You dont have javascript enabled! Please enable it! কামারুজ্জামান দশ কুখ্যাত নরঘাতকের একজন - সংগ্রামের নোটবুক

শেরপুর

কামারুজ্জামান দশ কুখ্যাত নরঘাতকের একজন

মনিরুল ইসলাম লিটন, শেরপুর থেকে ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে হত্যাখুনের অন্যতম পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী ঘাতক কামারুজ্জামান (বর্তমানে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল) প্রথম বদর বাহিনী গঠন করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলে। তখন শেরপুরে অবস্থানরত পাকি মেজর রিয়াজের “প্রডাকশন” এই ঘাতক কামারুজ্জামানের সশস্ত্র বদররাই এলাকায় নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুটপাট, ধর্ষণ চালিয়েছিল। এরা বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার নিরীহ মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে শেরপুরের বধ্যভূমিগুলােতে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। কামারুজ্জামান ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা। পাকি হানাদার বাহিনীর সহায়ক এদেশীয় এক উৎকৃষ্ট ঘাতক হিসাবে কামারুজ্জামানই সেদিন এ দায়িত্ব নিয়েছিল। দেশে হাতে গােনা ১০ কুখ্যাত নরঘাতকের মধ্যে এই কামারুজ্জামান একজন। কামারুজ্জামান শেরপুরে তার সহচর হিসাবে আরও কয়েক কুখ্যাত ঘাতককে বেছে নিয়েছিল। এরা হলাে, কামরান (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই অবস্থা বুঝে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়), জয়নাল আবদীন (প্রথমে দৈনিক মিল্লাত, বর্তমানে সাপ্তাহিক সােনার বাংলার বার্তা সম্পাদক), সুজা তালুকদার, হযরত আলী (বর্তমানে কাজী), আব্দুল বাকের (বর্তমানে স্বঘােষিত পীর), হবিবর রহমান (হবি হাজী), সুরুজ্জামান (ঝিনাইগাতী মালিঝিকান্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের মৌলভী শিক্ষক)। অবশ্যই এরা ছাড়াও বদর বাহিনীতে আরও বহু সদস্য ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল দিনগুলাের দিকে তাকালেই শেরপুরবাসীর মনে পড়ে এই ঘাতক দলটির কথা। এরা শেরপুর শহরের নয়ানী বাজারস্থ সুরেন্দ্র মােহন সাহার দ্বিতল ভবনটিতে কুখ্যাত বদর বাহিনীর ক্যাম্প গড়ে তােলে। এই ভবনের উপর তলায় বসত কামারুজ্জামান তার ঘাতক সহচরদের নিয়ে। নিচতলায় করা হয়েছিল নির্যাতনের অন্ধকার গারােদখানা। প্রতিদিন ঐ গারােদখানা ভরা হতাে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকার নিরীহ মানুষদের ধরে এনে। তারপর রাতের আঁধারে ঘাতকরা চোখ বেঁধে তাদের ঝিনাইগাতীর আহম্মদনগর, কয়েরি রােড এসব বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করত। শেরপুর শহরের উপকণ্ঠে শেরী ব্রিজ এবং ঝিনাইগাতীর বগাডুবি ব্রিজ ঘাতকদের মানুষ খুন করার দুটি স্পট ছিল । নিরীহ মানুষজনকে ধরে আনার সময় বলা হতাে কামারুজ্জামান সাহেব আপনাকে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলেছে। কোন মাবাবারই সাধ্য ছিল না এই ঘাতক কামারুজ্জামানের দলের হাত থেকে তাদের সন্তানকে বাচানাের। দিনের বেলা কুখ্যাত বদররা ঐ ক্যাম্পে পবিত্র ইসলামের নামে। পাকিস্তানীদের জয়গান গাইত। উচ্চ সুর তুলত পাকিস্তানের উৎস কি- লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ইত্যাদি। আর গ্রামের নিরীহ কৃষকদের কাছ থেকে জোর করে গবাদিপশু ছিনিয়ে এনে ক্যাম্পে জবাই করে খেত। মৌজ করত। রাতে চলত তাদের মানুষ খুন করার পালা।

শেরপুর কলেজের (বর্তমানে সরকারী কলেজ) ছাত্র গােলাম মােস্তফাকে পরীক্ষা শেষে ধরে নিয়ে ঘাতক কামারুজ্জামানের দল শেরী ব্রিজে গুলি করে হত্যা করে। শহীদ গােলাম মােস্তফার মা মাহমুদা খাতুন স্বাধীনতার পর কামারুজ্জামান ও তার সহচরদের ব্রিরুদ্ধে শেরপুর সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। পরে হত্যা মামলাটি নানাভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। শহীদ জননী মাহমুদা খাতুন বর্তমানে শেরপুর জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়িকা। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে এই প্রতিনিধিকে তিনি জানান, সেদিন গােলাম মােস্তফাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ শুনে শহীদ জননীর। পিতা সৈয়দ আহাম্মদ জ্ঞান হারিয়ে মারা যান। তার ক্ষোভ- নরঘাতক কামারুজ্জামানদের এদেশে বিচার হলাে না। শহীদ গােলাম মােস্তফার সাথে যােগাযােগ ছিল এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের। গােলাম মােস্তফার খালাত ভাই শাজাহান আলী তালুকদার স্মৃতিচারণ করে বলেন, দিনটি ছিল ২৪ আগস্ট। ঐ দিন তিনি এবং গােলাম মােস্তফা একই সাথে শেরপুর কলেজে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। গােলাম মােস্তফাকে ধরার উদ্দেশ্যে প্রথমে কলেজে ঢুকেছিল কামারুজ্জামানের এক ঘাতক সহচর। পরীক্ষার হল থেকে বের হবার পরই তারা গােলাম মােস্তফাকে ধরে কামারুজ্জামানের ঐ ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে চালানাে হয় তার ওপর শারীরিক নির্যাতন। পরে রাত ৮টার দিকে শহরের শেরী ব্রিজে নিয়ে তাকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেখানে এক সাথে হত্যা করা হয় ৬/৭ জনকে।

এই গণহত্যার এক জীবন্ত সাক্ষী হলেন শ্রীবরদী এলাকার রানী শিমুল গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম। মুক্তিযােদ্ধাদের সাের্স বলে তাকে ধরে আনা হয়েছিল। কামারুজ্জামান তাকে হত্যা করার হুকুম দিয়েছিল। আবুল কাশেম জানান, শেরী ব্রজে এক এক করে হত্যা করা হচ্ছিল সকলকে। গােলাম মােস্তফাকে গুলি করা নিয়ে ঘাতক কামরান ও জয়নাল আবদীনের মধ্যে চলে প্রতিযােগিতা। অবশেষে ঘাতক জয়নাল আবদীন তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর কাশেমকে গুলি। করার আগেই সে মৃগী নদীতে ঝাপ দিয়ে ঐ রাতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। পানিতে গুলি ছুড়েও ঘাতকরা তাকে হত্যা করতে পারেনি। ঘাতকরা প্রতিরাতেই এমন হত্যালীলা চালাত এলাকায়। এভাবেই কামারুজ্জামানও হয়ে ওঠে দেশের হাতে গােনা ১০ কুখ্যাত নরঘাতকদের মধ্যে একজন। অসংখ্য মানুষ খুন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। কামারুজ্জামান এখন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা। এমপি হবার জন্য ভােট এলেই এলাকার মানুষের কাছে কামারুজ্জামানও প্রতিবার ভােট ভিক্ষায় নামে। কিন্তু এই ঘৃণিত। ঘাতককে মানুষ কখনও গ্রহণ করেনি। কামারুজ্জামানের বাড়ি শেরপুরের বাজিতখিলা গ্রামে।

জনকণ্ঠ ॥ ২২-১২-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন