একাত্তরের ‘রাজাকার দিইল্লা’ এখন মওলানা সাঈদী
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ নেকড়ে যেমন মেষের ছদ্মবেশ নিলেও নেকড়েই থেকে যায়, তেমনি একাত্তরের নরপশু রাজাকার-আলবদররা স্বাধীনতার পর ভােল পাল্টালেও নরপশু রাজাকার-আলবদরই থেকে গেছে। পিরােজপুরের একাত্তরের ‘রাজাকার দিইল্লা স্বাধীনতার পর জনগণকে ধর্মকর্মের কথা শুনিয়ে মওলানা সাঈদী’ হলেও তার অধর্মের অপকর্মের কলঙ্ক ত্রিশ বছর পরও মুছে যায়নি। এখনও সাঈদীরা একাত্তরের স্বাধীনতাবিরােধী দালাল-ঘাতক ধর্ষকের নির্মমতা নৃশংসতার ভয়ঙ্কর প্রতীক। গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নিপীড়ন ইত্যাদির মাধ্যমে এরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের বিরােধিতা করেছে। এ সত্য থেকে এরা পলায়ন করতে পারে, কিন্তু সত্য নিষ্ঠুরভাবে আমৃত্যু তাদের ধাওয়া করে যাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে এই সাঈদীদের নাম উচ্চারিত হবে সীমাহীন ঘৃণায়। স্বাধীনতার পর নেতৃত্বের অদূরদর্শিতায় দেশে স্বাধীনতার শত্রু রাজাকার-আলবদরদের সাময়িকভাবে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পুনর্বাসন হয়েছে। কিন্তু লাখাে শহীদের রক্তের সিড়ি দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থাৎ একাত্তরের বাস্তবতাকে ইতিহাস কখনও বিস্মৃত হবে বলে রাজাকার-আলবদরদের প্রশ্নটি বার বার আসবে, যতদিন না মহাকাল শেষ রাজাকারটির চিহ্ন মুছে ফেলে। একাত্তরের রাজাকার দিইল্লা এখন মওলানা সাঈদী। সে জামায়াতে ইসলামীর মজলিশে। শুরার এক সদস্য এবং বিতর্কিত ব্যক্তি। সংসদের একজন সদস্যও। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযােগ, সে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী লাদেনের এক ভাবশিষ্য। বাংলাদেশে তালেবানী স্টাইলে ক্ষমতাদখলের অলীক স্বপ্ন যারা দেখে, তাদের একজন এই সাঈদী। জাতির দুর্ভাগ্য, সাঈদী সগর্বে ঘােষণা করে, তাকে রাজাকার প্রমাণ করতে পারলে সে সংসদ থেকে পদত্যাগ করবে। এমন দুস্পর্ধার পরও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে দাবিদার বর্তমান সরকার তার বিরুদ্ধে কোনও তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু পিরােজপুরের মুক্তিযােদ্ধা বয়েজউদ্দিন পশারী ও পারেরহাট ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আমজেদ হােসেন গাজি তার চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সাঈদী সে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। রাজাকার সাঈদীর বিরুদ্ধে এমনও অভিযােগ রয়েছে যে, সে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয়। ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের পিতা পিরােজপুরের মহকুমা পুলিশ সুপার ফয়জুর রহমান আহমেদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। অভিযােগটি আর কেউ নয়, এই . শহীদের কন্যা সুফিয়া হায়দার ও তার জামাতা আলী হায়দার খান করেছিলেন। ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির যুদ্ধাপরাধীর তালিকায়ও সাঈদীর নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এমন অভিযােগও রয়েছে, সাঈদী একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এত বেশি তৎপর ছিল যে, বিজয়ের প্রাক্কালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও আবদুল আজিজ নামে এক মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করেছিল। তদন্ত করলে এ ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যশাের কালেক্টরেটের জনৈক রশিদ মিয়ার বাসায় আত্মগােপন করেছিল। এর পর গােপনে পাড়েরহাট একবার এলেও ভয়ে জনসমক্ষে বের হতে পারেনি। তার পর দেশত্যাগে সে বাধ্য হয়। ১৯৮৫ সালে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত ১৪ বছর সে কোথায় ছিল তা কেউ বলতে পারে না। তার পর থেকে সাঈদী মওলানা হিসাবে পরিচিতি পায় এবং ধর্মসভা বা ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতা দিতে শুরু করে। অশ্লীল ও অশ্রাব্য কথায় ভরা তার ওয়াজে বাঙালী জাতিসত্তা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধিতা অতি সাধারণ বিষয়। ওয়াজের ক্যাসেটের মাধ্যমে তালেবান স্টাইলে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে সাঈদী।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী লাদেনের ভাবশিষ্য বলে সাম্প্রতিককালে তার পরিচয় ক্রমশ ব্যাপক হয়ে উঠছে। জানা গেছে, সাঈদী ঈদের পর অস্ট্রেলিয়ায় ধর্মসভা করতে যাচ্ছে। প্রবাসীদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন স্থানে সাঈদী ধর্মসভা করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। বিদেশের মাটিতে তার সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশীদের মধ্যে বিক্ষোভ এবারই প্রথম হতে যাচ্ছে না। একাত্তরে সাঈদীর ভূমিকা কি ছিল সে সম্পর্কে পাঠকরা জানতে চেয়েছেন। সরেজমিনে অনুসন্ধান করে আমাদের পিরােজপুর সংবাদদাতা জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার পাক সেনাদের হাতে মুক্তিযােদ্ধাদের তুলে দেয়া, হত্যা, দোকানপাট, বাড়িঘর লুটপাট, নির্যাতন-নিপীড়নে ‘দিইল্লা’ নামে পরিচিত সাঈদীর অপকর্মাদি নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা হলেও পাড়েরহাটের বাসিন্দারা আজও তা ভােলেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধই সউদখালি গ্রামের ইউসুফ আলী সিকদারের পুত্র দেলােয়ার হােসেন ওরফে দিইল্লার ভাগ্যকে বদলে দিয়েছে। যুদ্ধ শুরুর আগে এই দিইল্লা ছিল পাড়েরহাটের বাদুরা গ্রামের ইউনুস মুন্সীর ‘ঘরজামাই’। শ্বশুরালয়ে থাকা দিইল্লা ছিল বেকার। একটি মুদি দোকানে বসে আড্ডা মারত। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে দিইল্লা রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখায়। মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক ব্যক্তি ও পরিবার এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় সে এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, অচিরেই হানাদারদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। তাকে তিন শ’ সদস্যের এক রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়া হয়। জোর করে তরুণদের ধরে এনে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীতে নাম লেখাতে বাধ্য করত সাঈদী।
কেউ রাজাকার বা আলবদর না হতে চাইলে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হতাে বলেও অভিযােগ রয়েছে। এ সময় সে রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতা মওলানা দানেশ মােল্লা, মােছলেম মওলানা ও সেকান্দার সিকদারের নৈকট্য লাভ করে। পরবর্তীতে পিরােজপুর মহকুমার রাজাকারপ্রধান মাণিক খােন্দকার তাকে আলবদর বাহিনী গঠনের দায়িত্ব দেয়। সাঈদী তার চার রাজাকার সঙ্গীকে নিয়ে গঠন করে এক যৌথ তহবিল যা পরিচিত ছিল ‘পাঁচ তহবিল’ নামে। লুটের মালকে তারা গণিমতের মাল বলে আখ্যায়িত করত এবং পাঁচজনের মধ্যে ভাগাভাগি হতাে। যুদ্ধকালীন পাড়েরহাট বন্দরে সাঈদী তার অধীনস্থ রাজাকার ও আলবদরদের নিয়ে হেলালউদ্দিন পশারী, সইজউদ্দিন পশারী, রইজউদ্দিন পশারী, আমজেদ গাজির বাড়িসহ অর্ধশতাধিক দোকান লুট করে। পাড়েরহাট খেয়া সংলগ্ন সুলতান তালুকদারের ঘর দখল করে মুদি মনোেহারী দোকান নিজের নামেই চালু করে। একাত্তরের জুন মাসে বন্দরের উত্তর প্রান্তের মদনমােহনের বৃহৎ ও সুদৃশ্য বাড়িটি লুটপাটের পর ভেঙ্গে সাঈদী সেটি নিজ বাড়িতেই নিয়ে আসে।
আগস্ট মাসের গােড়ার দিকে গােপাল বণিক নামে এক মুক্তিযােদ্ধাকে আটক করে তাকে সে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। গােপালকে হানাদাররা পিরােজপুর বালেশ্বর ঘাটে গুলি করে হত্যা করে। সাঈদীর সহযােগিতায় একইভাবে ইউপি সদস্য কৃষ্ণ কান্ত সাহাকে হত্যা করা। হয় ঐ বালেশ্বর ঘাটে। এ ছাড়া সাঈদী বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নারায়ণ সাহা, বিপদ সাহা, মাখন সাহাসহ আরও কয়েক বণিকের দোকান লুট করে। লুণ্ঠনের পাশাপাশি বহু ঘরবাড়ি পােড়ানাে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের চাপের মুখে ধর্মান্তরিত করা, মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা তৈরি করে পাক বাহিনীকে দেয়া ও তাদের মাতাপিতাসহ আত্মীয়স্বজনকে হয়রানি, নির্যাতন ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অনেক অভিযােগ রয়েছে- যা সরকার তদন্ত করলে এখনও বিস্তারিতভাবে জানা যাবে। এই সাঈদীর বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযােগ, পাক বাহিনীর ভােগের জন্য বলপূর্বক মেয়েদের ধরে এনে সে তাদের ক্যাম্পে পাঠাত। ১৯৯৭ সালে সাঈদী সগর্বে বলেছে আমি মানুষ মেরে থাকলে আমার বিরুদ্ধে কোন মামলা হলাে না কেন?” সাঈদীর এ কথার জবাব বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ড. মুনতাসীর মামুন দিয়েছিলেন। শাহরিয়ার কবির মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ পরিবারের যে তথ্যচিত্র তুলেছেন তার কিছু অংশ ড. মামুন দেখে লিখেছেন,” সেখানে এক প্রৌঢ়া অশ্রুরুদ্ধ কষ্ঠে অভিযােগ করেছেন, তার স্বামীকে হত্যা করেছে সাঈদী এবং হত্যার বিচার চেয়েও তিনি তা পাননি। কারণ, এখন সাঈদীর যােগাযােগ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে।
জনকণ্ঠ ॥ ০৫-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন