মুনছুর উদদৌলাহ পাহলােয়ান, আফছার আলী নানুর নাম শুনলে ইসলামপুরের মানুষ আজও শিউরে ওঠে
আনােয়ার হােসেন মিন্টু, ইসলামপুর থেকে ॥ একাত্তরের ২৭ আগস্ট, ভর দুপুরে বাড়ির আঙ্গিনায় ৪ অবুঝ সন্তান ও স্ত্রীর সামনে স্বামী ঘুনু ফকিরকে গুলি করে নৃশংস হত্যার বিবরণ দেয়ার সময় এখনও মূৰ্ছা যান পঞ্চাশাের্ধ মিসিরন বেওয়া। দুঃখী মায়ের মুখে পিতা হত্যার লােমহর্ষক কাহিনী শােনার সময় বার বার চোখ মােছে পুত্র মমতাজ আলী। এ পরিবারের অপরাধ, ক’জন ক্ষুধার্ত মুক্তিযােদ্ধার জন্য তাদের ঘরে ভাত রান্না হয়েছিল। গৃহকর্তাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি জল্লাদের দল। পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বাড়িঘরে। সে আগুনের লেলিহান শিখা স্থায়ী হয় টানা ৫ দিন। পুড়ে ছাই হয় কাছিমা গ্রামের ৪ শতাধিক ঘরবাড়ি। গৃহবধূ মিসিরনের বয়স তখন ২৫ বছর। বিয়ের পর ক’বছর না যেতেই নাকের ফুল খুলে বিধবার শাড়ি পরতে হয়েছে টগবগে সুন্দরী যুবতী মিসিরনকে। বাবার মৃত্যুদৃশ্য প্রত্যক্ষকারী তৃতীয় শ্রেণীতে পড় য়া মমতাজের বয়স এখন ৪০। বর্তমানে ৭ সন্তানের জনক। ৩ বােনকে বিয়ে দিয়েছে অনেক কষ্টে। স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে এখন দিন কাটছে অতিকষ্টে। বিগত ২৯ বছরে এ পরিবারের ভাগ্যে সরকারী সাহায্য জুটেছে মাত্র ৫শ’ টাকা। ‘৭১-এর সেই ভীতিকর দিনগুলােতে পশ্চিম জামালপুরের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের নেতৃত্বদানকারীদের একজন এখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক। তার নাম মুনছুর উদদৌলাহ পাহলােয়ান ওরফে বুদু মিয়া। অপরজন কুখ্যাত আলবদর আফছার আলী নান্ন (৪৮)। এখন মুক্তিযােদ্ধা সেজে বসে আছে। ইসলামপুরের স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা সূত্রগুলাে জানিয়েছে, মুনছুর ছিল জামালপুর আশেক মাহমুদ সরকারী কলেজের ৩য় বর্ষের ছাত্র। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা এই মুনছুর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সরাসরি পাকি জেনারেলদের সাথে সহজেই সখ্য গড়ে তােলে। এক সময় বনে যায় মহকুমা রাজাকার কমান্ডার।
তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন রাজাকার কমান্ডারসহ গ্রুপ কমান্ডার। মুনছুরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল লুৎফর রহমান। বন্ধুর আশীর্বাদে লুৎফর রাজাকারের গ্রুপ কমান্ডার বনে যায় । মুক্তিযােদ্ধারা জানায়, এই লুৎফর ছিল কুখ্যাত জল্লাদ। তার বর্বর নৃশংসতার কাহিনী ইসলামপুরের কেউ ভুলতে পারেনি। তারা জানায়, এসব রাজাকার কমান্ডারের অনুসারীরা ইসলামপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে হিন্দু বাড়িগুলােতে লুট করে তাতে অগ্নিসংযােগ করেছে। যাদের নাম শুনলে ভুক্তভােগীরা এখনও আঁতকে ওঠে। ঘৃণায় থুথু ফেলে। এ সকল রাজাকার এখন জনদরদী হিসাবে সমাজে বসবাস করছে। মুনছুরের নেতৃত্বে গঠিত থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। ছাড়াও শান্তি কমিটিও পাকিদের মন খুশি করতে নেমে পড়ে মাঠে। মুক্তিযােদ্ধারা বলেছেন, একাত্তরে মানুষরূপী এসব জানােয়ার মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কত যে নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েছে সেই হিসাবের কোন রেকর্ড নেই। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা এ রাজাকার বাহিনীর বর্বর নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি ভুলতে পারে না। ভয়ঙ্কর জল্লাদ মুনছুর বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের জীবন্ত সাক্ষী তারই সহােদর সাবেক ডাকসু জিএস, প্রাক্তন এমপি ‘৭১-এর বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ উদদৌলাহ পাহলােয়ান (৭০)। একাত্তরের মানুষরূপী জানােয়ার ছােট ভাই মুনছুরের নাম উচ্চারণ করতে এখনও তিনি ঘৃণাবােধ করেন।
‘৭১-এর ভীতিকর রাতে আপন ভাইয়ের হিংস্রতার কবল থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জনকণ্ঠকে জানান, ‘৭১-এর আগস্টের এক সন্ধ্যায় গুঠাইল বাজার মসজিদে মাগরিবের নামাজরত অবস্থায় ঐ জানােয়ার মুনছুর তাকে ধরার জন্য পাকি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে পুরাে এলাকা ঘেরাও করে। পরে মসজিদ থেকে কোনমতে পালিয়ে তিনি আত্মরক্ষা করেন। শেষ রক্ষা হবে না বুঝতে পেরে গণরােষের ভয়ে ভয়ঙ্কর মুনছুর স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন ছিল আত্মগােপনে। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযােদ্ধারা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজেও ব্যর্থ হয়। পরে তার ঘনিষ্ঠ সহচর শেরপুরের আলবদর কমান্ডার বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা কামারুজ্জামানের আশীর্বাদে চাকরি নেয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। বর্তমানে সে ঐ সংস্থার উপপরিচালক। বাস করেন। ঢাকায় নিজের বাড়িতে। এই কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডারের ঘনিষ্ঠ তিন সহচরের একজন নরঘাতক লুৎফর রহমান ২৯ বছরেও জন্মভূমির মাটিতে পা রাখতে পারেনি। বছরখানেক আগে তার মৃত্যু হলে জামালপুরে তাকে কবরস্থ করা হয়। রাজাকার মুনছুর পাহলােয়ান সম্পর্কে তার আপন বড় ভাই আশরাফ উদদৌলাহ পাহলােয়ানের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে তিনি আরও বলেন, ‘৭১ সালে রাজাকার হওয়ায় এই ঘৃণ্য ছােট ভাইয়ের সঙ্গে আজ পর্যন্তও তিনি কথা বলেন না। এমনকি পারিবারিকভাবেও দুই ভাইয়ের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই বলে তিনি জানান। অপর কুখ্যাত আলবদর মনি স্বাধীনতার পর আত্মগােপন করে। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে সে আবার ইসলামপুরে ফিরে আসে এবং বর্তমানে সে শিক্ষকতার পেশায় কর্মরত। বদর বাহিনীর অন্য সদস্য নানু এখন তালিকাভুক্ত মুক্তিযােদ্ধা। এ ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পালনকারী বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আবু বকর ছিদ্দিক আক্ষেপ করে বলেন, ‘স্বাধীনতার ৩০ বছরেও আমার নাম মুক্তিযােদ্ধার তালিকায় ওঠেনি। অথচ কুখ্যাত আলবদর এখন হয়ে গেছে তালিকাভুক্ত মুক্তিযােদ্ধা।
জনকণ্ঠ ॥ ১৮-০১-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন