You dont have javascript enabled! Please enable it!

মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁও গণহত্যার নেতৃত্বে ছিল আলাউদ্দিন, আনা মিয়া আব্দুল মতিন গং

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন, মৌলভীবাজার থেকে ॥ মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পাচগাঁও গ্রামের সেই নৃশংস গণহত্যার কথা আজও মনে হলে জেলাবাসীর গা শিউরে ওঠে। জঘন্য হত্যাকারী ঘৃণিত রাজাকাররা এখন সমাজের উচু স্তরের সমাজসেবক হিসাবে বহাল তবিয়তে আছে। হত্যাকাণ্ডে নিহতদের পরিবার আজও হত্যাকারীদের অভিশাপ দিচ্ছে। সেই ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। বকুল চন্দ্র মালাকার, জিতু মালাকার, চরিত্র শব্দকর, সুবােধ মালাকার, জামিনী। মালাকার, সাধু শব্দকর ও লাড় মালাকার। তাদের মধ্যে বকুল চন্দ্র মালাকারের বয়স। ১০/১২ হওয়াতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাঁর পরিবারের বাবা, ভাই, জেঠাসহ ৯ জনকে হত্যা করা হয়। হত্যার সময় গুলির আঘাতে আহত হয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান বাকি ৬ জন। এঁদের মধ্যে আজও জীবিত আছেন ৩ জন। এই লােমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে নাম প্রকাশ না করার অনুরােধ জানিয়ে তারা জানান সেদিনের এই কাহিনী। ‘৭১ সালের ৭ মে (২৩ বৈশাখ) সারা রাত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সেই রাতে এলাকার। ঘৃণিত রাজাকার পাকি প্রেমিক আলাউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে পাকি সৈন্যদের আসর বসে। তাদের সেই রাতে নৈশভােজে আপ্যায়িত করা হয়।

গ্রামের নিরীহ জনসাধারণ সারা দিন কাউয়াদীঘি হাওরে বােরাে ধান কাটা শেষে যখন রাতের বেলা গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল ঠিক তখনই রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী, ডাঃ আনা মিয়া ও খারপাড়ার আব্দুল মতিন গং ৫০/৬০ পাকি সৈন্যকে নিয়ে পুরাে পাচগাও গ্রাম ঘিরে ফেলে। বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে গ্রামের নিরীহ জনসাধারণকে ধরে আনে এবং বলতে থাকে “পাঁচগাও মে চক্কর দেগা, সরকার বাজার মে মিটিং করেগা, উচকো বা’দ তুমকো ছােড় দেগা।”, এসব কথা বলে শতাধিক লােককে সরকার বাজারের দীঘির পাড়ে জড়াে করে। চতুরদিক হাল্কা অন্ধকারে ঢাকা। নিরীহ গ্রামবাসীকে হাল্কা আলাের ভিতরে নিজেদের পরনের কাপড় খুলে দু’জন দু’জন করে হাত-পা বেঁধে ফেলে। তখন সময় হবে। আনুমানিক ভাের ৬টা। ৭৫ নিরীহ গ্রামবাসীকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একে একে লাথি মেরে দীঘিতে ফেলে দেয়। এর পর নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে ৬৯ নিরীহ গ্রামবাসীকে। ৬৯ গ্রামবাসীর শরীরের রক্তে সেদিন দীঘির পানি লাল হয়ে গিয়েছিল।

সমস্ত দিন নিহতদের মৃতদেহ পড়ে থাকে সেখানে। কেউ সেগুলাে উদ্ধার করার সাহস। পায়নি। পরদিন এলাকার কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি লাশগুলাে তুলে দীঘির পশ্চিম পাড়ে সমাহিত করেন। সেদিনের ঘটনায় যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তারা হলেন– অমূল্য চরণ দাস (মাখন বাবু), হীরন্ময় দাস, নিখিল রঞ্জন চক্রবর্তী শান্ত, কৃষ্ণ চন্দ্র চক্রবর্তী, বিনােদ বিহারী চক্রবর্তী, ললিত মােহন দাস, কুমােদ চন্দ্র নাগ, পুতুল চন্দ্র অধিকারী, অজয় চরণ দেব, নরেশ চন্দ্র দেবনাথ, নরেন্দ্র মালাকার, নরী চন্দ্র মালাকার, রসময় মালাকার, সুকেশ মালাকার, বীরেশ মালাকার, পুতুল চন্দ্র মালাকার, আধাই মালাকার, লাল মালাকার, উমেশ চন্দ্র মালাকার, রবি মালাকার, নগেন্দ্র মালাকার, ভুবন চন্দ্র মালাকার, নগরি শব্দকর, অবি শব্দকর, কুটি শব্দকর, শ্যামল চন্দ্র শব্দকর, উপেন্দ্র। শব্দকর, রাজেন্দ্র শব্দকর, নরাই শব্দকর, নরেশ শব্দকর, সােনাতন নমশূদ্র, বসন্ত নমশূদ্র, জ্যোতি নমশূদ্র, সুরেশ নমশূদ্র, পরেশ নমশূদ্র, পিয়ারী নমশূদ্র, উমেশ চন্দ্র নমশূদ্র, সুরেন্দ্র মালাকার, গুপেশ মালাকার, লংগু মালাকার, সুবল মালাকার, বিমল মালাকার, টুনা মালাকার, সুরেন্দ্র মালাকার, রমন মালাকার, ইরেশ চন্দ্র মালাকার, কুমার। মালাকার, ইরেশ লাল মালাকার, বাদন মালাকার, নিত্যরাশী মালাকার, গুপেশ শব্দকর, রমন শব্দকর, মনাই শব্দকর, বিরেশ শব্দকর, হিরেন্দ্র শব্দকর, পরেশ শব্দকর, শার শব্দকর, উপেন্দ্র মালাকার, গােপাল মালাকার, নিরদ শব্দকর, সতিশ চন্দ্র মালাকার, বিধু চন্দ্র মালাকার, রসময় চক্রবর্তী, দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, দীজেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য, রজনী কুমার দে, নগেন্দ্র চন্দ্র দেয়, রমণী কুমার দে, চৈতন্য মালাকার, নরেশ চন্দ্র দেবনাথ। এর পর পাকি সৈন্যরা এবং তাদের দোসররা সেই পাঁচগাঁওয়ে চালায় লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযােগ।

সারা গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সেই দৃশ্য আজও মনে হলে গা শিউরে ওঠে। সেই কুখ্যাত রাজাকার আলাউদ্দিন চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের বাড়ি দখল করে লীলা নাগের মায়ের স্মৃতি বিজড়িত কুঞ্জলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করে সমাজপতি সেজেছিল। সম্প্রতি তার সেই ঘটনগুলাে স্মরণ করে এলাকাবাসী তাকে আর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করেনি। ডা. আনা মিয়া পল্লী চিকিৎসক সেজে রাজনগর উপজেলায় সমাজসেবক হিসাবে নিজের অতীতকে ধামাচাপা দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। খারপাড়ার আব্দুল মতিন রাজনগর থেকে মৌলভীবাজার সদরের চাদনীঘাট এলাকায় বাসাবাড়ি করে বিলাস বহুল জীবনযাপন করছে। আলাউদ্দিন বক্তব্য দেয়নি পাচগাঁওয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতে আলাউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে গেলে। আলােচনার শুরুতেই সে সাংবাদিক ও জনকণ্ঠ প্রতিনিধি জেনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অনেক বােঝানাের পরও তাকে শান্ত করতে না পেরে বাধ্য হয়ে তার বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়। এ জন্য তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

জনকণ্ঠ ॥ ২৮-০৩-২০০১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!