জামালপুর
শত শত মানুষের খুনী আলবদরের জল্লাদ আশরাফ আস্তানা গেড়েছে ঢাকায়
মােস্তফা বাবুল, জামালপুর থেকে ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় লােমহর্ষক নৃশংস হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করতে গেলে জামালপুরের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আজও জল্লাদ আশরাফ হােসাইনের নাম উচ্চারণ করেন তীব্র ঘৃণাভরে। কুখ্যাত এই জল্লাদই ছিল খুনী আলবদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। বিষধর সাপের চেয়ে ভয়ঙ্কর জল্লাদ আশরাফের বর্বর নৃশংসতার কাহিনী জামালপুরের কেউ ভুলতে পারেননি। তার সম্পর্কে। মুক্তিযােদ্ধারা বলেন, ‘একাত্তরে মানুষরূপী এই জানােয়ারটা ছিল রক্তপিপাসু খুনী, মানুষখেকো বাঘ। রক্তের পিপাসা মিটাতে সে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কতশত মানুষ খুন ও জবাই করেছে তার সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হিসাবের কোন রেকর্ড নেই। আলবদর হাইকমান্ডের এই শীর্ষ নেতা এখন ঢাকায় পুনর্বাসিত। মহানগরীতে আস্তানা গেড়ে সেখানে সে জেকে বসে রাতারাতি অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক বনে গেছে। পর্দার আড়ালে থেকে নাটের গুরু সেজে একাত্তরের এই শীর্ষ খুনী বর্তমানে দেশব্যাপী মৌলবাদী অশুভ তৎপরতার কলকাঠি নাড়ছে- সম্পূর্ণরূপে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বসেই। আলবদর বাহিনী গঠনের সূতিকাগার ছিল তৎকালীন জামালপুর মহকুমা শহর। একাত্তরের ২২ এপ্রিল পাকি ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের হানাদাররা জামালপুরে পদার্পণের। পর পরই বদর বাহিনী গঠনের তৎপরতা শুরু হয়। শহরের ইকবালপুরের আশরাফ হােসাইন ছিল তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি। ছাত্র সংঘের নেতা হিসাবে আশরাফ আগে থেকেই একজন দুর্ধর্ষ ক্যাডার ছিল। পাকি সেনাদের পেয়ে তার দাপট বহুগুণ বেড়ে যায়। হানাদারদের দোসর হয়ে বেপরােয়া।
তৎপরতার মাধ্যমে দ্রুত জামালপুরে ‘কিং অব দ্য টাউন’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করে। পাকি সেনাদের পদার্পণের মাত্র এক মাসের মধ্যে ২৭ জুন ছাত্র সংঘের কর্মীদের। সংগঠিত করে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করে নিজেই বনে যায় এই সন্ত্রাসবাদী। চরমপন্থী দলের চীফ কমান্ডার। বর্তমান জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী আলবদরের সর্বাধিনায়ক হলেও জামালপুরের মানুষ জানেন আশরাফ হােসাইন হলাে এ বাহিনীর জন্মদাতা বা প্রতিষ্ঠাতা। পাকি ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের স্টাফ অফিসার ক্যাপ্টেন। শামসাদের সাথে ছির তার গভীর সখ্য। এই পাকি সেনা কর্তার সহায়তায় আলবদরকে গড়ে তােলা হয় সহযােগী সশস্ত্র প্যারামিলিটারি বাহিনী হিসাবে। আলবদরের হেডকোয়ার্টার ছিল জামালপুরে আশেক মাহমুদ কলেজের ডিগ্রী হােস্টেল। জামালপুর মহকুমা শহরের এই হেডকোয়ার্টার থেকেই তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলায় আলবদরের বিস্তার ঘটানাে হয়। স্থানীয় পিটিআই ছিল বদর রিক্রুটিং সেন্টার। ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মীদের তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের দীক্ষায় প্রলুব্ধ করে সশস্ত্র ট্রেনিং দিয়ে বদর বানানাে হতাে। আশরাফের নেতৃত্বে গঠিত এই আলবদররা অল্প দিনেই গােটা ময়মনসিংহ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগসহ বীভৎস তাণ্ডব শুরু করে। প্রায় ১০ হাজার ছাত্র সংঘের কর্মী নিয়ে গঠিত হয় তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার বদর বাহিনী। বদর বাহিনীর অবিসংবাদিত কমান্ডার হিসাবে আশরাফ একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী বনে যায়। তার সহযােগী সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে (বর্তমান জামায়াতের যুগ্ম সম্পাদক) কামারুজ্জামান শেরপুর এবং আব্দুল বারীকে দেয়া হয় জামালপুরের চার্জ। দেশ স্বাধীনের ২৯ বছর পরও জামালপুরে মুক্তিযােদ্ধা এবং সাধারণ মানুষ তার নাম ভুলে যাননি।
জঘন্য ঘৃণাভরা এই নাম উচ্চারণ করতে এখন অনেকেই লজ্জাবােধ করেন। নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জ্বলজ্বলে স্মৃতি বহন করে সেই নারকীয় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। জামালপুর শহরেই দেওয়ানপাড়ায় বেঁচে আছেন সাইদুর রহমান ওরফে সাদু চেয়ারম্যান। তিনি ঘাতকের বুলেটের মুখােমুখি হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। তার চাক্ষুষ স্মৃতির কথা বললেন জনকণ্ঠকে। একাত্তরের ৭ জুলাই সরিষাবাড়ী থানার বাউসী ও ভাটারা থেকে পাকি হানাদার ও বদরের যৌথ কমান্ড বাহিনী ৪ জনকে ধরে এনেছিল। তাদের মধ্যে একমাত্র সাদু চেয়ারম্যান বেঁচে আছেন, বাকি ৩ জনকেই তারা হত্যা করেছে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জামালপুর শহরের প্রবীণ গুণী ব্যক্তিত্ব, সাবেক প্রাদেশিক পরিষদের চেয়ারম্যান সিবিপি নেতা সাবেক এমপি মােহাম্মদ শাহনেওয়াজের বাবা আব্দুল হামিদ মােক্তার। তিনি ছিলেন জামালপুরবাসীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাকে ধরে আনার পর ৭ দিন বন্দী শিবিরে আটকে রেখে ছেড়ে দিয়েছিল। পাকি সেনা কর্তা ক্যাপ্টেন শামসাদ। পরে বদর কমান্ডার আশরাফের চাপের মুখে সেই রাতেই তাকে ফের ধরে এনে শহরের ছনকান্দা শ্মশানঘাটে হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করার পর লাশ ব্রহ্মপুত্র নদের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। একই রাতে সেই ফায়ারিং স্কোয়াডে আরও ৮/১০ জনকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। সাদু চেয়ারম্যানের শ্যালক আব্দুল হামিদ খান ছিলেন ছাত্রলীগের একজন তুখােড় নেতা। তাকে হত্যা করে। নদীতে ফেলে দেয়া হয়। শুধু সেদিন তিনিই বুকের ওপর ঘাতকের রাইফেল গর্জে ওঠার আগেই নদীতে ঝাপিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। নিজের শ্যালকসহ আরও নিরীহ ১০/১২ তাজা প্রাণ ঘাতকের বুলেটে ঝরে যেতে দেখেছেন। শুধু সাদু চেয়ারম্যান বেঁচে আছেন। নাৎসি বাহিনীর চেয়েও হিংস্র আলবদর বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের চাক্ষুষ জীবন্ত সাক্ষী। হয়ে ।। জামালপুরে নাকি এখনও রক্তের গন্ধ পাওয়া যায়।
বাতাস যেন তাজা রক্তের গন্ধে এখনও ভারি হয়ে আছে। বদরের স্রষ্টা আশরাফের রক্তের তৃষ্ণা মিটাতে কত সংখ্যক প্রাণ ঝরেছে ইতিহাসের ডায়রিতে তার রেকর্ড নেই। আশেক মাহমুদ ডিগ্রী হােস্টেল ছিল আলবদরের হেডকোয়ার্টার। গােটা হােস্টেলই ব্যবহৃত হয়েছে টর্চার সেল ও কসাইখানা হিসাবে। শিকার ধরে এনে টর্চার সেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানাে হতাে। মধ্যযুগীয় নৃশংসতা। শারীরিক নির্যাতন শেষে মৃতপ্রায়দের পশুর মতাে জবাই করা। হতাে। মানুষ জবাই করার কলাকৌশল শিখানাে হতাে দুর্ধর্ষ বদরদের। জল্লাদ আশরাফের সহযােগী বদর বাহিনীর সেরা কসাইদের মধ্যে আব্দুল বারী, মান্নান, শরীফ, রনজু, নন্দন, মােতাহার, ফজলু, ওসমান, হারুন, মজনু, গফুর, হাশেম সােলায়মান প্রশিক্ষিত ছিল। এদের পাশবিক বর্বর নির্যাতনের শিকার শহরের চামড়াগুদার রােডের আমজাদ হােসেন বেঁচে আছেন। তিনি সারা দেশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে সেই বীভৎস। নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন এখনও বহন করছেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন আমজাদ হােসেন।
বদর আশরাফের খতম’ লিস্টে তার নাম ছিল । ১০ আগস্ট বিকাল ৪টায় আশরাফের নির্দেশে বদররা তাকে ধরে ডিগ্রী হােস্টেলের বন্দী শিবিরে নিয়ে যায় । টর্চার সেলে তাকে ৪ দিন আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্মম নির্যাতন চালায় তার ওপর। আমজাদ হােসেন জনকণ্ঠকে বললেন, ‘টর্চার সেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, আঙ্গুল ঢুকিয়ে চোখের মণি উপড়ে ফেলতে দেখেছি। আমজাদের দেহে নির্মমভাবে বেয়নেট চার্জ করা হয়। গলার শ্বাসনালি কেটে দেয়া হয়েছিল। তাজা রক্তের স্রোতের মধ্যে গড়াগাড়ি যেতে হতাে। ১৪ আগস্ট রাতে আমজাদসহ আরও ৮/১০ জনকে হত্যা করে লাশ পাশেই বনপাড়ায় যৌতি গােরস্তানে (বর্তমানে মুক্তিযােদ্ধা গণগােরস্তান) ফেলে দেয় বদর কসাইরা। আধা ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে আমজাদের। চোখ মেলে দেখে সে লাশের স্তুপের উপর পড়ে আছে। প্রাণের কোন সাড়া নেই। অলৌকিকভাবে আমজাদ বেঁচে যান। তাঁদের পেটে বুকে গলায় ও মাথায় সেই বীভৎস নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন এখনও মােছেনি। জামালপুর যেদিন হানাদারমুক্ত হয় সেদিন ডিগ্রী হােস্টেল থেকে বস্তা বস্তা মানুষের চোখ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও কর্তিত মাথা উদ্ধার করা হয়েছে। ডিগ্রী হােস্টেলের সেই কসাই খানায় অগণিত মানুষ হত্যা করে বদর বাহিনীর জন্মদাতা আশরাফ হােসাইন উপাধি লাভ করেছিল মানুষখেকো রক্তপিপাসু বাঘ হিসাবে। স্বাধীনতার বিজয়লগ্নে মানুষরূপী এ হিংস্র জানােয়ারটা দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে সৌদি আরবে আত্মগােপন করে। দীর্ঘদিন ছিল আত্মগােপনরত অবস্থায়। এরশাদের সামরিক শাসনামলে স্বাধীন দেশের এই গণশত্রু আশরাফ হােসাইন ঢাকায় ফিরে এসে আস্তানা গড়ে তােলে। ৪৪, পুরানা পল্টনের একজন ব্যারিস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সেবা সাহিত্য সংস্কৃতি জনকল্যাণ সংস্থার সাইনবাের্ড ঝুলিয়ে জেঁকে বসে।
নানা রকমের ব্যবসার ফাঁদ পেতে অল্প দিনেই অঢেল বিত্তবৈভব লাভ করে। পাকি হানাদারদের স্বেচ্ছাসেবক ঢাকায় বসে সেবার নামে পাকিপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং আলবদরদের একত্রীকরণ ও সেতুবন্ধ রচনা করে চলেছে। একাত্তরে আলবদর বাহিনীর জন্মদাতা আশরাফ হােসাইনের সেবার আস্তানায় জন্ম হয়েছে পরবর্তীতে দেশের একটি মৌলবাদী পত্রিকার । তার অন্যতম সহযােগীরাও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় আজ প্রতিষ্ঠিত। শরীফ বদর। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালক। বদরের সেকেন্ড ইন কমান্ড আব্দুল বারী ঢাকায় আইন পেশায় জড়িত এবং মােতাহার আনসারের এ্যাডজুটেন্ট হয়েছে। আশরাফের ঘনিষ্ঠজনদের সাথে এখনও সেই সখ্য ও যােগাযােগ রয়েছে। একাত্তরের এই জল্লাদ এতই বিচক্ষণ ও ধুরন্ধর যে, পর্দার আড়ালে বসে নাটের গুরু সেজে দেশে তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের রূপরেখা বাস্তবায়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে।
জনকণ্ঠ ॥ ২৬-১২-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন