এ্যাড আনসারের বাহিনী তালার মাটি কাঁপিয়েছে চালিয়েছে অসংখ্য হত্যাকাণ্ড
ফখরে আলম ॥ পাকি বাহিনীর দোসর এ্যাডভােকেট আনসার সাতক্ষীরার তালা থানা এলাকায় ১৯৭১ সালে রাজাকার পয়দা করে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যার পাশাপাশি নিরীহ অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে। আনসারের রাজাকার ক্যাডার বাহিনীর কমান্ডার ইয়াকুব, ওমর আলী, লােকমান গণহত্যায় অংশ নিয়ে পুরাে তালা এলাকার মাটি কাঁপিয়েছে। এই গংয়ের নৃশংসতার সাক্ষী হয়ে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার এরফান আলী ও তার মামা মুক্তিযােদ্ধা মইজউদ্দিন। তালা থানা এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান ছিল আনসার আলী। আনসার তালায় রাজাকার সৃষ্টি করে। ডেথ সাটিফিকেট ইস্যু করে রাজাকারদের নিরপরাধ মানুষের ওপর লেলিয়ে দেয়। হাতবাস গ্রামের ওমর আলী, চরগ্রামের লােকমান ও মােয়াকাঠি। গ্রামের ইয়াকুব- এই তিন নরপশু রাজাকার কমান্ডার ছিল আনসারের মূল সেনাপতি। সরেজমিন তালা এলাকা ঘুরে জানা গেছে, পাটকেলঘাটা ডাকবাংলাে ছিল রাজাকার ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাসহ অসংখ্য মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়ে রাজাকাররা। গুলি করে হত্যা করে কপােতাক্ষ নদে লাশ ফেলে দিয়েছে। এলাকার সুন্দরী গৃহবধূ, তরুণীদের এই ক্যাম্পে আটকে রেখে নরপশুরা পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে। বেশ। কয়েকজন বীর মুক্তিযােদ্ধাকে এই গং হত্যা করে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে মুখে ঢুকিয়ে। নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এমন বর্বর, অশ্লীল অনেক কাহিনী উল্লেখ করে রাজাকারদের প্রতি থু থু ছুড়েছে অনেকেই। এরাই যশােরের কেশবপুরে বগা গ্রামের হাইস্কুল শিক্ষক মােজাম্মেল হােসেনকে নির্মমভাবে হত্যা করে কপােতাক্ষ নদে ফেলে দেয়।
হত্যা করার আগে তার ওপর চালানাে হয় নির্মম নির্যাতন। জানা গেছে, রাজাকার কমান্ডার ইয়াকুব এলাকার সকলের। শ্রদ্ধার পাত্র এই শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে। ইয়াকুবের নৃশংসতার সাক্ষী কমিরা ইউনিয়ন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার এরফান আলী আর তার মামা মইজউদ্দিন। এরফানের জবানিতে একাত্তরের সেই গা শিউরে ওঠার মতাে সত্য পাঠ এমন; হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় তালার কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের। নির্দেশ পেয়ে আমি সেকশন কমান্ডার হিসাবে ৪০ জনের মুক্তিযােদ্ধা দল নিয়ে হাকিমপুর থেকে মার্চ করি। ২৩ নবেম্বর আমরা কপােতাক্ষ নদ পার হয়ে নওয়াকাটি গ্রামে এসে বিছিন্নভাবে ১৭ জন আশ্রয় নেই। ২৪ নবেম্বর সকাল ১০টার দিকে ইয়াকুবের নেতৃত্বে ২শ’ রাজাকার পুবের গ্রাম ঘিরে ফেলে। রাজাকাররা। মইজউদ্দিন, ঝড় সরদার, মােহর আলী, ওমর আলী, সরফুদ্দিনসহ গ্রামের অনেকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আমি আর মইজউদ্দিন মামা চেয়ারম্যান জবেদ মােড়লের বাড়ির পাশে ধানক্ষেতে আশ্রয় নেই। চেয়ারম্যানের বড় ছেলে মহিউদ্দিন ইয়াকুব রাজাকারকে খবর দিয়ে আমাদের ধরিয়ে দেয়। রাজাকাররা আমাদের পাটকেলঘাটা ক্যাম্পে নিয়ে। অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ২৫ নবেম্বর দু’জনকে অজ্ঞান অবস্থায় সাতক্ষীরা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতনের পর আমাদের গাড়িতে করে মাহমুদপুর খাল। পাড়ে নিয়ে যায় হত্যার জন্য। এ সময় পাকি বাহিনীর জওয়ানরা আমাদের দেখতে চায়। পাকি সেনারাও নির্যাতন চালায়।
দুপুরে এক পাকি মেজর আমার সঙ্গে কথা বলে। ইংরেজীতে তাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। আমি মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীর স্বপ্ন স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে ঐ মেজর রাজাকারদের নির্দেশ দেয় গুলি না। করার জন্য। এরপর আমাদের সাতক্ষীরার ডায়মন্ড হােটেলের একটি কক্ষে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত হলে আমরা মুক্তিলাভ করি।” দীর্ঘ নির্যাতনের ফলে এরফান ও মইজউদ্দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাভাবিকভাবে এ দু’ মুক্তিযােদ্ধা চলাচল করতে পারেন না। সে সময়ের বিএ’র ছাত্র এরফান এখন তালা ইউনিয়ন পরিষদে সচিবের চাকরি করেন। রাজাকারদের নির্যাতনের কারণে তার আর লেখাপড়া হয়নি । মইজউদ্দিনও একই কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি। রাজাকারের নৃশংসতার শিকার হয়ে এই দু’ মুক্তিযােদ্ধা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার কমান্ডার ওমর আলী ও লােকমানকে গুলি করে। হত্যা করে। রাজাকার কমান্ডার ইয়াকুব গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। কয়েক বছর পরে। গ্রামে ফিরে আসে। এখন সে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আর এ্যাডভােকেট আনসার ঢাকায় আত্মগােপন করে থাকার পর ১৯৭৫ সালে বাড়ি ফেরে। ফের জামায়াতের রাজনীতি শুরু করে। ১৯৯১ সালে এমপি নির্বাচিত হয় জামায়াতের টিকিটে।
জনকণ্ঠ ॥ ২১-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন