You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিল্লা লাকসামের মুক্তিযােদ্ধা হত্যাকারী আদম শফিউল্লা এখন বিশিষ্ট শিল্পপতি

আবুল কাশেম হৃদয়, কুমিল্লা থেকে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনে দাড়িয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দৃষ্টি মেলে ধরলে দেয়ালঘেরা সুবিশাল এলাকায় যে দ্বিতল প্রাসাদটি দেখা যায় সেটি একটি সিগারেট ফ্যাক্টরি । কিন্তু তার নাম যা-ই থাকুক না কেন লাকসামবাসী এটাকে হত্যাপুরী বলেই চেনে-জানে। এই হত্যাপুরীতে নারী সরবরাহকারী ও মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহ রহমানসহ অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা হত্যায় সাহায্যকারী আদম শফিউল্লা ওরফে মুহাম্মদ জাকারিয়া এখন এ দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি এবং একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক। স্থানীয় বাগমারা ইউনিয়ন পিস কমিটির অন্যতম নেতা এই কুখ্যাত আদম শফিউল্লা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দু’বার নিজের নাম। এফিডেভিট করে বদল করেও মানুষের কাছ থেকে আড়াল করতে পারেনি নিজেকে। কুমিল্লা, লাকসাম, বাগমারা ও বরলের মানুষ এখনও তাকে রাজাকার আদম শফিউল্লা হিসাবেই চেনে-জানে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এপ্রিলের প্রথম দিকে লাকসামে যখন।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী প্রবেশ করেনি তখন পাকিস্তানের খাদেম এই রাজাকার আদম শফিউল্লাকে মুক্তিযােদ্ধারা ধরে চোখ বেঁধে ক্যাপ্টেন গাফফারের গাড়িতে করে ভারতের কাঠালিয়ায় নিয়ে যায়। শফিউল্লার সঙ্গে নেয়া হয় রাজাকার আফসার উদ্দিনকে। কিন্তু ভারতের কাঠালিয়ায় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে সে পালিয়ে দেশে ফিরে আসে। দেশে এসেই যােগ দেয় পিস কমিটিতে। সে হয় বাগমারা ইউনিয়ন কাউন্সিল পিস কমিটির অন্যতম নেতা। লাকসামের সিগারেট ফ্যাক্টরি ও কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থান নেয়া পাকি বাহিনীকে সে মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য প্রদান, চিহ্নিতকরণ ও নারী সরবরাহের দায়িত্ব পালন করত। তার সক্রিয় নেতৃত্বে ও ইশারায় কনকশ্রী গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহ রহমানসহ অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।

শহীদ মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহর পিতা মােঃ ইসহাক জানান, আমার ছেলে মেজবাহ রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার প্রশিক্ষণ নিতে ২০ এপ্রিল ‘৭১ ভারতে চলে যায়। ভারতের কাঠালিয়ায় গ্রুপ কমান্ডার আবুল বাশারের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাড়ির খবর নিতে লাকসামের পেরুল ইউনিয়নের কনকশ্রী গ্রামে আসে। বাড়ির খোজখবর নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে। ২৭ জুন পশ্চিমগাঁওয়ে গেলে রাজাকার আদম শফিউল্লা সহযােগীদের বলে একে ধরে আন’। রাজাকাররা মেজবাহকে ধরলে শফিউল্লা লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরিতে পাকি বাহিনীকে খবর দেয়। প্রথমবার পাকি সেনা না এলে দ্বিতীয়বার খবর দিলে পাক সেনার গাড়ি এসে মেজবাহকে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় জনৈক রফিক ডাক্তার সুপারিশ করলেও রাজাকার শফিউল্লা ও তার সহযােগীরা মানেনি। পাকসেনারা মেজবাহকে চোখ বেঁধে নিয়ে পশ্চিমগাঁও কলেজ প্রাঙ্গণে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে এবং পার্শ্ববর্তী ডাকাতিয়া নদীতে তার লাশ ফেলে দেয়। মােঃ ইসহাক পুত্র হত্যার কথা বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে আরও জানান, আমি পাগলের মতাে এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করেছি। কিন্তু শফিউল্লা ও ছনগাঁওয়ের জনৈক রাজাকারের (নাম মনে করতে পারেননি) মন গলেনি। তিনি জানান, ডাকাতিয়া নদীর পার্শ্ববর্তী তারাবাইয়া নামক এলাকার লােকজন আমার ছেলের লাশ নদী থেকে তুলেছিল। তারা দাফনেরও ব্যবস্থা করেছিল কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা এলাকাটি পাকি টার্গেটে পরিণত হবে এই ভেবে তাকে দাফন করতে দেয়নি। পরে আমার ছেলের লাশ আবার ডাকাতিয়া নদীতে ভাসিয়ে দেয়া দেশ স্বাধীনের পর লাকসামে রাজাকারের বিরুদ্ধে প্রথম যে মামলাটি হয়েছিল সেটি করেছিলেন শহীদ মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহর ভাই মমতাজ উদ্দিন আহাম্মদ। আদম শফিউল্লাসহ ছনগাঁওয়ের ঐ রাজাকার ছিল আসামী। ছনগাঁওয়ের রাজাকার ধরা পড়লেও ধরা পড়েনি শফিউল্লা। শুধু মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহ নয়, এমন অনেক মুক্তিযােদ্ধা ও অসংখ্য নিরীহ মানুষ হত্যায় সাহায্য করেছিল আদম শফিউল্লা। লাকসামের হত্যাপুরী।

সিগারেট ফ্যাক্টরিতে গ্রাম থেকে পল্লীবালা ও কুলবধূদের ধরে এনে উলঙ্গ করে কারখানার ছাদের ওপরে দু’হাত উপরে তুলে সারা দিন রেলিংবিহীন ছাদের ওপর হাঁটানাে হতাে। অনতিদূরে যাত্রীবাহী ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের এ দৃশ্য দেখানাে হতাে। রাতে-দিনে বিভিন্ন কোঠায় মেজর গার্দিজি ও তার দোসররা চালাত তাদের ওপর নির্মম পাশবিক নির্যাতন। চাবুকের আঘাতে এবং পাশবিক অত্যাচারে জর্জরিত রাতের গভীরতায় প্রায়ই ভেসে আসত মা-বােনদের বুকফাটা করুণ আর্তনাদ। হত্যা করে তাদের ফেলে দেয়া হতাে গর্তে। লাকসাম উপজেলা মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কুদুস, মুক্তিযােদ্ধা বদিউজ্জামান মজুমদারসহ অনেক মুক্তিযােদ্ধা জানান, আদম শফিউল্লা এই হত্যাপুরীতে নারী সরবরাহ করত। কত মেয়ের যে সে সর্বনাশ করেছে তার ইয়ত্তা নেই। একজন মুক্তিযােদ্ধা জানান, পাকিস্তান রেডিওতে ঐ সময় রাজাকার আদম শফিউল্লার একটি সাক্ষাতকারও প্রচারিত হয়। একদল বিদেশী সাংবাদিক লাকসাম পরিদর্শনে এলে এ সাক্ষাতকার নেয়। উল্লেখ্য যে, প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার দি রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ঐ সাংবাদিক দলকে বিশেষ সাংবাদিক’ বলে অবহিত করেছেন। আশির দশকে আদম শফিউল্লা প্রথমে নাম এফিডেভিট করে রাখে মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার। পরবর্তীতে আবার এফিডেভিট করে মজুমদার’ শব্দটি বাদ দেয়। এখন তার নাম মুহাম্মদ জাকারিয়া। সেই আদম শফিউল্লা এখন দেশের প্রথম সারির শিল্পপতি। দেশের একটি শিল্প গ্রুপের ভাইস। চেয়ারম্যান।

জনকণ্ঠ ॥ ২৫-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!