মেহেরপুর
মেহেরপুরের নারীলােভী কমান্ডার লতিফ এখন এক তালেবানী সংগঠনের নেতা
মহসিন আলী আঙ্গুর, মেহেরপুর থেকে ॥ বন্য হায়েনার মতাে জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ ও হত্যার হােলি খেলায় একাত্তরে মেতে উঠেছিল মেহেরপুর সদর থানার বুড়িপােতা ইউনিয়নের দক্ষিণ শালিকা গ্রামের রাজাকার কমান্ডার আব্দুল লতিফ মােল্লা। বাংলাদেশ আহলে হাদিস গ্রুপকে বিভক্ত করে সে তালেবান আদর্শে জামায়াতুল। মুসলিমিন নামে একটি সংগঠন করে মেহেরপুর জেলা আমিরের দায়িত্বে রয়েছে। জেলার গ্রামগঞ্জে সে প্রায় ৫ হাজারের অধিক জঙ্গী ক্যাডার বানিয়ে যখন তখন ফতােয়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িতে না পেয়ে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়দাতাদের ধরে নিয়ে তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করত। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবারের মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করত। ভারতের সীমান্তবর্তী বুড়িপােতা ইউনিয়নের গ্রামগুলাে থেকে ২/৩ কিলােমিটার দূরত্বে মেহেরপুর শহর। এখানে প্রতিনিয়ত মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের আক্রমণ করত। ফলে পাকি সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। মেহেরপুর শহর থেকে ৩/৪ গাড়ি পাকি সেনা নিয়ে লতিফ মােল্লা দক্ষিণ শালিকা গ্রাম আক্রমণ করে। পাকি সেনারা গ্রামের চারদিকে ঘেরাও করে চিরুনি অভিযান চালায়। এই সময় লতিফের পরামর্শে পাকি সেনারা গ্রামের ইসমাইল দাউদ, আলাউদ্দিন, আজগর রমজান, চাদৰক্স ফুলসেরাত ও আরও অনেকের বাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
তারা গ্রামের নারীদের এক জায়গায় জড়াে করে সুন্দরী অনেক নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতন করতে থাকে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঐদিন বুড়িপােতা গ্রামের পুণ্ড শেখের পুত্র আলাউদ্দিন তাদের গুলিতে নিহত হয়। মেহেরপুর মহকুমার ওয়াপদার বিদ্যুত লাইন বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা নিয়েছিল একদল মুক্তিযােদ্ধা। এদের পরিকল্পনা ছিল বােমা মেরে সাবস্টেশন উড়িয়ে দেয়া হবে। সে মােতাবেক সদর থানার ঝাউবাড়ীয়া গ্রাম দিয়ে মেহেরপুরে প্রবেশ করেন মােঃ রফিকুল ইসলাম, মােঃ মােজাম্মেল হক (বর্তমান বিএমপির জেলা দফতর সম্পাদক), মােঃ নাসির উদ্দিন (বর্তমান সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান কুষ্টিয়া সরকারী গণগ্রন্থাগার) ও মােঃ ওমরুল হুদা (বর্তমান অধ্যাপক নড়াইল সরকারী কলেজ)। ওয়াপদার পিছনে একটি আম বাগানে তারা ওত পেতে থাকেন। এ সময় রফিক সড়কে উঠে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে এসে পাহারাদার রাজাকার কমান্ডার লতিফের হাতে ধরা পড়েন। ছাত্রজীবনে একই সাথে পড়ার কারণে রফিক লতিফকে বােমার আঘাত করেনি। তবে লতিফ বলেছিল, তুই অস্ত্র ফেলে দে এবং আমিও ফেলে দিচ্ছি। রফিক অস্ত্র ফেলার সঙ্গে সঙ্গে লতিফ বাঁশি বাজালে। রাজাকার দল এসে রফিককে ধরে ফেলে। পরে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। মেহেরপুর শহরের মণ্ডলপাড়ার মােঃ মিষ্টি মণ্ডলের পুত্র মােঃ মক্কর মণ্ডলকেও সে হত্যা করে। আব্দুল লতিফের চেহারায় এখন বার্ধক্যের ছায়া পড়লেও তার হিংস্রতা কমেনি। ফতােয়াবাজি করে সে এলাকায় রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে শহীদ রফিকের বৃদ্ধ মা।
জহুরা খাতুন বলেছেন, লতিফের বিচার হতেই হবে। কারণ সে শুধু আমার সন্তানকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, অনেক নারীর ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে। মেহেরপুর কাশবপড়া জামাতুল মুসলিমিন ট্রাস্ট অফিস কক্ষে রাজাকার কমান্ডার আবদুল লতিফ মােল্লা এ প্রতিনিধিকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মেহেরপুর মহকুমায় পাক সেনাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার হাজী কর্নেল মােতালেব রব্বানীর সততার জন্য এখানে নারী ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি হয়নি। তার নির্দেশে আমাদের মুজাহিদ বাহিনী। এলাকার মানুষের মা-বােনদের ইজ্জত ও জানমালের নিরাপত্তা দিয়েছে বলে সে দাবি করে। রাজাকার আবদুল লতিফ অকপটে বলে, আমি ‘৭১ সালে মেহেরপুর সরকারী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। এপ্রিল মাসে পাক সেনারা আমার আব্বার। লাইসেন্সধারী বন্দুকটি নিয়ে যায়। এবং আমাকে মুজাহিদ ট্রেনিং নিতে বাধ্য করে। ট্রেনিং শেষে এপ্রিলের শেষ দিকে একটি রাইফেল হাতে তুলে দেয় এবং আমাদের ২৫ জন মুজাহিদকে মেহেরপুর শহর রক্ষার ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়। লতিফ জানায়, হােটেল বাজারের নিহত রফিক, মল্লিক পাল্লার আবদুর রাজ্জাক ও হেবলকে হত্যার অভিযােগ সঠিক নয়। আমি তাদের আদৌও চিনি না। তবে শুনেছি। পাকি বাহিনী তাদের হত্যা করেছে। সে আরও বলে, গাভীপুর, যাদবপুর, কালাচাদপুর, দক্ষিণ শালিকা গ্রামের ঘরবাড়ি পার্কি সেনারা পুড়িয়েছে। পাক সেনাদের চাপে মুজাহিদ ট্রেনিং নেয়াতে আওয়ামী লীগের রােষানলে পড়ি। তাই তারা আমাকে পাকসেনার দালাল বলে চিহ্নিত করে। আমি বাঁচার তাগিদে মুজাহিদ থেকে যাই। বাংলাদেশ স্বাধীন। হবার পর সরকার আমার বিরুদ্ধে নারী ধর্ষণ, খুন-রাহাজানি মামলা দায়ের করে। কুষ্টিয়া জেলা জজ কোর্টে সাক্ষী প্রমাণের মাধ্যমে আমি নিরপরাধ প্রমাণিত হই।
জনকণ্ঠ ॥ ১০-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন