You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঝিনাইগাতীর ঘাতক সুরুজ মিয়া এখন ইমাম ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করে বেড়ায়

মনিরুল ইসলাম লিটন, শেরপুর থেকে ॥ ৭১’র ঘৃণিত পাকি দালাল শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী এলাকার সুরুজ মাওলানা এখন মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক। এলাকার ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করে বেড়ায়। ঝাড়ফুক দেয়- ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শেরপুর সীমান্তের ঝিনাইগাতী এলাকার কুখ্যাত সুরুজ মাওলানা গড়ে তুলেছিল রাজাকারআলবদরদের নিয়ে ঘাতক বাহিনী। এলাকাবাসীর মতে, তখন ঘাতক সুরুজের অস্ত্রধারী সহচর হিসাবে ছিল তার সহােদর ভাই আয়নল ও জাহের আলীসহ এলাকার আশরাফ খলিফা, উসমান গনি (বর্তমানে ঝিনাইগাতী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক), মােহাম্মদ আলী মাওলানা (মৃত) আহাম্মদ মেম্বার, ইসমাইল হােসেন (বর্তমানে জামায়াত নেতা), হােসেন মুন্সী, আফাজ চেয়ারম্যান, হযরত মেম্বার (মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত), নুরু (মৃত), রওশন আলী (মৃত), কাশেমসহ আরও অনেকে। এলাকায় এই নরঘাতক সুরুজের হাজারাে কুকীর্তির কাহিনী রয়েছে। ঝিনাইগাতীর আহাম্মদনগরে পাকিদের ক্যাম্পে বসে ঘাতক সুরুজ হত্যা খুনের পরিকল্পনা করত। বনগাঁও গ্রামে বৃদ্ধ কৃষক আফরােজকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল। তার অপরাধ, পার্শ্ববর্তী রাঙ্গামাটি ঘােষপাড়া গ্রামের হিন্দু লােকজনকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। অনেককে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করেছিলেন। বৃদ্ধ আফরােজ পায়ে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন ঘাতক সুরুজের কাছে। লাভ হয়নি।

ঝিনাইগাতীর মহারশী নদীর পাড়ে এসে একটু পানির জন্য আর্তনাদ করেছিলেন। পানি নিয়ে এসেছিলেন হাদি নামে আরেক কৃষক তার বাড়ি থেকে পানি আর খেতে পারেননি। পথেই আফরােজকে গুলি করে হত্যা করেছিল ঘাতক দল। এলাকার কৃষক হাদি এখনও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। আফরােজের বাড়িতে আশ্রিত শতাধিক হিন্দু লােকের ওপরও ঘাতক সুরুজ তার সহচর ও পাকি হানাদারদের নিয়ে বর্বরােচিত নির্যাতন চালিয়েছিল সেদিন। অনেকের মাথা ন্যাড়া করে কলেমা পড়িয়ে গরুর মাংস খাইয়ে মুসলমান বানিয়েছিল। ঘাতক সুরুজ ও আহাম্মদ মেম্বারের ইঙ্গিতে ঝিনাইগাতীর খৈলকুড়া গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা মকবুলের ছেলে খালেক (১৩) ও ঝিনাইগাতী বাজারের মুক্তিযােদ্ধা সিদ্দিকুর রহমানের ছােট ভাই ওমর ফারুক (১১)কে দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘাতকরাই ঝিনাইগাতীর আওয়ামীসমর্থক সাইদুর রহমান ওরফে ছুডিকে পাকি মেজর রিয়াজের হাতে তুলে দিয়ে সেদিন হত্যা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পথে অপরিচিত দুই ছাত্রকে এলাকায় পেয়ে ঘাতক সুরুজ নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এমন বহু হত্যাখুনের হােতা নরঘাতক সুরুজের এসব নির্যাতনের কাহিনী ঝিনাইগাতীর মানুষ এখনও ভােলেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এলাকার নিরীহ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে তার দোর্দণ্ড দাপট। এলাকায় ঘাতক সুরুজের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, বিভিন্ন মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাত, প্রতারণা, মাদ্রাসা পরীক্ষা কেন্দ্রে বদলি পরীক্ষা দেয়ার অভিযােগসহ নিজের বাবাকে মারপিট করার মতাে কুলাঙ্গারী কাহিনীও রয়েছে।

এলাকার এক শিক্ষক বলেছেন, ঝিনাইগাতী উপজেলার রামনগর গ্রামের মৃত আকবর আলীর ছেলে সুরুজ আলীর মাদ্রাসা সার্টিফিকেটে লেখা সুরুজ মিয়া। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলের পােস্টারে মাওলানা সুরুজ্জামান লিখে বড় মাপের পরিচয় দিয়ে বয়ান করে বেড়ায় । ঝিনাইগাতী এলাকায় ঘাতক সুরুজের নাম নিতেই সাধারণ মানুষ মুখ কুঁচকে ঘৃণা জানায়। ঘৃণাভরে অনেকে জানিয়েছেন, এমন পাপিষ্ঠ ব্যক্তি এখনও মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে টিএনও’র গাড়িতে করে বেড়ায়। মসজিদের ইমামতি করে। গাছের একটি আম খাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘাতক সুরুজ তার বৃদ্ধ বাবা আকবর আলীকে মারপিট করেছিল নিজের হাতে। ভাত। পেয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করে বেচারা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এমন কুলাঙ্গারের কাহিনী ঝিনাইগাতীর মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। অনেকে বলেছেন, এই কুখ্যাত সুরুজই এখন মা-বাবাকে খেদমত করার বয়ান করে ওয়াজ মাহফিলে । দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকেছে সুরুজ। পরে হঠাৎ করে নালিতাবাড়ীর রাজনগর তার শ্বশুরের এলাকার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করে। কথিত আছে, নারী কেলেঙ্কারির অভিযােগে সেখান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর ঝিনাইগাতীর বনগাঁও হাফেজ উদ্দিন হাই স্কুলে মৌলভী শিক্ষক হিসাবে যােগ দেয়। একই অভিযােগের কারণে এখান থেকেও তাকে বিতাড়িত করা হলে ঝিনাইগাতী বাজার জামে মসজিদে ইমামতির চাকরি নেয়। কিন্তু অতীত কুকর্ম আর নিজের বাবাকে মারপিট করার ঘটনা জেনে প্রথম দিন জুমার নামাজ পড়ার পর ঐ মসজিদের মুসল্লিরা আর ঘাতক সুরুজের পিছনে নামাজ পড়েননি।

এলাকাবাসী অভিযােগ করেন, ইতােপূর্বে সুরুজ নালিতাবাড়ীতে মাদ্রাসা কেন্দ্রে এক পরীক্ষার্থীর বদলি পরীক্ষা দিতে গিয়ে ধরা। পঁড়ে নাজেহাল হয়েছিল। অবশেষে এলাকার মানুষের হাতে-পায়ে ধরে ঘাতক সুরুজ ঝিনাইগাতীর দীঘিরপাড় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা নেয় এখানেও রয়েছে তার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ। মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়ােগকে কেন্দ্র করে মামলায় জড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাটি এখন ধ্বংসের মুখােমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ‘৭১-র খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগসহ বহু কুকর্মের হােতা দেখতে কুৎসিত জল্লাদের মতাে চেহারার ঘাতক সুরুজ এখন এলাকার টিএনও’র গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায় দোর্দণ্ড দাপটের সঙ্গে। তিনানী বাজার জামে মসজিদের ইমামতি করে সে। মানুষকে ঝাড়ফুঁক দেয়। ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। নতুন প্রজন্ম জানে না এই কুখ্যাত নরঘাতকের আসল পরিচয়। ঘাতক সুরুজ এখনও এলাকার মানুষকে বােকা বানিয়ে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে তার ধর্ম ব্যবসা।

সুরুজ মাওলানার বক্তব্য

তথ্য অনুসন্ধানকালে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘৭১-এর ঘৃণিত ঘাতক সুরুজ মাওলানার সঙ্গে  এই প্রতিনিধির কথা হয়। ‘৭১-এ মানুষ খুনসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযােগ সে অস্বীকার করে। তবে, স্থানীয় আহম্মদনগর ক্যাম্পে তার যাতায়াত এবং পাকিদের নানা কাজ করে দেয়ার কথা সে স্বীকার করে। সে বর্তমানে ঝিনাইগাতী উপজেলা জামায়াতের একজন রুকন।

জনকণ্ঠ ॥ ০৩-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!