সিলেটের বালাগঞ্জে দুই হত্যাযজ্ঞের নায়ক আহাদ চৌধুরী। ওরফে সাদ মিয়া এখন বীমা কর্মকর্তা
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তরের দুর্ধর্ষ খুনী সিলেটের বালাগঞ্জে সবচেয়ে বড় দু’টি হত্যাকাণ্ডের প্রধান নায়ক আব্দুল আহাদ চৌধুরী ওরফে সাদ মিয়া এখন সিলেট শহরের একটি বেসরকারী বীমা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বালাগঞ্জের আদিত্যপুরে ৬৩ জন এবং বুরুঙ্গায় ৭৮ জন মুক্তিপাগল বাঙালীকে হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে পাকি সেনারা। শহীদ হওয়া এসব মানুষকে বাড়িঘর থেকে ধরে এনে পাকিদের হাতে তুলে দিয়েছিল এই সাদ মিয়া। মাত্র ১৮ দিনের ব্যবধানে এত বড় দু’টি গণহত্যার ঘটনা বালাগঞ্জে স্বাধীনতাকামী মানুষকে স্তম্ভিত ও স্বজন হারানাের শােকে মুহ্যমান করে তুললেও তার হৃদয় কাপেনি। খুনের নেশায় মাতােয়ারা সাদ মিয়া সে সময় প্রতিরাতেই বিভিন্ন জনপদে লুটতরাজ ও মানুষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে আরও অসংখ্য খুনের ঘটনার সাথে সে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত ছিল। এ জন্য সে তার নিজ গ্রাম বালাগঞ্জের করণসিসহ স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে মানুষ খেকো’ সাদ মিয়া হিসাবে বেশি পরিচিত। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে সিলেটের তৃতীয় স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সে জেল থেকে ছাড়া পায়। স্থানীয় কয়েক মুক্তিযােদ্ধা জানান, সাদ মিয়া একাত্তরে সাধারণ একজন অস্ত্রধারী রাজাকার হলেও পাকিদের আকণ্ঠ দালালী এবং তাদের মনােরঞ্জনে যুবতী মেয়ে সরবরাহ করে সে সময় বালাগঞ্জের শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মৌলভী ফজলুর রহমান ও বালাগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার আফতাবুজ্জামানের চেয়েও নিজেকে পাকি আর্মিদের বিশ্বস্ত হিসাবে প্রমাণ করেছিল।
এ জন্য মুক্তিযুদ্ধকালে সে ছিল সবচেয়ে বেপরােয়া ও দুর্ধর্ষ। বালাগঞ্জে নিপীড়ন, নির্যাতন, লুটপাট ও অসংখ্য নারকীয় হত্যাকাণ্ডে তার। সহযােগী ছিল একই থানার উম্মরপুর ইউনিয়নের খাদিমপুরের জানুমিয়া ওরফে আজিজুল হক, বুরুঙ্গার গৌছ মিয়া, মােক্তারপুরের গৌছুর রহমান চৌধুরী, ছােট হাজিপুরের আব্দুল খালিক, হিজল্যা নিবাসী আলিসুদ্দিন, খুজকিপুর নিবাসী মদরিছ আলী প্রমুখ। আদিত্যপুর গণহত্যার ঘটনায় যে দু’জন মুক্তিকামী মানুষ পাকি সেনাদের গুলি খেয়েও ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা হলেন শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী ও সুখময় চন্দ্র দেব। সুখময় কয়েক বছর আগে পরলােকগমন করেছেন। আর শিবপ্রসাদ সেন চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধকালে তারই চোখের সামনে বাবা, জেঠা ও জেঠাত ভাইয়ের মর্মান্তিকভাবে গুলিতে নিহত হবার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, একাত্তরের ১৪ জুন ভােরে পাক হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকাররা যখন আদিত্যপুর গ্রাম ঘেরাও করে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল প্রাঙ্গণে এনে নিরীহ মানুষদের হাত-পা বেঁধে জড়াে করেছিল তখন তিনি ধরা পড়েননি। ঐ দিন দুপুরে পাকিরা গণহত্যা চালানাের মাত্র দশ মিনিট আগে একটি পুকুর পাড়ের ঝােপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে সাদ মিয়াসহ তিন রাজাকার ধরে নিয়ে দাঁড় করায় অন্য বন্দীদের সাথে। এরপর বন্দুকের নল থেকে বৃষ্টির মতাে গুলি বেরুতে থাকলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঘটনার পর পাকি আর্মি ও রাজাকাররা চলে গেলে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের মানুষ এসে তাকে রক্তাক্ত মুমূর্ষ অবস্থায় সেখান থেকে উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যান। তখন বেশ ক’জন হৃদয়বান মানুষের সহায়তায় তাঁর চিকিৎসা চলে। বুরুঙ্গার গণহত্যার ঘটনায়ও নিবাস চক্রবর্তী, প্রীতিরঞ্জন চৌধুরী ও রানু মালাকার নামে তিন ব্যক্তি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।
এঁদের মধ্যে প্রথম দু’জন বর্তমানে বুরুঙ্গা হাই স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ােজিত রয়েছেন। তারা শােনালেন ৭৮ জন স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষের একই সাথে শহীদ হবার করুণ কাহিনী। একাত্তরের ভূমিকা সম্পর্কে আব্দুল আহাদ চৌধুরীর বক্তব্য জানতে চাইলে সে বালাগঞ্জের আদিত্যপুর ও বুরুঙ্গার গণহত্যায় তার নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বলেছে, আদিত্যপুরের ঘটনার সময় সে পাকি আর্মিদের হাতে বন্দী এবং বুরুঙ্গার ঘটনার সময় ঢাকায় ছিল। সে নিজেকে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী হিসাবে পরিচয় দিয়ে বলে আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে এখনও সে বিচ্যুত হয়নি। তবে একাত্তরে পাকি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর শুধু জীবনরক্ষার্থে কয়েকদিন পাকিদের পক্ষে কাজ করেছে। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে দালালী মামলায় কারাদণ্ড ভােগের কথা অবশ্য সাদ মিয়া স্বীকার করেছে। সে জানায়, একসাথে দণ্ডভােগকারী রাজাকার জানু মিয়া বর্তমানে ঢাকায় সৌদি আরবভিত্তিক একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে উচু পদে আসীন আছে এবং তার অন্যতম আরও দুই সহযােগী ইতােমধ্যে ইহলােক ত্যাগ করেছে। এদিকে আদিত্যপুর ও বুরুঙ্গার গণহত্যায় সাদ মিয়া তার সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করলেও ঐ দু’টি এলাকাসহ বালাগঞ্জের পঞ্চাশাের্ধ প্রতিটি মানুষের কাছে আব্দুল আহাদ চৌধুরী ওরফে সাদ মিয়া একজন রাজাকার নামধারী ভয়ঙ্কর ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে সে মিথ্যাচার করে নিজের পক্ষে সাফাই গাচ্ছে বলে মন্তব্য করে কয়েক মুক্তিযােদ্ধা বলেন, সাদ মিয়ার কথা সত্য হিসাবে মেনে নিতে হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই মিথ্যা হয়ে যাবে।
জনকণ্ঠ ॥ ০২-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন