You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফরিদপুরের ভাঙ্গার মূর্তিমান আতঙ্ক জাকারিয়া এখন বিএনপি নেতা

প্রবীর সিকদার, ফরিদপুর থেকে ॥ একাত্তরে পাকি দোসর দুর্ধর্ষ রাজাকার কমান্ডার জাকারিয়া খলিফার হাত থেকে সেদিন রেহাই পায়নি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মালী গ্রামের কল্পনা ঘােষ ও মীন পাল। স্ক্রম হারানাে কল্পনা ছেড়েছে দেশ, মীনা এখন যন্ত্রণাদগ্ধ এক গৃহবধূ। শুধু কল্পনা, মীনা নয়, একাত্তরে সেই দুর্ধর্ষ জাকারিয়া বাহিনী নির্মমভাবে লুটে নিয়েছিল দু’শতাধিক মা-বােনের সম্ভ্রম, নৃশংসভাবে খুন করেছিল শতাধিক মুক্তিপাগল জনতাকে। সেই জাকারিয়া খলিফা এখন বিএনপি নেতা, থানা অফিস-আদালতের দালাল। জাকারিয়া খলিফা একাত্তরে ভাঙ্গা এলাকার এক মূর্তিমান আতঙ্ক। ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আজিজ খলিফার ছেলে এই জাকারিয়া খলিফা। আজিজ খলিফা নেতৃত্ব দেয় তথাকথিত শান্তি কমিটির, গঠন করে রাজাকার বাহিনী।

আর ভাঙ্গা থানা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত করে নিজের ছেলে জাকারিয়া খলিফাকে। অল্প কদিনেই নৃশংস সব যােগ্যতা প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজাকার কমান্ডার জাকারিয়া খলিফা হয়ে ওঠে দুর্ধর্ষ এক আতঙ্ক। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দুর্ধর্ষ এই কুখ্যাত জাকারিয়া বাহিনী নৃশংসভাবে খুন করে ভাঙ্গা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার শতাধিক মুক্তিপাগল জনতাকে; পৈশাচিক তাণ্ডব চালায় তৎকালীন ভাঙ্গা ইউনিয়নের ছিলারচর, হাজরাহাটি, রায়পাড়া সদরদী, ঘারুয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গারপাড়, হাজরাকান্দা, পালপাড়া, বিবিরকান্দি, হামিদী ইউনিয়নের জানদী, নওপাড়া, দিগনগর ইউনিয়ের দিগনগর, চুমুরদী ইউনিয়নের চুমুরদী, চান্দ্রা ইউনিয়নের মালী গ্রাম, চরযশােরদী ইউনিয়নের চরযশােরদী, নূরুল্যাগঞ্জ ইউনিয়নের ডাক্তার বাজার, আবদুল্লাহবাদ, কাউলিবেড়া ইউনিয়নের লােচনগঞ্জ, সদরপুর ইউনিয়নের ১৪ রশি, তুজারপুর ইউনিয়নের উচাবাড়িসহ অর্ধ শতাধিক গ্রাম জনপদে। দুর্ধর্ষ জাকারিয়া বাহিনীর ঘাটি ছিল আজকের ভাঙ্গা উপজেলা ভূমি অফিস।

রাজাকার কমান্ডার জাকারিয়া খলিফা ও তার কুখ্যাত সহচরেরা ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বাড়ি থেকে ডেকে এনে রাজাকার ক্যাম্পে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘারুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন লস্কর, সাধারণ সম্পাদক ডাঃ শাহজাহান মুন্সী, ছাত্রলীগ নেতা নাসির উদ্দিন রওশন ও সদরদী গ্রামের আইনউদ্দিনকে। রাজাকার ক্যাম্পেই (আজকের উপজেলা ভূমি অফিস) সেদিন তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে কুখ্যাত এই জাকারিয়া বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারান ঘারুয়া-পালপাড়ার পূর্ণ চন্দ্র পাল, ব্রজবাসী পাল, রাধা বল্লভ পাল, হাজরাকান্দার সুভাষ সাহার পিতা, চরযশােরদীর কেশব রায়, চুমুরদীর কল্যাণ রায়, ছিলাধরচরের গােপীনাথ দে, মালী গ্রামের রমেশ ঘােষ, সদরদীর আনােয়ার উদ্দিন মােল্লাসহ নাম না জানা অনেক মুক্তিপাগল মানুষ। ফরিদপুরের অন্যতম নৃশংস হতাকাণ্ডটি ঘটেছিল তৎকালীন ভাঙ্গা থানার হামিদী ইউনিয়নের জানদী গ্রামে।

হামিদী ইউনিয়নের নওপাড়া গ্রামের বিশিষ্ট পাকি দোসর ইমদাদ কাজী ওরফে ইংগুল কাজীর নির্দেশে কুখ্যাত জাকারিয়াই একাত্তরে পাকি সেনা বহর নিয়ে ঢুকেছিল জানদী গ্রামে। সেদিন পাকি ঘাতক সেনারা পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করেছিল টনিক সেন, উপেন সেন, জ্ঞানেন সেন, নিত্যানন্দ সেন, মঙ্গল সেন, মধুসূদন সেন, কালা সেন, সােমা সেন, ক্ষিরােদ দত্ত, নদে দত্ত, বিনয় সেন, গােবিন্দ চন্দ, রতিকান্ত চন্দ, সুধীর সেন, পঞ্চানন সেন, বটকৃষ্ণ চক্রবর্তী, মাধব দত্ত, প্রাণবল্লভ ধর, রবীন্দ্র নাথ, সুকেশ চন্দ্র, পন্টু কুমার, শঙ্কর সেন, দেবাশীষ দত্ত, শ্ৰীমন্ত দত্ত, জানদী রামকৃষ্ণ আশ্রমের মহারাজসহ ৩১ গ্রামবাসী-আশ্রিতকে। ৫০ গ্রাম জনপদে তাণ্ডব চালানাে এ জাকারিয়া বাহিনীর দুর্ধর্ষ সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে ছিল বেছে বেছে হিন্দু, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মুক্তিযােদ্ধাদের আটক করে নির্যাতন করা, খুন করা, তাদের ঘরবাড়িতে লুটপাট-অগ্নিসংযােগ করা, নারী ধর্ষণ ও পাকি সেনা ক্যাম্পে বাঙালী মা-বােন সরবরাহ করা, পাকি সেনা বহরকে পথ চিনিয়ে দেয়া। সেদিন এ বাহিনীর তাণ্ডব থেকে রেহাই পায়নি ভাঙ্গার ঐতিহ্যবাহী মদনমােহন জিউ মন্দির।

দু’হাজার বাড়িতে লুটপাট ও পাঁচ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে জাকারিয়া বাহিনী একাত্তরে ১০ কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে কুখ্যাত রাজাকার কমাণ্ডার জাকারিয়া ও তার পিতা কুখ্যাত পাকি দোসর আজিজ খলিফাকে পুলিশ আটক করেছিল। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছিল সুনির্দিষ্ট মামলা। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর এই কুখ্যাত দুর্ধর্ষ খলিফা পরিবার আবার ভাঙ্গা এলাকায় চালায় একাত্তরের বিভৎস তাণ্ডব। এদের তাণ্ডবের কাছে ঘারুয়ার খাড়দিয়াবাসীরা আজও সন্ত্রস্ত, জিম্মি। বিএনপির রাজনীতির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে থানা-অফিস-আদালতের দালালির মাধ্যমে প্রভাববলয় টিকিয়ে রেখেছে একাত্তরের সেই কুখ্যাত রাজাকার জাকারিয়া খলিফা। পাকি সেনা ক্যাম্পে নারী সরবরাহকারী শাহজাহান মাস্টারের ছেলে এএফএম ফয়েজ ক্ষমতাসীন দলের এক সংসদ সদস্যের আশীর্বাদে দখল করে নিয়েছে নবগঠিত ভাঙ্গা পৌরসভার সর্বোচ্চ আসন পৌর প্রশাসকের পদটি। আর জটিল এসব প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বহাল তবিয়তে দাপটের সাথেই টিকে আছে একাত্তরের কুখ্যাত খুনী-ধর্ষক-লুটেরা-রাজাকার জাকারিয়া খলিফা ও তার দোসর চক্র।

রাজাকার জাকারিয়া যা বলে একাত্তরের ভূমিকা প্রসঙ্গে জাকারিয়া খলিফা বলে, আমার আব্বা আজিজ খলিফা ছিলেন ঘারুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, জাদরেল মুসলিম লীগার। আমি ছিলাম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে। ছাত্রলীগ করতাম। একাত্তরে আমি ভাঙ্গা কেএম কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলাম। আব্বার নিরাপত্তার স্বার্থে আমি রাজাকার হয়েছিলাম। “গণ্ডগােলে’র নয় মাস আমি রাজাকার হিসাবে ভাঙ্গাতেই ছিলাম। ভাঙ্গার রাজাকার | বাহিনী লুটপাট, হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের মতাে অনেক জঘন্য অপকর্ম চালিয়েছে। তবে আমি কোন অপকর্মের সাথে জড়িত ছিলাম না। জনকণ্ঠ ॥ ১১-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!