You dont have javascript enabled! Please enable it! ঠাকুরগাঁওয়ে মওলানা তমিজউদ্দিনের নেতৃত্বে চালানাে হয় খুন লুট নির্যাতন - সংগ্রামের নোটবুক

ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁওয়ে মওলানা তমিজউদ্দিনের নেতৃত্বে চালানাে হয় খুন লুট নির্যাতন

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ ১৯৭১-এ মুক্তিযােদ্ধা-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যখন বাংলার মাটিকে। পাক হানাদার নরপশুদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত করতে সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামে ব্যস্ত তখন ঠাকুরগাঁওয়ের পিস কমিটির সভাপতি মওলানা তমিজউদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েক ব্যক্তি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সার্বিক সহযােগিতা করে তাদের ছায়াতলে থেকে স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালায়। ‘৭১-এ স্বাধীনতাবিরােধী এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তির নির্যাতনের কাহিনী বলতে এখনও মানুষ শিউরে ওঠে এবং এখনও প্রকাশ্যে তাদের নির্যাতনের কাহিনী আর নাম বলতে অনেকেই ভয় পায়। অসংখ্য ব্যক্তি এ প্রতিনিধিকে জানান, ১৯৭১-এ তমিজউদ্দিনের নেতৃত্বে অনেকেই প্রকাশ্যে কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কেউ উচ্চবাচ্য করলে তাদের প্রকাশ্যে পাখির মতাে গুলি করে মারত অথবা ইপিআর ক্যাম্পে খবর দিয়ে পাক সেনাদের দ্বারা আত্মীয়স্বজনসহ সকলকে ধরে এনে খাচায় ভরে দিত এবং অমানুষিক নির্যাতন করত। নির্যাতনের ফলে ইপিআর ক্যাম্পের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠত। মওলানা তমিজউদ্দিন এবং রশিদুল হকের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গী এলাকায় রাজাকার-আলশামস বাহিনীর বিশাল এক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময়। তথাকথিত পাকিস্তানীদের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে মওলানা তমিজউদ্দিন জামায়াতে ইসলামীর আমির হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেয়। আফতাব উদ্দিন চৌধুরী এবং আজিজুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও সদরের জাঠিভাঙ্গায় আড়াই হাজার নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তাদের অর্থ-সম্পদ লুট করে নেয়া হয়।

শামসুল হক মাস্টারের নেতৃত্বে ঠাকুরগাঁও সদরের ইসলামনগরের সাত ব্যক্তিকে পাক সেনারা ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়। নিহতরা হলেন আহম্মদ হােসেন, মাজহারুল ইসলাম, ইয়াকুব হােসেন, ইসলামুল হক, সিরাজউদ্দিন, নুরুজ্জামান ও দবিরুল ইসলাম (মাহাদী)। এই শামসুল হক মাস্টার বর্তমানে জেলা বিএনপির একজন নেতা। সারা দেশের মানুষ যখন ইনকিলাব পত্রিকাকে বর্জন করছিল, সেই সাথে ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষ যখন ঠাকুরগাঁওয়ে মৌলবাদী পত্রিকাটি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছিল তখন ‘৭১-এর সেই রাজাকার শামসুল হক মাস্টার ঠাকুরগাঁওয়ে পত্রিকাটির পাঠক ফোরাম গঠনে নেতৃত্ব দিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপ খাটিয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ঐ পত্রিকা চালু রাখে। পাকিস্তানী খান সেনাদের এসব রাজাকার-আলবদর সহযােগিতা না করলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা শত্রুমুক্ত থাকত। দেশ স্বাধীন হলে মওলানা তমিজউদ্দিন আত্মগােপন করে। বঙ্গবন্ধু সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে। সে সময় আওয়ামী লীগের একটি অংশের সহযােগিতায় সে নাগরিকত্ব ফিরে পায়। তবে শর্ত ছিল, সে আর কোনদিন রাজনীতি করতে পারবে না।

কিন্তু ‘৭৫-এর বিয়ােগান্ত ঘটনার পর মওলানা তমিজউদ্দিন আবার তার স্বরূপে বেরিয়ে আসে এবং ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ হতে তালা-চাবি মার্কা নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। এখানেই শেষ নয়, ঠাকুরগাঁও শহর সংলগ্ন সালান্দর আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ পদে বহাল হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে জামায়াতের ঘাটিকে শক্তিশালী করে জামায়াতকে গতিশীল করে গড়ে তােলে। পাশাপাশি ঠাকুরগাঁওয়ের জামে মসজিদ এবং কেন্দ্রীয় ঈদগাহের ইমামের দায়িত্বে বহাল হয় এবং জেলার প্রধান কাজী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিয়ের কাবিননামার সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দেয়ায় তার কাজীগিরি বাতিল করা হয়।

‘৭১-এর ঘূণিত পিস কমিটির নেতা সেই রাজাকার মওলানা তমিজউদ্দিন সে সময়ে বাংলার স্বাধীনতাকে নস্যাত করতে প্রধান ভূমিকা রাখলেও এখন সে মসজিদের ও ঈদগাহের ইমামতি এবং বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের মধ্যমণি প্রধান বক্তা হিসাবে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বীরদর্পে সমাজে প্রতিপত্তি বজায় রেখেছে। স্থানীয় একটি এনজিওর উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত রয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অনেকেই মওলানা তমিজউদ্দিনের ইমামতিতে নামাজ পড়েন না। তারা আশা করেন, ঘৃণিত এসব রাজাকারের বিচার একদিন হবেই। তমিজউদ্দিনের বক্তব্য ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীকে সহায়তা প্রদানকারী ঠাকুরগাঁওয়ের হােতা পিস কমিটির সভাপতি মওলানা তমিজউদ্দিনকে ‘৭১-এ স্বাধীনতাবিরােধী কার্যকলাপের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে সে জানায়, সে কখনও ভাবেনি পাকিস্তান সরকারকে হটিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। সে ভেবেছিল, পাকিস্তান বহাল থাকবে। তাই সর্বত্র শান্তি বজায় রাখার লক্ষ্যে ঠাকুরগাঁওয়ে পিস কমিটির নেতৃত্ব। দিয়েছিল। সে সেসময় তার পরিচিত অনেক মানুষের জীবন রক্ষার চেষ্টা করেছিল, সেজন্যই ঠাকুরগাওয়ের মানুষ তাকে বড় মসজিদের প্রধান ইমাম এবং কেন্দ্রীয় ঈদগাহের ইমাম নির্বাচিত করেছে। নাগরিকত্ব বাতিলের ব্যাপারে সে বলে, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। সেসময় পাক হানাদারকে সহায়তা প্রদান করায় আজও সে অনুশােচনা করে এবং ভুল স্বীকার করে।

জনকণ্ঠ ॥ ২১-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন