজির হবার সুযােগ্ না দিয়ে, সভা সমাবেশ গণসংযােগ করার সুযােগ না দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও তার উপদেষ্টা অফিসারগণ আড়াই বছর ধরে হাওয়াই জাহাজ ও সরকারী যানবাহনে ঘুরে ফিরে বালাদেশে অতঃপর মাত্র ৪২ দিনের নােটিশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে ফরমান জারী করেছেন তা হচ্ছে একটি ইলাবরেড ফ্রড বা বিরাট ভাওতা।২২

জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টঃ দ্বিতীয় সন্তান 

২৭. জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন জাগদল দিয়ে তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন না। সেজন্য, তিনি আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। ১৯৭৮ সনের ১লা মে তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হলাে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য এটা ছিলাে একটি জগাখিচুড়ী ব্যবস্থা। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল অবশ্য প্রেসিডেন্ট জিয়াকে জাগদলের প্রার্থী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রূপে প্রদ্বিন্দ্বিতার অনুরােধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া সে অনুরােধে সাড়া না দিয়ে চীন-সৌদি বলয়ের আশ্রিত দলগুলােকে এক করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার প্রিন্ট তৈরী করেন। ফ্রন্টে যে সমস্ত দল যােগদান করেছিলাে তারা হলাে জাগদল, ভাসানী ন্যাপ (মশিউর), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (শাহ আজিজ) লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ তফসিলী জাতি ফেডারেশন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এর কোনটারই সদস্য ছিলেন না। কিন্তু তাকেই করা হলাে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী। প্রত্যেক দল থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হলাে।

২৮. ৭৮ সনের ২৫ মে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচনী ঘােষণা ও কর্মসূচী প্রকাশ করা হয়। ফ্রন্টের দফা ছিলাে ১৩টি। অথচ ১৯৭৭ সনের মে মাসে অনুষ্ঠিত গণভােটে জিয়াউর রহমান ঘােষণা করেছিরেন ১৯ দফা কর্মসূচী। ২৩ কিন্তু গনভােটের ম্যানডেটকে ঝেড়ে ফেলে জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ঘােষণা করলেন ১৩ দফা [পরিশিষ্ট-৮] ১৩ দফার সঙ্গে ১৯ দফার তাৎপর্য ও পার্থক্য লক্ষ্যণীয়, কতিপয় দফা পরস্পর বিরােধী।

২৯. বিভিন্ন পরস্পর বিরােধী নেতৃত্ব ও স্বার্থ লালনকারী ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা একমত হতে পেরেছিলেন কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থের প্রশ্নে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে বানােয়াট মিথ্যাচার, কল্প কাহিনী, অতিরঞ্জিত অপপ্রচার এবং ভারত বিরােধীতা তাদের একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছিলাে। তাদের ঐক্যের সূত্রে কোন আদর্শবােধ ছিলাে না। কোন রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে এই ফ্রন্ট গঠিত হয়নি। স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল ও শক্তিকে প্রতিরােধ করার লক্ষ্যেই এই ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিলাে। জিয়াউর রহমান তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দোহার‘, সৃষ্টির জন্যই ফ্রন্ট গঠন করলেও নির্বাচনের ১০৭ দিন পর ফ্রন্ট ভেঙে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে আর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ৩০. ১৯৭৮ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে ২৮শে মে ১৯৭৮ সনে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের ১৩ দফা নির্বাচনী ঘােষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারকালে ঘােষিত ও প্রতিশ্রুত এই দফা সম্পর্কে তেমন একটি প্রচার করা হয়নি। নির্বাচনী কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে আওয়ামী লীগ, ভারত বিদ্বেষকে। সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যে ক্ষেত্রে দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেই যেখানে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী সেক্ষেত্রে নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট (গজ) গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে দাড় করানাে সেই সময়ের বিচারে যুক্তিযুক্ত হয়েছিলাে বলে ইতিহাস প্রমাণ করবে। আওয়ামী লীগ জেনারেল ওসমানীকে সামনে রেখে ঘর গােছানাের প্রক্রিয়া চালায়। ২৪ 

৩১. ১৯৭৫ সনের ১৫ ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর রাজনৈতিক দল ও কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করার পর প্রায় ৩ বছর রাজনৈতিক দলসমূহকে ঘরে আটকে রেখে আওয়ামীলীগের শাসনামল সম্পর্কে বানােয়াট মিথ্যাচার প্রচার করা হয় অহরহ। রেডিও টিভি হতে এমন সব বিষয় প্রচার করা হয়। যা শুধু মিথ্যাচারই নয়, জাতীয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও মর্মবাণীকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। মনগড়া কল্পকাহিনী, ২৫ বছর চুক্তি সীমান্ত চুক্তি ইত্যাদি মিলিয়ে আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জনমনে বিভীষিকাময় চিত্র তুলে ধরা হয়। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ সামরিক ফরমানে নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। 

৩২. এই অবস্থা জিয়াউর রহমানের তিন বছর স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের ১ লক্ষ ১৩ হাজার নেতা কর্মীকে পর্যাক্রমিক গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখে।২৫ নির্মম অত্যাচার অনেককে জেলখানায় হত্যা করা হয়। প্রায় তিন হাজার জোয়ান-অফিসারদের ফাঁসী দেয়। সমগ্র দেশে এক বিভীষিকাময় অবস্থার সৃষ্টি করে। জিয়াউর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা বিরােধী উগ্র ডান বাম চক্র যারা জিয়ার দলে ভীড় জমায় তারা শ্লোগান তুলে একটা দুটো বাকশাল ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর।সর্বোপরি দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমান ৭৮ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩০শে মে, ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভায় বলেন, আজ আমি আপনাদের কাছে সত্য কথা বলিব। আওয়ামী বাকশালীরা কোন দিন স্বাধীনতা চায় নি। ওরা স্বাধীনতা বিক্রী করে দিয়েছিলাে। অই ওরা স্বাধীনতা রক্ষা করিতে পারিবেনা ৩১ শে মে নারায়ণগঞ্জ জনসভায় ঘােষণা করেন, আওয়ামী বাকশালীরা স্বাধীনতা চায় না। ওরা পরাধীনতা চায়। ওরা দেশকে বিক্রি করতে চায়। যারা দেশকে বিদেশের কাছে বিক্রি করতে চায় তাদের ভােট না দেবার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহবান জানান। ২৬ 

৩৩. সাধারণ একজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী একথাগুলাে উচ্চারণ করলে এটাকে নির্বাচনী স্টান্টহিসেবে বিবেচনায় আনা যেতে পারে। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যে সমস্ত মারাত্বক অভিযােগ করেছেন, তা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রদ্রোহীতার প্রশ্ন। তিনি নিজেই দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন পশাসক, প্রধান সেনাপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার। দেশ চলছিলাে সামরিক শাসনের অধীনে। এই অভিযােগের স্বপক্ষে নিশ্চয়ই প্রয়ােজনীয় তথ্য ও প্রমাণপত্র তার হাতে আছে । যারা স্বাধীনতা চায়নি, এখনাে চায়না, যারা অতীতে স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছে। এবং আজও বিক্রি করে দিতে চায় এতসব জেনে শুনে কেন সেই আওয়ামী লীগকে সামরিক শাসনের আওতায় দল গঠনের অনুমতি দিলেন

৩৪. আসলে এসবই ছিলাে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ভাওতাবাজী, মিথ্যাচার। জিয়াউর রহমান নিজেই আওয়ামীলীগের সহযােগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামীলীগকে উইন ওভার” করতে না পেরে জিয়ার মাথা গরম হয়ে যায়। দেশের বুকে তখন মাঝে মাঝেই গুজবের মতাে শুনা যে-জিয়া খুব শীঘ্রই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘােষণা করবেন। এসব গুজব জিয়াউর রহমান নিজেই ছড়াতেন। জিয়াউর রহমান আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন আমি তাে আওয়ামীলীগেরই। আপনাদের অধীনেই যুদ্ধ করেছি। আপনাদের অধীনেই চাকুরী করেছি। আওয়ামীলীগের জন্য আমিই তাে আছি।কিন্তু আওয়ামীলীগের সরাসরি শর্ত ছিলাে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার করতে হবে, জাতির পিতাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং আওয়ামীলীগে যােগদান করতে হবে। জিয়া প্রস্তাবিত দলে আওয়ামীলীগ যােগদান করবেনা। ২৮

৩৫. নির্বাচনের পূর্বে সেনা ছাউনি হতে লক্ষ লক্ষ টাকা বিলানাে হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এক অংশকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে নির্বাচনের টাকা দেয়া হয়। শ্রমিক বেল্টে কাজী জাফর দুহাতে টাকা খরচ করেন। চিহ্নিত দাগী মাস্তান ও আসামীদের কারাগার হতে ছেড়ে দেয়া হয়। 

৩৬, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহসীন হলে ১৯৭৪ সনে ৭ জন ছাত্র হত্যার মূল আসামী ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট শফিউল আলম প্রধান, যাকে বঙ্গবন্ধুর সরকার গ্রেফতার করেছিলেন। ছাত্র হত্যার দায়ে ৭ বছর সশ্রম করাদন্ড ভােগ করছিল সেই শফিউল আলম প্রধানকে জিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কারাগার হতে ছেড়ে দেন।

৩৭. ৩রা জুল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ই জুন সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল ওসমানী বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে।২৯

জিয়াউর রহমান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন। ব্যবহার করেন গােয়েন্দাবাহিনীকে। বিশেষ তহবিল হতে কোটি কোটি টাকা দুহাতে খরচ করেন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতেও বিপুল পরিমাণ টাকার অপচয় করেন জিয়া নির্বাচনী স্বার্থে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মঃ

৩৮, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তিনি আর্মি এ্যাক্ট পর্যন্ত সংশােধন করেছেন। (হাসানুজ্জামান পৃ. ৪৪/৪৫)। জিয়াউর রহমানের মনােনয়নপত্র বাছাই কালে এম, , জি, ওসমানীর মনােননের অন্যতম সমর্থক ও অন্যতম প্রস্তাবক ফেরদৌস আহমদ কোরেশী রিটার্নিং অফিসারের কাছে একটি আপত্তি পেশ করেন। এতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশের ৫ (২) খ ধারা অনুযায়ী এবং সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২) দফার (ছ) উপদফা অনুযায়ী এবং সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ও সেনাবাহিনীর রেগুলেশন বা সেনা আইনের ২৯৩ ও ২৯৬ বিধিদ্বয় অনুসারে সেনাবাহিনীর চাকুরী করা কালে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না। এই আপত্তি বাতিল হয়ে যায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের ২৮/৪/১৯৭৮ তারিখের রুল ৫/১/৭৮/২৪১ নম্বর আদেশ ” লে সংশােধিত আকারে ২৯৩-ক বিধি অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা রাষ্ট্রপতি পদে আসীন এমন কোনাে অফিসারের ক্ষেত্রে উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।৩০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ হতেও আপত্তি উথাপিত করা হয়।

 

৩৯. আওয়ামী লীগ ও গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের পক্ষ হতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সেনাপতি পদ হতে জেনারেল জিয়ার পদত্যাগ, নির্বাচনের আগে ৬ মাস সময় প্রদান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকরে পদ হতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার পদত্যাগ, পি,পি,আর বাতিল, সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত সকল মামলা উচ্চতর আদালতে আপীল করার সুযােগ, সামরিক আইন প্রত্যাহার, ‘৭২ পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতি এবং চতুর্থ সংশােধনী বাতিল, ‘৭২ সনের সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করার দাবী জানানাে হয়।

৪০, জিয়াউর রহমান এর কিছুই মানলেন না। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২রা মে আওয়ামী লীগ, পিপলস্ লীগ , ন্যাপ (মােজাফফর) সি,পি,বি, গণআজাদী : লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি সমন্বয়ে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট-গজ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গজের প্রার্থী হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল (অবঃ) আতাউল গনি ওসমানী। নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী বললেন, আমার এক দফা। আমি সংসদীয় গণতন্ত্র চাই।৩১

৪১. ৭ দলীয় ঐক্য জোট আওয়ামী লীগের দাবীর প্রায় হুবহ দাবী উত্থাপন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখলেও নির্বাচনের ১ সপ্তাহ পূর্বে আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করতে হবে। দেশ থাকলে গণতন্ত্র আসবে। আওয়ামী-বাকশালীদের প্রতিহত করুন।৩২

৪২. সামাজবাদী দলের ফাস্ট সেক্রেটারী সিদ্দিকুর রহমান সাংবাদিক সম্মেলনে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অর্থহীন এবং ইহাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে থাকার জন্য একটি ন্যাক্কারজনক নিম্নশ্রেণীর রাজনীতির খেলার চাকুরী মাত্র।৩৩

ভােট জালিয়াতির বিশ্বরেকর্ড

৪৩. ৭৮ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রর্থীর সংখ্যা ছিল ১০ জন। এরা হলেন মেজর

জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এম,,জি, ওসমানী, জনাব আজিজুল ইসলাম, জনাব আবুল বাশার, প্রিন্সিপাল আবদুল হামিদ, হাকিম মাওলা খবির উদ্দিন আহমদ, জনাব আবদুস সামাদ, জনাব গােলাম মােরশেদ, শেখ আবু বকর সিদ্দিক, ও সৈয়দ সিরাজুল হুদা। সর্বমােট ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৭ জন ভােটারের মধ্যে ২ কোটি ৮৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৪ টি ভােট পরে। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান ১কোটি ৫৭ লাখ ৩৩ হাজার ৮০৭টি, জেনারেল (অবঃ) ওসমানী ৪৪ লাখ ৫৫ হাজার ২ শভােট, আজিজুল ইসলাম ৪৯ হাজার ৬৪, আবুল বাশার ৫১ হাজার ৯৩৬, প্রিন্সিপাল আবুল হামিদ ২৩ হাজার ৯৬৪, হাকিম মাওলা খবির উদ্দিন ৮ হাজার ৪২৫, আবদুস সামাদ ৩৭ হাজার ২৭৩, গােলাম মােরশেদ ৩৮ হাজার ১৯৩. শেখ আবু বকর সিদ্দিক ২৫ হাজার ৭৭ এবং সৈয়দ সিরাজুল হুদা ৩৫ হাজার ৬১৮টি ভােট পেয়েছিলেন। শতকরা ৫৪% লােক ভােট দিয়েছিল। ৪৪. সুধি পাঠকদের একটু স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়ােজন যে, ১৯৭৭ সনে মেজর জেনারেল জিয়া হাঁ/না ভােট করেছিলেন। তখন ভােটের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮৫৮ জন। এর মধ্যে বৈধ ভােট পড়েছে ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭০ হাজার ৭৬৮ টি। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান হা সূচক ভােট পেয়েছিলেন ৩ কোটি ৩৪ লক্ষ ৮৭০টি। প্রদত্ত ভােটের ৯৮,৮৮% ভাগ- যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে এবং ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন- এই ৩৬৯ দিনের মধ্যে জিয়ার ভােট কমেছে ১ কোটি ৭৬ লক্ষ ৬৭ হাজার ৩৬ টি। এবং ভােটারদের উপস্থিতি কমেছে ১, ৪৮, ৯৩, ৮৭৪টি। ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে-র নির্বাচনে প্রকৃত প্রস্তাবে ভােটারদের উপস্থিতির হার ছিল নগণ্য। কিন্তু প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের তুলনাহীন জনপ্রিয়তা দেখাতে নির্দেশিত জেলা-থানা প্রশাসকগণ বিপুল পরিমাণ ভােট জালিয়াতি করেছে। যা ছিলাে বিশ্বরেকর্ড। নির্বাচন কমিশন-এর নিরপেক্ষতা বলতে কিছুই ছিলােনা। সামরিক শাসনের অধীনে স্বয়ং সামরিক প্রধান যেখানে প্রার্থী সেখানে সকল আইনানুগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছিলাে। 

৪৫. জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতির উর্দি পরে সশস্ত্র বাহিনীর স্যালুট নিচ্ছেন। নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে ড্রেস পরে গ্রামে গিয়ে জিয়ার পক্ষে ভােট চাইছেন- জিয়াকে ভােট না দিলে জনগণের ভােগান্তি হবে বলে হুমকি দিচ্ছেন। সামরিক অফিসারদের জেলায় জেলায় নির্বাচন তদারকীর নাম করে জেলা প্রশাসনকে কবজা করে নেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে; এমনি অবস্থায় নিরীহ জনগণ জানমালের নিরাপত্তা বিধানে জিয়াউর রহমানকেই ভােট দিয়েছেন। কেননা ৭১ সনে সামরিক বাহিনীর নির্মম নিষ্ঠুরতা তাদের চেতনায় তখনও জ্বল জ্বল করে জ্বলছিল। এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রাত দশটার পর কার্য্য এই পরিবেশে ৭৮-এর প্রহসন মূলক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সমগ্র নির্বাচন কাঠামাে ও ব্যবস্থাকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছিলাে। নির্বাচনের পর ২৯ শে মে জুন ৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ২৮ সদস্যের একটি মন্ত্রী পরিষদ ও দু জন প্রতি মন্ত্রী নিয়ােগ করেন।৩৫ 

৪৬. ১৯৭৭ এর গণভােট ও বিগত ৩রা জুন -এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেমন দেশের ভবিষৎ শাসনতন্ত্র ও সরকারের কাঠামাে সম্পর্কে দেশবাসীকে সুস্পষ্টভাবে জ্ঞাত করানাে হয়নি, ‘৭৮ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তেমনি শাসনতান্তিক কাঠামাে ও সরকারের পদ্ধতি সম্পর্কে নীরবতা ও অস্পষ্টতা বিদ্যমান।

৪৭. ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন পদ দখলের পর

বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে মে মাসে তার প্রতি আস্থা সূচক গণভােট অনুষ্ঠানের কথা এবং ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচনের কথা ঘােষণা করেন। এ ঘােষণাতেও সংসদীয় গণতন্ত্রের ওয়াদা অপরিবর্তিত থাকে। তৎসত্বেও জনগণ মনে করছিলাে যে, মধ্যবর্তী দেড় বছরের জন্য জেনারেল জিয়া রাজত্ব করবেন তার জন্য তিনি গণভােটের দ্বারা ম্যান্ডেট নিয়েছেন। 

৪৮, কিন্তু প্রশ্ন উঠলাে ১৯৭৮ সালেন ডিসেম্বর মাসে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি কি সংসদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন? ব্যারাকে ফিরে যাবেন? নাকি তিনি প্রধান সেনাপতি পদ ছাড়বেন

৪৯.সময়ও এগিয়ে চললাে ৩০শে সেপ্টেম্বর ও ২রা অক্টোবর বগুড়া ও ঢাকায় ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথান হলো। অভ্যুথানের দুতিন দিন পর প্রেসিডেন্ট দেশী ও বিদেশী এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করলেন যে, ভারত হতে যে সমস্ত সশস্ত্র দুস্কৃতিকারী এসেছে, যারা সীমান্তে হামলা ও ফারাক্কায় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার বিষয়ে টু শব্দ উচ্চারণ করে না তাদের উস্কানীতেই ব্যর্থ অভ্যুথান ঘটে। শুরু হলাে ধামকি, হুংকার। কিন্তু তদন্তে প্রমাণিত হলাে চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ জড়িত নেই। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বলয়ে প্রেসিডেন্ট কার্টার বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সােচ্ছার হলেন। ১৯৭৭ এর শেষে এবং ৭৮ এর প্রথমে ইউরােপীয় পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘন সম্পর্কে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। বলা হয়, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠত না হলে বৈদেশিক সাহায্য কমে যাবে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলগুলাে এতদিন বিভিন্ন ইস্যুর ভিত্তিতে আওয়ামী বাকশাল রুখার জন্য মেজর জেনারেল জিয়াকে অব্যাহত ও অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছিল তারাও নির্বাচন ও প্রকাশ্য রাজনীতির দাবী উত্থাপন করে। এই সমস্ত অব্যাহত দাবী ও ঘটনার পরিপেক্ষিতে ১৯৭৭ সালেন ১৫ই ডিসেম্বর রাতে রেডিও ও টেলিভিশনে ভাষণে জিয়াউর রহমান একটি ব্যাপক ভিত্তিক রাজনৈতিক ফ্রন্টগঠনের আহবান জানান, তখনও পার্লামেন্টটারী সরকারের ওয়াদা হতে জিয়াউর রহমান পিছিয়ে যাননি। তখনও ৪র্থ সংশােধনী রেখে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে সরকারী অপপ্রচার চলতে থাকে। প্রচারে প্রতীয়মান হলাে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ৪র্থ সংশােধনী বাতিল হবে। দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি সরকার গঠিত হলে সার্বভৌম পার্লামেন্টের ক্ষমতা কি হবে বলা হলােনা। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জিয়া নীরব থাকলেন। একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি পদ আকড়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হয়ে শসনতন্ত্র সংরক্ষণ ও হেফাজত এর শপথ গ্রহণ করলেন। কিন্তু কয় বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেন তাও গােপন করা হলাে।

৫০. নির্বাচন উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে কত দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হলেন এই প্রশ্নের উত্তরে জিয়া পাল্টা সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, আপনি কত দিনের মনে করেন? রাজনীতিতে এলে  সেনাবাহিনী কি ছাড়বেন? এই সম্পর্কে বলা হলাে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এখন আর সেনাবাহিনীর প্রধান নন, এখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নন, তিনি সশস্ত্র বাহিনী সমূহের সুপ্রীম কমান্ডার। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর পােশাকেই বলতে থাকেন পার্লামেন্ট হবে সার্বভৌমকেমন সার্বভৌম?” সরকার পদ্ধতির রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারবে কি? যদি আগমী ৭৯-এর নির্বাচন সংখ্যাগুরু এমপিরা জাতীয় সংসদে সংসদীয় সরকারের স্বপক্ষে প্রস্তাব পাশ করে তাহলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়ার অবস্থা কি দাঁড়াবে? তিনি কি পার্লামেন্টারী সরকারের অধীনে শাসনতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হবেন? ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন?

এই প্রহসনের অর্থ কি

৫১. জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, দেশ থেকে সামরিক আইন তুলে নেবেন রাজনৈতিক দলবিধি প্রত্যাহার করা হবে এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম সর্বপ্রকার নিয়ন্ত্রন মুক্ত হবে। এখন স্পষ্টতঃ মার্শাল ল উঠছে না,প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনী ওয়াদা ভংগ করে চলেছেন। বাংলাদেশকে পুলিশী স্টেট‘-এ পরিণত হযেছে। বাক, স্বাধীনতা, নিয়মতান্ত্রিক বিরােধীতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সহ মৌলিক অধিকার হরণ করে জিয়াউর রহমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে দেশে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে চলছেন।

পার্লামেন্ট নির্বাচন ও কালো টাকা আর ষড়যন্ত্র: 

৫২. জিয়াউর রহমানের নিকট, জীবন মরণ সমস্যা ছিলাে জাতীয় সংসদ নির্বাচন।১৯৭৮ সনের ৮ই নভেম্বর জিয়াউর রহমান টেলিভিশন রেডিওতে ঘােষণা দিলেন ১৯৭৯ সনের ২৭শে জানুয়ারী দেশে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। টিভি বেতার ঘােষণায় তিনি আরাে বললেন, পার্লামেন্ট হবে সার্বভৌমএবং পার্লামেন্ট নির্বাচনের পরপরই মার্শাল ‘ল উঠিয়ে নেয়া হবে। নির্বাচন হবে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ। তিনি প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশ গ্রহণে অনুরােধ জানান। পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘােষণার পর বিরােধী দল হতে প্রতিক্রিয়া জানানাে হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১১ দফা দাবী উত্থাপন করে। দাবীগুলাের মধ্যে

নির্বাচনের পূর্বেই সামরিক আইন প্রত্যাহার, সামরিক বাহিনী হতে জিয়াউর রহমানের পদত্যাগ, রাজবন্দীদের মুক্তি, সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত সকল বন্দীদের উচ্চতর আদালতে আপিল‌ের সুযােগ প্রদান, ৪র্থ সংশােধনী বাতিল করে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, বিশেষ ক্ষমতা আইন সহ সকল কালাকানুন বাতিল ছিলাে অন্যতম। বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, জাতীয় জনতা পার্টি, জাসদ, গণআজাদী লীগ, ডি, এল, ন্যাপ (নাসের) জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ইউ পি পি দলগুলাে নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রায় একই রকম দাবী উথাপন করে। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ১০ দল নির্বাচন সংক্রান্ত দাবীর সঙ্গে নির্বাচন পিছানাের দাবীও জুড়ে দেয়। মুসলিম লীগ এসব দাবীর সঙ্গে পৃথক নির্বাচনের দফাও নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়। মুসলিম লীগ নেতারা বায়তুল মােকাররমে জনসভা করে ঘােষণা করে ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে এসব দাবী মানা না হলে উদ্ভূত গুরুতর পরিস্থিতির জন্য মুসলিম লীগ দায়ী থাকবে না।৩৭ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মুসলিম লীগের হুশিয়ারীতে কর্ণপাত না করে মুসলিমলীগ প্রধান খান, আবদুস সুবুর খান এর সঙ্গে গােপনে পরামর্শ করলেন। সবুর খানের মুসলিম লীগ নির্বাচনে যাওয়ার ঘােষণা দিলাে। সিপিবি, দীর্ঘ কয়েকদিন নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলােচনা করে এবং কোনরূপ শর্ত ছাড়াই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবশ্য পূর্ব কথা ছিলাে আওয়ামী লীগের সাথে কথাবার্তা বলে নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তা না করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে গােপনে সলাপরামর্শ করে তারা শর্তহীনভাবে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরপরই ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা সমর্থন করেন। সে জন্য ন্যাপের পক্ষে শর্তহীনভাবে নির্বাচন যাওয়াই স্বাভাবিক।

গণ রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাঃ

৫৩. ৭৮-এর ৩রা জুন নির্বাচনের পর মেজর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট পদে শক্ত। হয়ে বসলেন। ৭৬-৭৭ সন পর্যন্ত কয়েকটি সামরিক অভ্যুথান নির্মমহাতে দমন করেছেন। এখন তিনি সৈনিকহতে রাজনৈতিকহওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে এলেন। চীনপন্থী গ্রুপ, স্বাধীনতা বিরােধী দল, ব্যক্তি, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের নিয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে একটি রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করার

লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান অগ্রসর হলেন। জুন মাস হতেই জিয়া ও তার সঙ্গীরা নতুন একটি দল গঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা চালাতে লাগলেন। সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপােষকতায় নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া দেশব্যাপী চালু হল। দল গঠনে প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে জিয়াউর রহমান বললেন জাতীয় ঐক্যের অভাব, বিশেষতঃ দেশপ্রেমিক শক্তি ও গােষ্ঠীর মধ্যে সমঝােতা ও মৌলিক ঐক্যবােধের অভাব বাংলাদেশের মত আপাতঃ দারিদ্র অথচ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে সহজেই বৈদেশিক আধিপত্যবাদ ও আভ্যন্তরীণ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার শিকারে পরিণত করতে পারে।”৩৯ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের কথা ঘােষণা করেন এবং দলের আহবায়ক হন। ২৬শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউটের এক জনসভায় প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমান বলেন, “আমরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মাধ্যমে বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি এবং এ কারণে আমি জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ভেঙে দেবার কথা ঘােষণা করছি।তিনি বলেন, “আমি আশা করি ফ্রন্টের অঙ্গদলগুলাে এই ঘােষণা মেনে নেবে।” জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে শুধু সঙ্গীণবিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হলেন না, বরং ফ্রন্টের মাধ্যমে জনগণকে দেয়া নির্বাচনী ওয়াদাকে বুটের তলায় চেপে ধরলেন। জিয়ার ঘােষণা ছিল অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী; জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জিয়ার ব্যক্তিগত দল বা সম্পত্তি ছিলাে না। ৬টি দল নিয়ে গঠিত ১২ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটি দ্বারা ঐক্যের খাতিরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দলনিরপেক্ষ লােক হিসেবে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্ট পদে মনােনয়ন দিয়েছিলাে। ফ্রন্ট থাকা না থাকার ব্যাপারে তার একক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন অধিকারই ছিলাে না। স্বৈরাচারী ডিক্টেটর হিসেবে জিয়া ফ্রন্ট বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠন করার ঘােষণা দেন। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের প্রার্থী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর, প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিকট ৭৭ সনের হাঁ/না ভােটে দেয়। সেখানে ১৯ দফার অস্তিত্ব থাকার কথা ছিলাে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য ১৯ দফাকে বলি দিয়ে তিনি ফ্রন্ট করেন ১৩ দফার ভিত্তিতে। ১৩ দফার ৪ নম্বর দফার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল সরকার পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্ধারণ করবে। কিন্তু জাগদল, ন্যাপ (মশিউর) ও মুসলিম লীগ নিয়ে গঠন করলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। 

৫৪. ১৯৭৮ সনের আগস্টে দলের পক্ষে ডাঃ এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ঘােষণাপত্র শীর্ষক পুস্তিকার ৭ নম্বর দফায় বলা 

হলাে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য, সামাজিক অনাচার ও অসমতা দূর করার জন্য, দ্রুত সার্বিক জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থক প্রয়াস চালানাের জন্য যে স্থিতিশীল ও নির্ঘন্ধ জাতীয় নেতৃত্বের প্রয়ােজন তা দেবার ক্ষমতা রয়েছে কেবল এমন এক প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের, যেখানে রাষ্ট্রপতি নিজে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দল, জনগণ সমর্থিত, অবিসংবাদিত, স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে বিশ্বাস করে। সেই জন্য আমাদের দল একাধিক রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ নির্বাচিত এবং সক্রিয়ভাবে গণসমর্থিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারে বিশ্বাস করে।অর্থাৎ পার্লামেন্টকে সরকার পদ্ধতি ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি নির্ধারণের ক্ষমতা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দেয়া হয়েছিল, তা সরাসরি অস্বীকার করা হলাে। জিয়াউর রহমানের নিকট এসব দফার কোন মূল্যই ছিল না। তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার পথ নিষ্কন্টক করা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা। সেজন্য ১৯৭৭ সনে হাঁ/না ভােটের সময় জনগণের রায় চেয়েছিলেন ১৯ দফা দিয়ে। ৭৮ সনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৯ দফা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ১৩ দফা দিয়ে। ১৩ দফায় জনগণকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনের পরপরই তা ছুঁড়ে ফেলা হলাে। পুনরায় ঘােষিত হলাে ১৯ দফা। আবার সেই ১৯ দফার পেট থেকে শিল্প বিপ্লব ঘটানাের জন্য দেয়া হলাে ৪৩ দফা।

দল ভাঙ্গাভাঙ্গির রাজনীতিঃ

৫৫. জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের (জাগদল) আহবায়ক ও উপরাষ্ট্রপতি জনাব বিচারপতি আব্দুস সাত্তার জাগদল সম্পর্কে বলেন যে, ফ্রন্ট ঠিকই আছে, তবে আমাদের নিজস্ব পার্টি জাগদলকে সংহত ও শক্তিশালী করার জন্য মনােযােগ দিচ্ছি। তিনি পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অনুপ্রেরণা ও নির্দেশে জাগদল গঠিত হয়েছে। জাগদল আহবায়ক সুস্পষ্টভাবে জানান যে, সকল বাস্তব অর্থে রাষ্ট্রপতি হচ্ছে জাগদলের নেতা।জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারী উদ্যোগে কযেকটি দল নিয়ে এক দল গঠনের চেষ্টা চলছে। সরকারী মহলেরই কেউ কেউ একদল গঠনের ঘােরতর বিরােধী। বর্তমানে একদল গঠনের পক্ষে এবং বিপক্ষে বামপন্থী মন্ত্রী এনায়েত উল্লাহ খান সাম্প্রতিক ভাষণে বলেছেন যে, গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে জাতীয় ঐক্য, তিনি সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে ঐক্য গড়ে তােলার জন্য আহবান জানিয়েছেন। জনাব এনায়েত উল্লাহ খানের বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে গঠিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের সকল অংশও দলকে নিয়ে একটি দল গঠন করা। জনাব। এনায়েত উল্লাহ খানের এই আহবান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার আহবানেরই প্রতিধ্বনি মাত্র। এদিকে জাগদলের আহবায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ও মৎস্যমন্ত্রী জনাব ওবায়দুর রহমান সম্প্রতি চাঁদপুরে এক জনসভায় ঘােষণা দিয়েছেন যে জাগদলের কোন বিকল্প নেই। অর্থাৎ তিনি চান না যে, কতিপয় দলকে একত্রিত করে নিয়ে জাগদলের বিলুপ্তি সাধন করা হােক। ৪ঠা জুলাই ৭৮ সমাপ্ত জাগদলের জেলা ও মহকুমার কমিটির আহবায়কদের সম্মেলন পন্ড হয়ে যায়। এই সম্মেলনের শুরুতেই এক দল গঠনের প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দেয় এবং সেদিন বিকেলে হােটেল ড্যাফোডিল প্রাঙ্গণে শ্লোগান পাল্টা শ্লোগানের পর এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ধাওয়া করে, হাত থেকে কাগজ ছিনিয়ে নেয়া এবং পরিশেষে কোন সুরাহা ছাড়া অধিবেশন শেষ হয়। ড্যাফোডিলের ঘটনা শেষ হওয়ার পরে একটি গ্রুপ জনাব মােজাম্মেল হকের নামে এক বিবৃতি প্রচার করে। তিনি বলেন যে, তার হাত থেকে স্বার্থবাদী মহলের ভাড়াটিয়া গুন্ডারা একটি কাগজ ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে মারতে উদ্যত হয়। বলা বাহুল্য, এই কাগজে এক দল গঠনের সমর্থনে সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ছিলেন।পরদিন আরও ১৫ জন সদস্য ও ৬৪ জন আহবায়ক এক যুক্ত বিবৃতিতে অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করার জন্য আহবান জানান। বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঐক্যবিরােধী ক্ষমতা লােভী অনুপ্রবেশকারীদের চক্রান্ত প্রতিহত করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আহবান জানানাে হয়। সিনিয়র মন্ত্রী ও ন্যাপের জনাব মশিউর রহমান তার বক্তব্যের মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্যের কথা বলেছেন।

আভাসে ইঙ্গিতে তিনিও একদল গঠনের পক্ষপাতী। একদল গঠিত হলে কাজী জাফর আহমাদের অসুবিধা হবে, তবে কর্মীরা একদলে যেতে রাজী নয়। তারা তাদের পার্টির অস্তিত্ব বিলােপের বিরােধী। কাজী জাফর যদি একদল গঠনে রাজী হয়ে নিজের দলের পৃথক সত্ত্বার বিলােপ সাধনে রাজী হন তবে কর্মীদের হারাতে হবে। বর্তমানে কাজী জাফরের সামনে বিরাট সমস্যাএদিকে মুসলিম লীগের সাথে এক হওয়া, তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করাটাও ইউপিপির ঘােষিত নীতির পরিপন্থী। এখন একটু তলিয়ে দেখা যাক, ঐক্য ও একদল গঠনের প্রশ্নে এই মতবিরােধ কেন? উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জনাব এনায়েতউল্লাহ খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, এদেশের দক্ষিণপন্থী রাজনীতি উত্থাপনের সম্ভাবনা খুবই কম। বামপন্থীরাই রাজনীতিতে প্রাধান্য পাবে জনাব খানের বর্তমান ভূমিকা ও তার উপরােক্ত বক্তব্যের অনেক মিল আছে। কিন্তু জনাব আবুল হাসানাত, জনাব মওদুদ, জনাব শাহ আজিজুর রহমানসহ মুসলিম লীগের সদস্যবৃন্দ, বিচারপতি জনাব সাত্তার, জনাব ওবায়দুর রহমান ও আরও অনেকে যারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে আছেন তাদের পরিচয় কি? বর্তমান সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক মন্ত্রী এবং সাবেক তথ্য উপদেষ্টা জনাব শামসুল হুদা চৌধুরীও পাল্টা প্রশ্ন করেন আমাদের দেশে বামপন্থী বলে কেউ আছে নাকি? এক সাথে ফ্রন্ট করছেন, মন্ত্রীসভায় আছেন, তাদের মধ্যে ডান-বামের লড়াই কেন? বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে যারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শরীক হয়ছেন তাদের মধ্যে আদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে না, আছে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে সংঘাত। অবশেষে জাগদল ২৯শে আগস্ট জিয়াউর রহমানের ঘােষিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে যােগদান করে।

দলকে টুকরাে টুকরাে করোঃ 

৫৬. বাংলাদেশে দল ভাঙ্গা এবং দল গড়ার রাজনৈতিক খেলা জমে উঠছে। আর এর নেপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমান। জিয়া সাহেব সব দলই ভাঙ্গতে পেরেছেন, কিন্তু জাসদ তিনি এখনও ভাঙ্গতে পারেননিদক্ষিণ বঙ্গের এক জনসভায় আ.স.ম. আব্দুর রবের এই উক্তির দিন পনের মধ্যেই জাসদে নাটকীয় ভাঙ্গন ধরেছে। মতাদর্শগত বিরােধ, নেতৃত্বের কোন্দল, এক শ্রেণীর নেতার লােভ-লালসা ও সুবিধাবাদী ভূমিকা ইত্যাদি ছাড়াও দেশে পাইকারী দল ভাঙ্গাভাঙ্গির আরেকটি কারণ হচ্ছে জিয়ার গােয়েন্দা বাহিনীর প্ররােচনা ও প্রয়াস। বাকশাল গঠিত হবার আগে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল দেড় ডজনের মত। গত পাঁচ বছরে নিত্যনতুন দল গজাতে গজাতে এবং পুরানাে দলগুলাে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কম-বেশী শখানেক। মুসলিম লীগ ভেঙ্গে চার টুকরো হয়েছে, ন্যাপ হয়েছে দুভাগ, ভাসানী ন্যাপ তিন চার ভাগ, জনতা পার্টি দুভাগ, সাম্যবাদী দল দুভাগ, পিপলস লীগ দুভাগ, আইডিএল দুভাগ, জাগমুই দুভাগ, ইউপিপি তিন ভাগ এবং ভাসানী ন্যাপের নূরুল জাহিদ গ্রুপও আবার দুটুকরা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভাঙার চক্রান্ত অব্যাহত আছে।

জিয়ার মার্শাল ডেমােক্রেসী : পার্লামেন্ট নির্বাচন

৫৭. ৭৯ সনের নতুন বছরের শুরু। সামরিক বাহিনী,গােয়েন্দা বাহিনী, পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডিসি এসপি এদের বিরাট বহর নিয়ে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক

আইন প্রশাসক, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান, প্রধান সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নির্বাচনী প্রচারে অবতীর্ণ হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচার না বলে এটা যেন নির্বাচনী যুদ্ধ। সিলেটের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বিরােধী দলের বিশেষ করে আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে চিরাচরিতভাবে বলেছেন, “কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সামনে হাজির হতে ভয় পাচ্ছে।১৯৭৭ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে পার্লামেন্টে নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন জিয়াউর রহমান অনির্দিষ্টকালের জন্য তা স্থগিত ঘােষণা করে এবং নির্বাচন চাওয়ার অপরাধে র্যাংক এন্ড ফাইল  আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে কোনদিন ভয় পায়নি-বরং জিয়াই তখন নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভীত হয়ে তড়িঘড়ি নির্বাচন বন্ধ করেছিলাে।

৫৮. পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের দাবী ছিল পরিষ্কার। দেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার, ৪র্থ সংশােধণী বাতিল করে ১৯৭২ সনের সংসদীয় পদ্ধতির সংবিধান চালু, সেনাবাহিনীর পদ হতে পদত্যাগ, জরুরী আইন প্রত্যাহার, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং উচ্চতর আদালতে আপীলের ব্যবস্থা-এসব দাবী জনগণের দাবী। জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যথার্থভাবেই নির্বাচনের পূর্বে এসব দাবী উত্থাপন করেছে।

৫৯. প্রেসিডেন্ট এসব দাবী যদি মেনে নিতেন তারপরও যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করতাে তাহলে প্রেসিডেন্টের ভাষণের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যেতাে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘােষণা দিয়েছেন। এই ঘােষণা যদি বাস্তব অর্থে কার্যকরী করতে হয় তবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের পূর্বেই মার্শাল ল প্রত্যাহার করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মার্শাল ল তুলবেন জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে। মার্শাল ল আওতায় জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনক্রমেই জনগণের কাঙ্খিত নয়, এতে প্রকৃত জনমতের প্রতিফলনও হবে না। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যখন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হয়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তখন সামরিক বাহিনীর নিরপেক্ষতা থাকে না, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্নই ওঠেনা। 

৬০. প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের মাথা গরম হয়ে আছে। ১৯৭৯ সনের ২রা জানুয়ারী নতুন দল বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শত শত বাস-ট্রাক, লঞ্চ ব্যবহার করে ১০/২০ টাকা করে লােক ভাড়া করে আনার পর পল্টনের মিটিং-এ যে জনসমাবেশ হয়েছে, মিটিং কতটা সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে জিয়াউর রহমান নিজেই তা স্বচক্ষে দেখেছেন ও উপলব্ধি করেছেন। ভাড়া করা লােক এসেছে ঠিকই কিন্তু মিটিং-এ বসেনি। এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করেছে। শ্লোগান দেয়নি, হাততালি দেয়নি বা দিতে অভ্যস্ত নয়-এমন লােকদের জড়ো করায় নিরুত্তাপ জনসভায় জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ। 

৬১. এই বিক্ষুব্দ চিত্র নিয়ে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিএনপির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান পার্লামেন্ট নির্বাচনকে জনগণের জন্য এক অগ্নীপরীক্ষাবলে অভিহিত করেছেন। জনগণের জন্য অগ্নিপরীক্ষা না হলেও জিয়ার জন্য সত্যিই এটা অগ্নিপরীক্ষা। কেননা ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে সামরিক ফরমান, বিধি, প্রবিধান, বিজ্ঞপ্তি, জারী করে যে ৫ শতাধিক গণবিরােধী আইন, নির্দেশ, বলবৎ করা হয়েছে তা সংসদে পাশ করার জন্য প্রয়ােজন দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের। পার্লামেন্ট নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসন লাভ না করতে পারলে জিয়াউর রহমানের সামনে ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করছে।

জিয়া সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরতে পারেন নাঃ

৬২. জিয়াউর রহমান এটা যথার্থভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে সামনে তার সমূহ বিপদ। ২রা জানুয়ারী জনগণের চেতনা ও উপলব্ধি করে জিয়াউর রহমান সরাসরি মাঠে নেমে পড়লেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি হতে যে সমস্ত ব্যক্তিদের মনােনয়ন দিয়েছিলেন তাদের একটাই যােগ্যতা ছিল যে, তারা ক্ষমতাসীন দলের লােক। জিয়া নিজেই প্রার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে চলেছেন। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, আনসার, ভিডিপি দ্বারা লােক জোগাড় করে এনে তিনি জনসভায় প্রার্থীর হাত ধরে উচু করে বলছেন যে, প্রার্থী সৎ ও ভালাে মানুষ। রাজাকার যে প্রার্থী হয়েছে তার সম্পর্কে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি বলছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য এর অবদান ভুলবার নয়,পাশে থাকছে শাহ আজিজ, মশিউর রহমান প্রমুখ। গাড়ী, হেলিকপ্টার, জলযান ব্যবহার করে দেশের প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট নির্বাচনে ঝাপিয়ে পড়েছেন। 

৬৩. ১৯৭৯ সনের নির্বাচনে প্রায় ২৫০ আসনে বিএনপি স্বাধীনতা বিরােধীদের ছেড়ে দেয়। এর মধ্যে ৮৪ জন চিহ্নিত রাজাকার মুলত রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসিত করা হয়। 

৬৪.নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সশস্ত্রবাহিনীর পােশাক পরা সম্পর্কে জেনারেল ওসমানী এক বিবৃতি দেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন না বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান সেনাপতি ও বর্তমানে জাতীয় জনতা পাটির প্রধান অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম, , জি, ওসমানী এক বিবৃতিতে বলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রূপে সশস্ত্র বাহিনীর পােশাক পরতে পারেন না। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর বহুকাল হতে প্রচলিত বিধি ও ঐতিহ্য এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের রীতি অনুসারে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র  বাহিনীর পােশাক পরতে পারেন না। পােশাক পরিধান নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র বাহিনীর বিধি অনুসারে একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার বিধিতে সুনির্দিষ্ট উপলক্ষ্যে তার চাকুরিতে থাকাকালীন বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন। তবে ইহা একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার যিনি একটা নির্বাচিত বেসামরিক পদে কাজ করছেন তার বেলায় প্রযােজ্য নয়, এবং একজন অবসরপাপ্ত অফিসার আর এক বাহিনীর পােষাক পরতে পারেন না। নির্বাচিত বেসামরিক পদে নিযুক্ত থাকাকালীন তিনি সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক উপলক্ষে বেসামরিক পরিচ্ছদের উপর সশস্ত্র বাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় অর্জিত মেডেলবা পদক অবশ্যই পরতে পারেন। উদাহরণ স্বরূপ উপরােক্ত বিধি ও রীতি অনুসরণেই জেনারেল আইজেন হাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সশস্ত্র বাহিনীর কোন আনুষ্ঠানিক বা অন্য কোন উপলক্ষে সশস্ত্র বাহিনীর পােশাক কোন দিন পরেন নাই। অতএব, সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটা আইন লংঘনের অন্যায় উদাহরণ সৃষ্টি না করে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর পােষাক পরা বন্ধ করা উচিত অথবা নিজেকে একজন নির্বাচিত ও বেসামরিক রাষ্ট্রপতিরূপে প্রতারণা করা বন্ধ করা উচিত।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৭৯ সনঃ

৬৫. ১৮ ফেব্রুয়ারী দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ৩,৮৪, ১৬,৫৯৪ জন ভােটারের মধ্যে ১,৯১,০৬,১২৫ জন ভােটার অর্থাৎ শতকরা ৪৯.৭৩ জন ভােটার এই নির্বাচনে তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করেছেন। এবং প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৪১ থেকে ৪৩ ভাগ ভােট পেয়ে সরকারী দল বিএনপি ৩০০টি আসনের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ভােটের শতকরা ২৮ থেকে ৩০ ভাগ ভােট পেয়ে ৪০টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। অন্য দলের মধ্যে মুসলিম লীগ-আই,ডি,এল ১০টি, জাসদ ৯টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, ন্যাপ (মােঃ) ১টি, জাতীয় একতা পার্টি ১টি, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৭টি আসনে জয়লাভ করেছে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ১৭টি রাজনৈতিক দল আদৌ কোনাে আসন লাভে সক্ষম হয়নি। 

৬৬. নির্বাচনী রায়ে জনমতের যে প্রতিফলন ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যারা নির্বাচনী রাজনীতিতে আদৌ বিশ্বাস করেন না অথচ আগে ভাগেই নির্বাচন নিয়ে চক্রান্ত করেছে এবং যেসব দল সরকারী সমর্থনে গড়ে উঠেছিলাে তার অধিকাংশ দলকেই সচেতন নির্বাচকমন্ডলী প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর যে দলগুলাের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তেও সােচ্চার ছিলেন সেই দলগুলােই তুলনামূলকবাবে ভালাে করেছে। আওয়ামী লীগ এবং জাসদের নির্বাচনী ফলাফল এই সত্যেরই প্রমাণ বহন করে। 

৬৭. প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং তার সরকারের মন্ত্রীরা বিগত ৩ বছর যাবৎ আওয়ামী বাকশাল‘-বিরােধী চিৎকার করা সত্ত্বেও নির্বাচনে বাকশালপন্থী আওয়ামী লীগ দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পার্টিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। অবশ্য দলপ্রধান জনাব আবদুর মালেক উকিল দুটি নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু একটিতেও জয়লাভ করতে পারেননি। 

৬৮. আওয়ামী-বাকশাল বিরােধিতার কারণে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয় ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে বলে যারা বিশ্বাস করতেন, তারা নিশ্চয়ই পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল দেখে উপলব্ধি করেছেন যে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার জনপ্রিয়তা ঘাটতির পথে। নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হয়নি, বিরােধী দলের কর্মীদের ভয়-ভীতি দেখানাে হয়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বিজয়ী প্রার্থী এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বির ভােটের ব্যবধান খুবই সামান্য। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দুচার শবা হাজার ভােটের ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এছাড়াও প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্বাচনের পূর্বে যে জাসদকে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সৃষ্ট দল বলে চিহ্নিত করেছিলেন সেই জাসদও জাতীয় সংসদে ৯টি আসন লাভ করেছে। আওয়ামী লীগ সম্পর্কে জিয়ার আক্রমণ ছিলাে অত্যন্ত চড়া গলায়, উচ্চ মার্গে।

৬৯. রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই লক্ষ্য করেছেন বিরােধী দল কি অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাে। অতীতের কীর্তি-অপকীর্তির কথা বাদ দিলেও বিরােধী দলগুলাে নির্বচনের প্রাক্কালে যে অসংগতিপূর্ণ কথা ও কাজের এবং দলভাঙ্গাভাঙ্গির নজির স্থাপন করেছিলাে; তাতে দেশবাসী বিরােধী দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করলেও বিস্ময়ের কিছু ছিলাে না। বিরােধী দলের সুবিধাবাদী রাজনীতির কারণে অনেক বিএনপি প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হতে পেরেছেন। পরিকল্পিত ব্লু-প্রিন্টের বিজয় %, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর বিএনপি এবারের। নির্বাচনকে যেভাবেই চিহ্নিত করুক না কেন বিএনপির এ বিজয় পূর্ব-পরিকল্পিত র- প্রিন্টের হুবহু বাস্তবায়ন। সরকারী দল কয়েকটি জায়গায় তাদের নির্বাচনী বিজয় নিয়ে বেশ বেকায়দায় গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না। জামালপুর-৫ নির্বাচনী এলাকার ঘটনাটি। ১৮ই ও ১৯শে ফেব্রুয়ারী এই দুদিনের নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণায় বিজয়ী বলে বেসরকারীভাবে উল্লেখ করা । হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমানের নাম। কিন্তু। এরপর হঠাৎ জেনারেল (অবঃ) খলিল বা তার মনােনীত এজেন্টের সম্মতি ও অংশগ্রহণ ছাড়াই বিধান বহির্ভূতভাবে ঐ এলাকার ভােট পুনর্গণনা হয়। পূর্বেই ব্লুপ্রিন্ট অনুসাবে ঐ আসনে জেনারেল (অবঃ) খলিলের বদলে বিএনপি প্রার্থীকে নির্বাচিত বলে ঘােষণা করা হয়। জেনারেল (অবঃ) খলিলুর রহমান এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এই ব্যাখ্যার বিপক্ষে বিএনপি পাথরের মত নিশ্রুপ, একটা কথাও বলেনি। ভাবখানা এই যে কাজ হয়ে গেছে, কথা বলে। লাভ কি। বিএনপির নির্বাচনী ক্রেডিবিলিটি বা বিশ্বাসযােগ্যতা গুরুতরভাবে বিপদের সম্মুখীন আরাে একটি জায়গায়, নােয়াখালী-৫ আসনে; সেখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন আওয়ামী লীগ প্রধান আবদুল মালেক উকিল এবং বিএনপি প্রার্থী ডাক ও তারমন্ত্রী জনাব মওদুদ আহমদ। এই আসনে মন্ত্রী মওদুদ পেয়েছেন ৪৮ হাজার ৩০২ ভােট এবং প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল মালেক উকিল পেয়েছেন ৯ হাজার ১৪২ ভােট। জনাব আবদুল মালেক উকিলের জামানতও খােয়া গেছে। মওদুদের বিজয় ও মালেক উকিলের পরাজয় পর্যবেক্ষক মহলে দারুণ বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তরুণ ডাক ও তারমন্ত্রী যে তার এলাকায় জনগণের এতােখানি প্রিয়এবং আওয়ামী লীগের মতাে বিশাল এক রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান প্রবীণ জননেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল যে এতােখানি গণনিন্দিতপ্রত্যাখ্যাত‘, তা দেশবাসী পূর্বে অনুমান করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জনাব মওদুদের এই বিজয়কে কারচুপি, দুর্নীতি ও পেশীবলের বিজয় বলে অভিহিত করেছে। বিএনপি ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রায় সব দলই উল্লেখিত প্রবীণ রাজনীতিবিদ জনাব আবদুল মালেক উকিলের হেরে যাওয়াকে পূর্বপরিকল্পিত ব্লু-প্রিন্টের বাস্তবায়ন বলে মন্তব্য রেখেছে। যেমন ইউপিপির রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আবদুল মালেক উকিলের পরাজয় সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বরেন, “আমি জনাব মালেক উকিলের বিবৃতি দেখেছি এবং সেগুলাে সত্য বলেই মনে হয়।অবশ্য এ ব্যাপারে মুসলিম লীগ নেতা কাজী কাদেরের বক্তব্যটি স্পষ্ট। তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির ব্যাপক দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে এক জায়গায় মন্তব্য করেন, “জনাব মালেক উকিলের সাথে আমার মতপার্থক্য থাকতে পারে। তিনি ফেল করেননি। তাঁকে ফেল করানাে হয়েছে। প্রবীণ রাজনীতিবিদ মালেক উকিল চ্যারিটি বয়মওদুদ আহমদের কাছে হেরে যাবেন, তা বিশ্বাস করা যায় ।যদি মার্শাল লনা থাকতাে, যদি নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকার পদত্যাগ। করতেন, যদি প্রশাসনকে রাজনীতির বাইরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতাে, তাহলে বিএনপি শতকরা ১০টি আসন পেতাে কিনা এনিয়ে গণমনে সন্দেহ ছিলাে এবং এখনাে আছে।

৭১. বহু নির্বাচনী এলাকার ফলাফল বিশ্লেষণ করা যায়, এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জয়লাভ নিশ্চিত ছিল। আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, জাসদ বা ইউপিপি জানতাে দেশে মার্শাল ল যেখানে বহাল, প্রধান সামরিক শাসক একই সাথে দেশের প্রেসিডেন্ট এবং বিএনপির চেয়ারম্যান, যেখানে অর্থ ও প্রশাসন ক্ষমতাসীন। সরকারের হাতের মুঠোয়, সেখানে নির্বাচনের ফলাফল নিরপেক্ষ হতে পারেনা। পার্লামেন্ট নির্বাচনঃ সেনা বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যগণের হুমকি। 

৭২. ইসলামী ডেমােক্রেটিক লীগের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুর রহিম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বগুড়া ২ আসনে সেনাবাহিনীর পােশাক পরিহিত সশস্ত্র লােকজনসহ ঘরে ঘরে গ্রামে-গ্রামে ধানের শীষে ভােট না দিলে পরিণতি খারাপ হবে বলে হুমকি দেয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রিসািইডিং অফিসারদের নিজ গ্রামের ভােট কেন্দ্রে নিয়ােগ করা হয়। নির্বাচনের দিন প্রার্থী নিজে ভােটারসহ ভােট। কেন্দ্রে পােলিং বুথে ঢুকে নিজে হাতে ব্যালট পেপারে সিল মারেন। নির্বাচনের একদিন পূর্বে খালিশপুর শিল্প এলাকার শ্রমিক ৫,০০০ টাকা করে এডভ্যান্স দেওয়া হয়। শ্রমিকদের মতে, এটা ইলেকশনের ফি। বিএনপি প্রার্থীকে ভােট দেওয়ার ঘুষমাত্র।৪৮

জিয়ার প্রাসাদ চক্রান্তের বিজয়

৭৩. পূর্বশর্ত পূরণের শর্তে নির্বাচন বর্জন করার জন্য আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ।  (মিজান) সহ বিরােধী দল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাে এবং দাবী দওয়া আদায়ের জন্য দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে সংগ্রামের প্রাথমিক  কর্মসূচী ও দাবী সপ্তাহ ঘােষণা করেছিলাে এবং কর্মসূচী মােতাবেক জনসভা, জনসংযােগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাে এতে জিয়া প্রমাদ গুণতে থাকেন। জিয়াউর রহমান ও তার গােয়েন্দা বাহিনীর চেষ্টায় জনগণের আশা আকাঙক্ষার পিঠে ছুরিকাঘাত করে দশ দলের পাঁচ দল, মিজান চৌধুরীর আওয়ামীলীগ ও মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর) নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার নিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। জিয়ার প্রাসাদ চক্রান্ত জয়ী হয়। ৪৯

মিজান লীগের জন্ম রহস্য 

৭৪. মিজান আওয়ামী লীগ-এর জন্মই রহস্যময়। বঙ্গভবনে ক্ষমতার উচ্চস্তরে সলাপরামর্শের পরে এই দলটি ভূমিষ্ট হয়। প্রাসাদ রাজনীতির ব্লু-প্রিন্ট মােতাবেক শক্তিধর ব্যক্তির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা এবং এক পর্যায়ে পরিকল্পনা মােতাবেক একদিনে দুটি কাজ সম্পূর্ণ করা হয়। একদিকে অস্ত্র উদ্ধরের নামে সারাদেশব্যাপী আওয়ামী লীগ কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যখন পুলিশী তল্লাশ হয়রানী, গ্রেফতার চলছে তখন একই দিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব মিজান চৌধুরী আওয়ামী লীগের বিভক্তির কথা ঘােষণা করেন। মিজান লীগের জন্মই ষড়যন্তের এই কুটিলঅন্ধকারে ঢাকা।৫০) 

৭৫. জন্মের পর হতেই দলটি একটি স্ববিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করে। জিয়ার ব্লু-প্রিন্ট অনুযায়ী বাকশাল বিরােধীতা করে, অন্য দিকে আবার গণতান্তিক বঙ্গবন্ধুসােহরাওয়ার্দী আওয়ামীলীগের কথায় সােচ্চার হয়ে থাকে। এক দিকে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের প্রবক্তা, অন্যদিকে জিয়ার প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারকে স্বীকার করে নেয়। বিরােধী দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলে মিজান লীগ বেকায়দায় পরে। জিয়া শাহীর বিরােধীতার ভান করলেও আসলে সরকার বিপদে পড়ুক এটা তাদের কাম্য ছিল না। উল্লেখ্য যে, মিজান চৌধুরী সহ অন্যান্য প্রভাবশালী নেতা সর্ব জনাব শামসুল হক, অধ্যাপক ইউসফ, নূরে আল সিদ্দিকী, ময়েজ উদ্দিন, আবদুস সুলতান, আবদুর রউফ প্রমুখ একাধিকবার আতাউর রহমানের দশ দলের বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন, নির্বাচন বর্জনের কথা জোরেশােরে বলেছেন। মিজান লীগের নেতৃবৃন্দ রাত তিনটা পর্যন্ত ক্ষমতাশীন মহলের সঙ্গে পরামর্শ করেন, ঐ গােপন সলাপরামর্শ মােতাবেক মিজানুর রহমান চৌধুরী তাড়াহুড়া করে এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। এবং বিরােধী দলগুলিকে আর একবার আলােচনা বৈঠকে ডাকবার জন্য সরকারের কাছে অনুরােধ জানান।

কোটি টাকার ওভার ড্রাফটের জনসভা 

৭৬. স্বীয় অপকীর্তির কারনে মুজিব আমলে কি ভাবে মিজান চৌধুরী উপেক্ষিত হয়েছেন বায়তুল মােকারমে অনুষ্ঠিত দলীয় জনসভা মিজান চৌধুরী তাকে বাকশাল

বিরােধীচার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঐ সময়ে তিনি রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসায় নামলেন। ঔষধ কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু মুজিব সরকার সুযােগ-সুবিধা দেয়নি। সুযােগ-সুবিধা দিয়াছে জিয়াউর রহমান। কোটি টাকার ওভার ড্রাফট মঞ্জুর হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে আয়ােজিত জনসভায় জিয়া সরকারকে সুন্দর সার্টিফিকেট প্রদান করেন। আওয়ামী লীগ মিজান এর উক্ত জনসভা ওভার ড্রাফট এর জনসভা। মিজান চৌধুরী। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলে আওয়ামী লীগ বিপদে পরে। নির্বাচনে অংশ গ্রহণ ব্যতীত আওয়ামীলীগের যে উপায় থাকবে সে হিসেবে জিয়ার মাথায় ছিলাে।

জাসদের হট লাইন

পি পি আর অধীনে জাসদের লাইসেন্স প্রাপ্তিদের পিছনে ডাক তার মন্ত্রী জনাব মওদুদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। ১৯৭৭ সনের ১৪ই অক্টোবর ব্যর্থ অভ্যুথানের পর জিয়াউর রহমান তিনটি দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এই তিনটি দল হচ্ছে ডেমােক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশের 

কমিউনিষ্ট পার্টি ও জাসদ। ১৮ই নভেম্বর ৭৮ সরকার পি পি আর প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে দলগুলির উপর আরােপিত নিষেধ প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু যখন কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিলাে তখনও জাসদ রহস্যজনকভাবে রাজনীতির অনুমতি পায়। নির্বাচন বয়কট প্রেসিডেন্ট জিয়ার জিংহাসনই ধ্বসে যেতে পারে সে কারণে জনাব মওদুদ জাসদের উপর চাপ ও লােভনীয় টোপ ফেলেন। এই সমস্ত টোপের মধ্যে রয়েছে জনাব আ, , , আবদুর রব এর মুক্তি ও চিকিৎসার জন সরকারী সাহায্যে বিদেশে প্রেরণ এবং অন্যান্য নেতা কর্মীদের মুক্তি।

জিয়ার রাজনীতিতে কোটি টাকার খেলা

৭৭. জিয়াউর রহমান দেশে কোটি টাকার রাজনীতি চালু করেছেন। একই সঙ্গে আইয়ুব  খানের পথ ধরেছেন রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র হননে। তার চক্রান্ত্রের খেলায় জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দলগুলি ও তার নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে চলেছেন। একই সাথে কালাে টাকা ছড়িয়ে রাজনীতিকে পণ্য হিসেবে কেনাবেচার সামগ্রীতে পরিণত করেছেন। মুসলিম লীগ প্রধান খান সবুরের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকা পাওয়া এবং তা ভাগাভাগির ব্যাপারে অভিযােগ উঠে। এই অভিযােগ উত্থাপন করেছে তার দলেরই সদস্য জনাব শারাফত হােসেন চৌধুরী। তিনি মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী। পরিষদের সদস্য। গত ১৩ই জানুয়ারী তার একটি বিবৃতি স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন আসন্ন নির্বাচনে মুসলীম লীগের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতিক্রমে মনােনীত কয়েকজনের নাম আকস্মিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি ফরিদপুর-১১ আসন হতে গত ৬ই জানুয়ারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে টাকা জমা দেই। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমার নমিনেশন প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই সংবাদে আমার অবাক হওয়ার কথা ছিলাে। কিন্তু তা হইনি। জনাব খান এ সবুরের অগণতান্ত্রিক ও খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত আমাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে প্রাণপ্রিয় মুসলীম লীগের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। খান এ সবুর মুসলীম লীগকে পকেট লীগ করতে সচেষ্ট। এ দেশের রাজনীতিতে জনাব খান এ সবুর একজন গণধিকৃত ও ডিগবাজী বিশারদ ব্যক্তি একথা কার না জানা। এই স্বেচ্ছাচারী কপট রাজনীতিবিদের হাত হতে মুসলীম লীগকে রক্ষা করা এবং পার্টি প্রধানের পদ হতে জনাব সবুরকে সরিয়ে দেয়া আশু কর্তব্য হয়ে পড়েছে। তাহা ছাড়া ইতিমধ্যে আলাউদ্দিনের প্রদীপের মত এক কোটি টাকা যে কোন তরফ হতে মুসলীম লীগ সংগঠনের নামে যােগাড় করা হয়েছে, তার ভাগাভাগি রেটে আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য তাও আমরা বুঝে পেতে চাই ৫২ টাকার ব্যাপারটি গুরুতর অভিযােগ। কিন্তু এ সম্পর্কে খান এ সবুর মুখ খুলেন নি। যেহেতু জনাব সবুর এ সম্পর্কে একেবারে নীরব সেহেতু তা অনেক কথারই জন্ম দিয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা হতে আসলাে। শারাফত চৌধুরীর আলাউদ্দিনের প্রদীপের মতােএবং যে কোন তরফ হতেএবং এই তরফ তা কি তা দেশবাসীর জানার কথা। জিয়াউর রহমান পি পি আর এর মাধ্যমে দলীয় তহবিলের উৎস সম্পর্কে যে শর্ত আরােপ করেছিলেন, সামরিক সরকারের প্রধান হয়ে সেই জিয়াউর রহমানও একেবারেই নীরব। প্রথমে নির্বাচন বর্জন এবং পরে ঐ বর্জনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে জনাব খান সবুরের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের ঘােষণার সঙ্গে ঐ এক কোটি টাকার যােগসূত্র আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জিয়াউর রহমানই এই টাকা দেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

সুবিধাবাদের রাজনীতি ও জিয়া নিজেই টাকা গুনেছেন

৭৮. জিয়ার আমলে বাংলাদেশে সুবিধাবাদের রাজনীতি চালু হয়েছে। এক ব্যক্তি একদল-ধরনের রাজনীতিক যারা আছেন সুযােগ-সুবিধার আদায়ে তারা তড়িঘড়ি করে জিয়ার দলে ঢুকে পরছেন। এই সুযােগ-সুবিধা, লাইসেন্স পারমিট, নগদ অর্থ এবং বিবিধ ধরনের। জিয়া দুহাতে সুবিধা বিতরণ করে চলেছেন। তার উদার চিত্ত ও উন্মুক্তদ্বার হতে কেউ বিফল হয়ে ফিরে আসছেন না। জিয়া পূর্ব হতেই টাকা “গােনায় অভ্যস্ত। জিয়া নিজেই স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলদেশ সরকারের নিকট হতে বেতন ভাতা নিয়েছেন অন্য দিকে ঐ সময়েই ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তাদের নিকট হতেও টাকা গুনেছেন। বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারাভিযানের অন্যতম প্রার্থী জেনারেল ওসমানী তার প্রতিদ্বন্দ্বী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ভারতে থাকাকালীন সময়ে (১৯৭১ সালে) ব্রিগেডিয়ার পান্ডের দফতরে টাকা গুণবার অভিযােগ আনেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের পক্ষ হতে তার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় নি। 

জিয়ার মিথ্যাচার

আওয়ামী লীগ বাকশালীদের সম্পত্তির হিসেব নিকাশের আদেশ জারী করে প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে জানে মেরে ফেলার এটে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া আওয়ামী-বাকশালীদের বিদেশের গােলামীর রাজনীতি‘ ‘হত্যার রাজনীতি’, ‘দুর্নীতির রাজনীতি’, ‘গণতন্ত্র হত্যারও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির অন্তহীন অভিযােগ নিয়ে মাঠ গরম করেছিলেন। কিন্তু এসব অভিযােগের একটিও প্রমাণ করতে পারেন নি। সব চেয়ে দুর্নীতিবাজ বলে প্রচারিত গাজী গােলাম মােস্তফার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সাতটি কেসের একটিও প্রমাণিত হয়নি। তার পরেও জিয়া এসব মিথ্যাচার থেকে কোন সময়ই ক্ষান্ত হননি।

আওয়ামী-বাকশালীরা স্বাধীনতা চায়নিঃ জিয়া

৭৯. জিয়ার কণ্ঠে আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে অভিযােগের অন্ত নেই। প্রেসিডেন্ট

জিয়া বিগত ৩০শে মে পল্টন ময়দানে জনসভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী-বাকশালীরা কোনদিন স্বাধীনতা চায়নি। তারা চেয়েছিলাে পরাধীনতা। আরাে এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তিনি বললেন ও আওয়ামী-বাকশালীরা আজও স্বাধীনতা নস্যাতের চেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই উক্তির অর্থ এই যে, আওয়ামী-বাকশালীরা অতীতে স্বাধীনতা চায় নি, এখনও তারা স্বাধীনতা বিপন্নের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার দুশমন, বিদেশের এজেন্ট, রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী। প্রেসিডেন্ট জিয়া যখন আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে এই গুরুতর অভিযােগ উত্থাপন করেন তখন দেশে চালু আছে পূর্ণ সামরিক শাসন। প্রেসিডেন্ট জিয়া এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ। কিন্তু শুধু রাজনৈতিক স্টান্ট বাজির জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে। জিয়া ভালাে করেই জানেন, আওয়ামী লীগের অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন

কেবলমাত্র একজন সেক্টর কমান্ডার। আওয়ামী লীগের সরকারের অধীনে সাড়ে তিন বছর শুধু চাকুরী করেননি-তােয়াজ করে চলেছেন, এমনকি বাকশালকে সমর্থন জানিয়েছেন, বাকশাল সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ী দৌড়িয়েছেন। বাকশাল গভর্ণর ডেজিগনেটদের শুভেচ্ছাপত্র পাঠিয়েছেন। [পরিশিষ্ট-৯) সেই জিয়ার মুখে আওয়ামী-বাকশালীদের সম্পর্কে এমন বেপরােয়া উক্তি সত্যের মাপকাঠিতে আদৌও টিকে না।

হত্যাকারীরা কোথায়?

৮০. ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্টের পর হতে বিগত ৩ বছর ধরে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় হতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা আওয়ামী বাকশালীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী হত্যার অভিযােগ এনে বাংলাদেশের মাঠ ময়দান সংবাদপত্রে। প্রেসিডেন্ট জিয়া আওয়ামী-বাকশালীদের বিরুদ্ধে বিশ ত্রিশ হাজার ব্যক্তিকে হত্যা গুম ও খুনের লােমহর্ষক অভিযােগ এনেছেন, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী কর্ণেল আকবর হােসেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে বায়তুল মােকারমে দুটি জনসভায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যার অভিযােগ আনেন। অথচ বামপন্থী সর্বহারা পার্টি বলছে মুজিব আমলে ১১৬ জন সশস্ত্র ক্যাডার সংঘর্ষে নিহত হয়। 

দশ হাজার অস্ত্র গেলাে কোথায়?

৮১. শুধু তাই নয়, তিনি এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে আরও অভিযােগ করেন যে বিরােধী রাজনৈতিক শক্তিকে খতম করার জন্য স্পেশাল ব্রাঞ্চ দশ হাজার অস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাঝে বিতরণ করেছে। সেই দশ হাজার অস্ত্র গেলাে কোথায়? তা উদ্ধার হয়েছে? না হয়ে থাকলে কাদের নিকট অস্ত্র তাদের নাম ঠিকানা পরিচয় কি? আর বাইশ হাজার লােককে খুন করেছে, যারা সেই ঘাতকরা আজ কোথায়? প্রকৃত প্রস্তাবে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সামনে এসব মিথ্যা অভিযােগের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী। নেতাকে গ্রেফতার করার ও পুলিশী হয়রানির এটি ছিলাে কৌশল। এবং জনগণকে বিভ্রান্ত হাতিয়ার মাত্র।

আওয়ামী-বাকশালীদের সম্পত্তির হিসাবের ফলাফল

৮২. সামরিক ফরমান বলে ঘােষিত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার,প্রধানমন্ত্রী, এমপিসহ যে সমস্ত ব্যক্তি অফিস অব প্রফিট হােন্ড করেছেন সেই সমস্ত ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর হতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত অর্জিত অর্থ ও সম্পত্তির হিসাব ও সম্পত্তির অর্জনের উৎস সম্পর্কে সরকারের নিকট নির্ধারিত ফরমে জমা দিয়েছে। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে ও পরে ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে কি সম্পত্তি ছিল এবং নতুন করে কার সম্পদ, সম্পত্তি হয়েছে তার তুলনামূলক হিসাবও দেওয়া হয়েছে। হিসাব দাখিলের শেষ তারিখ ছিল ১৯৭৮ বছরের ৩১শে মে। তাহার পরে আট মাস অতিক্রান্ত। দুই একজন ছাড়া সমস্ত আওয়ামী নেতারাই সম্পত্তির হিসাব দাখিল করেছেন।

প্রেসিডেন্ট সম্পত্তির হিসেব মেনে নিয়েছেন

৮৩. প্রেসিডেন্ট আওয়ামীদের ঐ হিসাবে মেনে নিয়েছেন। কেননা, ঐ রাষ্ট্রীয় ফরমানে বলা হয়েছে যে, যাদের হিসাবে গরমিল থাকার অথবা সম্পদের উৎসের সহিত প্রকৃত আয়ের গরমিল থাকবে তাদিগকে আগামী বছরের জন্য কোন প্রকার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অযােগ্য বলে ঘােষণা করা হবে। সম্পত্তির হিসাব জনিত কারণে আওয়ামী লীগের কোন এমপি বা মন্ত্রীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়নি। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক পুরাতন এম,সিএ ও এমপি আসন্ন সংবাদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কেননা তাদের বিরুদ্ধে জিয়া সরকার শত চেষ্টা করেও কোন অভিযোেগ দাড় করাতে পারেননি। 

প্রধান মুক্তি পেলেন কিন্তু সাথীরা 

৮৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের কোহিনূরসহ ৭ জন ছাত্রকে হত্যার অপরাধে ছাত্রলীগের এককালীন প্রেসিডেন্ট সফিউল আলম প্রধানসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রের দীর্ঘ মেয়াদী কারাদন্ড হয়। অভিযুক্তরা ঐ হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিলাে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী জনাব সফিউল আলম প্রধান। অন্যরা ছিলাে তার সহযােগী। সেই সফিউল আলম প্রধানকে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পূর্বে হঠাৎ করে মুক্তি দেওয়া হলাে কিভাবে? দেশবাসী তা জানতে পারেনি। সাজা কি মওকুফ বা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, না কি ক্ষমা প্রার্থনার প্রেক্ষিতে মুক্তি দেয়া হয়েছে? খুনের মামলার প্রধান আসামীকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইনের হাতে ন্যায় বিচারের জন্য গ্রেফতার করেছিলাে। কারাগারে পাঠিয়ে ছিলাে এবং মামলা রুজু করেছিলাে। সাজা দিয়েছিলাে। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার লক্ষ্যে সাত খুনের মামলার আসামী মুক্তি পায় জিয়ার নির্দেশে। কেননা রতনে রতন চেনে।


জিয়ার রাজত্বে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত চক্রান্ত

১. গণতান্ত্রিক দেশের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংবাদপত্র জনগণের কণ্ঠস্বর। রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব যাদের হাতে তারাও-জনগণের মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলাের ভালাে ভালাে কথা বলে চলেছেন। দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রয়েছে বলে সরকার বারবার মুখে দাবি করছেন, টিভি, রেডিও বিভিন্ন বক্তব্য বিবৃতিতেও ফলাও করে একথা প্রচার করছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। সরকার। ক্ৰমেক্রমে জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছেন। জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ সরকার জনমত প্রকাশের পথ বন্ধ করছেন। 

২. খাদ্য সংকট, চুরি, ডাকাতি খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি সামাজিক অপরাধ এবং দুষ্কর্মের অবাধ রাজত্ব দেশে কায়েম হয়েছে। এসব ব্যর্থতা, দুষ্কর্ম, অযােগ্যতা ফাস হওয়ার ভয়ে সরকার সংবাপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন। জিয়ার সামরিক সরকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্রতাকে ভয় পান। তাই মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়িয়ে অগণতান্ত্রিক পথে নিউজপ্রিন্টের মূল্য বাড়িয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তীব্রতা দুর্বল করতে ছলে-বলে কৌশলে সংবাদপত্রের অস্তিত্বের ওপর ক্রমাগত আঘাত হানছে। সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করছেন। সংবাদপত্রের কোনাে স্বাধীনতা নেই। 

৩. নিউজপ্রিন্টকে সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। মাত্র। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর মূল্য দু‘-দুবার বাড়িয়েছেন। শতকরা আশিভাগ বিজ্ঞাপনের ওপর রয়েছে সরকারী কর্তৃত্ব। বিজ্ঞাপন বন্টনের ক্ষেত্রেও জিয়া সরকারের পক্ষপাতমূলক নীতি অনুসৃত হচ্ছে। সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে। স্বাধীন সংবাদপত্র যাতে এই সংকট সহসা কাটিয়ে উঠতে না পারে তার জন্যে সরকার বিজ্ঞাপনের বাজেট শতকরা আশিভাগ কমিয়ে দিয়েছে। সরকারের অনুসৃত এই নীতি স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর সরাসরি হুমকি বলে সংবাদপত্র পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল বিবৃতি দিয়েছে। ইতিমধ্যে নিজউপ্রিন্টের মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ ৮০ সনের ২১শে অক্টোবর দেশব্যাপী কালাে দিবস পালনের যে কর্মসূচী ঘােষণা করেছে তার প্রতি দেশের রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রমনা জনগণ সমর্থন জানিয়েছেন।

৪. প্রবীণ সাংবাদিক জনাব জহুর হােসেন চৌধুরীর মতে, “জাতীয় স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার মতাে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কথাটারও কোনাে সরল অর্থ নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে সাধারণত সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ চাপ বা প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা বােঝায়।সাপ্তাহিক রােববার প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনত্ব নেই। সংবাদপত্রগুলােকে সব সময়ই সরকারী, জকুটির দিকে লক্ষ্য রেখে মতামত প্রকাশ এবং সংবাদ ছাপতে হয়।

৫. বিবিসি হতে বলা হয়েছে, “দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে যে কটি বেসরকারী মালিকানায় পরিচালিত সেগুলাে সরকারের সমালােচনা করলেও সবসময়ই একটা আশঙ্কা রয়েছে যে, যে কোনাে সময় এ সমালােচনার জন্যে বিপদ আসতে পারে। 

৬. তাছাড়া সবসময়ই সরকারের ভ্রুকুটির দিকে লক্ষ্য রেখেই মতামত প্রকাশ করতে হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসাররা টেলিফোনে বিভিন্ন সংবাদপত্রে কোন খবর ছাপা যাবে আর কোন্ খবর ছাপা যাবে না সে সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশ দেন। বর্তমানে শতকরা ৮০ ভাগ শিল্প বাণিজ্য সরকারী মালিকানায় থাকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার মারফতে সরকার যে কোনাে সংবাদপত্রের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ চাপাবার চেষ্টা করতে পারেন এবং করছেনও।

৭. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটা ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকারের অংশ বিশেষ। বিভিন্নভাবে সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবি সরকারের হাতের মুঠোয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আসলে ব্যক্তি স্বাধীনতা বা বাক-স্বাধীনতার অংশবিশেষ। অপর কথায় জনগণের মঙ্গলামঙ্গল, কল্যাণের ব্যাপারে সরকারকে দায়িত্বশীল করার ক্ষেত্রে স্বাধীন সংবাদপত্র হলাে প্রতিবাদী কণ্ঠ। সরকারকে সঠিক পথে রাখার ব্যাপারেও স্বাধীন সংবাদপত্র বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার সমালােচনা সত্ন করতে পারে না। কারণ তারা যেভাবে হত্যা খুন করছে তা প্রকাশিত হলে জনতার রুদ্ররােষে সরকারের পতন হতাে। সেজন্য সংবাদপত্রকে নিয়ে সরকারের কত ভয়।

৮. দেশে এখনাে মার্শাল ল ইমারজেন্সি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, মানুষের মৌলিক অধিকার জরুরী অবস্থার মধ্যে অক্ষুন্ন রয়েছে। কিন্তু আইনগত দিকে থেকে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইমারজেন্সি ও মৌলিক অধিকারের। সহ অবস্থান ব্যাপারটি পারস্পরিকভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ

৯. প্রেস এন্ড পাবলিকেসন্স অ্যাক্টের বাধন ছাড়াও স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্টেও সংবাদপত্রের ব্যাপারে বিশেষ নিষেধ রয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশ ব্যাপারে, সংবাদপত্রে নিউজ প্রিন্ট বন্টনের ব্যাপারে সরকারের পুরাে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। 19. বাংলাদেশের দুটি মাত্র জাতীয় ইংরেজী দৈনিকের দুটিই সরকারী মালিকানাধীন। || দেশে তৃতীয় কোনে ইংরেজী দৈনিক প্রকাশের ব্যাপারেও সরকার অনুমতি দেননি। মন বিভিন্নভাবে সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের চাবি যেখানে সরকারের হাতে সেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকতে পারে না।

১০. যদিও বলা হচ্ছে সংবাদপত্রের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু সংখ্যার পরিমাণ দেখেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পরিমাপ করা যায় না। ১১. সামরিক শাসনের বিধি-নিষেধ, জরুরী আইন বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল রেখে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা অর্থহীন। যদিও প্রেসিডেন্ট জিয়া সাংবাদিকদের মনজয় করার জন্য ১০ লক্ষ টাকা অনুদান ঘােষণা করেছেন।

১০০


জিয়ার রাজত্বে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

১. সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান বলেছেন, তিনি আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার ক্ষেত্রে স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। জিয়া বলে বেড়ান আওয়ামী লীগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পথ রুদ্ধ করেছিলাে। 

২. ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা ছিলাে। বিচার বিভাগ সম্পর্কে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিলাে, “প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিকে নিয়োেগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে আলােচনা করে অন্য বিচারকদের নিয়ােগ করবেন। ৫ম সংশােধনীতে এই অনুচ্ছেদটি প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারপতিদের নিয়ােগ করবেন‘-চতুর্থ সংশােধনীর কথাগুলােই রাখা হয়। তাহলে আওয়ামী লীগকে দোষারােপ করা হচ্ছে কেন? ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিলাে বিচার বিভাগীয় কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ। (বদলি, পদোন্নতি এবং ছুটি) এবং শৃঙ্খলাবিধান ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারে . থাকবে। ৫ম সংশােধনীতে বিচার বিভাগীয় কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে এবং বিচার। বিভাগীয় দায়িত্ব পালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (বদলি, পদোন্নতি এবং ছুটি ইত্যাদি) এবং শৃঙ্খলাবিধান ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের এখতিয়ারে থাকবে।” পঞ্চম সংশােধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়। তবে এর সাথে শেষে একটি লাইন যুক্ত করা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট সুপ্রিম কোর্টের সাথে আলােচনা করে বিচার কার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান করবেন। 

৩. এছাড়া জরুরী আইন বলে আদালতের ক্ষমতা খর্ব করে, মার্শাল লরেগুলেশন ৭/৭৭, মার্শাল লরেগুলেশন ৩৪/৭৭ এইসব কালাকানুনের মাধ্যমে আদালতের এখতিযারকে হরণ করে এবং আদালত প্রদত্ত রায় নাকচ করে এবং পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে সমস্ত কালাকানুন বলবৎ রেখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কিংবা মৌলিক অধিকার অক্ষুন্ন রয়েছে এমনটি বলার কোনই অবকাশ নেই। 

৪. বাংলাদেশের বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবি বলেছেন, ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সরকারের প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীরা এতাে বলছেন যে, অন্য কারও পক্ষে নতুন করে বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি, দেখছি গােটা বিচার বিভাগটিই কার্যত সরকারের অনুগ্রহ আর সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে রয়েছে। যদিও সরকার অর্থশাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের সমষ্টি এবং সমন্বয়। অথচ কাজের বেলায় বিচার বিভাগের প্রতি দেখানাে হয় বিমাতাসুলভ মনােভাব। শুধু তাই নয়, সরকার এবং প্রশাসনে এমনও অনেকে আছেন যারা বিচার বিভাগ তথা কোর্ট আদালতকে দেশ শাসনের পথে একটা বিরাট অন্তরায় হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত এবং তাদের ভাবটা এই যে, তারা নেহায়েতই ভালাে মানুষ বলেই এখনাে বিচার বিভাগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। এ জাতীয় মনােভাবকে লালন করা হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের ক্ষেত্রে ফঁকি-ঝুঁকির আশ্রয় নেওয়া, কোর্ট আদালতের কায়িক অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তােলা খুবই স্বাভাবিক।

জিয়ার ভাওয়তাবাজি

৫. এডভােকেট সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেছেন, “প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পৃথকীকরণের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম এ দুটো মেট্রোপলিটন নগরীতে ম্যাজিট্রেসি গঠনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে এ দুটো নগরীতে কাজও শুরু করে দিয়েছে মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেসি। ম্যাজিস্ট্রেসি-সরকারের শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা বিভিন্ন জেলায়ও শাসন বিভাগ থেকে ম্যাজিস্ট্রেসিকে পৃথক করার চেস্টা করব।২) প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্য সম্পর্কে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেন, ম্যাজিস্ট্রেসি সরকারের শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে প্রেসিডেন্ট যে কথা বলেছেন, তা মােটেও ঠিক নয়। কারণ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেসি সরাসরি সংস্থাপন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। কাজেই প্রেসিডেন্টের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর। শুধু এটুকুই নয়, প্রেসিডেন্টের পুরাে ভাষণে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চকিত সর্বসম্মত দাবি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইন পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের সমস্যাবলীর ব্যাপারে ক্ষেপহীন মনােভাবই ব্যক্ত হয়েছে।

বিচার বিভাগের সংকট আরাে ঘনীভূত

৬. বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আজ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বিচারকের অভাব। বলতে গেলে ৪৭ সালের পর বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি বরং অনেক পদ খালি পড়ে আছে এখনাে। মুন্সেফদের যে বেতন দেয়া হয় তাতে নতুনরা মুন্সেফের চাকরির জন্য উৎসাহিত হচ্ছেন না। শুধু নিম্ন আদালত নয় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরাও দারুণ আর্থিক সংকটে ভুগছেন। স্বাধীনতার আগে হাইকোর্টের বিচারপতিরা চার হাজার ও সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি পাঁচ হাজার টাকা বেতন পেতেন। এটা চলে এসেছে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। পাকিস্তান আমলে সুপ্রীম কোর্টের বিচারকরা কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারীর চেয়ে এক হাজার টাকা বেশি বেতন পেতেন। এখন পাচ্ছেন মাত্র একশটাকা বেশী। সুপ্রীম কোর্টের বিচারকরা বর্তমান বেতন পান সর্বমােট ৩১০০ টাকা। কিন্তু এতাে অল্প টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে চলা যে কতােটা কষ্টকর ব্যাপার সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া বিচারকদের সরকারী গাড়ি ও বাসা পাওয়ার কথা। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আপীল ডিভিশন ও হাইকোর্ট ডিভিশনের মােট ২৩ জন বিচারপতির মধ্যে ৫ জন এখনও সরকারী বাসা পাননি, গাড়ি পাননি ৭ জন। যাদের জন্য বাসা ও গাড়ির ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না তাদের দেয়া হয় মাত্র দুই হাজার টাকা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাড়ি না পাওয়ার সম্প্রতি বিচারপতি আবদুল মালেক ও বিচারপতি রফিকুর। রহমান পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে বারের কোনাে সুদক্ষ আইনজীবীকে সুপ্রীম। কোর্টের বিচারপতির পদ গ্রহণে আকৃষ্ট করা দুরূহ হয়ে উঠেছে।” 

৭. দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করলেই শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়ে যাবে না। এর জন্য প্রয়ােজন সব রকম ছল চাতুরি ত্যাগ করে সাংবিধানিক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করা। একমাত্র সাংবিধানিক গ্যারন্টিই বিচার। বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। কাজেই ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে মূল বিধানসমূহ সন্নিবেশিত ছিলাে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও কার্যকারী। করলেই বিচার বিভাগ শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে পারে। এ প্রসঙ্গে ব্যারিষ্টার ইশতিয়াক আরও বলেন, বিচার বিভাগের চাকরিতে বা বিচার বিভাগীয় কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব নিযুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটদের কেবল মাত্র কোর্টের সুপারিশ অনুসারেই নিয়ােগ করতে হবে এবং এটিকে সংবিধানের অবশ্য পালনীয় বিধানরূপে গণ্য করতে হবে। সুপ্রীম কোর্টের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগীয় কাজ সম্পদানে নিযুক্ত ম্যাজিষ্ট্রেটদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব। স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং ভালাে আইন ছাড়া বিশ্বের কোনাে সরকারই তার জনগণের প্রতি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের জনগণের অবস্থা ও বিশ্বাস এখনও সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে বা লুপ্ত হয়ে যায়নি, কিন্তু ঔদাসীন্য, বীরাগ ও নৈরাশ্য ক্রমশই পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণে লরিফমর্স অডিনেন্স সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটির সুপারিশক্রমে আটাত্তর সালে আইন সংস্কার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশ আইনজীবীদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে এবং আমরা সম্মিলিতভাবে এর প্রতিবাদ করেছি। এই অধ্যাদেশে আইন সংস্কারের লক্ষ্য নেই, যা আছে তা হলাে ফৌজদারী কার্যবিধির কতিপয় সংশােধনের চেষ্টা, দেওয়ানী কার্যবিধির আপীল ও সিভিল রিভিশনের ক্ষেত্রে দুই ধারা বিধির সংশােধন। এছাড়া আছে বিট্রেশন এ্যাক্টের ছােটখাট একটি সংশােধন এবং কোর্ট ফি এ্যাক্ট, স্মল কটেজ কোর্টস এ্যাক্টের মামুলি সংশােধন। এটাকে সংস্কার অধ্যাদেশ বলা হয় না, এটা সংশােধনী অধ্যাদেশ। যাহােক, নতুন জাতীয় সংসদকে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনাে আলােচনার সুযােগ দেয়া হয়নি। প্রস্তাবিত যে কোনাে সংস্কারমূলক আইন সম্পর্কে জনগণকে কোনাে আলােচনার সুযােগ না-দিলে এবং জনপ্রতিনিধিগণ জাতীয় সংসদে সেগুলাে যথাযথভাবে আলােচিত না হলে এই আইন সংস্কারের কোনাে পদক্ষেপই কার্যকারী কিংবা গ্রহণযােগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। আইন সংস্কার অধ্যাদেশের মাধ্যমে এক কলমের খােচায় একগাদা মামলা কমিটিয় কোর্ট থেকে সেশন কোর্টে স্থানান্তর করা হয়েছে। জেলা সেশন কোর্টগুলােতে এমনিতেই নিজেদের অনেক বিচারাধীন মামলা জমে আছে। তার ওপর কোটগুলাের সম্প্রসারণ ও লােকবল না বাড়িয়ে তাদের ওপর কোর্টস থেকে আরও বাড়তি মামলার বােঝা চাপানাে ক্ষতিকর। আমরা আশাকরি এই সমস্যাসমূহের ব্যাপকতা সম্পর্কে সম্যক বিবেচনা করা হবে। ক্রমাগত অবহেলার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বিপদ রয়েছে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণার উন্মেষ ঘটবে। ম্যাজিষ্ট্রেটেদের ক্ষমতা বাড়ানাে হয়েছে, তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে যে পর্যন্ত ম্যাজিষ্ট্রেটরা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হবেন এবং বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদ না করা হবে- ততদিন পর্যন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চত করা সম্ভব তাে নয়ই বরং সংকট আরও ঘনীভূত হবে। সামরিক আদালতের বিচার সম্পর্কে তিনি বলেন, সামরিক আদালতে বিচারের রায় আমি মানি না। এর বিরুদ্ধে অবিলম্বে উচ্চ আদালতে আপীলে সুযােগ দেয়ার জন্য আমি জোর দাবী জানাচ্ছি। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীলের সুযােগ না দিয়ে কাউকে মৃত্যুদন্ড প্রদান মানবতা ও ন্যায় বিচারের পবিপন্থী।৩

ল-রিফর্মসে প্রশাসনের কালাে হাতের ছাপ

, বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করা হবে বলে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রী যতােই বক্তৃতা বিবৃতি দেন না কেন বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ আনুষ্টানিক বক্তৃতা কিংবা ফলাও করে প্রচার করলেই শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হয় না, হতে পারে না। বর্তমান সরকার তথাকথিত লরিফর্মস অর্ডিনেন্স জগদল পাথরের মতাে চাপিয়ে দেয়। উক্ত অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়নি, বরঞ্চ দেশের বিচার বিভাগকে সার্বিকভাবে আইন সংস্কারের নামে নৈরাজ্যের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে। প্রশাসন যে-কোনাে ছুঁতােয় সর্বোচ্চ আদালতের এখতিয়ার সংকুচিত করতে সচেষ্ট এই লরিফর্মস অর্ডিনেন্সে সেই প্রশাসনের কালাে হাতের ছাপ সুস্পষ্ট। এই অডিনেন্সে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১৭৩ ধারা সংশােধন করে ৩ (খ) উপধারা সংযােজন করে তদন্তকারী সংস্থার ক্ষমতাকে অসম্ভব বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এই সংযােজনের ফলে পুলিশ একবার চার্জশিট দেয়ার পরও বিচার চলাকালে ও ইচ্ছে করলে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এক বা একাধিক চার্জশিট দাখিল করতে পারে। এর ফলে পুলিশ কর্তৃক নিরীহ ব্যক্তিদের হয়রানির আশংকা বেড়ে গেছে বহুগুণ। এই অর্ডিনেন্সের ফলে বিচারধীন মামলা রাতারাতি কমিটং কোর্টস থেকে জেলা সেশন আদালতে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ঢাকা জেলায় সেশন আদালতের আগে বিচারযােগ্য মােকদ্দমা ছিলাে মাত্র ৩৫০টি। লরিফর্মস অর্ডিনেন্স দায়ের হওয়ার পর এখন সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯০০ এ, কিন্তু বিচারকের সংখ্যা বাড়েনি। ফলে বর্তমানে যে সংখ্যক বিচারক আছেন তারা যদি অন্য সব মােকদ্দমা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সেশন মােকাদ্দমারই বিচারই করেন তা হলে দায়েরকৃত মামলাটি নিষ্পত্তি হতেও দশ বছর সময় লাগবে। এমনি অবস্থা সব আদালতেই।

গ্রাম আদালতঃ বিচারের নামে প্রহসন

৯. গ্রাম আদালত স্থাপন মানেই হলাে বিচারকে চরম অবিচারের দিকে ঠেলে দেয়া।

আমাদের দেশের চেয়ারম্যানরা যেভাবে ভিলেজ পলিটিক্সে জড়িয়ে পড়েন তাতে তাদের কাছে নিরপেক্ষ বিচার আশা করা যায় না। অথচ গ্রাম আদালতে বিচারের রায় সুপ্রীম দেওয়ানী আপীলে অথবা রিভিশনাল এখতিয়ারের বহির্ভূত করা হয়েছে। এতে বিচারের নামে প্রহসন হচ্ছে, হচ্ছে অবিচার।

বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের উদাসীনতার কথা উল্লেখ একজন বিশিষ্ট আইনজীবী বলেন, জিয়া সরকার দেশের বিচার বিভাগের ব্যয় নির্বাহের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেন, তা থেকেই বিচার বিভাগের প্রতি তাদের উদাসীনতা এবং বিরূপতা সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। সরকার শুধুমাত্র কোর্ট ফি থেকেই আয় করে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা। কিন্তু সর্বোআদলতের বিচারকমন্ডলী থেকে শুরু করে সরকারের লঅফিসারদের বেতনাদিসহ সমগ বিচার বিভাগের বাজেট পৌনে চার কোটি টাকারও কম; অথচ পশু পালন ও পশু চিকিৎসা বাবদ সরকারী বাজেট . বরাদ্দ প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।৪

বিশেষ ক্ষমতা আইন সম্পর্কেঃ জিয়া 

১০, ১৯৭৫ সনের স্পেশাল পাওয়ার এ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইন সম্পর্কে জিয়াউর রহমান সমগ্র দেশে এটাকে আওয়ামী-বাকশালীদের অপৰ্কীতি ও কালাকানুন বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ চালান। ৭৯ ক্ষমতা পাকাপােক্ত হওয়ার পরও ৭৪ সনের। সেই বিশেষ ক্ষমতা আইন জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় বাতিল করেন নি। নির্বিচারে ঢালাওভাবে তা প্রয়ােগ করে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেন। জিয়া অত্যন্ত চাতুৰ্যপূর্ণভাবে এটাকে‘, ‘৭৪ সনে প্রণীত কালাকানুন বলেছেন, অন্যদিকে একে বহাল রাখার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তিনি বলেন অনুকম্পার আবেদন সবসময় মানবিক কারণে সাধ্যমত বিবেচনা ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রাণদণ্ড লাঘব করা হয়। কিন্তু আমি যদি সত্যিই সামরিক আইনে সকল সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রর্দশন অথবা সুপ্রীমকোর্ট আপিল করার অধিকার দানের ব্যাপারে একমত হতে না পারি তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। তিনি বলেন, “কোনাে বিশেষ আইনের অধিনে কোনাে বিশেষ আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা বা দণ্ডদানকে খারাপ বলা যায় না। অথবা নিয়মিত আপীল আদালতকে আমলে আনা হয়নি বলেই আপীলের বদলে কোনাে পর্যালােচনা অগ্রহণযােগ্য বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়।প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আরাে বলেন, “বিশেষ আইন ও বিশেষ আদালতের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এধরণের আইন ও আদালতের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে কৃত অপরাধের বিচার করতে বিশেষ আদালত প্রয়ােজন।তিনি বলেন, “কোনাে আইন। কোনাে দেশের প্রয়ােজন উপযােগী হলে এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতি নিশ্চিত করতে পারলে এর একটা অর্থ ও উদ্দেশ্য থাকে। আমরা সমাজকে অধঃপতিত হতে এবং দুষ্কৃতকারীদের অবাধ বিচরণ ও দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে দিতে পারি না।

বিচার বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে

১১. এডভােকেট সম্মেলনে ভাষণদানকালে প্রধান বিচারপতি জনাব কামালউদ্দিন হােসেন বলেন, বিচার বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।রিফর্মস অর্ডিনেন্স কার্যকর প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, এই অর্ডিনেন্স কার্যকর হওয়ার এবং ফৌজদারী কার্যবিধির অষ্টাদশ পরিচ্ছদ বাতিল হওয়ায় ব্রাজিষ্ট্রেট কোর্টের মােকাদ্দমাসমূহ সরাসরি সেশন জজের আদালতে স্থানান্তর হয়ে মামলার সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সৃষ্টি হয়েছে এক অচলাবস্থার। এসব মােকাদ্দমার নিষ্পত্তি হওয়া দূরে থাকুক, বিদ্যমান মামলাগুলাে নিষ্পত্তি হতে আরও তিন-চার গুণ বেশি সময়ের প্রয়ােজন। তিনি অবিলম্বে প্রত্যেক জেলা পর্যায়ে কমপক্ষে কয়েকজন অতিরিক্ত জেলা জজ এবং প্রত্যেক মহকুমা পর্যায়ে পরিমাণ সংখ্যক সাব জজ ও মুন্সেফ নিয়ােগের সুপারিশ করেন। বিচারপতি জনাব কামাল উদ্দিন হােসেন। বলেন, ‘সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরাঅর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। এ ছাড়া নিম্ন বিচার বিভাগের অফিসারগণ যেভাবে বেতন ও ভাতা পান তাও ন্যায়সংগতভাবে নির্ধারিত হয়নি।

সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাবলি 

১২. আইনজীবী সম্মেলনে শেষ দিনে (৩০শে মার্চ ১৯৮০) গৃহীত প্রস্তাবে চতুর্থ ও ৫ম সংশােধনী, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন , গ্রাম ও পৌরশালিসী আদালতসংক্রান্ত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করার জোর দাবি জানিয়েছে। বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দাবি করে সম্মেলন সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়ােগ ও অপসারণকে সংবিধানভুক্ত ও সংসদের এখতিয়ারাধীন করারও জোর দাবি জানায়। সম্মেলন বিচার বিভাগের সকল নিয়ােগ বদলী পদোন্নতি সুপ্রীম কোর্টের আওতায় ন্যস্ত, সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সহ কোন বিচারককে রাষ্ট্রের অন্যবিধ কারণে দায়িত্বে নিয়ােগ না করার এবং দেশে সার্কিট কোর্ট ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য কোর্ট প্রশাসনিক বিভাগে উপযুক্ত স্থানে সুপ্রীমকোর্টর হাইকোর্ট ডিভিশনের ব্রাঞ্চ রেজিষ্ট্রী স্থাপনেরও দাবি জানানাে হয়। সম্মেলনে গৃহীত অন্যান্য প্রস্তাবে সামরিক আইন ও অন্য আইনে দণ্ডিত সকল ব্যক্তিকে হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীলের সুযােগদান, প্রধান বিচারপতির সুপারিশ ব্যতীত সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়ােগ না করার বিধান সংবিধানে সন্নিবিশিত করা, সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থনে গৃহীত প্রস্তাব ব্যতীত সুপ্রীম কোর্টের কোনাে বিচারক অপসারণ না করার প্রথা, নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে আদালতসমূহের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খর্ব কিংবা সংকোচনের সকল কালাকানুন। বাতিল করার দাবি জানায়।

জিয়ার ভাষণে ক্ষোভ

১৩. সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, উক্ত ভাষণে দেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উচ্চকিত সর্বসম্মত দাবি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইন পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিদের সমস্যাবলির ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের ভ্রুক্ষেপহীন ১: মনােভাবই ব্যক্ত হয়েছে। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রােধ, দ্রব্যমূল্য হ্রাস, সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সম্মেলন সরকারের উদ্যোগ কামনা করে। সম্মেলন যে কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে আপীলে সুযােগদান করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করে এবং হাইকোর্ট ডিভিশনের অনুমােদন ছাড়া এবং আপীলের সুযােগদানের আগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা উচিত নয় বলেও জোর অভিমত ব্যক্ত করে। প্রস্তাবে বলা হয়, সম্মেলন আইন সংস্কার অধ্যাদেশ পুরােপুরি বাতিল করার পক্ষপাতী নয়তবে ন্যায়বিচার সহজতর করার স্বার্থে অর্ডিন্যান্সে ১৯৪৮-এর ফৌজদারী দণ্ডবিধি, ১৯০৮ সালের দেওয়ানী দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট কিছু সংশােধনী কামনা করে। এছাড়া সম্মেলনে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ ও পৌরসালিসী অর্ডিনেন্স অবিলম্বে বাতিল করার জোর দাবি জানায়। বিচার বিলম্বের জন্য বিচারকের অভাবকে দাবি করে সম্মেলন উপযুক্ত চাকরির শর্তে আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়ােগের দাবি এবং বার কাউন্সিলের সদস্যদের নিয়ে বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল গঠনের জন্য প্রধান বিচারপতিকে ক্ষমতাদানের দাবি জানানাে হয়। 

১৪. ১৯৭৯ সনের ৬ই এপ্রিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার পর্যন্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেন, বলতে গেলে বিচার বিভাগের কোন ক্ষমতাই ছিলাে না। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে সারাদেশে সামরিক শাসনজারী করা হয়। ২০শে আগস্ট ৭৫-এর এই সামরিক ফরমানে ঘােষণা করা হয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট হতে শুরু করে কোন কোর্টেই সামরিক শাসনের আওতায় জারীকৃত কোন কৃৎকর্ম, আদেশ, ঘােষণা, বিজ্ঞপ্তি বিধি-বিধান উপ-বিধি সহ অন্যান্য কিছু সম্পর্কে প্রশ্ন তােলা যাবে না। 

৬ এই সামরিক ঘােষণা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিলাে। সেক্ষেত্রে জিয়ার রাজত্বে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্ন আসে না, আসে না ন্যায় বিচার ও আইনে আশ্রয় লাভের প্রশ্ন।

১০৯

রঙিন চশমা ঃ আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি

১. জনৈক বুদ্ধিজীবি এক সেমিনারে বলেছিলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী দুজনই চোখে রঙিন চশমা ব্যবহার করেন। তাই তাদের কাছে দেশের সবকিছু রঙিন আর উজ্জ্বল মনে হয়। রঙিন চশমার আড়ালে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক ফয়দা লুটার চেষ্টা করেছেন জিয়াউর রহমান ও তার সরকার।

ছিনতাই রাহাজানির স্বাধীনতা

রাহাজানির ভয়ে পথচারী সন্ত্রস্ত, ডাকাতির ভয়ে গ্রামবাসী ভীত, যান-পরিবহনে হামলা, হাট-বাজার লুট, হত্যা-গুম-অপহরণ-ধর্ষণ এসব জিয়ার রাজত্বে। প্রতিদিনের ঘটনা। জিয়াউর রহমান রাজধানী ঢাকাকে মেট্রোপলিটন সিটি হিসেবে ঘােষণা দিয়ে। বলেছেন, ঢাকা হবে অপরাধমুক্ত এলাকা। কিন্তু অপরাধ কমেনি-মুক্ত হওয়া তাে। দূরের কথা। ছিনতাই রাহাজানি অস্বাভাবিভাবে বেড়ে গেছে। একই সঙ্গে হত্যাকাণ্ড, দুস্যতা, অপহরণ, ধর্ষণ, অন্যান্য অপরাধ বাড়ছে। পুলিশের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ঢাকা শহরে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে বেড়ে গেছে যা ১৯৭৫ সালের চেয়েও বেশি। তথ্যে জানা যায়, রাজধানীতে ১৯৮০ সালে ৬৮টি হত্যাকাণ্ড, ১৪টি ডাকাতি, ৪৭টি দস্যুতা, রাহাজানি ও ছিনতাই, ৪৯৫টি সিধেল চুরি, , ১০২টি চুরি, ৮৩৭টি দাঙ্গ-হাঙ্গামা, ২১৬টি অপহরণ, ৬৩টি বে-আইনী অস্ত্র আইনের। অপরাধ ও ৪,৯০১টি বিভিন্ন ধরণের অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। পূর্ববর্তী বছরগুলােয় রাজধানীতে শুধুমাত্র ছিনতাই -রাহাজানি সংখ্যা হচ্ছে ১৯৭৯ সালে। ৩৮টি, ১৯৭৮ সালে ৫৫টি , ১৯৭৭ সালে ৬০টি, ১৯৭৬ সালে ১৯৮টি।

পুলিশের পরিসংখ্যানে ছিনতাই রাহাজানি সহ অপরাধের যেসব চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তা প্রকৃত ঘটনার ভগ্নাংশ মাত্র বর্তমানে ছিনতাই-রাহাজানিসহ বিভিন্ন রকম অপরাধের শতকরা ৭৫ভাগ ঘটনাই থানায় রেকর্ড হয় না।

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই 

৪. ৭ই মে সন্ধ্যা ১৯১৮ রাতে প্রকাশ্যে ঘাতকদের শাণিত অস্ত্রের নিমর্ম আঘাতে

প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আবদুর রহমান ও প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক ফেরদৌস আলম রক্তে মহানগরীর রাজপথ রঞ্জিত হলাে। ৮ই মে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশের বক্তব্য অনুসারে দেখা গেছে, যেহেতু ঘােড়াশাল শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক নেতা আবদুর রহমানের নিজস্ব এলাকা সেহেতু তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোনাে পক্ষ এ-হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকতে পারে। ঘােড়াশাল, কাঞ্চন, পলাশ শ্রমিক বেল্টের নাড়ীনক্ষত্র যাদের নখদর্পণে তারাও বলবেন, পুলিশ অমূলক সন্দেহ পােষণ করেনি। গত ১লা মে ঘােড়াশালে অনুষ্ঠিত বিএনপি সমর্থিত একটি জনসভায় রহমানের আয়ুকে সাতদিনের সময় দিয়ে প্রকাশ্যে হুমকি দেয়া হয়েছিলাে। ৬ই মে, বুধবার। বিকেলে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে বাংলাদেশ একা মােহরার (নকলনবীশ) এসােসিয়েসেনের ৪৭ দিন ধর্মঘটজনিত পরিস্থিতিতে সভা। ১৭টি জেলা প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। ঐ সভায় জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি জনাব আবদুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন। এবং তিনি একা মােহরারদের ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া মেনে নেওয়ার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন। সভা চলাকালীন বিএনপি সমর্থিত একট্টা মােহরার এসােসিয়েসসেরন কর্মকর্তা দাবিদার জনৈক আবুল হােসেন কয়েকজন সমর্থকসহ সভাস্থলে আগমন করেন। তারা অনেক যুক্তিহীন প্রস্তাব দেন। বিএনপি সমর্থিত একট্টা মােহরার এসােসিয়েশন রেজিষ্ট্রীকৃত নয়।। এবং অবৈধ। ঐ দিন রাতে জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একা মােহরারদের আলােচনা সভার দ্বিতীয় পর্যায়ে আবুল হােসেন গমন করলে তাকে বলা হয় আপনারা এ আলােচনায় থাকতে পারে না। এরই প্রেক্ষিতে আবুল হােসেন এবং তার সহযােগীরা উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “ এ-অপমান আমরা সহ্য করবাে । প্রতিশােধ আমরা নেবােই।” 

৫. গুপ্ত হত্যা হয়েছে কয়েক হাজার কিনারা হয়নি। বিচার হয়নি। আসামী ধরা পড়েনি। দুলাল-রহমানকে হত্যা করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। নারায়ণগঞ্জের আওয়ামীলীগ নেতা মুনিরকে হত্যা করা হয়েছিলাে। প্রকাশ্য

দিবালােকে হত্যা করা হয়েছিলাে কলীগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হােসেনকে। কদিন আগে হত্যা করা হয়েছে রাজশাহীর সাম্যবাদী দলের আবুল কাশেমকে। মনে হচ্ছে গােটা দেশে যেন মানুষ হত্যার পারমিট দেয়া হয়েছে। এদের বিচার হবে না। এরা ধরা পড়বেনা। কেননা এরা ক্ষমতাসীন আশ্রয়ে লালিত এবং আশ্রিত।

জিয়ার রাজত্বে সন্ত্রাস 

৬. অস্ত্র (সংশােধনী) আইন বেআইনী অন্ত্র উদ্ধারের চাইতে নিরীহ জনগণের উপর নির্যাতন বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং সরকার এ আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। জাতীয় সংসদে বিরােধী সদস্যদের প্রতিবাদের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শাহ-আজিজুর রহমান বিলটির সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। হত্যা লুণ্ঠন নারীধর্ষণ একেবারেই শেষ হয়েছে। এমন দাবী করিনা। যা আছে তা দূর করাই এ আইনের উদ্দেশ্য। এ আইনের বিরােধীতা করতে গিয়ে সাম্যবাদী দলের জনাব তােয়াহা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন।গণফ্রন্টের জানাব এ, এস, এম, সােলায়মান বলেছেন, ‘দেশে এখন ত্রাসের রাজত্ব চলছে, গ্রামাঞ্চল ছাড়াও খােদ রাজধানীতেই ডাকাতি রাহাজানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম লীগের জনাব আলমাস হােসেন বলেছেন, ‘সরকার জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে আইন প্রয়ােগ করতে পারবেন। কেননা পায়ের নীচে মাটি নেই তাই সরকার যুব কমান্ড গঠন করে। অস্ত্র সরবরাহ করেছেন।মুসলিম লীগের জনাব এম,, মতিন বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রের খােলায় বহু মূল্যবান জীবন নষ্ট হয়েছে। একথা সরকারও জানেন কিন্তু কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন কেউ তা জানে না। আইডিএল-এর জনাব মােজাম্মেল বলেছেন, ‘এক শ্রেণীর দুস্কৃতকারী বিশেষ রাজনৈতিক দলের লেলিয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেননা অস্ত্রধারকারী লােকেরা তাদের বন্ধু।

পুলিশের রিপাের্ট 

৭. ১৯৭৯ সালে সারা দেশে এক হাজার ৬শ ৫০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ৭৮ সালের তুলনায় হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ শতকরা ১৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৯ সালে থানায় এজাহারকৃত মােট অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ৪; এর মধ্যে অপহরণ ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ ২৫ হাজার থেকে বেড়ে ২৮ হাজার দাড়িয়েছে। 

১৯৭৮ সনে দেশে এক হাজার ১শ ৪১ টি ডাকাতি, এক হাজার ৬টি রাহাজানি, ৮ হাজার ৭শ ২১টি সিঁদেল চুরি, ১হাজার ৪শ ৫৮টি চুরি, এক হাজার ৬শ৬৮টি হত্যা, ৭ হাজার ৮শ২১টি সংঘর্ষ, ২৮ হাজার ৬শ৩৬টি বিভিন্ন ধরনের অপরাধ । সংঘটিত হয়েছে। গত বছর গুপ্ত হত্যার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ৭৮ সালে থানার এজাহারেকৃত গুপ্ত হত্যার সংখ্যা ছিল ৫০টি, ৭৯ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫৭টিতি দাঁড়ায়। এছাড়া গত বছরের আরাে উলেখযােগ্য বিষয় হলাে গুপ্ত সংগঠনগুলাের তৎপরতা বৃদ্ধি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়ােজিত লােকদের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকদফা সংঘর্ষ।

প্রিন্সেস সংস্কৃতি ও যুব সমাজকে ধ্বংসের ব্লু-প্রিন্ট 

৬. ছিনতাই, রাহাজানির জন্য অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি অপসংস্কৃতির একটা মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। জিয়াশাহীর বাংলাদেশী সংস্কৃতির প্রায় পুরােটা অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির চর্চা ও পৃষ্টপােষকতা নব্য লুটেরা ধনিক শেণী এদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের একটা বড় অংশ বিদেশী সংস্কৃতি নামে দেশীয় সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন করছে। বাইরে থেকে সংগৃহীত টাকা দেশে আসছে, টাকা উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা-হতাশা সামাজিক অবক্ষয়। নব্য গড়ে ওঠা ধনীরা তাদের অর্থ উৎপাদন-ব্যবস্থা, উৎপাদনের সম্পর্ক পাল্টে দেবার জন্য ব্যবহার করছে না। তারা প্রাত্যহি জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মের মধ্যে দিয়ে শুধু তাদের হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠার অবস্থানকে দৃঢ় করতে চাচ্ছে। এর সঙ্গে টিভি আর চলচ্চিত্রের ভূমিকা যুক্ত। চলচ্চিত্র আর টিভির অধিনে যা দেখানাে হয় তার ক্ষতিকর দিকটাই বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। জনজীবনের এদুটোরই ভূমিকা অপরিসমি। চলচ্চিত্র এবং টিভির প্রধান উপজীব্য হিশেবে ইদানীং খুন খারাপি, দুর্ধর্ষতা, ভয়াবহতা ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এতে তরুণ আর যুব সমাজ আয়ত্ত করছে অপরাধমূলক কাজকর্মের নিত্য নতুন নব কৌশল। নয় অশালিন পত্রিকা, অশ্লীল ছবি সহ বিভিন্নরকম আপত্তিকর এ্যালবাম-ভিউকার্ড এদেরকে ভীষণ উৎসাহিত করে। রফিল্ম দেখার ব্যাপারেও এরা বেশ উৎসাহিত।

ব্লু ফিল্ম আকর্ষিত দর্শক

১০, এ সম্পর্কে ২১ শে এপ্রিল ৮১ রােববার এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে | রফিল দর্শক আকর্ষণ করে বেশি। একটা সাধারণ ছবি দেখার জন্যে যে পরিমাণ

দিবালােকে হত্যা করা হয়েছিলাে কলীগঞ্জের জাসদ নেতা আলী হােসেনকে। কদিন আগে হত্যা করা হয়েছে রাজশাহীর সাম্যবাদী দলের আবুল কাশেমকে। মনে হচ্ছে গােটা দেশে যেন মানুষ হত্যার পারমিট দেয়া হয়েছে। এদের বিচার হবে না। এরা ধরা পড়বেনা। কেননা এরা ক্ষমতাসীন আশ্রয়ে লালিত এবং আশ্রিত।

জিয়ার রাজত্বে সন্ত্রাস

অস্ত্র (সংশােধনী) আইন বেআইনী অন্ত্র উদ্ধারের চাইতে নিরীহ জনগণের উপর নির্যাতন বহুগুণ বৃদ্ধি পায় এবং সরকার এ আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। জাতীয় সংসদে বিরােধী সদস্যদের প্রতিবাদের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শাহ-আজিজুর রহমান বিলটির সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, রাষ্ট্রপতি। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। হত্যা লুণ্ঠন নারীধর্ষণ একেবারেই শেষ হয়েছে। এমন দাবী করিনা। যা আছে তা দূর করাই এ আইনের উদ্দেশ্য। এ আইনের বিরােধীতা করতে গিয়ে সাম্যবাদী দলের জনাব তােয়াহা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন।গণফ্রন্টের জানাব এ, এস, এম, সােলায়মান বলেছেন, ‘দেশে এখন ত্রাসের রাজত্ব চলছে, গ্রামাঞ্চল ছাড়াও খােদ রাজধানীতেই ডাকাতি রাহাজানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মুসলিম লীগের জনাব আলমাস হােসেন বলেছেন, ‘সরকার জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে আইন প্রয়ােগ করতে পারবেন। কেননা পায়ের নীচে মাটি নেই তাই সরকার যুব কমান্ড গঠন করে অস্ত্র সরবরাহ করেছেন।মুসলিম লীগের জনাব এম,, মতিন বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রের খােলায় বহু মূল্যবান জীবন নষ্ট হয়েছে। একথা সরকারও জানেন। কিন্তু কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন কেউ তা জানে না। আইডিএল-এর জনাব মােজাম্মেল বলেছেন, ‘এক শ্রেণীর দুষ্কৃতকারী বিশেষ রাজনৈতিক দলের লেলিয়ে অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেননা অস্ত্রধারকারী লােকেরা তাদের বন্ধু।।

পুলিশের রিপাের্ট

৭. ১৯৭৯ সালে সারা দেশে এক হাজার ৬শ ৫০টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে ৭৮ সালের তুলনায় হত্যাকাণ্ডের পরিমাণ শতকরা ১৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৯ সালে থানায় এজাহারকৃত মােট অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ৪; এর মধ্যে অপহরণ ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ ২৫ হাজার থেকে বেড়ে ২৮ হাজার দাড়িয়েছে।

১৯৭৮ সনে দেশে এক হাজার ১শ ৪১ টি ডাকাতি, এক হাজার ৬টি রাহাজানি, ৮ হাজার ৭শ ২১টি সিঁদেল চুরি, ১হাজার ৪শ ৫৮টি চুরি, এক হাজার ৬শ৬৮টি হত্যা, ৭ হাজার ৮শ২১টি সংঘর্ষ, ২৮ হাজার ৬শ৩৬টি বিভিন্ন ধরনের অপরাধ । সংঘটিত হয়েছে। গত বছর গুপ্ত হত্যার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। ৭৮ সালে থানার এজাহারেকৃত গুপ্ত হত্যার সংখ্যা ছিল ৫০টি, ৭৯ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৫৭টিতি দাঁড়ায়। এছাড়া গত বছরের আরাে উলেখযােগ্য বিষয় হলাে গুপ্ত সংগঠনগুলাের তৎপরতা বৃদ্ধি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নিয়ােজিত লােকদের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকদফা সংঘর্ষ।

প্রিন্সেস সংস্কৃতি ও যুব সমাজকে ধ্বংসের ব্লু-প্রিন্ট 

৬. ছিনতাই, রাহাজানির জন্য অর্থনৈতিক কারণের পাশাপাশি অপসংস্কৃতির একটা

মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। জিয়াশাহীর বাংলাদেশী সংস্কৃতির প্রায় পুরােটা অপসংস্কৃতি। অপসংস্কৃতির চর্চা ও পৃষ্টপােষকতা নব্য লুটেরা ধনিক শেণী এদের সংখ্যা বাড়ছে। এদের একটা বড় অংশ বিদেশী সংস্কৃতি নামে দেশীয় সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন করছে। বাইরে থেকে সংগৃহীত টাকা দেশে আসছে, টাকা উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে না। সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা-হতাশা সামাজিক অবক্ষয়। নব্য গড়ে ওঠা ধনীরা তাদের অর্থ উৎপাদন-ব্যবস্থা, উৎপাদনের সম্পর্ক পাল্টে দেবার জন্য ব্যবহার করছে না। তারা প্রাত্যহি , জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে। প্রতিটি কর্মের মধ্যে দিয়ে শুধু তাদের হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠার অবস্থানকে দৃঢ় করতে চাচ্ছে। এর সঙ্গে টিভি আর চলচ্চিত্রের ভূমিকা যুক্ত। চলচ্চিত্র আর টিভির অধিনে যা দেখানাে হয় তার ক্ষতিকর দিকটাই বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। জনজীবনের এ । দুটোরই ভূমিকা অপরিসমি। চলচ্চিত্র এবং টিভির প্রধান উপজীব্য হিশেবে ইদানীং খুন খারাপি, দুর্ধর্ষতা, ভয়াবহতা ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এতে তরুণ আর যুব সমাজ আয়ত্ত করছে অপরাধমূলক কাজকর্মের নিত্য নতুন নব কৌশল। নয় অশালিন পত্রিকা, অশ্লীল ছবি সহ বিভিন্নরকম আপত্তিকর এ্যালবাম- ভিউকার্ড এদেরকে ভীষণ উৎসাহিত করে। বু ফিল্ম দেখার ব্যাপারেও এরা বেশ উৎসাহিত।

ফিল্ম আকর্ষিত দর্শক ১০. এ সম্পর্কে ২১ শে এপ্রিল ৮১ রােববার এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে

র-ফিলা দর্শক আকর্ষণ করে বেশি। একটা সাধারণ ছবি দেখার জন্যে যে পরিমাণ

দর্শক সমাগম হয় ব্লু ফিল্ম দেখার জন্য হয় দ্বিগুণ, তিন গুণ বেশি। হলিউড, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন ডেনমার্ক থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, গ্রীস, ইতালি ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্লু ফিল্ম দেশে আসছে। বিদেশী ছবি যেমন বায়ােনিক ওম্যান-খ্যাত লিণ্ডসে ভাগনার এবং চলচ্চিত্রের কল্যাণে সােফিয়া লরেন, ব্রিজিত বার্দোত-এর রূপ যৌবন তারা দেখতে পাচ্ছে। ভিসিআর ব্লু ফিল্ম এ নগ্ন নরনারীর যৌনফেলী দেখার জন্য দর্শকদের বেশির ভাগই থাকে তরুণ ও কিশাের। বলাবাহুল্য সংস্কৃতি চর্চার নামে এসব অপসংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তৈরি করে প্রকারান্তরে দেশের ভবিষ্যৎ বলে খ্যাত তরুণ সমাজকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে অন্ধকারে। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকরা এসব চলচ্চিত্র টিভি ভিসিআর এর মাধ্যমে খুন-খারাপি দুর্ধর্ষতা ভয়বহতা নগ্নতা প্রত্যক্ষ করেই প্রভাবিত হয়। অনেকক্ষেত্রে তাদেরই কেউ কেউ ছিনতাই রাহাজানিসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। এমন দৃষ্টান্ত অসংখ্য। এসব ছাড়াও সংস্কৃতিচর্চা নামে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে খেলা, ক্রিয়াকর্ম চালানাে হচ্ছে। বিশেষ করে নগ্ননৃত্য, জুয়া হাউজি ইত্যাদি সুস্থ সামাজিক পরিবেশকে কলুষিত করছে সন্দেহ নেই।” 

১১. ৮১ ফেব্রুয়ারী মাসের ৪ তারিখে বগুড়া প্রদর্শনীতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।

প্রদর্শনীর যাত্রামঞ্চের চতুর্দিকে লােক উপচাননা। দর্শকদের আসনে প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের বেশ কজন উপস্থিত। সাধারণ দর্শকদের মধ্যে একটা বড় অংশ ছিলাে গ্রাম থেকে আসা। অল্প বয়সী তরুণ। রাত ১২টায় যাত্রাগান শুরু হলাে । প্রথমে যন্ত্রসঙ্গীত বেজে উঠলাে তালও ক্রমে ক্রমে দ্রুত হয়ে উঠছে। এ অবস্থায়। খুবই সামান্য পােশাক, বলতে গেলে অর্থ নগ্ন অবস্থায় রূপসী তরুণী লাকী খান মঞ্চে উঠে এলাে। শুরু হলাে নাচ। দ্রুত থেকে আরও দ্রুত হয়ে উঠছে তার পদচালনা, বাহু সঞ্চালন। তার অঙ্গ-ভঙিমার মধ্যে দিয়ে অবশেষে বেরিয়ে এলাে অশ্লীল ইঙ্গিত; নিতম্ব, স্তন ইত্যাদির ঢেউ খেলানাে নৃত্য ইতিমধ্যে দর্শকদের মধ্য উত্তেজনা আর চিৎকার। একই সঙ্গে নর্তকীর দিকে টাকা পয়সা ছুঁড়ে মারার দৃশ্য। এক রকম জমজমাট প্রতিযােগিতা। কেউ কেউ তাে বাঁশের বেড়া ডিঙিয়ে নর্তকীর দিকে এগুতেও লাগলাে। ঠিক এ সময় হঠাৎ পুলিশের ধ্যান ভাঙলাে। শুরু হলাে

লাঠিচার্জ। 

১২. মার্চের ৩রা তারিখে ইত্তেফাকে প্রকাশিত অন্য এক খবরে জানা যায়, ভৈরবেও অনুরূপ অর্থাৎ প্রদর্শনীতে নগ্ন নৃত্য-জুয়া ইত্যাদি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। কক্সবাজারে তাে পর্যটন মেলায় নগ্ন নৃত্যকে কেন্দ্র করে অবশেষে আগুন ধরিয়ে স্টল।

চেঁচ সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। 

১৩. জিয়াশাহীর ছত্রছায়ায় সংস্কৃতি চর্চার নামে দেশে অসামাজিক কার্যকলাপ যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তাকে একমাত্র সন্ত্রাসের সঙ্গেই তুলনা করা যায় সংস্কৃতির। 

খােলসে মােড়া অপসংস্কৃতির দৌরাত্ম্য বলতে গেলে দেশব্যাপী ছেয়ে আছে। পহেলা বৈশাখ পালন করা নিয়েও ঘটেছে দুটি অপ্রীতিকর ঘটনা। এই দুটি ঘটনার জের অবশেষে অনেকেই চমকিয়ে দিয়েছে। কমবেশি ভাবিয়েছে। ঘটনা দুটি ঘটেছে ঢাকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পহেলা বৈশাখ পালন করা নিয়ে ছেরাে মেয়েদের হলে চড়াও হয়েছে। অভিভাবকরাও সন্ত্রস্ত। 

১৪. এগুলাে কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়-এই মতামত ব্যক্ত করে সমাজের শীর্ষস্থানীয় এক জন ব্যক্তি বলেছেন, বগুড়া, ভৈরব, কক্সবাজার কিংবা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাগুলাে জাতির সম্মান আর মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে হেয় করেছে। তারা মনে করেছেন, এসব অবশ্যই গুরুত্বের সংগে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু তবুও সরকার নীরব-নির্বিকার। জিয়াউর রহমান মুখে বলছেন শােষণ আর অপরাধমুক্ত সমাজ গড়ার কথা। কিন্তু কাজে তার উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে।

পুলিশ ভাড়ায় পাওয়া যাবে 

১৫. ১৯৮০ সালের সরকারী দৈনিকে আর্মস গার্ড এভেইলএবল অন পেমেন্ট শিরােনামে একটা খবর প্রকাশ হয়েছিল। শিরােনামটি বাংলা অর্থ গিয়ে দাড়ায় ভাড়ায় পুলিশ পাওয়া যায়। নিরপত্তা বিধানের জন্যেই এই ব্যবস্থা। অর্থাৎ দেশে নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলেই টাকা খাটিয়ে পুলিশ ভাড়া নেয়ার একটা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দেশে ছিনতাই রাহাজানিসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে তাই নিরাপত্তা বিধানের জন্য ভাড়ায় পুলিশী ব্যবস্থা। কিন্তু জিয়াশাহী বলছে সব ঠিক আছে। আজ চতুর্দিকে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, নিরাপত্তার ভীষণ অভাব, ছিনতাই-রাহাজানি লেগেই আছে। সংবাদপত্রের পাতা উল্টালেই মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে পুলিশ ছিনতাই রাহাজানি-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন মহল থেকেও অভিযােগ ওঠেছে যে, কিছু কিছু পুলিশকর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। দিনরাত বলতে কিছু নেই, যখন তখন আসামী ধরার নাম করে পুলিশ নিরীহ জনগণের ওপর চড়াও হয়। গত ৮১ সনের ৮ই ফেব্রুয়ারী দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত একটা খবরেও স্বরাষ্টমন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই উদ্বেগের কারণ আর কিছুই নয়, পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। 

১৬. বরগুনার হতভাগ্য নকুল চন্দ্রের কথা। নকুল চন্দ্রকে একদিন মর্মান্তিক এবং পৈশাচিক বর্বরতার মধ্যে চোখের পানি ভাসাতে হয়েছে। গভীর রাতে পুলিশ তার বাড়িতে হানা দেয়। নকুল চন্দ্রের অপরাধ সে গরীব এবং অসহায়। তাই তার

সামনেই পুলিশের লােকেরা স্ত্রী এবং কন্যাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ এবং নির্যাতন করে। স্বামী এবং পিতা হয়ে নকুল চন্দ্র সেদিন স্ত্রী এবং কন্যার ধর্ষিত হওয়ার করুণচিত্র। চোখের পানিতে আড়াল করতে চেয়েছিলাে, কিন্তু পারেনি।

১৭. ৮১ সনের পহেলা মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশিত অন্য এক খবরেও অনুরূপ এক ঘটনার কথা জানা যায়। গভীর রাতে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় একটি আবাসিক হােটেলে কর্তব্যরত পুলিশের কক্ষ থেকে একজন গৃহবধুকে উদ্ধার করা হয়। গৃহবধূকে উদ্ধার করার পর ঐ মহিলা জানায়, সে দীর্ঘদিন যাবৎ পুরুষ বেশে। পুরুষের পােশাক পরে একটা ট্রাকের হেলপার হিসেবে কাজ করে আসছে। ঘটনার দিন রাত এগারােটায় বাসা ফেরার পথে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে পৌঁছলে কনস্টেকল হঠাৎ এসে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে সঙ্গে করে হােটেলের গার্ড রুমে নিয়ে আসে। এবং ধর্ষণ করে। কিছুদিন আগে মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে একটি কিশােরীকে ফঁাড়িতে ধরে এনে ধর্ষণ করা হয়।

১৮, ৮১ সনের ১০ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর। খবরটি হচ্ছে ছিনতাইয়ের অভিযােগে পুলিশ নায়েক গ্রেফতার। ছিনতাই করার সময় মেট্রোপলিটান পুলিশের আর্মড ফোর্সের একজন নায়েক গ্রেফতার হয়ে হাজতবাস করছে। একই দিনে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযােগে একজন ট্রাফিক কনস্টবলকেও গ্রেফতার করা হয়। প্রথম ঘটনাটি ফুলবাড়িয়া সেন্ট্রাল বাসডিপাের কাছে ঘটে। শহীদুল ইসলাম নামক এক ব্যক্তি কুমিল্লা যাওয়ার জন্য। রাতে ফুলবাড়িয়া বাস ডিপােয় আসে। নায়েক ইদ্রিস চৌধুরী (৭২১) হঠাৎ এসে। তাকে তল্লাশী করার নাম করে রিক্সায় তােলে। এবং পরে ভদ্রলােকের টাকা পয়সা এবং ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শহীদুল ইসলাম এই সময় চিৎকার। শুরু করলে আশেপাশের লােকজন ছুটে আসে। ইদ্রিস আলী গ্রেফতার হয়। দ্বিতীয়। ঘটনাটি হচ্ছে, প্রমােদবালাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরাফেরা করায় রমনা পুলিশ আহমদ। আলী নামক একজন ট্রাফিক পুলিশকে গ্রেফতার করে।

অপরাধ ৭৫ সনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশী

১৯. জিয়াউর রহমান ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা শহরে ছিনাতই রাহাজানিসহ অন্যান্য অপরাধ রােধ করার জন্য ১৯৭৬ সালে ১লা ফেব্রুয়ারি মেট্রোপলিটান পুলিশবাহিনী। গঠন করে। তবু দেখা যায় ছিনতাই-রাহাজানির সংখ্যা বাড়ছেই এবং তা এখন। ১৯৭৫ সালের কয়েক গুণ বেশি। বর্তমানে মেট্রোপলিটান পুলিশ বাহিনীতে বিভিন্ন পদমর্যাদার অফিসারসহ ৯ হাজার পুলিশ রয়েছে। পুলিশের দেয়া এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় ঢাকা শহরে অন্যান্য বছরের তুলনায় ছিনতাই রাহাজানিসহ নানারকম অপরাধ বেড়েছে। অপরাধের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। বাংলাদেশ সংসদে দেশের চিত্র

২০. ৪ মাসে ১৩৫টি নারী হত্যু ও ১৩৪টি নারী অপহরণ ।। ৩ মাসে ৪৩২টি খুন ।।

মদের দোকান বাড়ছে। হিজবুল বহরের জন্য প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকা গচ্চা। জাতীয় সংসদে জুন ১৯৮০ সনে সংসদ সদস্যদের উথাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রীরা যেসব তথ্য প্রকাশ করছেন, তাতে দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইন শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির এক নাজুক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের দেওয়া কতগুলাে তথ্য এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলাে :

১৯৭৫ সালের পর থেকে দেশে মদের দোকানের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধুমাত্র রংপুর জেলায় যেখানে ১৯৭৫ সালে নদের দোকান ছিল ৬টি, ১৯৮০ সালে তা এসে দাড়িয়েছে ১৭টিতে। 

জাহাজ চলাচল মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, হজ্ব যাত্রীদের জন্য ব্যবহৃত হিজবুল বহরজাহাজটির জন্য ৭৮-৭৯ সালে ১ কোটি ২০লাখ ৭০ হাজার টাকা লােকসান দিতে হয়েছে এবং জাহাজটি পােষার জন্য প্রতিদিন ৭৫,০০ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে বর্তমানে কর্মরত ৭৪ জন বিদেশীর জন্য ৭৮-৭৯ সালে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে, গত পাঁচ বছরে ৭৬ সন থেকে ৮০ সন পর্যন্ত ৪শ২৪ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। 

২৭ জন কয়েদী ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন জামালপুর কারাগারে বর্তমানে ২২৬ জন কয়েদী রাখা হয়েছে।

শুধুমাত্র ৭৯ সনে ঢাকা শহরে ৪৫টি হত্যা, ৭টি ধর্ষণ, ২৯টি ডাকাতি, ৩৪টি ছিনতাই এবং ১৯৫টি অপহরণ সংঘটিত হয়েছে৮০ সালের মাত্র সাড়ে ৪ মাসে ঢাকা শহরে ৯৯টি হত্যা, ১১টি ছিনতাই ও ৩৩ জন অপহৃত হয়েছে। 

১৯৮০ সনে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মােট ১৩৫টি নারী হত্যা ও ১৩৪টি নারী অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। 

চলতি বছরে ১২টি লঞ্চ ডাকাতি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে মােট ৪৩২টি খুন হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। গত বছরের প্রথম ৩ মাসের তুলনায় এ বছরের খুনের সংখ্যা ৬১টি বেশী।।

১১৯


অন্তত লাশটা দাও

রাসেল-এর রক্তে জিয়ার হাত

১. জাতির জনক ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন।১ খুনীদের তিনি বলেছিলেন যে আমি এসব ব্যাপারে জড়াতে চাইনা। যদি তােমরা কিছু করতে চাও তাহলে এটা জুনিয়র অফিসারদেরই করা উচিত। ২

২. নির্বাচিত সরকার ও সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। একটি আইনানুগ নির্বাচিত সরকার উৎখাত এবং প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হত্যা চক্রান্তের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে যে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান তা পালন করেননি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সংগে যােগসাজশ অব্যাহত রেখে সেনাবাহিনীর নিয়মরীতি ও আর্মি এ্যাক্টের ৩১ ধারা লংঘন করেন। এসব তথ্য থেকে নিশ্চিতভাবেই একটি কথা প্রমাণ হয় যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারবর্গ ও শিশুপুত্র রাসের-এর রক্তপ্রবাহে জিয়ার হাতের স্পর্শ ছিলাে।

খুনীদের অব্যাহতি ও বৈধতা দান

৩. জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তার প্রমাণ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ৭৯ সনের পার্লামেন্টে বৈধতা। এই অধ্যাদেশে ১৫ই আগস্টের খুনীদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। খােন্দকার মােশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেও-এর কোন আইনগত ভিত্তি ছিলােনা। কেননা, খন্দকার মােশতাক সামরিক আইন প্রশাসক ছিলাে না কিংবা সংবিধানসম্মত বৈধ। রাষ্ট্রপতিও ছিলাে না। সংবিধান বহাল ছিলাে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের কোন আইন জারীর ক্ষমতা নেই।

৪. এ কারণেই বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, মােশতাক সংবিধান বাতিল বা রহিত করেনি, জাতীয় সংসদও ভেংগে দেয়নি। এই অবস্থায় প্রধান সামরিক প্রশাসক না হয়েও সামরিক শাসনের আওতায় মােশতাক কিভাবে এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করতে পারে

৫. সংবিধান মতে উক্ত অধ্যাদেশটি ছিলাে অবৈধ ও মৃত। স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিলাে অধ্যাদেশটির জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জাতীয় সংসদ তৈরী করেন‘, সংবিধানের ৫ম সংশােধনী পাশ করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে সাংবিধানিকভাবে রক্ষা ও প্রটেকশন দেন জিয়াউর রহমান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলে কি খুনীদের আশ্রয়দানের এই দায়িত্ব নিতেন?

৬. জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের ৮ই জুন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ১২জনকে কূটনৈতিক পদে নিয়ােগ দান করেন। এই খুনীদের নাম (১) লেঃ কর্ণেল শরিফুল হক ডালিম প্রথম সচিব (চীন), (২) লেঃ কর্ণেল আজিজ পাশা, প্রথম সচিব (আর্জেন্টিনা), (৩) মেজর মহিউদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব (আলজেরিয়া), (৪) মেজর শারিয়ার, দ্বিতীয় সচিব (ইন্দোনেশিয়া), (৫) মেজর বজলুল হুদা, দ্বিতীয় সচিব (পাকিস্তান), (৬) মেজর। রশীদ চৌধুরী, দ্বিতীয় সচিব (সৌদী আরব), (৭) মেজর নূর, দ্বিতীয় সচিব (ইরান), (৮) মেজর শরিফুল হােসেন, দ্বিতীয় সচিব (কুয়েত), (৯) ক্যাপ্টেন কিসমত হােসেন, তৃতীয় সচিব (আবুধাবী) (১০) লেঃ খায়রুজ্জামান,তৃতীয় সচিব (মিসর), (১১) লেঃ নজমুল হােসেন, তৃতীয় সচিব (ক্যানাডা), (১২) লেঃ আবদুল মজিদ, তৃতীয় সচিব (সেনেগল)। 

৭. শুধু তাই নয়, বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব শূণ্য করার জন্য ১৯৭৫ সনে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম, মনসুর আলী ও এ, এইচ, এম, কামারুজ্জামানকে ঢাকা কারাভ্যন্তরে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সনে হত্যাকান্ডের জন্য গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটিকে জিয়াউর রহমান কাজ করার সুযােগ দেন। এমন কি লালবাগ থানায় হত্যাকান্ডের জিডি গায়েব করা হয়। 

৮. জেল হত্যাকান্ডে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাজ জিয়াউর রহমান বন্ধ করে দেন। জেল হত্যাকান্ডের উপর তৎকালীন ডি আই জি, এ কে আউয়াল লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছিলেন এবং ৬ই নভেম্বর ৭৫ এই হত্যাকান্ডের তদন্তে তিন সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিলাে। জিয়াউর রহমান এ তদন্ত কমিটি বাতিল ও মামলাটি সি আই ডির নিকট হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। এমনকি, লন্ডনভিত্তিক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড তদন্ত সদস্যদের দেশে ঢুকতে দেননি। সেই থেকে আজও তা ডার্ক রুমে ফেলে রাখা হয়েছে। ১০

৯. প্রহসনমূলক গনভােট দেশ ও জাতিকে স্তম্ভিত করলাে। সামরিক বাহিনীর উচ্চাভিলাষী অফিসার ও সিপাইগণও জিয়াউর রহমানের প্রহসনমূলক ফাঁকিবাজি ধরে ফেলেন। শুরু হলাে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। জিয়ার আমলে ১৯টি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।১১ জিয়া নির্মমভাবে হাজার হাজার সেনা সদস্যদের হত্যা করেন।

১০. ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের আসামান্য সাফল্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী অফিসারদের ও জোয়ানদের মধ্যে প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগরূক করে। জওয়ানরা ভাবতে থাকে তারাই দেশের হর্তা-কর্তা। জিয়াউর রহমান নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য সেপাইদের অস্কারা দিতে থাকেন। ৭ই নভেম্বর ৭৫ সনে সিপাহী-জনতা ভাই ভাইশ্লোগান দিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াকে তারা প্রধান সেনাপতি পদে পুনঃঅধিষ্ঠত করেছে এই ভেবে যে, জিয়া তাদের সঙ্গে যে চুক্তি করেছেন ক্ষমতায় থেকে জিয়া তা পালন করবেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়াউর রহমানকে বন্দী হতে মুক্ত করেন। তাদের দাবী অনুসারে জিয়াউর রহমান ১২-দফা দাবীতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।১২

১১. কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলাে এই যে, ৭ই নভেম্বর কর্ণেল (অঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বে জিয়া মুক্ত হওয়ার পর পরবর্তীতে কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরকে বিচারের যে অভিযােগপত্র তৈরী করা হয়, তার মধ্যে বিশেষভাবে অভিযোেগ ছিলাে ৭ই নভেম্বর কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের সৈনিকদের উস্কানী দিয়েছে, তাদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছে এবং হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ১৩

১২. কর্ণেল (অঃ) আবু তাহেরকে ফাঁসি দেবার ফলে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেপাইগণের নিকট একটি কথাই পরিস্কার হয়ে ওঠে যে, জিয়াউর রহমান একজন বিশ্বাসঘাতক। জিয়া কর্তৃক ১২-দফা স্বাক্ষরিত হওয়ার পর জিয়া এইসব দাবীর মধ্যে সামান্য বেতন বৃদ্ধি ও ব্যাটম্যানশীপ বাতিল করেন। অন্য সব দাবী জিয়া সতর্কভাবে এড়িয়ে যান। 

১৩. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য ও বাইরে তাদের সমর্থকগণ সুযােগ খুঁজতে থাকেন। কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহেরের অনুগত ও সমর্থকবৃন্দ বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে সামনে রেখে। কিন্তু জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে প্রতিষ্ঠার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং শোষণণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তােলার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাবেদার হয়ে পড়ে এবং নিষিদ্ধ ঘােষিত সাম্প্রদায়িক দলগুলিকে রাজনীতি করার সুযােগ প্রদান করেন। গণবিরােধী ডান পন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ও কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির সঙ্গে আতাত করেন। এ সবই ছিলাে ৭ই নভেম্বর অংশগ্রহণকারী সৈনিক সংস্থার চেতনার পরিপন্থী। ১৪

১৪. জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনীকে একীভূত করার পর আইন-শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে অনুরূপ এক বাহিনী গঠন করেন। স্পেশাল আমর্ড ফোর্স গঠন তাহের অনুগত সৈনিকবৃন্দ সুনজর দেখেননি। তাদের সংখ্যা ১২,৫০০ উন্নীত করা হয়। সয়ংক্রিয় অস্ত্র সরবরাহ, ভালাে পােশাক ও নতুন গাড়ী দেয়া হয়। বেতন ভাতাও ছিলাে আকর্ষণীয়। ১৫ 

১৫. ১৯৭৮-র অক্টোবরে আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটালিয়ান সৈন্যরা এক বিদ্রোহের আয়ােজন করেতার সঙ্গে কুর্মিটোলার এয়ার বেজ থেকে কয়েক শত ইয়ারম্যান এসে তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। রাত পৌনে তিনটায় ৭০০ আর্মি ও ২৫ ট্রাক ভর্তি বিমান সদস্য কেন্দ্রীয় অর্ডিন্যান্স ডিপাে থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করে। সকাল ৫টায় তারা রেডিও স্টেশন দখল করে বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘােষণা দেয়। তারা হাজার হাজার লিফলেট বিতরণ করে, সৈন্যদের বিদ্রোহে যােগ দিতে আহবান জানায়। ৭ই নভেম্বরে জিয়ার নামে তারা ছিল উন্মাদ, কিন্তু এবার তাকেই তারা বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করে তার শাসনের অবসান চায়। ৭ই নভেম্বরের মতাে তারা রাস্তায় শ্লোগান দেয় সিপাহী জনতা ভাই ভাই 

১৬. কিন্তু তাদের বিদ্রোহ পূর্ণতা লাভ করার পূর্বেই সি জি এস-এর দায়িত্বে নিয়ােজিত মেজর জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশে নবম ডিভিশনকে বাইপাস করে ঢাকা বিগ্রেড কমান্ডার লেঃ কর্ণেল আমিন আহমদকে এই বিদ্রোহ দমনের ও জিয়াকে রক্ষা করার নির্দেশ দেয়া হয়। বিদ্রোহদের সঙ্গে ঢাকা বিগ্রেডের সংঘর্ষ ঘটে। ক্যান্টমেন্টে অবস্থানরত জিয়াকে বিদ্রোহীরা খুঁজে না পাওয়ায় অল্পের জন্য জিয়া বেচে যান। ইতিমধ্যে নবম ডিভিশন এগিয়ে আসে এবং বিদ্রোহ দমন করে। বিদ্রোহীরা বিমান বাহিনীর কতিপয় অফিসারকে হত্যা করে। ১৬ 

১৭. বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণ করার পর জিয়াউর রহমান কঠোর মনােভাব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে সন্দেহভাজন সদস্য ও অফিসারদের এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে এ্যান্থনী মাসকার্ণহাস লিখেছেনজেনারেল জিয়া এই অভ্যুথানের সঙ্গে জড়িত সৈনিক আর এয়ারম্যান দের উপর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য প্রতিশােধ নিয়ে তাঁর মনে প্রজ্জলিত প্রতিহিংসার আগুন নির্বাপিত করেন। সরকারী হিসেব মত তিনি ১৯৭৭ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দুমাসের মধ্যে ১১৪৩ (এগারশত তেতাল্লিশ) জন সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে লটকিয়ে খুন করেন। তাছাড়া বহুশত সৈনিককে তিনি দশ বছর থেকে যাবজ্জীন পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে জেলে পাঠিয়ে দেন। আইনগত পদ্ধতি আর ন্যায় বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে এ শাস্তির কাজ সমাপন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে বড় পৈশাচিক সাজার আর কোন নজির নেই। তিন/চার জনকে একবারে বিচারের জন্যে ডেকে ফাসির দন্ডাদেশ দেয়া হতাে। জেনারেল। জিয়া বসে বসে সেগুলাে অনুমােদন করতেন এবং তাঁর পরপরই তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতাে। উল্লেখিত পদ্ধতির সকল কাজই মাত্র ৪৮ ঘন্টা সময়ের সম্পন্ন করা হতাে। তাঁর সহযােগীদের একজন আমাকে জানিয়েছিলাে, জেনারেল জিয়া, প্রেসিডেন্ট আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বৈত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তাঁর নিজের হাতে লিখে ঐ সকল হতভাগা সৈনিকদের দন্ডাদেশ অনুমােদন করতেন। বেসামরিক বন্দীরা স্মৃতিচারণ করে বলে, কয়েক সপ্তাহ ধরে জেল খানার রাতগুলাে সৈনিকদের আর্তচীৎকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিলাে। তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে নিয়ে যাবার সময় তারা নির্দোষ বলে বুকফাঁটা চিকার ভেঙ্গে পড়তাে। এই সকল হত্যালীলার জন্যে বিমান বাহিনী বা সেনা বাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠিত আইন কানুনকে মেনে চলা হয়নি। বিধি মােতাবেক, শাস্তির সময়ে কেবল জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুর দন্ডাদেশ প্রদান করতে পারে। জেনারেল কোর্ট মার্শালে কমপক্ষে পাঁচজন মিলিটারী জজ থাকে। এদের মধ্যে একজনকে অন্ততঃপক্ষে লেঃ কর্ণেল হতে হবে এবং বাকী চারজনের কেউই ক্যাপ্টেনের নীচে হতে পারবে না। এবং কমিশন প্রাপ্তির পর ক্যাপ্টেনদেরকে কমপক্ষে তিনবছর . চাকুরী সম্পন্ন করতে হবে। অভিযুক্তদেরকে তাদের আত্মপক্ষ অবলম্বনের জন্যে পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে, জেনারেল জিয়া দেখলেন যে এই সকল নিয়ম কানুন তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট অন্তরায়। সেজন্যে একটি মার্শাল লঅর্ডারঘােষণা করলেন। ঐ ঘােষণায় বিশেষ আদালতের নামে এমন কোর্ট তিনি সৃষ্টি করলেন, যেগুলােতে বিচারের জন্যে একজন লেঃ কর্ণেলের সঙ্গে হাবিলদার ও তার কাছাকাছি পদমর্যাদার লােকেরা বসূতে পারতাে। দ্রুতগতিতে মামলার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এভাবেই ব্যবস্থা গৃহীত হলাে। এই উপমহাদেশের কোথাও এধরনের ঘটনা ঘটানাে হয়েছে বলে নজির নেই। এক কলমের খোঁচায় জেনারেল জিয়া রাতারাতি দুই ডজনেরও বেশী এই ধরনের কোর্ট সৃষ্টি করলেন। ন্যায় বিচারের কোন প্রশ্নই সেখানে উঠতে পারে না। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈনিকদেরকে খুন করা হয়েছিলাে মাত্র। এমন একটি কোর্টের উদাহরণ নিম্নে বর্ণিত হলাে। ঐ টির নাম মার্শাল ল ট্রাইবুনাল নং-১৮, ঢাকা। কেস নং ১/১৯৭৭, তাং-৮ই অক্টোবর, ১৯৭৭ সাল।

সংশ্লিষ্ট জজদের নামঃ

১। লেঃ কর্ণেল কাজী সলিমুদ্দিন মােঃ শাহারিয়ার

২। সুবেদার মােঃ আবদুল হালিম

৩। নায়েক সুবেদার আবদুল হাকিম

৪। হাবিলদার আনােয়ার হােসেন

৫। হাবিলদার এম, এফ, আহমেদ

১৯৭৭ সালের ১লা/২রা অক্টোবর রাতে বিদ্রোহের অভিযােগে অভিযুক্তরা ছিলােঃ 

১। ৬২৭৮০২৮ নায়েক এনামুল হক।

২। ৬২৮৪৫৪ সিগন্যাল কাজী সাইদ হােসেন

৩। ৬২৮১১৮৬ নায়েক আবদুল মন্নান

৪। ৬২৮৪৭৩৬ সিগন্যালার এস কে জাবেদ আলী। 

তারা সবাই নিজেদেরকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু তার কোন উপায় ছিলাে না। তিনজন অভিযােগকারী, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, নায়েক আবুল বাসার এবং ল্যান্স নায়েক আবদুল আলী দৌড়ে এসে উপস্থিত হয়ে যায়। অভিযুক্তদের পক্ষে কোন সাক্ষী ইত্যাদি ছিলাে না। একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় যে, সে দোষী ব্যক্তিদেরকে অস্ত্রাগারে ঢুকে রাইফেল নিয়ে একটি আর্মির গাড়ীতে উঠে চলে যেতে দেখেছে। আর একজন অভিযুক্তদের ব্যারাকের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছে। তাদের কেউ বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছেবলে চিৎকার করেছিলাে। অভিযুক্তদের একজন বলে সে ব্যারাকের সকলের শেষে ঘুম থেকে জেগে ছিলাে এবং সে সম্পূর্ণভাবে নিরপরাধ আর একজন অভিযুক্ত বলে যে, চীৎকার শুনতে পেয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে অন্ত্রগার থেকে সেও রাইফেল হাতে নিয়েছিলাে। কিন্তু তারপরেই সে দেখতে পায় যে কোথাও কোনরকম যুদ্ধ বেধে যায় নিসুতরাং সে তার অধিনায়কের নির্দেশে পরে অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়। এই সকল সাক্ষী প্রমাণ আর অভিযুক্তদের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বিশেষ সামরিক আদালত চারজনের সবাইকে দোষী বলে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেয় এবং মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। পরদিন, ৯ই অক্টোবর, স্বয়ং জেনারেল জিয়া ঐ সব মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমােদন করে মন্তব্য দেনঃ “যতক্ষণপর্যন্ত ওরা না মরে’ ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখাে।’ এই চারজন হতভাগ্যকে ১০ই অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা হরা হয়।

 ১৮. বিচারের নামে প্রহসন চলতে থাকে। বিদ্রোহীদের মরণ চিৎকারে কারাগারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। সে সময় কারাগার হতে বেগম সুফিয়া কামালের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীরা একটি চিঠি লিখে পাঠায়। চিঠিটি এখানে উল্লেখ করা হলাে

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে নির্যাতিত সৈনিকবৃন্দের পক্ষ থেকে

কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা ২২-১০-৮১ 

মা,

* আপনি আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম গ্রহণ করুন। গতকল্য প্রকাশিত সংবাদ পত্রিকায় আপনার অতি মূল্যবান ও হৃদয়গ্রহী বিবৃতিখানা পড়ে আমরা খুবই প্রীত হয়েছি। বাংলাদেশের সকল মা ও বধূদের পক্ষ থেকে আপনি সদাশয় সরকারের কাছে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত অফিসারদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছেন। আপনি স্নেহময়ী মায়ের যােগ্যতম কাজই করেছেন। আপনার এহেন গৌরবময় ভূমিকার জন্য আমরা সত্যই গর্বিত। জাতি আপনার ন্যায় মমতাময়ী বিদুষী মহিলা পেয়ে গর্ববােধ করবেই।

কিন্তু মা, আপনি কি জানেন ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবরে ঢাকা সেনানিবাসে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনার প্রেক্ষিতে কতজন সৈনিককে ফাঁসির রজ্জতে প্রাণ দিতে হয়েছে? আপনি কি জানেন কত অভাগী মায়ের প্রাণপ্রিয় সন্তানকে ওরা বেয়নেট নিয়ে খুচিয়ে, গুলি করে, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে, রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে? আপনি কি জানেন, কত শত সৈনিক এখনও যাবজ্জীবন কারাদন্ড মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে দিনে দিনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আপনি কি জানেন মৃত ও জীবিত (বন্দী) সৈনিকদের পরিবারের সদস্যরা আজ পথের ভিখারী, পেটের জ্বালায় অনেকেই আজ ইজ্জত বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে?

মাগাে, আমরা এতই অসহায়-আমাদের কথা কেউ বলে না। আমাদের জীবনের মূল্য কারাে কাছে নেই। ‘৭৭-এর ঐ ঘটনার পর অনেককে দেখেছি মিছিল করে বলতে ‘ওদের ফাঁসি দাও’, কিন্তু আমরা কি অপরাধ করেছিলাম তা জানতে কেউ চাইল না। সত্যই কি সেদিন কেউ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিল। না হয় তর্কের তিরে ধরেই নিলাম আমরা জিয়াকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম কিন্তু এখন তাে জিয়াকে হত্যা করাই হয়ে গেল, হত্যাকারীদের বাঁচিয়ে রাখাটা যদি মানবতা হয়, তবে যারা হত্যা করতে চেয়েছিল কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মধ্যে থেকে ৪২৫ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৩৫০ জনকে দীর্ঘমেয়াদী কারাদন্ড দেওয়া কোন মানবতা? মাগাে, আপনি কি ঐ সৈনিকদের বিধবা পত্নী ও এতিম শিশুদের কান্না শুনতে পান না? নিশ্চয় পান। আমরা দৃঢ় আশা পােষণ করি, আপনি এদের কথাও বলবেন।  চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অভিযুক্তরা সকলেই অফিসার এবং তাঁরা সকরেই বড় ঘরের সন্তান তাঁদের কথা আজ সকল মহল থেকে বলা হচ্ছে। তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। আমাদের সবিনয় আবেদন মাত্র এই, সেই সংগে আমাদের অসহায় পরিবারবর্গের কথাও যেন বলা হয়। আজ ৪ বছর জেল খেটে আমাদের আর কিছুই নেই। মানসিক দুশ্চিন্তায় এবং বিভিন্ন সময়ের কারা-নির্যাতনের ফলে আমাদের মধ্যে এমনও আছেন যাঁর ৫৫ বৎসর বয়স। ৮টা ছেলেমেয়ে রেখে এসেছেন। ঘরে এক মুষ্ঠি চাউল রেখে আসতে পারেন নি।

আমরা আপনার কাছে আবেদন করছি মা, আপনি এ সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন, দীর্ঘ বৎসর কারা-যন্ত্রণা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? আমরা কি এতই সাংঘাতিক? যদি এতই সাংঘাতিক হয়ে থাকি তবে আমাদের একই মামলার আসামী ৩১নং বিশেষ সামরিক আদালতে প্রথমে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পরে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামী গাজী গােলাম মাওলা ও আমীর হােসেনকে ১০ বৎসর সাজা মাফ করে দিয়ে মুক্তি দেওয়া হল কি করে? ওদের প্রতি মানবতা দেখান হল। আমাদের প্রতি এমন বিমাতাসুলভ আচরণ কেন? একটা মিউটিনি মামলার সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত দু’জনকে যদি ক্ষমা করা যায় তবে আমাদের বেলায় বাধা কোথায়, তা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা অবশ্য ঐ দু’ভদ্রলােকের ন্যায় মােটা অংকের টাকা খরচ করতে পারব না।

আপনি কবি, আপনি মা, আপনি আমাদের ন্যায় হতভাগ্যদের মনের যন্ত্রণা ভাল। করেই বুঝবেন ও মর্মস্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন। আল্লাহ আপনাকে সেই তৌফিক দিয়েছেন। আমাদের কথা বলার জন্য, আমাদের মুক্তি দাবি করার জন্য আমরা বাংলাদেশের এমন কোন দল, সংগঠক ও ব্যক্তিত্বকে বাকী রাখিনি- বলতে পারবেন, আমরা তাঁদেরকে জানাইনি। কিন্তু কেউ আমাদের কথা বলেন না।

বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে আমরা বর্তমানে প্রায় দেড়শত সৈনিক আছি, যাদের ৬০% জনের সাজা হল ২০ বৎসর, তারপর ১৫/১৪/১২/১০ বৎসর।

মাগাে, আপনি যার হাতে লিখা পড়ছেন, সেই হতভাগ্যের পিতা, পুত্রশােকে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত একবুক হতাশার জ্বালা নিয়ে পরকালে পাড়ি জমিয়েছেন গত ফেব্রুয়ারীতে। এবার নিশ্চয় আমাদের যন্ত্রণার গভীরতা অনুধাবন করতে পেরেছেন। অতএব, আপনাকে আর বিরক্ত করাটা সমীচীন মনে করি না।

মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করে। পরদিন, ৯ই অক্টোবর, স্বয়ং জেনারেল জিয়া ঐ সব মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমােদন করে মন্তব্য দেনঃ যতক্ষণপর্যন্ত ওরা না মরেততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখাে।এই চারজন হতভাগ্যকে ১০ই অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা হরা হয়।

১৯. এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় সমস্ত বন্দী মারাত্মক ক্ষুব্ধ হন এবং ডি, আই, জি (প্রিজন) এর কাছে দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। একই সাথে তারা অন্যান্য বহুমুখী সমস্যা নিয়ে আলােচনার জন্য ডি,আই,জি (প্রিজন)-এর সাক্ষাৎ কামনা করলে তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়। অনন্যোপায় হয়ে ৩ ডিসেম্বর ৭৯ দুপুর ১২টা থেকে অফিস কেস টেবিল ও উৎপাদন বিভাগে নিয়ােজিত সকল সাজাপ্রাপ্ত বন্দী কর্মবিরতির মাধ্যমে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। ৫ই ডিসেম্বর, ‘৭৯ একটি দরখাস্ত জেলা প্রশাসকের বরাবর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। প্রেরণ করলেও জেলা প্রশাসকের সাক্ষাৎলাভে ব্যর্থ হয়ে সকল বন্দীরা ৭ই ডিসেম্বর ৭৯ জেলা প্রশাসকের কাছে আরেক দফা দরখাস্ত প্রেরণ করেন। এতে উল্লেখ করা হয় যে, সাক্ষাৎদানে ব্যর্থ হলে ৮ই ডিসেম্বর সূর্যোদয় থেকে সকল বন্দীরা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য প্রতীক অনশন পালনে বাধ্য হবেন। তবুও জেলা প্রশাসক আসেননি। 

২০. ৮ ডিসেম্বর সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টা রাজশাহীর জেলের সকল বন্দী প্রতীক অনশন পালন করেন। এর পরও জেলা প্রশাসক কিংবা করা-কর্তৃপক্ষ বন্দীদেরসাথে সাক্ষাৎ বা আলােচনার কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। জেলা প্রশাসক সাক্ষাৎদানে ব্যর্থ হলে সকল বন্দী ১৩ই ডিসেম্বর, ‘৭৯ থেকে আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হবেন। অভিন্ন বক্তব্য সম্বলিত চরমপত্র আই, জি, (প্রিজন)-এর বরাবরে প্রেরিত হয়। তার হাতে ১৮ দফা দাবী প্রদান করা হয়। 

২১. ১৮ দফা দাবীর মধ্যে ডি, আই জি (প্রিজন) এর অপসারণ, মধ্যযুগীয় নির্যাতন বন্ধ,

খাবারের উন্নতমান, পানি, বিদ্যুৎ পায়খানার সুব্যবস্থা, বন্দীদের সুচিকিৎসা, লাইব্রেরীতে বই, দৈনিক পত্রিকা সরবরাহ, সংস্কৃতির চর্চার ব্যবস্থা, রাজবন্দীদের রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের দাবী সহ ১৮ দফা দাবী জানানাে হয়। 

২২. ১১ ডিসেম্বরের আলােচনা বৈঠকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) ১৮ দফা দাবী থেকে কিছু দাবী মেনে নেন। এছাড়া তিনি বন্দী প্রতিনিধিদের এ বক্তব্যের সাথে নীতিগতভাবে একমত হন যে, কারাসংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে এ-দাবীর আনুষ্ঠানিক ও সরকারী স্বীকৃতি মিলেছে যে, বর্তমান জেলকোড সময়ােপযােগী নয়। সুতরাং বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে ব্রিটিশ প্রণীত জেলকোডের হুবহ প্রয়ােগ হতে পারে না। সর্বোপরি তিনি এ অভিযােগ বলে মেনে নেন যে, ডি,আই,জি (প্রিজন), এর আচরণ অমানবিক এবং তিনি তাকে মানবিক আচরণ করতে নির্দেশ দেন। উক্ত বৈঠকে তিনি কিছু-কিছু বিষয় তদন্তের জন্য গ্রহণ করেন। এবং অন্যান্য বিষয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে বন্দী প্রতিনিধিদের আলােচনার জন্য ১৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক আসেননি। 

২৩. এসময় কনকনে ঠাণ্ডা পড়ে। কম্বলের অভাবে বন্দীরা ভীষণ অসুবিধায় পরেন। তিন শতাধিক বন্দীদের একটিও কম্বল নেই। শতাধিক বন্দীর একটি চটও নেই। এব্যাপারে জেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বারংবার বলা সত্ত্বেও কোনাে ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কর্তৃক স্বীকৃতি দাবিসমূহও বাস্তবায়িত করেনি, বরং জেল কর্তৃপক্ষ চরম নির্যাতনমূলক কথবার্তা ও আচরণ করতে থাকে। 

২৪. বিনা বিচারে আটক বন্দীদের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা সৃষ্ট হয়। জরুরী আইনে আটক বন্দীগণ মুক্তির লক্ষ্যে অনশন শুরু করেন। আইনগতভাবে তারা মুক্তি পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু তাদের যথাসময়ে মুক্তি না দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে আটকাদেশ এলে বন্দীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। 

২৫. ৩০ জানুয়ারী সন্ধ্যায় লক-আপের পর ৮টার দিকে Indian Ward থেকে তিনজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দী কর্পোরাল শামসুল হক, মােজাফফর হােসেন ও আক্কাস আলীকে বলপূর্বক ওয়ার্ড থেকে বের করা হয় এবং দৈহিক নির্যাতন করতে করতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সাথে সাথে সমস্ত কারাগর শ্লোগান প্রকল্পিত হয়ে ওঠে। অন্যায়ভাবে বদলি করা চলবে না ডি, আই, জি (প্রিজন)-এর অপসারণ চাইপ্রভৃতি। রাত ৮টা থেকেই অনশন শুরু হয়ে যায়। গভীর রাত পর্যন্ত শ্লোগান অব্যাহত থাকে। 

২৬. ৩১ জানুয়ারী ১৯৮০ জেলকোড অনুযায়ী ভােরবেলা সেলসমূহের তালা খােলার নিয়ম থাকলেও সেদিন তালা খােলা হয়নি। এসময় বন্দীরা তালা খুলে দেয়ার জন্য কারারক্ষীদের অনুরােধ জানায়। কিন্তু রক্ষীরা জানায় যে, তাদের সেলের তালা না খােলার আদেশ দেয়া হয়েছে। বন্দীদের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সকাল নয়টার দিকে জেলের বিভিন্ন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রায় দেড়শকারারক্ষী লাঠি, লােহার রড ও বিভিন্ন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জেলখানায় প্রবেশ করে এবং দোমহলায় বেপরােয়া হামলা চালায়। এমনি বেপরােয়া হামলা সময়ই হঠাৎ করে এলার্ম বেজে ওঠে। এলার্ম বাজার সাথে সাথে জেলের প্রধান গেট দিয়ে আরাে ২৫/৩০ জন কারারক্ষী ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় নিরাপত্তার আশায় বন্দীরা সেলের দরােজা খােলা পেয়ে মেডিক্যাল সেন্টারের (জেলের ভেতরেই) দিকে দৌড়ােতে শুরু করে। জেল কর্মকর্তারা এ-সময় একদল কারারক্ষীকে সাথে নিয়ে দ্রুত জেলের প্রধান গেটে চলে যায় এবং বিনা হুশিয়ারিতে অসহায় বন্দীদের লক্ষ্য করে গুলীবর্ষণ শুরু করে। গুলীবর্ষণ চলতে তাকে প্রায় একঘন্টা। গুলীর আওয়াজে সারা রাজশাহী শহরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। 

২৭. বিক্ষুব্ধ জনতা জেলের কাছে জমায়েত হয়ে গুলীবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এক ঘন্টায় প্রায় সাড়ে আটশরাউণ্ড গুলীবর্ষণ করা হয়। গুলীতে ঘটনাস্থলেই দুজন নিহত ও অন্য একজন হাসপাতালে মারা যান। গুলীবর্ষণ থামার প্রায় আধ ঘন্টা পর গুরুতর আহত কয়েকজনকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয় এবং অন্যদের ভর্তি করা হয় জেল হাসপাতালে। নিহত ” আবদুর রহিম (ঈশ্বরদী, পাবনা), মােঃ শাফি (শিবগঞ্জ, বগুড়া) ও আবদুর গান (গবিন্দপুর, বগুড়া)। 

২৮. সরকার জেল হত্যা তদন্ত করার জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন। কমিশনের সদস্য- রাজশাহীর জেলা ও দায়রা জজ জনাব শামসুদ্দিন আহমদ। তদন্ত রিপাের্টে বিডি আর, রিজার্ভ পুলিশ ও জেলা পুলিশ কর্তৃক গুলী চালানাের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়। 

জিয়া নিজেই মাঠে নামেন 

২৯. রাজশাহী কারাগারে তিনজন বন্দীকে গুলী করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পরার সাথে সাথেই সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গুলী চলাকালীন সময়ই বিপুল জনতা রাজশাহী জেলের সামনে ভিড় করে বিভিন্নরকম শ্লোগান দিতে থাকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বিরাট-বিরাট প্রতিবাদ মিছিল ও বিকেলে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ভুবনমােহন পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন রাজশাহী শহরে পালিত হয় পূর্ণ হরতাল। ঢাকায় দশ দলের পক্ষ থেকে হরতাল আহবান করা হয় প্রায় সব দলই প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে হরতালেরর প্রতি সমর্থন জানায়। হরতাল পালন একটি গণতান্ত্রিক অধিকার হলেও সরকারী দল হরতাল বানচালের জন্য সর্বশক্তি নিয়ােগ করেবিএনপির শুধু কর্মকর্তারাই নয়, প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেও মাঠে নামেন এবং একটি সভায় ঘােষণা করেন- কোন মতেই হরতাল হতে দেয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজে হরতালের আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকার বিভিন্ন বাজারসমূহ পরিদর্শন করে দোকানপাট খােলা রাখার অনুরােধ জানান। এছাড়া জাতীয়তাবাদী যুবদলের সদস্যরাও ট্রাক ভর্তি করে সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।

হরতাল বন্ধে জালিয়াত

৩০. সবচেয়ে বড় জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয় গভীর রাতে। সরকারী দলের পক্ষ থেকে মাইকে প্রচার করা হয়- আগামী কাল অনিবার্যকারণে হরতাল স্থগিত রাখা হয়েছে। সরকারী দলের সব রকম চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ৯ই ফেব্রুয়ারী সারা ঢাকা শহরে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। স্বাধীনতার পর এমনি পূর্ণ হরতাল পালন এই প্রথম। হরতালে সন্ত্রাস ঃ আরাে লাশ

৩১. হরতালের দিন ভাের থেকে সরকারী দলের পক্ষ থেকে দারুণ ত্রাস সৃষ্টি করা হয়।

ভাের বেলায় বেপরােয়াভাবে হামলা চালানাে হয় আওয়ামী লীগ, কমুনিস্ট পার্টি ও জাসদ অফিসে। সারা শহরে এক শ্রেণীর যুবক মাইকোবাস ও জীপে করে পুলিশের সাথে বেরিকেড ভাঙার কাজে অংশ নেয় এবং ফাঁকা গুলী করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। হকিষ্টিক ও লাঠিসোটা নিয়ে যুবকরা বিভিন্ন স্থানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের ওপর হামলা চালায়। হরতালের দিনে প্রাণ হারায় মােহাম্মদ শাহজাদা বাদশা ও নূরুল আলম। নুরুল আলম ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে এবং শাহজাদা আজিমপুরে গুলীবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মারা যায়। আহত হয় প্রায় শতাধিক। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় তিনশলােককে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অনেকের বিরুদ্ধেই ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযােগ এনে মামলা দায়ের করে জিয়াউর রহমানের সরকার।

খুলনা জেল হত্যাকাণ্ডঃ আরাে লাশ

৩২. জেলখানার সমাগ্রিক কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে জেলভেঙে কয়েদীদের পালিয়ে যাবার ছিলাে অপূর্ব সুযােগ। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে না। জেলবন্দীদের কতগুলাে মৌলিক অীধকারের প্রশ্ন, সেই অধিকারবােধ নিয়ে জেলকর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনমহলের সঙ্গে কয়েদীদের বিবাদ-বচসা এবং সর্বশেষে তার জের হিশেবে ৫০ জন বন্দীকে হত্যা, সংক্ষেপে এই ছিলাে ২১শে অক্টোরের খুলনা জেলের নির্মম ঘটনা বলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়। খুলনা জেলখানার কয়েদী ধারণ ক্ষমতা ছিলাে ২৪৫ জন, ঘটনার সময়ে সেখানে অবস্থান করছিলেন ৯১০জন জেলবন্দী ও ১০৬ জন জেলকর্মচারী। প্রতি সপ্তাহে বিচারাধীন অসংখ্য বন্দীকে নিয়মমাফিক নিয়ে যাওয়া হতাে আদালতে, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাদের বসিয়ে রাখা হতাে কোর্ট-হাজতে। বিচার বা চার্জশীট ছাড়াই সন্ধ্যার সময় আবার তাদের ফিরিয়ে হতাে জেলখানায়। বিচারের এই নিত্য নৈমিত্তিক প্রহসন বিচারাধীন বন্দীদের মানসিক ও শারীরিক চাপ সৃষ্টি করে। 

৩৩. এই অবস্থায় কয়েদীদের পেশকৃত ২৩ দফা দাবিগুলাের মধ্যে ছিলাে জেলার, ডেপুটি জেলার ও জেল-ডাক্তার সহ কতিপয় অসৎ কর্মচারীর অপসারণ, উন্নতর আহার ও চিত্তবিনােদনের ব্যবস্থা, বিচারাধীন বন্দীদের মামলা অবিলম্বে নিষ্পত্তিকরণ, তিন বছরের বেশি বিচারাধীন অবস্থায় আটকে রাখা বন্দীদের বিনাশর্তে মুক্তিপ্রদান, সামরিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের উচ্চতর আদালতের আপিলের সুযােগ প্রদান, ইত্যাদি। ২৩-দফা দাবি আদায় করাই হলাে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

৩৪. ২১শে অক্টেবর সকাল। কয়েদীদের সঙ্গে স্থানীয় আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের প্রায় ঘন্টাব্যাপী একটি সুদীর্ঘ লড়াইয়ের সূত্রপাত ঘটে, যার ফলে ১১৪ জন পুলিশ ৬ জন দমকলবাহিনী সদস্য এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের ৫জন সৈনিকও আহত হয়। 

৩৫. সরকারী প্রেসনােটে এই ঘটনাকে দুদল বিবদমান কয়েদীর মধ্যে সংঘর্ষে জের বলে অভিহিত করে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চায়। জেল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের নিরুদ্বিগ্ন অসহযােগিতা এ কথাই প্রমাণ করে দেয় যে, এর পেছনে ছিলাে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ। রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার ফলে ৫০ জন কয়েদীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা এবং প্রায় দেড়শকয়েদীকে মারাত্মকভাবে আহত করতে জিয়া শাহীর প্রচেষ্টার কোনাে ঘাটতি ছিলাে । 

ঢাকা জেল রক্তের দাগ শুকায়নি

৩৬. ১৯৭৭ সালের ২২শে জুন ঢাকা জেলের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বন্দীদের উপর অত্যাচার চালানাে হয়। ভােরবেলা জেল কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে কারারক্ষী ও পুলিশ বেপরােয়া আক্রমণ করে। ৭৫-এর চার নেতার রক্তের দাগ শুকায়নি জেল অভ্যন্তরে। আক্রমণে আবদুল মমিন তালুকদার, মাহবুব উদ্দিন, আবদুল কুদ্স মাখন, আতিকুর রহমান প্রমুখ আহত হয়েছেন। দেশব্যাপী জেলের মধ্যে এই আক্রমণের তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। ১৯ ঢাকা জেলের ঘটনা নিয়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৭৭ সনের ১ জুলাই এক জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নিকট। এর জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন ও কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশের অনুরােধ জানায়।

মুক্তিযােদ্ধার লাশ 

১৯৭৫ পূর্ববর্তী খুনের ঘটনাকে কেন্দ্রকরে একটি মামলা দায়ের হয় বাজিতপুর থানায় ১৯৭৬ সনে। ঘটনার বিবরণ অস্পষ্ট। অনেকটা বানােয়াট। ঘটনায় যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সর্বহারা পার্টির লােক। ৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসন 

জারীর পর এই ঘটনা নিয়ে মামলায় আসামী করা হয় ৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে। আসামীরা হলেন আবুলাল, শামসুদ্দিন, আবদুর রউফ, কাঞ্চন মিয়া, ও চান মিয়া। এরা মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ৭৬ সনে এই মামলার আসামী আবুলাল ও শামসুদ্দিকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৬ সালে আগষ্ট মাসে আবদুর রউফ এবং কাঞ্চন মিয়া সামরিক আদালতে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭৭ সালে ২৮শে সেপ্টেম্বর জিয়া কর্তৃক গঠিত ঢাকার দুই নম্বর সামরিক আদালত ৫ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত ৫ জনের মধ্যে চাঁদ মিয়া পলাতক ছিলাে। ৩রা জুন ৮০ দিনগত মধ্যরাতের পর বিশেষ সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ৪ জনের ফাঁসি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্পন্ন হয়। সরকারী মুখপাত্রের মতে এরা সকলেই ছিলেন মুজিব বাহিনীর সদস্য।

সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা 

৩৭. ৪ঠা জুন বুধবার সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান আবদুল

মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক চারজন মুক্তিযোেদ্ধার ফাঁসির প্রতিবাদে দেশব্যাপী তিনদিন দলীয় পর্যায়ে শোেক পালন ও ৭ জুন অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। তারা বলেন, ফাসির আগেও আমরা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করেছিলাম এবং তিনি ৪৮ ঘন্টা ফাসি স্থগিত রাখেন। ফাসির দুই ঘন্টা আগেও রাত ১২টায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা। জনাব আসাদুজ্জামান খান ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক বঙ্গভবনে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে আরেক দফা সাক্ষাৎ করেন এবং ফঁসির আদেশ মওকুফ করার জন্য তারা একটি লিখিত আবদনপত্র পেশ করেন। বাজিতপুর হত্যা মামলাকে সামরিক আইন জারি হওয়ার আগেকার ঘটনার অস্পষ্ট অভিযােগের ভিত্তিতে সাজানাে হয়েছে বলে তারা উল্লেখ করেন। জনাব মালেক উকিল স্বাধীনতাবিরােধীদের দণ্ডাজ্ঞা মওকুফ ও মুক্তিদানের কথা উল্লেখ করে বলেন, . “মুক্তিযােদ্ধাদের ফাসিদান সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যা।দেশবাসীকে রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াবার আহবান জানান। 

৩৮. ৪টি লাশ কফিনবদ্ধ করে সন্ধ্যা সােয়া ৬টায় বায়তুল মােকররমে প্রাঙ্গণে আনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও বহু লােকের উপস্থিতিতে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নামাজে জানাজা পড়ান। জানাজাশেষে ৪টি কফিন নিয়ে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলকারীরা শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবাে না‘, স্বৈরাচারীর গদিতে আগুন জ্বালাে একসাথেইত্যাদি শ্লোগান সহকারে শহরের কয়েকটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে পৌছে। সেখান থেকে লাশ বাজিতপুরে নিয়ে যাওয়া হয়।

রঙিন চশমার আড়ালে নিষ্ঠুর জিঘাংসা

৩৯. জিয়াউর রহমান আমলে দেশের জেলখানাগুলিতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিনা কারণে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার বন্দীদের আটক, তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়। দেশের প্রতিটি কারাগারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এদের গাদাগাদি করে রাখা হয়। খাবার ছিলাে অত্যন্ত নিম্নমানের। চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিলােনা তেমন। বন্দীদের অধিকাংশই ছিলাে মুক্তিযােদ্ধা। তারা চোখের সামনে দেখছে স্বাধীনতা বিরােধীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছেআর তাদের দিয়ে জেল ভর্তি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তাদের ক্ষোভ ছিলাে প্রচন্ড। ১৯৭৮ সন থেকে ১৯৮০ সনের ২২শে জুন পর্যন্ত জেলের অভ্যন্তরে ৫১টি ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ২০।

মুক্তির আদেশ ঃ পুনরায় গ্রেফতার

রঙিন চশমার অন্তরালে নির্মম নিষ্ঠুর জিঘাংসায় উন্মত্ত জিয়ার হৃদয় ছিলাে সীমারের চেয়েও কঠিন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হত্যা ও নিপীড়ণে তার বিবেককে দংশন করেন। সামরিক প্রতিপক্ষকে যেমনভাবে রক্তের বদলায় শায়েস্তা করেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিও করেছেন অনুরূপ আচরণ। অনেক নেতাকর্মী হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু জেলগেট থেকেই তাদের করা হয়েছে। পুনরায় গ্রেফতার। এর সংখ্যা একজন নয়-হাজার হাজার।

নির্মম অত্যাচার আর হিংস্রতা

৪০. রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার পর তাদের উপর চলতাে নির্মম অত্যাচার। আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর যে কিভাবে অত্যাচার হতাে তার বর্ণনা দেয়া দুঃসাধ্য। জেরা করার সময় বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন, গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে পেটানাে, শরীরের গুপ্ত স্থানে বরফ ঢুকানাে, অন্ডকোষের সঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে দেয়া, খাবার না দেয়া, পানির বদলে মগে পেশাব করে খেতে বলা, এসব অভিযােগ ছিলাে হাজার হাজার।

মাহফুজ বাবু কোথায় ঃ অন্ততঃ লাশটা দাও 

৪১. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য জিয়াউর রহমান ব্যবহার করেছেন

গােয়েন্দা বাহিনীকে। এরা সাদা পােশাকে ঘুরে বেড়াতাে। বিভিন্ন গাড়ী ব্যবহার করতাে। যখনই নির্দেশ আসতাে তখনই তারা তৎপর হয়েছে। এসব সাদা পােশাকধারী বাহিনীর সদস্যগণ যাকে গ্রেফতার করেছে তাদের অত্যাচারে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাদের লাশ গুম করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের বলিষ্ঠ নেতা মাহফুজ বাবুকে ৭০ সনে পুরনাে ঢাকা হতে দিনের বেলা প্রকাশ্যে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সাদা পােশাকধারীরা। মাহফুজ বাবু আজো ফিরে আসেনি। তার মা কাদতে কাদতে অন্ধ হয়ে গেছেন। তার কাছে যেই দেখা করতে যেতে তার মায়ের প্রশ্ন ছিলাে আমার মাহফুজ বাবু কোথায়? হয় তাকে এনে দাও-না হলে অন্ততঃ তার লাশটা দাও। মাহফুজ বাবু-র এই নির্মম অদৃশ্যতা’-একটি নয়। একাধিক। হাজার হাজার। এই ছিলাে জেনারেল জিয়ার গণতান্ত্রিক (1) বাংলাদেশের চিত্র।


মুক্তিযুদ্ধের হৃদপিন্ডে ছুরি

১. বাংলাদেশ সংবিধান হঠাৎ করে রচিত হয়নি। পাকিস্তানী শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে সমগ্র বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে সংগ্রাম করেছে। লড়াই করেছে। সেই সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মধ্য হতে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানী বা মুসলিম জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, সামরিক স্বৈরাচারের বিপরীতে গণতন্ত্র, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং শোষণ মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র তথা শােষণমুক্ত সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সমগ্র বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। এই সকল মহান লক্ষ্য ও আদর্শকে সামনে রেখেই বাঙালী জাতি সগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করেছে, লক্ষ লক্ষ বাঙালী শহীদ হয়েছেন এবং দেশ স্বাধীন করেছে।

২. দেশ স্বাধীন হবার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ও নেতৃত্বে বাঙালী জাতির এই আকাঙক্ষা ও জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি রূপে১৯৭২ সনের ৪ঠা নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। এই সংবিধান স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধে মূল্যবােধের উপর ভিত্তি করে রচিত।

৩. ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সামরিক ফরমানে সংবিধানের মৌলিক আদর্শগত পরিবর্তন আনা হয়। মূলতঃ স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধকে হত্যা করা হয়। 

৪. বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস ও লক্ষ লক্ষ শহীদদের আত্মত্যাগের কাঙ্খিত দলিল। জিয়াউর রহমান স্বীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনার উপর ভিত্তি করে রচিত শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধর হৃৎপিন্ডে ছুরি চালিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরে বন্দী করে, ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটক করে

জনমতকে বুটের তলায় চেপে ধরে জনগণের অভিপ্রায়কে সঙ্গীণে বিদ্ধ করে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানী আদর্শে ফিরিয়ে নেন। 

(ক) সংবিধানের প্রস্তাবনার শীর্ষে (পরম দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে)এই কথাগুলাে যুক্ত করেন। 

(খ) প্রস্তাবনার অংশে যেখানে উল্লেখিত ছিল জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে”- সেই স্থানে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়। বাঙালী জাতি শুধুমাত্র নয় মাসে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেনি। হাজার বছরের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ছিলাে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালী জাতির সেই হাজার বছরের সংগ্রাম, অগণিত মানুষের আত্মদান ও রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াউর রহমান শুধু মাত্র বাঙালীর জাতির সংগ্রামকে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত করে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসকে যেমন নাকচ করেছেন, তেমনি লাখাে শহীদদের প্রতি করেছেন অবমাননা। গ.সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ যেখানে লেখা ছিল বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেনস্থলে বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেনযােগ করা হলাে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ভাষা,

সাহিত্য, সংস্কৃতি কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বন্ধনকে ছিন্ন করা হলাে। 

(ঘ) সামরিক ফরমানে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় মুছে ফেলা হলাে। ৯ম অনুচ্ছেদ যেখানে বলা হয়েছিল ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।এই নবম অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হলাে স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমুহের উন্নয়ন”। কোথায় জাতি স্বত্ত্বা আর আত্মপরিচয়ের বিশাল গৌরবমন্ডিত ঐতিহাসিক ভিত্তি আর কোথায় স্থানীয় শাসনের কথা,-ভাবতে অবাক ও বিস্মিত হতে হয়! ঙ.সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হলাে। যে ১২ অনুচ্ছেদ ছিলাে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের অন্যতম মূলভিত্তি। পাকিস্তান আমলে সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ও শােষক গােষ্ঠী পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করেছে। সমাজ প্রগতির ধারাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। সম্প্রদায়গত হানাহানি লাগিয়ে, দাঙ্গা বাধিয়ে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, খুন ধর্ষণ হত্যা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে মানবিকতাকে করেছে 

ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করতে না পারে সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য 

ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,

খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,

গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে অপব্যবহার,

ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ণ বিলােপ করা হইবে”-এই অনুচ্ছেদ রহিত করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের হীন স্বার্থে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদের তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা ৷ লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা। লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্ম ভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করিবার কোন অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবেনা।অর্থাৎ ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অপপ্রয়াসে পবিত্র ধর্মকে হীনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না। জিয়াউর রহমান এই অনুচ্ছেদ শর্তটুকু বিলুপ্ত করেছেন। একই সাথে স্বাধীনতা বিরােধী সাম্প্রদায়িক দল জামাত ইসলাম, শিবির, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে রাজনীতি করার সুযােগ করে দেন, মওলানা রহিম, শাহ আজিজ, সবুর খান, আলিম, মতিন, শামসুল হুদা, মওলানা মান্নান স্বাধীনতা বিরােধী। ব্যক্তিদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে। সংবিধানে শুধুমাত্র ১২নং অনুচ্ছেদে সংযােজন করেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও সাধারণ ক্ষমার আওতায় অনেকেই জেল হতে বেরিয়ে এসেছিলাে, তবুও তাদের রাজনীতি করার অধিকার ছিলাে না। সংবিধানের ৬৬নং লিপিবদ্ধ হয়েছিলাে-সংসদে নির্বাচিত হবার যােগ্যতা ও অযােগ্যতা সম্পর্কে। উক্ত অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছিলাে কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যােগ্য হইবেন না, যদি (গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী

রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা বা স্বীকার করেন

(ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশে যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল)

আদেশের অধীনে যে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত হইয়া থাকেন; একই সাথে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদে ভােটার তালিকায় নামভুক্তির

যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল

৫. তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল)

আদেশের অধীনে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত না হইয়া থাকে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ভােটার তালিকা আদেশ (পি. ও নং ১০৪) এবং বাংলাদেশ যোগসাজশকারী আদেশকে (পি ও নং ৮) চতুর্থ তফসিলে সাংবিধানিকভাবে প্রটেকশন দেয়া হয়েছিলাে।

৬. মূলতঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তি ও দালালদের সর্বস্তরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এক সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মােহম্মদ সায়েম একাধারে গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতি এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান নানাবিধ কৌশলে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।

৭. জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলেন তার বহু কাঙিক্ষত। প্রেসিডেন্ট পদটি করায়ত্ত করতে তিনি আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ও দলগুলাের নিকট হতে তেমন সহায়তা পাবেন না। সেজন্য তাকে বিকল্প শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। এবং তাদের নিয়েই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে এগিয়ে যেতে হবে। 

৮. স্বাধীনতা বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীলদের সংখ্যাশক্তি যাচাই করার লক্ষ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমান তদানীন্তন এয়ার ভাইস মার্শাল এম, জি, তাওয়াবকে সক্রিয় করে। তােলেন। এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব স্বাধীনতা বিরােধী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং দক্ষিণপন্থী দল ও গ্রুপগুলােকে একত্রিত করে একটি শক্তি মহড়ার ব্যবস্থা করেন সিরাতুন্নবী দিবসকে সামনে রেখে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সপ্তাহব্যাপী সিরাত মজলিশে এয়ার ভাইস মার্শালের বক্তৃতা দেবার সময় শ্লোগান ওঠে তাওয়াব ভাই তাওয়াব ভাই, চঁাদ তারা মার্কা পতাকা চাই।জামাত, মুসলিম লীগ ও দক্ষিণপন্থী দলগুলাে এই সিরাত মজলিশে তাদের শক্তি সংখ্যা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়।সমাজ বিপ্লবের ধারক বলে দাবীদার এবং ৭ই নভেম্বর ঢাকার সেনা ছাউনির বন্দীদশা হতে উদ্ধারকারী কর্ণেল (অবঃ) তাহের এবং জাসদ নেতৃবৃন্দকে পাওয়ার কনটেষ্টে’-এ মাঠ থেকে বের করে দেবার এবং তাদের আচ্ছামত শাস্তি বিধানের নিমিত্তে জিয়া এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবকে দিয়ে ডানদের দ্বারা বামদেরঠেকানাের কৌশল গ্রহণ করেন। কর্ণেল তাহেরকে ফাসি ও জাসদ নেতৃবৃন্দকে কারান্তরালে পাঠানাের প্রেক্ষাপটে তিনি কিছুদিনের মধ্যে তাওয়াবকেও দেশ থেকে বের করে দেন স্বাধীনতা বিরােধীদের স্বীয় কবজায় আনার লক্ষ্যে। 

৯. এতসব খেলায় ধুরন্ধররাজনীতিবীদগণের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, ক্ষমতার রশি আসলে প্রেসিডেন্ট সায়েমের হাতে নেই-ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে দাড়িয়ে আছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ক্ষমতার লাটাই তার হাতেই। সেজন্য সুবিধাবদী রাজনীতিবিদ যারা স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দালাল নামে। আখ্যায়িত হয়ে কারাগারে ছিলেন এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বঙ্গভবনের দিকে আগ্রহ প্রত্যাহার করে সেনাছাউনির দিকে ছুটতে থাকেন। বঙ্গভবনে বসে বিচারপতি সায়েম যিনি যথার্থভাবেই মনে করেছিলেন সামনের শীতে (৭৭ সনে) দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন যেহেতু জাতির নিকট এ বিষয়ে তিনি ওয়াদাবদ্ধ; তিনি অচিরেই দেখতে পেলেন যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ সেনাছাউনিতে দৌড়াচ্ছেন।প্রধান সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন একথা সম্ভবতঃ বিচারপতি সায়েম দৃষ্টিগ্রাহ্য হলেও তার কিছু করার ছিলাে না। তিনি ছিলেন কেবলমাত্র ঘটনার সাক্ষী, জ্যান্ত  পুতুল মাত্র। 

১০. বিচারপতি সায়েমের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তাকে সামনে রেখেই জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সনের মে মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ৪২ জাতি ইসলামিক কনফারেন্সে যােগদান করেন। তুরস্কে গিয়ে তিনি রাজনীতি করার যে অাকাঙ্খা এবং ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করার যে অদম্য অথচ সুপ্ত বাসনা দীর্ঘদিন লালন করে আসছিলেন তার বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে তাকে বাংলাদেশকে ইসলামীকরণেরপরামর্শ দেন এবং এ ব্যাপারে যাবতীয় সাহায্য সহযােগিতা করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের সমর্থন তার পক্ষে আদায় করে দেবার বিষয়ে তাকে আশ্বস্ত করা হয়। ঐ একই সময়ে তিনি বালাদেশ মুসলিম লীগের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পাকিস্তান গমন করেন, বাণিজ্যক চুক্তি করেন এবং এ বিষয়ে পাকিস্তান থেকে তাকে সমর্থন দানের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এই লক্ষ্যে তিনি সামরিক ফরমান বলে দালাল আইন বাতিল করেন।

কোলাবােরেটর্স আদেশ বাতিল

১১. জেনারেল জিয়ার অব্যাহত চাপে এবং জাতীয় ঐক্যেরযুক্তিতে পরাস্ত প্রেসিডেন্ট

বিচারপতি জনাব সায়েম এক অর্ডিন্যান্স জারী করে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) আদেশটি (১৯৭২ সালের ৮ সম্বর প্রেসিডেন্ট আদেশ) বাতিল করে দেন। বাসস পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ, ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স। (বিশেষ ট্রাইবুন্যাল) (বাতিল) অর্ডিন্যান্স নামে অভিহিত এই অর্ডিন্যান্সেটিতে বলা হয়েছে যে, উক্ত আদেশটি বাতিল হওয়ায় কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট বা আদালত সমীপে এই আদেশ বাতিলের অব্যাবহিত পূর্বে মুলতবী থাকা সমস্ত বিচারকার্য বা অন্যান্য মামলা এবং উক্ত আদেশ বলে কোন পুলিশ অফিসার বা অপর কোন কর্তৃপক্ষ দ্বারা বা সমীপে পরিচালিত সমস্ত তদন্ত কার্য বা অন্যান্য মামলা বাতিল হয়ে যাবে এবং সেগুলি আর চালানাে হবে না। এতে উক্ত আদেশ বলে কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে দায়েকৃত কোন আপীল ব্যাহত হবে না বলে। অর্ডিন্যান্সটিতে উল্লেখ করা হয়। অর্ডিন্যান্সটিতে আরও বলা হয় আদেশটি বাতিল হওয়ায় মুলতবী থাকা বিচার, তদন্ত ও অন্যান্য মামলা রদ হওয়া ছাড়া ১৮৯০ সালের সাধারণ উপধারা আইন

“(১৮৯৭ সালের দশম আইন) এ ৬ নম্বর ধারার প্রয়ােগও ব্যাহত হবে না।” 

১২. জিয়াউর রহমানের নিজস্ব পর্যালােচনায় এ বিষয়টিও বেরিয়ে এসেছিলাে যে, শুধুমাত্র জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন নিলে তার মুখে শুধু কলংক লেপনই হবে মুক্তিযােদ্ধার বাহিরাবরণ যা তিনি ধারণ করে আসল চেহারা আড়ল করে রেখেছেন তাও খসে পড়বে। এতে জনগণ এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে দেখা দেবে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। সেজন্য তার প্রয়ােজন ছিলাে চীনপন্থীদের সমর্থন আদায়।। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনপন্থীরা ছিলাে কোণঠাসা, রাষ্ট্রক্ষমতা হতে বহু দূরে। অন্তর্কলহে ছিন্নভিন্ন চীনপন্থীদের সংগঠিত করার বয়স ও ক্ষমতা মাওলানা ভাসানীর ছিলাে না। চীনপন্থীদের এক বিরাট অংশ স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলাে কেননা চীন বালাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে দুই কুকুরের কামড়াকামড়িহিসেবে গণ্য করেছিলাে। স্বাধীনতার পর এদেশীয় চীন অনুসৃত রাজনীতিবিদদের অবস্থান সুখপ্রদ ছিলাে না, সাংগঠনিক বা রাজনীতি ক্ষেত্রে। জিয়াউর রহমান জামাত-মুসলিম লীগের সমর্থন আদর করার পর বিপ্লবী চীনা নেতাদের দিকে হাত বাড়ালেন। এই লক্ষ্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭

সনে জানুয়ারীতে চীন সফর করেন। এভাবে জিয়াউর রহমান উগ্র ডান এবং উগ্র বামদের এক মেরুতে দাঁড় করাতে জাতীয় ঐক্যেরশ্লোগান দিতে ভুল করেন নি। পরিস্থিতির উর্বর সময়ে ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ সনে সামরিক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট পদটি বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে কেড়ে নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি-যদিও ইতিপূর্বে ১৯৭৬ সনের ২৯শে নভেম্বর তিনি সামরিক প্রশাসকের পদটি দখল করতে ভুল করেন নি। 

১৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ বিশেষ করে সৌদি আরব, তুরস্ক, জর্দান, সুদান, সংযুক্ত আমির আমিরাত দেশগুলাের পক্ষ হতে পূর্ণ সাহায্য ও সহযােগিতা প্রাপ্তির লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান সংবিধান হতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধানাবলী ১২ অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে পাকিস্তানী ধারার শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে দাঁড় করালেন এবং একই সাথে ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অধিকার সম্বলিত ফরমান জারী করলেন এবং সংবিধানের ৩৮নং ধারার শর্তসমূহ বাতিল করলেন। 

১৪. ১৯৭৬ সনের ২৮ শে জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি নিয়ন্ত্রণ (পি,পি,আর) জারী করেন। অনুমােদনপ্রাপ্ত ২২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ধর্মীয় দলগুলাের ৬টিকে নিয়ে গঠিত আই ডি এল কে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। বাংলাদেশে পুনরায় ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার দরজা খুলে দেয়া হয়। অনুমতি প্রদান করলে এই দলগুলাে একযােগে ১৯৭৭ সনের ৩০শে মে অনুষ্ঠিত হাঁ না ভােটে জিয়াউর রহমানকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রকাশ্য সমর্থন দান করেন। শুরু হয় জামাত-মুসলিম লীগ, ঘাতক দালালদের ব্যাপক পুনর্বাসন রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। শুধুমাত্র ক্ষমতায় থাকার অভিলাষে ক্ষমতার দাপটে সামরিক শাসনের আওতায় জনগণকে বুটের তলায় রেখে স্বাধীনতা বিরােধীদের ক্ষমতায় অংশীদারিত্বে আনার ক্ষেত্র মুক্তিযােদ্ধাপ্রস্তুতে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখিত হবেন সন্দেহ নেই। 

১৫. জিয়াউর রহমান মুক্তিযােদ্ধাদের পােশাকে মন্ত্রী সভায় স্বাধীনতা বিরােধীদের নেতৃস্থানীয় শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মীর্জা গােলাম হাফিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, শফিউল আযম এবং আবদুল আলীমের মতাে ব্যক্তিবর্গকে নিতে সাহসী হয়েছিলেন। এমন কি স্বাধীনতার সরাসরি বিরােধকিারী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন।

১৬. বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক যে সমস্ত স্বাধীনতা বিরােধী নেতৃবৃন্দের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিলাে জিয়া স্বাধীনতা বিরােধী সেই সকল ব্যক্তিদের নাগরিত্ব ফিরিয়ে

দেবার জন্য ১৯৭৮ সনের ১১ই ফেব্রুয়ারী নাগরিকত্ব আইনের সংশােধনী আনয়ন করেন। স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনৈতিকভাবে, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১৮ই জানুয়ারী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক প্রেসনােটের প্রেক্ষিতে অধ্যাপক গােলাম আজমও তার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আবেদন জানালে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী ঘৃণ্য কার্যক্রমে অধ্যাপক গােলাম আজমের স্থূপীকৃত ফাইলের হাত দিতে সাহসী হন নি। ১৯৭৮ সনে ১১ জুলাই অসুস্থ মাতাকে দেখার জন্য পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানের পাসপাের্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে গােলাম আজম বাংলাদেশে আসেন এবং বালাদেশে এখন পর্যন্ত অবস্থান করছেন। 

১৭. এমনিভাবে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসন করেন। স্বীয় ক্ষমতাকে স্থায়ী করার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের দলিল শাসনতান্ত্রিক বিধানকে হেঁটে ফেলেন। জিয়াউর রহমানকে এ কাজটি করতে হয়েছিলাে তার পাওয়ার বেজঠিক রাখার স্বার্থে। কেননা, সামরিক বাহিনীর প্রায় পুরােটাই ছিলাে পাকিস্তানী মানসিকতায় আচ্ছন্ন। চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদে তাদের বসিয়ে জিয়াউর রহমান ভেবেছিলেন তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী কাঠামােয় দাড়িয়ে গেছে। সেজন্য মুক্তিযােদ্ধার মুখােশেজিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিন্ডে শাণিত ছুরি বসিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠিত হননি।


উৎপাদনের রাজনীতি

১. প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশে উৎপাদনের রাজনীতির কথা একনাগাড়ে বলেছেন। কিন্তু উৎপাদনের রাজনীতির বদৌলতে দিন দিন দেশ বিদেষী ঋণে ডুবে গেচ্ছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বলে চলেছেন দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। উৎপাদনের রাজনীতির উৎপাদনকতদূর হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত হিসেব করা যেতে পারে। 

২. খাদ্যশস্য ও আউশ, আমন বােরাে ফসলের উৎপাদন ১৯৭৫-৭৬ সনে ছিলাে ১ কোটি ৩১ লক্ষ টন। ১৯৭৬-৭৭ সনে ঐ উৎপাদন হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ১৬ লক্ষ টন। ১৯৭৭-৭৮ সনে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২৮ লক্ষ টন। ১৯৭৮-৭৯ সালে উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ১ কোটি টনের নীচে চলে যায়। ৭৫ সন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৫ ভাগ। ৭৫-৮১ সনে এসে তা দাঁড়ায় ১.৭। এভাবে মাছ, ডাল, মাংসের প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাট : ১৯৭৫ সনে ৭০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সনে উৎপাদিত হয়েছে ৫৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫৪৯ বেল।

৩. শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাটশিল্পে উৎপাদনের হ্রাসের পরিমাণ ১০২% ভাগ, কাগজ শিল্পে ২.৫% ভাগ, চিনি শিল্পে ৩.৩% ভাগ এবং বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে ৫৫টি মিলের মধ্যে অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১৪টি বস্ত্র। মিলে উৎপাদনই হচ্ছে না।

আয় কমেছে ও দারিদ্র্য বেড়েছে

৪. রাজধানী ঢাকার গুলশান বনানীর বাড়িঘর, বহতল ভবন, রাস্তাঘাট, মােটরগাড়ী,

রঙিন টিভি, ভিসিআর, অভিজাত বিপনী বিতান- এসব দেখলে মনে হয় দেশের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ৬৯-৭০ সনে মাথাপিছু আয় ছিলাে ৭৭০ টাকা। ৭৮-৭৯ সনে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৭২১ টাকায়। বিশ্ব ব্যাংকের রিপাের্ট অনুসারে ৭৩-৭৪ সনে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৩ কোটি লােক অর্থাৎ ৪৪% শত লােক দারিদ্র সীমার নীচে জীবনযাপন করতাে। ৮১-৮২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি অর্থাৎ ৬৬ শতাংশে।২য় বিশ্ব রেকর্ড নেই 

৫. উৎপাদনের রাজনীতির প্রবক্তাজিয়াউর রহমান দ্বিতীয় পাঁচমালা পরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩% শতাংশ ধরে খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করে রফতানীর বাণী শুনিয়েছেন। খসড়া উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ বছরে ২ কোটি টন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌছতে বছরে ৮% ভাগ খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু এদেশে গত বিশ বছরে খাদ্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ১.৯ ভাগ মাত্র। ৫ বছর ক্রমাগত ভাবে ৮% হারে উৎপাদন বৃদ্ধির রেকর্ড বিশ্বে নেই।

দেশ বিক্রী করে হলেও খাদ্য শস্য আনা হবে

৬. প্রেসিডেন্টের ঘােষিত উৎপাদনের রাজনীতির মহাত্ম্যে ভর্তুকি তুলে দেয়া হয়েছে।

সার, কীটনাশক, তেল, মবিল, পাওয়ার পাম্পের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। দেশে দুর্ভিক্ষ চলছে। দেশের হাজার হাজার লােক বেকার হয়ে আছে। কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকে না খেয়েও দিন কাটাচ্ছে। ছিন্নমূল মানুষ আর ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়ছে। ছিন্নমূল মানুষের যা কিছু নগণ্য সম্পত্তি জলের দামে দিচ্ছে। দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের রিপাের্টে বলা হয়েছে দেশের মানুষ গরু-ছাগল, জায়গা-জমি, থালা-বাটি বিক্রি শুরু করেছে। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল ও ঠাকুরগাঁও-চুয়াডাঙ্গার দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে।। উপরন্তু ঐ অঞ্চলে মার্কেটিং অপারেশন বন্ধ থাকায় সমস্যা আরও তীব্র। পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা এবং সহজ ও দীর্ঘমেয়াদী কৃষিঋণের কোনাে ব্যবস্থা নেই। এই হচ্ছে দেশের বর্তমান অবস্থা। যে দিকে চোখ যায় শুধু অভাব আর অভাব। ভূমিহীনের সংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে।

খাদ্য ঘাটতি বেড়েছে

আমাদের দেশে বার্ষিক খাদ্য চাহিদার পরিমাণ হচ্ছে ১ কোট ৬৮ লাখ টন। এ বছরের প্রথম দিকে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিলাে ১৩ লাখ টন। কিন্তু সেই পরিমাণ এখন বৃদ্ধি পেয়ে ২২ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এ হিসেব সরকারের। বাস্তবে এই ঘাটতির পরিমাণ আরও বেশি। অনুকূল আবহাওয়ায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭৫ সনে ও ৭৬ সনে দুবছর ভালাে ফল পাওয়া গেছে। যার ফলে ধান-চালের। বাজারে স্থিতিশীলতা ছিলাে।

সার, ডিজেল ও কীটনাশকের দাম বেড়েছে

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সরকার যখন সার ও কীটনাশকের দর বৃদ্ধি করেন। বিরােধীদলের নেতৃবৃন্দ সরকারী এই নীতির তীব্র সমালােচনা করে বলেছিলেন, এ সিদ্ধান্তের ফলে কৃষি উৎপাদন দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রতিটি জনসভায় সার ও কীটনাশক ওষুধের দাম বাড়ানাের তীব্র সমালােচনা করেছে। কিন্তু শত সমালােচনা সত্ত্বেও সরকার তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেনি। চলতি অর্থ বছরে কৃষি উৎপাদন প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিলাে ১৯৭৭ সালের তুলনায় ৪.৩ ভাগ বেশি। কিন্তু সে লক্ষ্যমাত্রার ১.৩ ভাগ মাত্র অর্জিত

সরকার এই ব্যর্থতার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই দায়ী করছেন। কিন্তু এই ব্যর্থতার জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই দায়ী নয়। খরায় কোনাে কোনাে অঞ্চলের ফসল নষ্ট হয়েছে সত্য কিন্তু সময়মতাে সেচ সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যর্থতা সরকারকেই নিতে হবে। তেল, ডিজেল দুষ্প্রাপ্য এবং অগ্নিমূল্য হওয়ায় ১০ হাজার পাওয়ার পাম্প অচল। ইরি ব্লকে ইরি চাষ হয়নি। সার এবং কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি করায় কৃষকের পক্ষে তার ক্ষেতের ফসল পারুল পােকা, মাজরা পােকার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কৃষি উৎপাদনের গতিবেগ সঞ্চারের জন্যে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভরাট নদী-খাল খনন করে একদিকে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষার দীর্ঘমেয়দী পরিকল্পনা গ্রহণ করতেও সরকার শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বেচ্ছাশ্রম ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় দুএকটি নদীখাল পুনঃখনন, উলশীযদুনাথপুরে স্বনির্ভর প্রকল্পের বিস্তর প্রােপাগাণ্ডা করা হয়েছে। কিন্তু খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। সাফল্যের চেয়ে বহুগুণ অর্থ খরচ হয়েছে প্রচারে বর্তমান রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমানের আমলে। ১৯৭৯ সালে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি মারাত্মক। প্রতিটি পত্র-পত্রিকায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করছে। সেচের জমি কমেছে

৭. দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। প্রতিটি জিনিসের দাম ৭৪ এর দুর্ভিক্ষাবস্থার চেয়েও অনেকগুণ বেশী। খাদ্যশস্যের দামও বেড়েছে। দাম কমার আশু সম্ভাবনা অকল্পনীয়। প্রধান কারণ খাদ্যঘাটতি। বেসরকারী হিসেবে ঘাটতি ৩২ লাখ টন। ১৯৭৪-৭৫ সালে যে পরিমাণ জমিতে সেচ করা হতাে তার। পরিমাণ কমেছে। সারা বাংলাদেশে পাওয়ার পাম্প এবং নলকূপের সাহায্যে সেচ করা হতাে এরূপ জমির পরিমাণ ছিল ৩৫,৬১৪ ৭২ একর। ১৯৭৬-৭৭ সালে তা আরও কমে গিয়ে হয় ৩০,০৩,০২০ একর। ৬ জিয়ারউর রহমানের শাসনে তিন। বছরে সেচের জমির পরিমাণ কমেছে ৫ লাখ একরের বেশি। উন্নতমানের বীজ ব্যবহার কমেছে, কেননা সেচের ব্যবস্থা নেই।

উৎপাদন বাড়েনি চাহিদা বেড়েছে 

৮. চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ বৃদ্ধি না পাবার প্রধান কারণ হচ্ছে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়েনি। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের উৎপাদন এবং সরবরাহ মানুষের চাহিদা এবং প্রয়ােজনের সঙ্গে অগ্রসরমান সামঞ্জস্যতা ৭৫ পরবর্তীতে আরাে হ্রাস পেয়েছে। জিয়ার আমলে মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, ভালাে শাকসজি, মসলা ও ফলমূলের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। সাথে সাথে হ্রাস পেয়েছে এসব জিনিসের মাথাপিছু প্রাপ্যতা। জনসংখ্যা বেড়েছে, উৎপাদন সেই তুলনায় বাড়েনি বরং কমেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৭২-৭৩ সালের তুলনায়, এমন কি খাদ্য সংকটের বছরের তুলনায়ও বহু জিনিসের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। টাকার অংকে ৭২-৭৩ সালে মাছ ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮৬.৯০ ও ২২৩ কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে ৭৭-৭৮ সালে মাছ ও মাংসের উৎপাদনের পরিমাণ মাত্র ২৮৭.৯০ ও ২৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে কম করে হলেও ১ কোটি। মরিচ, রসুন, পেয়াজ ইত্যাদ জাতীয় মশলার উৎপাদন ৭২-৭৩ সালে ছিলাে ৩,২২,০০০ টন। ৭৬-৭৮ সালে এর উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ২,০৫,০০০ টন এসে দাঁড়ায়। শাকসজির ইত্যাদি জিনিসের উৎপাদন ৭৪-৭৫ সালের তুলনায় বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে।

৯. উৎপাদন হ্রাসের পাশাপাশি সরকারের ঘাটতি অর্থব্যবস্থা (ডেফিসিট ফাইনেনসিৎ) মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। দেশে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাগুজে নােটে বাজার ছেয়ে গেছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে বাজারে মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ ছিলাে ৮৫৯ কোটি টাকা। ১৯৭৮-৭৯ সালে এর পরিমাণ ১৫১০ কোটি টাকারও বেশী। গােটা অর্থনীতি এখন এক ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি জনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত। বাজারের ওপরে সরকারের আদৌ কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই।

কাফনের কাপড়ের জন্য কগজ কাপড় দরকার 

১০. ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ সরকারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্টারপ্রাইজেস

(ন্যাশনালাইজেশন) অর্ডার, ১৯৭২ (প্রেসিডেন্টের ২৭নং আদেশ) অনুযায়ী দেশের মৌলিক ও প্রধান শিল্পের সঙ্গে বস্ত্রশিল্পও জাতীয়করণ করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাের সুষ্ঠু পরিচালনার দায়িত্ব টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়। উৎপাদন ত্বরান্বিত এবং দেশে বস্ত্রশিল্পের সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে জিয়ার আমলে ৭৭ সাল শােচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় সরকার মাধাপিছু ১০ গজ বস্ত্র উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বিটিএমসি (বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন) মাথাপিছু ৬ গজ কাপড় উৎপাদনও নিশ্চিত করতে পারেনি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ‘৭২-৭৩ সালে বি.টিএম.সির কাপড় উৎপাদনের পরিমাণ ছিলাে ৬৬১.৮৫ লাখ গজ। ৭৩-৭৪ সালে ৬৬৬.৬০ লাখ গজ; ‘৭৪-৭৫ সালে ৬০১.৮৭ লাখ গজ; ‘৭৭-৭৮ সালে। উৎপাদনের পরিমাণ ৬১৭.৪৬ লাখ গজ। বস্ত্র উৎপাদনের এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ‘৭৭-৭৮ অর্থ বছরে বি,টি,এম,সির বস্ত্র উৎপাদন স্বাধীনতা উত্তরকালের অর্থাৎ ৭২-৭৩ অর্থবছরের তুলনায়ও হ্রাস পেয়েছে। সুতাে উৎপাদনের ক্ষেত্রেও বি,টি,এম,সি তেমন কোনাে সাফল্য দেখাতে পারেনি। উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জনে বস্ত্রশিল্প ৬৯-৭০ সালের উৎপাদন মাত্রার তুলনায় অগ্রগতির চেয়ে নিম্নগামী হচ্ছে। টাকু প্রতি উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি শিফটে টাকুপ্রতি ৩ আউন্স সুতাে উৎপাদনের ক্ষমতা বিদ্যমান। ১৯৬৮-৭০ সালে টাকু প্রতি উৎপাদন ছিলাে প্রতি শিফটে ২.৮৩ আউন্স। ১৯৭৭-৭৮ সালে উৎপাদন হ্রাস পেয়ে ২.৩৮ আউন্সে এসে দাঁড়ায়। ৭৬-৭৭ সালে ২.৪২ আউন্স। ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় টাকু প্রতি সুতা উৎপাদন হ্রাস পেয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন ব্যর্থতা এর ওপর নির্ভরশীল। দেশের তাঁত শিল্পও মারাত্মক দুর্যোগের মুখােমুখি।

শিল্প কল-কারখানার চাকা সামনের দিকে ঘুরছেনা ওর

জানা গেছে, বিদ্যুৎ স্বল্পতা, ম্যানেজমেন্টের অভাব, প্রয়ােজনীয় মেশিনারী পার্টসের দুষ্প্রাপ্যতা, আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব ইত্যাদি কারণে অচল টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি

পেয়েছে। ৬৯-৭০ সালে দেশে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকুর মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার। টাকু সচল ছিলাে। অচল টাকুর সংখ্যা ছিলাে শতকরা ১৩ ভাগ। ১৯৭৭-৭৮ সালে। ৯ লাখ ৭৭ হাজার টাকুর মধ্যে ৭ লাখ ৯৯ হাজার সচল অর্থাৎ ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকু অচল ছিলাে। ৭৮-৭৮ সালে অচল টাকুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় শতকরা ১৮.২ ভাগে। এই হিসেব ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরের। ৭৮-৭৯ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকুর মধ্যে ৮ লাখ ১২ হাজার টাকু সচল রয়েছে। ৭৮৭৯ সালে অচল টাকুর সংখ্যা হিসেবে দাঁড়াবে শতকরা ১৭ ভাগ। উল্লেখিত হিসেবে এটা স্পষ্ট যে, শিল্প কলখারখানায় চাকা সামনের দিকে ঘুরছেনা। ঘুরছে পেছন দিকে।

পরিকল্পনা মন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশার সুর

১১. জিয়াউর রহমান বলছেন উৎপাদন বেড়েছে। মানুষ সুখে আছে। আর পরিকল্পনা

মন্ত্রীর কণ্ঠে হতাশার সুর। ২য় পাঁচশালা পরিকল্পনার খসড়া মােট ২৫,৫৯৫ কোটি টাকার। পরিকল্পনার খসড়া বইটির ওজন দুই সের। এই খসড়া পরিকল্পনার উপর সাংবাদিক সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী ফসিউদ্দিন মাহতাব মন্তব্য করেছেন, ‘বর্তমান। যেভাবে চলছে তাতে সার্বিক অবস্থা শিগগিরই আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে।তিনি বলেন, বর্তমানে লােকসংখ্যা নকোটি। এর শতকরা ৮০ ভাগ লােক দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাস করে। তারা ভাল করে দুবেলা খেতে পারেনা। শতকরা ৬০ ভাগ অপুষ্টিতে ভােগে। ২ কোটি ৮০ লাখ লােক শ্রমজীবী, তাদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগের কোন কাজ নেই। কৃষিজীবী মানুষের শস্থকরা ৫০ ভাগেরও বেশী। ভূমিহীন। বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুসারে দেশের লােক সংখ্যা শতাব্দীর শেষে ১৩ কোটিতে দাঁড়াবে। শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা হবে ৪ কোটি ৬০ লাখ হয় 

সাংবাদিক মার্শাল-এর রিপাের্ট

১২. বালাদেশ প্রেরিত বৈদিশিক ঋণ ও সাহায্যের একটি বড় অংশই দুর্নীতির রন্ধ্রপথে হারিয়ে যায়।একথা লিখেছেন লস এঞ্জেলস টাইমস। বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সফর করে এই প্রতিবেদনটি লিখেছেন পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক টেইলর মার্শাল। বাংলাদেশে কর্মরত কয়েকজন আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা ও অন্যদের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে টেইলর মার্শাল লিখেছেনযাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন সেই ভূমিহীন দরিদ্র পল্লীবাসীর হাতে বৈদেশিক ঋণ সাহায্যের শুধু অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ গিয়ে পৌছে। সাহায্যের অধিকাংশই সর্বত্র বিরাজমান দুর্নীতির মাধ্যমে শুষে নেয়া হয় এবং এর অধিকাংশই যায় সচ্ছল ব্যক্তিদের পকেটে। এভাবে দরিদ্র এবং সংখ্যালঘু ধনীদের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়তে থাকে। সাহায্যের প্রয়ােজনীয়তার ব্যাপারে সেখানে কেউ প্রশ্ন তােলেনা। সমস্যা হচ্ছে, যাদের সবচাইতে বেশী প্রয়ােজন তাদের কাছে সাহায্য ও ঋণ পৌছে না। খাদ্যবাবদ বরাদ্দের মাত্র এটি ভগ্নাংশ বিতরণের জন্য পাঠিয়ে বাকি অংশ স্থানীয় কর্মকর্তারা বিক্রি করে দেয় বলে অন্তহীন কাহিনী শােনা যায়। টেইলর মার্শাল আরও লিখেছেন ঘুষদানের প্রয়ােজনীয়তার কারণে প্রকল্প সাহায্যের অর্থের পরিমাণ প্রায়ই সংকুচিত। বিশেষ করে প্রকল্পের সাথে নির্মাণ কাজ জড়িত থাকলে দুর্নীতি হবেই। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলাে বিরল ক্ষেত্রে ঘুষের সাথে প্রত্যক্ষভাবে। জড়িত থাকে। তবু ঠিকাদাররা মূল্যোকৃতির সময় ঘুষের অংক ও হিসেব করে নেয় এবং ফলে প্রকারান্তরে ঘুষের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের অর্থই ব্যবহার করা হয়। একটি নির্মাণ প্রকল্প মূল্যায়নের দায়িত্বে নিয়ােজিত সরকারী সংস্থার একটি দলের সদস্যদের প্রত্যেককে তাদের সরকারী অনুমােদনের জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে। এসব লােক নিয়মিতভাবে ১০টি প্রকল্প যাচাই করতে গিয়ে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়ের মােটামুটি ৬শগুণ পকেটস্থ করে। এছাড়া কোনাে বিদেশী সরঞ্জাম আমদানীর জন্য আবশ্যিকভাবে প্রদত্ত কমিশন পায় শহরাঞ্চলের এজেন্টরা। কার্যত কোনাে ব্যতিক্রম ছাড়াই পল্লী অঞ্চলে বড় বড় ভূস্বামী যে কোনাে নতুন কর্মসূচী নিজেদের স্বার্থে লাগানাের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সাথে চক্রান্ত করে থাকে। যেমন সেচের জন্য নতুন নলকূপ সচরাচর বড় ভূস্বামীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে ক্ষুদ্র জমির মালিকদের তুলনায় তাদের ভাগ্যের উন্নতি ঘটে।উৎপাদনের রাজনীতি বনাম কুকুর, রােটারি ও মন্ত্রীবর্গ ঃ একটি সম্পাদকীয়

১৩. ঈদে মিলাদুন্নবীর সময় রাষ্ট্রপতি দেড় হাজার সঙ্গীসাথী নিয়ে হিজবুল বহরনামক জাহাজে সমুদ্র বিহারে গিয়েছিলেন। সঙ্গী সাথীরা ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গ, বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা, সমাজকর্মী নামধেয় কিছু নিমন্ত্রিত ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাবীদের মধ্যে কিছু সযত্নে বাছাই করা ছাত্রছাত্রী ও একদল গাইয়ে বাজিয়ে নরনারী। এহেন প্রমােদ বিহার সংবাদপত্রে, সভা সমিতিতে ইতিমধ্যে যথেষ্ট নিন্দিত হয়েছে। গত রােববার ঢাকার ধানমন্ডি পাড়ার একটি ক্লাবের উদ্যোগে কুকুর প্রদর্শনী। হয়েছে। প্রদর্শনীর বিনিময়ে প্রবেশাধিকার ছিল। এ জাতীয় ঘটনা কিছু ধনী লােকের বিলাস মাত্র। এই আপাত নির্দোষ ঘটনায় তুলনায় আরও অনেক ধরনের উৎকৃষ্ট ও বিকৃত বিলাসে ধনিক শ্রেণী মগ্ন থাকে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হল ঐ কুকুর প্রদর্শনীতে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী বাণী পাঠিয়েছেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে লেঃ জেঃ (অবঃ) খাজা ওয়াসিমউদ্দীন এ ধরনের ব্যাপারে ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা হয়ে উঠবেবলে আশা প্রকাশ করেছেনপ্রদর্শনীর ছবি টেলিভিশনে খবর প্রচারকালে প্রায় ১ মিনিট ধরে দেখানাে হয়েছে; একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায় সচিত্র সুদীর্ঘ রিপাের্ট বেরিয়েছে ইত্যাদি। ঐ একই দিনের ঘটনা উপরাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার রােটারি ক্লাবের সদস্যদের একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছেন। অপর একটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষস্থানে ৫ কলাম ছবিসহ এটি খবর হয়েছে। বিত্তবান শ্রেণীর লােকজনদের নিয়ে রােটারি, লায়ন প্রভৃতি ক্লাবগুলি তাদের অবসর বিনােদনের জন্য গঠিত এবং মাঝে মধ্যে জনসেবায় অংশগ্রহণ করা ও তার সচিত্র রিপাের্ট সংবাদপত্রে ছাপানাে হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তা সকলের জানা আছে। মন্ত্রিদের ব্যস্ততার আরও একটি নমুনা উল্লেখ করছি। ঢাকার একটি হােটেলে জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কিত একটি ব্যবসাভিত্তিক প্রাইভেট কলেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাণী পাঠিয়েছেন, পেট্রোলিয়াম ও যুব- এই দুই দপ্তরের দুই জন মন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পীকার উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। এছাড়া ফি হপ্তায় একটি করে মিনা বাজার উদ্বোধন আর তাতে উপস্থিত ঝলমলে পােষাক পরা ধনী ললনাদের বড় বড় ছবি সংবাদপত্রে ছাপা তাে চলছেই। যেন এগুলােই গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ঘটনা। রাষ্ট্রপতির উৎপাদনের রাজনীতিআর ২৪ ঘন্টা কাজের বিপ্লবীআহবানে সাড়া দিয়েই হয়তাে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা এ ধরনের ক্লাব, প্রদর্শনী ও মিনা বাজারের কাজে ছুটাছুটি করে এই মাঘ মাসের শীতেও ঘেমে জবজবে হচ্ছেন। আমরাও এসব তুচ্ছ ঘটনা সম্পাদকীয় স্তন্তে উল্লেখ করতাম না যদি এগুলাে আমাদের। বর্তমান সরকার ও সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের গােটা কর্মকাণ্ডের একটা দিকনির্দেশ না হতাে। সে নির্দেশনাটি হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশবে সর্বতােভাবে ধনিক শ্রেণীর জন্য ও ধণিক শ্রেণীর আদর্শে গড়ে তােলা হচ্ছে। কোটি কোটি নিরন্ন মেহনতী মানুষকে শােষণ করে ধনিক শ্রেণীর উৎকট বিলাসের রসদ জোগানাে হবে-এটাই ওদের স্বপ্ন। সরকার ও সমাজপতিদের এই নীতিই প্রতিফলিত হচ্ছে ঐ জাতীয় নানা অনুষ্ঠানে এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে। দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃত চিত্র ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ঝলমলে পােষাক পরা সুখী রমনী ও লােমশ বিদেশী কুকুরের ছবির নিচে। উৎপাদনের রাজনীতির বড় অবলম্বন বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ। অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সর্বোপরি প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজই হলাে বিদেশ

থেকে ঋণ সংগ্রহ করা এবং সেটা ফলাও করে কাগজে প্রচার করা। জিয়াউর রহমানের আমলে ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশী ঋণ আনা হয়েছে। কিন্তু নতুন কলকারখানা স্থাপিত হয়নি একটিও।

উৎপাদনের নয় ঃ ধ্বংসের রাজনীতি

১৪. জিয়ার রাজত্বে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য পার্থক্য আকাশচুম্বি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপাের্ট এবং অন্যান্য সরকারী রিপাের্টে জীবন যাত্রার ব্যয়ভার ক্রমাগত বৃদ্ধির উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৬৯-৭০ সালে একশটাকায় যা কেনা যেতাে তা ১৯৭৮ সালের শেষের দিকে এসে ৩৫৭ টাকা ২৭ পয়সায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে ঐ একশটাকার জিনিসের মূল্য ৫৩৯ টাকায় ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে ৬৯০ টাকায় এবং ১৯৮১ জানুয়ারিতে ৬৭৪ টাকায় এসে দাঁড়ায়। জিয়াউর রহমান উৎপাদনের নয়, ধ্বংসের অর্থনীতি অনুসরণ করছেন। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা কথাও এ প্রসঙ্গে ৩০শে এপ্রিল ৮০ সনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিশেষ সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে দেশকে বহুজাতিক সংস্থার অবাধ শােষণে পরিণত করেছে। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা, কারিগরি, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিকভিত্তিক একটা পরিকল্পনা মাত্র। এর মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করা যাবে না। জিয়া দেশের আসল চিত্র লুকিয়ে রেখেছেন

দারিদ্র্য হ্রাসের কথা পরিকল্পনায় বলা হলেও দারিদ্রের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানাের কথা সরকার বিভিন্ন মিটিং মিছিলে চিৎকার করে বললেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানাের জন্য প্রথমেই ভূমি সংস্কারের ব্যবস্থা প্রয়ােজন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে একদম নীরব। দেশ দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার রক্তশূন্য ক্ষেত্রে আটকা পড়ে গেছে। উপরন্ত দেশে অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সূতােয় বাঁধা। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রা ওঠা নামার প্রতিক্রিয়া সাধারণ মানুষের চেপে বসে। দৈনিক ইত্তেফাকের বরাত দিয়ে রােববার এ সম্পর্কে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ? ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক চাপে শুল্কের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের পদ্ধতিতে এবং রপ্তানী বৃদ্ধিতে উৎসাহের নামে জিয়ার আমলে এ পর্যন্ত ১২ বার বাংলাদেশী মুদ্রার মান হ্রাস করা হয়েছে। এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি বা

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অর্থনীতিতে বেশি চাপ সৃষ্টি হয়েছে।দেশে ১৯৭৭-৭৮ সালে মুদ্রা সরবরাহ ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় শতকরা ২৬৭ ভাগ, বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে শিল্পজাত দ্রব্যাদির সামগ্রিক উৎপাদন ১৯৭৭-৭৮ সালে ১৯৬৯-৭০ এর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ২.৬ ভাগ। কৃষি উৎপাদন ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৬-৭৭ সালে শতকরা ৯.৩৬ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহের সঙ্গে উৎপাদন তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। নয় কোটিরও বেশী লােকসংখ্যার শতকরা আশি জনের জীবন মান দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। শতকরা ষাটজন অপুষ্টিতে ভুগছে। দুই কোটি আশি লাখ কর্মক্ষম লােকের শতকরা পয়ত্রিশ জন সম্পূর্ণ বেকার। মােট জনসংখ্যার আশি জনই নিরক্ষর। দেশের এই চিত্র জিয়াউর রহমানের সরকার সচেতনভাবেই লুকিয়ে রেখেছেন তার প্রমাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের নিত্যনতুন ঘােষণার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

যুব কমপ্লেক্স ও উৎপাটনের হাতিয়ার 

১৫. প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সনের ১৮ ও ১৯শে ফেব্রুয়ারী শেরে বাংলা নগরে জাতীয় যুব কনভেশন করেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা খরচ করে। দেশের যুব। সমাজকে সংগঠিত করে উৎপাদনের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে যুব সমবায় কমপ্লেক্স নামে প্রকল্প গ্রহণ করেন। জিয়া সম্মেলনে বললেনঃ সমবায় বিপ্লব-বিপ্লবই সমবায়থানায় যুব কমপ্লেক্স গঠিত হলাে। হাটবাজার, ইজারদারী হতে শুরু করে ঠিকাদারী মাস্তানী-গুন্ডামী ভয়ভীতির সাহায্যে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ করে দেয়া হলাে। মূলতঃ উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুব শক্তিকে জড়িত না করে এদের সমাজের মাস্তান বাহিনীতে পরিণত করা। হলাে। কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে যুব সমাজের মধ্যে নৈতিক অধঃপতন গুরুতর হলাে। বিরােধী দল পার্লামেন্টে দাবী তুললেন, যুব কমপ্লেক্স বিলুপ্ত করা হােক। যুব। কমপ্লেক্স দুর্নীত ও মাস্তান চক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কৃষকেরা সামান্য। শাকসজী, কলা, কাঠাল, বীজ ধান, ডিম, কচুর লতি, যাই বেচতে হাট বাজারে আনে তা থেকেই তােলারবিএনপির পান্ডারা থাবা মেরে কিছু নিয়ে যায়। তােলারও কোন নিয়ম আছে। বিএনপির যুব কমপ্রেক্সের এসব পান্ডারেরর অত্যাচারে অতিষ্ঠিত হয়ে ডেমরা কান্দারহাট বাজারে হাজার হাজার কৃষক জনতা। প্রতিবাদ মিছিল বের করে। দেশের বহুস্থানে এরকম প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে।আমাকে সরাতে হবে

১৬. এই সমালােচনার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া যুব কমপ্লেক্স সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “যুব কমপ্লেক্সে বিলুপ্তির আগে আমাকে সরাতে হবে।ব্যক্তি বিশেষের। ক্ষমতায় থাকা না থাকার জন্য যুব কমপ্লেক্স যে গঠন করা হয়েছে এখন তা পরিস্কার। যুব সমাজের কল্যাণ চিন্তার বাইরে যুব কমপ্লেক্স গড়ে তােলা হয়েছে। সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে এই যুব কমপ্লেক্সের ছেলেদের রাজনৈতিক ট্যাঙাড়ে বাহিনী। হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, নগদ অর্থ দিয়ে তাদের চরিত্র নষ্ট করা হচ্ছে। উৎপাদন বৃদ্ধি কিংবা জনসংখ্যার বিস্ফোরণই রােধ যুব কমপ্লেক্সের কাজ না হয়ে যুব কমপ্লেক্সের প্রধান কাজ হয়েছে বর্তমানে খাজনা আদায় করা এবং আদায়কৃত অর্থের সিংহভাগ ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা। সমবায়মন্ত্রী বলেছেন যে, যুব কমপ্লেক্সের আয় ১০ কোটি টাকা হলে তাদেরকে শতকরা ২৫ ভাগ কমিশন দেয়া হবে। গ্রাম-বাংলার হতভাগ্য বেকার যুবকদের জন্য ফলপ্রসূ কোনাে ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার পরিবর্তে তাদের ভাগ্য কাচা পয়সায় বেঁধে ফেলা হলাে। জিয়াউর রহমান যুব কমপ্লেক্সের মাধ্যমে দেশের আড়াই কোটি যুবককে সংগঠিত করার অঙ্গীকার ঘােষণা করেছেন। ভবিষ্যতে ইয়ুথ এসেমব্লি গঠন করার পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। যুব কমপ্লেক্সের সাহায্যে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রফতানী করার ঘােষণা রীতিমতাে বাগাড়ম্বর।

যুব কমপ্লেক্স ও দুর্নীতি পঙ্কিলে

হাট বাজার থেকে দুই বছরে হিসেব মােতাবেক প্রায় ১২ কোটি টাকা তােলাআদায় হয়েছে। কিন্তু সরকারী খাতে জমা হয়েছে মাত্র ১২ লাখ টাকা। ১৯৭৮ এর ৩০শে নভেম্বর যুব কমপ্লেক্সের কাছে হস্তান্তরের আগে তালা আদায়বাবদ প্রতি বছর সরকারী তহবিলে প্রায় ৩ কোটি টাকা জমা হতাে। আদায়কৃত টাকার শতকরা ২৫ ভাগ জেলা প্রশাসনের পিএল একাউন্টে জমার বিধান থাকলেও ১২ কোটি টাকা তােলা আদায়ের মধ্যে ৮ কোটি টাকাই বিএনপি যুব কমপ্লেক্স আত্মসাৎ করেছে।

উৎপাদনের রাজনীতি ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের শ্লোগান

১. খালকাটা বিপ্লবের শেষ হতে না হতেই জিয়া দ্রুতগতিতে দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার বিপ্লব ঘােষণা করেন। শুরু হলাে বিপ্লবনিরক্ষরতা দূরীকরণ বিপ্লব। কিন্তু দেশের শিক্ষার অবস্থা কি? শিক্ষার প্রসার ব্যতীত শিল্পায়ন, জাতীয় অগ্রগতি,

প্রবৃদ্ধি অর্জন ও শ্রম-দক্ষতা বৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণেতারা সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশী করে। শিক্ষা বিস্তার, নিরক্ষরতা দূরীকরণে জিয়াউর রহমান সােচ্চার। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা ভিন্ন রকম। ১৯৭৮-৭৯ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি, হয়েছে অধােগতি।

ছাত্র-ছাত্রী হ্রাস পেয়েছে

সরকারী পরিসংখ্যানে জানা যায়, ১৯৭৮-৭৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা যােগ্য ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা সারাদেশে ছিলাে ১৫০ *খ। অর্থাৎ ১৯৭৭-৭৮ সালের তুলনায় ২.৮০ শতাংশ বেশী। ৭৮-৭৯ সনে প্রাথমিক শিক্ষার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আনুমানিক ৮২ লাখ অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় শতকরা ০.০৮ জন বেশী। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ০.০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনা তা হ্রাস পেয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ। করতে পারে এ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দেশে বাস্তবে, বাড়েনি, বয়স্ক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে এ রকমের লােকের সংখ্যাও কমেছে। ৭৮-৭৯ সনে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত ছাত্র-চাত্রীর সংখ্যা আনুমানিক ১ কোটি ২৫ লাখ। ৭৭-৭৮ বছরের তুলনায় এই সংখ্যা শতকরা ২.৮০ ভাগ বেশী। ৭৮-৭৯ সনে মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২০ লাখ ৭ হাজার। ৭৭-৭৮ সনে এই সংখ্যা ছিলাে ২১ লাখ ৫৬ হাজার। অর্থাৎ ৭৭-৭৮ সনের। তুলনায় মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করছে এরূপ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৬.৯১ ভাগ। ৭৮-৭৯ সনে মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯,২২৫। এর আগের বছর এই সংখ্যা ৮,৫৯৪। অর্থাৎ সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ৭.৩৪ ভাগ, আর ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কমেছে শতকরা ৬.৯১ ভাগ। ৭৭-৭৯ সনের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিলাে ১ লাখ ৬৬ হাজার। ৭৭-৭৮ সনের সংখ্যা ছিলাে আনুমানিক ২ লাখ ১১ হাজার। অর্থাৎ ৭৭-৭৮ সনের তুলনায় ৭৭-৭৯ সনে উচ্চ শিক্ষার্থী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা শতকরা ২১ ভাগ হ্রাস। পেয়েছে। 

কারণ ও অর্থনৈতিক সংকট

এসব তথ্য থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসছে তা হলাে ক্রমশ অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ফলে শিক্ষার পরিমাণ কমছে। মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার

ব্যয়ভার অভিভাবকদেরই বহন করতে হয়। স্কুল-কলেজের বেতন বৃদ্ধি বই-খাতাপেন্সিলের মূল্য বৃদ্ধি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের বর্ধিত খরচ বহন করা অনেক পিতামাতার পক্ষেই সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয় বাড়ছে। ক্রমান্বয়ে। এবং এই বর্ধিত ব্যয় সংকুলান করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ মেটানাে অসম্ভব। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তবে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম, শতকরা প্রায় ২০% ভাগ। এই শতকরা ২০ ভাগের পক্ষেও শিক্ষার ব্যয় সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ছে। শুধু গলাবাজি

অথচ জিয়া সরকার জাতীয় উন্নয়নের কথা প্রতিদিনই বলে চলেছেন। বলছেন, জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথা। অথচ শিক্ষার মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই হয়েছে। এই অবনতি সামগ্রিক জাতীয় অর্থনীতির অধােগতি ও সংকটের লক্ষণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবর্তন অর্থাৎ শিক্ষা প্রসার না ঘটাতে পারলে জাতীয় উন্নতি বা অগ্রগতিও সম্ভব নয়কথা ছাড়া অর্থাৎ লােক দেখানাে কথা বলা ছাড়া জাতীয় অগ্রগতির ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ নেই।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বিএনপি টাউটদের হাতে

১৮. জিয়াউর রহমান এই বাস্তবতা বুঝে না বুঝেই নিরক্ষরতা দূরীকরণের শ্লোগান তুলেছেন। নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচীতে ক্ষমতা ভাগ করে এবং স্তর বিভক্ত হিসেবে আমলাদের কাজের সমন্বয় ও পরিকল্পনার জন্য স পদ ও নিয়ন্ত্রণ সেল রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান জাতিকে আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ স্বেচ্ছাশ্রমে হবে। সরকারী কর্মচারী, শিক্ষক, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ এবং শিক্ষিত লােকজন সবাই। অবৈতনিকভাবে শিক্ষাদান করবেন নিরক্ষরদের। নিরক্ষরদের মধ্যে বয়স্ক ও শিশুরা রয়েছেন। এদের অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার জন্য দেশব্যাপী উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি সামাজিকভাবে জাগাতে হবে। তা না করে জিয়াউর রহমান সংকীর্ণ দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থে বিএনপি কর্মীদের ডাক দিয়েছেন নিরক্ষরতা দূর করার কাজে ঝাপিয়ে পরতে। ক্ষমতার মধুচক্রের চারপাশে এসে যারা ভীড় করেছেন সেই গ্রাম্য টাউট বাটপারদের দ্বারা নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী সফল হবে না। কেননা নিরক্ষরতা কর্মসুচী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়ােজন ত্যাগী আদর্শবান নেতা

কর্মী যা বিএনপির নেই। প্রয়ােজন নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ। অথচ বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থই শতকরা ৪০ ভাগ কেটে নেয়া হয়। প্রচলিত শিক্ষাই যেকানে ব্যাহত হবে, সেখানে নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী সফল হতে পারেনা। অর্থ সংস্থান, শিক্ষা উপকরণ, পরিবেশ, সুযােগ সুবিধা প্রদান না করে ডেপুটি কমিশনার আর প্রেসিডেন্টের দপ্তর, শিক্ষা অর্থ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সমূহে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ সেল স্থাপন করে নিরক্ষরতা। দূরীকরণ কর্মসূচী সফল হতে পারেনা। মাধ্যমিক শ্রেণীর ছাত্রদের পাঠক্রমে প্রতিটি ছাত্রকে একজন করে নিরক্ষর লােককে স্বাক্ষর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলাে। শেষ পর্যন্ত এটা হাসির তামাশায় পরিণত

চমক দিয়ে লোেক ভুলানাে

১৯. নিরক্ষরতা দূরীকরণের মত জাতীয় কর্মসূচী বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে আবশ্যক ছিলাে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের আহ্বানটা একটা মামুলী ধরনের। যদি জিয়া সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকতাে তবে। আগেই আলাপ-আলােচনা করে জাতি গঠনের কাজে সকলকে নিয়ে একযােগে নেমে পড়া যেত। সহযােগিতা গ্রহণের মনােভাব হত সেটাই। সকাল বিকেল রাজনৈতিক বিরােধী দলকে শত্রু বলে, বাকশালী গালি দিয়ে, বিদেশী আদর্শের ধূয়া তুলে দেশ বিক্রি করার অভিযােগ করে ধোঁকা দিয়ে মহৎ কিছু অর্জিত হতে পারেনা। আসল কথা হল, সবকিছুকেই বিপ্লব বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা। চমক দিয়ে, ভংগী দিয়ে লােক ভােলাবার এই কৌশল জনগণের চোখে ধরা পড়ে গেছে। 

২০. নিরক্ষরতা দূরীকরণের কর্মসূচী গ্রহণের ক্ষেত্রে ও শিশুদের কিভাবে তার সরল সহজ বাস্তবভিত্তিক পদ্ধতি ও পথ-নির্দেশ আবশ্যক। বয়স্ক নিরক্ষরদের শিক্ষা দিতে হবে, আর্থিক সমস্যা এবং বিভিন্ন অসুবিধার আশু মােকাবিলার পথ বের করতে হবে। যে দেশে শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ শিশুর দুবেলা পেট ভরে খাদ্য জোটে না, তার হাতে বই-শ্লেট তুলে দেয়ার কথাটা বাস্তবভিত্তিক হতে হবে। যে দেশে কোটি লােক পেটভরে খেতে পায় না, সেদেশে নিরক্ষরতার অবসান মুখের কথা বা শ্লোগান তারা সম্ভব নয়। বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপক প্রবর্তন নিরক্ষরতা দূরীকরণের পথে সহায়ক। কিন্তু প্রাথমিক স্কুল বাড়েনি। ছাত্র কমেছে। প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা হতাশাব্যাঞ্জক।


অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে নিরক্ষরতা দূর করার একটা সম্পর্ক আছে, ক্ষমতার আসন থেকে তাও কাটছাট করা হয়েছে। 

২১. নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য জিয়া সরকারের সদিচ্ছার কেউ বিরােধিতা করেনি।

কেউ করবে না, সবাই নিরক্ষরতা দূরীকরণ চায়। কিন্তু জিয়া সরকারের শিক্ষা খাতের বাজেট কেটে নেয়ার পর, আন্তরিকতা কথায় ও কাজের মিল বরাদ্দকৃত টাকার সুষ্ঠু ব্যবহারের ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায় বলে কথিত নিরক্ষরতা দূর করার সরকারী কর্মসূচী কেবলমাত্র রাজনীতির স্কুল প্রচারণা। দুর্দশাগ্রস্ত প্রাথমিক স্কুল, সরকারী শিক্ষকদের ধর্মঘট, বাজেট থেকে শিক্ষার বরাদ্দ অর্থ কেটে নেওয়া, বই-খাতাপত্র শ্লেটের অগ্নিমূল, বৈষম্যমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব বহাল রেখে বিপ্লবের সীলমােহর দিয়ে নিরক্ষরতা দূরীকরণ সম্ভব নয়। গ্রাম সরকারই আমার সব

২২. জিয়াউর রহমান একটি বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে! স্বপ্নটার সঙ্গে তিনি দর্শনও যােগ করতে চেয়েছেন। জিয়াউর রহমানের অনেক দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বড় দর্শন ক্ষমতায় থাকার ভিতকে পাকাপাকি করা। তা যেভাবে, যে কোন পন্থাতেই হােক না কেন। ক্ষমতার ভিত ব্রিটিশ গড়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও ক্ষমতার ভিত চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের গম দিয়েছিলেন। অর্থ দিয়েছিলেন। অডিটের বালাই ছিলাে না। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে এদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানও অনুরূপভাবে গ্রাম সরকার গঠন করার জন্য দিনরাত ভাষণ দিয়ে চলেছেন। বলেছেন, “গ্রাম সরকারই আমার সব।১৯৭৬ সনে সামরিক শাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গ্রাম পরিষদ-এর কথা ঘােষণা করেন। ১৯৮০ সনে পার্লামেন্টে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার পরিকল্পনা অনুমােদিত হয়। ১৯৮০ সনের ৩০শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান ঢাকার অদূরে সাভার জিরাবােতে গ্রাম সরকার এর উদ্বোধন করেন। ১৯৮১ সনের ৭ই জানুয়ারি। গ্রাম সরকার প্রধানদের রাষ্ট্রীয় খরচে এক মহাসম্মেলন করেন। প্রতি গ্রামে ৯টি মন্ত্রণালয়ের ১১ জন মন্ত্রী। তারাই সব করবে। গ্রাম ছারখার 

২৩. গ্রাম সরকার গঠন নিয়ে গ্রামে দলাদলি লাঠালাঠি সংঘর্ষ হয়েছে। আহত ও নিহত হয়েছে অগণিত। প্রাধান্য বজায় রাখতে গিয়ে গ্রামীণ টাউটদের কদর ও দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায়। গ্রামীণ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এক অমােঘ অস্ত্র হিসেবে গ্রাম সরকার হচ্ছে। প্রচলিত গ্রামীণ জীবনকে বিভক্ত করে সংঘর্ষমুখী করে তােলার ক্ষেত্রে জিয়ার গ্রাম সরকারকে অনেকে গ্রাম ছারখার কর্মসূচী বলে আখ্যায়িত করেছে।

জিয়ার এক ভাষণের মূল্য ৪ কোটি টাকা 

২৪. ৭ই জানুয়ারী ঢাকা অনুষ্টিত গ্রাম সরকার প্রধানদের মহাসম্মেলন‘-এ উপস্থিতি হয়েছিল ৭০ থেকে ৮০ হাজার লােক। এর মধ্যে ২ জন সড়ক দুর্ঘটনার আর একজন হাঁপানি রােগে প্রাণত্যাগ করেছেন। আর খাদ্যে বিস্ক্রিয়ায় ৩ হাজার ৪২৫ জন মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসাধীনের মধ্যে ২৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের বসার জন্য প্যান্ডেল বানিয়েছিলেন ৩৭ লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে। তাছাড়া আনুষঙ্গিক ব্যাপক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিলাে। সরকারী টাকায় গ্রাম প্রধানরা ঢাকা মহানগরীতে এলেন। প্রতি গ্রাম থেকে একজন গ্রাম সরকার প্রধান, প্রতি ইউনিয়ন থেকে একজন চেয়ারম্যান গ্রাম সরকারের মহিলা প্রতিনিধি, এছাড়া থানা সার্কেল অফিসার, মহুকুমা অফিসার ও একজন করে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। আর এদের সঙ্গী সাথী মিলিয়ে জনসংখ্যা লক্ষাধিক। মাথাপিছু তিনশটাকা বরাদ্দ। সব মিলে জনগণের তহবিল থেকে ৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এবং এই টাকা উৎপাদনের রাজনীতিতে আত্মনিবেদিত প্রেসিডেন্টের জন্য কিছুই নয়। কেননা ১০০ লােকের জনসভায় ভাষণ দিতে যান তিনি হেলিকপ্টারে পাঞ্চাশ ষাট হাজার টাকার জ্বালানী খরচ করে। এই মহাসম্মেলনে রাষ্ট্রপতির দুই ঘন্টার ভাষণ ব্যতীত অন্য কোন কর্মসূচী ছিলাে ঐ ভাষনও ছিল চিরাচরিত রাষ্ট্রপতির বহু বক্তৃতার পুনরাবৃত্তি মাত্র। গ্রাম সরকার প্রধানদের মহাসম্মেলনে জিয়ার জীবনেও মহাভাষণ। এই ভাষণের দাম ৪ কোটি টাকা। পুলিশ, সরকারী কর্মচারী দুর্নীতিবাজঃ গ্রাম সরকারই ভরসা

২৫. রাষ্ট্রপতি বলেছেন, পুলিশ ও সরকারী কর্মচারীরা দুর্নীতিবাজ। তাই গ্রাম সরকারই তার ভরসা। দুর্নীতিবাজ প্রশাসনে গ্রাম সরকার প্রধানদেরকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তােলার আহ্বান চমৎকার। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনকে গ্রাম সরকার গড়ে তােলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সার্কেল অফিসার, মহকুমা প্রশাসকের পছন্দসহ লােকেরাই গ্রাম সরকারে থাকছে। ঐ প্রশাসন এবং গ্রাম সরকার মিলে এক নতুন দুর্নীতির চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রাম সরকার পরিচালনার জন্যও টাকা বরাদ্দ করা হবে বলে রাষ্ট্রপতি বলেছেন। শুধু তাই নয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেম্বরদের মতাে গ্রাম সরকার প্রধান এবং সদস্যরাও মাসিক মাসােহারা দেয়া হবে বলে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর বিভিন্ন ভাষণে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠা একটি সরকারী কর্মসূচী। সরকারী কর্মকর্তাগণ গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বহু গ্রামে গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেন গ্রাম সরকার?

২৬. গ্রাম সরকার সম্পর্কে বিএনপির জাতীয় সংসদ সদস্যরাও খুব একটা জানেন না। খােদ রাষ্ট্রপতি গ্রাম সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অর্ডার দিয়েছেন কিন্তু পার্লামেন্ট এ সম্পর্কে কিছুই জানে না। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকও প্রায় সকল বিদেশী সাহায্য সংস্থা এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের গ্রামগুলােয় উন্নতি এবং অধিক কৃষি উৎপাদনের উপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিক কৃষি উৎপাদনের সাথে সাথে সুষম বন্টনেরও নীতি নিয়ে ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তাঁর ঘােষিত সবুজ বিপ্লবনামে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিলাে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রণীত একটি কর্মসূচী। সবুজ বিপ্লবেরকর্মসূচী সম্পূর্ণটাই ছিল জনগণের অংশ গ্রহণ ও আমলাচক্র মুক্ত। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চলতে থাকে বৈদেশিক সহায্যপুষ্ট এবং দেশীয় উদ্যোগে কৃষি সমবায় সমিতিসমূহ। সবুজ বিপ্লবের পথ ধরে আওয়ামী লীগেরই কয়েকজন নেতৃস্থানীয় স্বনির্ভরআন্দোলনের সূচনা করেন। যদিও স্বনির্ভর আন্দোলনের কর্মধারা চট্টগ্রামের কোনাে কোনাে স্থানে পাকিস্তানী আমলা থেকেই চলে আসছিলাে স্বাধীনতার পর এক একটি জেলা এক একটি নামে এ আন্দোলনে নিয়ােজিত হয়েছিল। যেমন ঢাকাঃ স্বনির্ভর, চট্টগ্রাম সােনালী ইত্যাদি।

ঢাকার সরকারের দিকে তাকাতে হবেনা .

২৭. পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের পরপরই দেখা গেলাে ক্ষমতা দখলকারী রাষ্ট্রপতি মােশতাক আহমেদ স্বনির্ভর আন্দোলনটিকে সরকারী কর্মসূচীতে রূপান্তরিত করলাে। পত্রপত্রিকাগুলােয় স্বনির্ভর আন্দোলনের পক্ষে একটি না একটি খবর থাকতােই। খুব হৈ চৈএর কান্ড। ১৯৭৫ সালে ২৪/২৫শে সেপ্টেম্বর স্বনির্ভরের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাতীয় আন্দোলনে রূপে স্বনির্ভর বাংলাদেশঘােষণা দেয়া হয়। ১৯৭৬ সনে ৩-৫ই জানুয়ারী স্বনির্ভর বাংলাদেশ এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্বনির্ভর সংগঠন ও সমবায় বিদেশী সাহায্য ও সরকারী অনুদানের উপর নির্ভর করতাে। জিয়াউর রহমান এই আন্দোলনকেই এগিয়ে নিয়ে যান, গ্রাম সরকার। প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর দিকে। ১৯৭৮সালের জানুয়ারীতে টাঙ্গাইল জেলার বেশ কটি ইউনিয়নে ইউনিয়ন ও গ্রাম সরকার গঠনের উপর ব্যাপক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। টিভি ও রেডিওতে গ্রাম সরকারের উপর বিভিন্ন কর্মসূচী প্রচারিত হতে থাকে। ১৯৭৮ সালের ৫ই জুলাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান টাঙ্গাইলের কালিহাতী থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে মিলিত হন। প্রেসিডেন্ট এখানে গ্রাম ও ইউনিয়ন সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এখানে তার প্রদত্ত ভাষণে বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার ও জনগণের মধ্যে আর কোন পার্থক্য নেই, কেননা আপনারা এখন গ্রাম সরকার গঠন করেছেন, আপনারা মন্ত্রী বানিয়েছেন, এখন আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনুযায়ী নিজেদের সমস্যা সমাধান করলে ঢাকার সরকার-এর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে নাপ্রেসিডেন্ট জিয়া গ্রাম সরকার এর স্বীকৃতি দিয়ে কাজ করার সুযােগ প্রদান করেন। ক্ষমতা ও সম্পদ বিকেন্দ্রীয়করণ না করে জিয়ার এসব ভাষণ ছিলাে। নিছক ভাওতাবাজী।

গ্রাম সরকারের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী 

২৮. ১৯৮০ সালের প্রথম ভাগে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হঠাৎ করে গ্রাম সরকার

কর্মসূচীকে স্বীকৃতি প্রদান করে জাতীয় আন্দোলন রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া সর্বত্র গ্রাম সরকার কর্মসূচী বাস্তবায়নের আহবান জানালেও গ্রাম সরকার জনগণের কাছে একটি রহস্যময় অধ্যায়। গ্রাম সরকার সংগঠনের গঠণ প্রণালী ও কার্যকারিতা ক) ইউনিয়ন সরকারঃ থানা পর্যায়ের সরকারী বিভাগগুলােকে ১১টি সম কার্যভিত্তিক ১১টি বিভািগে ভাগ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, নির্বাচিত ৯জন সদস্য এবং মনােনীত দুইজন সদস্যের মধ্যে মােট ১১টি বিভাগের ১১টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বন্টন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের মন্ত্রী নামে আখ্যায়িত করা হবে। দপ্তরগুলাে হলােঃ (১) আইন শৃংখলা ও নিরাপত্তা (২) অর্থ, রাজস্ব ও ভূমি প্রশাসন (৩) পরিকল্পনা, যােগাযােগ, পূর্ত কর্মসূচী ও স্বেচ্ছাশ্রম (৪) কৃষি, খাদ্য, সেচ ও বন (বৃক্ষ রােপণ) (৫) পশু পালন (৬) মৎস্য (মজা পুকুর) (৭) শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম-যুবক ও কিশাের (৮) সমবায়, ভূমিহীন ও আই আর ডিপি (৯) সমাজ কল্যাণ ও কুটির শিল্প (১০) স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য (১১) পরিবার পরিকল্পনা ও মহিলা। ইউনিয়ন পরিষদের ১১ জন সদস্য যেমন ১১ জন মন্ত্রী, তেমনি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী। গ্রাম সরকারের অধীনেও এমনি ১১টি মন্ত্রনালয় রয়েছে, তবে গঠন পদ্ধতি একটু ভিন্নতর। ইউনিয়নের মত গ্রাম পর্যায়ে নির্বাচিত সদস্য পাওয়া যাবে

তাই গ্রামের জনগণকে ৫টি দলে ভাগ করে যথাঃ (১) কৃষক (২) ভূমিহীন (৩) যুবক (৪) মহিলা (৫) অন্যান্য পেশার প্রত্যেক দল থেকে ২জন করে মন্ত্রী নিয়ে এবং সংখ্যাগরিষ্ট দল থেকে আর ১ জন নিয়ে মােট ১১টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বন্টন করা হয়।

গ্রাম সরকারের দফারফা 

২৯. জিয়ার মৃত্যুর পর গ্রামসরকারের আসল চেহারা বের হয়ে পড়ে। যে সব ইউনয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং স্বনির্ভর গ্রাম সরকারের গ্রাম প্রধানরা আউশ ও আমন ধান সংগ্রহের জন্য নেয়া অগ্রিম অর্থ এখনও জমা দেননি তাদেরকে ৩রা এপ্রিল ৮৩ ইস্যুকৃত সামরিক আইনের এক নম্বর নির্দেশের অধীনে ৩০ শে এপ্রিলের মধ্যে ট্রেজারী চালানের মাধ্যমে উক্ত অর্থ জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই চালানের। একটি কপি সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। মহকুমা প্রশাসক জাতীয় পর্যায়ে এই অগ্রিম অর্থের চূড়ান্ত হিসাব নিকাশ যথাযথ পরীক্ষার পর খাদ্যমন্ত্রণালয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি পেশ করবেন এবং আগামী ৭ই মে তারিখের মধ্যে নির্ধারিত প্রােফর্মায় স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসমূহ স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক এবং সার্কেল অফিসারদের (রাজস্ব) সাথে এই অর্থ জমা দেওয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য ও ব্যাখ্যার জন্য * যােগাযােগ করতে পারেন। এ তে

ধান ক্রয়ের টাকা ও ধানের হিসেব নেই

৩০. গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। ১৯৮০ সালের ২২শে আগষ্ট গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনিয়ন সদস্যদের আমন ও আউশ ধান ক্রয়ের জন্য ৬০ কোটি ১০ লাক্ষ ৯০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছিলাে। প্রত্যেক ইউ, পি সদস্য ও গ্রাম সরকার প্রধানকে ৫০০ মণ করে ধান কেনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলাে। ৬৫ হাজার ২৯৩ জন গ্রাম সরকার এবং চেয়ারম্যান সহ ৪৩ হাজার ৫২০জন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের অধিকাংশই ধান

কিনে অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করেছেন। ডিসেম্বর মাসেই স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত হয় যে, ৬০ কোটি ১০ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকার সিংহভাগই গায়েব হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধানের হিসেব ভূয়া। যে সব গ্রাম সরকার প্রধান ও ইউনয়ন পরিষদ সদস্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান কেনার টাকা এবং ধানের হিসেব দিতে পারেননি তাদের বিরুদ্ধে ৪০৬ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতারি পরােয়ানা জারীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলােমামলা দায়েরের কথা জানা গেছে। ৮২ জানুয়ারীতে যে, দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযােগে দেশের তিন শতাধিক চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্যকর্মসূচীর গম অথবা সরকারী ও ইউনিয়নের অর্থ আত্মসাতের অভিযােগে এক বা একাধিক ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে ধান কেনার টাকার হিসেব অপর দিকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতার অভাবে গ্রামে গ্রামে একদা তাওবসৃষ্টিকারী গ্রাম সরকার প্রধানগণ এখন ভীত, সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা। বান্দরবন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া ১৯৮১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির তাবেদারীতে ৬৫ হাজার ২৯৩ টি গ্রাম সরকার গঠিত হয়। গ্রাম সরকার গঠনের পর মাত্র ৪টি সম্মেলনে ব্যয় হয় প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

খালকাটা বিপ্লব

৩১. জিয়াউর রহমানের সূচিত বিপ্লবের প্রথম ধাপ খালকাটা বিপ্লব। ১৯৭৯ সনের ১লা ডিসেম্বর এই বিপ্লব ঘােষিত হয়। এই কার্যক্রম মনিটর করার জন্য প্রেসিডেন্ট সচিবালয়ে সমন্বয় সেল গঠিত হয়। প্রচার করা হয় ৭৯ সন ও ১৯৮১ সনের মধ্যে ২৪৭৫.১৮ মাইল স্বেচ্ছাশ্রমে খালকাটা হয়েছে। এর ফলে ১৬ লক্ষ একর জমি সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। ফলে বার্ষিক ১৬ লক্ষ টন খাদ্য শস্য বেশী উৎপাদিত হবে। ১৪ ৮৫ সনের মধ্যে ৬০ লক্ষ টন অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদন করে রপ্তানী করা হবে। ১৫ প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেছেনঃ খাদ্য শস্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করবেন। কিন্তু খাদ্য শস্য উৎপাদনের চিত্রটা কি? ১৯৭৫ সনে আমন আউস বােরাে ফসলের উৎপাদন ছিলাে ১ কোটি ৩১ লাখ টন, ১৯৭৬-৭৭ সনে তা হ্রাস পেয়ে ১ কোটি ১৬ লক্ষ টনে দাঁড়ায়, ১৯৭৭-৭৮ সনে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিলাে ১কোটি ২৮ লাখ টন ১৯৭৮-৭৯ সনে তা হ্রাস পেয়ে ১ কোটি টনের নীচে নেমে আসেঘঘাষিত খালকাটা বিপ্লবঃ বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই

৩২. জিয়াউর রহমান যেখানেই খাল খনন উদ্বোধন করতে যান সেখানেই হাজার হাজার

লােক। কোদাল ওঠে শত-সহস্র হাতে। কেউ আসে উৎসাহে, কেউ আসে প্রেসিডেন্টকে এক নজর দেখতে। বিএনপি কর্মীদের ও ইউপি চেয়ারম্যানদের দক্ষতায় সব মিলিয়ে উৎসুক দর্শকের ভীড়। প্রগতিশীলরাও একদিন মাটি কাটার স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিয়েছিলেন এখন তাদের খাল কাটার বিপ্লব শেষ। 

৩৩. জিয়াউর রহমান স্বেচ্ছাশ্রমের কথা জোরেশােরেই বলছেন, কিন্তু কার্যত খাল কাটার বিপ্লবে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ ব্যয় করে চলেছেন। স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রকে এই কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত করে এস ডি ও, ডি সি গণ প্রাইভেট কার, জীপ, গাড়ি। রিকুইজিশন করে চেয়ারম্যান মেম্বরদের উপর চাপ সৃষ্টি করে, তেল খড় পুড়িয়ে এই খাল খননের কাজের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন। এবং এস, ডি, ; ডি, সি সাহেবরা এই খাল খননের কাজে জেলা এবং মহকুমা পর্যায়ে ব্যস্ত। তার ফলে। সরকারী কাজকর্ম প্রায় অচল। এতাে হৈ-চৈ আর সৌখিন কোদাল ধরার বাহারী উৎসবে উৎসাহের অন্ত ছিলােনা। দেদার খরচ হয়েছে দুহাতে। কিন্তু ধীরস্থিরভাবে খাল খননের এই কার্যক্রমকে পরিচালনা করলে বর্তমান খরচের তুলনায় ৪ গুণ কম খরচে এই মহা উৎসবসম্পন্ন করা সম্ভব হতাে। স্বেচ্ছাশ্রমের নামে মাটি কাটা শ্রমিকদের নিয়ে খাল কাটানাে হচ্ছে এবং তাদের। মজুরির টাকা জবরদস্তি করে স্থানীয় লােকদের নিকট থেকে আদায় করা হচ্ছে।  খাল কাটা বিপ্লবঃ খাল কাটতে হবে নতুবা মানুষ কাটা হবে ঃ একটি রিপাের্ট

৩৪. উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আহমেদ একটি খালকাটা প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রশাসনের তরফ হতে বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ও ছাত্রীদের উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলাে। সেদিন অসুস্থ থাকা সত্বেও কয়েকজন শিক্ষয়িত্রী চাকুরী হারানাের ভয়ে উপস্থিত হয়ে মাটি কাটায় অংশ নিয়েছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম মহকুমার এসডিও এবং ম্যাজিষ্ট্রেট পটিয়া থানার অধীন ২২টি ইউনিয়নে প্রাইমারি পিটি স্কুল, হাই স্কুল, ও কলেজের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং সরকারী কর্মচারীদের ওপর এই হুকুম জারি করেন যে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে দিতে হবে নতুবা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পিটি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্যতামূলকভাবে কয়েকবার মাটি কাটাতে নেওয়া হয়। কোন কোন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও কয়েক দিন মাটি কাটেন। কিন্তু দ্রুত এই হুকুম তামিলের স্বেচ্ছাশ্রমেভাঁটা পরলে পূর্বোক্ত সরকারী কর্তা ব্যক্তিরা নতুন নির্দেশ জারি করেন। তা হলাে স্বেচ্ছাশ্রম নয়, নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটিকাটার খরচা বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিতে হবে। আর তারপরই শুরু হয় জবরদস্তি টাকা আদায়। কেলিশহর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টাকা দিতে না পারায় ম্যাজিষ্ট্রেট তাদের গ্রেফতার, রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের দায়ে অভিযুক্ত করার ভয় দেখান এবং পদত্যাগ করতে বলেন। ইউনিয়নে কে কে টাকা দিচ্ছে না তার। নামের তালিকা ম্যাজিষ্ট্রেট দাবী করেন এবং গ্রেপ্তারের ভয় দেখান। ১৯ বলঘাট ইউনিয়নের গৈড়সা গ্রামের ইউপি সদস্য তাজুল ইসলামকে পটিয়ায় আটকে রেখে খালকাটার খরচের দোহাই দিয়ে তার এলাকার একটি পাওয়ার। পাম্প বাবদ পাঁচ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। ২৬শে ডিসেম্বর ৮০ পটিয়ার চেয়ারম্যান, গ্রাম সরকার প্রধান ও পাওয়ার পাম্প ম্যানেজারদের সভায় পটিয়ার এস, ডি ও এই বলে ধমক দেন যে, এবার খালকাটা, নতুবা মানুষ কাটা হবে। এভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটার নামে এক আমলাতান্ত্রিক ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। 

৩৫. স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটার জন্য টাকা ধার্য করা হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত সাধারণ কৃষক ও জনগণকেই তা বহন করতে হচ্ছে। প্রতি পাওয়ার পাম্প পিছু খাল কাটার চাঁদা বাবদ ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। পটিয়া রেজিষ্ট্রার অফিসে দলিল রেজিষ্ট্রি করার সময় দলিল প্রতি ১০ টাকা এ কারণে বেশি নেয়া হচ্ছে। লবণ ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। লবণের ব্যবসায়ীরা মণ প্রতি ১ টাকা দাম বাড়িয়ে সেটা পুষিয়ে নিচ্ছে। এভাবে অফিসসমূহে বা ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্য টাকা সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮০-৮১ সালে খালকাটার প্রহসন নিখুতভাবে বর্ণনা করেছেন। পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজের ঐ সময়ের ১ম বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্র সংসদের সহকারী আমােদ-প্রমোেদ সম্পাদক। পত্রটি নিম্নরূপঃ সরকার খালকাটা কর্মসূচী বাস্তবায়িত করার জন্য কলেজকে কয়েক লাখ টাকা। দেওয়া হয়েছিলাে। প্রথম দিন কলেজের সব ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্রায় তিন মাইল দূরে বাজিতপুর ঘাটে পদ্মার একটি শাখা নদী খনন করতে যান। উচ্চ পর্যায়ের একজন সরকারী অফিসারও সঙ্গে ছিলেন। দেখা গেল, খালকাটার চেয়ে ছবি তােলার প্রতিযােগিতা। এরপর কলেজের প্রত্যেকটি ক্লাস জনপ্রতি ৩০ টাকার বিনিময়ে দুদিন করে খালকাটার সুযােগ পেয়েছিল। অর্থাৎ প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য ৩০ টাকা ব্যয় করে খালকাটানাের চেষ্টা করা হয়। তারপরও কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে কিছু টাকা থাকায়, কলেজ প্রাঙ্গণে একটি পুকুর খনন করার চিন্তা করা হয়। ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে তখন নতুন পুকুর খনন না। করে পুরাতন দুটি পুকুরের সংস্কার করে, তাতে মৎস্যচাষের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে কলেজের আম বাগানের মধ্যে খাল। খনন করলেন মৎস্য চাষের আশায়। কিন্তু সেখানে মৎস্য বা কিছুই আর নেই। পত্র লেখক তাঁর গ্রামের একটি খালকাটা কর্মসূচীর কথাও উল্লেখ করেন। খালটি করতােয়া নদী হতে শুরু করে বিল পর্যন্ত প্রায় এক মাইল দীর্ঘ। এই খালের উদ্দেশ্য খরা মওসুমে অধিক ফসল উৎপাদন। কিন্তু এই খাল কাটতে গিয়ে বিপুল পরিমান ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে এবং ঐ জমিতে যে ফসল উৎপাদন হতাে, খালকাটার পর সে পরিমাণ ফসলও হয় নি। কারণ, খালে কোন পানিই নেই।

১. জিয়াউর রহমানের প্রিয় শ্লোগানের মধ্যে একটি ছিলাে মানি ইজ নাে প্রব্লেম।পাকিস্তানের সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও এরূপ কথা মাঝে মধ্যে বলতেন। আইয়ুব খানের সেই কথাকেই জিয়া রূপান্তরিত করেছেন রাষ্ট্রীয় দর্শনে। আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতার ভিত গড়ার লক্ষ্যে সমগ্র দেশকে বাইশ পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই বাইশ পরিবারই পাকিস্তানের অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাংক বীমা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতাে।

২. সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, “মানি ইজ নাে প্রব্লেমশ্লোগান দিয়ে ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট পূর্ববর্তী ২ জন কোটিপতির জায়গায় শতাধিক কোটিপতি তৈরী করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন ব্যাংকগুলাে জিয়ার রাজত্বে ২২ হাজার। কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে। এর মধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা আদায়ের অযােগ্য।

৩. জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ বলেছেন-খেলাপী ঋণের যে বড় অংশ এখন মাথা ব্যাথার কারণ, তার সিংহভাগ জিয়ার আমলে দেয়াতিনি আরাে বলেছেন, “এমনকি সার্কিট হাউসে বসে দরখাস্তের উপর লিখে দেয়া হতাে ঋণ দিন।জিয়ার আমলে শিল্পায়নের নামে দলীয় লােক দেখে দেখে আর্থিক সুবিধা দিতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত মূল্যের মাত্র ১০% শতাংশ মূল্যে পানির দামে রাষ্ট্রায়াত্তকৃত শিল্প দলীয় সমর্থকদের মধ্যে বেচে দেয়। সেই বিক্রির কিস্তির টাকা এখনাে আদায় হয়নি, যার পরিমাণ ২৪০ কোটি টাকা। ঋণ নিয়েছে, কিন্তু কেউ শিল্প গড়েনি। ঋণের টাকায় বাড়ি, গাড়ি, ভােগ বিলাস, বিদেশে পুজিপাচার, অন্যখাতে বিনিয়ােগ করেছে। বিএনপি আমলে শিল্পপতিনামে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা গােষ্ঠীর মধ্যে বেশীর ভাগই ফ্রডএটা শাসকদের প্রশ্রয়েই হয়েছে। 

৪. জিয়ার আমলে বিদেশী দাতা সংস্থার নির্দেশে শিল্প স্থাপনে শর্ত বেধে দেয়া হয় যে, বৈদেশিক মুদ্রায় প্রদত্ত ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার পরিবর্তিত দামে পরিশােধ করতে

হবে। পরিশােধের এই বিধান প্রকৃত শিল্পোদোক্তাদের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, ১৯৮১ সনেই মুদ্রামান হ্রাসের ফলে ১ ডলারের মূল্য ২০ টাকায় ওঠে। শিল্প মালিকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যবহৃত ঋণ পরিশােধ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮২ সনে সামরিক তদন্ত কমিটির সূত্রে অনুযায়ী জিয়ার আমলে শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থার ঋণ মঞ্জুরী বেঙ্গল কার্পেট, সােনালী পেপার এন্ড বাের্ড, আফতাব অটো মােবাইল, হাইস্পীড শিল্প বিল্ডিং এন্ড হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং, কাশেম টেক্সটাইলস, আরজান কার্পেট এন্ড জুট উইভিং মিল লিঃ, হাওলাদার ডাক পাইপ, ইসমাইল কার্পেট, নর্দান ডিস্টিলারিজ, চিটাগাং জুট মিলসসহ অন্যান্য শিল্প কারখানার বিনিয়ােগকৃত প্রায় ৪০০০ কোটি টাকার মধ্যে অধিকাংশের ক্ষেত্রে মালিকের বিনিয়ােগের গড় পড়তা হিসাব ছিলাে মাত্র ১০% ভাগ। ইসমাইল কার্পেট-এর মালিকের বিনিয়ােগ ছিলাে বেশী তাও মাত্র শতকরা ১৪.৮৮ ভাগ। এ সম্পর্কে একজন অর্থনীতিক বিশ্লেষক বলেছেন, “বাংলাদেশ বণিক পুজি শক্তিশালী করার মাধ্যমে কোটিপতি সৃষ্টির ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতি সহায়ক হয়েছে-শিল্পপতি সৃষ্টিতে নয়।

৫. ১৯৮১ সালে মুদ্রাস্ফীতির হার দাড়ায় শতকরা ২০% ভাগে, অথচ জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয় শতকরা ১.৬ ভাগ। ১৯৮০-৮১ অর্থ বছরে দেশের রফতানী থেকে আয় হয়েছে সাড়ে ১১শ৬০ কোটি টাকা, আমদানী ব্যয় সেখানে ছিল প্রায় ৫ হাজার ২শ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯শ৭৯ কোটি টাকা।

৬. বিশ্বব্যাংক জিয়ার আমলের ৮১ সনের এক রিপাের্ট বলেছে বাংলাদেশ তার ক্ষমতার বাইরে আর্থিক লেনদেন, আমদানী ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করার ফলে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সংকটাপূর্ণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।জিয়াশাহীর লাগামহীন এবং স্বৈচ্ছাচারী আর্থিক পদক্ষেপের ফলেই বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পেতে পেতে জুন মাসের শেষ দিকে ৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের নীচে নেমে এসেছে। আই এম এফ মনে করে আমদানী ও রফতানী বাণিজ্যে ২৯৭৯ কোটি টাকা ঘাটতি সত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার সুষ্ঠু ব্যবহার ও মূল্যায়ন করা হচ্ছেনা। মানি ইজ নাে প্রব্লেম‘- শ্লোগানটি ছিল বিদেশ থেকে যে কোন শর্তে ঋণ এনে দেশে একনায়ক সুলভ ক্ষমতার ভিতকে শক্ত করা। স্বভাবতই বাংলাদেশের মত একটি গরীব দেশের জন্য সাহায্য প্রয়ােজন। প্রয়ােজন উৎপাদন ঘাটতি দূর করার জন্য, সীমাহীন দারিদ্র বিমােচনের জন্য। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজেই বেপরােয়াভাবে ঋণের অর্থ অপচয়ে উৎসাহ দিয়েছেন। জনগণের সার্বিক কল্যাণ চিন্তা না করে মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থ রক্ষার জন্য অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ ব্যয়িত হয়েছে।

৭. ৩০ কোটি টাকা ঋণ করে সাদা-কালাে টেলিভিশনকে রঙিন করার যন্ত্রপাতি আমদানী খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। ৫৭ কোটি টাকা ঋণ করে সােনারগাঁও হােটেল নির্মিত হয়েছে। কোটি কোটি বিদেশী ঋণে নির্মিত হচ্ছে গােল্ড হিল কমপ্লেক্স। কিন্তু এসব অর্থ ব্যয় করে স্থাপন করা হচ্ছে না কলকারখানা যা উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যা কোটি কোটি মানুষের বেকারত্ব দূরীকরণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে ঋণ বাড়ছে। কিন্তু দারিদ্য ঘুচছে না। ৭৩-৭৪ সনের ঋণের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ১৪ লাক্ষ ডলার। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে তা পৌছে ৩৩৬ কোটি ১৫ লক্ষ ডলারে অর্থাৎ বেড়েছে ৭ গুণ। সরকারী পরিসংখ্যাণে দেখা যায় খাদ্য সংকটের সময়েও (৭৪-৭৫) বছরে গড়ে প্রতিটি মানুষ খাদ্য পেয়ে ৩৫৬ পাউন্ড, কিন্তু ৭৮-৭৯ সনে পেয়েছে ৩২৯ পাউন্ড। ১৯৭৫-৭৬ সনে খাদ্য আমদানী। করতে হয়েছে ১৪.৪০ টন ৭৯৮০ সনে ২৭.৭৮ লক্ষ টন। দিন দিন ভাতের থালা থেকে ভাত কমে গেছে। জিয়াউর রহমান শর্তহীনভাবে বাংলাদেশকে দাতা দেশগুলাে, আই এম,এফ ও বিশ্ব ব্যাংকের নিকট দায়বদ্ধ করে ফেলেছে। বিশ্ব ব্যাংকের নীতিই হলাে, ‘ঋণ কর, উড়াও, আবার ঋণ কর।এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জোরালে কণ্ঠেই বলেছেন, ‘মানি ইজ নাে প্রব্লেম।

৮. জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে লাভজনক শিল্প কারখানাকে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে এবং পানির দামে দলীয় সমর্থকদের মধ্যে তা বেচে দেন। বাহ্যত এসব করা হচ্ছিলাে রাষ্ট্রায়াত্ত খাতে লােকসান, অদক্ষতা ইত্যাদি অজুহাত তুলে; সর্বোপরি জনগণের কল্যাণের দোহাই দিয়ে। কিন্তু বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে বাস্তবে যা ঘটেছে তা হলাে এই সুবিধাজনক বিনিময় সময়ে পাটকল মালিকরা প্রায় ৩০০ কোটি টাকা এবং বস্ত্রকল মালিকরা প্রায় ১৫০ কোটি টাকা লাভ করেছিলেন বা সঠিক অর্থে বললে জনগণকে ফাঁকি দিয়েছেন, যদিও তা সরকারের অজানা ছিলােনা। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার পাটকলগুলি ব্যক্তিগত খাতের মালিকরা লাভ করেছেন মাত্র ৫ কোটি টাকায় এবং তাও পাওনা অর্থের মাত্র এক পঞ্চমাংশ প্রদানের মাধ্যমে। বাকী অর্থ অনেক কমসুদে ৯টি কিস্তিতে পরিশােধের কথা ছিলাে। সেটুকুও করতে তারা গররাজি, এসব মালিকরা আরাে নতুন সুবিধার জন্যে দাবি উত্থাপন করেছে। আগে রাষ্ট্রীয় খাতকে ভর্তুকী দিয়ে বাংলার পাটচাষীকে বাঁচাননা হতাে, এখন ভর্তুকী দিয়ে মুষ্টিমেয় ধনিককে পােষা হচ্ছে।
লােকসানের অজুহাতে লাভজনক/অলাভজনক সমস্ত শিল্পই নাম মাত্রমূল্যে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিগতখাতে। অধ্যাপক রেহমান সােবহান ও এ আহমেদ আহসান প্রদত্ত তথ্যাবলী থেকে এটাও প্রমাণিত যে, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলির ক্ষেত্রেও বিরাষ্ট্রীয়করণের পর ব্যক্তিগত খাত তাদের অবস্থা উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। ২৪টি কারখানার বিরাষ্ট্রীয়করণের জরীপ থেকে জানা যায় যে, এর মাত্র ৮টির ক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণের পর আগের তুলনায় লাভ বেড়েছে বা লােকসান কমেছে। পক্ষান্তরে, বাকি দুই তৃতীয়াংশে কারখানারই পরবর্তী পারফরমেন্সপূর্বের তুলনায় আরাে অবনতি হয়েছে। ৫টি কারখানা তাে একদম বন্ধই হয়ে গেছে, ৭টিতে নতুন করে লােকসানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পূবের ৪টি লাভজনক। কারখানা বর্তমানে লােকসান দিতে শুরু করেছে। বিরাষ্ট্ৰীয়করণের পর প্রায় সর্বত্রই ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে এবং সর্বত্রই নিয়মিত শ্রমিকের বদলে বদলী শ্রমিক নিয়ােগ প্রচন্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিরাষ্ট্রীয়কৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ইউনিটগুলি টেন্ডারে বিক্রি করা হয়েছিলাে এবং ক্রেতা মালিকরা এখন ধার্যকৃত দামের মাত্র এক পঞ্চমাংশ টাকা প্রদান করে মিল ইউনিটগুলাের মালিক হয়ে বসেছিলেন। বাকি টাকা বার্ষিক ৮ শতাংশ সুদে কিস্তিতে শােধ করার নিয়ম ঠিক হয়। কিন্তু ইউনিটের নমুনা জরীপের হিসাব অনুযায়ী নতুন মালিকদের কাছে এখন পর্যন্ত সুদসহ মােট পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪৩ কোটি টাকা। তদুপরি, এর মধ্যেই ৮১ কোটি টাকা মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের তালিকাভুক্ত হয়েছে। তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী শফিউল আজম নিজেই এক সভায় ঘােষণা করেন যে, জিযার আমলে ব্যক্তিগত খাতে অনুমােদিত মােট শিল্পের শতকরা ৩০% ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি। ১০

৯. ব্যক্তিখাতে ঋণ কেলেংকারি উদঘাটিনের জন্যে সরকার জনৈক বিগ্রেডিয়ারের

নেতৃত্বে যে সামরিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন, তার রিপাের্টের যে সামান্য অংশ প্রকাশ পেয়েছে তা থেকে জানা যায়, ১১ বছরে বি.এস.বি এবং বি.এস.আর, এস, যে ১২৪৮টি শিল্প প্রকল্পের অনুমােদন দিয়েছিলাে তার মাত্র ৩৬% শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। তাও এগুলাের অধিকাংশ এখনাে সাইনবাের্ড সর্বস্বই বলে জানা গেছে, উৎপাদন শুরু হয়নি। আরাে বলা হয় যে, রাষ্ট্রীয়ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি মাত্র ১১ জন শিল্পতিকে মােট ৩৮৯ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছে এবং এর মধ্যে ২০৭ কোটি ১৬ লক্ষ ৮২ হাজার টাকার ঋণ এখনই তামাদি হয়ে গেছে। উল্লেখিত দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেংকারী বর্তমানে এমন এক মাত্রা যােগ করেছে যে বিদেশী দাতা দেশগুলিরও তা নজরে এসেছে।

১০. জিয়ার আমলে মুষ্টিমের ধনীকরা রাষ্ট্রীয়ও খাত থেকে যে ঋণ নিয়েছেন সেগুলি তারা আরা পরিশােধ করেননি। একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিবেশিত খবর থেকে জানা যায় যে, মাত্র ৯টি ধনীক পরিবার ১৯৮২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসব গ্রুপের নামধামও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এদেরকে খারাপ দেনাদার (bad borrowar) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে এদের যােগাযােগ, প্রভাব ও ঘুষ প্রদানের ব্যবস্থা থাকায় কাউকেই শাস্তি ভােগ করতে হয়নি।

১১. শুধু শিল্পোদ্যোগই নয় জিয়াউর রহমানের সরকার ব্যক্তিগত খাতে ব্যাংক স্থাপনের , অনুমতি দেয়ার পর সেখানেও চালু হয়েছে এক অবিশ্বাস্য তােঘলকি কান্ড। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এ যাবৎ প্রতিষ্ঠিত ৬টি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ব্যাংকের ১৫ জন ডিরেক্টর নিজেরা তাদের ব্যবসার নামে ৮২ সাল পর্যন্ত ১২৫ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ধার নিয়েছেন, অথচ সমস্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের মােট মূলধনই হল মাত্র ৪৮ কোটি টাকা। 

১২. এই সংক্ষিপ্ত চিত্র থেকেই একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ৭৫ পরবর্তীকালে বিরাষ্ট্রীয়করণের নামে যথেচ্ছা লুণ্ঠনের পথ অবারিত করা হয়েছে। মুষ্টিমেয় এসব ধনীক গ্রুপের পক্ষে এরূপ অর্থ আত্মসাৎ করেও সুনাম ও যশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। কারণ একটাই, সেটা হলাে জিয়ার শাহীর সঙ্গে রয়েছে এদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। বস্তুতঃ এটিই তাদের অন্যতম পুজি। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে জিয়া সরকারের নীতিমালা প্রণীত হয়েছে এইসব ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে। প্রকৃতপক্ষে ভর্তুকী, লুটপাট, , ডি, এবং ঋণ নিয়ে দেশকে লুটে-পুটে ফোকলা করে দিয়েছে দেশের লুটেরা ধনীক গােষ্ঠী। কিন্তু প্রভাবশালী প্রচার মাধ্যমগুলি এদের পক্ষে কাজ করায় জনগণ এসব তথ্য জানতে পারেনি। জনগণকে সঠিক তথ্য জানতে দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে, গণতান্ত্রিক অধিকার না থাকায় দেশের জনগণও তাদের সঠিক নিরপেক্ষ অভিমত ব্যক্ত করার সুযােগ পায়নি। জিয়ার আমলঃ ক্যালােরী চিত্র ১৫. ওজনের হিসেবে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গ্রামীণ মানুষ দৈনিক গড়পরতা ৮৮৬ গ্রাম খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ করতেন। ১৯৭৫-৭৬ সালেও এই খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৮০৭ গ্রাম। কিন্তু ১৯৮১-৮২ সালে এই ভােগের পরিমাণ মাত্র ৭৬৪ গ্রামে এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের দৈহিক গড়ন ও কাজের হিসেবে প্রতিদিন ২২৭৩ ক্যালােরীর প্রয়ােজন। ১৯৭৫-৭৬ সালেও এদেশের মানুষের দৈনিক গড়পরতা ক্যালােরী গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২০৯৪। আর ১৯৮১-৮২ সালে ক্যালােরী গ্রহণের গড়পরতা পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯৪৩ যা নিম্নতম প্রয়ােজনের তুলনায়ও শতকরা ১৫ ভাগ কম। ১৯৭৫-৭৬ সালে। বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ ভাগ মানুষ প্রয়ােজনীয় খাদ্যভােগ করতে সক্ষম ছিলাে। আর ১৯৮১-৮২ সনে এই পরিমাণ শতকরা ৭৬ ভাগে এসে ঠেকেছে অর্থাৎ জিয়ার রাজত্বে শতকরা তিন চতুর্থাংশের বেশী নাগরিকরাই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। প্রােটিনের হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ সালে শতকরা ৭২ ভাগ পরিবারের লােকেরা প্রয়ােজনীয় প্রােটিন ভােগ করেছেন। কিন্তু ১৯৮১-৮২ সালে মাত্র শতকরা ৪৮ ভাগ পরিবারের পক্ষে প্রয়ােজনীয় প্রােটিন ভােগ করা সম্ভব হচ্ছিল। ১৩ উপরিউক্ত তথ্য থেকেই বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরােত্তর ঘনীভূত হওয়ার বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। এই সংকটের একটা দিক হলাে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মানুষের আয় ক্ষমতা হ্রাস। ফলে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর আস্থা এই সময় উন্নতির বদলে দ্রুত অবনতির দিকে ধাবিত হয়েছে। মানি তাদের নিকট প্রব্লেম হয়েই থেকেছে।

জাতীয় আয় বৃদ্ধি হয়নি 

১৩. অনুৎপাদনশীল খাতে মুষ্টিমেয় ধনীক গােষ্ঠীকে কোটি কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হলেও সেক্ষেত্রে কর্মক্ষম এই বিশাল জনগােষ্ঠির জন্যে কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং বিভিন্ন রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তরের ফলে হাজার হাজার কর্মরত শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। এবং এটাও হয়েছে সরকারী নীতিমালার বদৌলতে। কর্মপ্রার্থী ও কর্মে নিয়ােজিত শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান আমাদের অর্থনীতির ভয়াবহ বিপর্যয়ের সুদূর প্রসারী ইঙ্গিত বহন করে। আয় স্বাধীনতার পরবর্তী তিন বছরে বাৎসরিক গড়পরতা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৯ ভাগ। জিয়ার আমলে তা দ্রুত গতিতে হ্রাস পায়। উপর তলার শতকরা ১০ভাগ ব্যক্তিরা মােট আয়ের ৪৫% ভাগ ভােগ করেন, আর নীচু তলার শতকরা ৪০ জন মাত্র ১৫% ভােগ করে থাকেন। 

১৪.জিয়ার আমলে ঃ দ্রব্যমূল্য 

১৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালেই দ্রব্যমূল্যকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এমনকি বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খাদ্য উৎপাদন, বিশ্ব বাজার, দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক

অবস্থা সবকিছুই ছিল একটা অনুকূল স্থিতিশীল পর্যায়ে। তা সত্ত্বেও, ১৯৭৫-এর তুলনায় ১৯৭৮-৭৯ সন থেকে আরম্ভ করে ৮১ পর্যন্ত সময়ে দ্রব্যমূল্য প্রতিবছর শতকরা ১২ থেকে ১৫ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৫ উপরে উল্লেখিত করুণ চিত্র থেকে মানি ইজ নাে প্রব্লেমশ্লোগানের নগ্ন দিক বেরিয়ে এসেছে।নব্য পরগাছা ধনী

১৬. জিয়াউর রহমানের মানি ইজ নাে প্রব্লেমশ্লোগানের নেপথ্যে দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোন গতিশীলতা না এসে দেশে ব্রীফকেসধারী নব্যধনী সম্প্রদায়ের বিকাশ হতে থাকে। নব্য ধনী সম্প্রদায়ের বিকাশের মূল প্রক্রিয়া মুৎসুদ্দি হলেও এই প্রক্রিয়ার সংস্কৃতি স্বভাবতই দেশের ভেতরের সম্পদও বিভিন্ন নীতি বিবর্জিত উপায়ে আত্মসাৎ করতে উৎসাহ দেয়। এইভাবে দেশের নিজস্ব সম্পদও পুনবন্টিত হয়ে এক পরগাছাসম্প্রদায়ের কাছে চলে যেতে শুরু করে।এই লুটেরা ধনীকদের মােড়ল জহিরুল ইসলাম। জিয়াউর রহমান কর্তৃক তার পৃষ্ঠপােষকতার দলিল প্রকাশিত হয় এক সামরিক তদন্তে।

১৭. জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের লুটেরা ধনীক শ্রেণীকে জনগণের টাকা ও জনগণের জন্য সংগৃহীত বিদেশী ঋণ অনুদানের টাকা লুট করার যে সুযােগ দিয়েছেন ১৯৮২ সনে সামরিক তদন্ত কমিটির রিপেৰ্টে তার কিছু বিবরণ রয়েছে। জিয়া অকারণে এদের টাকা লুট করতে দিয়েছে এমন নয়। এসব লুটেরাও জিয়াকে দিয়েছে কোটি কোটি টাকা। কোটি কোটি টাকা হাতে পেয়ে জিয়া বলে বেড়াতেন মানি ইজ নাে প্রব্লেম।জিয়া কীভাবে ধনীক লুটেরাদের সাহায্য করেছে। এ প্রসঙ্গে শুধু বাল্লাদেশের অন্যতম ধনী জহুরঙ্গ ইসলামের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জহুরুল ইসলাম যুৎসই অবস্থানে চলে আসেন। আসলে চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যে জিয়াউর রহমান আর জহুরুল ইসলামরা এক, জিয়া তার ক্ষমতাগ্রহণের বিভ্রান্ত কৌশলটি থেকে শুরু করে পরবর্তী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকেই দুর্নীতিগ্রস্ত করেন। রাজনীতিবিদদের চরিত্রকে টাকা দিয়ে কিনে নেয়া, দল ভাঙ্গানাে, প্রতিটি গণতানিক ইনস্টিটিউশনকে ভেঙ্গে ফেলা বা নিজের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে-জিয়াউর রহমান ছিলেন অদ্বিতীয়। অন্যদিকে দুর্নীতির শিকড়কে জহুরুল ইসলাম মন্ত্রী, সচিব, রাষ্ট্রদূত আর ব্যাংকগুলাের উচ্চমহলে অবাধে বিস্তার করে রাখেন। জিয়ার ক্যাবিনেটে জহুরুল

ইসলামের বেতনভুক্ত দুজন কর্মচারী মন্ত্রী ও ছিলেন। হাবিবুল্লাহ খান ও জাকারিয়া চৌধুরী। 

১৮ .মার্শাল ল ইনভেস্টিগেশন রিপাের্ট

জহুরুল ইসলাম গ্রুপের ১২টি প্রতিষ্ঠান। বলাবাহুল্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক। জহুরুল ইসলাম নিজে এবং বিরাট পরিমাণ টাকা এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক থেকে তােলা হয়েছে ১, মিলনার্স লিমিটেড,২. ঢাকা ফাইবারস লিমিটেড,৩. নাভানা স্পাের্টস লিমিটেড,৪. ইসলাম শিপিং লিমিটেড, ৫. নাভানা লিমিটেড, ৬. ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ৭. আফতাব অটোমােবাইলস লিমিটেড, ৮. এসেনশিয়াল প্রােডাক্টাস, , বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট (আরব আমিরাত) লিঃ, ১০. ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড, ১১. নাভানা এন্টারপ্রাইজ (যুক্তরাজ্য) লিমিটেড, ১২. আল হামারা গ্লাস ইন্ডাষ্ট্রিজ।  ‘লুটেরা ধনিক গােষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র জহুরুল ইসলামই নিজস্ব লুটপাটের সীমা দেশসহ দেশের বাইরে পর্যন্ত ব্যাপক বিস্তৃত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলাের বৈদেশিক শাখাসমূহ থেকে জহুরুল ইসলামের তথাকথিত বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট ও নাভানা লিমিটেডের নামে বিরাট পরিমাণ ঋণ অনুমােদন করা হয়েছে। জহুরুল ইসলামের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের অনাদায়ী এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের টাকার পরিমাণটা সামরিক তদন্ত কমিটির সূত্র মতে ১১২ কোটি ৪২ লক্ষ। সামরিক তদন্ত কমিটি জহুরুল ইসলাম গ্রুপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনাদায়ের এরকম বর্ণনা দিচ্ছে । মিলনার্স লিমিটেডঃ ২৮-২-১৯৮১ সালে অগ্রণী ব্যাংক তাদের ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ। মঞ্জুর করে। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশােধ না করায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় ১৮-৫-১৯৮২ তারিখ পর্যন্ত ৬১.৩৩ লক্ষ টাকা। জনতা ব্যাংকও প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৪ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। তাও অপরিশােধিত। ইসলাম শিপিং লিমিটেড ১৯৮০ এর মার্চে সােনালী ব্যাংক ইসলাম শিপিং লিমিটেডের নামে ২৭ লক্ষ টাকার ঋণ অনুমােদন করে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে আরাে ১ লক্ষ টাকা পরিশােধ করা হয়। সুদসহ অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ থেকে যায় ২২.০৯ লক্ষ টাকা। নাভানা লিমিটেড ঃ গাড়ী আমদানী করার জন্য জহুরুল ইসলাম নাভানা লিমিটেড। স্থাপন করেন। সােনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে এক বছরের জন্য ১৯৮০ সালে ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সামরিক তদন্তকালীন সময় পর্যন্ত যা মূলতঃ অনাদায়ীই রয়ে গেছে।

ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডঃ প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণদাতা ব্যাংক হচ্ছে পূবালী ও সােনালী। পূবালী ব্যাংক দেয় তিন কোটি সাড়ে বার লক্ষ টাকা। ১ কোটি ৭১ লক্ষ টাকার অংক অনাদায়ী রয়েছে। সােনালী ব্যাংকও অজ্ঞাত পরিমাণ টাকার কাঁচা পাট বন্ধক রেখে ১৯৭৬-৭৭ সালে ৬০ লক্ষ টাকা ঋণ দেয়। বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিঃ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৬ সালে আবু ধাবিতে ৫০০০ গৃহ তৈরীর অর্ডার পায়। জনতা ব্যাংক আবুধাবি শাখা হতে ঋণ মঞ্জুর করা হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৮২ এই ঋণের অনাদায়ী পরিমাণ ১৫ কোটি ৮৯.৮০ লক্ষ দিরহাম। উল্লেখ্য বেঙ্গল ডেভেলপমেন্টের এই কাজটির মূল্যমান ছিল ৪৭৩.৭৫০ মিলিয়ন দিরহাম। ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে কাজ শুরু করার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তা ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে শিফট করা হয়। সময় নির্ধারণ করা হয় তিন বছর। সেই হিসেবে ১৯৮০ সালের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবার কথা। এবং ব্যাংকের ঋণও পরিশােধ হবার কথা। ১৯৮১ সালে ২০ এপ্রিল তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি দল আবুধাবীতে পৌছেন। আরাে ১ লাখ ৩০ হাজার দিরহাম ঋণ অনুমােদনের সুপারিশ করেন। যথা সুপারিশ তথা কার্য। মধ্যপ্রাচ্যের এই কাজটির জন্য শ্রমিকদের যাতায়াত ও বেতন ভাতার নাম দিয়ে জনতা ব্যাংকের ঢাকাস্থ শাখা থেকে ১ কোটি ৬৬.৯৩ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করে। ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে ঋণটি বিতরণ করা হয়। এবং ১৯৮২ সালে সেটা নবায়ন করা হয়। আফতাব অটোমােবাইলস চট্টগ্রাম জহুরুল ইসলামের গাড়ী এসেম্বলী করার কারখানা। ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সহ প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আফতাব অটোমােবাইলসের আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছিল ৭কোটি ৭ লাখ। পরে পুননির্ধারণ করা হয় ৭ কোটি সাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। এই হিসাবের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ১৯৮১ সালের মধ্যে এপ্রিলে ৩ কোটি টাকার এল/সি ঋণ মঞ্জুর করে। সাথে ২ কোটি ২.৭১ লক্ষ টাকার নগদ ঋণ অনুমােদন করে। নাভানা এন্টারপ্রাইজ (যুক্তরাজ্য) লিঃ জহুরুল ইসলামের এটি একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। অবস্থান লন্ডনে। ১৯৭৯-এর এপ্রিলে সােনালী ব্যাংকের লন্ডন শাখা জহুরুল ইসলামকে নাভানা লিমিটেডের বিপরীত ৫.৫০ লক্ষ পাউন্ড ঋণ প্রদান 

করেন। সর্বশেষ ওভার ড্রাফটের পরিমাণ ৩৪ লক্ষ পাউন্ড। আর ৩১.১২.১৯৮১ তারিখ পর্যন্ত অনাদায়ী ঋণ ৪১.১৬ লক্ষ পাউন্ড। বাংলাদেশী মুদ্রায় ১৬ কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা। এছাড়া মুদ্রা পাচার করে জহুরুল ইসলামের লন্ডনে কিনেছে ৩০ লক্ষ পাউন্ডের দুটি বাড়ি। সামরিক তদন্ত কমিটির মতে জহুরুল ইসলামের ঋণ পরিশােধের ক্ষমতা সীমিত। এবং ব্যাংক একজন মাত্র ব্যক্তিকেই এই বিরাট পরিমাণ ঋণ দিয়ে প্রচলিত নিয়মের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে। যেখানে বিভিন্ন ব্যাংকে জহুরুল ইসলামের আরও বিরাট অংকের ঋণ রয়েছে।

জহুরুল ইসলাম নয়ঃ জিয়ার

পাঠকের একথা মনে করার কারণ নেই যে, ব্যক্তি জহুরুল ইসলামের ফিরিস্তি। দেয়া হচ্ছে। আসলে ঘটনাটি তা নয়। জিয়াউর রহমানের আমলে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ঋণ আনা হয়েছে তা কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার এটি একটি উদাহরণ। অভিযােগে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের তিনটি নির্বাচন ও বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচনে জহুরুল ইসলাম কোটি কোটি টাকা তুলে দিয়েছিলেন।  

বৈদেশিক সাহায্য ঃ মানি ইজ নাে প্রব্লেম 

১৯. বহিঃসম্পদ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহের পর্যালােচনা করলে দেখা যায় জিয়াউর রহমানের রাজত্বে ১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮০-৮১ অর্থবছর পর্যন্ত মােট ১০৮১৪ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্য এদেশে এসেছে। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বিনিময় হার অনুসারে ১৯৭৫-৭৬ সালে পেয়েছে ১২২৩ কোটি টাকা, ১৯৭৭-৭৮সনে পেয়েছে ১৫৫৬। কোটি টাকা, ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে ২৩৫০ কোটি টাকা ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে পেয়েছে ২৯০৯ কোটি টাকা। ১৯৮০-৮১ সালের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার। অনুসারে জেনারেল জিয়ার শাসন আমল (১৯৭৫-৭৬ থেকে ১৯৮০-৮১) পর্যন্ত। মােট বিদেশী সাহায্য (ঋণ ও অনুদান) হিসাবে মােট ১১,৬৩৩ কোটি টাকা গ্রহণকরেছে। ১৯ এই বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ও বাস্তব সম্মত ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে একটি সুষ্ঠু ভিত্তির সূচনা করা যেত। কিন্তু বস্তুতঃ এই সাহায্যের মূল অংশই রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার। হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্যের প্রায় পুরােটাই জিয়াউর রহমান কিছু। মুষ্টিমেয় লােকের হাতে তুলে দিয়ে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান সুসংহত করতে চেয়েছেন। 

২০. বৈদেশিক সাহায্যের একটি উল্লেখযােগ্য অংশ বৈদেশিক ঋণ, যা সুদসহ একটি নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরৎ দিতে হয়। জিয়ার আমলে বৈদেশিক ঋণের বােঝা শুধু বেড়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে বৈদেশিক ঋণ ছিলাে ৫১৭ কোটি টাকা তা। ১৯৮১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৯৩৭ কোটি টাকা। এত বিপুল পরিমাণ ঋণ তিনি এদেশের সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। ঋণের সময় তিনি সুদের হারের দিকেও দৃষ্টি দেননি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদের হারের উল্লেখযােগ্য বৃদ্ধি সত্বেও অপ্রয়ােজনীয় ঋণ গ্রহণ করেছেন। যার সুদূর প্রসারী প্রভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে পরেছে। রাপ্তানী আয়ের বিরাট অংশ এই ঋণ পরিশােধে ব্যয় করা হচ্ছে। ৮০-৮১ সালে বৈদেশিক সুদ সহ ঋণশােধের দায় দায়িত্ব মােট রপ্তানী আয়ের ৩৮% ভাগে এসে দাঁড়ায়। যাহা ১৯৭৩-৭৪ সালে ছিলাে মাত্র ৪% ভাগ।২০

২১. বৈদেশিক অর্থে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ড যথাযথ সমাপ্তিও সময় মত করতে পারেননি। অনেক অপ্রয়ােজনীয় প্রকল্পে অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির অগ্রাধিকারকে প্রধান্য দেয়া হয়নি। ব্যক্তি বিশেষের বাণিজ্যিক সুবিধা প্রসরের দিকে বেশী নজর দেয়া হয়েছে।

২২. প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের দুটি প্রধান অংশ একটি অনুদান অপরটি বৈদেশিক ঋণ। অনুদানের অর্থ ফেরত দিতে হয় না। কিন্তু ঋণ এর অর্থ পরিশােধ করতে হয়। জিয়ার আমলে অনুদানের এবং ঋণের অনুপাতে ব্যাপক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। শতকরা হিসাবে জিয়ার আমলে গড় বৈদেশিক সাহায্যের ঋণের অংশ ৬৫%। আর অনুদান ৩৫% বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় ২০% ছিলাে ঋণ এবং অনুদান ছিলাে ৮০%। বিশেষগােষ্ঠীদের অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়ায় অপ্রয়ােজন খাতে ব্যপক দুর্নীতি বেড়ে যায়। রাজনৈতিক স্বার্থে পরিচালিত জিয়ার বৈদেশিক সাহায্য নীতির ফলে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতি দ্রুত কমে আসে। বাংলাদেশে পরিসংখ্যানে ব্যুরাের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় জিয়ার মৃত্যুর সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে মাত্র ৮ কোটি ৩৬ লক্ষ ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিলাে। এটা ছিলাে জিয়ার মানি ইজ নাে প্রব্লেম এর রাজনৈতিক মাহাত্ম্য। এই রিজার্ভ দেশের একমাসের চাহিদাও মেটাতে অক্ষম। বৈদেশিক সাহায্যের সাথে দাতা দেশ দেয় বিভিন্ন শর্ত, যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে থাকে বিদেশী পণ্যের জন্য দেশের বাজারকে খুলে দেয়া। জিয়াউর রহমান এই প্রক্রিয়ার শর্তে দেশকে উৎপন্ন নির্ভর না করে আমদানী নির্ভরতার দিকে পরিচালিত করেছেন। রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরাে পরিকল্পনাগুলাে কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, জিয়ার আমলে আমদানী ব্যয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানী ও রপ্তানীর পার্থক্য ক্রমে বেড়েই গিয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে পন্য বাণিজ্যের ট্রেডিং ব্যালান্স ছিলাে ৪৩৫ কোটি টাকা, সেখানে ১৯৮০৮১ সালে হয়েছে ২,৯৭৯ কোটি টাকা। দেশকে এই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির দিকে ঠেলে দিয়ে দেশের উৎপন্ন ব্যবস্থাকে করে ফেলেছে ছিন্নভিন্ন।

জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সার্বভৌম জাতীয় সংসদ

১. ১৯৭৮ সনের ৩রা জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ১৯৭৯ সনে ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে সামনে বলা হচ্ছিল দেশে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠিত হবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সংবিধানের যে সংশােধনী ঘােষণা করেছেন সে সম্পর্কে জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট সংবিধানের যে সংশােধনী ঘােষণা করেছেন উহাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিই থাকার কথা বলা হইয়াছে। এমন ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচিত সংসদ প্রেসিডেন্টের নিকট অনুগত থাকিবে। তাহারা বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়ার সংবিধান সংশােধনী বাকশালের চতুর্থ সংশােধনী অপেক্ষাও বেশী অগণতান্ত্রিক ও মহাবাকশালী।

. ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত

২. পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর ৬ই এপ্রিল জেনারেল জিয়াউর রহামান সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সরকারী দলের নেতৃবৃন্দ ও মুসলিম লীগের সবুর খান এই পদক্ষেপকে ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্তবলে উল্লেখ করেছেন। জাতীয় ঐক্য ও দুঃখী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। এবং শােষিত মানুষের কল্যাণে জাতির জনক রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সনের ১৫ ই আগস্টের পর হতে ৩ বছর ৫ মাস ২১ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ একটানা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারপ্রতিষ্ঠার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বৈরাচারবলা। হয়েছে, ‘গণতন্ত্র হত্যাকারী’, ‘বিশ্বাসঘাতককত কিছুই না অপবাদ হয়েছে।

১৯৭২ সনের পার্লামেন্টারী ডেমােক্রেসী হতে প্রেসিডেনশিয়াল পদ্ধতিতে রাষ্ট্র। পরিচালনার জন্য শাসনতান্ত্রিক এই পরিবর্তনকে স্বৈরাচারী পদ্ধতিবলে অভিহিত করে জিয়াউর রহমান কমপক্ষে একহাজার দিবস রজনী দেশময় চিৎকার করেছেন।৪

জিয়ার সংবিধান ও স্বৈরাচার পদ্ধতির স্থায়ী রূপ

৩. সংবিধানই যদি একটি সরকারের চরিত্র নির্ধারণ করে থাকে চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে জাতীয় দলের হাতে যে রাষ্টীয় ক্ষমতা অর্পিত হয়েছিল ৫ম সংশােধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান তা একব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশােধনীকে বিল হিসেবে উথাপন করে জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে পাশ করিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, মীজান। লীগ, ন্যাপ, জাসদ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাতীয় একতা পার্টির নেতৃবৃন্দ ৫ম সংশােধনী পাশের বিরুদ্ধে সংসদে ওয়াক আউট করেছে। এবং আতাউর রহমান খান, সবুর খান সহ ২০ জন সদস্য ভােট দানে বিরত ছিলেন। তারা ওয়াক আউট করেনি। জাতীয় সংসদে ৫ম সংশােধনী পাশ করার মাধ্যমে স্বৈরাচারী পদ্ধতির স্থায়ী রূপ পেলাে। গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী প্রায় ৫ শত সামরিক ফরমান, আদেশ, বিধান, প্রবিধান, বিধি, বিজ্ঞপ্তি, একই সাথে পাশ হয়ে গেলাে। পাশ হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই আগস্টে যেভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে তার বিচারের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবকারী বিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ও কর্ণেল (অবঃ) তাহের সহ হাজার হাজার হত্যাকাণ্ডও বৈধ হয়ে গিয়েছে।

আইয়ুব খানের পথ ধরে 

৪. সামরিক শাসন তুলে নেয়ার জন্য জেনারেল জিয়া যে অনন্য সাধারণ দৃষ্টিান্ত স্থাপন করেছেন বলে বলা হচ্ছে, জিয়ার পূর্বসূরী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানও নির্বাচন দিয়ে, শাসনতন্ত্র দিয়ে, মার্শাল ল তুলে নিয়ে, নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে নিকট অতীতে চেষ্টা করেছেন। পার্লামেন্ট আইয়ুব খানের আমলেও ছিল। কিন্তু বাস্তবে প্রমাণিত সকল ক্ষমতা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পাকিস্তানে যে শাসন ব্যবস্থার পত্তন হয়েছিলাে, তা কোনােক্রমেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিলােনা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উত্তরসূরী লেঃ জেনারেল জিয়া সেই কাজটিই করেছেন রাবার স্ট্যাম্প থেকে 

৫. প্রেসিডেন্ট জিয়া সার্বভৌম সংসদের নামে পার্লামেন্টকে তার স্বেচ্ছাচারী কর্মকান্ডের রাবার স্টাম্প হিসেবে ব্যবহার করছেন। বিশেষ ক্ষমতা আইন, কালাকানুন , প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন এ্যাক্ট-এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকরে, জরুরী অবস্থা বহাল রেখে, মৌলিক অধিকার রহিত করে, বিচার বিভাগের। স্বাধীনতা হরণ করে যে ব্যবস্থা ও পদ্ধতি জিয়াউর রহমান কায়েম করেছেন তা গণতন্ত্র নয়; এক ব্যক্তির শাসন। স্বেচ্ছাচার ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর রাষ্ট্র চলছে। একটি সিস্টেম প্রয়ােজন যার মাধ্যমে জনগণ হবে ক্ষমতার উৎসজনগণের নিকট জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে এবং তাদের অধিকার সদা সর্বদা সমুন্নত থাকবে তার পথ রুদ্ধ করা হয়েছে।

ভূতের মুখে রাম নামক 

৬. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ঘােষিত দুঃখী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একক জাতীয় দল গঠনকে স্বৈরাচারীআখ্যা দিয়ে কেউ কেউ এব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় ব্যবস্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে জনগণের অংশ গ্রহণ, জন প্রতিনিধিদের নিকট জবাবদিহী করার ব্যবস্থা, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অধিকার নিশ্চিত কিনা তার উপরে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের কার্যকারিতা নির্ভরশীল। সংসদ জনগণের কণ্ঠস্বরে কথা বলে কিনা, সংসদে জবাবদিহিতা আছে কিনা- এসব বিবেচনাই দেশে গণতন্ত্র থাকা না থাকার মূল প্রশ্ন। জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ, বিশেষ ক্ষমতার আইনের প্রয়ােগ, জরুরী আইনের কঠোর ব্যবস্থা করে গণতন্ত্রের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে জিয়াউর রহমান। রাজবন্দী মুক্তি, সার্বভৌম পার্লামেন্ট, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে ১৫ই আগস্ট পূর্ববর্তীতে যে , শাসনতন্ত্র ছিলাে, যে পার্লামেন্ট ছিলাে, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও জরুরী অবস্থা ছিলাে বহাল রেখে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা জনগণের সঙ্গে তামাশা মাত্র। শুধু তাই নয়, ‘৭৫ সনে মার্শাল ছিলাে না। মার্শাল লবহাল রেখে গণতন্ত্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা যেন ভূতের মুখে রাম নাম। সংসদের সার্বভৌমত্বঃ বিসমিল্লাহতে গলদ।

৭. প্রায় ৪ বছরের ব্যবধানে ২রা এপ্রিল ৭৯ জাতীয় সংসদের বৈঠক শুরু হয়। এটা ছিলাে বালাদেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ। সংবিধানে আছে স্পীকার সদস্যদের শপথ গ্রহণ করাবেন। জাতীয় সংসদ। সদস্যদের মধ্য হতে প্রবীণ সদস্যকে অস্থায়ী স্পীকার নিয়ােগ করে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বের পতাকা তুলে ধরা যেতাে। তা না করে জেনারেল জিয়া  তার নিযুক্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য অস্থায়ী স্পীকার নিয়ােগ করেন। এতে যে কোন নির্বাচিত মর্যাদাবান জাতীয় সংসদ সদস্যরেই আত্মসম্মানে আঘাত লাগার কথা। সংসদ সদস্যের বাইরে প্রেসিডেন্টের নিয়ােগকৃত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয় এমন একজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে দিয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট অত্যন্ত সন্তর্পনে যে মেসসটি দিলেন, তা হলাে সংসদ নিজের কাজ নিজে করতে পারে না। প্রেসিডেন্টের রাবার স্টাম্প হিসেবেই এটিকে কাজ করতে হবে। ভাইস প্রেসিডেন্টকে অস্থায়ী স্পীকার নিযুক্ত করলে জাতীয় সংসদের ৫৩ জন বিরােধী দলীয় সদস্য উক্ত অনুষ্ঠান বর্জন করে, দলগুলাে হলাে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাসদ, ন্যাপ (মােজ ফফর), গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জাতীয় একতা পার্টি, স্বতন্ত্র ২ জন। ভাইস প্রেসিডেন্টের পরিচালনায় শপথ গ্রহণ করেন বিএনপি দলীয় সদস্যগণ মুসলিম লীগ, আই ডি এর, কৃষক শ্রমিক পার্টি জাতীয় লীগ।৫

জন্মেই স্বৈরতন্ত্র ও বিএনপি

৮. জেনারেল জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বললেও বিএনপির

গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র নেই। গ্রাম থেকে জেলা পর্যন্ত কমিটিগুলাে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠনের কথা থাকলে কমিটি চাপিয়ে দেয়া হয় উপর থেকে। দলীয় সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দলের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমানের হাতে। সকল স্তরে সাংগঠনিক কমিটি হয় মনােনয়নের মাধ্যমে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দল গঠনের সুযােগ নেই। নেতৃত্বের গুণ নয়, দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জিয়াউর রহমান মনােরঞ্জনই পার্টিতে উন্নতির চাবিকাঠি। সর্বোচ্চ সংস্থা জাতীয় কাউন্সিলেরও করার কিছু নেই। দলের গঠণতন্ত্রে রয়েছেঃ দলের চেয়ারম্যান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়ােজনবােধে জাতীয় কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্য থেকে কয়েকজন সদস্যের সমন্বয় গঠিত বিভিন্ন বিষয়ে কমিটি মনােনীত করতে পারবেন।কাউন্সিলের দায়িত্ব দলের নতি ও কর্মসূচী গ্রহণ করার বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা। আর দলের নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার অধিকার জাতীয় স্থায়ী কমিটির। কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদকের (মহাসচিব) রিপাের্ট বিবেচনা ও গ্রহণ

করতে পারে। দলের গঠণতন্ত্র সংশােধন করার ক্ষমতা কাউন্সিলের থাকলেও অগণতান্ত্রিক ধারাগুলাের অপসারণ করে আরাে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনাে পদক্ষেপ নেবার সুযােগ ও সাহস কারাে নেই। জাতীয় কাউন্সিলেও মােট যােগদানকারী সদস্য সংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ মনােনীত হবেন চেয়ারম্যান কর্তৃক। জাতীয় নির্বাহী কমিটিও গঠিত হয় চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনয়নের মাধ্যমে। মহাসচিব ডা বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ নির্বাহী কমিটির সকল কর্মকর্তা চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত; দলের নির্বাচিত কর্মকর্তা নন। দলের নীতি নির্ধারণ, কর্মসূচী প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, এবং ওয়ার্ড পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১১ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটিও চেয়ারম্যান কর্তৃক মনােনীত। চেয়ারম্যান এ কমিটির প্রধান। জাতীয় সংসদে, পার্লামেন্টারী দলের নেতা, উপনেতা, চীফ হুইপ, হুইপ বিএনপির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান মনােনীত করেন। সংসদীয় দল বা মূল দলের গুরুত্ব নেই। গঠনতন্ত্রে আছেঃ দলের চেয়ারম্যান হবেন প্রধান কর্মকর্তা। পার্টি ইলেক্টোরাল কলেজ তাকে ২ বছরের জন্য নির্বাচিত করবেন। কিন্তু পার্টি গঠনের পর চেয়ারম্যান পদে এ পর্যন্ত কেউ নির্বাচিত হননি। পার্টিকে গণতান্ত্রিক কাঠামাে দেবার জন্য একটি অংশ সােচ্চার। অপরপক্ষ বলছেন, ‘গণতন্ত্র বাইরের জন্যেঃ দলের জন্যে নয়।দলের মহাসচিব ও সংসদ উপনেতা। বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, জিয়া দেশে যে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছেন তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশেই এমন গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। অথচ উপ-প্রধানমন্ত্রী ও উপ নেতা ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র দিতে হবেএকথা বলায় মন্ত্রীত্ব ও নেতৃত্ব হারিয়ে ওকালতীতে ফিরে যান। সংসদে এখন তিনি একজন সাধারণ সদস্য।৬ জিয়াউর রহমানের আমলে জাতীয় কাউন্সিল যা ছিল সর্বোচ্চ সংস্থা, তার কোন ভূমিকা ছিলােনা। বিএনপির চেয়ারম্যান হিসেবে জিয়াউর রহমানকে পর্যন্ত তারা অনুমােদন দেবার সুযােগ পায়নি। জাতীয় স্টান্ডিং কমিটি কোন সময়ই তার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি, শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানকে সমর্থন করা ছাড়া।

কেন্দ্রীয় অফিস ঃ স্বৈরাচারের আখড়া 

৯. বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিস পরিচালিত হতাে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও তার সহযােগী দ্বারা। যিনি জিয়ার ছিলেন ব্যক্তিগত সহকারী । পার্টির তহবিল, প্রেস, প্রচার, যােগাযােগ তার এবং তার সহযােগীদের দ্বারা পরিচালিত হতাে। বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে ৫০ জন স্থায়ী কর্মকর্তা ছিলাে। পার্টির গঠনতন্ত্রে যদিও লিখিত ছিলাে পার্টি সদস্যদের চাঁদা, অনুদান ও সমর্থকদের। দানের টাকায় পার্টি পরিচালিত হবে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তার মন্ত্রীবর্গ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিকট হতে চাঁদা আদায় করতেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হতাে এবং খরচের কোন হিসেব হতােনা। জিয়ারউর রহমান স্বৈরাচারী হিসেবে স্বৈরাচারী পার্টি কাঠামােয় বিএনপিকে গড়ে। তুলেছিলেন উঠেছিল। বিএনপি প্রকৃত পক্ষে ছিলাে ওয়ান ম্যান পার্টিযার গঠনতন্ত্র চেয়ারম্যানকে দিয়েছিলাে অসীম ক্ষমতা, যে ক্ষমতা জিয়াউর রহমান। পার্টির অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক ধারাকে স্তব্ধ করে রেখেছিলেন।

গণতন্ত্রের বিএনপিকরণ 

১০. জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেই সামরিক পােশাক পরে সামরিক বাহিনীর

বহর নিয়ে দেশবাসীকে গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু না পার্টিতে না প্রশাসনে অথবা রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় কোথায়ও গণতন্ত্র চর্চা হয়নি। গণতন্ত্র বলতে জিয়াউর রহমান বুঝতেন বিএনপিকরণ। প্রশাসনকে বিএনপিকরণের হাজারাে দলিল প্রমাণ ও উদাহরণ রয়েছে। জিয়াউর রহমানের আমলে গণতন্ত্রের নামে বিএনপির দলীয়করণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যায়। নগ্ন দলীয়করণের একটি বিশেষ পর্যায়ে। প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। ঢাকা, রংপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও দিনাজপুরের ঘটনাবলির পর জনগণ প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ দেখেছে প্রশাসনিক দলীয়করণের নির্লজ্জ দৃষ্টান্তসমুহ। এ-সমস্ত ঘটনা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রশাসনের উপর দলীয় চাপই এর জন্য মূলত দায়ী। যেমন ঢাকায় জনৈক বিএনপি কর্মী কর্তৃক ম্যাজিষ্ট্রেটকে প্রহার করার পরও পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অস্ত্রধারী দুজন পুলিশ ছিলাে নীরব, তারা বলতে গেলে চাকুরী হারানাের ভয়ে ঐ কর্মীকে আটক করা থেকে বিরত থেকেছে। সিলেটে তিনটা অমূল্য জীবন বিদায় নিলাে বিএনপির উস্কানীর ফল হিসেবে। কুমিল্লার জনৈক উপমন্ত্রীকে যথাযথ সম্মান দেখানাে হয়নি বলে সাসপেও হলেন কয়েকজন পুলিশ। মুন্সিগঞ্জে বিএনপির বড় নেতাকে সেলুট দেয়া হয়নি বলে বদলী হলাে জেলা ও মহুকুমা পর্যায়ের অফিসারদের। দারােগা-পুলিশ, সিওর চাকরি তাে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দয়ার উপর নির্ভরশীল। সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের ফাইলে হাজার তদবির কেস। ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে এমপিদের সুপারিশ,

জেলা প্রশাসক, মহকুমা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে বদলী এবং চাকরিচ্যুত করার লিখিত নির্দেশ, থানার ওসি বদলানাের কেস এগুলাে। ওসিকে দিয়ে আসামির মুক্তি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য গ্রেফতার-এর নাম গণতন্ত্র চর্চা। কোথাও নির্দেশের হেরফের হলে ঐ কর্মচারীর ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। শতাধিক ঘটনা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে বন্দী। সিনিয়র পলিসি পুল গঠনের কথা ঘােষণা থেকেই বিরােধ। বেসামরিক ছত্রছায়ায় সামরিক ব্যক্তিদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থার ফলে বিরােধ অনেকটা বিদ্রোহের রূপ নেয়। সচিব থেকে শুরু করে এস,পি পর্যন্ত এখন প্রায় শতাধিক উর্দিপরা তােক বেসামরিক প্রশাসনে, জেলার পুলিশ সুপারের চারজন ছাড়া বাকি সবাই সামরিক লেবাশধারী। সচিবালয়ে যুগ্ম ও উপ-সচিব নেয়ার মৌখিক পরীক্ষা। অনেকটা লােকদেখানাে। পরীক্ষায় ৩৫ জন কর্ণেল ও দশ জন মেজর পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। এরা সহসাই যােগ দেবেন সচিব ও উপসচিব পদেবাইরে দূতাবাসগুলােতেও এদের সংখ্যা বাড়ছে। রেডিও টেলিভিশনে উর্দিপরা লােক। গােটা প্রশাসনকে বি এন পি করণের মহৎ উদ্যোগ চলছে। এপ্রসঙ্গে বিবিসির মূল্যায়ন ছিলােঃ বাংলাদেশের শসনব্যবস্থা এখনাে সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল। প্রেসিডেন্ট নিজেও দ্বৈতভূমিকা নিয়েছেন। তিনি নিজে তাঁর সামরিক পদ পরিত্যাগ করলেও এখনাে ক্যান্টেনমেন্টেই আছেন।

জিয়ার গণতন্ত্রের ভাষা ধরেঙ্গা মারেঙ্গাঃ একটি সম্পাদকীয়

১১. জনগণের ভাত কাপড়ের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে সরকার ও সরকারী দল নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও বর্তমান বিরােধী দলসমূহেকে সকল সংকটের জন্য দায়ী করছে। বিরােধী দলের প্রসঙ্গ এলেই তারা বেসামাল হয়ে পড়েন। কক্সবাজার থেকে ঢাকা ফেরার পথে বিমানে একটি দৈনিক-এর প্রতিনিধির সাথে একান্তে আলাপকালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছেন, “বিরােধী দলগুলাের সংযম নিয়ে আচরণ করা উচিত বিরােধী দলগুলাের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি যে আশা করেছেন অনুরূপ আচরণ বিরােধী দলগুলাে তাঁর বা তাঁর দলের কাছ থেকে আশা করতে পারেন। সরকার ও সরকারী দল কি বিরােধী দলগুলাের প্রতি অনুরূপ আচরণ করে থাকে? সাম্প্রতিক কালে সরকার ও সরকারী দলের নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা-বিবৃতিতে সংযম তাে দূরের কথা বিন্দুমাত্র শালীনতা প্রকাশ পাচ্ছেনা। রাষ্ট্রপতি যে দিন বিমানে বিরােধী দলগুলাের প্রতি সংযমের আচরণ আশা করেছেন, সেদিনই ঢাকার বায়তুল মােকাররমে তাঁর দল জাতীয়তাবাদী দলের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐ সভায় ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুররহমান, পশুপালন মন্ত্রী ওযায়দুর রহমান, বিএনপি সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রমুখ। শাহ আজিজুর রহমান তাঁর ভাষণে বিরােধী দলসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে, “আর নয়। এখন থেকে পাকড়াও করতে সরকার কাল বিলম্ব করবেনা।বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রসঙ্গে ওবায়দুর রহমান বলেছেন যে, “আমরা এসব কাগজকে ছারপােকার মতাে টিপে মারতে পারি।বিরােধী দলের নেতাদের সম্পর্কে বলেছেন, “বস্তাবন্দী করে বঙ্গপসাগরে নিক্ষেপ করা হবেইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিপূর্বেও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য জনসভায় বিরােধীদলসমূহকে উৎখাতকরার হুমকি দেয়া হয়েছে। লেঃ কঃ (অবঃ) আকবর ১৫ হাজার বিরােধী দল সদস্যদের জেলে পাঠানাে উচিত বলে এক জনসভায় মন্তব্য করেছেন। রাষ্ট্রপতি যেদিন পূর্বোক্ত আশা ব্যক্ত করেছেন, সরকারী দলের জনসভা হতে যেদিন ধরেঙ্গে, মারেঙ্গেধরনের হুমকি উচ্চরিত হয়েছে, সেদিনই সারাদেশে পুলিশ বাংলাদেশের কমিনিষ্ট পার্টি (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাসদ সহ বিরােধী দলের বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। বর্তমান সরকারের প্রায় পাঁচ বছরের শাসনামলে জনজীবনে বিশেষতঃ মেহনতি মানুষের, নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ধারনের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে-এটা কেউ অস্বীকার করতে পারেন? জনগণের পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। সর্বস্তরের জনগণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ প্রভৃতির মাধ্যমে ন্যূনতমভাবে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার দাবীই তুলে ধরছে। এর ফলে সরকার বেসামাল ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিতান্তই ভাত-কাপড়ের দাবীতে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণ যে আন্দোলন করছে, সরকার তাকে অভিহিত করছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিতবলে। এর জন্য দায়ী করছে বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহকে। নির্যাতন চালানাে হয়েছে আন্দোলনকারী জনগণ ও বিরােধী দলগুলাের উপর। বিরােধী দলের অস্তিত্ব। ছাড়া সরকার ও সরকারী দলের সামনে কি দেশের কোন বাস্তব সমস্যার নেই? সরকারী দলসহ সকলকে আমরা এই কথাটি উপলব্ধি করার আহবান জানাই যে, ধরেঙ্গা, মারেঙ্গা করে আর যাই হােকনা কেন, দেশের সংকট ও সমস্যা, বিন্দুমাত্র লাঘব হয়নি, হবেনা। জনজীবনের বাস্তব সমস্যাগুলাে স্বীকার, তা সমাধানের পথ সম্পর্কে বিএনপির সভাগুলােতে কোন বক্তব্য রাখা হচ্ছে কি? খালকাটা ও উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। দেশের কোটি কোটি মেহনতি কৃষক নিজেদের গরজেই উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির কথা কৃষকদের বলার কোন অর্থ নেই। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ভূমিহীন কৃষক, পাটচাষী, গরীব কৃষক, শ্রমিক, অল্প আয়ের মানুষ তার সুফল ভােগ করতে পারবে তার নিশ্চয়তা সমাজে আছে কি? সরকারী দল যেমন বলছে শ্লোগানের রাজনতি

আর চলবে না আমরাও বলতে চাই ঠিক তাই, এই প্রশ্নগুলাের জবাব না দিয়ে ধরেঙ্গা, মারেঙ্গার রাজনীতি কারও জন্যই কোন সুফল বয়ে আনবে না। 

গণতন্ত্রের শ্বেত সন্ত্রাস ঃ আরাে একটি রিপাের্ট

১২. সরকার এবং সরকারী দল সারাদেশে শ্বেত-সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। কারা প্রাচীরের অভ্যন্তরে, প্রকাশ্য রাজপথে, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে, কলে-কারখানায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানে চলছে এই শ্বেত-সন্ত্রাসের তাণ্ডবলীলা। দেশ পরিচালনায় ও জনগণের সমস্যা-সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়ে সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। বিনা প্ররােচনায় রাজশাহী কারাগারে কয়েকজন বন্দীকে গুলি করে হত্যা করেছে এই সরকার। এই নিমর্ম হত্যাকন্ডে দেশবাসী স্তস্তিত। এর প্রতিবাদে দেশের ১০টি বিরােধী রাজনৈতিক দল ৯ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরে হরতাল আহবান করেছিলাে।

হরতাল ঠেকাতে জিয়া 

১৩. এই হরতাল বানচাল করার জন্য সরকার এবং সরকারী দল সকল প্রচেষ্টাই গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বয়ং রাজধানীর পাড়ায়-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে হরতাল বানচালের আহবান জানিয়েছেন। অভিনব কৌশলে হরতাল বানচালের জন্য বিএনপি রাত বারােটায় বিরােধী দলের নামে সারা ঢাকা শহরে প্রচার করে যে, আগামীকল্য বিরােধীদল হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু জনগণ এই মিথ্যা প্রচার ধরে ফেলে। 

১৪. জনগণ এতে বিভ্রান্ত না হয়ে পরদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে। সরকারী নীতির প্রতি প্রকাশ করে প্রতিবাদ। দিশেহারা ও ক্ষুব্ধ সরকার তাই প্রতিবাদী জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়েছে সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী। সরকার দলীয় এই সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী হরতালের দিন প্রকাশ্য দিবালােকে দুজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। এরা হামলা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে। রাতের অন্ধকারে বিএনপি যুব সংগঠনের সশস্ত্র গুন্ডারা বিরােধী দলের কার্যালয়ে হামলা ও লুটতরাজ করে অগ্নিসংযােগ করেছে। এরা অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছিলাে তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানীর শ্রমিক নেতাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র ও একটি ছাত্রীবাসেও সরকারী দলের। সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে। ১২ ই ফেব্রুয়ারী এরা ডেমরার লতিফ বাওয়ানী জুট মিলে তিন তিন বার হামলা করে চালিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।উপরােক্ত ঘটনাবলী কোন বিছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিককালে অনুরূপ বহু ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কাঞ্চন, টংগী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের শিল্পাঞ্চল এবং ময়মনসিংহ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা জনগণ বিস্মৃত হয়নি। অত্যন্ত সুপরিকল্পিভাবে এই শ্বেত সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে সরকার ও সরকারী দল। সরকারই যে এই শ্বেত-সন্ত্রাস সৃষ্টির নায়ক তার প্রমাণ, সরকার প্রধান ও সরকারের কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক ভাষণ বিবৃতি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সকলেই প্রকাশ্য জনসভায় বিরােধীদলসমূহকে উৎখাতনির্মূল করার আহবান এবং প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায় সরকারী দল ও তাদের। গণসংগঠনসমূহ দেশ জুড়ে এই হত্যা, হামলা, অগ্নিসংযােগ ও লুট শুরু করেছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের অভাব বিশেষতঃ জনগণের উপর আস্থাহীনতা,ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীলতার অভাব থেকেই ওই মনােভাবই এইরূপ শ্বেত-সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। ষাটের দশকের দ্বিতীয় ভাগে দেশবাসী আইয়ুব-মােনেমের শ্বেত-সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেছে। দেশ স্বাধীন হলেও মূল্যবােধের ক্ষেত্রে আইয়ুব-মােনেম যে। বিষবৃক্ষ রােপন করেছিল তা পুরােপুরি উৎপাটিত হয়নি। 

জিয়ার সার্বভৌম সংসদ’-এর নমুনা

১৫. জিয়াউর রহমান ও তার সরকারের মন্ত্রী ও এমপিগণ অত্যন্ত জোরালাে ভাষায়

বলতেন এই সংসদ সার্বভৌমকিন্তু সংসদের ক্ষমতা সম্পর্কে সরকারী দলের একজন সাংসদ দেশের মানুষের সামনে আসল কথাটি প্রকাশ করেছেন। বিরােধীপক্ষের জবাবে তারা বলেছেন : মন্ত্রী পরিষদ সংসদের কাছে দায়ী নয়।১৪ ১১ই এপ্রিল ৮০ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত অধিবেশন চলেছে। অধিবেশনে প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর ধন্যবাদ সূচক বক্তৃতার মধ্যেই ছিলাে সীমাবদ্ধ। সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বছরের প্রথমে প্রেসিডেন্ট ভাষণ দেন। এই অধিবেশনও ছিলাে তাই। ৯ই এপ্রিল প্রেসিডেন্ট সংসদে ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট বলেন ঃ গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য জাতীয় সংসদের দায়িত্বশীল ও সক্রিয় বিরােধীপক্ষের অস্তিত্ব অপরিহার্য। পরমমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবােধের পরিচয় দিয়ে আমরা যদি একটা সুষ্ঠু সংসদীয় কর্মপদ্ধতি ও ঐতিহ্য গড়ে তুলতে পারি, তাহলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিকাশে বিপুল সহায়ক হবে।তিনি বলেন, “সার্বভৌমত্ব রক্ষাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য।” 

১৬. প্রেসিডেন্ট যেন গ্রাম সরকার প্রধানদের সামনে ভাষণ দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে,

প্রেসিডেন্টের ভাষণে সংসদীয় কর্মপদ্ধতি ও ঐতিহ্য গড়ে তােলার কোন সুযােগই নেই এই জাতীয় সংসদে। বিরােধী দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান বলেনঃ

কতকগুলাে গণবিরােধী আইন পাশ করা ছাড়া এই সংসদের কোনাে ক্ষমতা নেই। রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। মুসলিম লীগৈর খান এ সবুর বলেন ঃ প্রেসিডেন্টে এমনভাবে বক্তৃতা করেছেন মনে হলাে তিনি যে গ্রাম সরকার প্রধানদের সম্মেলনে ভাষণ দিচ্ছেন।জনাব খান এই সংসদকে নপুংসক পার্লামেন্টাবলেও আখ্যায়িত করেন। জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান খান বলেনঃ এই সংসদে কিছু বলে লাভ নেই। কেউ কারাে কথা শুনে না। আইন-শৃঙ্খলা প্রসঙ্গে বলেছেন, “দেশে আইনও নেই, শৃঙ্খলাও নেই-আছে শুধু শৃঙ্খল।১৫)

ক্ষমতা আছে তবে গােপনে 

১৭. প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কে বিরােধীপক্ষের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ক্ষমতা

ছে-তবে সবই গােপনে। মন্ত্রী পরিষদের বিরুদ্ধে মিঃ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত অনাস্থা প্রস্তাব আনেন ও সরকারী দলীয় একজন সদস্যদের সাথে জনৈক পুলিশ। অফিসারের অশােভন আচরণকে কেন্দ্র করে অধিকার প্রস্তাব আনেন। অনাস্থা প্রস্তাবের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উপপ্রধানমন্ত্রী জনাব জামালউদ্দিন আহমদ বলেছেনঃ বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী নয়। সংসদ শুধু মাত্র প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী। এ প্রসঙ্গে তিনি সংবিধানের ৫৬ ও ৫৮ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করেন। স্পীকার রুলিং এ বলেন, সংবিধানের কোনাে ধারা লংঘন করা হয়নি। পুলিশ অফিসারের অশােভন আচরণে সরকার দলীয় সদস্য মুর্শেদ আলী খান পন্নি। স্মরণাপন্ন হয়ে ছিলেন সংসদের কাছে। অধিকার ভঙ্গের অভিযােগ এনে পন্নি পুলিশ অফিসারের শাস্তি দাবি করেন। ৩ ঘন্টা আলােচনার পর এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ কমিশনার সাসপেণ্ড হয়েছেন। পুলিশ-কমিশনারকে সংসদে যেতে হয়নি। পার্লামেন্ট তার বিচারের ব্যবস্থা করতে পারেনি। মুর্শেদ আলী খান পন্নি তার অধিকার প্রস্তাবে বলেন ঃ গত ২১শে এপ্রিল রাতে তার বাসায় চুরি হয়। ভােরবেলা তা টের পেয়ে তিনি মােহাম্মদপুর থানায় টেলিফোন করেন। কিন্তু যদিও তার বাসভবন থানার অত্যন্ত কাছে ছিলাে তা সত্ত্বেও পুলিশ আসতে দেরি হওয়ায় তিনি ঢাকা। মেট্রোপলিটন পুলিশের কন্ট্রোল রুমে টেলিফোন করেন। সেখানে উপস্থিত সরকারী পুলিশ কমিশনার সাফায়াত আলীকে তিনি চুরির ঘটনা এবং মেহাম্মদপুর থানার পুলিশের আসতে দেরি করার কথা জানানএই নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে উক্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার বলেনঃ ইউ ব্লাডি এমপি, এটা তােমার বাপের কোম্পানী নয়। যাও না পার্লামেন্টে দেখি কি করতে পারাে? এমপি হয়ে তােমরা বাস্টার্ডরা আমাদের কাজ শেখাতে এসেছে। প্রেসিডেন্টের নাম উচ্চারণ

করেও পুলিশ অফিসার নানা ধরনের ব্যঙ্গোক্তি করেছেন, যা এ সংসদের জন্য অবমাননাকর।কিন্তু সংসদ সদস্যের অবমাননা অর্থাৎ সংসদকে কটাক্ষ করার পরও বিচার না হওয়ায় সংসদ যে রাবার স্ট্যাম্প তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও চীপ হুইপ উপস্থিত না থাকায় স্পীকারকে দিনের কার্যসূচীর কয়েকটি বিষয় স্থগিত রাখতে হয়েছে। প্রশ্নোত্তরপর্বে অসত্য তথ্য পরিবশেন রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। এই হলাে সার্বভৌম সংসদ’-এর নমুনা!

উপদ্রুত এলাকা বিল ঃ ভিন্নরূপে মার্শাল ল

১৮ .১৯৮০ সালের উপদ্রুত এলাকা বিল জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এ,এস,এম, মুস্তাফিজুর রহমান সংসদে এই বিল উত্থাপন করেন। এই বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,

বাংলাদেশের কোনাে অংশে বিরাজমান অস্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ যা দেশে বিদ্যমান আইন দ্বারা সফলতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সে সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের সে অংশকে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করা এবং তৎসংক্রান্ত ও তদানুষঙ্গিক বিষয়ে বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এই বিল আনা হয়েছে।বিলের ৩নং অনুচ্ছেদে কোন এলাকাকে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করিবার ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সরকার যদি এইরূপ মত পােষণ করেন যে, বাংলাদেশের কোন অংশে এইরূপ উপদ্রুত বা বিপজ্জনক অবস্থা বিরাজ করিতেছে যে, গণশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও তাহা রক্ষার জন্য বেসামরিক ব্যক্তি সাহায্যার্থে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ব্যবহার প্রয়ােজন, তাহা হইলে সরকার সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা বাংলাদেশের সেই অংশকে উপদ্রুত এলাক বলিয়া ঘােষণা করিতে পারিবেন। বিলের ৪নং ধারায়, গুলী করা, তল্লাশী চালানাে, গ্রেফতার করা, বিনষ্ট করা ইত্যাদির ক্ষমতা শীর্ষক অধ্যায়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কোনাে অফিসার বা কোনাে ম্যাজিষ্ট্রেট অথবা পুলিশের অন্যূন সাবইন্সপেক্টর পদমর্যাদার কোনাে অফিসার বা বাংলাদেশের রাইফেলসের অন্ন হাবিলদারের পদমর্যাদার কোনাে অফিসার কি পরিস্থিতিতে গুলী ছুড়তে পারবেন, কোনাে আস্তানা বা কাঠামাে ধ্বংস করতে পারবেন, বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন, বিনা পরােয়ানায় কোনাে গৃহাঙ্গণে প্রবেশ ও তল্লাশী চালাতে এবং এর জন্যে প্রয়ােজনীয় শক্তি প্রয়ােগ করতে পারবেন তার বিধানসমূহের বিবরণ দেয়া হয়েছে। এই আইনের অধীনে পুলিশ অফিসার বলতে পুলিশ বাহিনীর অঙ্গীভূত আনসার বাহিনীর অফিসারকেও বােঝাবে। বিরােধীদলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামান খান এই বিলকে মার্শাল লর চেয়েও জঘন্য আইন বলে অভিহিত করেছেন। গণতন্ত্রের কণ্ঠরােধ ও রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা করার জন্য এই বিলটি আনা হয়েছে। বিল সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও প্রচলিত সকল মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই বিল সম্পর্কে দৈনিক সংবাদএকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এতে তাঁরা বলছেন উপদ্রুত এলাকা বিলটিতে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ তথা পুলিশ-বিডিআর-এর হাতে যে ঢালাও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তা কোনােক্রমেই গণতন্ত্রের নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অনুকুল নয়। সরকার দেশের কোনাে অঞ্চলকে একবার উপদ্রুতবলে ঘােষণা করলে সে এলাকার জনসাধারণের আর মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযােগ বলতে কিছু থাকবে না। এমনকি নিম্নপদস্থ পুলিশ ও বিডিআর কর্মচারীরাও নিজ নিজ বিচার বুদ্ধি বা খেয়ালখুশি মােতাবেক গুলীবর্ষণ, নিছক সন্দেহবশে বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার ও খানা তল্লাশী করতে পারবেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মারফত স্বাভাবিক আদালতকে পাশ কাটিয়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেয়া যাবে। সরকারী কর্মকর্তারাই সর্বদাই যে সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এর কোনাে নিশ্চয়তা নেই। বরং অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে যে, এ ধরনের অস্বাভাবিক আইনের অপ্রয়ােগের আশঙ্কাই অধিক। কেন দৈনিক ইত্তেফাকএ সম্পর্কে লিখেছে, বিশেষ ট্রাইব্যুনালের কোন আদেশ, রায় এ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কোন আপীল করা যাইবে না এবং উক্ত আদেশ, রায় বা দন্ডাদেশ সংশােধন করিবার কর্তৃত্ব কোন আদালতের থাকিবে না১৭ নম্বর ধারায় এই কথা সন্নিবেশের দ্বারা দেশের প্রচলিত কোর্ট আদালতের প্রতিচরম অনাস্থা প্রকাশ করার মাধ্যমে দেশে আইনের শাসনের নীতিমালা বানচাল করার ব্যবস্থা করা হইয়াছে।”১৯ এই সংক্ষিপ্ত আলােচনা, রিপাের্ট ও সম্পাদকীয় মন্তব্যের মাধ্যমে এটা পরিস্কারভাবে প্রতীয়মান যে, দেশে গণতন্ত্র ছিলাে না, ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পথ রুদ্ধ ছিলাে এবং সার্বভৌম সংসদেরনামে রাবার স্ট্যাম্পবহাল ছিলাে।


প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অন্তরালে

১. জিয়াউর রহমান বারবার প্রশাসনিক পরিবর্তনের কথা ঘােষণা করেছেন। প্রশাসনিক এই পরিবর্তন প্রশাসনকে জোরদার, দুর্নীতিমুক্ত ও সময়ােপযােগী প্রশাসন গড়ে তােলার পরিবর্তে স্বাধীনতা বিরােধীদের পুনর্বাসনে পরিণত তা করেছেন। সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও কর্পোরেশনগুলােকে তাদের গত {ত চার বছরের কাজের অভিজ্ঞতার আলাকে এবং তাদের নিয়ন্তণ ও সমন্বয় যাতে আরােও কার্যকর হয়ে উঠে সেজন্য প্রশাসনিক পুনর্গঠণ ও পুনর্বিন্যাসের কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। 

২.সামরিক ঘােষণায় বলা হয় ৫ সদস্যের একটি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এই প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও পুনবিন্যাস করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের পাঁচ সদস্যর কমিটির সদস্যরা হলেন ঃ কাজী আনােয়ারুল হক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, কমােডার এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এমজি তােয়াব এবং ডঃ এম এন হুদা। আনােয়ারুল হক কমিটির আহ্বায়ক এবং বাকি চারজন্যই। কমিটির সদস্য। প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এই কমিটি গঠন করেছিলেন অনিয়মিত নিয়ােগ, পদোন্নতি, পােষ্টিং-এর কেসগুলাে দেখা এবং প্রশাসনের। সামগ্রিক দক্ষতা বাড়ানাের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের দ্বারা পূর্বের অন্যায়ের প্রতিকার করার জন্য সরকারী ঘােষণায় একে পুনর্গঠনের প্রথম পর্যায় বলে, অভিহিত করা হয় এবং বলা হয় এই প্রক্রিয়া অব্যহত থাকবে। ঘােষণায় বলা হয় গত ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সময়ে অবাঞ্ছিত প্রভাব খাটিয়ে ও অনিয়মিতভাবে এবং যােগ্য অফিসারদের দাবি চেপে রেখে কতিপয় নিয়ােগ, পােস্টিং ও পদোন্নতি করা হয়েছে।২

৩. ঘােষণা বলা হয় যে স্বাধীনতার পর কাজের সুযােগ ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় বিষয়ের চিন্তা-ভাবনা না করেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলােকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে, অসংখ্য কর্পোরেশন গঠন করা হয়েছে। এতে দারুণভাবে বিভিন্ন বিষয় জড়িয়ে গেছে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, জনশক্তি ও অর্থের অপচয় হয়েছে। এতে প্রশাসনিক দক্ষতা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অতএব প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন। প্রশাসক তার উপদেষ্টা পরিষদের একটি কমিটির গঠন করেন অনিয়মিত নিয়ােগ, পদোন্নতি, পােস্টিং-এর কেসগুলাে দেখার জন্যে অতীতে যে সব অন্যায় করা হয়েছে সেগুলাের প্রতিকার এবং প্রশাসনের সামগ্রিক দক্ষতা উন্নত করার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশের জন্য। কমিটির কমপক্ষে সাতটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এসব বৈঠকে বিভিন্ন পদে নিয়ােগের যােগ্যতা সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন জিয়ে আলােচনা করা হয় ও এই উদ্দেশ্যে কতিপয় সুর্দিষ্ট নীতি ঘােষণা করা হয়।

৪. এ ধরনের কমিটি গঠনই ছিলাে উদ্দেশ্যমূলক। কারণ কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত ব্যক্তিরা নিরপেক্ষ ছিলেন না। জনাব আনােয়ারুল হক পাকিস্তানের খাটি পুলিশী আমলা x হিসেবে শেষদিন পর্যন্ত দক্ষতা’-র সঙ্গে কাজ করেছে। বাঙালীদের উপর নির্যাতন

ও নিপীড়ণের প্রশ্ন পাকিস্তানীদের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলেছেন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত দালাল এবং মন্ত্রী। তিনি হচ্ছেন এই কমিটির আহবায়ক। ডাঃ এম এন হুদা আইয়ুব মােনায়েমের বিশ্বস্ত অনুচর। এম, জি, ” তােয়াব মুক্তিযুদ্ধের কনসেপ্টেই বিশ্বাস করতেন না। বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজান্ত্রহিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তােয়াবের প্রচেষ্টার অন্ত ছিলােনা।৩ এই কমিটির লক্ষ্যই ছিলাে পাকিস্তানী অফিসারদের পুনর্বাসন করা। 

৫. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দুবছর সিনিয়রিটি প্রদান করেন। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টো। পাকিস্তানী প্রত্যাগত ১লক্ষাধিক সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের চাকুরী। বাতিল করেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উদার ও মহানুভব হয়ে পাকিস্তান হতে প্রত্যাগত সামরিক ও বেসামরিক অফিসারদের চাকুরীতে বহাল করলেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সিনিয়রিটি দেবার কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন। চাকুরী পুনর্বিন্যাসের ক্রমে তাদের পুনৃবিন্যাস করুই ছিলাে এই কমিটির উদ্দেশ্য।

৬. কমিটি দেখেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনগুলোর বর্তমান কাঠামাের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যানের প্রয়ােজন। বিভিন্ন । মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের ব্যাপারে দেখা গেছে তাদের সংখ্যা কমানাের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলাের সংখ্যা এমন সংযােজনের দ্বারা কমানাে যেতে পারে যাতে ওভারহেড ব্যয় কমে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় আরও কার্যকর হতে পারে।।

৭. উপদেষ্টা পরিষদের উল্লিখিত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সরকার আশা করেন যে, এই পুনর্গঠনের ফলে যারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, দেশের সার্বিক স্বার্থে তারা বিষয়টিকে সদয়ভাবে গ্রহণ করবেন এবং তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না । কেন, দেশের কল্যাণের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। পুনগঠনের এটা প্রথম পর্যায়। এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। 

৮ . সরকারের মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিভাগ, পরিদপ্তর, অধিদপ্তর, স্বায়ত্ত শাসিত সংস্থা এবং কর্পোরেশনগুলাে বঙ্গবন্ধু পুনর্গঠিত করেছিলেন জাতীয় স্বার্থেই। একটি প্রাদেশিক সরকার হতে জাতীয় সরকার পরিচালনার জন্য এই পুনর্গঠন ছিলাে অত্যন্ত জরুরী। জিয়াউর রহমান এসব উপলব্ধি করলেও বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানসমূহে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সংখ্যা ছিলাে বেশী এবং মূলতঃ তারাই উচ্চ পদগুলাে দখল করে রেখেছিলেন। এটা কোনক্রমেই পুনর্গঠন কমিটির সহ্য হয়নি। উচ্চপদ সমূহে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের অপসারণের জন্যই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হ্রাস ও একত্রীভূত করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিলাে।

৯. জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের বিষয়টি সম্পর্কে আলােচনার পূর্বে জিয়ার উপদেষ্টা ও মন্ত্রীপরিষদ কাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এ সম্পর্কে আলােকপাত করা যেতে পারে। ১৯৭৬-৮১ সালের মধ্যে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা ও মন্ত্রী সভায় যে ৮০ জন ব্যক্তি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তার মধ্যে ১৩ জন সামরিক কর্মকর্তা, ৮ জন বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ১৮ জন শিল্পপতি, এবং ৩১ জন ছিলেন রাজনীতিবিদ। এই ৩১ জনের মধ্যে মুসলিম লীগ চৈনিক পন্থী স্বাধীনতা বিরােধীদের সংখ্যা ছিলাে ১৯ জন। বাকীগুলাে দল ছুটদের নিয়ে পূরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৫০০ শত সরকারী কর্মচারী অংশগ্রহণ করেছিলেন এর মধ্যে মাত্র ১৩ জন সিএসপি অফিসার, দুজন পি, এস, পি, ইপিসিএস-এর কতিপয় অফিসার এবং নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের সংখ্যাই ছিল বেশী।

১০. বাঙালী সিএসপিদের সংখ্যা ছিল ১৮০ জন। বঙ্গবন্ধুর সরকার ৬ হাজার বেসরকারী কর্মচারীকে পাকিস্তানীদের সঙ্গে দালালী করার অপরাধে চাকুরীচ্যুত করেন। এরমধ্যে নয় জন সিএসপি অফিসারও ছিলেন। জিয়াউর রহমান এসব পাকস্তিানী দালাল ও স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরােধীতাকারী ঐ নয় জন সিএসপি অফিসারকে চাকুরীতে পুনর্বহাল করেন। 

১১. পররাষ্ট্রসচিব জনাব ফখরুদ্দিন আহমদকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিদেশ পাঠিয়ে দেয়া হলাে এদিকে পররাষ্ট্র দফতরের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি জনাব ভােবারক হােসেনকে পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত হলাে ঢাকায় সরকারীভাবে একথা ঘােষণা করা হয়েছে। তােবারক হােসেন স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অপশন দেননি। পাকিস্তানীদের পক্ষে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এম এন হুদা আর একজন বেনিফিসিযারী। ১৯৬৩ সনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগহণ করেন এবং পাকিস্তান স্পেশাল ব্রাঞ্চের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সনের জুন মাসে এন.এস.আই হেড কোয়ার্টারে এক সাক্ষাৎকারে হুদাকে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা অথবা হত্যায় তারা জড়িত ছিলেন কিনা জানতে চাইলে, হুদা হেসে বলেন প্রশ্নটি অত্যন্ত পরিস্কার। এ এম আনিসুর রহমান ১৯৬৯ সনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীর গ্রাজুয়েট। ১৯৭০ সনে পাকিস্তান আর্মির প্যারা মিলিটারী ফোর্স হিসেবে আলবদর বাহিনী সংগঠিত হচ্ছিল। আল বদর বাহিনীর কমান্ড কাউন্সিলের মৌলানা মান্নানের তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ ফোর্সের তিনি কমিশনার নিযুক্ত হন। এ,কে,এম মুসলেহউদ্দিন ১৯৭১ সনে মুসলিম লীগ ও সামরিক জান্তার ঘনিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সনে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএ ও ইনপােলস থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। তিনি এন,এস,আই-এর পদস্থ ব্যক্তি হিসেবে কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। মুসা মিয়া চৌধুরী যিনি এন, এস, আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর-তার সম্পর্কে। লিফসুজ বিস্তারিতভাবে দেখিয়াছেন যে, সি, আই-এর আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত ইপােলসে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এই ব্যক্তিটি রায়ট কন্ট্রোল কাউন্টার রেভ্যুলেশন ও পুলিশ টেররবিষয়াদি সম্পর্কে কিরূপ উচ্ছিসিত প্রশংসায় বিগলিত ছিলেন।১০ এবং ঐ সমস্ত আইডিয়া স্বদেশে বাস্তবায়ন করতে তারা কিরূপ পরঙ্গমতায় পরিচয় প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুসামিয়া চৌধুরীকে প্যারামিলিটারী আর্মি ব্যাটেলিয়ান সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সালাউদ্দিন আহমদ ১৯৬৮-৮৯ সনে আয়ুব-মােনেমের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন ও ঐ সময়ে শ্রমিক আন্দোলন দমনের জন্য কর্তৃপক্ষের সুনাম অর্জন করেন। কথাবার্তায়। অভিজাত এবং কঠোরতা সম্পন্ন এই ব্যক্তি দেশ স্বাধীন হবার পর রােমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি (ফাও) প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবের পদে অধিষ্টিত হন এবং বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার পক্ষের হাজার হাজার অনুসারীদের কারাগারে নিক্ষেপে উৎসাহী ছিলেন।

১২. বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রবাসী সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে শুরু হয়ে যায় অলিখিত প্রশাসনিক সংকট। পাকবাহিনীর সংগে যােগসাজশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য নয় জন প্রক্তন সি, এস, পি অফিসার সহ ছয় হাজার কর্মচারী চাকুরীচ্যুত হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও বাংলাদেশে চাকুরীরত ঐ সময়ের অফিসারগণ সব সময়ই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। আমলারা বলতে শুরু করলেনঃ সংবাদ পত্র দেখে তারপর অফিসে যেতে হবে। কেননা কোনদিন পর্যন্ত | তিনি চাকুরীতে থাকবেন কি থাকবেন না তা তাদের জানা নেই। মুজিব হত্যার পর তারা প্রশাসনে জেকে বসলেন। 

১৩. প্রাক্তন সি, এস, পি, অফিসার ও ই, পি, সি, এস অফিসারদের মধ্যে চাকুরীর স্তর বিন্যাস ও কাঠামাে নিয়ে বিরােধ থাকে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ডঃ মােজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসন ও চাকুরী পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রাক্তন সি, এস, পি। সিস্টেমকে আর্টিফিশিয়েল ইনস্টিটিউশননামে আখ্যাত করে সকল বড় বড় পদ সি এস পি অফিসারদের প্রাপ্যএই প্রথা ও নিয়মকে বাতিল করে দেয়। এতে সি, এস, পি অফিসারগণ ফুসতে থাকেন। তারা কোন কাজ না করে, আড্ডা মেরে, গালগল্প করে সময় কাটাতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এরা নিজেদের যথাযােগ্য স্থান করে নেয়।

১৪. প্রাক্তন সি, এস, পি অফিসার শফিউল আযম। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী ছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর আদেশ নির্দেশ। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি পালন করেছেন। স্বাধীনতার কিছুকাল পুর্বে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়। পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশকারী এই প্রবীণ, ও মেধাবীসি,এস, পি অফিসার স্বাধীন বালাদেশে চাকুরী না পেয়ে গােপনে বঙ্গবন্ধু বিরােধী সি, এস, পিদের পরামর্শ দাতার ভূমিকা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই এই জ্ঞানী অফিসারটিচাকুরীতে উচ্চাসন লাভ করেন। এবং চাকুরীতে নিয়ম বিরুদ্ধ পদোন্নতি সম্পর্কিত রিভিউ কমিটির প্রধান হয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যথাযােগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ ও এডমিনিষ্ট্রেশনকে। ক্লীনকরার জন্য তৎপর হয়ে উঠেন। অচিরেই পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের। যথাযােগ্য আসন ও মর্যাদায় উন্নীত করে তিনি তাদের সমহিমায় পুনর্বাসিত করেন। জিয়াউর রহমানের প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস শুধুমাত্র বেসামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলােনা-তা ছিলাে সর্বব্যাপী। জিয়া সামরিক ক্ষেত্রেও প্রশাসনিক পুনবিন্যাস করে। তাদের সুযােগ সুবিধা বৃদ্ধি, সংখ্যা বৃদ্ধি ও কাঠামাের পরিবর্তন করেন। 

১৫. সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর জিয়া তার ক্ষমতার ভিত্তি সামরিকবাহিনীকে অধিকতর শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯৭৬ সালে সে সামরিকবাহিনরি মধ্যে বিদ্যমান অশান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১২,৫০০জন-সদস্য বিশিষ্ট একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন করেন। 

১৬. ১৯৭৭ সালের জানুয়ারী মাসে প্রাপ্ত এক হিসাবে প্রকাশ, ক্ষমতা দখল করার এক বছরের মধ্যেই জিয়া সামরিক ডিভিশনের সংখ্যা ৪ থেকে বাড়িয়ে ৯ ডিভিশনে পরিণিত করে।১২ (সানরাইজ”, লণ্ডন, বর্ষ ঃ ১, সংখ্যাঃ ৬, জানুয়ারী, ১৯৭৭) ১৯৭৭ সালের মে মাসের বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, ১৯৭৩ আর্থিক সালে ডিফেন্স, জাস্টিস ও পুলিশ” (দেশরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ) খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মােট জাতীয় ব্যয়ের শতকরা ১৭ দশমিক ৬ ভাগ। ১৯৭৬ আর্থিক সালের জন্য মুজিব সরকার। উক্ত খাতে ১৪৭ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। জিয়া-এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ২০৬ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মােট জাতীয় ব্যয়ের শতকরা ৩১ দশমিক ১ ভাগ বরাদ্দ করে। ১৯৭৭ সালের বরাদ্দের পরিমাণ ছিলাে ২২৭ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। ১৩

১৭. ১৯৮১ সালে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর) ন্যৈবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা শতকরা ৩০০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে (অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর আমলে) সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৫ হাজার, ১ হাজার ও ১হাজার ৫শ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে (জিয়ার আমলে) এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাড়ায় যথাক্রমে ৭০ হাজার, ৩ হাজার ৫শও ৪ হাজার। 

১৮. জিয়ার আমলে প্যারা মিলিটারী ফোর্সঅর্থাৎ আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। বঙ্গবন্ধুর আমলে জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও বাংলাদেশ রাইফেল্স-এর সদস্যসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২০ হাজার ও ১৫ হাজার। জিয়া রক্ষীবাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশ রাইফেলস সদস্যসংখ্যা ৩০ হাজারে উন্নীত করে এবং ৩৬ হাজার সদস্যবিশিষ্ট সশস্ত্র পুলিশ-রিজার্ভবাহিনী, ৮ হাজার সদস্যবিশিষ্ট আনসারবাহিনী ও ৯ লক্ষ ৬০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনী সৃষ্টি করে। ১৪ শৃংখলাবাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে এই সুবাদে জিয়াউর রহমানে পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের জায়গা করে দেন।

১৯. জিয়াউর রহমান এই সবই করেছিলেন তার পাওয়ার বেজ‘-কে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে। সামরিক অধিনায়ক হয়ে সামরিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল হওয়া ব্যতীত জিয়াউর রহমানে গত্যন্ত ছিলােনা। প্রশাসনিক প্রশাসনকে সামরিকী করণের সুপকিল্পিত পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হন। তিনি প্রশাসনিক শৃংখলা ভংগ করে সচিবালয়, কূটনৈতিক পদে, কর্পোরেশন ব্যাংক বীমা আর্থিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সামরিকবাহিনীর লােকদের ঢুকিয়ে দেন। এইভাবে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রে এইসব চাপিয়ে দেয়া বহিরাগতদের আগমনে প্রশাসনিক কাঠামােয় বিশৃংখলা দেখা দেয়। যার পরিণাম শুভ হয়নি।

১৯৯


ভিত্তি প্রস্তরঃ রাজনৈতিক প্রতারণার কৌশল

১. রঙিন পর্দায় সুদর্শন মুখশ্রী। ঘােষিত হলাে আজ প্রেসিডেন্ট জিয়া বুড়িগংগা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন।সচিত্র টিভি প্রতিবেদন। রঙিন চশমা, সাফারী সুট পরিহিত প্রেসিডেন্ট ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। স্থাপনের পর হাত তুলে মােনাজাত করা হলাে। তারপর শ্লোগান-কর্মীদের প্রেসিডেন্ট জিয়া চেয়ারম্যান জিয়া জিন্দাবাদইত্যাদি। পরদিন কাগজে বের হলাে আরাে সচিত্র খবর। 

২. কাগজে ছাপা হলাে; প্রেসিডেন্ট জিয়া আশুগঞ্জ সার কারখানা উদ্বোধন করবেন। হেলিকপ্টারে আশুগঞ্জ গেলেন ও সার কারখানা উদ্বোধনের বিস্তারিত প্রতিবেদনও কাগজে ছাপা হলাে। কিন্তু বাস্তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার বুড়িগংগা সেতুর প্রকল্পএর অস্তিত্ব যেমন ছিলােনা, আর আশুগঞ্জ সার কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়েছিলাে উদ্বোধনের বহু পরে- জিয়া তখন বেঁচে নেই।

৩.  ১৯৭৯ ২১শে ডিসেম্বর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি লেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান। ভিত্তি প্রস্তর ছাড়া এক ইঞ্চি কাজ সম্পন্ন হয়নি। 

৪. সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান ১৯৮০ সালের ২৮ আগষ্ট। অফিসের কাজের জন্য কয়েকটি রুম করা হয়েছে। ছাত্ররা আগের সেই জরাজীর্ণ টিনের ঘরে ক্লাস করে। কোন ক্লাসে মুলি বাঁশের বেড়া খুলে পড়েছে এই হলাে অবস্থা। ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়েছে। বরাদ্দ নেই।। কাজ হয়নি। 

৫. খিলগাঁও মডেল কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের জানুয়ারী সালের ২৭ তারিখে। ১৯৮৬ সনে ঐ ভিত্তি প্রস্তর ভেঙ্গে আলমারীতে রাখার ব্যাপারে জানা যায় সরকার ১৯৭৩ সালে এ কলেজের জন্য সাড়ে নবিঘা জমি হুকুম দখল করেন। রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সনের জানুয়ারী নব নির্মিত ভবনটি উদ্বোধন করেন এবং কলেজের একটি পূর্ণাঙ্গ কাজ বাস্তবায়ন করার ওয়াদা করেন। স্কীম বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি সচিবালয় থেকে ঢাকা মিউঃ কর্পোরেশনকে একটি পত্রও দেন। কলেজের নামে বরাদ্দকৃত নির্দিষ্ট স্থানে নবনির্মত ভবন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উদ্বোধন হওয়ার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ আশা করেছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাদ্দকৃত জমির সেলামীর টাকা জমা দেওয়ার অনুমতি দেবেন এবং বরাদ্দকৃত স্থানটি কলেজ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করবেন। ২১/৮/৭৮ তারিখের এক পত্রে নির্বাহী প্রকৌশলী জমি বন্টন কমিটির বরাবরে কোন কারণ না দেখিয়ে জানান যে, কলেজের নামে বরাদ্দকৃত সাড়ে নবিঘা জমির বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এবং নব নির্মিত ভবন (রাষ্ট্রপতি জিয়া কর্তৃক উদ্বোধন) অন্যত্র সরিয়ে নেবার জন্য তিনি ঐ পত্রে নির্দেশ দেন। তারপর ভিত্তি ” প্রস্তর খুলে ঘরে রেখে সেখানে একটি নতুন ভবন তৈরী করা হয়, যাতে দখলী না হারায়।

৬. রাজনৈতিক কারণে প্রতিশ্রুত বেশিরভাগ প্রজেক্টের ভাগ্য অনিশ্চিত। ৮২-৮৩ অর্থবছরে মাত্র দশটি প্রজেক্ট উন্নয়ন কর্মসূচীতে স্থান পেয়েছে। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৬০০টি প্রকল্পের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সব কটি প্রকল্পই সড়ক ও জনপথ বিভাগের। ৮২৮৩ সালের অর্থবছরে পরিকল্পনা কমিশন ৩৬২ টি প্রজেক্ট অনুমাদন করে। এর মধ্যে মরহুম জিয়া প্রতিশ্রুত ৮০টি প্রজেক্ট স্থান পায়। কিন্তু মেজর জেনারেল শাসসুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত প্রকল্প বাছাই কমিটি মাত্র ১৯৯টি প্রজেক্টের অনুমােদন দিয়েছে। এই প্রজেক্টের মধ্যে ১০টি প্রজেক্ট রয়েছে রাজনৈতিক কারণে প্রতিশ্রুত। 

৭.প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবদ্দশায় ১৯৮০ সালের ৫ই মে তার প্রতিশ্রুত প্রজেক্টগুলাের মূল্যায়নের জন্য বঙ্গভবনে একটি বৈঠক বসে। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান যে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয় তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে প্রেসিডেন্টের প্রতিশ্রুত প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ৬২ বছর সময় লাগবে। রিপাের্টটির উপসংহারে উল্লেখ করা হয় যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্পগুলাে পরীক্ষা করেছেন। রিপাের্টটিতে সার্ভে রিপাের্টের যে মন্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব। রাজনৈতিক ফায়দা তােলার জন্যই এই প্রজেক্ট গুলাে খাতাপত্রে স্থান পেয়েছিলাে এবং নির্বাচনের সময়ই বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

৮. প্রতিশ্রুতির সংখ্যা, উদ্দেশ্য এবং অবাস্তবতা-সব মিলিয়ে গােটা দেশের চিত্র সত্যিই বিস্ময়কর। জিয়াউর রহমানের আমলে প্রতিশ্রুতির বহর লক্ষ্যণীয়। প্রেসিডেন্ট জিয়া হেলিকপ্টারে করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং যেখানেই তিনি গেছেন, সেখানেই তার দলীয় কর্মীরা এবং স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিপুল অর্থ ব্যয়ে সমাবেশ করারর্সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আর মানি ইজ নাে প্রােরেম‘-এর প্রবক্তা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের করতালি আর সমর্থন পাবার জন্য একাধিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। করেছেন ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। 

৯. হিশেব করা হচ্ছে প্রতিশ্রুতির বাস্তবতা-অবাস্তবতা এবং এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কতটা সময় দরকার হতে পারে ইত্যাদি। এর সাথে আর, একটা বিষয় হিসেব করে দেখা দরকার যে, সাড়ম্বর সংবর্ধনা এবং বিভিন্ন প্রকল্পে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের আনুষ্ঠানিকতার কি পরিমাণ সরকারী অর্থ ব্যয় হয়েছে। বিদেশ থেকে স্বাধীনতার পর কম অর্থ আসেনিদশ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে বৈদেশিক সাহায্য এসেছে। এই অর্থ জাতীয় উন্নয়নের কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে এদেশের শিল্প, কৃষি, শিক্ষা এবং যােগাযােগ ব্যবস্থার দৈন্যদশা অনেক আগেই দূর হয়ে যেতাে। কিন্তু দেশ ও জাতির দূর্ভাগ্য, এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সিংহভাগই ক্ষমতাসীনদের একটা কৃত্রিম রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির কাজে অপচয় করা হয়েছে। 

১০, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এরকম কয়েক হাজার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। যেখানেই গেছেন স্থাপন করেছেন এক একটি ভিত্তিপ্রস্তর। জিয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে অর্থ প্রয়ােজন তার হিসেব নিকেস করে দেখা গেছে এটি ছিল প্রতারণা ও চমক সৃষ্টির রাজনীতি। তার ১৯ দফার মতােই এগুলাে ছিলাে রাজনৈতিক প্রতারণার শতাব্দীর ফমূলা।

২০২


প্রমােদ বিহার ও তালিয়া বাজাও

হিজবুল বহরের প্রমােদ বিহার 

১. একটি সাপ্তাহিকের রিপাের্টে হিজবুল বহর সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “হিজবুল বহর সমুদ্র সম্পদ আরহণ সম্পর্ক দুদিন . ব্যাপী এক সেমিনারের আয়ােজন উপলক্ষে জানুয়ারীর ১৮ তারিখে সমুদ্রযাত্রা । করে। এই সেমিনার অভিযানে কয়েকশ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী, বিজ্ঞানী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সরকারী কর্মচারী সহ স্বয়ং প্রেসিডেন্ট অংশ গ্রহণ করেন। বঙ্গোপসাগরের বুক থেকে সম্ভাব্য খাদ্য, খনিজ, ও ওষুধ সম্পদ আহরণ এবং দেশের অর্থনেতিক উন্নয়নে সেগুলােকে কাজে লাগাবার উপায় অনুসন্ধানের নিমিত্ত এই সেমিনারের আয়ােজন করা হয়। খনিজ সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে জাহাজের সেমিনারে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের মহাসচিব অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ডাঃ আর, , গণিসহ বিভিন্ন বিজ্ঞানী ভাষণ দেন।

সুন্দরী সুবেশী মহিলাদের আলুলায়িত চুল

২. ২৫-১-৮১ তারিখে টেলিভিশনে প্রতিভাবান ছাত্র-ছাত্রীদের সংক্ষিপ্ত অনুভূতি,

মতমত ও সাক্ষাৎকার টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারিত হয়। বলা বাহুল্য, এই পর্দায় সাক্ষাৎকার প্রদানকারী ব্যক্তিত্বদের চেহারা ও কন্ঠস্বরই প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের বুকে বিভিন্নখাদ্য, খনিজ ও ওষুধ সম্পদ, প্রাপ্তি ও আহরণ সম্পর্কে বিপুল ও প্রবল আশাবাদ। এরই ফাকে ফাকে কচিৎ-কখনাে পর্দা জুড়ে ভেসে উঠেছে সমুদ্রের ঢেউ-খেলানাে অশেষ জলধি, আর হু-হু হাওয়ার উচ্ছাস-যা বিশেষ করে সুন্দর ও সুবেশী মহিলাদের চুল আলুলায়িত করে দিয়ে যাওয়ায় বেশ বােঝা গেছে। অংশ গ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রীই প্রতিভাবন ও মেধাবী সেহেতু তাদের পক্ষে সমুদ্র সম্পদ প্রাপ্তি সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যদ্বাণী করে দেয়া সম্ভব। সুতরাং সেক্ষেত্রে কোন ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রয়ােজন আদৌ পরে না। জনৈক সুন্দরী সােৎসাহে এক পর্যায়ে যখন বঙ্গোপসাগরের বুকে কতাে কোটি(!) টাকার সােনা লুকায়িত আছে জানালেন, তখন হাস্যসম্বরণ করে সিরিয়াসলি সত্যিই বাহবা দিতে হলাে। সার্থক এ-সমুদ্র যাত্রা। হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন।এবং এই বিবিধ রতনেরা এক অভিনব ও অভূতপূর্ব সমুদ্র সেমিনারে সমবেত হয়ে সত্যি-সত্যিই অবলীলাক্রমে অনর্গল ভবিষ্যবাণী করে যেতে পারেন! সেজন্য শুরুতে বলেছি এবং আফসােস করেছি। জনৈক বিদগ্ধব্যক্তি আফসােস করেছেন এভাবেঃ হায়, আমরা কেন প্রতিভাবান মেধাবী অথবা ধুরন্ধর রাজনীতিক হতে পারলাম না। তাহলে তাে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুটা অন্তত সােনালী মরীচিকা সদৃশ অবদান রাখতে পারতাম। পাশাপাশি আর একটি ভাবনাও চকিতে উকি দিয়েছে অনেকের মনে।

হিজবুল বহর প্রসঙ্গ

, ১৯৭৭ সালের ১৮ই আগষ্ট বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ফ্রান্স থেকে যাত্রীবাহী এই জাহাজটি ৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ক্রয় করেজাহাজটি ছিলাে ২৭ বছরের পুরােনাে এবং ১৮১৬ জন যাত্রী পরিবহণের ক্ষমতাসম্পন্ন। হজ্ব মৌসুমে হজ্বযাত্রীদের পরিবহণ ও কয়েকটি বিলাসভ্ৰমণ ছাড়া বিএসসি কর্তৃপক্ষ একে কখনােই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করতে পারেনি। ফলে বছরের নমানই হিজবুল বহর চুপচাপ বসে থাকে। এভাবে বসিয়ে রেখে কেবল ইঞ্জিন চালু রাখতে গিয়েই বিএসসি এ-পর্যন্ত ৪কোটি ২০লাখ টাকা লােকসান দিয়েছে। অতঃপর এনইসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিপিং কর্পোরেশন জাহাজটিকে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন হিজবুল বহরকে গবেষণা জরিপ জাহাজের রূপান্তিত করা হবেএবং এই হস্তান্তরের আগে সম্ভবত এটাই হিজবুল বহরের শেষ প্রমােদাভিসার। এতােদিন ধরে ক্রমাগত লােকসান দিতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিদায়ের আগে সে তার ডেকে আয়ােজিত এক সেমিনারের কল্যাণে রকমারী আশার বাণী ও সম্ভাবনার ফানুস অনাগতকালের জন্য রেখে যেতে পেরেছে। বিদায়, হিজবুল বহর।

সামাজিক অপরাধ

৪. বিলাসবহুল জাহাজ হিজবুল বহরের এই প্রমােদভ্রমণের দাওয়াত প্রত্যাখান করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন ছাত্র। এরাও প্রতিভাবান ও মেধাবী। তারা সম্মিলিতভাবে মন্তব্য করেছেন, দেশের ব্যাপক দারিদ্য আর অশিক্ষার পরিবেশে এই ধরনের ব্যয়বহুল সমাবেশ সামাজিক অপরাধ। এই পাঁচ জন ছাত্র কলেন, সলিমউল্লাহ খান (আইন), আহমেদ আহসান (অর্থনীতি), ফেরদৌস হােসেন (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), মাহমুদুর রহমান (মনােবিজ্ঞান), ও ইমতিয়াজ আহমেদ (আন্তর্জাতিক সম্পৰ্ক)। সম্ভবত তারা এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য বিষয়ে সচেতন বলেই, শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রতিভাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে দেননি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন অংশগ্রহণকারী অন্যরা নিজেদের জ্ঞাতসারে হােক, অজ্ঞাতসারে হােক, নিজেদের প্রতিভা ও মেধাকে দলীয় রাজনীতির দূতক্রীড়ায় ব্যবহারের পদ সুগম করে দিয়েছেন। এ-কথা বলার কারণ, এ- জাতীয় প্রমােদভ্রমণে বাণী ও কথার ফানুস নানাভাবেই উড়ানাে হয়ে থাকে, কিন্তু আপামর। দেশবাসী কখনােই এ থেকে আদৌ কোনাে বাস্তব ফলাফল পায় না, শুধুমাত্র হাড়-মাংস কালি করে সরকারকে দেয়া আরাে বেশ কয়েক লাখ টাকা গচ্চা দেয়া ছাড়া!

প্রলােভিত মেধার বিষফল 

৫. প্রলােভিত মেধাকে রাজনেতিকভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে জিয়ার প্রচেষ্টার জুড়ি নেই। এভাবে বাংলাদেশ মেধার আর মননকে প্রলােভিত করে গড়ে তােলা হয়েছিল চাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অভি-নীরু সেই প্রলােভিত মেধার বিষফল। ছাত্র রাজনীতিতে জিয়াউর রহমান যে বিষবৃক্ষ রােপণ করে গেছেন তার ফলশ্রুতি আজ শিক্ষাঙ্গণ রণাঙ্গণেপরিণত হয়েছে।

তালিয়া বাজাও জোরে আরাে জোরে ?

৬. হেলিকপ্তটার, সাফারী ও হাততালিএই তিনটি জিনিসের প্রেসিডেন্ট জিয়া

সম্ভবত খুব দুর্বল। হেলিকপ্টার না হলে তার চলে না। গ্রামের মানুষের সাথে দেখা করতে শহর থেকে রাজনীতি গ্রামে নিয়ে যাবার জন্য তার চেষ্টার অন্ত নেই। বাংলাদেলে খুব কম ইউনিয়ন আছে যেখানে তার পদধূলি পরেনি। গ্রামের মানুষ তার পদস্পর্শে একেবারে যে কৃতার্থ হননি, তা বলা ঠিক হবে না। তাকে দেখা গেছে গ্রাম-গ্রামান্তরে। বছরে দিনের মধ্যে ৩শদিনই হেলিকপ্টার ভ্রমণ। হেলিকপ্টার তার নিত্য দিনের সাথী। 

৭. উর্দি পরতে-পরতে অভ্যাস গেছে খারাপ হয়ে। হঠাৎ করে ড্রেস পাল্টানাে যায় । কি করা যায়-খুঁজে বের করা হলাে সাফারী। সাফারী রাতারাতি হয়ে গেলাে পপুলার ছােট চাই থেকে শুরু করে বড় চাই পর্যন্ত সবার গায়ে সাফারী। দেখলেই বুঝা যায় এরা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী অর্থাৎ মার্শাল ডেমােক্রেসির ক্ষুদে সমঝদার। 

৮. এই হাততালির একটা ইতিহাস আছে। হাততালি লােকাল মেইড না-শােনা যায় উত্তর কোরিয়া থেকে আমদানী করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় এটা বহুলভাবে প্রচলিত। প্রেসিডেন্ট জিয়া একবার গিয়েছিলেন সেদেশে সফর করতে। সফর শেষে দেশে ফিরেই চালু করলেন অবিকলভাবে। প্রথম মাদারীপুরের এক জনসভায় এই হাততালি চালু হয়। সেদিন লােকজন খুব একটা সাড়া দেয়নি। এখন জাতীয় হাততালিতে পরিণত হয়েছে। হাততালি ছাড়া কোনাে অনুষ্ঠান কল্পনাই করা যায় না। হাততালির আবার ষ্টাইলও রয়েছে। হাততালি শুরু হলে কোরাস সুরে বলা হয়-জোরে আরাে জোরে । ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমীতে কোনাে এক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। এতে লেখা হয়েছিলাে হাততালি দিয়ে মহামান্যকে (প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাবেন।”

২০৬


জিয়ার বিদেশ নীতি ঃ এক্কা দোক্কা চালক

১. জিয়াউর রহমান তার পররাষ্ট্রনীতিকে বলেছেন একা দোক্কা চালতিনি বলেন,

ফরেন পলিসিটি কি? পররাষ্ট্র নীতি কি জিনিষ? আপনারা লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই। যে, গ্রামে ও শহরের অলিতে গলিতে ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা একটা খেলা করে যার নাম হলাে একা দোক্কা খেলা। অর্থাৎ একটা রেকটেঙ্গুলারের মধ্যে ছােট বেশ কিছু ঘর থাকে। একবার দাঁড়িয়ে একজন একটা পাথর পাথর ছুড়ে মারে। (চালমারে) অর্থাৎ এক্কা দোক্কা চাল। তারপর এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরের। মধ্যে যায়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু নিয়ম-কানুন থাকে। তা হলাে সব ঘরেই এক সঙ্গে যাওয়া যাবে না। একটায় গেলে অপরটায় যাওয়া নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। ফরেন। পলিসিটাও তাই। ফরেন পলিসি অনেকটা এক্কা দোক্কা খেলা।”… তিনি আরাে বলেন, “পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে আভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটা একসটেনশন। কথাটি সত্যি। কারণ ঘরের মধ্যে দুর্বল থেকে বাইরে গিয়ে কিছু করা যায় না।” 

২. জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্র নীতির এক্কা দোক্কা খেলাটি খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তিনি পররাষ্ট্রনীতিকে অত্যন্ত স্বার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন স্বীয় স্বার্থে, দেশ ও জাতির জন্য নয়। ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং বিদেশে তার নিজের ইমেজ গড়ে তােলার কাজেই জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতি আবর্তিত হয়েছে। জিয়ার রহমান-এর ক্ষমতা দখলের নেপথ্যে দেশী ও বিদেশী পরাজিত ছ, শক্তি পাকিস্তান, চীন এবং এর অন্তরালে সৌদি সমর্থন বিদ্যমান। পাকিস্তান-সৌদি রাজনৈতিক বলয়ে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পেয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করার এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭৬ সনে মে মাসে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ৪২টি মুসলিম দেশসমূহের দ্বারা গঠিত ইসলামিক কনফারেন্স সংস্থার অধিবেশনে যােগদান করে দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রবর্তনে প্রতিশ্রুতি দিয়ে। আসেন।

৩. ১৯৭৪ সনে সৌদি বাদশা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘােষণার কথা বললে বঙ্গবন্ধু তার বিপরীতে বাদশাকে বলে পাঠান যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। এখানে সব সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম পালনের অধিকার থাকবে। শুধু তাই নয়, তিনি সৌদি বাদশাকে একথা বলেও অভিযুক্ত করেন যে, বাংলাদেশে মুসলমান নর-নারীর উপর যখন পাকস্তিানী সামরিক বাহিনীকে অত্যাচার, গণহত্যা ও ধর্ষণ করছিলাে তখন পবিত্র মক্কা শরীফের হেফাজতকারী হিসেবে কেন তিনি তার। প্রতিবাদ করেন নি। এরপর স্বাভাবিক কারণেই সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেনি।

৪. বাংলাদেশে বেতার নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তানী ভাবধারায় রেডিও বাংলাদেশথেকে খুনী মেজর (অবঃ) ডালিম ১৫ই আগস্ট ৭৫ সনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাল্লাদেশ-এর স্থলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশঘােষণা প্রদান করে। এই ঘােষণার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো সৌদি বাদশাকে এ ঘােষণার কথা অবগত করালে সৌদি বাদশা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করেনি। 

৫. কিন্তু ধূর্ত খন্দকার মােশতাক বাস্তব অবস্থা এবং জিয়াে-পলিটিক্যাল অবস্থান। বিবেচনা করে ঐ ঘােষণা কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে ঐ সময়ের জন্য সমীচীন। মনে করেনি। ফলে ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশনামে ঘােষিত না। হলেও কার্যতঃ পাকিস্তানী ধারায় রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হতে থাকে।

৬. জিয়াউর রহমানের ১৯৭৬ সনের তুরস্ক এবং তুরস্ক হতে পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করেন। জেনারেল জিয়ার সফরের পূর্বেই ১৯৭৬ সনের ৮ই মার্চে মঙ্গলবার ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেছেন যে, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন এটাই স্বাভাবিক এবং বিশ্বের কোন দেশের এটাকে ভুল বােঝা উচিৎ নয়।পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ৮ই মার্চ ইসলামাবাদে বাংলাদেশের সাথে বিশেষ সম্পর্ক এবং দ্বিপাক্ষিকতার মনােভাবের ওপর বিবৃতি দিচ্ছিলেন। বিবৃতিতে জনাব ভুট্টো বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রশ্নে বিস্তারিত বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, কোন দেশ আমাদের ভুল বুঝলে সেটা খুবই অন্যায় হবে।জনাব ভুট্টো বলেন, অতীতে আমরা পরস্পরকে যেভাবে জেনেছি ভবিষ্যতেও আমরা পরস্পরকে অনুরূপভাবে উপলব্ধি করব। আমরা সুসময়ে ও দুঃসময়ে মিত্র হিসেবে একযােগে কাজ করে।

যাবাে।তিনি ঘােষণা করেন, প্রতিটি সংকটে ও প্রতি মুহূর্তে আমরা পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াবাে 

৭. জনাব ভুট্টো যখন এই বিবৃতি দিচ্ছেলেন, তখন তার পাশে ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আলহাজ্ব মােহাম্মদ জহির উদ্দিন। তার দিকে ফিরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। বললেনঃ এই মুহূর্তে আমার পাশে একজন রাষ্ট্রদূত আছেন যাকে আমি রাষ্ট্রদূত বলতে পারি না। তবু তিনি একজন রাষ্ট্রদূত। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তাঁকে আমি রাষ্ট্রদূত বলি কি করে? তিনি আমাদের ভাই। তিনি ও আমরা একত্রে কাজ করেছি। তিনি ও আমরা একই পরিষদের সদস্য ছিলাম। তিনি ও আমরা একই। পার্টি কংগ্রেসে যােগ দিয়েছি। তিনি ও আমরা এক সঙ্গে দাঁড়িয়েছি এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে বলেছি। তিনি ও আমরা পল্টন ময়দান, মােচিগেট ও অন্যান্য বহুস্থান থেকে বক্তৃতা করেছি। তা সত্ত্বেও তিনি একজন রাষ্ট্রদূত। কারণ বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ।জনাব ভুট্টো বলেন, “অবশ্যি একই সময়ে তাদের ও আমাদের মধ্যে একটি বিশেষ সম্পর্কও রয়েছে এবং এটা স্বাভাবিক এবং বিশ্বের কোন দেশেরই এটাকে ভুল বােঝা উচিৎ নয়। বিশ্বের কোন দেশ যদি ভুল বুঝে সেটা খুবই অন্যায় হবে। কারণ অতীতে আমরা পরস্পরকে যেভাবে জেনেছি ভবিষ্যতেও আমরা পরস্পরকে অনুরূপভাবে উপলব্ধি করবাে এবং সুসময়ে ও দুঃসময়ে মিত্র হিসাবে আমরা একযােগে কাজ করে যাবাে। প্রতিটি সংকটে ও প্রতি মুহূর্তে আমরা পরস্পরের পাশে দাঁড়াবাে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে আমি এই আশ্বাস দিচ্ছি। তাদেরকে জানিয়ে দিন যে, তাদের বিপদে-আপদে আমরা তাঁদের পাশেই রয়েছি এবং আমরা তাদের পার্শ্বে দাঁড়াবাে যেমন করে আমাদের গৌরবােজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা পরস্পর পাশে দাঁড়িয়েছি। ভুট্টোর বিবৃতি প্রকাশের পর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে বেপরােয়া ও লাগামহীন আক্রমণ শুরু করেন। 

৮. প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তার দেশের শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের নিকট অস্ত্র প্রেরণ করেন’- এই মর্মে ভারতীয় প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানী মুখপাত্রের জবাব ছিলাে আত্মরক্ষামূলক। বাংলাদেশে পাকিস্তানী অস্ত্র পাঠাননার অভিযােগ ভিত্তিহীন। বালাদেশের পাকিস্তান সমর্থক লােকজনের কাছে পাকিস্তান গােপনে জাহাজযােগে অস্ত্র পাঠিয়েছেন বলে ভারত যে অভিযােগ করেছে ইসলামাবাদে পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র তাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করেছেন, পাকিস্তানী। সরকারী সূত্রের এক বিবৃতির উদ্ধৃতি উল্লেখ করে এনার সংবাদদাতা এ খবর দিয়েছে।


পাকিস্তানীদের সাহায্য করার জন্য পাকিস্তান গােপনে বাংলাদেশে জাহাজযােগে অস্ত্র পাঠাচ্ছে-এই ভারতীয় অভিযােগ খন্ডন করে গত ১৮ই মার্চ ৭৬ ইসলামাবাদে পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র উক্ত বিবৃতি দেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে পাকিস্তানের সদিচ্ছার ওপর প্রশ্ন তুলে ভারত যে অভিযােগ করেছে পাকস্তিানী পররাষ্ট্র দফতরের উক্ত মুখপাত্র তা দ্ব্যর্থহীনভাবে অস্বীকার করে বলেন, ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির অধীনে পাকিস্তান যে কোন একটি অথবা অমীমাংসিত তিনটি প্রশ্ন নিয়েই নয়াদিল্লীর সঙ্গে আলােচনা করতে প্রস্তুত। 

৯. পাকিস্তানী মুখপাত্র ভারতের সংঙ্গে পাকিস্তানের যে তিনটি অমীমাংসিত সমস্যার উল্লেখ করেন সেগুলাে হচ্ছে- দুদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, একে অন্যের আকাশসীমা দিয়ে বিমান চলাচলের পারস্পরিক অধিকার এবং কাশ্মীর সমস্যা। পাকিস্তানী মুখপাত্র তার বিবৃতিতে উক্ত ভারতীয় অভিযােগকে সম্পূর্ণ। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন।৬ এই প্রেক্ষাপটে সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের পাকিস্তান গমন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি তাকে দেশের স্বাধীনতা বিরােধী চক্রের সহযােগিতা পেতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। 

১০. সৌদি আরব, তুরস্ক বিশেষ করে পাকিস্তান হতে আশ্বস্ত হয়ে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি আবু সাদাত মােহাম্মদ সায়েমের হাত থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি কেড়ে নিতে বিলম্ব করেন নি। এর পূর্বে তিনি বালাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যারা সক্রিয়ভাবে বিরােধিতা করে হত্যা, খুন লুঠ অগ্নিসংযােগের মত গুরুতর অভিযােগে দালাল আইনে অভিযুক্ত ছিলাে সেই দালাল আইন সম্পূর্ণ বাতিল করে তাদের রাজনীতি করার অধিকার প্রদান করেন।

১১. একই সাথে বাঙালী জাতীয়তাবাদ পরিবর্তন করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ঘােষণা দিয়ে পাকস্তিানী শিল্পপতিদের শিল্প কারখানা ফেরৎ দেবার ব্যবস্থা করেন। জিয়াউর রহমান দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে গােপন চুক্তি করে পাকিস্তানীদের ব্যবসা বাণিজ্যে অবাধ সুযােগ প্রদান ও পাকিস্তানীদের শিল্প কলকারখানা ফেরৎ দেন যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় স্বার্থে এসব শিল্প কলকারখানা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে জনগণের সম্পতিতে পরিণত করেছিলেন। ১৯৭৬ সনে ঢাকায় বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকায় এ বিষয়ে সংবাদ ছাপা হয়। যােগ করতে হবে।

১২. পাকিস্তান ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের সহায়তায় জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক প্রশাসকের করায়ত্ত করার পর প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাৎ মােহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদ হতে বিতাড়িত করে স্বয়ং পদটি দখল করার জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করেন। জিয়াউর রহমান ইতিপূর্বেও বালাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে বিরাজমান বিশৃংখলা নিরসনে বিশেষ বগুড়া ও ঢাকায় সেনাবিদ্রোহ দমনে কোটি উইলিয়াম কর্তৃপক্ষের সাহায্য জামনা করেন। জিয়ার সমর্থনে সেদিন ভারতীয় ট্যাংক ও বিমান বহর সজ্জিত ছিল।

১৩. জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সনে জানুয়ারিতে চীন সফর করে তাদের আশীর্বাদ লাভ করেন। চীনের সঙ্গে আর্থিক বাণিজ্যিক এবং প্রযুক্তি বিষয়ে চুক্তি করেন। এই যুক্তির ফলে চীন বাংলাদেশকে ৭৫ থেকে ৮১-৮২ পর্যন্ত ৮ কোটি ডলার ঋণ। দেয়। বালাদেশ চীন থেকে পণ্য আমদানী করে ২৮৪.৫২ মিলিয়ন ডলার। চীনে রপ্তানী করে মাত্র ৬৫.৯৮ মিলিয়ন ডলার এবং চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য | ঘাটতি দাঁড়ায় ২১৮.৫৪ মিলিয়ন ডলার। চীন বাংলাদেশের সামরিক অফিসারদের  প্রশিক্ষণ দেয় এবং সামরিক সরঞ্জামাদি প্রদান করে। চীনের রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক নেতৃত্বের অধিষ্ঠান ও কর্তৃত্ব জিয়ার মনে এই প্রতীতি আরাে দৃঢ় করে যে তাকেই রাষ্ট্রপরিচালনার সর্বময় ব্যক্তি হতে হবে। 

১৪. জিয়ারপ্রেসিডেন্ট পদক দখলে ভারতের সম্মতি ছিলাে অপরিহার্য। জিয়াউর রহমান এ জন্য ভারতকে ছাড় দেন। ভারতের বিরুদ্ধে বাহ্যতঃ প্রচার করলেও ভারতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আমলের সকল চুক্তি বহাল রাখেন, এমন কি পানি সমস্যা ও বাণিজ্য

বিষয়ে আরাে বেশী ছাড় দেন। 

১৫. জিয়াউর রহমানের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণের পূর্বে ১৯৭৭ সনের ১৬-১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ভারতীয় মন্ত্রী জগজীবন রাম ঢাকায় অবস্থান করেন এবং কয়েক দফা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শ্রী মােবারজী দেশাই ক্যাবিনেটের মন্ত্রী হিসেবে শ্রী জগজীবন রাম পানি বন্টন সম্পর্কে আলােচনার জন্য আসেন। কিন্তু পানি বন্টন সম্পর্কে আলােচনার কোন অগ্রগতি দেশবাসী জানতে পারেনি। জগজীবন রাম ভারতে প্রত্যাগনের ৭২ ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ ২১শে এপ্রিল ১৯৭৭ সনে বিচারপতি সায়েমের নিকট হতে গভীর রাতে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট পদ কেড়ে নেন। জিয়ার বিলাসী বিদেশ সফর

১৬. জেনারেল জিয়ার বিদেশ সফর নিয়ে বহু চমকপ্রদ কথা বাজারে চালু রয়েছে। গরীব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে জিয়ার বিদেশ সফর ছিলাে রাজকীয়। যেন

গােটা দেশটাই ছিলাে জিয়াউর রহমানের জমিদারী এবং তালুক। সে হিসেবেই জিয়াউর রহমান তার রাজত্ব পরিচালনা করেন। জিয়াউর রহমানের আমলে সর্বদিকে অপব্যয় সীমা ছাড়িয়ে যায়। জিয়াউর রহমান বিদেশ সফরকালে ভাড়া করা বিমান ভর্তি করে তােক নিয়ে যেতেন। তার প্রতিনিধি দলে দলীয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ছাত্র, ব্যবসায়ী, সিনেমা শিল্পী ও আত্মীয় স্বজনও থাকতেন। কোন কোন সময় চিত্রনায়ক, চিত্র নায়িকা এবং টেলিভিশনের সুন্দরী রমনীরা আঁর সফরসঙ্গী থাকতেন।

বাহারী খরচ

১৭. ৭৮ সাল থেকে ৮১ সালের মে মাসে নিহত হবার পূর্ব পর্যন্ত জেনারেল জিয়া

অন্ততঃ ৫০টি দেশ সফর করেন। কোন কোন দেশ সফর করেন ২/৩ বার। জিয়ার বিদেশ সফরে কম করে হলেও ২০ কোটি টাকার বেশী খরচ হয়েছে। জিয়ার সফরের পূর্বে একটা অগ্রগামী দল বিদেশ যেতাে। তাদের কাজ ছিলাে সেদেশের পত্রিকায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের ছবি ও গুণকীর্তন প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা। ১৯৮০ সালের জুন মাসে জিয়ার লন্ডন সফরকালে গার্ডিয়ান ও টাইমস পত্রিকায় বিশেষ সংখ্যা বের করার জন্য খরচ হয় ৩০ হাজার পাউণ্ড। ৮১ সালের গােড়ার দিকে পশ্চিম জার্মানী সফরকালে পত্রিকা ও টিভিতে ছবি প্রদর্শনের জন্য ব্যয় হয় ৫০ হাজার পাউণ্ড। ৮০ সালে নয়াদিল্লী সফরের সময় টাইমস অব ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্থান টাইমস কাগজে বিশেষ সংখ্যা বের করার জন্য ব্যয় হয় প্রায় ১০ হাজার পাউণ্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর কালে প্রায় ২০ লক্ষ ডলার ব্যয় হয়। বিদেশ সফর শেষে জিয়ার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হাজার হাজার টাকা খরচ করে দ্রব্যসামগ্রী কিনে আসতেন। ৭৯ সালে ভিসিআর আনার দায়ে প্রেসিডেন্টের মুখ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা হাতে নাতে ধরা পরে। তাছাড়া বিদেশে তাদের কারাে কারাে হােটেলে থাকাকালীন কেলেংকারীর কথাও প্রকাশ হয়ে পড়ে।

রাতে বাংলাদেশ ব্যাংক খােলা হলাে

১৮. প্রতিবার যখনই প্রেসিডেন্ট জিয়া বিদেশে সফরে গেছেন তখন একটি না একটি চমকপ্রদ ঘটনার অবতারণা ঘটেছে। প্রেসিডেন্ট-এর বিদেশে সফরের একদিকের চিত্রই শুধু দৈনিক সংবাদপত্রসমূহকে স্থান পায়। চিত্রের অপর দিক সব সময় অপ্রকাশিত ও অকথিতই থেকে যায়। এমন দুটি ব্যাপার ঘটেছে, প্রেসিডেন্ট-এর বিগত দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও । ডাঃ রুমানিয়া সফরের সময়। 

উত্তর কোরিয়ার বিগত জাতীয় দিবসে প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য বিশ্বের বিশেষ করে এশিয়ার প্রায় ৫০টি দেশের রাষ্ট্র প্রধানকে দাওয়াত করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসব দেশ সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেনি। তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে ঐ দাওয়াত সানন্দে কবুল করেন। প্রেসিডেন্ট প্রায় একশত জন সদস্যর একটি বিরাট বাহিনী নিয়ে যান। এই বিরাট বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন সমাজের নামগােত্রহীন ব্যক্তি, যারা দেশে কোন গুরুত্বের অধিকারী নন। আর বিদেশে তাে তাদের কোন প্রয়ােজনই ছিলােনা। প্রতিনিধি দলে ছিলেন যুবক, ছাত্র ও তরুণী। এই সমস্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের শুধুমাত্র বিদেশে নিয়ে যাওয়ার আগের ঘটনাও চমকপ্রদ। ঐ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মচারীদের ধর্মঘট চলছিলাে। ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাভাবিক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ ছিলাে। তৎসত্ত্বেও বিশেষ ব্যবস্থাহীন বিকেল এবং রাতে ব্যাংক খুলে মুদ্রার ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গীদের মধ্যে এমন সব ব্যক্তিও রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা এখনও বিচারাধীন ছিল। 

সফরসঙ্গী রুমানা আহমদ, নাশিদ কামালসহ 

১৯. প্রেসিডেন্টর রুমানিয়া ও তুরস্ক সফরের কাহিনীও মুখরােচক। প্রেসিডেন্ট রুমানিয়া যাওয়ার দুদিন পূর্বে জাপানী অনুদানে সংগৃহীত সিটি অব টোকিওনামক বােয়িং বিমানটি ঢাকায় আসে। আর ঐ বিমানটিতে তিনি নিয়ে যান প্রায় ৭০ জন সদস্যের দলবল। প্রেসিডেন্টকে বিদেশে সফরে শাহান শাহ্, বাদশাহর মত চলাফেরা করার অধিকার জনগণ দেয়নি। অখ্যাত অজ্ঞাত লােকের বাদশা সুলভ ভ্রমণে শােভাবর্ধন করতে পারে, কিন্তু এই দরিদ্র দেশের জন্য বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় জনগণ কেন মেনে নেবে। রুমানা আহমদে আর নাশিদ কামালের মত ২০/২২ বৎসরের তরুণীরা প্রেসিডেন্টের সফরের অঙ্গসৌষ্ঠর বর্ধন ছাড়া আর কি কাজে এসেছে?

সফর কি রাজনৈতিক ঘুষ?

২০. প্রেসিডেন্টের বিদেশ সফরের সময় যে সমস্ত বেসরকারী ব্যক্তি তার সঙ্গী হচ্ছেন

পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট এর জাতীয়তাবাদী দলে তাদের নাম শােভা পাচ্ছে। বিএনপি করার জন্য এ ধরনের রাজনৈতিক ঘুষ দিয়ে বিদেশী মুদ্রার অপচয় আর

বিচারাধীন আসামীরা প্রেসিডেন্টের বিদেশ সফরে সহগামী হয় কি করে? উত্তর কোরিয়া, রুমানিয়া ও তুরস্ক সফরের সময় প্রতিনিধি দলের প্রতিটি সদস্যের নামধাম প্রকাশ করলে এসব সত্য উদঘাটিত হবে।

জিয়ার সফর সঙ্গী রােজি সামাদ ঃ ঘর ভাঙলাে

রােজী ও সামাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর পত্র পত্রিকায় কেউই প্রকাশ্য বিবৃতি দেননি। অভিনেত্রী রােজী ও চিত্র গ্রাহক পরিচালক কাজী আবদুস সামাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তাদের দুজনের একান্ত বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ ক্ষীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কেন এমনটি হলাে? এই বিশ্লেষণে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা লিখেছে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার আগে জার্মানী সফর করেছিলেন। রােজী সম্মানিতা রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী ছিলেন। আর সে খবর জার্মানীর পত্র-পত্রিকায় ছবি সহকারে ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিলাে। মনস্তাত্তিক দিক থেকে রােজীর জার্মানী সফর রােজী-সামাদের সম্পর্কের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রভাব ফেলে। রােজী ঐ সফরের পর হতেই নাকি নিজেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের একজন ব্যক্তি হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। তার সঙ্গে নাকি যােগাযোেগ গড়ে ওঠে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের। একটা ডােন্ট কেয়ার ভাব গড়ে ওঠে রােজীর মধ্যে। সামাদ যেন তার কাছে গৌণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। এই অভিযােগ অনেকের। জার্মানী পত্র-পত্রিকায় নানারূপ কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। একটি পত্রিকায় একটি বিরাটাকৃতি বেমানান ওভারকোট পরিহিত জিয়াউর রহমানের ছবি ছাপিয়ে ক্যাপশন বলা হয়, “বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শীতকালীন সময়ে জার্মানী সফরে ওভারকোট ও আনতে ভুলে গেছেন, কিন্তু সাথে করে সুন্দরী রমণী আনতে ভুলেননি।

ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট কোণঠাসা হয়

২২. জিয়াউর রহমান স্বেচ্ছাচারী কায়দায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাঠামাে ও নিয়মনীতি ভেঙে ফেলতে দ্বিধা করেনি। বিদেশের মাটিতে জিয়াউর রহমান ও তার সরকারের প্রশংসা তুলে ধরার লক্ষ্যে তিনি ইচ্ছেমত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটদেরকোণঠাসা করে রাখেন। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তার নীতি ছিলাে স্পষ্ট। তার নিকট যা ভালাে মনে হতাে তার উপর ভিত্তি করেই পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়ন করতেন। এই লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাটদেরকোণঠাসা করে বিদেশী মিশন সমূহে ৩২ জন সামরিক

অফিসারদের নিয়োেগ করেন।  সামরিক অফিসারদের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ও পরিবারবর্গের আত্মস্বীকৃত খুনীদেরও বিদেশ মিশনে কূটনৈতিক দায়িত্ব প্রদান করেন। এমনকি খুনী ফারুক-রসিদকেও কটনৈতিক পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন।

পররাষ্ট্রনীতির আরেক দোক্কা ঃ দূতপুল .

২৩. জেনারেল জিয়ার নিকট পররাষ্ট্রনীতি কোন নীতিই ছিলােনা। যখন যেমন তেমনভাবে তিনি পররাষ্ট্রনীতিকে পরিচালিত করেছেন। উদাহরণ দূতপুল গঠন। জিয়াউর রহমান দূতপুল সদস্যদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, “বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য ও সহযােগিতা পাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে দূতপুল সদস্যগণ অবদান রাখবেন। জাতীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৫৩ জনকে নিয়ে দূতপুল গঠন করা হয়। এদের মর্যদা প্রতিমন্ত্রীর সমতুল্য। বলাবাহুল্য, বিএনপির জাতীয় সংসদ সদস্যগণের মধ্য হতেই দূতপুলের সদস্যদের নিয়োেগ করা হয়। মন্ত্রী, উপ-মন্ত্রী ও তাদের পদমর্যাদা সম্পন্ন জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে দূতপুল গঠনের ফলে এর সংখ্যা দাঁড়াল ১৩০জন। দূতপুল গঠনের নেপথ্যে ছিলাে বিভিন্ন দল থেকে আগত এবং পরস্পর কোন্দলরত দলীয় সদস্যদের সন্তুষ্ট রাখার কৌশল। বিদেশে গিয়ে সেদেশের সরকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আচরণের ও কথাবার্তার রাজনীতি, যাকে বলে কূটনৈতিক আচার-আচরণ সে সম্পর্কে এসব সদস্যদের আদৌ কোন অভিজ্ঞতা নেই। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, কূটনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র দু/চার ঘন্টা ক্লাস করে অর্জন সম্ভব নয়। অথচ জিয়াইর রহমান সেই প্রশিক্ষণের কাজটিই শুধু করেছেন।ফরেন সার্ভিসের কাজ করার নীতিসিদ্ধ প্রথা আছে। সেক্ষেত্রে যাদের নিয়ােগ করা হয়েছে তাদের শিক্ষাগত যােগ্যতা যাই থাকুক না তাদের অবস্থা দাঁড়াবে পেয়ার আলীদের মতাে ইয়েসে’, ‘নাে’ ‘ভেরি গুড়জাতীয় কথাবার্তায়। দূতপুল গঠন। করে জিয়াইর রহমান দলীয়করণ নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের কূটনৈতিক রাজনীতিকে কলুষিত আবর্তে ঠেলে দিয়েছেন।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঃ জিয়ার পদক্ষেপ

ফারাক্কা ইস্যু 

২৪. ১৯৬০ সনের এপ্রিলে ভারত সরকার গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা ব্যারাজ করার প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রধানতঃ কলকাতা বন্দরের ন্যব্যতা বজায় রাখাই ছিলাে এর মূখ্য উদ্দেশ্য এবং নদীর উপর সেতু হিসেবে যােগাযােগ ব্যবস্থাও গড়ে তােলে। ১৯৭০ সনে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ শেষ হলেও। সংযােগ খাল সম্পূর্ণ হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভারত-বাংলাদেশ যুক্ত নদী কমিশন গঠিত। হয়। ১৯৭৪ সনে ১৩ই মে ভারতের সঙ্গে চুক্তি হয়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে একটি চুক্তির ভিত্তিতে কমপক্ষে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশ পাবে এবং ফারাক্কায় প্রাপ্ত পানির ৮০% ভাগ বাংলাদেশ পাবার অধিকারী হবে শুষ্ক মৌসমে বিশেষ করে ২১ এপ্রিল হতে ৩১শে মে পর্যন্ত, ৪১ দিন। ৭৫ সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ভারত বিদ্বেষ উস্কে দেয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে স্বাধীনতা বিরােধী চক্রকে রাজনীতি করার অনুমতি প্রদান করে। এবং ফারাক্কা চুক্তি করে বঙ্গবন্ধু ভারতের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়েছে এই মর্মে ব্যাপক প্রচার, অপ্রচার চালানাে হয়। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত ধূর্তার সঙ্গে চীনপন্থী নেতৃবৃন্দকে ভারত বিরােধী প্রচারণায় নামাতে সমর্থ হন। মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে স্বাধীনতা বিরােধী চক্র ও চৈনিক পন্থী ফারাক্কা ইস্যুকে নিয়ে তােলপাড় শুরু করে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বলয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ স্বাধীনতার সময় যে সমস্ত দেশ বিরােধীতা করেছিল তাদের সমর্থন লাভে জাতিসংঘে ফারাক্কা ইস্যু উথাপন করে। কিন্তু জাতিসংঘ হতে বলে দেয়া হয় দু দেশ বসে এর ফয়সালা করুন। ১৯৭৭ সনের নভেম্বর মাসে জিয়াউর রহমান সরকার ভারতের সঙ্গে একটি । চুক্তিতে আবদ্ধ হন। চুক্তি মােতাবেক বাংলাদেশ কমপক্ষে ৩৪ হাজার কিউসেক। পানি শুকনাে মৌসমে পাবে এবং তা এপ্রিল মাসের শেষ দশ দিনে। তিন বছরের জন্য এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির এই অন্তবর্তীকালীন সময়ে শুকনাে মওসুমে গঙ্গার প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়ে যৌথ নদী কমিশন জরীপ চালাবে। বাংলাদেশের আর্থ। পরিবেশগত ক্ষেত্রে গঙ্গার পানি প্রাপ্যতা জীবন মরণ সমস্যা। জিয়াউর রহমান মুখে যাই বলুন না কেন- ফারাক্কার ন্যায্য পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সমুন্ন রাখতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

দেশাইয়ের সফর ও নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পবিত্র কোরানের আয়াত লেখা সাইনবোের্ড সরিয়ে ফেলা হলাে।

২৫. ১৯৭৯ সনে জাতীয় সংসদে নির্বাচনের পরপরই গঠিত মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী পদ অলংকৃত করে স্বাধীনতা বিরােধীতাকারী কুখ্যাত শাহ আজিজুর রহমান। নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের একদিন পরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মােরারজী দেশাই। তিনদিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অটল বিহারী রাজপেয়ী পররাষ্ট্র সচিব মিঃ মেহেতা, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিব শ্রী শংকর, সেচ সচিব মিঃ প্যাটেলসহ ৫৪ সদস্যের একটি স্কুল প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী ছিলেন। ৭৬ সনে জিয়াউর রহমান ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ও মােড়ে প্রায় অর্ধশত বড় বড় সাইনবোের্ড টানিয়ে কোরানের আয়াত লিখে দিয়েছিলেন। কোরানের আয়াতের পাশপাশি বাংলায় তার অনুবাদ ছিলাে। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মােরারজী দেশাই এর আগমনের আগের রাতে সমঢাকা শহরে স্থাপিত অর্ধশত কোরানের আয়াত সম্বলিত সাইনবাের্ড রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা হলাে। ৭৮ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ৭৯ সনের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় জনগণের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করার লক্ষ্যেই কোরানের আয়াত সম্বলিত সাইনবাের্ড টানানাে হয়েছিলাে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই এর আগমনে ভারতের নিকট বাংলাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষ চেহারা তুলে ধরার জন্য জিয়াউর রহমান কোরানের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেন। 

২৫ বছরের চুক্তি সম্পর্কে 

২৬. ১৯৭৫ সনের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্পর্কে মিথ্যা অপপ্রচারের এক বিরাট হাতিয়ার হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে কুৎসা রটনা করতে থাকে। জিয়াউর রহমান ২৫ বছরের চুক্তি সম্পর্কে প্রকাশ্য না বললেও আকারে ইংগিতে এই চুক্তিকে গােপনীয় চুক্তি, ভারতের নিকট দাসত্ব বলতেন। ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্রপতি সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান থেকে তারই মন্ত্রীদের দ্বারা এ ধরনের প্রচারণা চালানাে তা শুধু কূটনৈতিক রীতিনীতি বিরুদ্ধ নয় বরং তা দেশের ভবমূর্তিকেও ক্ষুন্ন করেছে। কোন চুক্তি দেশের স্বার্থ বিরােধী হলে সরকারের উচিত দেশবাসীকে তা জানানাে। ২৫ বছর চুক্তি কোন গােপন চুক্তি নয়। এই চুক্তির বিবরণ প্রচার করা হয়েছে। এই চুক্তির মধ্যে জাতীয় স্বার্থ বিরােধী কোন অনুচ্ছেদ থাকে তবে চুক্তির শর্ত মােতাবেক আলােচনার ভিত্তিতে তা স্থগিত কিংবা বাতিলযােগ্য। চুক্তিটির জিয়াউর

রহমানের সাফারীর পকেটেই আছে। চুক্তিটি সাধারণের প্রকাশ করে বলা হােক কোন্ কোন্ অনুচ্ছেদ ধারা দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করেছে? জিয়াউর রহমান নিজেই জানেন এবং ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তির কোন ধারা বা অনুচ্ছেদই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব পরিপী কোন কিছু নেই। জেনে শুনও তিনি ও তার মন্ত্রীবর্গ ২৫ বছরের চুক্তিকে গােলামীর চুক্তি হিসেবে আকার ইংগিতে বা প্রকাশ্যে আখ্যা দিচ্ছেন। পার্লামেন্টে (৯৩ সনে) একজন সংসদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন মন্ত্রী মহােদয় মনে করেন কিনা ২৫ বছর চুক্তি গােলামীর চুক্তি? তার উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জবাব দিয়েছেন-চুক্তির শিরােনামই হলাে এর উত্তর। চুক্তি শিরােনাম হলােগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভরতীয় সাধারণতন্ত্রের মধ্যে মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তিচুক্তি[পরিশিষ্ট-১০] সীমান্ত তিন বিঘা, বাণিজ্য, চোরাচালান, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা কোন সমস্যাই সমাধান জিয়াউর রহমান করতে পারে নি।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক

২৭, ৫ লাখ অবাঙালী যারা পাকিস্তানকে তাদের মাতৃভূমি ও পাকিস্তানে ফিরে যাবার জন্য ৭২-৭৩ সনে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির নিকট অশন দিয়েছিলাে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগষ্টের মধ্যে তাদের ১ লক্ষ ৭০ হাজার অবাঙালী প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ঐ অবাঙালীদের পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনে ব্যর্থ হন। মূলতঃ জিয়া এসময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ১৯৭৭ সনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পাকিস্তানে সফরে গেলে পাকিস্তান প্রত্যাবর্তন কর্মসূচীতে রাজী হন। ১৯৭৮ সনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পাকিস্তানে গেলে মাত্র ১৬ হাজার অবাঙালী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৯৮০ সনে পাকিস্তানী পররাষ্ট্র সচীব বাংলাদেশে এলে কৌশলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। জিয়া একজন অবাঙালীকেও পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠাতে পারেননি। এটি ছিলাে বিরাট কূটনৈতিক পরাজয়। পাকিস্তানের নিকট পাওনা সম্পদ 

২৮. জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তানের নিকট ১৯৭১ সনের মূল্যবান অনুসারে

২৪৪৬ কোটি টাকা এবং যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হিসেবে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩২৪১ কোটি সর্বমােট ৫,৬৮৭ কোটি টাকা বাংলাদেশকে পরিশােধের জন্য চাপ দেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই চাপ তীব্রতর হয়েছিল। এই ন্যয্য পাওনা টাকা আদায়ের চাপ প্রদানের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করেন নি।  মােশতাক-জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে প্রথমেই কূটনৈতিক মিশন ও রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করেন। জিয়াউর রহমান ৭৭ সনে পাকিস্তানে গিয়ে এ সম্পর্কে আর কোন প্রশ্ন তুলেননি। জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেবার এমন নজির বিশ্বে খুবই কম আছে। বর্তমান হিসেবে এই টাকার পরিমাণ ৩০ হাজ৭ কোটি টাকা।

তালপট্টি দ্বীপ 

২৯. দক্ষিণ তালপট্টি হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মােহনায় জেগে ওঠা একটি নতুন দ্বীপ। ১৯৭৮

সনের এর আয়তন দুবর্গ মাইল। ১৯৭০ সনে দ্বীপটি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৭৮ সনে ভারত দ্বীপটিতে সৈনা নামায়। এ প্রেক্ষিতে ২৭শে মে জাতীয় সংসদে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে ভরতীয় সামরিক হস্তক্ষেপেরে বিষয়ে উথাপিত মূলতবী প্রস্তাবে অংশ নেয়ার সময় বিরােধী দলীয় সংসদগণ যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত ভূখন্ড রক্ষার সংকল্প ঘােষণা করেন। তারা আরাে বলেন জিয়া সরকারের ব্যর্থ পররাষ্ট্রনীতির জন্যই আজ দক্ষিণ তালপট্টিত্বে ভারতীয় পতাকা উড়ছে।

রাষ্ট্রপতি দুর্বল কণ্ঠ 

দক্ষিণ তালপট্টি সমস্যা সমাধানে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে- এ-কথাটা রাষ্ট্রপতি এমন এক মুহুর্তে বলেছেন যখন দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানার প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে মতবিরােধ চলছে। বিশেষ করে যে মুহূর্তে ভারত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে সৈন্য নামিয়েছে সে মুহূর্তে দেশের সার্বভৌম স্বার্থের প্রশ্নে। রাষ্ট্রপতির দেয়া ঐ প্রতিশ্রুিতি নানা কারণেই অর্থবহ। দেশবাসীও স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল রাষ্টপতি যা বলেছেন কা কাজের মধ্যমে বাস্তবে রূপ লাভ করুক।

শ্বেতপত্র নয়ঃ শােকপত্র

এদিকে গত ২৬শে মে ৮১ সরকার দক্ষিণ তালপট্টি প্রশ্নে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ

করেন। শ্বেতপত্রটি অসম্পূর্ণ। তাদের মতে সরকার তার দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার জন্য শ্বেতপত্রটি রাজনৈতিকভাবে প্রকাশ করেছেন। শ্বেতপত্রটি যেহেতু সরকারী দলের রাজনৈতিক স্বার্থে প্রকাশিত হয়েছে, সেহেতু ১৯৭৮ সালের আগে দক্ষিণ তালপট্টি সম্পর্কে কোন তথ্যই শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়নি। বিরােধী রাজনৈতিকদলগুলাে থেকে অভিযােগ তােলা হয়েছে যে, ভারত কর্তৃক দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি দখলের সুযােগ দিয়েছেন ক্ষমতাসীন সরকারই। অভিযােগে আরও বলা হয়, সরকারের ব্যর্থ আর নতজানু পররাষ্ট্রনীতির জন্যই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের ওপরে বাংলাদেশ তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার হারিয়েছে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে যেহেতু ভারতীয় পতাকা উড়ছে সেহেতু এই দ্বীপটিকে ঘিরেই ভারত কিছু বাড়তি

আর এই সময়ের সুযােগ নিয়ে যদি দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা একমাত্র ভারতই ভােগ করে-তাহলে একবার যা দখল হয়ে যায় তা আর ফেরত পাওয়া যায় না, এই রূঢ় সত্যটি সামনে রেখে বলতেই হয়, দক্ষিণ তালপট্টির ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ভাষাটি নিতান্তই দুর্বল!জনৈক পার্লামেন্টারিয়ানের ঠাট্টা অনুযায়ী সরকারের শ্বেতপত্রটি শােকপত্র মাত্র। ১৯শে মে এবং ২৬শে মে এ-দুদিন দৈনিক পত্রিকাগুলােয় প্রকাশিত দক্ষিণ তালপট্টির মানচিত্র দুরকম দেখানাে হয়েছে। ফলে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোতসহ আন্তর্জাতিক সীমানা এবং অন্যান্য অবৃস্থান চিহ্নিতকরণে আকাশপাতাল ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়। ১৯শে মে দৈনিক পত্রিকাগুলােয় প্রকাশিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মানচিত্রে হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মধ্যস্রোত এবং আন্তর্জাতিক সীমানা এ-দুই-ই দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের মধ্য-অঞ্চল বরাবর দেখানাে হয়েছে। সীমানা। পরিমাপের জন্য স্কেল সংকেতও ঐ মানচিত্রে দেখানাে হয়নি। দ্বীপটির ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ভারতের কাছে আগেই নতজানু হয়ে আছে। ২৬শে মে সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত দক্ষিণ তালপট্টির আরও একটি মানচিত্র দৈনিক পত্রিকাগুলােয় প্রকাশিত হয়। এই মানচিত্রের সঙ্গে প্রথমবার প্রকাশিত মানচিত্রের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। দ্বিতীয়বার প্রকাশিত মানচিত্রে হাড়িয়াডাঙ্গা L6 নদীর সদ্যস্রোত এবং আন্তর্জাতিক সীমানা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপেরও কয়েক মাইল। . পশ্চিম দিয়ে দেখানাে হয়েছে। এছাড়া সীমানা পরিমাপের জন্য এই মানচিত্রে এক ইঞ্চিকে চার মাইল পর্যন্ত ধরা হয়েছে। ২৬শে মে প্রকাশিত এই মানচিত্রে স্পষ্টতই প্রমাণ করে ভৌগােলিক অবস্থানগত দিক থেকে দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি বাংলাদেশের। 

দক্ষিণ তালপট্টির এই ঘটনা রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে জাতির সামনে তুলে ধরা হয়েছিলাে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কন্যা ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে দেশের মানুষের মধ্যে যে জাগরণ জিয়াউর রহমান লক্ষ্য করেছিলেন তা ভিন্ন খাকে প্রবাহিত করার লক্ষ্যই তালপট্টি প্রশ্নটি জাতির সামনে তােলা হয়েছিলাে। এটা প্রমাণিত তালপট্টি দ্বীপে বহু পূর্বেই ভারতের পতাকা উডডীন হয়েছিলাে- জিয়া তখন টু শব্দ করেনি। এখনাে কেউ করছেনা। শুধু তাই নয় জিয়া সীমান্ত সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধুর সময়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির যে পরিমাণ ছিলাে জিয়ার আমলে তা প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পায়।

২২০


ছেড়া গেঞ্জী ও ভাঙা সুটকেস্

, চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত জিয়ার ছোঁড়া গেঞ্জী ও ভাঙা সুটকেস্নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক হয়। বিরােধী জাতীয় সংসদ সদস্যগণ বললেন, ভালাে কথা কিন্তু সাফারী সুটগুলাে কোথায়? জাতীয় সংসদে এক সংসদ সদস্য বললেন, জিয়াউর রহমানের সাফারী সুটের সংখ্যা ছিলাে প্রায় ৪ শতাধিক। এগুলাে প্যারিস থেকে আসতাে। তার বাড়ি এয়ার কন্ডিশনড়। যা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ছিলনা। লন্ডনে হিথরাে এয়ারপাের্টে জিয়াউর রহমানের ৪০ সেট সাফারী সুট আটক নিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক স্ক্যান্ডাল হয়েছিলাে যা বিদেশের পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। জিয়াউর রহমান ভালাে পােশাক পরতে ভালােবাসতেন। ফিটফাট। সুবেশী জিয়াউর রহমানের ছোঁড়া গেঞ্জী ও ভাঙা সুটকেট‘-এর কাহিনী বানিয়ে সুটেট বুটেট সুগন্ধী মাখা জিয়াকে রাতারাতি কাদা মাটির মানুষকরে ছাড়লেন। তার সততা কিম্বদন্তিকেও হার মানালাে। যদি কিছু মনে না করেনঅনুষ্ঠানের পরিচালক সমকালীন গােপালভাঁড় ফজলে লােহানী বঙ্গভবনে বাবুর্চিকেও টেলিভিশনের পর্দায় এনে হাজির করলেন। তাকে দিয়ে বললেন, ‘সাহেব দুপদে খাবার খেতেন, কখনাে ৩ পদ পছন্দ করতেন না। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) প্রশ্নের জবাবে টেলিভেশনেই বললেন, জিয়াউর রহমান ৪ পদের খাবার খেতেন। তাছাড়া চকলেট ও আইসক্রীম ছিল তার প্রিয় খাবার।এরূপ কেচ্ছা কাহিনী টিভি-বেতার পত্র পত্রিকায় ঢালাওভাবে প্রচার করা হলাে। কিন্তু সম্প্রতি বেগম খালেদা জিয়ার মেজবােন সেলিনা ইসলাম বিউটি জানিয়েছেন জিয়া আমার রান্না ঘরে এসে বসতাে। বলত বড় আপা এটা খাব, ওটা খাব। সেমাই রাধছেন- দেন খেতে ভালাে লাগে। মাংস রাধছেন, দেন তাে এক টুকরাে মাংস।২ কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আসলেই কি জিয়াউর রহমান সৎ ছিলেন যদিও বাজারে তার সততা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন তুলেনি। বিদেশী ভাষ্যকার বলেছেন তিনি যতটা না সৎ ছিলেন তার চেয়ে সততা‘-র ভড়ং ছিলাে বেশী। তিনি ও তার মন্ত্রীবর্গ এবং রাজনৈতিক দলের চাইরা কেউই দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন না। দুর্নীতি রাষ্ট্রপতি জিয়া ও পারিষদবর্গের দুর্নীতি খতিয়ে দেখা যাক।

২. পরলােগত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে মন্ত্রীবর্গ ক্ষমতাসীন ২৮, জনের যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে-তাতে একজন ছাড়া আর বাকি সবাই কোটিপতি। এই ২৮ জন বর্তমানে ১ হাজার ১৯ কোটি ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ২২১ টাকার মালিক।। ছেড়া গেঞ্জি ও ভাঙ্গা স্যুটকেস-এর আড়ালে জিয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের লােকেরা জাতীয় সম্পদের এক-অষ্টাংশ কুক্ষিগত করেছেন রাষ্ট্রপতি জিয়ার ৬ বছর রাজত্বে বিদেশ থেকে যে ১০ হাজার ৮ শত ১৪ কোটি টাকা ঋণ ও অনুদান আনাহরয়েছে ও যে জাতীয় সম্পদ অর্জিত হয়েছে এসব টাকা ও সম্পদ লুট করেছে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট জিয়া ও তার মন্ত্রীবর্গ। রাষ্ট্রপতি জিয়া গত ৩০শে মে চট্টগ্রাম নিহত হবার পর যে ঢাকঢোল পিটিয়ে তাঁর ছেড়া গেঞ্জী আর ভাঙা স্যুটকেসের একটি কল্পিত কাহিনী টেলিভিশনে হাজার হাজার টাকার ফিলা খরচ করে দেখানাে হয়। কিন্তু আস্তে আস্তে থলের বিড়াল নয়, থলি থেকে এক সর্বগ্রাসী বাঘই বেড়িয়ে পড়েছে আর সেই বাঘ প্রমাণ করলাে রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং তার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও দলীয় নেতারা কিভাবে কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। তাদের সেই সম্পদের পাহাড় সম্পর্কে একটি হিসেব যা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক সূত্রে প্রাপ্ত এবং পূর্বে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রচারিত হয়েছে, তবে চিত্ররূপ।৩ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ৪. ক্যান্টমেন্ট এলাকায় যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেই বাড়ি সহ মােট ৩ কোটি 0 টাকা। চট্টগ্রাম শহরের ওপর ১০ কাঠা জমির দাম ১০ লাখ টাকা। সাভারে ১০ কাঠা জমির দাম ১ লাখ টাকা। বঙ্গভবনের সােনালী ব্যাংক শাখার ১০ লাখ টাকা। বেগম জিয়া পরে তা ব্যাঙ্ক অব কমার্স এন্ড ক্রেডিট এ জমা দিয়েছেন। এ নিয়ে পার্লামেনন্টে বির্তক সৃষ্টি হলে সরকার তাড়াহুড়া করে এটি জিয়া পরিবারকে প্রদত্ত সরকারী অনুদান(?) হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। তথাকথিত বীমার ২৫ লাখ টাকা এবং জিয়ার পুত্র তারেক ও আরাফাতকে প্রতি মাসে দেড় হাজার টাকা করে তিন ও পাঁচ বছরে ১ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা। মােট পরিমাণ ৩ কোটি ২৬ লক্ষ টাকার সম্পত্তি ও নগদ অর্থ। অথচ ক্ষমতার আগে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সম্পত্তি ছিলাে মাত্র সাভারের ১০ কাঠা জমি। জিয়ার নিহত হওয়ার আগে ও পরে তার মোট টাকা ও সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ৭২ লক্ষ ছিলাে। এরপর জেনারেল এরশাদ বেগম খালেদা জিয়াকে ২ কোটি টাকার একটি বাড়ি মাত্র ১ টাকায় উপহার দিয়েছেন। গত ৬ বছরে বিদেশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ ও অনুদান আনা হয়েছে। এই টাকা শােধ করতে হবে গরীব চাষী-মজুরদের। কিন্তু এসব টাকা লুট করেছে জিয়া ও তার মন্ত্রীরা।

প্রধান মন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান 

৫. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ১ কোটি ৬৮ লাখ ১১ হাজার ৭৫০ টাকা। চাটার্ড ব্যাংক, ঢাকা ৫৭ লাখ ৫০০ টাক। শ্রীভলেজ ব্যাংক, ঢাকা ২৩ হাজার ৩৫০ টাকা। গ্রীলেজ ব্যাংক, চট্টগ্রাম ৩ কোটি ৬৫লাখ ১৯ হাজার টাকা (বেনামে)। সােনালী ব্যাংক ঢাকা, ২৩ হাজার ৪০০টাকা। গুলশানে একটি বাড়ি, মূল্য ৬০ লাখ টাকা। ২টি গাড়ী (বেনামে) মূল্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। স্বর্ণ (ঢাকা সােনালী ব্যাংকে রক্ষিত) ১৪০ ভরি, মূল্য ৫লাখ ৬০ হাজার টাকা। সর্বমােট ৬ কোটি ৫৯ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।

উপ-প্রধান মন্ত্রী জামালউদ্দীন আহমেদ

৬. গ্রীলেজ ব্যাংক, ঢাকা ১১কোটি ৩৬ লাখ ৩ হাজার টাকা (বেনামে)। কমার্স ব্যাংক,ঢাকা ৮৯ লাখ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ১০ হাজার ২২৫ টাকা। সােনালী ব্যাংক, চট্টগ্রাম ৫১ হাজার ৮০০ টাকা। জনতা ব্যাংক, চট্টগ্রাম ২লাখ ৭৩ হাজার ৭০৩ টাকা। হাবিব ব্যাংক,ঢাকা ২৭ কোটি ৫৫লাখ ৭০ হাজার টাকা। ধানমণ্ডিতে ২টি বাড়ী, মূল্য ২১ লাখ টাকা। বনানীতে ১টি বাড়ী, (বেনামে), মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। ২টি গাড়ী, ৩টি বাস, মূল্য ২৬ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে নাসিরাবাদে বেবী টেক্সীর ১টি শিল্প কারখানা, মূল্য ৬৫ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে ফৌজদারহাটে ১টি কার্পেট কারখানা, মূল্য ১৬ কোটি টাকা। চট্টগ্রামের জামালখানের একটি বাড়ী, মূল্য ১৬ লাখ টাকা। ঢাকায় ২টি বিদেশী শিল্পের অংশীদার, মূল্য ৮ কোটি টাকা। মতিঝিলে ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিল্ডিংয়ের মালিক, মূল্য ৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। স্বর্ণ (অগ্রণী ব্যাংক চট্টগ্রাম, স্ত্রীর নামে) ১৬৫ ভরি, মূল্য ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মােট ১৯৯ কোটি ১৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭২৮ টাকা।

উপ-প্রধানমন্ত্রী এস,, বারী এ,টি 

৭. সােনালী ব্যাংক ঢাকা ২৭ হাজার ৩০০ টাকা। জনতা ব্যাংক, ৪ হাজার টাকা।

হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ১ লাখ ২২ হাজার ৫০০ (বেনামে)।

গুলশানে ১টি প্লট, মূল্য ১৫ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অংশীদার মূল্য ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ঢাকায় ১টি মুরগীর খামার ও ১টি মৎস্য প্রক্রিয়া কারখানার যৌথ অংশীদার, মূল্য ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। মােট ২ কোটি ৫৪লাখ। মত ৩হাজার ৮০০ টাকা।

খাদ্যমন্ত্রী আবদুল মােমেন

৮. ক্রেডিট এণ্ড কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ৪৩ লাখ ৭ হাজার টাকা বেনামে। সােনালী

ব্যাংক, ঢাকা ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ১লাখ ৭১ হাজার ৩০০ টাকা। ১১টি গুদাম ঘরের মালিক, মূল্য ১ কোটি ২২ লাখ টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ী, মূল্য ২৬ লাখ টাকা। ১টি লবণ ব্যবসার মালিক, মূল্য ৩লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ১ লাখ ৮০ হাজার টাকামােট ১ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা।

সংস্থাপনমন্ত্রী জেনারেল মজিদুল হক

৯. গ্রীণ্ডলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা (বেনামে)। ক্রেডিট এণ্ড কমার্স , ঢাকা ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৫০ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ২১ হাজার ১শত টাকা। ধানমণ্ডিতে ১টি বাড়ী, মূল্য ১৭ লাখ টাকা।বনানীতে ১টি বাড়ী, মূল্য ২০ লাখ টাকা। গুলশানে ২টি বাড়ী, (১টি বেনামে), মূল্য ৬৬ লাখ টাকা।স্বর্ণ ২২০ ভরি (মেয়ে ও জামাইয়ের নামে, সােনালী ব্যাংক, ঢাকা) মূল্য ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি ঔষধের দোকানের মালিক, মূল্য ৩ লাখ টাকা। মােট ১ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ১৫০ টাকা।

স্থানীয় সকোর মন্ত্রী ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম

১০. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৫ কোটি ৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। (শ্যালকের নামে)। জনতা ব্যাংক, ঢাকা ২ লাখ ২৭ হাজার ২৮০ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ৪লাখ ১৬ হাজার ৩০২ টাকা।

মালিবাগে ১টি বাড়ী, মূল্য ২৮ লাখ টাকা। মতিঝিলে একটি যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকানা (স্ত্রীর নামে।, মূল্য ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ষ্টেডিয়ামে একটি ঘড়ির দোকানের মালিক, মূল্য ৩ লাখ টাকা। মােট ৬ কোটি ৮১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮২ টাকা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মােস্তাফিজুর রহমান 

১১. গ্রীণ্ডলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৪১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৯ কোটি

১লাখ ১১ হাজার ৮৮০ টাকা (স্ত্রীর নামে) । সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ৭ হাজার ৯০ টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ৫৮ হাজার ৩০৭ টাকা। গুলশানে ১টি রাড়ী, মূল্য ৪০ লাখ টাকা। টংগীতে ১টি শিল্প কারখানার যৌথ মালিকানা (ভাইয়ের নামে), মূল্য ২৪ কোটি টাকা। শেরে বাংলা নগরে ২টি বাড়ী, মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। মােহাম্মদপুরে ১টি বাড়ী, ৩টি প্লট, মূল্য ১২ লাখ টাকা। মালিবাগে ১টি বাড়ী, মূল্য ২০ লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মূল্য ১১ লাখ টাকা। ৩৮০ ভরি স্বর্ণ (স্ত্রীর নামে) , রূপালী ব্যাংক, ঢাকা, মূল্য ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। নিউমার্কেটে একটি কাপড়ের দোকান, মূল্য ৭লাখ টাকা। ঢাকায় একটি আধুনিক ছাপাখানার মালিক (শ্যালকের নামে), মূল্য ৩০ লাখ টাকা। মােট ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ৫১ হাজার ২৭৭ টাকা।

অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান 

১২. কমার্স এণ্ড ক্রেডিট ব্যাংক, ঢাকা ২ কোটি ৩ লাখ ৬৯ হাজার ২০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৪ কোটি ৭০ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ৫১ হাজার ৭৩০ টাকা, গ্রীগুলেজ ব্যাংক, ঢাকা ১ লাখ ২১ হাজার ৫১৯ টাকা, রুপালী ব্যাংক, ঢাকা ৬ হাজার ৯৪০ টাকা। ঢাকায় ১টি আধুনিক হােটেলের মালিক, (ভাইয়ের নামে) মূল্য ৫ কোটি টাকা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ২টি। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিক, মূল্য যথাক্রমে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ৭৫ লাখ টাকা। (স্ত্রীর নামে), গুলশানে একটি বাড়ী, (স্ত্রীর নামে), মূল্য ২৫ লাখ টাকা। ঢাকায় ২টি শিল্প কারখানার অংশীদার, মূল্য তিন কোটি টাকা (ভায়রার নামে), ১টি গাড়ী, ১টি মাইক্রোবাসের মালিক মূল্য ৪ লাখ টাকা। সিলেটে ১১টি মৎস্য ব্যবসা ও ১টি মাছ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানের অংশীদার, মূল্য যথাক্রমে ১৮ কোটি ও ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। (শ্যালকের নামে) স্বর্ণ ৫৫ ভরি (স্ত্রীর নামে) অগ্রণী ব্যাংক,
ঢাকা মূল্য ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। মােট ৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯৯ টাকা

তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা 

১৩. হাবিব ব্যাংক, ৫৩ লাখ ১৭ হাজার ৫৫০ টাকা, ক্রেডিট এণ্ড কমার্স ব্যাংক, ১লাখ

৩৩ হাজার টাকা ( মেয়ের নামে) গ্রীগুলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬ শত টাকা (স্ত্রীর নামে), অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা, ১১ হাজার ৪ শত টাকা। নিউ ইস্কাটনে ১টি বাড়ী, মূল্য ১২ লাখ টাকা। বনানীতে একটি বাড়ী, মূল্য ২৮ লাখ টাকা। (স্ত্রীর নামে), বায়তুল মােকাররমে ও এজিবির পেছনে ২টি ইলেকট্রনিক্স কেসেট এবং টিভি ও রেডিও দোকানের অংশীদার (স্ত্রীর নামে), মূল্য ২৫ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি ফার্নিচারের দোকান, মূল্য ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। মােট ১৩ কোটি ৩ লাখ ৮ হাজার ৬৪০ টাকা।

বন্দর ও জাহাজ মন্ত্রী নুরুল হক

১৪. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৩১ কোটি ৭৬ লাখ ১৫ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে) চার্টার্ড ( ব্যাংক, ঢাকা ৩ কোটি ৭২ হাজার টাকা (শ্যালকের নামে), অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৫১ হাজার ৩৯০ টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা, গুলশানে ১টি বাড়ী, মূল্য ৩১লাখ টাকা। বনানীতে ১টি বাড়ী, মূল্য ২৪ লাখ টাকা। ৪টি বার্জের মালিক (বেনামে) মূল্য ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ৫টি লঞ্চের মালিক, মূল্য ৩০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মূল্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ঢাকার পুরানা পল্টনে ১টি বিল্ডিং-এর মালিক মূল্য ৬০ লাখ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকায় ১০৩ ভরি স্বর্ণ, মূল্য ৪ লাখ ১২ হাজার টাকা (স্ত্রীর। এ নামে)। মােট ৪০ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৮৯০ টাকা।

বিমানমন্ত্রী ওবায়দুর রহমান 

১৫. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৭ কোটি ৫৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা (বেনামে)। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ১ কোটি ৯২ লাখ ৬০ হাজার ৯৫০ টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ২৩ হাজার ৫০ টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ী মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। বনানীতে ১টি বাড়ী মূল্য ২৫ লাখ টাকা। মতিঝিলে একটি এক্সপাের্ট-ইম্পাের্ট ফার্ম ও একটি এয়ার লাইসেন্সের মালিক মূল্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা (বেনামে)। ২টি গাড়ীর মালিক , মূল্য ৪ লাখ টাকা। স্বর্ণ ৭২৫ ভরি রূপালী ব্যাংক, ঢাকা) মূল্য ২৯ লাখ টাকা। (স্ত্রীর নামে)মােট ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

রেলমন্ত্রী আবদুল আলিম 

১৬. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ২৯ হাজার টাকা (পুত্রের নামে)। হাবিব

ব্যাংক, ঢাকা ১৫ কোটি ৯৪ লাখ ৭০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। গ্রীলেজ ব্যাংক, ‘ঢাকা ৩ কোটি ২ লাখ ৪৭ হাজার ২০০ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ৪ লক্ষ ৭ হাজার ৩৩০ টাকা। বনানীতে ২টি বাড়ী মূল্য ৩১ লাখ টাকা। গুলশানে ১টি কনষ্ট্রাকশন ফার্মের মালির (বিল্ডিংসহ) মূল্য ১.কোটি ৫০ লাখ টাকা (পুত্রের নামে)। চট্টগ্রামে ২টি কনষ্ট্রাকশন ফার্মের মালিক মূল্য ৮০ লাখ টাকা। ঢাকার মতিঝিলে ১টি বিদেশী বাণিজ্যিক ফার্মের সাথে অংশীদার মূল্য ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা (শ্যালকের নামে)। একটি শিল্প কারখানার মালিক মূল্য ২০ কোটি টাকা (ভাইয়ের নামে)। ঢাকায় ১টি বিদেশী ইনডেনটিং ফার্মের সাথে অংশীদার মূল্য ১৫ কোটি টাকা। (শ্যালকের নামে)। ২টি গাড়ী ও ৪টি বাসের এবং ১০টি ট্রাকের মালিক মূল্য ৭৫ লাখ টাকা। মােট ১৩৯ কোটি ৪০ লাখ ৮৪ হাজার ২৩০ টাকা

পাটমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ খান

১৭. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ২৮ কোটি ৭৩ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। (স্ত্রীর নামে)। গ্রীন্ডলেজ ব্যাংক, ঢাকা ২০ কোটি ১১ লাখ টাকা ( ভায়রার নামে)। ক্রেডিট এণ্ড কামার্স ব্যাংক, ঢাকা ৬ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। সােনালী ব্যাংক, ১৮ লাখ ২৮ হাজার ৭১৫ টাকা। চট্টগ্রামে ২টি বাড়ী মূল্য ৪০ লাখ টাকা। ধানণ্ডিতে ১টি বাড়ী, মূল্য ১৮ লাখ টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ী, মূল্য ২৫ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক (বেনামে), ৩ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে ১টি শিল্প কারখানার মালিক বেনামে মূল্য ১০ কোটি টাকা। ঢাকায় ২টি বিদেশেী ফার্মের সাথে অংশীদার-এর মালিক মূল্য ৭ কোটি টাকা। মতিঝিলে ১টি জুট বিজনেসের মালিক, মূল্য ৮ কোটি টাকা (স্ত্রীর নামে)। ৪টি গাড়ীর মালিক মূল্য ৮ লাখ টাকা। ৫৪০ ভরি স্বর্ণ (হাবিব ব্যাংকে, স্ত্রীর নামে), মূল্য ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। গ্রীণ সুপার মার্কেটে ২টি দোকানের মালিক, মূল্য ১০ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট এবং ২টি ইনডেনটিং ফার্মের মালিক, মূল্য ২৫ কোটি টাকা (মামার নামে)। মােট ১০৯ কোটি ৫৬ লাখ ৮ হাজার ৭১৫ টাকা। যুব ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ মতিন ১৮. গ্রীগুলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৭ লাখ ২হাজার ৩০০ টাকা। চাটার্ড ব্যাংক, পকা ২ কোটি = ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। হাবিব ব্যাংক ঢাকা ৫৫ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৭২ হাজার ১০০ টাকা। গুলশানে একটি বাড়ী, মূল্য ৩৫ লাখ টাকানারায়ণগঞ্জে ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক (শ্যালকের নামে) মূল্য ৩ কোটি টাকা। ঢাকায় ২টি ঔষধ কোম্পানীর অংশীদার, মূল্য ১০ কোটি টাকা (ভাইয়ের নামে)। ১টি বিদেশী ঔষধ কোম্পানীর অংশীদার মূল্য ১৬ কোটি টাকা (স্ত্রীর নামে)। ২টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। সাভারে একটি খামারের মালিক, মূল্য ২০ লাখ টাকা। ১৮২ ভরি স্বর্ণ (সােনালী ব্যাংকে স্ত্রীর নামে) মূল্য ৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। মােট ৩২ কোটি ৮৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯০০ টাকা।

ত্রাণমন্ত্রী এমরান আলী 

১৯. চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা ১৬ লাখ ৬৪ হাজার ৪৩০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। সােনালী

ব্যাংক, ঢাকা ৬৫ হাজার ৮০০ টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ৫১ হাজার ৫০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। বনানীতে ১টি বাড়ী, মূল্য ২৫ লাখ টাকা। বায়তুল মােকাররমে ১টি কাপড়ের দোকান, মূল্য ১০ লাখ টাকা। ঢাকায় একটি বাণিজ্যি প্রতিষ্ঠানের মালিক (স্ত্রীর নামে), মূল্য ৫০ লাখ টাকা। একটি গাড়ীর মালিক, মূল্য ২ লাখ টাকা। ১টি শস্য সংরক্ষণাগারের মালিক (নারায়ণগঞ্জে), মূল্য ৩০ লাখ টাকা। মােট ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮১ হাজার ৭৩০ টাকা।

প্রাক্তন বস্ত্রমন্ত্রী মনসুর আলী

২০, হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ১ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা (ছেলের নামে)। চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা ৬ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)অগ্রণী ব্যাংক, = ঢাকা ১৩ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ীর মালিক, মূল্য ১৬ লাখ টাকা। ১টি গাড়ীর মালিক মূল্য ২ [ লাখ টাকা। ঢাকায় একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অংশীদার, মূল্য ১০ লাখ টাকা, ঢাকায় যা ১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, মূল্য ১ কোটি টাকা (স্ত্রীর নামে))। স্বর্ণ ৯৫ ভরি (হাবিব ব্যাংক, ঢাকা), (স্ত্রীর নামে), মূল্য ৩লাখ ৮০ হাজার টাকা মােট ৯ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা।

টেলিফোনমন্ত্রী মাইদুল ইসলাম

২১. গ্রীওলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৫৯ কোটি ৩৩ লাখ ৯১ হাজার টাকা (ভাইয়ের নামে)।

চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা: ২৪ কোটি ৭৫ লাখ ৯ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)। হাবিব

ব্যাংক, ঢাকা ৭ কোটি ৮৬ লাখ ২৭ হাজার টাকা (ভাইয়ের নামে)। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৩লাখ ২০ হাজার টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ৯লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৩টি শিল্প কারখানার মালিক (ভাইয়ের নামে), মূল্য ৬০ কোটি টাকা; মতিঝিলে ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠিানের অংশীদার (স্ত্রীর নামে), মূল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ীর মালিক, মূল্য ২৫ লাখ টাকা। মীরপুরে জমির মালিক, মূল্য ১৫ লাখ টাকা। স্বর্ণ ৮১০ ভরি ( হাবিব ব্যাংক, ঢাকা স্ত্রীর নামে) মূল্য ৩২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৪টি গাড়ী, ২৮টি ট্রাক, ও অন্যান্য গাড়ীর মূল্য ৮০ লাখ টাকা। মােট ১৫৭ কোটি ১০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। তার

|

শ্রমমন্ত্রী রিয়াজ উদ্দীন (ভােলা মিয়া)

২২. গ্রীগুলেজ ব্যাংক,ঢাকা ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা। চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা ১কোটি ৯৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ১১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ১লাখ ১ হাজার টাকা। গুলশানে ১টি বাড়ী, মূল্য ২২ লাখ টাকা। ঢাকার নবাবপুরে একটি যন্ত্রপাতির। দোকান মূল্য ৬০ লাখ টাকা। সাভারে ১টি খামারের মালিক, মূল্য ২১ লাখ টাকা। মতিঝিলে একটি বিদেশী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠারে অংশীদার মূল্য ১ কোটি টাকা (স্ত্রীর। নামে)। ১টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ২ লাখ টাকা। স্বর্ণ ৩২ ভরি সােনালী ব্যাংক, ঢাকা (স্ত্রীর নামে) মূল্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। মােট ৪ কোটি ৬৯ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা।

শিল্প প্রতিমন্ত্রী মান্নান শিকদারনায় 

২৩. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৫ কোটি ৮২ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা(স্ত্রীর নামে)। গ্রীণ্ডলেজ ব্যাংক, ‘ঢাকা ২ কোটি ১২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা (ভাইয়ের নামে)। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৭ হাজার ২০০ টাকা। বনানীতে ১টি বাড়ী মূল্য ৪০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে ১টি শিল্প কারখানার মালিক, মূল্য ৩ কোটি টাকা, ঢাকায় ১টি শিল্পের অংশীদার মূল্য ১২ কোটি টাকা। ঢাকায় ১টি সাইকেলের দোকান মূল্য ৩ লাখ টাকা, একটি গাড়ীর মালিক, মূল্য ২ লাখ টাকা। মােট ২৩ কোটি ৭১ লাখ ৬ হাজার ৩০০ টাকা।

যুবপ্রতিমন্ত্রী আবুল কাশেম 

২৪. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ২১ কোটি ৯০ লাখ টাকা (ভাইয়ের নামে)। চার্টার্ড ব্যাংক,

ঢাকা ১২ কোটি ৬৯ লাখ ৮৬ হাজার ৯০০ টাকা ভাইয়ের নামে) কমার্স ব্যাংক,

ঢাকা ১ কোটি ৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ১৩ হাজার ৭৫০ টাকা। ২টি বার্জের মালিক, মূল্য ১কোটি টাকা। ৬টি লঞ্চের মালিক, মূল্য ২০ লাখ ii. টাকা। মতিঝিলে ১টি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ও ১টি চায়নিজ হােটেলের মালিক, মূল্য [P ৮০ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি পেট্রোল পাম্পের মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জে ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, ৫ কোটি টাকা (বেনামে)। তেজগাঁও ১টি শিল্প কারখানার অংশীদার, মূল্য ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা (বেনামে)। ২টি বাড়ীর মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। ১টি সিনেমা হলের মালিক, মূল্য ৭০ লাখ টাকা। মােট ৫০ কোটি ৭৮ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫০ টাকা।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী তানভীর আহমদ সিদ্দিকী 

২৫. গ্রীগুলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৩৯ কোটি ৭৮ লাখ ৫৭ হাজার টাকা (ভাইয়ের নামে)।

হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ১০ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। কমার্স এও ক্রেডিট ব্যাংক, ঢাকা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৭০ হাজার ২০০ টাকা। (ভাইয়ের নামে)। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ টাকা। * সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ১১ হাজার ৫৮০ টাকাগুলশানে ১টি বাড়ী রমূল্য ৬০ লাখ টাকা। চট্টগ্রামে ১টি শিপিং ব্যবসার মালিক মূল্য ১৫ কোটি (স্ত্রীর নামে)। ঢাকায় ২টি প্রতিষ্ঠান ও ১টি এক্সপাের্ট- ইম্পাের্ট বিজিনেসের মালিক, মূল্য ৫ কোটি টাকা। ২টি সিনেমা হলের মালিক মূল্য ১ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে ৪টি ও ঢাকায় ১টি গুদাম ঘরের মালিক (স্ত্রীর নামে) মূল্য ১ কোটি টাকা। ঢাকায় ১টি স্বর্ণের দোকান, মূল্য ২ কোটি টাকা(ভাইয়ের নামে)। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের (তেজগাঁও) অংশীদার মূল্য ৭ কোটি টাকা (ভাইয়ের নামে)২টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি ইনডেনটিং ফার্মের মালিক মূল্য ৪ কোটি টাকা। মােট ৯৪ কোটি ৮ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫৮০ টাকা।

ভূমি প্রশাসন মন্ত্রী মােহাম্মদ ইসমাইল 

২৬. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৭৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ টাকা। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা (স্ত্রীর নামে)। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা। ৩টি জলাশয়ের মালিক, মূল্য ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা (স্ত্রীর নামে)।  (বেনামে) মিশন রােডে একটি বাড়ীর মালিক, মূল্য ১২ লাখ টাকা। মােট ২ কোটি  ৪৯ লাখ ২৫ হাজার ২৫০ টাকা।

পানি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এল কে সিদ্দিকী। 

২৭. গ্রীলেজ ব্যাংক, ঢাকা ২ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা। চার্টার্ড ব্যাংক, ঢাকা ১ কোটি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)। গুলশানে ১টি বাড়ী মূল্য ৩০ লাখ টাকা। ঢাকায় ১টি বিদেশী কন্সট্রাকশন কোম্পানীর অংশীদার, মূল্য ৮ কোটি টাকা। ২টি গাড়ীর মালিক, মূল্য ৪ লাখ টাকা। মােট ১১ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

গণপূর্তমন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন 

২৮. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা (স্ত্রীর নামে)। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা | ৩৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬০০ টাকা। রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ৪ লাখ ৪ হাজার ৫০০ টাকা। মীরপুরে ২টি ও মােহাম্মদপুরে ১টি বাড়ীর মালিক, মূল্য ৭০ লাখ টাকা। নিউ ইস্কাটনে ১টি বাড়ীর মালিক, (বেনামে) মূল্য ১৬ লাখ টাকা। মােট ৫কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ১০০ টাকা।

বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী সিরাজুল হক 

২৯. ক্রেডিট এণ্ড কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ১ কোটি ৭৮ লাখ ১৭ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)। ৯ অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ৩৩ হাজার ৭০০ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ‘ঢাকা ৪ হাজার ২৫০ টাকা। মালিবাগে ১টি বাড়ীর মালিক, মূল্য ৮ লাখ টাকা। এলিফ্যান্ট রােডে ১টি দোকানের মালিক, মূল্য ৩ লাখ টাকা। মােট ১কোটি ৮৯ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টাকা।

মৎস্য প্রতিমন্ত্রী ডাঃ আফতাবুজ্জামান 

৩০ গ্রীণ্ডলেজ ব্যাংক, ঢাকা ৮২ লাখ ২৯ হাজার টাকা (স্ত্রীর নামে)রূপালী ব্যাংক, ঢাকা ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা। সােনালী ব্যাংক, ঢাকা ৪৩ হাজার ৯০ টাকা। ২টি জলাশয়ের মালিক, মূল্য ৮ লাখ টাকা। মােট ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫৯০ টাকা।

কুষি প্রতিমন্ত্রী আমিরুল ইসলাম 

৩১. হাবিব ব্যাংক, ঢাকা ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা (ভাইয়ে নামে)। কমার্স এণ্ড ক্রেডিট

ব্যাংক, ঢাকা ৮ কোটি ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। অগ্রণী ব্যাংক, ঢাকা ১০ হাজার ৫০০ টাকা, ঢাকায় একটি ইনডেনটিং ফার্মের মালিক মূল্য ১০ কোটি টাকা। মােট ১৮ কোটি ১৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।

ছেড়া গেঞ্জী ও ভাঙা সুটকেস (খ) 

কণiজঙ্গী কোরান দিয়ে দুর্নীতি ঠেকানাের প্রতারণা

৩২. জেনারেল জিয়া, প্রেসিডেন্ট জিয়া, চেয়ারম্যান জিয়া, বহুগুণে বিশেষত জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত সততার কথা বাজারে আজো প্রচলিত আছে। জিয়াউর রহমান ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতির উর্ধে এই ইমেজ সৃষ্টির জন্য মাঝে মধ্যেই নানা ফন্দি। ফিকির করতেন। ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধােকা দেয়ার জন্য শাসনতন্ত্রে বিসমিল্লাহসংযােজন করেছেন, পাশাপাশি মদের দোকান খােলার জন্য দেদার লাইসেন্স দিয়েছেন। তিনি ঘুষ, দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের হাতে কোরান দিয়ে শপথ পড়ালেন, প্রকাশ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সতত জেহাদ ঘােষণাকারী জেনারেল জিয়া মন্ত্রীদের আচরণ বিধি জারী করে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন।

এবার পবিত্র কোরান দিয়ে দুর্নীতি ঠেকাবেন এই মতলব করলেন। আসলে এসবই ছিলাে জিয়ার ভড়ং। কেননা, কোরান হাতে দিয়ে যাদের তিনি শপথ করালেন তারা কে, তাদের অতীত কি এসব চতুর প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার অজানা নয়। সবাইকে দুর্নীতি করার অবাধ সুযােগ দিয়ে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করে তিনি বুঝাতে চাইছেল তিনি সৎ আর সবাই অসৎ, দুর্নীতিবাজ। কিন্তু যাদের দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য কোরান শপথ করালেন সেসব মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না কেন? এর সহজ উত্তর হলাে, তাহলে জিয়াউর রহমানের সততা সম্পর্কে হাটে হাড়ি ভেঙ্গে যেতে পারে।

কাশিম বাজার কুঠি 

এ সম্পর্কে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ভাষ্যকার লিখেছেন প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিকভাবে যেমন সকল ক্ষমতা কেন্দ্রবিন্দু, তেমনি দেশের সকল দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু তিনিমন্ত্রীদের হাতে কোরান দিয়ে শপথ করিয়ে তিনি নিজেকে সাধু প্রমাণ করার চেষ্টা করতে পারেন কিন্তু সে চেষ্টা সফল হবে না। কারণ দেশবাসী জানে যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক দল করেছেন, দল ভেঙ্গেছেন, ফ্রন্ট গড়েছেন, ফ্রন্ট ভেঙ্গেছেন একটার পর একটা নির্বাচন করেছেন আর এসব করতে গিয়ে অনেষ্টি বলতে কিছু অবশিষ্ট রাখেননি। আজ তাই বিভিন্ন মহল থেকে দাবী উঠেছে তার নির্বাচনী ব্যয়ের হিসেব সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশের। ১. আর মন্ত্রীমহােদয়রা ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েই প্রেসিডেন্টকে দলীয় রাজনীতি না করার জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ যুগিয়ে এসেছেন এবং এখনও যুগিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশে লােক পাঠাবার অছিলায় লাখ-লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার কাহিনী শােনা যাচ্ছে, তারও

সিংহ ভাগ চাঁদা হিসেবে দিতে হচ্ছে সরকারী দলকে। এ ছাড়া কিছু কিছু বিরােধী রাজনৈতিক দলকে সরকারী রাজনীতির প্রভাব বলয়ে রাখার জন্যও সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কাশিম বাজার কুঠিতে সরকার এবং কোন-কোন বিরােধী দলের মধ্যে টাকা-পয়সা লেন-দেনের ঘটনাতাে। অনেক আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় কম লেখালেখি হয়নি। আজ মন্ত্রীদের কোরান শপথ নিতে হচ্ছে, কিন্তু আগামীতে যখন তাদের লাখ-লাখ। টাকা বি,এন,পিকে চাঁদা দিতে হবে তখন সে অর্থ আসবে কোথা থেকে? মন্ত্রীমহােদয়রা যদি তখন শপথের কথা ভুলে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীনির আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, তাহলে কি পবিত্র কোরানের অবমাননা করা হবে না? তাছাড়া কোরান শপথ করেই যদি আজকের যুগে অপরাধীকে, দুর্নীতিবাজ থেকে, অপরাধের পথ থেকে, দুর্নীতির পথ থেকে দুরে সরিয়ে রাখা যেতাে, তাহলে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের কথা উঠতাে না, জনপ্রতিনিধিদের কাছে মন্ত্রীসভার একাউন্টেবল থাকার প্রশ্ন উঠতাে না কোরান শপথ করিয়েই সব কাজ চালিয়ে নেয়া যেতাে। প্রেসিডেন্ট জিয়া যদি সত্যিই সাধুসজ্জন ব্যক্তি হয়ে থাকেন তবে বিভিন্ন নির্বাচনে, একাধিক রাজনৈতিক দল গড়তে এবং চালাতে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে স্বপক্ষে রাখতে তাঁর কতাে টাকা ব্যয় হয়েছে এবং সে টাকা কোথা থেকে কিভাবে এসেছে তার একটা হিসেব জনসমক্ষে প্রকাশ করুন।জিয়াউর রহমান যদি এতই সৎ তাহলে দুটি নির্বাচনী প্রচারণায় কোটি কোটি টাকা কোথায় পেলেন? জাতীয় সংসদের তর্কবিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে বিএনপির তহবিলে জিয়া ৪ কোটি টাকা রেখে গেছেন। বিএনপির অফিসটি কিনেছেন ৬৭ লক্ষ টাকায়। এই টাকার উৎস কোথায়।

কেন্দ্রীয় অফিস নয় ও দুর্নীতি আখড়া

৩৩. প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাফারী যুগের ঘটনাবহুল কর্মকান্ড। সকাল-বিকাল মানুষ দেখছেন। দেখছেন ভাগ্যবান সব ব্যক্তিদের যাদের কথায় ৫৬ হাজার বর্গ মাইল ওঠে। বসে। কাঁপে। হাসে। পল্টনের একটা বাড়ি। এই বাড়িটি বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলাে ঝলমল। প্রতিটি রেলিং-এ ঝুলছে বড় আকারের সাইন বাের্ড। একতলায় ক্যান্টিন। নাম সেবন ক্যান্টিন। এগারােটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্লাট এখন দামী টেবিল আলমারী-সােফা ইত্যাদি সুন্দর আসবাব পত্রে ঠাসা।। নেতাদের বিশেষভাবে জেনারেল জিয়াউর রহমান-এর আগমনে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা হয়। গেটে পাহারা থাকে সব সময়। সাধারণ মানুষের পক্ষে যখন-তখন প্রবেশ অসম্ভব। প্যালেস সমতুল্য বাড়িটি। এক অবাঙালী ব্যবসায়ীর কাছে থেকে ৬৭ লাখ টাকা টাকায় কেনা হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে বি,এন,পির কেন্দ্রীয় দপ্তর। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। বি,এন,পি কর্তারা প্রতিবাদ করেননি। জমি ও বাড়ির দাম ও মানের দিক থেকে এর দাম সাতষট্টি লাখ টাকা কমই বলা চলে। এতাে লক্ষ টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় অফিস কেনা নজিরবিহীন ঘটনা। অনেক রাজনৈতিক দলের তিন/চার যুগ পার হয়ে গেলেও নিজস্ব অফিস হয়নি। সেখানে বিএনপি-র তিন বছর না হতেই বাড়ি ক্রয়ের অর্থ অবশ্যই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। এ টাকা এসেছে দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। প্রথাসিদ্ধ নিয়মেই জনগণের ঘাড় ভেঙে কয়েকগুণ সে অর্থ তারা আদায় করে। নেবেন, বিএনপি কর্তারাই সে সুযােগ করে দিয়েছেন। এছাড়া ধানমন্ডিস্থ দলীয় সচিবায় (৮হাজার টাকা ভাড়া) ভবনসহ সবগুলাে দলীয় ও অঙ্গ সংগঠন কার্যালয়গুলাে পরিচালনার এত বিশাল অংকের অর্থ চেয়ারম্যান জিয়া কিভাবে পান? ব্রিফকেস ব্যবসায়ী, মুনাফাখখার, মজুতদার ও চোরাকারবারী। রাজনৈতিকভাবে। টাকার খেলা আর বড়-বড় চক্রান্তের জন্য প্রাইভেট বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা। কিভাবে হামলা চালাতে হবে, কিভাবে অন্যের জনসভা মিছিল পণ্ড করা যাবে, অন্য দল ভেঙে নিজেদের দলে লােক ভেড়াতে হবে এসব ষড়যন্ত্র এ অফিসে হয়। এরা প্রতিপক্ষ রাজনেতিক দলের মিছিলের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিতেও কুণ্ঠাবােধ করে না।

৩৪. এছাড়াও ভাইস প্রেসিডেন্টের পুরােনাে গণভবন ব্যবহার করা হচ্ছে বিএনপি-এর

সভা-সম্মেলন-সংবর্ধনার কাজে। দলীয় অনুষ্ঠানাদি এখানে লেগেই থাকে। জনগণের দেয়া ট্যাক্সের অর্থে নির্মিত সরকারী একটা ভবন কিভাবে বিএনপি বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করছে? তদুপরি নগরীর মহল্লায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায়, জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডও গ্রাম-পাড়া পর্যায়ে বিএনপি এবং এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের অসংখ্য শাখা। কার্যালয় গড়ে উঠেছে। বেশির ভাগ কার্যালয়গুলােই মাস্তানের আখড়া। অনেক কার্যালয় রয়েছে সরকারী খাস জমিতে, কিংবা অন্যের জায়গায় অবৈধভাবে। অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ বিদ্যুৎ-পানি সংযােগ রয়েছে। এসব কার্যালয়ে পানাহার বিলাস এমন কি মদ্যপান, লাম্পট্যও চলে। বেশিরভাগ শাখা কার্যালয় স্থানীয় নাগরিকদের জন্য ত্রাস সৃষ্টি করছে, চাঁদাবাহিনীর আক্রমণ সামলাতে নাস্তানাবুদ হতে হয়। এদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক এ,কিউ,এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছেন, কাউকে বিএনপির নামে। চাঁদা দেবেন না। ৫

দুনীতি উচ্ছেদের শ্লোগান ঃ জাতীয় ফ্যাশন এ র মত 

৩৫. জিয়াউর রহমান প্রায় সকল সমাবেশ, মিটিং, জনসভায় সততই বলে চলেছেন দুর্নীতি রােধ করতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে। এই শ্লোগান আজ জাতীয় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মিন্টো রােড, হেয়ার রােড, মন্ত্রী পাড়া হতে শুরু

করে নিভৃত পল্লী উলশী যদুনাথপুর, নাম, জিরাবাে, মেহের পঞ্চগ্রাম হয়ে আজ না। নি, ৬৮ হাজার গ্রামে দুর্নীতি ক্যান্সারের মত ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রেসিডেন্ট নিজেও দুর্নীতি বিষয়ে লােক দেখানাে চমকপ্রদ উদ্যোগ নেন। ঘটা করে মন্ত্রীদের সম্পত্তির হিসেব নেয়া হলাে। ফিরিস্তি প্রকাশ পেলাে। ২৪ লাখ টাকার নগদ জমার তথ্যও বের হলাে। কিন্তু সব চুপচাপ। মন্ত্রীরা আয়কর দেন কিনা তাও জানা গেলাে না। দুর্নীর অভিযােগে ৫০ জন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত হলাে। রিপাের্ট হলাে। শাস্তি হলােনা। হলাে প্রমােশন। দুর্নীতির দায়ে প্রায় একডজন আমলাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলাে। দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলাে। আমলারা প্রকাশ্যেই বলাবলি করতে লাগলেন সাময়িক বরখাস্ত প্রত্যাহার করতে হবে। নইলে থলের বিড়াল প্রকাশ হয়ে পড়বে। জিয়াউর রহমান দেখলেন অবস্থা ভালাে নয়। ৩৭ দিন পর দুর্নীতির দায়ে সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত অফিসারদ্বয়ের আবার চাকরি হলাে। }} আমলারা জিয়াকে বললেন, দুর্নীতি উচ্ছেদ করবেন। করুন। তারা ২০ পৃষ্টা ব্যাপী রিপাের্ট করলেন ৩জন জাঁদরেল মন্ত্রীর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের উপর। তাদের শাস্তি তাে দূরের কথা, তাদের আরাে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলাে। ১৯জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপবহার, ঘুষ দুর্নীতির অর্ধশত প্রমাণ, বিদেশী ব্যাংকে টাকা জমানাের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নিকট রিপাের্ট গেলাে। জিয়া তাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করলেন। দুর্নীতির কেন্দ্রে বসে জিয়া নিজের সততার ইমেজ ধরে রাখতে লােক দেখানাের জন্য দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে কমিটির রিপাের্ট তাে দূরের কথা একটিও আনুষ্ঠানিক বৈঠকও বসেনি৬ বলাবাহুল্য দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত এবং দুর্নীতির আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা সাফারী সুট পরিহিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কোন ক্ষমতাই ছিলােনা।

হ্যাভ ইউ সিন এনি ক্যাট হুইস ডিজলাইক ফিস

৩৬. জিয়ার সততা সম্পর্কে ফার ইস্টার্ন-ইকোননিক রিভিউ-র মূল্যায়নে একথা বলা হয়েছে যে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিলাে রাজনীতি দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে।পত্রিকাটি আরাে লিখেছে যে, “জিয়া রাজনৈতিক দলের জনসভা অনুষ্ঠানের বাধা দিতেন না। কিন্তু প্রশাসনকে ব্যবহার করে কোন দল পার্লামেন্টে কতটা আসন পাবে সেটার ব্লু-প্রিন্ট তৈরী করতেন। রাজনৈতিক দলকে ভয় দেখাতেন। তিনি দল ভাঙার কৌশল অবলম্বন করতেন। সরলীকরণ ছিল এই যে, রাজনীতির নামে পৃষ্ঠপােষকতা, এমনকি সরাসরি ঘুষ প্রদান করে সমর্থন বাগানাে এবং সমালােচকদের মুখ বন্ধ করা। রিভিউ সংবাদদাতা সালামত আলীর প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় জিয়া পার্টির লােকদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন অপরাধ ওভার লুককরেন, কিন্তু পুলিশের উপর যেন চাপ না দেন। পার্টির কুখ্যাত আইন ভঙ্গকারীদের তিনি বহিস্কার করতে শুরু করেন।সালামত আলীর মন্তব্য ছিলাে পার্টির বিলুপ্ত ব্যতিরেকে পার্টিকে (বিএনপিকে দুর্নীতিমুক্তকরণের কোন উপায় আর অবশিষ্ট ছিলােনা।৭

দুর্নীতির কালাে বিড়াল কাসী চাই 

৩৭. জেনারেল জিয়াউর রহমানের দুর্নীতির আর একটি কৌশল ছিল পুজি প্রত্যাহার নীতি। পুজি প্রত্যাহারের নামে জিয়াউর রহমান কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা দামের ৩২২টি পরিত্যক্ত শিল্প কারখানা মাত্র ৫৭ কোটি টাকা ২৯ লক্ষ টাকা দামে বিএনপির সমর্থক প্রাইভেট পার্টির কাছে বিক্রি করেছে। নগদ দামে নয়া কিস্তিতে। রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ১ম কিস্তি দিয়ে মিল মালিক হয়েছে। মিলের জায়গা জমি বিক্রি করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। মিল বন্ধ হয়ে পরে আছে। শ্রমিক ছাঁটাই হযেছে। বকেয়া কিস্তি দেয়ার নাম নেই। এসব বকেয়া কিস্তির মূল্য। ১৩ কোটি ৬৪ লক্ষ টাকা। কিন্তু মিল মালিকরা কেটে পড়েছে। এরা জিয়াকে মােটা অংকের টাকা ঘুষ নয়‘ ‘চাঁদাহিসেবে দিয়েছে। বিবিসির সাম্প্রতিক এক খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনাদায়ী ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকা। এদিকে স্থানীয় একটি ইংরেজী দৈনিক প্রকাশিত হয়েছে ব্যাংগুলাে থেকে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তার এক তৃতীয়ংশ অর্থাৎ কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা একেবারে আটকে গেছে। এ অর্থ ফেরত পাবার কোন আশাই নেই। দুর্নীতির আরেক অধ্যায়ঃ ঋণ গ্রহীতাদের হদিস নেই 

৩৮. জিয়ার আমলে রাজনৈতিক স্বার্থে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও দলীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের কারসাজিতে অনেক ভূয়া ব্যক্তি এবং

প্রতিষ্ঠানের নামেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ, ওডি ইত্যাদি বরাদ্দ করা হযেছে। এসব প্রতিষ্ঠান ঋণ বা অগ্রিম তুলে নিয়েছে, আদতে যার অস্তিত্ব নেই। এ প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ঋণ গ্রহীতাদের অনেকের হদীস নেইশীর্ষক খবরে বলা হয়েছে, পুলিশ ঋণগ্রহীতাদের ঠিকানায় গিয়ে তাদের অনেকেই খুঁজে পাচ্ছেনা। শুধুমাত্র বগুড়া জেলায় ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে ছয় হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিবগঞ্জ থানার টেপাসাড়ী গ্রামে কিসমত উল্লাহর পুত্র বাশার আলী, মামুদ প্রামানিকের পুত্র মিছির প্রামানিক, মল্লিকপুর গ্রামের বছির প্রামানিকের পুত্র তবিবর রহমান, সামাদ আলীর পুত্র আবদুর রহমান ও কাজী প্রামানিকের পুত্র মমিন উদ্দিন নামে কোন লােকই নেই ঐ গ্রামে। কিন্তু এরা ঋণ গ্রহীতা ও এদের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। গ্রামের এই অবস্থার পাশাপাশি শহর ও রাজনীতিতে বিভিন্ন ট্রেডিং ফার্ম, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কলকারখানা স্থাপন বা পাট ক্রয়ের জন্য ঋণ গ্রহণের পর তার অধিকাংশই ব্যয়িত হয়েছে অনুৎপাদন শীল খাতে, ট্রেডিং ব্যবসায়ে, নতুন মডেলের গাড়ী ক্রয়ে কিংবা স্রেফ আমােদ মউজ ফুর্তিতে।

দুর্নীতি রূপ ঃ কালাে টাকা সাদা

৩৯. জিয়া সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির খবর পাওয়া যায় ১৯৮২ সালের আয়কর (আয় ঘােষণা) বিধির এম, এল, আর ৫/৮২) অধীনে প্রদত্ত রিপাের্টে। রিপাের্টে জানা। যায়, প্রায় ২৭৩ কোটি টাকার কর অনারােপিত আয় ঘােষিত হয়েছে। ১৯৮২ সালের ৫নং সামরিক আইন বিধির অধীনে অনারােপিত আয় ঘােষণার জন্য সর্বশেষ তারিখ ছিলাে ৩১মে আগষ্ট। দেশের অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন এতে কালােটাকার সামান্য অংশ্যই সাদা হয়েছে। দেশে পূঞ্জীভূত কালাে টাকার পরিমাণ ২৭৩ কোটি টাকার কয়েক গুণ হবে। ১৯৮০ সনের জাতীয় সংসদে জনৈক এম,পি-র তথ্যানুসারে দেশে ১২শত কোটি টাকার কালাে টাকা বিদ্যমান রয়েছে ” বলে দাবী করা হয়েছে। জিয়ার মৃত্যুর আগে এর পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছেসরকারী তথ্য বিবরণীতে প্রকাশ ২৭৩ কোটি টাকার কর অনারােপিত যে আয় ঘােষিত হয়েছে তার মধ্যে ২৭০ কোটি ১৮ লক্ষ ৭৪ হাজার ৭৪০ টাকা দেশীয় মুদ্রা, ৯লাখ ৮৫ হাজার মার্কিন ডলার এবং ২লাখ ৯৪ হাজার ২৩৯ পাউন্ড টালিং। ঘােষণা প্রদানকারীর সংখ্যা ১২, ৫৩৪জন। পরিশােধকৃত করের পরিমাণ ৩৬ কোটি ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার ৮৭৭ টাকা। উল্লেখ্য ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট

জাতির জনক হত্যার পর ১৯৭৬ সালের ৬নং সামরিক বিধি বলে ঘােষিত কর অনারােপিত আয়ের পরিমাণ ছিলাে ৪৬কোটি ১২লাখ ৮৪ হাজার টাকা। পরিশােধকৃত করের পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৭২ লাখ ৫৫হাজার টাকা।

দুই থেকে শতাধিক কোটিপতি 

৪০. জেনারেল জিয়ার আমলে বিএনপি সরকারের লুটপাট ও দুঃশাসনের আমলে জনগণের ভাগােন্নয়নের নামে হাজার হাজার টাকার লুটপাট, নিয়মনীতি বহিভূর্ত বেপরােয়া হরিলুট কিভাবে ৭৫ পরবর্তী ৬ বছরের মধ্যে দেশে কোটিপতির সংখ্যা। দুই থেকে শতাধিক করা হয়েছে এবং জিয়াউর রহমানের অনুগ্রহভাজন বিশেষ ব্যক্তিবর্গ শত শত টাকা গায়েব করে দিয়েছে তার আতঙ্কজনক চিত্র ফাঁস হচ্ছে। বিবিসি প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে বলা হয়েছে, ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকসমূহের  প্রদত্ত ঋণের টাকা বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে অনাদায়ী পড়ে রয়েছে তার পরিমাণ ৪ হাজার এক শত কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারী খাতে শতকরা ৬০ ভাগ এবং সরকারী খাতে শত করা ৪০ ভাগ। ১০

মাত্র পাঁচ হাতের কবজায় 

৪১. সামরিক তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে পত্রিকায় বলা হয়েছে, বহুক্ষেত্রে বৈধ। কাগজপত্র, সিকিউরিটি, এমন কি সমান্যতম নিয়ম কানুনের তােয়াক্কা না করে। জিয়া শাহীর নির্দেশে অনেক শিল্প ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ দ্বারা শিল্পকারখানা গড়ে তােলা হয়নি। ১৯৮১ সনে দৈনিক ইত্তেফাকে মাত্র পাঁচ হাতের কবজায়শীর্ষক প্রকাশিত এক রিপোের্ট বলা হয়েছে, দেশের আর্থিক সুযােগ সুবিধা, ব্যাংক সুবিধাদি এবং সম্পদের প্রায় শতকরা ৪০ভাগই মাত্র ৫টি শিল্প না গােষ্ঠীর পাঁচ হাতের কবজায়।

দুনীতির ছিপি ভ্যাট কলির

৪২. জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্টপােষকতায় সর্বত্রই চলছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড।

বিএনপি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ ও পুজি লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানে বিএনপি নতুন চেয়ারম্যান ও একজন করে ডাইরেকটর নিয়ােগ করার বিধান চালু করেছে। এদের। ব্যাংকিং বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও যােগ্যতা কোনটাই নেই। এদের একটাই যােগ্যতা তারা জিয়ার অনুগত এবং বি এন পি-র নেতা সমর্থক বা পৃষ্ঠাপােষক। এদের ভাতা, গাড়ী ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধার জন্য অতি “গে খরচ হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা। মাথাভারী প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসনকে

সম্পূর্ণরূপে বিএনপিকরণ করার ব্যবস্থা পাকাপােক্ত ভাবেই চলছে। ব্যাংক সুষ্ঠুভাবে চলে তার জন্য এসব চেয়ারম্যান ও ডাইরেকটরদের বসানাে হয়নি। হযেছে দলীয় স্বার্থ দেখার জন্য; দলীয় নেতা কর্মীরা যাতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সুবিধা পায় তার ব্যবস্থাপত্র দানের জন্য। এসব নিয়ােগ সম্পূর্ণভাবেই জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণােদিত এবং দলীয় দুর্নীতিকে জনসমক্ষে আড়াল করার ছিপিহিসেবেই তাদের ব্যাংকসমূহের মাথার উপর বসানাে হয়েছে।

আলাদা করে দেখা লুটেপুটে খাই।

৪৩. নেতাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য দুর্নীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিএনপি দলীয় ব্যাংক কর্মচারীরাও দুর্নীতি করার ও ব্যবস্থার অবাধ সুযােগ নিচ্ছে। এরা সমগ্র ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শ্বেতসন্ত্রাস কায়েম করেছে। ১৯৮১ সনের মে মাসে পৌনে দশটার দিকে ব্যাংকের চিকিৎসা ভাতা-ভাতা হ্রাসের পন্থা বের করার জন্য ম্যানেজিং ডাইরেক্টর জনাব ইজাদুর রহমানের কক্ষে মিটিং চলছিল। জেনারেল ম্যানেজার শেখ আমিনুল ইসলাম, ম্যানেজার আবুল হােসেন, মেডিক্যাল ম্যানেজার প্রমুখ কর্মকর্তা বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলছিলাে রুদ্ধদ্বার কক্ষে। বিএনপি সমর্থনপুষ্টি ইউনিয়ন নেতৃত্ব এতই শক্তিশালী যে ব্যাংকের চিকিৎসাভাতা নেয়ার নামে হরিলুট বন্ধে তাদের ছিলাে ঘাের আপত্তি। তারা এমডির কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ফেলে। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ইজাদুর রহমান, জেনারেল ম্যানেজার আশরাফুল হক কে মারধাের করে। ইজাদুর রহমানের হাতের আঙ্গুল ও আশরাফুল হকের বা পা ভেংগে গেছে। ৭৯ সালে যদিও নিয়মজারী করা হয়েছিলাে কর্মচারীদের চিকিৎসা ভাতা হবে বছরে ৮০০ টাকা। কিন্তু ক্ষমতাধর বিএনপি। নেতারা এ বিধি মানেনি। এক বছরে যথেচ্ছহারে চিকিৎসাভাতার নামে রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক থেকে তারা লােপাট করেছে প্রায় আট কোটি টাকা। ১২ যে চক্রটি ব্যাংকের সুষ্ঠু পরিবেশ ধ্বংস করছে সেই চক্রটি বিএনপির অঙ্গ সংগঠন। এ চক্রটির কোনাে । কোনাে সদস্য সিনেমা হলের নামে লাখ লাখ টাকা লােন নিয়েছে। একজন। ড্রাইভার এক মাসে মেডিক্যাল ভাতা নিয়েছে সােয়া আট হাজার টাকা। ব্যাংকের। টাকায় অন্য এক বিএনপি শ্রমিক নেতা বাস ট্রাকের মালিক হয়েছে। সরকারী বিধি। ভংগ করে ব্যাংক-এর জীপ, গাড়ি নিয়ে যখন তখন এরা সদল বলে বেরিয়ে পড়ে। বাধা দেবার কেউ নেই। কারণ এরা বিএনপি নেতা, জিয়ার আদর্শের সৈনিক।

বিএনপি ফান্ড ঃ ওরা আমাদের লােক

৪৪. মহানগরী ঢাকায় প্রকাশ্য ব্যাংক ডাকাতির অভিযােগে অভিযুক্ত ছাত্রদলের ৪ জন আসামীকে বড়কর্তার নির্দেশে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর পুলিশের

বিশেষ স্কোয়াড তাদের গ্রেফতার করেছিলাে। প্রকাশ্য দিবালােকে তারা ১৫ লাখ টাকা ব্যাংক ডাকাতি করে বিএনপি দুর্গ সলিমুল্লাহ ছাত্রবাসে আশ্রয় গ্রহণ করে। পুলিশ সেখান থেকে তাদের গ্রেফতার করে। ছাত্রদলের এসব দুষ্কৃতিকারীদের নাম নূরুল কবীর মিন্টু, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, আনােয়ার হােসেন খােকন, ইশতেয়ার রহমান ফালু। গত ৯ই জুন, ‘৮০ তেজগাঁও শিল্প এলাকায় টিসিবির গুদামে সােনালী ব্যাংকের বুথ থেকে একদল সশস্ত্র যুবক ১৫ লক্ষ টাকা ছিনতাই করে। পুলিশ ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী জানা যায় ঐদিন পৌনে দুটোর দিকে ৫/৬ জন যুবক একটি চকলেট রঙের জীপে চড়ে (ঢাকা চ-৩২৫) তেজগাঁও টিসিবি গুদামে সােনালী ব্যাংক শাখায় পৌছায়। ব্যাংকের বুথে টাকা গণনার সময় ৩ জন যুবক স্টেনগান, রাইফেল ও পিস্তল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং গার্ডদের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাদের নিরস্ত্র করে। ব্যাংক কর্মচারীদের হাত থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়ে যায়। একই সঙ্গে তারা গার্ডের রাইফেল ও স্টিল আলমারী হতে একটি বন্দুকও সঙ্গে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের হলে পুলিশ ব্যাপক তল্লাশী শুরু করে এবং ১২ই জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ হলে পুলিশ অভিযান চালায় ,৭৯নং কক্ষ হতে চারজনকে আটক করে এবং তাদের নিকট ২৬ রাউন্ড গুলিসহ ৩টি রিভলবার এবং ২৪ রাউন্ড রাইফেলের গুলি ও কালাে কাপড়ের তৈরী ৪টি মুখােশ উদ্ধার করে। ৭৯নং কক্ষটি বিএনপি ছাত্রদল নেতার। বিএনপি-র ভাবমূর্তি যাতে বিনষ্ট হয় তারজন্য পুরাে ঘটনাটাই ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার প্রয়াস চলছে। বিএনপির ছাত্রনেতারা ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে ঠিক করেছে এদের ছেড়ে দেয়া হবে। তবে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে সিংহভাগ টাকা বিএনপির ফান্ডে দিতে হবে। ১৩

বিএনপি ফান্ড ঃ রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প দোহন ঃ হাজার ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা

৪৫. জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বিএনপি মন্ত্রীবর্গ দেশের শিল্পপতি ব্যবসায়ী ধনিক বণিক গােষ্ঠীকে অবৈধ ও অন্যায় সুযােগ দিয়েছে তাদের নিকট হতে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করার জন্য মন্ত্রীদের মধ্যে প্রতিযােগিতা চলছে। বিএনপি ফান্ড গঠন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় কর্তাব্যক্তিদের প্রতি একটি নির্দেশ ও নিয়মিত পদ্ধতি। শিল্পমন্ত্রী জামাল উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রামে ডাঃ আনােয়ার নামক এক ব্যক্তিকে ৩০ লাখ টাকা অবৈধ উপার্জনের সুযােগ করে দিয়েছে। ১৪ মুসলিম লীগ নেতা এম. এ. মতিনের সুপারিশে এক বিশেষ ব্রীফকেসধারী ব্যবসায়ী চক্রকে সুবিধাদানের ফলে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানাকে সােয়া কোটি টাকা আয় হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। 


জনাব আনােয়ারের তেজগাঁওস্থ টাইগার ওয়ার প্রােডাক্টস কারখানায় ইঞ্চি ব্যাস বিশিষ্ট রডের সাহায্যে পেরেক, সরু তার উৎপাদন সম্ভব। কিন্তু তাকে তিন হাজার টন বিলেট আমদানীর মঞ্জুরী দেয়া হয়েছে। দেশে বিলেটের তীব্র সংকট চলছিলাে। খােলা বাজারে বিলেট পাওয়া যাচ্ছিলাে না। চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানায় এই বিলেট উৎপাদিত হয় এবং বিদেশ থেকে বিলেট আমদানীর বৈধ প্রতিষ্ঠান হলাে টিসিবি। টিসিবির বিলেট আমদানীর ফাইল আটকে রাখা হয় এবং দাম পুনর্মূল্যায়নের জন্য চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানায় উৎপাদিত বিলেট বাজারে ছাড়া বন্ধ করে রাখা হয়। দেশের রি-রােলিং মেশিনগুলাে বিলেট পাচ্ছিলাে না। এমনি। অবস্থায় জনাব আনােয়ারকে গত ৭৮ সালের ১২ই আগস্ট বি.এস.ইসিসিও এম (এস)/৩৪ ১/৭৮/২৫২ নং পত্র মােতাবেক তাকে বিলেট আমদানীর অনুমতি দেয়া হয়। আমদানীকৃত বিলেট তার কারখানায় ছিলাে অপ্রয়ােজনীয়। তিনি আমদানী করে সরাসরি সমুদয় বিলেট রি-বােলিং মালিকদের নিকট বিক্রি করে দেন এবং ৩০ লক্ষ টাকা হাতড়িয়ে নেন-যার সিংহভাগ যায় বিএনপি ফান্ডে। অথচ সময়মত টিসিবিকে বিলেট আমদানীর অনুমতি কিংবা চট্টগ্রামে ইস্পাত কারখানা উৎপাদিত বিলেট বাজারজাতকরণের অনুমতি দিলে রাষ্ট্রের লােকসান হতাে না।

দুর্নীতির জাতীয়করণ বিদেশীদের রিপাের্ট 

৪৬. বিএনপি আমলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কর্মসূচী ছিলাে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের জন্য উপঢৌকন স্বরূপ। জেনারেল আইয়ুব মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে ক্ষমতার ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে গ্রামীণ মেম্বার, চেয়ারম্যানদের গম চুরির উপঢৌকন প্রথা চালু করেন। বরাদ্দকৃত টাকা বা গম সবই ছিল অডিটের বাইরে। জেনারেল জিয়াউর রহমানও অনুরূপভাবে গ্রামে পাওয়ার বেজগড়ে তােলার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ও মেম্বার চেয়ারম্যানদের গম চুরির ব্যবস্থা করে দেন। কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কর্মসূচীর উপর অক্সফামের সাবেক ডিরেক্টর এন্ডু জেনকিনস বাংলাদেশ। সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা ভূমিহীন সংস্থাগুলির মধ্যে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে (১৯৭৯ সালে) দেখতে পাই যে, একটি এলাকার দশটি গ্রামে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে বরাদ্দকৃত গমের শতকরা ৭৬ ভাগই স্থানীয় রাজনীতিক ও সরকারী কর্মকর্তাদের পকেটে ঢুকে গায়েব হয়ে গেছে। অবশিষ্টাংশেরও বেশীর ভাগই তাদের ট্যান্ডেল এবং আত্মীয় পরিজন আত্মসাৎ করেছে। যে সকল স্থানীয় হর্তাকর্তা ১৯৭৯ সালে প্রেরিত জরুরী খাদ্য সরবরাহের শতকরা ৭৬ ভাগ লােপাট করেন, তারা অতপর ঐ লাভের টাকা পুলিশকে ঘুষ প্রদান ও গুণ্ডা ভাড়ার কাজে ব্যয় করেন। সেই সব লােকজনের।

জমিজমা কুক্ষিগত করার জন্য, যারা দুর্ভিক্ষে সবচাইতে বেশী দুঃখ দুর্ভোগ সহ্য করেছেন।নিবন্ধটিতে আরাে বলা হয় যে, অক্সফামের সাবেক খাদ্য সাহায্য বিষয়ক পরামর্শদাতা টনী জ্যাকসন সম্প্রতি লিখেছেন এমনকি যেখানে খাদ্য সাহায্য খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে রাস্তাঘাট ও সেচ খালের দ্বারা সাধারণত স্থানীয় ভূস্বামীরাই লাভবান হয়েছেন। খাদ্য সাহায্য উন্নয়নশীল দেশগুলির জুলুমবাজ সরকারী মহলের পেশী শক্তিশালী করার কাজেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, বৃটিশ সরকার ১৯৭২ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে যে ৪ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য সাহায্য হিসাবে দিয়েছেন তার মধ্যে ১ লাখ ৭২ হাজার টন সরাসরি চলে গেছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও সিভিল সার্ভিসের লােকজনের হাতে। ১ লাখ ৭ হাজার টন পেয়েছে ক্ষুদ্র শহর এলাকার প্রধানত মধ্যবিত্ত শ্রেণী আর এই খাদ্য সাহায্যের বড় জোর শতকরা ১৭ ভাগ মাত্র সত্যিকার গরীবদের হাতে পৌঁছেছে। ইতিপূর্বে গত ৯ই মার্চ ৭৯ পত্রান্তরে অক্সফামের সাবেক ফিল্ড ডিরেক্টর মিঃ ডেভিট ক্যামবেল কর্তৃক একটি বিদেশী সাময়িকীতে লিখিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে বাংলাদেশ কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর বরাদ্দকৃত গমের শতকরা ৭৫ ভাগই আত্মসাৎ হচ্ছে। বাংলাদেশে সাড়ে চার বছর চাকুরি করার পর অবসর গ্রহণ শেষে ক্যাম্পবেল উক্ত প্রতিবেদন লেখেন। খাদ্য সাহায্য ও অন্যান্য সাহায্য সরাসরি ধনীদের হাতে গিয়ে পৌছেএই শিরােনামে লিখিত প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন যে, তিনি দেখেছেন ঢাকার বস্তিতে বাস করে, দিনে একবারও হয়তাে খেতে পায় না এ রকমের পরিবারও রেশনের খাদ্য থেকে বঞ্চিত। তার ভাষায় বালাদেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী বহুলাংশে ব্যর্থ। হয়েছে। বরং এতে গরীব আরাে নিঃস্ব হচ্ছে ক্রমশঃ। জাতিসংঘ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠান কেয়ার বাংলাদেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীতে খাল খনন, সড়ক নির্মাণের কাজ করছে। কিন্তু এর দ্বারা বালাদেশের অনাহারী মানুষ উপকৃত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত খুব বিরল।মিঃ ক্যাম্পবেল আরাে বলেন, “বলাদেশ পল্লী প্রগতি কমিটি (ব্র্যাক) কর্তৃক দেশের প্রত্যন্ত দশটি গ্রামে পরিচালিত এক জরীপে দেখা গেছে, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর জন্য বরাদ্দকৃত গমের শতকরা ৭৫ ভাগ স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা আত্মসাৎ করছে। অবশিষ্ট ২৫ ভাগেরও একটি অংশ ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের আত্মীয় স্বজন খেয়ে ফেলছে। কাজেই প্রান্তিক গ্রুপ কি পাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি, এই কর্মসূচীর অধীনে একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও তা গ্রামের অনাহারী লােকদের বিশেষ কোন উপকারে আসে না। ভূমিহীন কৃষকরাও বলেছে, “এই কর্মসূচীতে তাদের কোন উন্নতি হয়নি। সেখানে তাদের পাওয়ার কথা দৈনিক ৩ সের গম, সেখানে তারা দেড় সেরের বেশী গম পাচ্ছে না।

নির্বাচনী খরচা ও খাদ্য দুর্নীতি

৪৭. জিয়া সরকারের আমলে নিত্যনতুন দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হচ্ছে। খাদ্যশস্য নিয়ে দুর্নীতিবাজ জিয়াশাহীর সরকারের নজিরবিহীন ঘাপলাবাজি, পাইকারী চুরিচামারি ও লুটপাট এবং অবাধে কোটি কোটি টাকার খাদ্য পাচারের ফলে উত্তরাঞ্চল ও খুলনায় অনাহারে প্রাণহানি শুরু হয়ে গিয়েছিলাে। দেশে খাদ্যশস্য নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও কারচুপি যে কি সর্বগ্রাসী ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিল ৮২ সনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দেড় হাজার রেশন দোকান, দুই লক্ষ রেশন কার্ড, সাড়ে চার হাজার খাদ্য শস্যের লাইসেন্স এবং ৫ হাজার রেশন পারমিট বাতিলের খবরটি থেকে তা কিছুটা অনুমান করা যায়। গম আত্মসাতের অভিযােগে সাবেক এমপির বিরদ্ধে মামলা দায়ের এবং খাদ্য বিভাগীয়। কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে গ্রেফতারের খবর থেকেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে খাদ্য কেলেংকারির সঙ্গে জড়িত ছিলাে অপরাধী চক্র। রাজনৈতিক স্বার্থে ৭৮-এ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কর্মসূচী ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে ভরা বর্ষায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর নামে ২০ কোটি টাকা দামের ২০ লক্ষ মণ গম বরাদ্দ করে গ্রামে গ্রামে টাউট বাটপাড়দের জন্য নির্বাচনী খরচা দেয়া হয়েছিল, বিনষ্ট উপক্রম ঘঘাষিত বলে নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপির কর্মীদের কাছে সস্তা দরে ১ লক্ষ ২০ হাজার টন সম্পূর্ণ ভাল চাল বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। খাদ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মহল শতকরা সাড়ে ৩ ভাগ। স্বীকৃত অপচয়ের সুযােগ নিয়ে সাড়ে তিন শত কোটি টাকার খাদ্যশস্য লােপাট করে নিয়েছে। উল্লেখযােগ্য যে ভারত বা পাকিস্তান কোথাও এখন আর স্বীকৃত অপচয়ের” নামে এই ধরনের পুকুর চুরির সুযােগ বহাল নেই ৮২ সনে এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর গম আত্মসাৎ ও সরকারী অর্থ নিয়ে দুর্নীতির অভিযােগে ৩ শতাধিক ইউপি চেয়অরম্যানকে সাসপেন্ড করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ধান কেনার জন্য প্রদত্ত অগ্রিম টাকার হিসাব এবং আত্মসাৎকৃত বা অব্যহৃত অর্থ ফেরত দেবার শেষ তারিখ ৮২-এর ৩০শে এপ্রিল উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু অনেকের কাছ থেকেই টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি।

এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পক্ষকাল সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, খাদ্যশস্য নিয়ে কারচুপি ও দুর্নীতির অভিযােগে বেশ কিছু মামলা দায়ের ও গ্রেফতারসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ যে, ময়মনসিংহের ইটনা অষ্টগ্রাম এলাকার বিএনপি সমর্থক সাবেক এমপি ফরহাদ আহমদ কাঞ্চন ও তার এক অনুচরের বিরুদ্ধে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর দেড় হাজার মণ গম আত্মসাতের অভিযােগে অষ্টগ্রামের সার্কেল অফিসার সামরিক আইনবিধি বলে মামলা দায়ের করেছেন। বগুড়ার সুবিল খাল খননের সঙ্গে সদর থানার ৫ জন ইউপি সদস্যকে ৬ই মে ৮২ গ্রেফতার করা হয়েছে। একই দিনে গম ও হাট তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযােগে মানিকগঞ্জে তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে সামরিক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গম আত্মসাতের অভিযােগে স্বরূপকাঠিতে ৫ জন, ভেড়ামারার জুনিয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং রায়পুরা থানার চান্দেরগাও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির অভিযােগে ৫ই মে কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুল জলিলকে এবং ৪ঠা মে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৩রা মের খবরে প্রকাশ, সরকারী গম ও ধান আত্মসাতের অভিযােগে ফরিদপুরের ডিক্রিরচর, চরজিসুরদি ও হামিরদি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদেরকে গ্রেফতার করেছে। অপর এক খবরে প্রকাশ গম আত্মসাতের অভিযােগে ২৮শে এপ্রিল জামালপুরের গােরদগা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরদিন সেখানকার দুজন রেশন ডিলারকেও আটক করা হয়েছে। এছাড়া গম আত্মসাতের। অভিযােগে যশােরের বাঘারপাড়া থানার রায়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং কুমিল্লার হাজিগঞ্জের বরফুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এক ইতিমধ্যে নওগাঁ মহকুমা খাদ্য দফতর ১৮টি চালকলের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৭ লক্ষ ৬২ হাজার ৮৩৮ টাকা মূল্যের ধান চাল আত্মসাতের অভিযােগে মামলা দায়ের করেছে। প্রায় একই সময়ে দিনাজপুর জেলায় ২৪ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা মূল্যের | ধান চাল আত্মসাতের অভিযােগে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ৪ জন মিল মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরেক খবরে বলা হয়েছে যে, গােডাউনে মাল ঘাটতির অভিযােগে খুলনায় ১৪ জন খাদ্য পরিদর্শক ও সহকারী খাদ্য পরিদর্শককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা

হয়েছে এবং খাদ্য শস্য বন্টনে দুর্নীতির অভিযােগে নড়াইলের খাদ্য পরিদর্শক ও প্রধান সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, কুড়িগ্রামে পক্ষকালের মধ্যে শুধু মাত্র এই মহকুমাতেই ১৩৬টি সংশােধিত রেশন ডিলার লাইসেন্স এবং ১০০টি খাদ্যশস্য লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। জেলা বা মহকুমা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও দেশের প্রায় সব জায়গায় থেকেই খাদ্য কেলেংকারীর অভিযােগে ব্যবস্থা গ্রহণের খবর পাওয়া গেছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, খাদ্যশস্য দিয়ে বিভিন্ন রকম কারচুপি ও দুর্নীতি, খাদ্যশস্য নিয়ে সর্বব্যাপী যে দুর্নীতি, ও কেলেংকারি চলেছে তা অত্যন্ত। প্রকটভাবে ধরা পড়ছে।

প্রশাসনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করা হয়েছিল

৪৮, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক লেঃ জেঃ হুসাইন মােহাম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সনের ৬ই মে সরকারী অর্থ, ত্রাণ সামগ্রী ও কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর অধীনে প্রদত্ত খাদ্যশস্য আত্মসাতের দায়ে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তি সম্বলিত ৪ নং সামরিক আইন বিধি জারির করার পর এ পর্যন্ত সারাদেশে সামরিক আদালতে বেশ কিছু অভিযােগ সংক্রান্ত মামলার বিচার হয়েছে। তন্মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযােগ্য সাড়ে এগারাে কোটি টাকার সাড়ে ৯ লাখ মণ খয়রাতি গম। আত্মসাতের চাঞ্চল্যকর মামলাটির রায় গত ২৯শে আগস্ট ঘােষিত হয়েছে। লেঃ কর্ণেল এম আমিরুল ইসলাম ইঞ্জিনিয়ারের নেতৃত্বে গঠিত অঞ্চলের ২নং সংক্ষিপ্ত সামরিক আইন আদালতে ৯ লাখ ৬২ হাজার মণ খয়রাতি গম আত্মলাভের এই চাঞ্চল্যকর মামলার শুনানী গত ৬ই জুলাই শুরু হয় এবং ২৯ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদী কারাদণ্ড প্রদান ও জরিমানা করে ২১শে । আগস্ট রায় ঘােষিত হয়। আদালত প্রধান অভিযুক্ত ঢাকার এডিসি (রিলিফ) এবিএম আবদুল লতিফকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। জরিমানা, অনাদায়ে আরাে ২ বছর ৯ মাস সশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন। উল্লেখ্য, প্রতিটি জেলায় ও থানায় বিএনপি পান্ডারা সরকারী কর্মকর্তাদের সহায়তায় এরকম হাজার হাজার দুর্নীতি করেছে। 

জিয়ার সততা লন্ডনের পত্রিকাকে ১৮ লক্ষ টাকা ঘুষ

৪৯. জিয়াউর রহমানের একটি সুচতুর কৌশল ছিলাে বিদেশী পত্রিকায় টাকা দিয়ে নিজের প্রচারের জন্য ক্রোড়পত্র বের করা। এবং সেই ক্রোড়পত্রের বরাত দিয়ে


বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায়, রেডিও টিভিতে সুখ্যাতি প্রচার করতাে। এসব ক্রোড়পত্র বের করার জন্য ঘুষ পর্যন্ত দেয়া হতাে। জেনারেল জিয়ারউর রহমান ৮০ সনের জুন মাসে লন্ডন সফরে গিয়েছিলেন। সরকারী সফর উপলক্ষ্যে ১৬ই জুন জিয়া লন্ডন পৌছায়। ফিনানসিয়াল টাইমসের সাবেক সংবাদদাতা বর্তমান সৈনিক রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা জনাব দাউদ খান মজলিশ জিয়ার লন্ডন সফর উপলক্ষে ১৬ই জুন ৪০/৫০ হাজার পাউন্ড বিজ্ঞানী ঘুষ দিয়ে দি গার্ডিয়ানদি টাইমস‘- এ দুটি পত্রিকায় বাংলাদেশ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। ১৯ এ ক্রোড়পত্র ১/ জিয়া ও সামরিক আইন প্রশাসনের নির্লজ্জ প্রশংসার লিফলেট বৈ অন্য কিছু নয়। দি টাইমস জেনারেল আইয়ুব খান সম্পর্কেও এরূপ মন্তব্য করেছিলাে। জিয়ার কড়া সামরিক শাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাপক চুরি ও অনিয়মের খবরাদি প্রকাশ করা সম্ভব ছিলাে না। সেজন্যে জনগণের নিকট তার দুর্নীতির এসব বিবরণ প্রকাশ হয়নিফলে জনগণের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে জিয়া সৎ।

২৪৬

ইতিহাস বিকৃতির নায়ক

, স্বাধীনতা ঘােষণা 

১. ১৯৮১ সনের ৩রা জুন সেই সময়কার জাতীয় সংসদে মরহুম জিয়াউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক শােক প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। শােক প্রস্তাবে বলা হয় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে তিনি বাংলাদেশ গণঅ্যুথানের নেতৃত্ব দেন এবং ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।বলাবাহুল্য, সেই থেকে প্রকাশ্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গে তথাকথিত বিতর্ক এবং বিভ্রান্তির প্রয়াস চালানাে হচ্ছে।

২. জাতীয় স্বাধীনতার পিছনে আছে এক দীর্ঘ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস। পাকিস্তান জন্মের পর হতে এদেশের শাসন ও শােষণের অবাধ রাজত্ব কায়েম হয়। বাঙালী জাতি সত্ত্বার সকল সুকৃতি, আত্মপরিচয়ের সকল উপাদান, ভাষা-সংস্কৃতি এবং জাতীয় বিশ্বাস ও শক্তিকে ধ্বংস করার নগ্ন চতুর কৌশলী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি বিভিন্ন সময়ে পর্যায়ক্রমিক সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত পটভূমিতে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা এবং নির্বাচন, প্রাসাদ চক্রান্তে ১৯৫৪ সনের ৩০শে মে পূর্ববঙ্গ পরিষদ বাতিল ঘােষণা, ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর সামরিক আইন জারী এবং আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও শাসন, কথিত ২২ পরিবারের নগ্ন শশাষণ, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উত্তাল গণআন্দোলন। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিদায় । ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণ। নির্বাচন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন। নির্বাচন পরবর্তী ষড়যন্ত্র। ৭১ সাল। ৬৬-এর ৬ দফা ১ দফায় পরিণত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান ও নির্দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা অর্জন।

৩. সংগ্রামের এই সকল স্তরে স্তরে জাতির মানস গঠন, আত্মজাগৃতির নবতর উদ্বোধন, আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়ের জাতিগত উপলব্ধি জনগােষ্ঠীর সর্বস্তরে কখনাে ধীরে কখনাে দ্রুত তালে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে বন্ধুর যাত্রায় বাঙালী জাতি সংগ্রামে, সাহসে, বৈশিষ্ট্যে, আত্মত্যাগের বলিষ্ঠতায় স্বাধীন। বীর্যবান সত্ত্বার স্বাপ্নিক সম্রাটের প্রতীকীরূপ বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সেজন্যেই ১৯৭০ সনের নির্বাচনে কায়েমী স্বার্থবাদীর সকল ষড়যন্ত্র, সমস্ত প্রলােভন, ক্ষমতার দাপটকে উপেক্ষা করে বাঙালী জাতি বঙ্গবন্ধুক এক অবিসম্বাদিত নেতারূপে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেদীর্ঘ দিবস রজনী, কত একাকী আপােষহীন তেজদৃপ্ত, কখনাে নিকষকালাে রাতের ঘাতক সঙ্গীণের মুখােমুখি হয়েও যিনি বাঙালী জাতি ও তার মুক্তির লক্ষ্যে, স্বাধীনতার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন সেই ব্যক্তিসত্ত্বার একক প্রতীকী নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

৪. ঐতিহাসিক ঘটনার স্বতঃসিদ্ধতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার, স্থপতি, সিহাপসালার এবং মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলাদেশ নাম তাঁরই দেয়া। সেজন্য বঙ্গবন্ধু, বাঙালী জাতি এবং বাংলাদেশ এক এবং অভিন্ন হয়ে আছে। যাঁর ডাকে, আহ্বানে, নির্দেশে, ঘােষণায়, অনুপ্রেরণায় বাঙালী জাতি তুলে নিয়েছে। হাতিয়ার, ঝাপিয়ে পড়েছে শত্রু নিধনে। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানকে ছােট করে না দেখলেও একথা বলা যায়-স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত পটভূমিকায় সামরিক কোন কর্মকর্তার বিশেষ ও উল্লেখ্য অবদানের অদ্ভুতদাবী এক কথায় নাকচ হয়ে যায়। আগরতলা মামলায় যে সমস্ত সামরিক অফিসারকে জড়ানাে হয়েছিলাে সেখানেও প্রধান ও ১নং আসামী শেখ মুজিব। অন্যান্যরা এসেছে তাঁকে জড়িয়ে। তবুও স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গে যখন বিতর্ক এসেছে তখন বিষয়টির বস্তুনিষ্ঠ ফয়সালা হওয়া দরকার।

৫. স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কে শত্রু পক্ষের ভাষ্য কি? , যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা কেন-স্বাধীনতার জন্যই তিনি প্রস্তুত ছিলেন না ,তার জবাবে এয়ার ভাইস মার্শাল আজগর খান লিখেছেন, “১৯৭১-এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকা যাই। সেখানে শেখ মুজিবের সাথে দেখা করি। আমি মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করলাম, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি কিরূপ নেবে এবং অচলাবস্থার অবসান কিভাবে সম্ভব? উত্তরে মুজিব বললেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সহজ। ইয়াহিয়া খান প্রথম ঢাকা আসবেন, এম এম আহমেদ (প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান) তাঁকে অনুসরণ করবেন। ভুট্টো আসবেন তারপর। ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবেন এবং তার পরেই পাকিস্তানের শেষ।

পাকিস্তানের শেষ অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৬ ,পাকিস্তান সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর মেজর সিদ্দিক সালিক ডেভিড লােশাক-এর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, When the forst short had been fired, the voice of Sheik Mujibur Rahman came faintly through on a wave length close to that of the offcial Pakistan Radio, in what must have been and sounded like a Pre-recorded message, the Sheik proclaimed East Pakistan to be the peoples Republic of Bangladesh” তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিলাে, কেননা আমি নিজে মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণার স্বকণ্ঠ বাণী শুনেছি। পাকিস্তানের তদানীন্তন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সদম্ভে ঘােষণা করেছিলেন আমি শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেব। কেননা তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছেন। শুধু তাই নয়, আজ যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদানকে খাটো, ছােট ও উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে হীনউদ্দেশ্য সাধন করতে চান তাদেরকে বাংলাদেশের গণহত্যা নায়ক ও প্রধানতম শ তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চের বেতার ভাষণটি পাঠ করার অনুরােধ জানাই।

৭. ইয়াহিয়া খানের এই ঘােষণাটি শুধু নয়, স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কিত পূর্ব পাকস্তিানের সংকট সম্পর্কে ঘােষিত পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রকাশিত শ্বেতপত্র একটি প্রামাণ্য দলিল। পাকিস্তান সামরিক এবং বেসামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্তৃক প্রণতি এই দীর্ঘ শ্বেতপত্রে স্বাধীনতা ঘােষণা করার জন্য একটি ব্যক্তিকেই অভিযুক্ত করা হয়েছে বার বার-তিনি হলেন শেখ মুজিব। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দিনগুলােতে সশস্ত্র অভ্যুথানের বিস্তারিত পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়া হতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর কাছে সরাসরি দায়ী করে সাবেক কর্ণেল ওসমানীকে বিপ্লবী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করেন। শ্বেতপত্রে ইপি আর ইবিআর-এর ট্রান্সমিটারে যােগাযােগ স্থাপনের কথাও বরা হয়েছে। যারা এই ঘােষণাটি প্রচার করেছিলেন তাদের নাম (১) এ কে এস এম এ হাকিম এ ই ডব্লিউ (২) জালাল আহমদ টিটিআরইএম ডব্লিউ (৩) জুলহাস উদ্দিন প্রাক্তন ইপিআর টিটিআর (৪) মােহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ই এস ডব্লিউ (৫) আবুল কাশেম খান টিটিআর (6) আবুল ফজল ক্যাশিয়ার। এরা বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ট্রান্সমিট

করেছিলেন। ভাষনটি ট্রান্সমিট করার পর তারা বঙ্গবন্ধুর নিকট জানতে চান তাদের। আর কি করণীয়। বঙ্গবন্ধু তাদের অবিলম্বে উক্ত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। 

৮. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর বক্তব্য, সাক্ষাৎকার এ প্রসেঙ্গ উপস্থাপন অত্যন্ত জরুরী। ১৯৭২ সনের স্বাধীনতা দিবসে পূর্বদেশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওসমানী বলেছেন ঃ ২৫শে মার্চ রাত দশটায় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন আপনাকে যেন ওরা কোন অবস্থাতেই ধরতে না পারে। তিনি আমার উপর যুদ্ধ পরিচালনার করার নির্দেশ প্রদান করেন।” যিনি যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সেনাপতি নিযুক্ত করেন তিনি যুদ্ধ ঘােষণা করেননি-এ যুক্তি কোনভাবে গ্রহণীয়? জেনারেল ওসমানী জাতীয় সংসদে স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গিত বিতর্কে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ১৯৮১ সনে পুনরায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বঙ্গবন্ধুই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।” 

৯. এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বলেন, “১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমি বিদেশে ছিলাম। ওমানের টেলিভিশন পর্দায় দেখেছি ভােটের ছবি। তার আগে ঝড়ের ছবি। দেশে ফিরে দেখলাম আমার দেখা বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে গেছেচারিদিকে দানা বেঁধে উঠেছে সংগ্রাম। এবার স্বপ্ন স্বার্থক হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হবেন রাষ্ট্রনায়ক।শেখ মুজিবের প্রতি একজন সরল প্রাণ সামরিক নেতার অকপট আত্মস্বীকৃতি, উপলব্ধির অবিকৃতি; স্বাধীনতার পরপরই সাপ্তাহিক বিচিত্রায় যা বিবৃত আছে। 

১০. মেজর জেনারেল জিয়ার লিখিত প্রবন্ধ একটি জাতির জন্ম এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযােগ্য। তিনি লিখেছেন ? “তারপর এলাে ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারাদেশে শুরু হলাে ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন। তিনি লিখেছেনঃ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলাে।ঐ ঘােষণার প্রেক্ষিতে তিনি ১৭ই মার্চ অন্যান্য অফিসারদের সংগে গােপন বৈঠকে মিলিত হন। লক্ষ্যণীয় জিয়াউর রহমান ঐ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতাহিসেবে স্বীকার করেছেন। যদিও ক্ষমতায় এসে তিনি ইতিহাসকে বারবার বিকৃত করতে চেয়েছেন স্বীয় সংকীর্ণ স্বার্থে। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ঐ গ্রীন সিগন্যালনা পেলে কি করতেন? কয়েকজন লােক নিয়ে বিদ্রোহ করতেন? তিনি আরও লিখেছেন, ‘অফিসারদের মেসে যাওয়ার


পথে আমি মেজর মীর শওকতকে ডাকলাম। তাকে জানালাম আমরা বিদ্রোহ করেছি। শওকত আমার হাতে হাত মিলালাে।‘ 

১১. মেজর মীর শওকত পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল শওকত হয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবেআপনারা বিবেককেই জিজ্ঞাসা করুন এটা অনস্বীকার্য যে ২৫শে এবং ২৬শে মার্চ ৭১-এর চরম মুহূর্তে প্রতিটি বাঙালীর মনেই স্বাধীনতার কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। সেই হিসেবে প্রতিটি বাঙালী সেদিন হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীনতার এক একজন ঘােষক। কিন্তু কে সেই মহান নেতা যিনি সেদিন অন্তরালে থেকেও প্রতিটি বাঙালীকে জুগিয়েছিলেন এই সাহস? কার আহ্বানে বাঙালী সেদিন পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা? ৭ই মার্চ (৭১) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কে জাতিকে স্বাধীনতার ডাক শুনিয়েছিলেন? ২৬শে মার্চ ৭১ সন্ধ্যা হতে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মূল বেতার কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে কালুর ঘাট ট্রান্সমিটারে অবস্থান করে যারা স্বাধীনতার কথা বললেন, বিভিন্ন ঘােষণা প্রচার করলেন, কে তাঁদের সেদিনের প্রেরণার উৎস ছিলেন? কার পক্ষে তারা প্রচার করেছিলেন সেসব ঘােষণা, স্বাধীনতার কথা? কাজেই বলুন কে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি? কে বা কারা ঘােষক ছিলেন, সেটা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল না? এই আনুষ্ঠানিকতার বিতর্কে আমি জড়িয়ে পড়তে চাই না।

১২. সামরিক ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি বেসামরিক ব্যক্তি তদানীন্তন চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডাঃ এ আর মল্লিক বলেন, “২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব সংগ্রাম পরিষদের অপিস থেকে ফোনে ডঃ আনিসুজ্জামানকে জানান যে, গতরাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। ঘােষণার বাণী চট্টগ্রামে পৌছে গেছে। তিনি আরও জানান চট্টগ্রাম বেতার থেকে এই ঘােষনা আজই প্রচার করা হবে। ডঃ এ আর মল্লিক বলেন ঃ বিকেলে হান্নান সাহেব স্বাধীনতার যে ঘােষণার পাঠ করেন তা আমরা শুনতে পাই।একাত্তরের রণাঙ্গনে বইয়ের লেখক শামসুল হুদা চৌধুরী লিখেছেনঃ স্পষ্টতই চট্টগ্রাম বেতার থেকে বাংলাদেশের। স্বাধীনতা ঘােষণার পক্ষে প্রথম বিপ্লবী ভাষণ প্রচারের গৌরব অর্জন করেছিলেন জনাব এম, , হান্নান। চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শুরু হয় ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে। তিনি লিখেছেন, এই বেতারে প্রথম সান্ধ্য অধিবেশনেই পবিত্র কোরান তেলাওয়াতের পর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার বাংলা অনুবাদটি উপস্থাপন করেন জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ৭১ সান্ধ্য অধিবেশনে সদ্য গঠিত এই বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পুনরায়

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােসণা পাঠ করলেন মেজর জিয়াউর রহমান।৮ ২৭শে মার্চে জিয়া কাগজ নিয়ে প্রথমে নিজের নামে স্বাধীনতা ঘােষনার খসড়ায় তার নিজের নাম কেটে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন।” 

১৩. তখন আমি পাবনার নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচিত তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পদ্মা যমুনার বাঁকে জড়ানাে এই অঞ্চলটি তখন উদ্বেল এবং উত্তাল অস্থির উত্তেজনা। প্রতিরােধ মানসিকতা প্রজ্জ্বলিত। ২৫শের রাতে ঢাকায় কি ঘটেছে জানিনা। সকালে ঢাকা বেতারে ভিন্ন কণ্ঠ, উর্দু বয়ান শুনে মনে হলাে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। বুঝলাম অসহযােগ আন্দোলন নেই। আন্দালন সশস্ত্র। লড়াই আসন্ন। থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে নিলাম। দুপুরে সিরাজগঞ্জ থেকে লােক এলাে, সিরাজগঞ্জ ওয়ালেস স্টেশন থেকে পাঠানাে একটি মেসেস ঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটি রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লােকদের হত্যা করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ। করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চলিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ ইপিআর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপােষ নেই। জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতা প্রিয় লােকদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয়বাংলা”

শেখ মুজিবুর রহমান

২৫শে মার্চ, ১৯৭১।

১৪. এই ঘােষণাটি হাতে পেয়েই নগরবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরােধ শুরু হয়ে গেলাে। পাকবাহিনীর মােকাবিলা করে অর্ধ শত মুক্তিযােদ্ধা নগরবাড়ীর নিকট ডাববাগানে প্রাণ দিয়েছেন। একটি জাতির স্বাধীনতার পটভূমি বিরাট এবং বিস্তীর্ণ। হাজার লােকের আত্মদান, ত্যাগ তিতিক্ষা, জেল জুলুম, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার মুকুর মুঞ্জরিত হয়। এটা কোন হঠাৎ খেয়ালী বা উচ্চাভিলাষী কোন ব্যক্তির নির্দেশে হয় না। জাতীয়

স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনাে খেলা নয়। যেন রেফারী হুইসেল দিলেই খেলা শুরু হয়ে। গেলাে। কোন এক ক্যাপ্টেন বা মেজর পাক সামরিক বাহিনীর পােষাকে আবৃত হয়ে হঠাৎ ঘােষণা দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার দাবীদার সাজলে জাতি কেবলমাত্র তাকে করুণা করতে পারে। ভাবখানা এই যে, কোন সামরিক অফিসার রাতারাতি বেতার কেন্দ্র দখল করে স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়েই দেশ স্বাধীন করে। ফেললাে। একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা দুরূহ কাজ। সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় মানস গঠন করতে হয়েছে। এই মানস গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সেজন্য তিনি জাতির নেতা, জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্থপতি। ইতিহাস। একথা বলবে। জাতির পিতার এই অনন্য ভূমিকার পাশাপাশি যারা জিয়ার কল্পিত ভাষণকে স্থাপন করে ইতিহাস বিকৃতি করতে চায় আপত্তি সেখানেই। জিয়ার কল্পিত ভাষণটি সামনে রেখে স্বাধীনতার শত্রু পক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাকেই বিভ্রান্তি। করতে চায়, অবমূল্যায়ন করতে চায়, বিতর্কের ধুম্রজালে স্বাধীনতাকেই ঘােট করতে চায়, সেখানেই ঘাের আপত্তি। তারা জানে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করা মানে স্বাধীনতাকে খাটো করা, বাঙালীকে অসম্মান করা এবং তারা জিয়ার ভাষণকে সামনে রেখে ঐ কাজটিই করতে চায়। এই রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ইতিহাসের সমস্ত আয়ােজন।

এবং অধ্যায়কে বাদ দিয়ে জিয়ার কথিত ভাষণ নিয়ে এত মাতামাতি পাগলামী। 

১৫. ৭১-এর ৩রা মার্চ পল্টনের ছাত্র জনসভায় ঘােষিত হয়েছিলাে স্বাধীনতার ইশতেহার, যেখানে বলা হয়েছিলাে, “৫৪ হাজার ৫ শত ৭৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ। বলা হয়েছিলাে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও সর্বাধিনায়ক। তারপর ৭ই মার্চের বজ্রকণ্ঠে ঘােষিত হলাে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।মূলতঃ স্বাধীনতার ঘােষণা, স্বাধীনতা সংগ্রামের রণকৌশল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চই ঘােষণা করেছিলেন। আর ১৯৭১ সালের মুজিব নগরে পঠিত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে বলা হয়েছে ? “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর

রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখন্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। উক্ত ঘােষণায় আরও বলা হয়েছে ? এই ঘােষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, সেই পবিত্র ঘােষণাকে অনুমােদন করছি।১০ সেজন্য স্বাধীনতার ১ম ঘােষণার উল্লেখ আমরা পাই ৩রা মার্চের ছাত্র জনসভায় * দ্বিতীয় ঘােষণা ৭ই মার্চ লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে, ২৬শে মার্চের ঘােষণা যা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত ও প্রচারিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পঠিত হয় ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর। যার উপর ভিত্তি করে সরকার। গঠিত হয়। যুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং যার ফলে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র।

খ. বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ।

১৬. জিয়াউর রহমান ১৯৭২ সনে বিচিত্রায় একটি জাতির জন্মশীর্ষক একটি নিবন্ধ লেখেন। সেই নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা মহানগরীতে মিঃ জিন্নাহ যে দিন ঘােষণা করলেন, উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আমার মতে ঠিক সেই দিনই বাঙালী হৃদয়ে অঙ্কুরিত, হয়েছিলাে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, জন্ম হয়েছিলাে বাঙালী জাতির।১১ ১৯৭৭ সনের ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান ছিলেন বাঙালী, তিনি বিশ্বাসী ছিলেন বাঙালী জাতীয়তাবাদে। ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিলে সামরিক ফরমান বলে সংবিধান সংশােধন করে তিনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। অবশ্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জনক পাকিস্তানী দালাল খান্দকার আবদুল হামিদ। তিনিই ১৯৭৬ সনের ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে সামরিক সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সুযােগ নিয়ে বাংলা একাডেমীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর ক্ষুদ্র নিবন্ধ পাঠ করেন। সেই থেকে ১৯৭৭ সনের ২১শে এপ্রিল সামরিক ফরমান বালাদেশী জাতীয়তাবাদ সংবিধান-এর অন্তর্ভূক্তি। বাঙালী জাতীয়তার পরিবর্তে পাকিস্তানী আমলে বাংলাদেশী জাতীয়তবাদ সমগ্র বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়কে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরােধীরা যা চায় তাহলে জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করা ও জাতীয় ঐক্যসূত্রকে প্রশ্নের মুখােমুখি করা। জেনারেল জিয়া তাদের পাতা ফাঁদেই পা রেখেছেন।

বাঙালী হয়েও মুসলমান হওয়া যায়-হিন্দু বা অন্য সম্প্রদায়ের পরিচয়ে কোন অসুবিধা হয়না। এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য কৃষ্টি ও সংগ্রাম সংস্কৃতি সব কিছুকেই বিসর্জন দিতে হয়। শেকড়হীন যেমন বৃক্ষ হয়না, ঐতিহ্যহীন তেমন জাতিও হয়না। এই জন্যই ডক্টর । মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তারচেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী।জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা বিরােধী জাতিদ্রোহী শক্তির সমর্থন আদায়ে এই ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন।

গ. মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয় বাংলার পরিবর্তে জিন্দাবাদ। 

১৭. পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে দ্বিজাতি তত্ত্বের মৌল প্রেরণার কণ্ঠধ্বনি ছিলাে জিন্দাবাদ।‘ ‘জিন্দাবাদবিদেশী শব্দ এবং পাকস্তিানী আদর্শের ধারক। ১৯৬৬ সনে জাতীয় দুর্যোগ মুহুর্তে বাঙালী জাতি সত্তার উদ্বোধনে বাংলাদেশের মানুষের বিজয় বালার। জয়এই আকাঙক্ষার জয়বাংলাবাস্তবায়নে উচ্চারিত হয়। তারপর হতেই জয়বাংলাপাকস্তিানী জিন্দাবাদ-এর পরিবর্তে তদানীন্তন সাড়ে সাত কোটি। মানুষের হৃদয়-নিঃসৃত ধ্বনি হয়ে দাঁড়ায়। স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় বাংলাশব্দটি ছিলাে। মুক্তিপাগল মানুষের রণধ্বনি। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তার দালালরা জিন্দাবাদ ধ্বনি নিয়ে বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে নিষ্ঠুর পশবিকতায়। তেমনি বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে জয়বাংলা। সমগ্র বাঙালী জাতির ও মুক্তিযুদ্ধের বলদর্পী রণধ্বনি ছিলাে জয়বাংলাস্বাধীন বাংলা ১৯৭৫ সনে জাতির জনককে হত্যা করে দেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেবার কৌশলে পুনরায় স্বাধীনতা বিরােধী আত্মস্বীকৃত খুনীদের মুখে উচ্চারিত হলাে জিন্দাবাদপাকিস্তানী মানসকিতায় আচ্ছন্ন ও চেতনায় লালিত সেনা অফিসার ও আমলা এবং স্বাধীনতা বিরােধীদের ঐক্যের যােগসূত্রে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোেধকে মুছে ফেলার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রচার মাধ্যমে পুনরায় জিন্দাবাদচাল করলেন।

ঘ. বাংলাদেশ বেতার-এর পরিবর্তে রেডিও বাংলাদেশ

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিলাে দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রচার মাধ্যমের নাম হয় বাংলাদেশ বেতার। কিন্তু ৭৫


পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান চক্র পুনরায় রেডিও পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশ বেতার-এর নাম পরিবর্তন করে রেডিও বালাদেশ চালু রেখেছে। এসবই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মূল্যবােধের বিকৃতি যে কাজটি জিয়াউর রহমান করেছেন সদর্পে ও স্বীয় স্বার্থে।

ঙ. স্বাধীনতা দিবস’-এর পরিবর্তে জাতীয় দিবস

জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে উদ্ধতপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলাে ২৬শে মার্চ বাঙালী জাতির স্বাধীনতা দিবসকে জাতীয় দিবসহিসেবে ঘােষণা। তিনি ১৯৮১ সনে ঘােষণা করেন যে, অতঃপর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস’ ‘জাতীয় দিবসহিসেবে পালিত হবে। এই ঘােষণার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা, ঐ ঘােষণার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সনের ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র এবং সর্বোপরি বাংলদেশের স্বাধীনতার আইনানুগ ভিত্তিতে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছেন। অন্য সমগ্র দেশে আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের আহ্বানে সারাদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সকল শক্তি ও পক্ষে মধ্যে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে জিয়াউর রহমান তার পূর্ব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিয়ে ২৬শে মার্চকে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসহিসেবে পুনরায় ঘােষণা করতে বাধ্য হন। স্বাধীনতা দিবস‘-সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির এই নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

, মুক্তিযুদ্ধের পরিবর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধ 

প্রকৃত পক্ষে জিয়াউর রহমান অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতির ইতহাস ও ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন। এক সামরিক ফরমান বরে ১৯৭২ সনের মূল সংবিধানের যেখানে লিখিত ছিলাে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের” সে শব্দগুলাে পরিবর্তন করে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে কথাগুলাে যােগ করেন। বাঙালী জাতি শুধুমাত্র নয় মাসে ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেনি এর পেছনে রয়েছে হাজার বছরের সংগ্রাম ও ইতহািস। জিয়াউর রহমান। বাঙালী জাতির সেই সংগ্রাম বিশেষ করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ২৪ বছরের সংগ্রাম মুছে ফেলার লক্ষ্য এই ইতিহাস বিকৃতি ঘটান। শুধু তাই নয়, বাঙালী জাতি শুধু জাতীয় স্বাধীনতার সগ্রাম করেনি; করেছে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে অর্থাৎ

প্রতিটি মানুষ যাতে পেট ভরে খেতে পায়, সুচিকিৎসা পায়, শিক্ষা পায়, গায়ে কাপড় পায়, বাসস্থান পায়, সর্বোপরি যথাযােগ্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা পায় এবং বৈষম্যহীন শােষণমুক্ত সমাজে ভদ্রভাবে বসবাস করতে পারে।

ছ. পতাকা বদলের ষড়যন্ত্র ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৯৭৮ সনের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে গাঢ় সবুজ জমিনের উপর লাল রঙের পরিবর্তে কমলা রঙের একটি বৃত্ত সম্বলিত পতাকা ঢাকার কিছুসংখ্যক সরকারী ভবনের উপর উত্তোলনের নির্দেশ দেন। | সেদিন এ উপলক্ষ্যে বলা হয়েছিলাে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে কমলা রঙের একটি বৃত্ত থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্তে ২৩শে ৭১ মার্চ সবুজ রঙের পটভূমিতে বাংলাদেশের ম্যাপ সম্বলিত লাল বৃত্ত খচিত পতাকা নিয়ে বাঙালী জাতি। সগ্রাম করেছেন। এই পতাকা হাতে ৩০ লক্ষ লােক শহীদ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সরকার বাংলাদেশ ম্যাপ তুলে দিয়ে সূর্যের প্রতীক হিসেবে ঐ পতাকাই গ্রহণ।

জাতীয় পতাকার অবমাননার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদের পর জিয়াউর রহমান তার পতাকা পরিবর্তনের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।১২ জিয়াউর রহমান সচেতনভাবেই ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়েছেন। বাঙালী জাতির ইতিহাস সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও স্বাধীনতার চেতনা লালন ও ধারণ করার মতাে মানসিক গড়ন তার ছিলাে না। এছাড়া ইতহািস ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনা অবলুপ্তির পদক্ষেপগুলাে মুক্তিযুদ্ধের হৃৎপিন্ডে ছুরি বসিয়ে দিয়েছিলাে-যা পূর্বে আলােচিত হয়েছে।

২৫৭

এক দানবীয় শক্তি 

১. একজন ব্যক্তির ক্ষমতার উচ্চভিলাষ একটি দেশ ও জাতিকে কীভাবে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায় সমকালীন ইতিহাসে তার নজির জেনারেল জিয়াউর রহমান।

২. হত্যা খুন ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক চক্রান্তের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্বকে পর্যদুস্ত করতে নির্মমভাবে তিনি এগিয়ে গেছেন সামরিক পােশাকে সশস্ত্র হয়ে। ৫ শতাধিক সামরিক ফরমান, বিধি-প্রবিধান, বিধান, আদেশ-নির্দেশ জারী। করে জনগণের সকল মৌলিক অধিকার হরণ করে এবং সংবিধানের ইচ্ছাকৃতভাবে। পরিবর্তন সাধন করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিক, বেসামরিক সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে এক দানবীয় শক্তির প্রতীক হিসেবেই বাল্লাদেশের ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন। 

৩. ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স মাথায় রেখে তিনি রাজনীতির দাবার ঘুটি চেলেছেন নিজের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নিরংকুশ করার স্বার্থে। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত এবং ব্যাঘ্রের চেয়েও হিংস্র। শত্রু নিধনে তার জুড়ি নেই, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে।কোন ন্যায় নীতির ধার ধরেননি তিনি। আদর্শবাদ বলতে তার কিছু ছিলােনা- ছিলাে শুধু লােক মােহিত করার শ্লোগান। দ্য প্রিন্স ছিলাে তার আদর্শ ও প্রয়ােগিক নির্দেশনা। 

৪. বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান সেনাপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক; প্রেসিডেন্ট সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এতগুলাে কর্তৃত্বশালী ও ক্ষমতাধর পদসমূহ । দখল করার পরেও জিয়ার মনে স্বস্তি ছিলােনা-একই সাথে বাংলাদেশের। সংবিধানকে ইচ্ছেমত সংশােধন করে এক মহাকর্তৃত্বশালী দানবীয় শক্তির কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে নিজেকে সুরক্ষিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস, তারই সৃষ্ট শক্তি ও চক্রান্তে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।। 

৫. জিয়াউর রহমানের বিরল সৌভাগ্য এজন্য যে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ও জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থায়

তার কালাে হাতের কলংক জনসাধারণের সামনে প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা কুক্ষিগত করে একচ্ছত্র, একনায়কত্ব ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানে পরিবর্তন আনেন ও পরিবর্তনসমূহ বলবৎ রাখেন; তাই তাকে অনন্ত অসীম বলদর্শী সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

Asdates, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি 

৬. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থে ১৯৭৫ সনের জানুয়ারীতে চতুর্থ সংশােধনীর

মধ্যেমে প্রসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটনাের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। বঙ্গবন্ধুর এই শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনকে গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবে প্রচার করলেও পরবর্তী শাসকগণ জিয়া-এরশাদ কেউই চতুর্থ সংশােধনীর এই প্রসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির পরিবর্তন করেননি। বরং তারা সামরিক ফরমানের শাণিত অস্ত্র দ্বারা উক্ত প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিকেই আরাে শক্ত, কঠিন ও দৃঢ় করেছেন। সংশােধিত সংবিধানের সঙ্গে নতুন নতুন অগণতান্ত্রিক অনুচ্ছেদ ও সামরিক ঘােষণা দ্বারা প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে এক দানবীয় শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। স্থাপন কবেছে নিজস্ব সাম্রাজ্য। রাজত্ব করেছেন জবাবদিহীহীন দাপটে। সংসদের কোন ক্ষমতা না থাকলেও হাস্যকরভাবে বলা

হতাে সার্বভৌম সংসদ 

৭. ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ধারা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন সংসদ সদস্যের দ্বারা। শাসনতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে তিনি রাষ্ট্র প্রধান। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সরকার প্রধান। ৪র্থ সংশােধনী এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র প্রধান হন। সংবিধানের সংশােধিত উক্ত ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

নির্বাহী ক্ষমতা

৮. সংবিধানের ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের সকল নির্বাহী কার্য প্রেসিডেন্টের নামে পরিচালিত হবে। প্রেসিডেন্ট আইনের দ্বারা তার কোন আদেশ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার দিকনির্দেশনা দেবেন এবং এই সমস্ত আদেশ যথাযথভাবে পালিত না হওয়ার কারনে কোন আদালতে মামলা করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট সরকারী কার্যাবলী বন্টণ ও পরিচালনার জন্য বিধিসমূহ প্রণয়ন করবেন। নির্বাহী বিভাগের যে কোন কর্মকর্তাকে প্রেসিডেন্ট তার ইচ্ছেমত নিয়ােগ ও বরখাস্ত করতে পারবেন।

জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা কতক্ষিত

৯. জাতীয় সংসদকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া গয়েছে। প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে প্রভাব খাটিয়ে আইন বিভাগকে তার ইচ্ছেমত আইন পাশের জন্য প্ররােচিত করতে পারেন। পরিণামে দেখা যায়, জাতীয় সংসদ জনগণের কল্যাণের জন্য প্রয়ােজনীয় আইন তৈরী না করে প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ আইন তৈরী করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট উপস্থিত হয়ে ভাষণ দিতে পারেন না। সংসদকে প্রভাব মুক্ত রাখার স্বার্থেই প্রেসিডেন্টকে এই ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশনে এবং প্রতি বছরের প্রথম অধিবেশনের বক্তব্য রাখতে বা বাণী প্রেরণ করতে পারেন।

১০. সংসদের সদস্যগণকে বাংলাদেশের জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে,

কিন্তু কার্যত এর কোনাে মূল্য নেই। সেই নির্বাচিত সংসদকে প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র একটি ঘােষণা দিয়ে সেই সংসদ স্থগিত বা বাতিল করে দিতে পারেন। সংবিধানের ধারা অনুযায়ী অর্থাৎ এই প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের সকল ক্ষমতা সংসদকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু মূল চাবিকাঠি প্রেসিডেন্টের হাতে। কারণ সংসদে পাসকৃত কোন বিল প্রেসিডেন্ট সম্মতিদানের পরই কেবল তা আইনে পরিণত হবে।  সুতরাং সংসদ বিল পাশ করতে পারে, কিন্তু তা আইন হবে তখন, যখন প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতি দেবেন। সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এবং সংসদকে প্রেসিডেন্টের হাতের কবজায় রাখা হয়েছে।

১১. প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে আইন প্রণয়নের একক ক্ষমতা। কারণ সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় বা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত সময়ে প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন। আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রয়েছে, তবে উক্ত পরিস্থিতি তিনি যেরূপ প্রয়ােজনীয় বলে মনে করেন, সেরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারবেন এবং জারি হবার সময় হতে অনুরূপভাবে প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।১১ সুতরাং বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইচ্ছেমত সংসদ ভেঙে দিয়ে তার মর্জিমাফিক আইন তৈরী করতে পারেন।

অধিকাংশ সময়ই সংসদ অধিবেশনে থাকেনি। ফলে প্রেসিডেন্ট অধিবেশন না  থাকাকালীন সময়ে তার ইচ্ছেমত আইন প্রণয়ন করতে পারেন।

প্রজাতন্ত্রের উচ্চপদে নিয়ােগদানের ক্ষমতা

১২. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতি, এটর্নি জেনারেল, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের সদস্যবৃন্দ, হিসাব পরীক্ষক ও


অডিটর জেনারেল, সরকারী কর্মকমিশনের সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ নিয়ােগ করেন। ১২ এ্যাটর্নি জেনারেল ও নির্বাচন কমিশনের সভাপতিসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দকে প্রেসিডেন্ট যে কোন সময় নিয়োেগ করতে পারেন এবং বরখাস্ত করতে পারেন। সুতরাং এ সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ তাদের পেশাহত দায়িত্বে সৎ ও নিরপেক্ষ হতে পারেন না। বরং প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশী মত তাদের কার্যপরিচালনা করতে হয়। সেজন্য জিয়া-এরশাদের আমলে কোন নির্বাচনই নিরপেক্ষ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। 

১৩. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে তার কার্যাবলী পরিচলনায় পরামর্শদানের উদ্দেশ্যে একজন প্রধানমন্ত্রী, একাধিক উপপ্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী সমন্বয়ে একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে। ১৩ তারা সংসদের নিকট জবাবদিহী করতে বাধ্য নন, তারা । প্রেসিডেন্টের নিকট জবাবদিহী করেন। দেশে মন্ত্রী পরিষদ একটি গুরুত্বহীন। পরিষদে পরিণত হয়েছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলেই আজ যাকে মন্ত্রী নিয়ােগ করেছেন, কাল তাকে বিদায় দিতে পারেন।

জরুরী অবস্থা জারী করার ক্ষমতা 

১৪. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে জরুরী অবস্থা জারীর এমন একটি বাড়তি ক্ষমতা দিয়েছে যার নজীর বিরল। তিনটি কারনে প্রেসিডেন্ট জরুরী অবস্থা জারি। করতে পারেন, (১) যুদ্ধ (২) বহিঃশত্রুর আক্রমণ (৩) আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা। লক্ষ্যণীয়, যুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ কিংবা আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা কেনাে কিছুরই দরকার নেই। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে প্রেসিডেন্ট মনে করলেই জরুরী এ অবস্থা জারি করতে পারেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হচ্ছে জরুরী অবস্থা জারিকালীন সময়ে নাগরিকদের চলাফেরা স্বাধীনতা, সমাবেশ করায় স্বাধীনতা, সভা সমাবেশ করার স্বাধীনতা, চিন্তা চেতনা ও কথা বলার স্বাধীনতা এই মৌলিক অধিকারগুলাে স্থগিত থাকবে। শুধু তাই নয়, এই জরুরী অবস্থা। চলাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট যে কোন মৌলিক অধিকার বলবত্তারনের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করার অধিকার স্থগিত রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। স্থগিত হয়ে যায় দেশবাসীর মৌলিক অধিকার। আটক করা হয় সেইসব ব্যক্তিদের, যারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রসৈনিক, গ্রেফতার আর । পুলিশী নির্যাতন ও নিদারুণ তান্ডবলীলা চলে স্বৈরাচারকে রক্ষা করার বেপরােয়া। রক্ত লােলুপতা। ” সরকারী অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত ক্ষমতা

১৫. সংবিধানের ধারা অনুযায়ী, ‘সরকারী অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত রয়েছে, এমন

কোন অর্থবিল বা বিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ছাড়া সংসদে উথাপন করা যাবে না।এছাড়া সংসদ যদি কোন মঞ্জুরী দাবি নামঞ্জুর বা হ্রাস করে, তবে সংশ্লিষ্ট বছরের আর্থিক বিবৃতিেিত উল্লেখিত ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রপতি একশত বিশ দিনের মেয়াদ পর্যন্ত সংযুক্ত তহবিল থেকে অর্থ প্রত্যাহারের কর্তৃত্ব প্রদান করতে পাবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচের কর্তৃত্বও প্রেসিডেন্টের হাতে কুক্ষিগত।

প্রেসিডেন্টের অপসারণ

১৬. বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে তার মেয়াদকাল পূর্ণ করার আগে সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরনের অভিযােগে অপসারণ করা যায়। এই অপসারণের জন্য। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের অভিযােগ আনতে হয়, এই অভিযােগ যদি তিন-চতুর্থাংশ সংসদ সদস্যের ভােটে পাশ হয় তবেই একজন প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা যায়। সুতরাং এই জটিল পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করা অসম্ভব। তাছাড়া প্রেসিডেন্টের হাতে সংসদ বাতিল করা ক্ষমতা থাকায় তার বিরুদ্ধে সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য অভিযােগ আনলেই সংসদ বাতিল করে তিনি তার অপসারণকে ঠেকিয়ে দিতে পারেন।

পাকিস্তানীদের সম্পত্তি ফেরৎ দেবার জন্য সংবিধান সংশােধন

১৭. সামরিক ফরমানে বাংলাদেশ সংবিধানে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে তা জাতীয় স্বার্থকে সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করার স্বৈরাচারী নজির।  ৪৭ নং অনুচ্ছেদে কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলক গ্রহণ, রাষ্ট্রায়াত্তকরণ বা দখল কিংবা সাময়িকভাবে বা স্থায়ীভাবে কোন সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্যক বা অন্যবিধ উদ্যোগসন্ন একাধিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক সংযুক্তকরণ, অনুরূপ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ব্যবস্থাপক, এজেন্ট ও কর্মচারীদের অধিকার সম্পর্কিত, খনিজদ্রব্য বা খনিজ তৈল অনুসন্ধান বা লাভের অধিকার সম্পর্কিত ইত্যাকার অধিকার বিলােপ, পরিবর্তন, সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণকরণের যে বিধানসংবিধানে ছিলাে এ সম্পর্কে সংবিধানের শর্তে তবে সংসদের সেইরূপ আইনের জন্য আনীত কোন বিলে যদি এমন বিধান থাকে কিংবা তাহার এমন কার্যকারিতা থাকে, যাহার ফলে কোন সম্পত্তি হইতে রাষ্ট্র বঞ্চিত হন, কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক দেয় যেখানে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়, তাহা হইলে অনুরূপ বিল সংসদের মােট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশ ভােটে গৃহীত না হইলে সম্পতির জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবেনা।এই শর্তযুক্ত কথাগুলি জিয়াউর রহমান বিলুপ্ত করেন এজন্য যে, ৪৭নং অনুচ্ছেদের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে যে পাকিস্তানী কলকারখানা রাষ্ট্রায়াত্ত করার যে বিধান বলবৎ ছিলাে সে বিধান থাকলে পাকিস্তানী শিল্পপতিদের এসব শিল্পকারখানা ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ফেরৎ দেয়া যাবে না। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ‘-এর আওতায় পাকিস্তানী নাগরিকদের শিল্প প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে দেবার জন্য একটি চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তির শর্তানুসারে জিয়াউর রহমান (১) ন্যাশনাল আয়রণ এন্ড স্টীল ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ (কালুরঘাট), (২) জেনারেল কোং লিঃ (চট্টগ্রাম), (৪) আল মােস্তফা ইন্ডাষ্ট্রিজ লিঃ (চট্টগ্রাম), (৫) আহমদিয়া ওয়েল মিলস লিঃ (চট্টগ্রাম), (৬) বাংলাদেশ টায়ার্স (ঢাকা), (৭) বেঙ্গল গ্লাস ওয়ার্কস লিঃ (ঢাকা), (৮) স্টীল ওয়ার্কস লিঃ (ঢাকা) (৯) রহমান মেটাল ইন্ডাষ্ট্রিজ (ঢাকা), (১০) বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজেস লিঃ (ঢাকা), (১১) ইষ্ট বেঙ্গল ট্রেডিং এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিয়াল করপােরেশন (চট্টগ্রাম), এই প্রতিষ্ঠানগুলি পাকিস্তানী শিল্পপতিদের ফিরিয়ে দেন। এই ১১টি শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৬০ কোটি টাকা মূলধন নিয়ােজিত হয়েছিলাে। 

সামরিক প্রধান নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে

 ১৮, সংবিধানের অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং লাভজনক পদে বহাল থেকে

রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করা যাবে নামেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, প্রধান সেনাপতি, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যেই ব্যক্তিস্বার্থে সংবিধানে পরিবর্তন করে বলা হলাে, আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযােগ্য একটি ঘােষণা করিতেছে না, এমন পদ ব্যতীত তিনি প্রজাতন্ত্রে কর্মে কোন লাভ জনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন তাহলেও তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। জিয়াউর রহমান শুধু নিজের জন্য তার নিয়ােগকৃত মন্ত্রী পরিষদের বেলায়ও একই সাথে এই আইনের প্রযােজ্যতার কথা বলে সংবিধানে২৭ ধারা যুক্ত করে। সেখানে বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি কেবলমাত্র প্রধান মন্ত্রী, উপ-প্রধান মন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন ।ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ব্যক্তি স্বার্থে সংবিধান কে ব্যবহার, সংবিধান কর্তন PY করার এমন নজির সম্ভবতঃ পৃথিবীতে আর নেই। তার

বিদেশের সঙ্গে গােপন চুক্তি

১৯. আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সনের ২য় সামরিক ঘােষণাপত্র দ্বারা সংবিধানে২৮ সংযােজন করলেন যেক্ষেত্রে দেশের প্রকৃত ক্ষমতার উৎস জনগণকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছেজনগণের কর্তৃত্বকে খর্ব করা হয়েছে। বিদেশের সঙ্গে যে কোন চুক্তি যা দেশের স্বার্থ হানি ঘটিয়েছে বলে কোন ব্যক্তির নিকট প্রতীয়মান হলে তিনি ইতিপূর্বে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করার অধিকারী ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমলে সীমান্ত চুক্তির অন্তর্ভূক্ত তিনবিঘা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হয়েছিলােএবং হাইকোর্ট এর যথাযথ রায় ও পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছিলেন। এমনকি ভারতের সঙ্গে ২৫ বছর চুক্তিও ছিলাে প্রকাশ্য চুক্তি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দলিল দস্তাবেজে দেশে বিদেশে যা প্রকাশিত হয়েছে। এই ২৫ বছর চুক্তির বৈধতা বা দেশ জাতির স্বার্থহানি ঘটে থাকলে যে কোন ব্যক্তি তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতের স্মরণাপন্ন হতে পারেন, পারতেন। কিন্তু জেনারেল জিয়া সামরিক ফরমান জারী করে সংবিধানে ১৪৫(ক)নং ধারা সংযােজনপূর্বক বিদেশের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জনগণকে অবহিত করার বিষয়ে বা চুক্তি বা চুক্তির মর্মকথা সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রাখার পথ বেছে নিলেন। সংবিধানে সংযােজিত অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ কোন চুক্তি এইরূপে পেশ করা হইবে না যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন যে, এইরূপ করা জাতীয় স্বার্থ বিরােধী হইবে।জাতীয় সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত এবং এই সংসদের মাধ্যমে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। সেই জাতীয় সংসদে কোন চুক্তি

উথাপন বিষয়ে জাতীয় স্বার্থ বিরােধী হবে কেন তা বােধগম্য নয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জনগণকে বা জন প্রতিনিধিদের বা জাতীয় সংসদকে কোন সময়ই ১ আস্থায় নেননি, সেজন্যই আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে এই শর্তারােপ করা হয়েছে।

হত্যা-খুনের অব্যাহতি

২০. সামরিক ফরমানের সকল অগণতান্ত্রিক আইনের শাসন পরিপন্থী ধারাসমূহকে ক. সংবিধানের চতুর্থ তফশিলের ও অস্থায়ী বিধানাবলী২৯ প্রটেকশন দেয়া হয়েছে। “বিধানে ধারাসমূহ৩০ যুক্ত করে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট হতে ১৯৭৯ সনের ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত সকল অগণতান্ত্রিক আদেশ, সামরিক ফরমান, বিধি-বিধান সব

কিছুকেই আইনের এক্তিয়ার বহির্ভূত করা হয়। এর সঙ্গে সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজী পাঠের মধ্যে কোন বিরােধ, বৈপরীত্য অথবা অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে ইংরাজী পাঠ প্রধান্য পাইবে”-যুক্ত হয়। অথচ ইতিপূর্বে এ ক্ষেত্রে ছিলাে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। ২১. ৫ম সংশােধনীর মাধ্যমে অন্যায় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, হত্যা কু ষড়যন্ত্র চক্রান্তের রাজনীতি, বেআইনী ও অসংবিধানিক কার্যক্রমকে বৈধতা দানের উদ্দেশ্যে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ট জাতীয় সংসদ সদস্য প্রয়ােজন। সেজন্য

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পেশীশক্তি কালাে টাকা, ভােট কারচুপি ও ভােট জালিয়াতির নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু হয়। জিয়াউর রহমান কোন প্রকার নিয়মনীতির তােয়াক্কা না করে, আদর্শকে ছুঁড়ে ফেলে, স্বীয় দুষ্কর্য ও অপকর্মকে ঢাকা দেবার জন্য দেশে ১০টি হুন্ডা, ২০ জন গুন্ডা, সব ঠান্ডাএই ধারার রাজনীতি প্রচলন করেন। রাজনীতিতে আত্মত্যাগ, আদর্শবাদ এসব যেন কথার কথা হয়ে দাড়ায়। রাজনীতিকে আদর্শহীন কালাে টাকার মালিকদের নিকট ইজারা দেয়া হয়।  জিয়াউর রহমানের আমল হতেই রাষ্ট্রীয়ভাবে ভােট কারচুপির বিশেষ ব্যবস্থা গৃহীত। ৭৩ সনের নির্বাচনে খন্দকার মােশতাক ভােট জালিয়াতি করে জয়লাভ করেছিলাে ব্যক্তিক পর্যায়ে। জিয়াউর রহমানের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্লু প্রিন্ট অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে ভােট কারচুপির ব্যবস্থা গৃহীত হয় । জিয়াউর রহমান ভােটে জয়লাভের জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, গােয়েন্দাবাহিনী, সশস্ত্রবাহিনীসহ সকল শৃঙ্খলাবাহিনী বেসরকারী প্রশাসনকে কাজে লাগানাে হয় এবং নির্বাচন কমিশনকেও প্রভাবান্বিত করেন। 

২২. নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন পরিষদ, অর্থ বরাদ্দ, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নিয়ােগ, বদলি, অপসারণ, সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান হিসেবে পুরাে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বক্ষেত্রে জেনারেল জিয়া সর্বময় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তার নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন। একচ্ছত্র সম্রাটের মতাে জিয়াউর রহমান তার রাজত্বকালে প্রমাণ করেছেন আই অ্যাম দি স্টেট।


২৬৫