You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফরিদপুর

ফরিদপুরের ঘাতক বাছুই এখন টিভি পর্দার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

প্রবীর সিকদার, ফরিদপুর থেকে ॥ একাত্তরের কুখ্যাত নরঘাতক, মা-বােনের সম্ভ্রম লুটেরা, পাকি দোসর, অর্ধশত গ্রাম-জনপদে ‘মেলিটারি’ নামের আতঙ্ক, খাড়দিয়ার বাই এখন একটি টিভি চ্যানেলে ইসলামী মূল্যবােধ সম্পর্কে নিয়মিত মতামতদানকারী ও ফতােয়া সম্পর্কিত হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে লিভ আবেদনকারী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। আর এসবের কিছুই জানে না নগরকান্দা উপজেলার দাদপুর ইউনিয়নের নতিবদিয়া গ্রামের শােভা রানী বিশ্বাস। একাত্তরে গােসাই পদ বিশ্বাসের নববধূ শােভা রানীর স্ক্রম অস্ত্রের মুখে লুটে নিয়েছিল আজকের এই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে খাড়দিয়ার কুখ্যাত সেই বাচ্চু। স্বামী-সন্তান নিয়ে জীবন্ত শােভা এখনও নরপশুদের পাশবিকতা শরীর-মন দিয়ে অনুভব করেন। সারা শরীরে তার এখনও ‘টন টন’ ব্যথা। একাত্তরের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারেন না শােভা। এ গ্রামেরই নগেন বিশ্বাসের স্ত্রী দেবী বিশ্বাসেরও সম্ভ্রম লুটেছিল এই বাচ্চু। সেই লজ্জায়-যন্ত্রণায় দেশ ছেড়েছে দেবী-নগেন, আর ফেরেনি। নতিবদিয়ার প্রবীণ দুই মৎস্যজীবী নকুল সরদার ও রঘুনাথ দত্ত এ ব্যাপারে জনকণ্ঠকে বলেন, লুটপাট-হামলা না করার শর্তে আমরা চাদা তুলে বাচ্চুকে দু’হাজার চার শ’ টাকা দিয়েছিলাম। তার পরও সে লুটপাট করেছে, গ্রামের দুই নববধূর ইজ্জত হরণ করেছে। পুরুরা গ্রামের জ্ঞানেন জীবন বাঁচাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। বাচ্চু সেখানেই তাকে নৃশংসভাবে খুন করে।

বাচ্চুর হাতের রাইফেলের গুলিতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান ফুলবাড়িয়ার চিত্তরঞ্জন দাস। সেদিন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জ্যোৎস্না পালিয়ে রক্ষা পেলেও একাত্তরে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তাঁর তিন শিশু সন্তান। সেই সব ভয়ঙ্কর স্মৃতির কথা স্মরণ করতে গিয়ে আজকের অসহায় বৃদ্ধ জ্যোৎস্না। বলেন, ‘আমরা হিন্দু মানুষ, বিচার চাওয়ার সাহস নাই। কেউ বিচার করলে মরেও একটু শান্তি পাতাম।’ বােয়ালমারী উপজেলার কলারন গ্রামের মনিময় রায় ওরফে কৃষ্ণ বাবু বাছুর হাতের রাইফেলের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে এখন চিরদিনের মতাে পঙ্গু। একাত্তরে বাদু ওরফে আজকের মাওলানা আবুল কালাম আজাদ মনিময় রায়ের বাবা। সুধাংশু রায়কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পাশের বটতলায় ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর রক্তাক্ত পিতাকে জড়িয়ে ধরার অপরাধে বাচ্চু মনিময়কেও গুলি করে।

গুলিতে গুড়িয়ে যায় মনিময়ের ডান পা। ফরিদপুর শহরের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের স্ত্রী এখন আর টেলিভিশনের পর্দার মুখােমুখি হন না এই ভয়ে-কখন সেই ম্ভ্রম লুটেরা বাছুর ছবি দেখতে হয়! নগরকান্দা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের বড় খাড়দিয়া গ্রামের সালাম মিয়ার ছেলে। বাচ্চু মিয়াকে অনেকেই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ নামে চেনে না। যারা চেনে আর তার একাত্তরের কুকীর্তির খবর জানে তারা তার ওয়াজ, তফসির শশানে না; ঘৃণা করে। সালাম মিয়ার ভাই ধলা মিয়া খুন হলে খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে বাছুর মা দুই শিশু সন্তান বাচ্চু ও হারুনকে নিয়ে আবার বিয়ে বসে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন মিয়ার সাথে । সেই থেকে একাত্তর অবধি দারিদ্রই নিত্যসঙ্গী ছিল। বাক্ষুদের । মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হয়েছিল বাচ্চু। বাকপটুতার কারণে সে কলেজে খুব পরিচিতি পায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকি সেনাদের সাথে সখ্যের কারণে তার হাতে চলে আসে অনেক অস্ত্র । আর সেই অস্ত্র-গােলাবারুদ নিয়ে সে বড় খাড়দিয়ার গ্রামের বাড়িতে তৈরি করে মিনি ক্যান্টনমেন্ট। গ্রাম ও আশপাশের শতাধিক যুবককে সে দলে টেনে দেয় প্রশিক্ষণ। গড়ে তােলে দুর্ধর্ষ এক সশস্ত্র পাকি দোসর বাহিনী। একাত্তরে খাড়দিয়ার চারপাশের ৫০ গ্রাম-জনপদের মানুষ। এ ভয়ঙ্কর বাহিনীকে জানত ‘খাড়দিয়ার মেলিটারি হিসাবেই ।

বাচ্চুর নেতৃত্বে খাড়দিয়ার এই ‘মেলিটারি বাহিনী এক এক করে লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, খুন, ধর্ষণ চালায়। তৎকালীন নগরকান্দা থানার খাড়দিয়া, ফুলবাড়িয়া, সােনাপুর, সালথা, কাগদি, বিষ্ণুদি, মাঝারদিয়া, যােগারদিয়া, উজিরপুর, পিসনাইল, কাসাইদিয়া, রাজনগর, পুরুরা; বােয়ালমারী থানার ময়েনদিয়া, শ্রীনগর, হাসামদিয়া, রাজাপুর, রাজাবিনি, হােগলাকান্দি, কালিনগর, কলারন, জয়পাশা, তেলজুড়ি, পরমেশ্বরদী, ডহরনগর, তামারাজি, মােড়া, নতিবদিয়া এবং আলফাডাঙ্গা, কাশিয়ানী থানার কয়েকটি গ্রামসহ ৫০ গ্রাম-জনপদে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে এখনও অনেক গ্রাম-জনপদে একাত্তরের ধ্বংসযজ্ঞের নানা স্মৃতি চোখে পড়ে। নরঘাতক বাচ্চু ও তার দুর্ধর্ষ সশস্ত্র বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে। হাসামদিয়ার হরিপদ সাহা, সুরেশ পােদ্দার, মল্লিক চক্রবর্তী, সুবল কয়াল, শরৎ সাহা, শ্রীনগরের প্রবীর সাহা, যতীন্দ্রনাথ সাহা, জিন্নাত আলী ব্যাপারী, ময়েনদিয়ার শান্তিরাম। বিশ্বাস, কলারনের সুধাংশু রায়, মাঝারদিয়ার মহাদেবের মা, পুরুরার জ্ঞানেন, মাধব, কালিনগরের জীবন ডাক্তার, ফুলবাড়িয়ার চিত্তরঞ্জন দাস, ওয়াহেদ মােল্লা, দয়াল, মােতালেবের মা, যবদুল, বাদল নাথ, আস্তানার দরবেশসহ বিভিন্ন গ্রাম-জনপদের শতাধিক মুক্তিপাগল মানুষকে। আর বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডই ঘটিয়েছে বাচ্চু ওরফে আজকের মাওলানা আবুল কালাম আজাদ নিজের হাতে।

একাত্তরে দুর্ধর্ষ এই বাচ্চুর। সহযােগী ছিল তার শ্বশুর চান কাজী, আপন ভাই হারুন, জাফর, মানিক চন্দ্র বিশ্বাস, মিঠু কাজী, লালু, মােহাম্মদ কাজী, মােসলেমসহ শতাধিক সশস্ত্র পাকি দোসর। পরে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে খুন হয়েছে জাফর, হারুন; কুষ্টিয়ায় আস্তানা গেড়েছে মানিক। বিশ্বাস। দেশ স্বাধীন হলে বাছু ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতে। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জেল থেকে বেরিয়ে একাত্তরে লুটে নেয়া কোটি টাকার সম্পদে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হয়ে ওঠে সেই বাছু। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চুর ছত্রছায়ায় সেই দুর্ধর্ষ বাহিনীর অনেকেই এবং তাদের উত্তরসূরিরা এখনও এলাকায় একাত্তরের মতই তাণ্ডব চালায়। বছর তিনেক আগেও পাশের গ্রামের প্রতিবাদী সাহসী যুবক, যুবলীগ নেতা ছিরু মিয়াকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। ছিরু মিয়ার অপরাধ ছিল বাজু ওরফে আজকের বিশিষ্ট মাওলানার একাত্তরের কুকীর্তি প্রচার করা। ফরিদপুর শহরেরই কিছু বিশিষ্ট লােক এক লাখ টাকার বিনিময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় চাঞ্চল্যকর ছিরু মিয়া হত্যা মামলার হুকুমের আসামী কুখ্যাত নরঘাতক খাড়দিয়ার বাছুর জামিনের ব্যবস্থা করেছিল সেদিন। ফরিদপুরের দুই বীর মুক্তিযােদ্ধা সােলায়মান আলী ও আমিনুর রহমান ফরিদ বলেন, তিন হাজার বাড়ি লুণ্ঠনকারী, এক হাজার ঘরবাড়ি-দোকানে অগ্নিসংযােগকারী, মুক্তিপাগল শতাধিক মানুষকে হত্যাকারী এবং শতাধিক মা-বােনের সম্ভ্রম লুটেরা বাচ্চু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ফরিদপুর শহরের চকবাজারের একটি বাড়ি দখল করে বানিয়েছিল তার আস্তানা। সে আস্তানাতেও নির্যাতিত হয়েছেন অনেক মা-বােন তার পরও কুখ্যাত বাঙ্গু ‘মাওলানা আবুল কালাম আজাদ’ নামের আড়ালে বিশিষ্টজন হয়ে ওঠায় বিক্ষুব্ধ এই দুই মুক্তিযােদ্ধাসহ ফরিদপুরের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সকল মানুষ। তাদের এখন একটাই প্রশ্ন- অসংখ্য মা-বােনের সম্ভ্রম লুটেরা ও একাত্তরের নরঘাতক। তথাকথিত ‘মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে খাড়দিয়ার বাছুর কি বিচার হবে। কখনও?

সংশােধনী

দৈনিক জনকণ্ঠের ১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় সেই রাজাকার প্রতিবেদনের ১১ পৃষ্ঠার ৪ কলামের ৮১ থেকে ৮৩ লাইনে ভুলবশত সেনা সদস্য অফির উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা। করে কথাটি লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হবে হত্যা করার উদ্দেশ্যে গুলি করে।

জনকণ্ঠ ॥ ০৫-০২-২০০১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!