You dont have javascript enabled! Please enable it!

রেল ইঞ্জিনের বয়লারে মানুষ পুড়িয়ে মারতে সিদ্ধহস্ত দেওয়ানগঞ্জের মােনায়েম এখন কোটিপতি

আনােয়ার হােসেন মিন্টু, ইসলামপুর থেকে ॥ দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনের লােকো। শেডে কয়লার ইঞ্জিনের অগ্নিকুণ্ডে পুড়িয়ে মানুষ মারার হােতা, একাত্তরের রাজাকার কমান্ডার মােনায়েম এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের কোটিপতি ব্যবসায়ী। একাত্তরে দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জে বহু খুন, ধর্ষণ ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে সে ছিল প্রধান ব্যক্তি। স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও দেওয়ানগঞ্জবাসী যেমন তাদের মন থেকে মুছতে পারেনি ‘৭১-এর দুঃসহ দিনগুলাের কথা, তেমনই ভুলতে পারেনি এ ভয়ঙ্কর জল্লাদ মােনায়েম বাহিনীর নৃশংসতার কাহিনী। এদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ‘৭১ সালে পাকি বর্বর বাহিনী পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে বুয়েটের ছাত্র দেওয়ানগঞ্জে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী একে আনােয়ারুল আজিম, জামালপুর আশেক মাহমুদ সরকারী কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা তারা মিয়া, দেওয়ানগঞ্জ সরকারী। হাইস্কুলের শিক্ষক মাইনুল ইসলাম, দেওয়ানগঞ্জ ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান একেএম হক, হারুনুর রশিদ, চারু মিয়া ও বুচা শেখসহ অনেক প্রতিবাদী মানুষকে। জ্বালিয়ে দিয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর। এছাড়া, দেওয়ানগঞ্জ রেল শ্রমিক লীগের সভাপতি বিশিষ্ট সমাজসেবক মেজবাহ উদ্দীন, ছাত্রীলীগ কর্মী লিচু প্রধান, দেওয়ানগঞ্জ থানার। দারােগা বজলুর রহমান ও রেল ইঞ্জিনের ফায়ারম্যান জয়নাল আবেদীনকে তারাই ধরে নিয়ে গিয়েছিল।

তারা আর ফিরে আসেনি। দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে কথা হয় বেশ কিছু ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে, তাঁরা অকপটে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার প্রধান মােনায়েম ও তার দোসরদের নানা অপকর্ম ও ধ্বংসযজ্ঞের বিশদ বর্ণনা দেন। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভােগী মুক্তিযােদ্ধা। জানিয়েছেন, মােনায়েম ছিল দেওয়ানগঞ্জ আলীয়া মাদ্রাসার ছাত্র ক্যাডার । মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে দেওয়ানগঞ্জ পাকি সেনাদের প্রথম মহড়ার দিনই মােনায়েম হাত মেলায় হানাদার বাহিনীর মেজর রফিক মালিক, ক্যাপ্টেন শামসাদ ও সুবেদার ইউসুফের সঙ্গে। মােনায়েমের সহায়তায় প্রথম অপারেশনের রাতেই হায়েনার দল মুক্তিযােদ্ধা সমর্থক গােষ্ঠীর অনেককেই চোখ বেঁধে নিয়ে যায় ঝিনাই ব্রিজ ও বাহাদুরাবাদ ঘাটে। সেখানে গুলি করে লাশ ভাসিয়ে দেয় নদীতে। দুর্ধর্ষ ক্যাডার মােনায়েম অল্প ক’দিনের মধ্যেই দেওয়ানগঞ্জ থানা রাজাকার কমান্ডার বনে যায়। সে সময় আজকের বকশীগঞ্জ উপজেলা ছিল দেওয়ানগঞ্জের একটি ইউনিয়ন। কমান্ডার মােনায়েমের বিশ্বস্ত সহযােগী ছিল কুখ্যাত আল বদর কমান্ডার ডাঃ মহির উদ্দিন। তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বিভিন্ন স্থানে। রাজাকার ও আল বদর বাহিনী। এ দু’কমান্ডারের ছিল দুই অবাঙালী জল্লাদ। তাদের একজন ছায়াছবি “পিচঢালা পথের” সহনায়ক বিহারী জিন্নাহ, অপর জন পাপ্পা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গ্রীন সিগন্যাল পেলেই এ দুই জল্লাদ সহযােগীদের নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের সমর্থকদের চোখ বেঁধে নিয়ে যেত বাহাদুরাবাদ ঘাট বা ঝিনাই ব্রিজে। সেখানে তাদের গুলি কিংবা জবাই করে হত্যা করা হতাে।

জনশ্রুতি আছে, জবাই করার আগে নরঘাতকরা তাদের ছােরার ধার পরখ করত শিকারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে। দেওয়ানগঞ্জের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযােদ্ধা জানান, ডাঃ মহির প্রায়ই অস্ত্র কাধে নিয়ে হাফপ্যান্ট পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। ‘৭১-এর সেই নারকীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই আজও বেঁচে আছেন। দেওয়ানগঞ্জ মুক্তিযােদ্ধা সংসদের কমান্ডার মাহাবুবুর রশিদ খুররম ‘৭১-এর ভীতিকর দিনগুলাের কথা বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ১১ এপ্রিল দেওয়ানগঞ্জ মানুষের কাছে অভিশপ্ত একটি দিন। সেদিন দুপুরে চিহ্নিত ক’জন রাজাকার পাক সেনাদের সঙ্গে নিয়ে ডালবাড়ী গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থক ষাটোর্ধ তুফানু শেখকে বাড়ি থেকে ধরে আনে। পরে হাত-পা বেঁধে দেওয়ানগঞ্জ রেলস্টেশনের লােকো শেডের ভিতর কয়লার ইঞ্জিনের অগ্নিকুণ্ডে ঢুকিয়ে দিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয় তুফানু শেখ। তিনি জানান, শহীদ তুফানুর স্ত্রীসন্তানরা ৩০ বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। আজ পর্যন্ত কেউ তাদের খোজখবর নেয়নি। তারা পায়নি কোন প্রকার সরকারী সাহায্য-সহযােগিতা। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা সূত্রগুলাে জানায়, দুর্ধর্ষ মােনায়েম রাজাকার কমান্ডার পদে অধিষ্ঠিত হবার পর পাকি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে একের পর এক অপারেশন চালায়। দেওয়ানগঞ্জ থানার দারােগা বজলুর রহমানকে স্থানীয় বাহাদুরাবাদঘাটে নিয়ে গুলি করে তার লাশ ভাসিয়ে দেয়।

বীর প্রতীক এনায়েত হােসেন সুজা মিয়া যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা ও বাহাদুরাবাদ হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান ও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ‘৭১-এর ভীতিকর এক রাতে চিকাজানি আকন্দ পাড়ার বেশ ক’জন মুরুব্বি ও মুক্তিযােদ্ধারা একটি অন্ধকার ঘরে গােপনে “জয় বাংলা” সেন্টারের খবর শােনার সময় মােনায়েম বাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ইফরাজ আলী (৪০)। পরে হাসপাতালে মারা যায় আহত রায়হান আলী। মুক্তিযােদ্ধারা জানান, মােনায়েম বাহিনীর সদস্য ছিল শতাধিক। এর মধ্যে সবচেয়ে আলােচিত বাহাদুরাবাদ নয়াগ্রাম মুন্সিবাড়ির এক হাজী পরিবার। এ গ্রামের আলহাজ রফিজুল হক ছিল শান্তি বাহিনীর অন্যতম সদস্য। তার ১১ পুত্রের মধ্যে বড় ৪ জন ছিল কুখ্যাত রাজাকার। এদের মধ্যে এনামুল স্বাধীনতার পর গ্রেফতার হয়। পরে সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে এসে ঢাকায় আদম ব্যবসার নামে শত শত মানুষের টাকা মেরে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তার অপর সহােদর এলাকার আলােচিত আল-বদর রেজাউল হক সােনা মিয়া এখন স্থানীয় বিএনপি নেতা। এই রাজাকার পরিবারের আরেক সদস্য ওবায়দুর হক মিঠু ৭ বছর ধরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করছে। এদেশের বিজয় আসন্ন দেখে মােনায়েম তার সহযােগীদের নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। প্রথমে ভারত ও পরে পাকিস্তান হয়ে চলে যায় সৌদি আরবে। সেখানে দীর্ঘদিন আত্মগােপন করে থাকার পর মােনায়েম বিএনপির শাসনামলে ঢাকায় ফিরে আসে। ঢাকার এলিফ্যান্ট রােড ও চট্টগ্রামের দেওয়ানজি পুকুর লেন এলাকায় মধু বিক্রির নামে একটি ব্যবসা কেন্দ্র খুলে বসে। দেশ-বিদেশে মধু ও আতর সাপ্লাইয়ের নামে নানা অবৈধ। ব্যবসার ফাঁদ পেতে সে অল্প দিনেই কোটিপতি বনে যায়। মােনায়েমের বাড়ি বকশীগঞ্জের বগার চর গ্রামে। ‘৭১-এর এই খুনী এতই বিচক্ষণ ও ধুরন্ধর যে, গত ৩০ বছরে সে একবারও দেওয়ানগঞ্জে আসেনি।

জনকণ্ঠ ॥ ২২-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!