জামালপুরে বহু খুনের হােতা এসএম ইউসুফ এখন সমাজসেবী ও বিভিন্ন পদে আসীন
মােস্তফা বাবুল, জামালপুর থেকে॥ একাত্তরে বীভৎস দিনগুলােতে জামালপুরে পৈশাচিক গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগসহ মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মদদ যুগিয়ে খাটি রাজাকার হিসাবে পাকি সামরিক জান্তার পদক উপহার পাওয়া এসএম ইউসুফ আলী এখন বিশিষ্ট সমাজসেবী, স্কাউটের কমিশনার। সরকারী-বেসরকারী প্রায় অর্ধশত সংগঠনের উচ্চ পদবী নিয়ে সে এখন অপ্রত্যাশিত গৌরব-গরিমা ও মর্যাদায় পুনর্বাসিত। এই রাজাকারের স্বাধীনতাবিরােধী অপকর্ম, কুকীর্তির নানা কাহিনী অনেকের স্মৃতির আয়নায় জ্বলজ্বল করলেও মুখােমুখি কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। একাত্তরের পাকি বাহিনীর অন্যতম দোসর এসএম ইউসুফ আলীর জঘন্য কাহিনীর ফিরিস্তি জামালপুরে মুক্তিযােদ্ধাদের মুখে শােনা যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলােতে। সে ছিল নানা কুকর্মের মদদদাতা, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। হানাদার বাহিনী যেদিন জামালপুর শহরে ঢুকে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর হামলে পড়েছিল সেদিন রাজপথে এসএম ইউসুফ আলীকে দেখা গেছে তার অনুচরদের নিয়ে কট্টর মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। তৌহিদী জনতার ব্যানারে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে সে ইসলামের অনন্য খাদেম হয়ে নিজেকে নজরানা’ হিসাবে পাকিদের কাছে সমর্পণ করে।
বাঙালী নিমূলের শপথ নিয়ে সে পিস কমিটির নামে জন্ম দিয়েছিল রাজাকার পর্ষদ। সরকারী আশেক মাহমুদ কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল আজিজ, অধ্যাপক আব্দুল গনি, অধ্যাপক মােজাম্মেল হক, অধ্যাপক গােলাম রব্বানী, অধ্যাপক শরিফ হােসেন, ডাঃ তানির উদ্দিন আহম্মদ, ডাঃ আব্দুস সামাদ, মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম, আব্দুল বারী, কবিরাজ মক্তব হােসেন, আব্দুল মান্নান, আশরাফ হােসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে ফজল, মওলানা মজিদ, মওলানা শওকত এরা ছিল কুখ্যাত রাজাকার পর্ষদের কেউকেটা ব্যক্তি। শহরের মেডিক্যাল রােডের সাধনা ঔষধালয় ছিল রাজাকারদের আস্তানা। পাকি সেনাকর্তা ক্যাপ্টেন শামসাদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল এই আস্তানায়। পাকিদের সাথে শলাপরামর্শ করে রাজাকার পর্ষদ হত্যাকাণ্ডের মৃত্যু পরােয়ানা জারিসহ নানামুখী ধ্বংসাত্মক অপারেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করত। সাধনার আস্তানায় বসে লুষ্ঠিত ধনসম্পদ ভাগ-বাটোয়ারা, টর্চার সেলে বন্দী রেখে মুক্তিপণ আদায় করত রাজাকাররা। মৃত্যুর ছােবল থেকে বেঁচে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নির্দয়-নির্মম হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত নিদর্শন। হয়ে আজও বেঁচে আছেন কাছারিপাড়ার ওয়ারেছ আলী এবং ওয়াপদার কর্মচারী আব্দুল ওহাব মিয়া। জামালপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান প্রাবন্ধিক ও কবি সৈয়দ ইমামুর রশীদ পাকি হায়েনাদের ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন ৫ দিন। তাকেও ধরে নিয়ে টর্চার করার পর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিল। শিবলী ফুরকানী নামে এক মওলানা তাকে তওবা পড়িয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেদিন বেঁচে যান। দীর্ঘ ৩০ বছর পর সে বীভৎস দিনের কাহিনী বর্ণনাকালে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ধরেই নিয়েছিলাম মরে গেছি। বেঁচে আছি এটা ভাবলে এখনও গা শিউরে ওঠে। কত মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে নিজের চোখে দেখা সেই নিষ্ঠুর কাহিনীর কথা বলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। দেশের জন্য যাদের প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে তাদের কয়েকজনের নাম এখনও স্মৃতির পাতায় অম্লান হয়ে আছে। পৌরসভার পলিশা গ্রামের আলহাজ জাবেদ আলীকে হত্যা করা হয় মসজিদের সামনে। তিনি আছর নামাজ পড়ে মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। হানাদাররা সেখানে গুলি করে তার প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়। তাঁর বিধবা পত্নী সরবান বেওয়া স্বামীর নৃশংস মৃত্যুর কথা মনে পড়লে। চোখের পানি ফেলেন।
সদর উপজেলার তিতপল্লা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন হায়দার আলী। তাকে শিলকুড়া গ্রাম থেকে ধরে আনা হয় পাকিদের ক্যাম্পে। পর দিন তার সহােদর ক্যাম্পে আসে ভাইয়ের খোঁজ নিতে ঘাতকরা উভয়কে নির্মমভাবে হত্যা করে। শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নুরুল মল্লিক ও তফিল উদ্দিনকে উপর্যুপরি গুলিবর্ষণ করে হত্যা করে রাস্তার ওপর ফেলে রাখে। ঘাতকের বুলেটে তাদের বুক-পিঠ ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। এসব হত্যা খুনে ইন্ধন যুগিয়েছিল সেই রাজাকার পর্ষদের হােতারা। শহরের পাথালিয়া গ্রাম পুরােটাই জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছিল। নির্বিচারে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল শহরের অসংখ্য দোকানপাট, বাসা-বাড়ি। একাত্তরে যুদ্ধের সময় এসএম ইউসুফ আলী ছিল শহরের সিংহজানি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক । জামায়াতে ইসলামীর এক নম্বর পাণ্ডা হিসাবে পাকি সেনাকর্তাদের আশীর্বাদে সে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম এ্যাডভােকেট আব্দুল হাকিমের শূন্য আসনে। প্রাদেশিক পরিষদের এমপি মনােনীত হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরােধী অপতৎপরতায় উল্লেখযােগ্য কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য সে পাকি সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পদক উপহার পায়। একাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন মহকুমা হাকিম এএম আব্দুল মান্নান ভুইয়ার সভাপতিত্বে এক অভ্যর্থনা সভায় ব্রিগেডিয়ার আসাদুল্লাহ তার হাতে এই পদক তুলে দেয়। এই পদক লাভ করে সে রাজাকার পর্ষদের শীর্ষনেতা হিসাবে অভিষিক্ত হয়। ১০ ডিসেম্বর জামালপুর শহরে পাকি হানাদার দুর্গের পতন হলে ইউসুফ আলীসহ রাজাকার পর্ষদের হােতারা সবাই গা-ঢাকা দেয়। কিছুদিন পর আত্মসমর্পণ করে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে প্রতিশােধের রােষানল থেকে বেঁচে যায়। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে রাজাকার পর্ষদের হােতারা ছাড়া পেয়ে পুনর্বাসিত হতে শুরু করে। এসএম ইউসুফ আলী সিংহজানি উচ্চ বিদ্যালয়ে সপদে পুনর্বহাল হয় ।
জিয়া-এরশাদ-খালেদা সরকারের আমলে তার কপাল খুলেছে নানাভাবে। শনৈঃ শনৈঃ শুধু উন্নতি হয়েছে তার পরবর্তী জীবনে। মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, বিজয় দিবসেও সে সশরীরে উপস্থিত থেকেছে। তাকে বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসনের কোন অনুষ্ঠানই হয় না। বিগত ২৫ বছর ধরে তার নামের পিছে যুক্ত হয়েছে নানা পদ-পদবী। দীর্ঘ ১১ বছর সে। জেলা স্কাউটের সভাপতির পদ কুক্ষিগত করে রাখে। স্কাউট আন্দোলনে গৌরবময় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সে বাংলাদেশ স্কাউটের চীফ ন্যাশনাল কমিশনার কর্তৃক মেডেল লাভ করেছে। সে আজ বিশিষ্ট সমাজসেবী এবং স্কাউটের এখনও এক জন কমিশনার। অর্ধশত সংগঠনের সাথে সে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সে সাধারণ সম্পাদক পদে এখনও বহাল আছে। সমাজ সেবা অধিদফতরের উন্নয়ন প্রকল্পের সভাপতি, রােটারী ক্লাব, শিশু সদন, প্রতিবন্ধী স্কুলসহ বিভিন্ন সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠনের সংগঠক। সম্প্রতি সে সিংহজানি স্কুল থেকে রিটায়ার করে নিজেই স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়ােগ করেছে।
জনকণ্ঠ ॥ ১৫-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন