You dont have javascript enabled! Please enable it! সিরাজগঞ্জের শিয়ালকোলের মজিবর স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও রাজাকার নামেই পরিচিত - সংগ্রামের নোটবুক

সিরাজগঞ্জের শিয়ালকোলের মজিবর স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও রাজাকার নামেই পরিচিত

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ ‘৭১-এর সেই রাজাকার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের মজিবর রহমান স্বাধীনতার ৩০ বছর পরও রাজাকার মজিবর নামেই পরিচিত। সে একবার শিয়ালকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে সে ছিল পাকি সেনাদের দোসর এবং তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহুকুমার তথাকথিত শান্তি কমিটির সদস্য। তার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহযােগিতায় পাকি সেনাদল এবং সিরাজগঞ্জ শহরের কতিপয় অবাঙালী শিয়ালকোল ইউনিয়নে বহু খুন, বাড়িঘরে আগুন এবং লুটতরাজ করেছে। সেই রাজাকার মজিবর চেয়ারম্যান এখনও এলাকার সমাজপতি। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৭ কিলােমিটার দূরে শিয়ালকোল ইউনিয়ন। ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন এলাকার বেশ ক’জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, মজিবর রহমান খাটি রাজাকার ছিল। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার মজিবরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে অনেকেই ভয় পান মুখ খুলতে। কেউ কেউ স্বাধীনতার ৩০ বছর পর পুরনাে কাসুন্দি ঘাটতে চান না। আবার অনেকেই সরাসরি বলেছেন তার কুকর্ম সম্পর্কে। ১৯৭১ সালের ১৭ জুন সিরাজগঞ্জে প্রথম পাকি সেনাদলের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয় ভদ্রঘাটে। ভদ্রঘাট শিয়ালকোল ইউনিয়নের পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন। ভদ্রঘাট ইউনিয়নের কালীবাড়ী, তেনাচেরাভদ্র ঘাট গ্রাম শিয়ালকোল ইউনিয়ন লাগােয়া। এখানেই যুদ্ধ হয় পাকি সেনাদের সঙ্গে। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৪/৫ জন নিহত হয়। পরে পাকি সেনারা গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে খুন করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এই অপকর্মে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছে সেই রাজাকার মজিবর। ভদ্রঘাটের যুদ্ধ’ শিরােনামে যুদ্ধকালীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার গাজী লুৎফর রহমান অরুন (যিনি সিরাজগঞ্জে সবার কাছে অরুণ দা নামে পরিচিত) লিখেছেন রাজাকার মজিবরের কথা।

তার লেখায় প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মজিবর ছিল শিয়ালকোল ইউনিয়নের জগতগাতি গ্রামের তথাকথিত শান্তি কমিটির  চেয়ারম্যান। ঐ শয়তানই পাকি হানাদার বাহিনীকে খবর দিয়ে এনেছিল ভদ্রঘাটে। ভদ্রঘাটে তখন ছিল পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের ক্যাম্প। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন বর্তমান আওয়ামী লীগের উল্লাপাড়া সংসদীয় এলাকার সংসদ সদস্য শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মির্জা। এই ভদ্রঘাটেই যুদ্ধে অংশ নেন যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা আমিনুল ইসলাম চৌধুরী । এই যুদ্ধে শহীদ হন এলাকার আজাহার আলী, ফজর রহমান, মঙ্গলা এবং আবুল হােসেন ভূইয়াসহ আরও অনেকে। এঁদের অপরাধ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করা। এর পর পরই পাকি সেনারা শিয়ালকোলে ঝাপিয়ে পড়ে। হত্যা করে ডজনখানেক মুক্তিপাগল মানুষকে এদের মধ্যে রয়েছে ফনি, শুটু, প্রেমচরণ, শিবচরণ প্রমুখ।  এ তথ্য জানালেন শিয়ালকোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান তালুকদার। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক (যার গ্রামের বাড়ি শিয়ালকোল ইউনিয়নের সারােটিয়া গ্রামে) আব্দুল হামিদ সরকার বললেন, রাজাকার মজিবর আমাদের বাড়ি পুড়িয়েছে। মুক্তিযােদ্ধা মরহুম দলিলুর রহমান দুলালের বাড়িতে আগুন দিয়েছে। এলাকার শতাধিক বাড়িঘর পুড়িয়েছে  নরহত্যা করেছে। সারাটিয়া গ্রামের তােমছের এবং মনছের আলীকেও রাজাকার মজিবরের নির্দেশে ধরে নিয়ে পাকি সেনারা হত্যা করেছে। সেই রাজাকার মজিবর রহমানের সঙ্গে আরও অনেকেই হত্যা এবং অগ্নিসংযােগের ঘটনায় জড়িত ছিল। তাদের মধ্যে কামারখন্দ উপজেলার পাইকশা গ্রামের মাওলানা ইসমাইল হােসেন অন্যতম। সে মারা গেছে। মজিবর রহমানও স্বাধীনতার পর প্রায় ২ বছর পালিয়ে ছিল। এলাকায় এখনও তার প্রভাব রয়েছে। তাকে এখনও এলাকার মানুষ রাজাকার মজিবর নামেই চেনে। পতিত স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে রাজাকার মজিবর শিয়ালকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিল।

মজিবরের মুখােমুখি

সিরাজগঞ্জের শিয়ালকোল ইউনিয়নের সেই রাজাকার মজিবর রহমান চেয়ারম্যান গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তার জগতগাতি গ্রামের বাড়িতে জনকণ্ঠের মুখােমুখি হয়। সে বলে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় (তার ভাষায় গণ্ডগােলের বছর) সে স্থানীয় শান্তি। কমিটির ১ নং ব্যক্তি ছিল। অর্থাৎ চেয়ারম্যান ছিল। তার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে সে বলে আমি (মজিবর) সঠিক কাজ করেছি। সত্যের পথে ছিলাম। বাড়িঘরে আগুন এবং নরহত্যাসংক্রান্ত প্রশ্নে সে বলে, আমি কোন অন্যায় কাজ করিনি। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান কেন- এ প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ওরা (মুক্তিযােদ্ধারা) আমার ক্ষতি করতে চেয়েছিল। তাই পালিয়ে ঢাকায় ছিলাম। এরই মধ্যে তার মেয়ে এবং বাড়ির মহিলারা ভিতর থেকে বলে, সে (মজিবর)। অসুস্থ, দু’বার স্ট্রোক করেছিল । সে বেশি কথা বললে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়বে। আপনারা চলে যান। এ সময় মজিবর চেয়ারম্যান তাদের থামিয়ে দিয়ে বলে, সে এখনও জামায়াতের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সে পাকি সেনাদের সঙ্গে ছিল -এ কথাও সে স্বীকার করেছে।

জনকণ্ঠ ॥ ১৯-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন