নীলফামারী
কালিগঞ্জে গণহত্যার হােতা নীলফামারীর বিহারী আবদুল্লাহ এখন বিএনপি নেতা ও সাংবাদিক
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ পাকি সেনাদের দোসর ‘৭১-এর রাজাকার বিহারী আবদুল্লাহ এখন। নীলফামারী বিএনপির নেতা ও সাংবাদিক। রাজাকার আবদুল্লাহ ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজী দৈনিক পত্রিকার নীলফামারীস্থ প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সাপ্তাহিক নীল সমাচার পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আবদুল্লাহ নীলফামারীর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল। ‘৭১-এ নীলফামারীর দায়িত্বে নিয়ােজিত পাকি ক্যাপ্টেন আল্লাহ রাখখা খানের সে ছিল একান্ত অনুগত। একই জীপ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়িয়ে বিভিন্ন অপারেশনে সে প্রত্যক্ষ সহযােগিতা করে। নিরীহ অসংখ্য মুক্তিপাগল বাঙালীকে হত্যা ও গণহত্যার পাশাপাশি আবদুল্লাহ বহু নারীকে উপভােগের জন্য পাকি সেনাদের হাতে তুলে দেয় এবং বিভিন্ন বাসাবাড়িতে লুটপাট চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩০ বছর পরও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলাে ভুলতে পারেনি রাজাকার। আবদুল্লাহর নৃশংস, হিংস্র ভূমিকার কথা। নীলফামারী শহরের সে সময়ের ব্যবসায়ী, সমাজসেবক বােথা বাবু (ব্রজনাথ ঘােষ) ও তার বড় ছেলে স্বপন কুমার ঘােষ, মেজ ছেলে তপন কুমার ঘােষ, হােমিও চিকিৎসক। ডাঃ বিষ্ণু ও তার ভাই ব্যবসায়ী শম্ভু, এলএমএফ চিকিৎসক ডাঃ হেমন্ত, ব্যবসায়ী। সালেহউদ্দিন শাহ, ছাত্রলীগ সভাপতি মাহফুজার রহমান চৌধুরী (দুলু) ও নীলফামারী। সদরের কুন্দুপুকুর গ্রামের জমিদার ঘিনা সাহা, হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজাকার কমান্ডার আবদুল্লাহর সঙ্গে সে সময়ের পিস কমিটির সভাপতি বর্তমানে নীলফামারী বার।
লাইব্রেরীর সভাপতি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সুরাহা কমিটির অন্যতম সদস্য এ্যাডভােকেট আব্দুল লতিফও জড়িত ছিল। অভিযােগ মতে, যে কোন হত্যাকাণ্ডের জন্য এই দু’জন সিদ্ধান্ত নিত এবং তাদের রাজাকার বাহিনী দিয়ে ধরে নিয়ে। এসে পাকি সেনাদের হাতে তুলে দিত হত্যার জন্য। এই ৯ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে প্রথম ৬ ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে ধরে নীলফামারী ডাকবাংলাের পাকি ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। পরে দারােয়ানীর জঙ্গলে (বর্তমানে দারােয়ানী টেক্সটাইল মিলস) নিয়ে এক সঙ্গে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এখানেই তাদের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়। বােথা। বাবুর দুই মেয়েকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে ২৫ এপ্রিল রাতে সালেহউদ্দিন শাহকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। উকিলপাড়ার ডাঃ আবুল হােসেন চৌধুরীর পুত্র ছাত্রলীগের সভাপতি মাহফুজার রহমান দুলুকেও পাকিরা ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় দুলু বাঁচার জন্য রাজাকার আব্দুল্লাহ ও পিস কমিটির সভাপতি এ্যাডভােকেট লতিফের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু তাদের মন গলেনি। কুন্ডুপুকুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জমিদার ঘিনা সাহাকে পাকি বাহিনী ক্যাম্পে দেখা করতে খবর পাঠায়। জমিদার ঘিনা সাহা এতে রাজি না হওয়ায় তাকে দড়ি দিয়ে জীপ গাড়ির পিছনে বেঁধে হেঁচড়িয়ে নিয়ে আসে এবং পরে গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
রাজাকার বিহারী আবদুল্লাহ সবচেয়ে লােমহর্ষক ঘটনাটি ঘটিয়েছিল জলঢাকা থানায়। জলঢাকা থানার বালাগ্রাম ইউনিয়নের কালিগঞ্জে। তিন শতাধিক নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাখির মতাে গুলি করে হত্যার নেপথ্যে রাজাকার আবদুল্লাহ জড়িত ছিল। ‘৭১এর ১৯ এপ্রিল সকাল ১০টায় ঘটে এই গণহত্যা। ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু একত্রিত হয়ে পাকি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিল। কালিগঞ্জ নামকস্থানে এই দলটি পৌছলে বিপরীত দিক দিয়ে জীপে করে আসে পাকি সেনারা। সেই গাড়িতে বসা ছিল রাজাকার আব্দুল্লাহ। বাংলা ও উর্দু কথা বলায় পারদর্শী এই আব্দুল্লাহ দোভাষী হিসাবেও কাজ করে এখানে। ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুর সহজ-সরল জবাব ছিল তারা ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। উর্দুতে আবদুল্লাহ পাকি সেনাদের কী বােঝাল তা ঐ গ্রামের সহজ-সরল তিন শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু বুঝে ওঠার আগে তাদের দু’ভাগে বিভক্ত করে লাইন করে দাড়াতে বলা হয়। এর পর ব্রাশফায়ার। দু’একজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। পড়ে থাকে লাশের স্থূপ। লাশগুলাে ফেলে রেখেই আবদুল্লাহসহ পাকি সেনারা চলে যায় জলঢাকা থানায়। সেখানে গিয়ে তারা লাশগুলাে মাটিচাপা দিতে হুকুম দেয়। পরে এই লাশগুলাে মাটিচাপা দেয়া হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া অমর কৃষ্ণ অধিকারী গণহত্যার ৭১ জনের নাম দিতে পেরেছেন। বর্তমানে এই স্থানটি কালিগঞ্জ বধ্যভূমি নামে পরিচিত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার আবদুল্লাহ নীলফামারী থেকে পালিয়ে রংপুরে আত্মগােপন করে। সেখানে রাজাকার শব্দের “কার” বাদ দিয়ে রাজা নাম ধারণ করে দীর্ঘদিন তেলের ব্যবসা করে। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজাকার আব্দুল্লাহ নীলফামারী শহরের লােকসমক্ষে ফিরে আসে। এর পরেও অসংখ্য হত্যা, মা-বােনের ইজ্জতহরণ ও লুটপাটের ঘটনা ভুলতে না পেরে মানুষজন তাকে ধরে।
বর্তমানে পৌর মার্কেটের প্রীতি স্টোর নামক দোকানের মােড় থেকে বাবুপাড়া সড়কের প্রায় সােয়া মাইল পর্যন্ত রাস্তায় মানুষজন থুথু ফেলে এবং রাজাকার আবদুল্লাহকে তা চেটে খাওয়ায়। এর পর বাবুপাড়ার একটি বাড়িতে (বর্তমানে জাপা (এ) নীলফামারী ১ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভােকেট এনকে আলম চৌধুরীর বাসভবন) নিয়ে গাছের সঙ্গে বাধে। কিন্তু এর পর এলাকার জনৈক এক প্রভাবশালী ব্যক্তি লােকজনের হাত থেকে উদ্ধার করে আব্দুল্লাহকে ছেড়ে দেয়। ছাড়া পেয়ে আবদুল্লাহ কিছু দিন কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও ধীরে ধীরে পুনরায় প্রভাব বিস্তারের রাস্তা করে নেয়। প্রথমে সে সাংবাদিকতা পেশা বেছে নেয়। এর পর রাজাকার আবদুল্লাহ ওঠাবসা শুরু করে ডিসি, এসপি থেকে শুরু করে সমাজের সব মহলে। পরে সে নিজে প্রকাশক ও সম্পাদক হয়ে ‘৯৪ সালের ১০ জানুয়ারি পত্রিকাটির প্রথম প্রকাশ ঘটায়। এ ছাড়া ১৯৮৮ সাল থেকে রাজাকার আবদুল্লাহ দীর্ঘ ৯ বছর ধরে একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক হিসাবে নীলফামারী জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ছিল। এই কমিটির সদস্যপদ তার বাতিল হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর। ১৯৯৮ সালে সে নীলফামারী বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যােগদান করে এবং সেই থেকে সে বিএনপির নেতা।
জনকণ্ঠ। ২৩-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন