You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযোেদ্ধা হত্যা করে যে উল্লাস করত সেই আসলাম আজ ফেঞ্চুগঞ্জের সমাজপতি - সংগ্রামের নোটবুক

সিলেট

মুক্তিযোেদ্ধা হত্যা করে যে উল্লাস করত সেই আসলাম আজ ফেঞ্চুগঞ্জের সমাজপতি

হাবিব-উর-রহমান, সিলেট থেকে ॥ জয় বাংলা স্লোগান শুনলেই যার মাথায় রক্ত চড়ে যেত, মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা ও নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যে মনে করত তার প্রিয় পাকিস্তান টিকে যাবে, সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জের সেই কুখ্যাত রাজাকার আসলাম উদ্দিন এখন সমাজপতি। ফেঞ্চুগঞ্জ থানার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়াসহ বহু। মুক্তিযােদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী মানুষ হত্যাকারী এই রাজাকার এখন যুগপৎ ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা। আশির দশকে সে বিএনপি করত। বর্তমানে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি, মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার স্থানীয় শাখার সদস্য ও মানিককোনা বাজার কমিটি সেক্রেটারি। সামাজিক সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তির জন্য কেউ এখন অলক্ষ্যেও তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পায়। কুশিয়ারা নদীর কূলঘেঁষা ফেঞ্চুগঞ্জ থানা সদরে একটি বড় গুদাম একাত্তরের রাজাকার ও পাকি সেনাদের হাতে মুক্তিযােদ্ধা আর স্বাধীনতাকামী শত শত মানুষ হত্যার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে আজও টিকে রয়েছে। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি খাইয়ার গুদাম’ নামে। পরিচিত। এই গুদামটির পাশ দিয়ে যাবার পথে এলাকার মুক্তিযােদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের অনেকের চোখ ছলছল করে ওঠে। তাদের মনে পড়ে যায় একাত্তরের মর্মস্পর্শী স্মৃতির কথা। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার আর পাকিরা মিলে এই গুদামকে মানুষ নিধনের নিরাপদ কসাইখানা বানিয়েছিল। এখানে শুধু ফেঞ্চুগঞ্জের মুক্তিকামী মানুষকে নয়, পার্শ্ববর্তী গােলাপগঞ্জ, বালাগঞ্জ, রাজনগর ও কুলাউড়ার মানুষ ধরে এনে জড়াে করা হতাে। তার পর নারকীয় উল্লাসে। তাদের হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া হতাে পার্শ্ববতী কুশিয়ারা নদীতে আর এসব হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নায়ক ছিল এই আসলাম উদ্দিন। সাবেক সেনা সদস্য হওয়ায় সে সময় পাকিদের সঙ্গে তার দোস্তি ছিল। যখন যেখানে খুশি অপারেশন। চালানাের জন্য পাকি সেনাদের নিয়ে যেত সে। মুক্তিযােদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালানাে ও বাড়িঘর লুটপাটে সে ছিল সিদ্ধহস্ত।

ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে চার কিলােমিটার পূর্বে আসলামের জীর্ণ কুটির ছিল সে সময়। রাজাকারদের প্রধান লিয়াজো সেন্টার। ফেঞ্চুগঞ্জের এক মুক্তিযােদ্ধা পরিবারের সন্তান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে এক রাতে বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা বাদশা মিয়ার মানিককোনার বাড়িতে এই রাজাকার কমান্ডার আসলাম পাকি সেনাদের নিয়ে যায়। সেখানে তাকে ঘুম থেকে তুলে টেনেহিঁচড়ে বাইরে। বের করে আনে। এরপর তার ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে। প্রতিরাতেই আসলাম বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের তল্লাশি করত। সেই সঙ্গে চালাত লুটপাট। এ অবস্থায় রাজাকারদের অত্যাচার-নির্যাতন যখন চরমে পৌছল তখন গােলাপগঞ্জের শান্তির বাজারে এক রাজাকার সদস্য ধরা পড়লে ক্ষুব্ধ। মুক্তিযােদ্ধারা তাকে হত্যা করে। নিহত এই রাজাকার ছিল আসলাম উদ্দিনের ভাই। ছােট ভাইয়ের নিহত হবার খবরে সে প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে আরও হিংস্র হয়ে ওঠে সে তার রাজাকার বাহিনীকে শান্তির বাজারের পার্শ্ববর্তী নূরজাহানপুর ও বঙ্গজিওল। গ্রামের মানুষের ওপর লেলিয়ে দেয়। সিলেট জেলা মুক্তিযােদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মােঃ রফিকুল হক বলেন, তিনি নিজে আসলামের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যগুণে পরে প্রাণে। বেঁচে যান। রফিকুল হক বলেন, সে সময় তিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর একটি গ্রুপের কমান্ডার।

২০ আগস্ট তার গ্রুপের ৪ সদস্য-শওকত আলী, নূরুজ্জামান, কুতুব উদ্দিন। ও ফয়েজ আহমদ এক অপারেশন চালাতে গিয়ে আসলাম বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু এ খবর তারা জানতেন না। এই চার মুক্তিযােদ্ধা ফিরে না আসায় তিনি ও তার সহকারী কমান্ডার সাজ্জাদুর রহমান পরদিন ভােরে একটি নৌকাযােগে তাদের খোঁজে মানিককোনা গ্রাম সংলগ্ন হাওরে গিয়ে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পরে অবশ্য। নির্যাতন-দুর্ভোগ সহ্য করে তারা মাস দুয়েক পর ছাড়া পান। স্বাধীনতার পর মুক্তিযােদ্ধারা আসলাম উদ্দিনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ালেও কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় যে, সে আত্মগােপন করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আর এর সবই সম্ভব হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন অর্জিত লুটপাটের বিপুল অর্থ-সম্পদের বদৌলতে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর সে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে। অবৈধ অর্থ, সম্পদ আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জোরে ধীরে ধীরে সমাজে, তার অবস্থান গড়ে তােলে। বর্তমানে সে এমন এক সামাজিক অবস্থানে গিয়ে পৌছেছে যে, তাকে ছাড়া এলাকায় আজ কোন সালিশ-বিচার হয় না।

জনকণ্ঠ ॥ ০৪-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন