You dont have javascript enabled! Please enable it!

পিরােজপুর মঠবাড়িয়ায় ৮ মেধাবী ছাত্রসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে জব্বার ইঞ্জিঃ বাহিনী

শওকত মিলটন/মিজানুর রহমান মিজু ॥ স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পরও জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নাম শুনলে মঠবাড়ীয়ার মানুষ শিউরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধকালে তার নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে তিনটি গ্রামের অসংখ্য মানুষকে, জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িঘর, লুট হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। সেই জব্বার ইঞ্জিনিয়ার এখন স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী। এই ব্যক্তি পিরােজপুর জেলা বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। মঠবাড়ীয়া আসনের জাতীয় সংসদের সাবেক প্রার্থী। এর আগে সে স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানও ছিল। ঘাতক জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে নিজের ইউনিয়ন সাপলেজার মানুষ সাপের মতাে ভয় করে। তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে গেলে তারা আতঙ্কিত হয়। একাত্তরের ভূমিকা। নিয়ে মুখ খুলতে ভয় পায়। যারা মুখ খুলেছে, সেসব সাহসী মানুষও স্মরণ করিয়ে। দিয়েছে তার দাপট সম্পর্কে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার জল্লাদ মামাশ্বশুর ইস্কান্দার মৃধা সম্পর্কে। বলেছে, ‘সাপলেজায় এসে সাপের লেজে পা দিয়ে ফিরতে পারবেন তাে?’ সাপলেজা ইউনিয়নের সাপলেজা গ্রামেই এমএ জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলাে। আইয়ুব আমলের মুসলিম লীগের এমএনএ জব্বার ইঞ্জিনিয়ার সুযােগ নিতে দ্বিধা করেনি। মঠবাড়ীয়া থানা শান্তি কমিটির সভাপতির পদে আসীন হয়ে। যায় পাকিদের পদলেহনের জন্য স্থানীয় নির্যাতিত গ্রামবাসী, মুক্তিযােদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের বলেছে একাত্তরে তার নানা কুকর্মের কথা তার মামাশ্বশুর ইস্কান্দার মৃধা ছিল তার নিধনযজ্ঞের সেকেন্ড ইন কমান্ড। স্থানীয় স্বাধীনতাবিরােধী মাদ্রাসাছাত্র আর সুযােগসন্ধানী লুটেরাদের নিয়ে। গঠন করে রাজাকার বাহিনী- যে বাহিনী চলত ঘাতক জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের পরিকল্পনা ও নির্দেশমতাে। বিজয়ের আগ পর্যন্ত এই জব্বার বাহিনী ছিল মঠবাড়ীয়ার মানুষের কাছে সাক্ষাত আজরাঈলের প্রতিচ্ছবি। জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের পরিকল্পনা অনুযায়ী মঠবাড়ীয়ার সবচেয়ে মেধাবী ৮ ছাত্রকে হত্যা করা হয়।

আর হত্যাযজ্ঞ শুরুও করেছিল সে নিজ গ্রাম সাপলেজা থেকেই। ১৯৭১ সালের ৬ মে তারিখটি এখনও সাপলেজার মানুষ ভুলতে পারে না। মঠবাড়ীয়া থানা মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার বাচ্চু মিয়া আকন সেই ভয়াল দুঃস্বপ্নের বর্ণনা দেন আমাদের। ঐ। দিন জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশমতাে মঠবাড়ীয়া থানার দারােগা জালাল ও রাজাকার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় ৯ জনকে। এরা হচ্ছে ১৯৬৬ সালে যশাের শিক্ষা বাের্ডে। এসএসসি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী গণপতি হালদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের মেধাবী ছাত্র বীরেন, প্রতিশ্রুতিশীল ছাত্রনেতা মঠবাড়ীয়া কলেজের তৎকালীন। ভিপি আনােয়ারুল কাদের, খুলনা কমার্স কলেজের ছাত্র জিয়াউজ্জামান ও তার ছােট ভাই ফারুকুজ্জামান, কলেজ ছাত্র অমল, শ্যাম ব্যাপারী, মালেক এবং স্কুলছাত্র গােলাম মােস্তফা। ফারুকুজ্জামানকে পরে ছেড়ে দেয়। বাকি ৮ জনকে মঠবাড়ীয়ার মানুষ আর। কখনও দেখেনি। পিরােজপুরের হুলারহাট নিয়ে ৮ মেধাবী ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা ২১ জুন। ১৯৭১ সাল। রক্তের হােলিখেলায় মেতে ওঠে জব্বার ইঞ্জিনিয়ার। তার নির্দেশে এক বিশাল জল্লাদ বাহিনী যায় সাপলেজা ইউনিয়নের ননী গ্রামে। ইস্কান্দার মৃধা, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নূর হােসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহাদাত হােসেন ২/৩শ’ রাজাকার নিয়ে এ অভিযান চালায়। তারা বাড়ৈ বাড়িতে হামলা করে। কিন্তু বাড়ৈ বাড়ির লােকজন প্রতিরােধের চেষ্টা করে। জল্লাদ বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে। ঐ বাড়ির ১৪ জনকে হত্যা করে। হত্যাযজ্ঞের পর তারা নির্বিবাদে লুটপাট চালায়।

সবশেষে অগ্নিসংযােগ করে ভস্মীভূত করে ‘মালাউন বাড়ি’। ৬ সেপ্টেম্বর ‘৭১। রাত ১২টা। ধানীসাপা ইউনিয়ন। গ্রামের নাম আঙ্গুরপাতাকাটা। “হিন্দুদের পাকিস্তানে জায়গা নেই’- জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের এ নির্দেশের কবলে পড়ে এ গ্রামটিও। জল্লাদ বাহিনী মিস্ত্রী বাড়ি, কীর্তনীয়া বাড়ি, হালদার বাড়ি, মাঝি বাড়ি, বালা বাড়ি এবং আরেক হালদার বাড়ির ঘুমন্ত মানুষদের ওপর হামলা চালায়। লুটপাট করে। ধরে নিয়ে যায় ৩৭ জনকে। প্রথমে নেয়া হয় থানায়। সেখানে অমানুষিক নির্যাতন চালানাে হয়। বন্দীদের মধ্যে ৭ জনকে মােটা অঙ্কের চাদার বিনিময়ে প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হয়। বাকি ৩০ জনকে চোখ এবং হাত বেঁধে থানার তিন কিলােমিটার দূরে সূর্যমণি মুইস। গেটসংলগ্ন বেড়িবাধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে ৯ জন বেঁচে যান অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়াদের একজন জ্ঞানেন্দ্রনাথ মিত্র। তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করায় জব্বার ইঞ্জিনিয়ার গং ক্ষুব্ধ ছিল। তাই আমাকেসহ আমাদের বাবা-চাচা ১৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়। শত কাকুতি-মিনতি করেও রেহাই পাইনি।’ ৯ জনের আরেক জন সন্তোষ মিত্র। তিনি বলেন, রাজাকার কমান্ডার ইস্কান্দার মৃধা বাড়িতে ঢুকেই হত্যার নির্দেশ দেয়।’ মঠবাড়ীয়া কেএম লতিফ ইনস্টিটিউশনের প্রাক্তন শিক্ষক সুধীন্দ্রনাথ মিত্র জানান,  একাত্তরে জব্বার ইঞ্জিনিয়ার তাকে মঠবাড়ীয়া ছেড়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। জব্বার ইঞ্জিনিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালে মঠবাড়ীয়ায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী উস্কানি দিত। সাপলেজার মুক্তিযােদ্ধা শামছুল হক এমন একটি সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, সাপলেজার কাচারীবাড়িতে এমন একটি সভা হয়। সেখানে জব্বার ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন, “হিন্দু এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পাকিস্তানে জায়গা নেই। হিন্দুদের সম্পত্তি গনিমতের মাল।

তা ভােগ করা মুসলমানদের জন্য জায়েজ।’ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ১৯৭৫ পর্যন্ত পালিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর সে আবার প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের জল্লাদ বাহিনীর হাতে নিহত জিয়াউজ্জামানের ভাই ফারুকুজ্জামান আমাদের জানান, ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে তার বাবা মতিউর রহমান জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে। ১৪ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২১ জুন জব্বার বাহিনীর হাতে নিহত বিনােদ বিহারী বিশ্বাসের ছেলে। যজ্ঞেস বিশ্বাস। ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে। ২শ’ ৬৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মামলা নং জিআর ১৮৬/৭২। অভিযােগ। আনা হয় হত্যা, লুট ও নির্যাতনের। ১৪ এপ্রিল ১৯৭৪ জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে চার্জশীট দাখিল করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে এ মামলা ধামাচাপা পড়ে যায়। গত ২১ বছরে সে মামলার খোজ কেউ রাখেনি। অথচ এ মামলাতেই তার বিচার সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন মঠবাড়ীয়া মুক্তিযােদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার লুতফর রহমান। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর প্রকাশ্যে এসে আবার সে মুসলিম লীগে সক্রিয় হয়। ৮৬’র নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়। আঁতাত করে স্বৈরশাসকের সাথে। জোর করে তার নাম বিজয়ী ঘােষণা করার অভিযােগ রয়েছে। ফুসে ওঠা জনতার ওপর সেনাবাহিনী গুলি চালালে ১৯৮৬ সালের ১৮ মে ৪ জন নিহত হয়। আহত হয় ১০ জন। জাতীয় পার্টির হয়ে ‘৮৮ সালে ভােটারশূন্য নির্বাচনে আবার সংসদ সদস্য হয়। ঐ বছরই পিরােজপুর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। মােট কথা, জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে আর পিছু ফিরে চাইতে হয়নি। ‘৯৬’র ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে সে যােগ দেয় বিএনপিতে ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আবারও সংসদ সদস্য। ‘৯১ এবং ‘৯৬’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের নির্বাচনে জনগণ তাকে ঠিকই প্রত্যাখ্যান করেছে। ‘৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মঠবাড়ীয়া থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিল। এখন জেলা বিএনপির প্রভাবশালী সদস্য ঢাকায় রয়েছে প্রাসাদোপম বাড়ি, একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। দেশ স্বাধীন হয়েছে ত্রিশ বছর। কিন্তু মঠবাড়ীয়ার মানুষ কখনও জব্বার ইঞ্জিনিয়ারদের অত্যাচারের বিভীষিকাময় সময়ের কথা ভােলেনি। তারা চায় তার বিচার।

জনকণ্ঠ। ২৩-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!