You dont have javascript enabled! Please enable it! কুড়িগ্রামে অগ্নিসংযােগ লুটপাটের নায়ক মীর ইসমাইল হােসেন এখন সমাজসেবক - সংগ্রামের নোটবুক

কুড়িগ্রামে অগ্নিসংযােগ লুটপাটের নায়ক মীর ইসমাইল হােসেন এখন সমাজসেবক

রাজু মােস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে ॥ লুটপাট, অগ্নিসংযােগের নায়ক ‘৭১-এর রাজাকার  মীর ইসমাইল হােসেন এখন সমাজের গুণী মানুষ ও সমাজসেবক। তার নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মীর ইসমাইল হােসেন ডিগ্রী কলেজ। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপাশা ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান শামসুল হক, কুড়িগ্রাম কলেজের লাইব্রেরিয়ান আবদুল হামিদ, মুক্তিযােদ্ধা মােঃ সােহরাব মণ্ডল, জেলা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু, আওয়ামী লীগ নেতা আবুনুর। বললেন, ‘৭১-এর সেই দিনগুলােতে মীর ইসমাইল হােসেনের ঘৃণ্য ভূমিকার কথা। ঐ সময় রাজাকার মীর ইসমাইল ছিল চাকিরপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিবাহিনীর সাথে ছিল তার অবাধ যােগাযােগ। এ সুযােগে হয়ে যায় পিস কমিটির চেয়ারম্যান। তার ইশারায় বাজেমজরাই, খুলিয়াটারী, ঠাটমারী গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিবাহিনী। নাককাটি গ্রামের ষাটোর্ধ হেমন্ত মণ্ডল, মুক্তিযােদ্ধা খােকন ঘােষ, মুক্তিযােদ্ধা, গবেষক ও লেখক আখতারুজ্জামান মণ্ডল জানান, যুদ্ধকালীন সময় ঠাটমারী গ্রামে মুক্তিযােদ্ধারা এসে আশ্রয় নিত। তাদের  আসা-যাওয়া দেখে স্থানীয় রাজাকাররা খবর দেয় পাকি সেনাদের ক্যাম্পে। ‘৭১-এর  আগস্ট মাসের শেষের দিকে এক সকালে পাকিবাহিনী ঘিরে ফেলে ঠাটমারী, বাজেমজরাই ও খুলিয়াটারী গ্রাম।

গ্রামবাসী কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাকিবাহিনী গ্রামগুলােতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং গুলি চালিয়ে হত্যা করে নিরপরাধ প্রায় ২০  গ্রামবাসীকে তাদের সেদিন সমাহিত করা হয়েছিল ঠাটমারী ব্রিজের কাছে। আজও ঐ বধ্যভূমিতে নির্মিত হয়নি স্মৃতিফলক। এই লােমহর্ষক ঘটনার অন্তরালের নায়ক ছিল আজকের সমাজসেবক মীর ইসমাইল হােসেন। ‘৭১-এর ৩ আষাঢ় শুক্রবার মীর ইসমাইল হােসেনের নির্দেশেই ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের নিভৃতপল্লী সেনপাড়া গ্রামে। পাকিবাহিনী গণহত্যা চালায়। সে সময় পাকিবাহিনীর হাতে অন্য নিরীহ গ্রামবাসীসহ  নির্মমভাবে শহীদ হন দেবেন্দ্রনাথ। তার বিধবা স্ত্রী সাবিত্রী সেন এখনও বেঁচে আছেন। তিনি ঐ ঘটনার সাক্ষী। পাকিবাহিনীর সেদিনের পাশবিকতার কথা বলতে গিয়ে ঝর | ঝর করে কেঁদে ফেলেন। ফুলকার চাকলা গ্রামের ব্যবসায়ী কালাম মিয়া, মুক্তিযােদ্ধা আবদুল করিম জানান, রাজাকার মীর ইসমাইল হােসেন খুব সুচতুর ব্যক্তি।

সে ‘৭১ সালে প্রতিটি কাজই আকার-ইঙ্গিতে করত। সেই সময় করে তার সহযােগীরা হচ্ছে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রাজাকার আইজার হােসেন, মেম্বার বাছত উল্লা সরকার ও তার জামাতা আকবর হােসেন। তাদের মতে, ‘৭১ সালে রাজারহাট উপজেলায় প্রায় ৪০ ভাগ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। যুদ্ধের সময় সাকোয়া, জয়দেব হায়াৎ, ছুটুসােনাবর, ঠাটমারী, বাজেমজরাই, তালুক কাককাটি হিন্দুপ্রধান এলাকা ছিল। যুদ্ধের সময় ঐসব এলাকার সব মানুষ ভারতে চলে যায়। আর এই সুযােগে রাজাকার মীর ইসমাইলের নির্দেশে তার জামাতা আকবর হােসেন পালিয়ে যাওয়া মানুষের জমির ধান, বড় বড় গাছ কেটে বাড়িতে নিয়ে যেত। লুট করেছিল সােনা, টাকাপয়সা। সেই রাজাকার আকবর হােসেন এখন রাজারহাট পাইলট স্কুলের শিক্ষক। ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর রাজাকার মীর ইসমাইল হােসেন কখনও বিএনপি কখনও জাতীয় পার্টির সংস্পর্শে এসে প্রায় ১৫ বছর চাকিরপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিল। বর্তমানে তার পুত্র ঐ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। রাজাকার মীর ইসমাইল হােসেন তার নামে প্রতিষ্ঠিত ডিগ্রী কলেজে পাকিস্তান প্রীতির কারণে দীর্ঘ ২৯ বছরেও করতে দেয়নি শহীদ মিনার’। এ বছর কলেজের ছাত্রছাত্রীদের চাপের মুখে তৈরি হয় শহীদ মিনার’। শুরু থেকেই এখনও রাজাকার মীর ইসমাইল জোরপূর্বক কলেজটি নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজাকার মীর ইসমাইল হােসেন সমাজের উচ্চ আসনে অবাধ চলাচল করলেও শুধু ‘৭১-এর ঐসব কৃতকর্মের জন্য সম্পর্ক নেই তারই নিকট আত্মীয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ শিক্ষক সােহরাওয়াদী পরিবারের সাথে।

ইসমাইলের বক্তব্য

মীর ইসমাইল হােসেনের সাথে সম্প্রতি তার বাসভবনে কথা হয়। তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘৭১-এ যুদ্ধকালীন সময়ে তার ভূমিকা কি ছিল? সে বলে, আমি ঐ সময় চাকিরপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার সাথে পাকিস্তানী বাহিনীর কোন যােগাযােগ ছিল না। আমি কোন যুদ্ধ অপরাধ করিনি। প্রশ্নঃ এলাকার লােকজন আপনার সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেন। উত্তর ঃ ঐসব বাজে কথা। আমি যদি ‘৭১-এ যুদ্ধের সময় অন্যায় করতাম তাহলে দীর্ঘদিন ঐ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হলাম কিভাবে। রাজারহাটে দু’টি নৃশংস গণহত্যা সম্পর্কে বলে, ঐ স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল বলে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ ঘটনা ঘটায়।

জনকণ্ঠ ॥ ২৬-০৩-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন