You dont have javascript enabled! Please enable it! রংপুরের ঘাতক একরামুল এখন বিএনপি নেতা পুলিশের দালাল ॥ ভয়ে কেউ মুখ খােলে না - সংগ্রামের নোটবুক

রংপুর

রংপুরের ঘাতক একরামুল এখন বিএনপি নেতা পুলিশের দালাল ॥ ভয়ে কেউ মুখ খােলে না

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তরের ঘাতক বহু হত্যা, খুন, ধর্ষণ, নারী পাচারকারী ও লুটপাটের হােতা এবং রাজাকারের রংপুর ডিস্ট্রিক্ট কমান্ডার একরামুল চেয়ারম্যান এখন রংপুর জেলা বিএনপি ও চারদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। সে পুলিশের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারী দালাল ও গ্রামের মাতবর হিসাবেও পরিচিত। ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর এলাকায় এসে আবারও সে নিজ মূর্তি ধারণ করে। তার অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ‘৭৫-এর পর মাত্র ক’বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত দু’শতাধিক পরিবার গ্রাম ছেড়েছে। এলাকাবাসী জানান, একরামুলের চোখ রাঙানি আর হুঙ্কারে ভীত হয়ে পর পর তিনবার তারা তাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। সকলেই তাকে চেনে ‘রাজাকার একরা’ বলে। কেউই মুখ ফুটে কিছু বলতে সাহস পায় না। তার নিজের দাঙ্গা বাহিনী ততা রয়েছেই, দ্বিতীয়ত রয়েছে পুলিশী অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়। একরামুল হক রংপুর জেলা বিএনপির সহসাংগঠনিক ও রংপুর সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং সদর থানা চারদলীয় সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করছে। অভিযােগে প্রকাশ, অতি সম্প্রতি সে তার এলাকার ২৮টি দরিদ্র পরিবারকে রেড ক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে ঘর বানিয়ে দেয়ার কথা বলে ২০ জনের কাছ থেকে ৫ হাজার করে এক লাখ। টাকা নিয়ে আত্মসাত করেছে। ‘৭১-এ রংপুর ছিল রাজাকার-আলশামসদের ঘাঁটি। আর এসব রাজাকারের নেতৃত্ব দিত এই একরামুল। যার পুরাে নাম একরামুল হক। পিতা মাওলানা সাঈদুর রহমানও ছিল একই প্রকৃতির।

সে সময় থেকে আজও তিনি জামায়াতের রুকন। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা এই পিতা-পুত্রকে অভিহিত করেন একই গােয়ালের গরু’ বলে। তাদের আদি নিবাস গঙ্গাচড়ার গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক গ্রামে। ‘৬৭/৬৮ সালে একরামুল বুড়িরহাট হাইস্কুলের শিক্ষক সারওয়ার-ই জাহানের বাসায় লজিং থেকে পড়াশােনা করত। সেখানে থাকাকালেই সে সদর থানার পশুরাম ইউনিয়নের খটখটিয়া দোলাপাড়া এলাকার জনৈক অবস্থাপন্ন ব্যক্তির সম্পত্তিপ্রাপ্তির লােভে জোবেদা খাতুন নামের তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে। পরে এই স্ত্রীর সাথে এসব ব্যাপারে বিরােধ সৃষ্টি হলে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটে সে আরেকটি বিয়ে করে। সেই স্ত্রী ফেন্সি বেগমের সাথেই পশুরাম ইউনিয়নের আমাশু গ্রামে এখন তার বসবাস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার বেশ কয়েক প্রবীণ জানান, সেখানে থেকেই একরামুল শুরু করে পাক হানাদার বাহিনীর পা-চাটা থেকে হত্যা, খুন, ধর্ষণের কর্মকাণ্ড। গ্রামে থেকেও তার দুর্ধর্ষতায় খুব অল্প সময়ে সে বনে যায় রাজাকারের রংপুর ডিস্ট্রিক্ট কমান্ডার। পরবর্তীতে তার দ্বারাই পরিচালিত হয় রংপুরের রাজাকারের সকল কু-কর্মকাণ্ড। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে থেকে পাক হানাদার ও রাজাকারদের অবস্থান এবং খবরাখবর। সংগ্রহকারী একজন জানান, একরামুলের অপারেশন এলাকা ছিল গঙ্গাচড়ার কয়েকটি এলাকা, সদর থানার বুড়িরহাট, চব্বিশ হাজারী, আমাশু, কুকরুল খটখটিয়া, পীরগাছার।

বড়দরগা, চান্দানাভাজ, ঠুটাপাইকার, কালিগঞ্জ অন্নদানগর ইত্যাদি এলাকা। শেষের। দিকে সে গঙ্গাচড়ার কোলকোন্দ এলাকায়ও চালায় অত্যাচার-নির্যাতন। মূলত সে তার কার্যক্রম শুরু করে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে। এসব এলাকায় সে ও তার বাহিনী। অন্তত পঞ্চাশের বেশি বাঙালীকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। চার ব্যক্তিকে পুড়িয়ে মারে। জ্বলন্ত ইটের ভাটিতে। সে সব কথা মনে হলে এখনও এলাকার মানুষের চোখের পাতা নড়ে না। তার বাহিনী সদর থানার আটিয়াটারী গ্রামের রজনী রায়ের ছেলে ক্ষিতীষ চন্দ্র। রায়কে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ফকিরগঞ্জ এলাকার নগরজিত রায়ের ছেলে হরমােহন রায়কে গুলি করে মারে। একই ভাবে গঙ্গাচড়া থানার পাশে গুলি। করে মারে এক মুজিব সেনাকে । এসব পরিবারের কেউই এখন এলাকায় নেই । জানা। যায়, এসব এলাকার অন্তত দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার তার অত্যাচারে ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। খটখটিয়া এলাকার মুক্তিযােদ্ধা আনছার আলী জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে মুজিব বাহিনীর ডিস্ট্রিক্ট লিডার মুকুল মােস্তাফিজের নির্দেশে তিনি এবং অপর মুক্তিযােদ্ধা মঞ্জুরুল যান ডিমলার মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বাসায় তাকে এবং একরামুলকে হত্যা করতে। সেখানে তারা দেখতে পান একরামুলসহ বেশ কিছু লােক শলাপরামর্শ করছে। যাদু মিয়া তাদের জোর করে ভাত খেতে দেয়। তারা খাওয়া শুরু করলে তাদের ধরাবার জন্য পাক হানাদারদের খবর দিয়ে আনে। পরে। সেখানে তারা গােলাগুলি করে বেরিয়ে আসেন।

এর পর দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁরা। যখন তাদের নিজ এলাকা খটখটিয়া হাইস্কুলে আসেন তখন দেখতে পান যাদু মিয়া, জাহাজ কোম্পানির মালিক রেজা আহম্মেদ, তার ছেলে ইরতেজা আহম্মেদসহ আরও অনেককে। তখন যাদু মিয়া ভালবাসা দেখিয়ে তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, এতদিন কোথায় ছিলি বাবা? তখন আনসার আলী উত্তেজিত হলে যাদু মিয়া এক পর্যায়ে তাদের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে এবং তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়। যে কারণে আনসার তাদের ক্ষমা করে দেন। আনসার আলী জানান, যাদু মিয়া ও একরামুলসহ অন্যদের গুলি করে হত্যা না করে জীবনে মহা ভুল করেছি। মুক্তিযােদ্ধা জুলহাস উদ্দিন জানান, রংপুর টাউন হলকে পাক সেনারা যে বালাখানা বানিয়েছিল সেখানে মেয়ে সরবরাহ করত একরামুলসহ অন্যরা। পশুরাম ইউনিয়নের বাবলু মণ্ডল, জাহিদুল। ইসলাম জানান, একরামুল সে সময় মানুষজন ধরে নিয়ে ইটভাটিতে পুড়িয়ে মারত। সে এলাকার জ্যোতিষ বাবু নামে এক ব্যক্তির লাইসেন্স করা একটি বন্দুক তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিয়ে নেয় এবং সেটিরই লাইসেন্স করে এখন তার বাসায় রেখে দিয়েছে। মুজিব বাহিনীর গ্রেটার রংপুর ডিস্ট্রিক্ট লিডার মুকুল মােস্তাফিজ জানান, কুখ্যাত একরামুলের কর্মকাণ্ড কারওই অজানা নয়। তাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বহুবার আটকের চেষ্টা করেছি।

কিন্তু আওয়ামী লীগেরই কিছু নেতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে তারাই তাকে আবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর পর ১৬ ডিসেম্বর রংপুর মুক্ত হলে মুক্তিযােদ্ধাদের চাপে একরামুল তার পিতা, সহযােগী আঃ মজিদ ভুট্টো, আবুল কাশেম মাস্টার, আলতাফ, পাগলা কাশেম, ফল ব্যবসায়ী সুলতান, নুরুল ইসলাম- সবাই গা-ঢাকা দেয়। এর পর আর কারও টিকিটির নাগাল পাওয়া যায়নি কোথাও। ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর একরামুলসহ সকলেই আবার বেরিয়ে আসে এবং একরামুল বিএনপিতে যােগ দেয়। সে তার দাপটে পরাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতায় এলে দল বদলের পালায়’ একরামুল জাতীয় পার্টিতে যােগ দেয়। পরে ‘৯০-এ এরশাদের পতনের পর আবার বিএনপিতে যােগ দেয় এবং আবারও ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। ‘৯৬এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আবারও দল বদলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু লােকজন তার চরিত্র জেনে ফেলায় সে সুযােগ আর পায়নি। কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার একরামুল শুধু যে ‘৭১ সালেই হত্যা, খুন, নির্যাতন। চালিয়েছে তা নয়। এখনও প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে এলাকার মানুষজনের ওপর ভয়ভীতি, নির্যাতন, নিপীড়ন চালাচ্ছে। ইউনিয়নে এখনও তার রয়েছে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। এলাকায় খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি যা কিছুই হােক, শুধু তার কাছে এসে নতজানু হয়ে বলতে হবে- চেয়ারম্যান সাহেব বাচান। চেয়ারম্যান তখন ডিমান্ড দেবে এত টাকা লাগবে। এর মধ্যে থানা-পুলিশ, আদালত, প্রতিপক্ষ সব কিছুই সে দেখে।

জনকণ্ঠ। ২০-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন