You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরার সব হত্যা ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের নেতৃত্বদানকারী বাকী এখন জনদরদী

মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা থেকে সাতক্ষীরার কুখ্যাত রাজাকার, সব হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের নেতৃত্বদানকারী রাজাকার বাহিনীর কর্নেল হিসাবে চিহ্নিত আব্দুল্লাহেল বাকী এখন জনদরদী। সাতক্ষীরার আলিপুর হাটখােলায় তার অনেক ব্যবসা। প্রতিষ্ঠান। সাতক্ষীরার টর্চার সেলে নির্যাতনের মাধ্যমে ৮ জন মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করেও সে বহাল তবিয়তে কয়েকবার ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জনপ্রতিনিধি হিসাবে এলাকায় কর্তৃত্ব করেছে। তার বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে ফুটে ওঠে পাকি বাহিনীর সহযােগী একাত্তরের এই রক্তপিপাসু নরঘাতকের চরিত্র। সাতক্ষীরার আলিপুর ইউনিয়নের বুলারাটি গ্রামের আব্দুল্লাহেল বাকী সাতক্ষীরার স্টার হােটেলে ৮ জন মুক্তিযােদ্ধাকে পিটিয়ে ও ঝুলিয়ে হত্যা করে। এই রাজাকারের নেতৃত্বে। এক বিধবা মায়ের মেধাবী ছাত্র আনছার আলীকে টর্চার সেলে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এই বাহিনীর হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া নৌকমান্ডাে ইমাম বারী স্মৃতিচারণে এই বর্বর রাজাকার বাকীর বর্বরতার কথা বলেন। ৭১-এর ১৭ আগস্ট সাতক্ষীরার বুধহাটা খেয়াঘাটে রাজাকার কমান্ডারের হাতে ধরা পড়ে ইমাম বারীসহ ৬ জন নৌকমান্ডাে।

১৮ আগস্ট ভাের ৬টায় কাটিয়ার সিরাজকে চোখ-হাত-পা বেঁধে বাকীর নেতৃত্বে বুধহাটার ইছাহাক রাজাকার কমান্ডারের সহযােগিতায় প্রায় ৫শ’ লােকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি ৫ জন নৌকমান্ডােকে ধরে আনা হয়। সাতক্ষীরার টর্চার সেল স্টার হােটেলে। ৫ জন নৌকমান্ডাের ১জন সহযােগী মহসীন পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে ১৮ আগস্ট রাতে সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা। হয় ১৭ জন মুক্তিকামী যুবককে। এদের ঝুলিয়ে রেখে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে ৭ জন মারা যায়। পরে পাকি বাহিনীর সহযােগিতায় ওয়াপদার হলুদ গাড়িতে করে এই ১৭ জনকে বিনেরপােতা ব্রিজে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা এই রাজাকার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি ভুলতে পারেনি। বাকীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে রাজাকার, আলবদর বাহিনী। শান্তি কমিটিও পাকিদের সহযােগিতায় মাঠে নামে। সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকাসহ গােটা পশ্চিমাঞ্চল ও সাতক্ষীরা শহরে এরা হত্যা করে হাজার হাজার নিরীহ মুক্তিকামী নারী-পুরুষকে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে এই রাজাকার প্রধান মুসলিম লীগ করার সুবাদে সরাসরি পাকি জেনারেলদের সাথে সখ্য গড়ে তােলে। হাতে ছড়ি ঘুরিয়ে পাকি বাহিনীর তােষামােদ করে সাতক্ষীরায় গড়ে তােলা হয় সশস্ত্র শান্তি বাহিনী ও আলবদর বাহিনী। শান্তি বাহিনীপ্রধান নির্বাচিত হয় জামায়াতের বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী শামসুর রহমান। বিভিন্ন বাহিনী ও কমিটির সমন্বয়ে গঠিত রাজাকারদের হেডকোয়ার্টার ছিল শহরের পিএন হাইস্কুল। এছাড়া শহরের পিটিআই স্কুল, সরকারী বালক বিদ্যালয়,মাহমুদপুর বিদ্যালয় ছিল রাজাকার ও পাকিদের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের স্থান। এই স্থানগুলােতে প্রতিদিন বহু মুক্তিযােদ্ধা, বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ বাঙালি নারী-পুরুষদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করেছে রাজাকার বাহিনী। স্বাধীনতালাভের পর এসকল স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এদিকে রাজাকার বাহিনীপ্রধানের অন্যতম সহযােগী ছিল বুধহাটার ইছাহাক কমান্ডার। ইছাহাক কমান্ডারের অধীনে ছিল প্রায় ২৪শ’ রাজাকার। এদের নেতৃত্বে প্রতিদিন শহরের দীনেশ কর্মকারের বাড়ি, বাকাল এলাকাসহ মাহমুদপুর স্কুলে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতাে নারী-পুরুষ, শিশুদের। এই বাকী ১৮ আগস্ট ১৭ জন মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যার জন্য পাকি জেনারেলদের হাতে তুলে দেয়। এই রাজাকার প্রধানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রাজাকার কমান্ডারসহ গ্রুপ কমান্ডার। সাতক্ষীরার বুধহাটার ইছাহাক রাজাকার, শহরের ডাঃ মল্লিক, পলাশপােলের রােকোনুজ্জামান খান, জনাব আলী, বৈকারীর জহিরুল ওরফে টেক্কা এরা সকলেই ছিল একেকজন রাজাকারপ্রধান।

এদের অনেকেই এখন জামায়াত নেতা। এছাড়া গােলাম কবীরসহ মাওলানা খালেকের ভূমিকা ছিল রাজাকার কমান্ডারদের ওপরে। রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি গড়ে ওঠে জল্লাদ বাহিনী। জল্লাদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে পুরনাে সাতক্ষীরার খোড়া রশিদ। এদিকে সাতক্ষীরার পশ্চিম সীমান্তের ভােমরা থেকে কলারােয়ার তলুইগাছা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ সহ লুণ্ঠনের নেতৃত্বদানকারী হিসাবে চিহ্নিত জামায়াত নেতা মওলানা খালেকের পরিচালনায় চলত পাকি বাহিনী। মেজর সামস, মেজর ফিরােজ, মেজর জিনজিয়ার খান এদেরকে নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাঙালীদের ওপর নির্যাতন চালানাে হতাে। সাতক্ষীরা শহর হানাদার মুক্তহবার পর নরখাদক রক্তপিপাসু আব্দুল্লাহেল বাকীসহ অন্যরা গণরােষের ভয়ে আত্মগােপন করলেও পরবর্তীতে সাধারণ ক্ষমার পর চলে আসে প্রকাশ্যে । বুধহাটার ইছাহাক কমান্ডার সিরাজ হত্যার অভিযােগে সাজা ভােগ করে সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পায়। এসকল রাজাকার কমান্ডার এখন জনদরদী হিসাবে সমাজে বাস করছে।

জনকণ্ঠ ॥ ০৪-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!