বটিয়াঘাটার বহু হত্যার নায়ক হাবিবুর জমাদ্দার (হাবু) এখন আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা
অমল সাহা, খুলনা অফিস ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুলনার বটিয়াঘাটায় পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসাবে রাজাকাররা যে অত্যাচার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সে কথা মনে করে এলাকার মানুষ আজও শিউরে ওঠে। সেদিনের সে রাজাকারদের একজন হাবিবুর রহমান জমাদ্দার (হাবু) এখন আনসার-ভিডিপির কর্মকর্তা। শেখ আশরাফ হােসেন নামের আর একজন প্রচুর বিত্ত-বৈভবের অধিকারী। সে সময়ের অনেক রাজাকার বহাল তবিয়তে এলাকায় থেকে নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার মানুষ তাদের ঘৃণার চোখে দেখলেও প্রকাশ্যে এদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে এখনও সাহস করে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসাবে বহু রাজাকার সেদিন বটিয়াঘাটার বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, অগ্নিসংযোেগ, নারীধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। এর মধ্যে সুরখালী (তহসিল অফিস), গাওঘরা (দাতব্য চিকিৎসালয়), বাড়ােয়ারিয়া ও ফুলবাড়ী ক্যাম্পের রাজাকারদের নৃশংসতার কথা ভেবে মানুষ এখনও আঁতকে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সে সময়ে থানা পর্যায়ে রাজাকারদের নেতৃত্ব দিয়েছিল সুরখালী ইউনিয়নের কল্যাণশ্রী (ছত্র ভিলা) গ্রামের হাবিবুর রহমান জমাদ্দার (হাবু) ও গঙ্গারামপুর ইউনিয়নের কাডিয়ানাংলা গ্রামের মহুয়া খান বুলবুল। সুরখালী ইউনিয়নের সুরখালী, গাওঘরা ও বাড়ােয়ারিয়া ক্যাম্পের দায়িত্ব ছিল যথাক্রমে শহর আলী সরদার (সুরখালী গ্রাম), শেখ আশরাফ হােসেন (গাওঘরা গ্রাম) ও হাতেম আলী (কোদলা গ্রাম) এবং বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের ফুলবাড়ী ক্যাম্পে ছিল এখলাস (হাটবাড়ী গ্রাম)।
মূলত এদের নেতৃত্বেই বটিয়াঘাটায় নারকীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বটিয়াঘাটা এলাকা ঘুরে জানা গেছে, রাজাকাররা হিন্দু এবং মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালিয়েছে এবং অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। অনেক মা-বােনের ইজ্জত হরণ করেছে। নৃশংসভাবে খুন করেছে বহু লােককে। এসব। ঘটনায় নেতৃত্বদানকারী ও খুনী জল্লাদদের নাম উচ্চারণ করতেও এলাকার মানুষ রীতিমতাে ভয় পায়।। গাওঘরা ক্যাম্প কমান্ডার শেখ আশরাফ হােসেনের নেতৃত্বে এক রাতে ৯/১০ জনকে ধরে গজালিয়া মুইস গেটের কাছে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যার পর লাশ ভদ্রা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কেউ কেউ বলছেন, সুইস গেটে ১৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং শব-ই-বরাতের রাতে তিন ক্যাম্পের রাজাকাররা মিলে এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। গজালিয়া মুইস গেটে সে রাতে খুন করা হয়েছে গাওঘরা, সুরখালী ও খড়িয়ালের আঃ রহমান গােলদার, লুৎফর রহমান মােল্লা, আঃ সাত্তার সরদার, হাশেম গােলদার, আঃ হামিদ, গােষ্ঠবিহারী ভদ্র, দিলীপ, গােবিন্দ, অসিত প্রমুখকে। খড়িয়ালের হরেণ মল্লিক ও সুরখালী গ্রামের জোয়াদ আলীকে সুরখালী লঞ্চঘাটে এবং খড়িয়ালের সুশীল ভদ্রকে গাওঘরা নদীর তীরে নিয়ে হত্যা করা হয়। কল্যাণশ্রী গ্রামের ইয়াকুব আলী (গ্রাম্য ডাক্তার)-কে বাড়ােয়ারিয়া লঞ্চঘাটে, গজালিয়া গ্রামের শামসুর রহমান মােল্লাকে বাদামতলায় গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানে আরও বেশ কয়েকজনকে রাজাকাররা হত্যা করেছে। তাছাড়া ১৯ মে সকালে পাকি বাহিনীর সদস্য ও রাজাকাররা বাদামতলা এলাকায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু লােককে হত্যা করে। ফুলবাড়ী ক্যাম্পের এখলাস নৃশংসভাবে মানুষ খুন করত বলে এলাকার মানুষের কাছে সে এখলাস জল্লাদ’ হিসাবে পরিচিতি পায়।
সে হাটে-বাজারে ঘােষণা দিয়ে মানুষ খুন করত বলে জনশ্রুতি রয়েছে। খলিল নামের এক ব্যক্তিকে নৌকায় রেখে বহু লােকের সামনে একটা একটা করে হাত-পা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে হত্যা করে। যদিও এ কসাই পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। বাড়ােয়ারিয়া ক্যাম্পের রাজাকারদের নৃশংসতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে গুরুদাসী মণ্ডল। রাজাকাররা তার স্বামী-সন্তানদের খুন করেছে। তাকে আটকে রেখে ইজ্জত হরণ করেছে। গুরুদাসীর স্বামী হরিপদ মণ্ডল। বাড়ােয়ারিয়া বাজারে দর্জির কাজ করত। সপরিবারে সেখানেই বসবাস করত। সব হারিয়ে গুরুদাসী এখন আধাপাগল অবস্থায় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গুরুদাসীর মতাে বটিয়াঘাটা এলাকায় আরও অনেক স্বামীহারা স্ত্রী ও সন্তানহারা মায়ের চোখের পানি গত ৩০ বছর ধরে ঝরছে। কিন্তু অত্যাচারী ও খুনী সে রজাকারদের বিচার হয়নি। এলাকাবাসী জানায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে থানা পর্যায়ে পাকি হানাদার বাহিনীর দোসর হিসাবে যে ব্যক্তি রাজাকারদের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে রাজাকার হাবিবুর রহমান জমাদ্দার (হাবু) এখন সে আনসার-ভিডিপির কর্মকর্তা। দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘদিন আত্মগােপন করে থাকে সে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর (বঙ্গবন্ধু হত্যার পর) সে আনসারভিডিপির চাকরি লাভ করে। বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার জুরাইছরি উপজেলার আনসারভিডিপির এ্যাসিস্ট্যান্ট এ্যাডজুটেন্ট পদে কর্মরত।
এর আগে যশােরের অভয়নগর উপজেলায় তার দায়িত্ব পালনকালে আকিজ জুট ইন্ডাস্ট্রি থেকে আনসারদের ১১টি রাইফেল লুট হয়। যার হদিস আজও মিলেনি। তার অন্যতম সহযােগী মহুয়া খান বুলবুল দেশ স্বাধীনের পর এলাকা ছেড়ে বাগেরহাটের রামপাল গিয়ে বসবাস করছে। আর এক রাজাকার শেখ আশরাফ হােসেন প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারী হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পূর্বে ছিল সে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী। হাটে হাটে বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করত। বর্তমানে চিংড়ি মাছের ব্যবসা করছে। গাওঘরা গ্রামে প্রাচীর ঘেরা সুরম্য দোতলা অট্টালিকা বানিয়েছে। বহু জমির মালিক হয়েছে। ‘৭১ সালে শুকদারা গ্রামে লুটপাট করে বিপুল সহায় সম্পদ করেছে। তারই বদৌলতে এখন সে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বাড়ােয়ারিয়া ক্যাম্প কমান্ডার হাতেম আলী মারা গেছে। তার সহযােগী মােজাহার বাড়ােয়ারিয়া বাজারে রেডিও মেকানিকের কাজ করে। ‘৭১-এর কৃতকর্মের জন্য সে। অনুতপ্ত। এলাকাবাসী জানায়, অধিকাংশ রাজাকার স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও বেশ কয়েকজন এখনও দাপটে আছে। তারা এখনও গর্ব করে মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের রাজাকারের ভূমিকার কথা বলে বেড়ায় ।
জনকণ্ঠ ॥ ০৩-০২-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন