কুড়িগ্রাম আব্দুল হামিদ মওলানার নির্যাতনের কথা মনে করে কুড়িগ্রামের মানুষ আজও শিউরে ওঠে
রাজু মােস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে ॥ একাত্তরে কুড়িগ্রামের খুন, ধর্ষণ, লুট ও বাড়ির পর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার অন্যতম হােতা রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ ওরফে। দাগিল মওলানা এখন শিক্ষক। সে সময়ের কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ মওলানা আড়াল করার জন্য এখন মওলানা হামিদ ছদ্ম নাম ব্যবহার করে। এই পাষণ্ড রাজাকার কমান্ডার শত শত মুক্তিপাগল, নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের খুনে হাত রাঙিয়েছিল। বহু মা-বোেনকে ধরে নিয়ে তুলে দিত পাকি সেনাদের হাতে। লুটপাট ও ঘরবাড়ি-জ্বালানাে ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। স্বাধীনতার পর মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে ঐ রাজাকার নিজের বাড়ির ঘরের ভিতরে গর্ত করে লুকিয়ে ছিল দীর্ঘদিন। বঙ্গবন্ধুর হাটুরে মানুষরা পিটুনি দিয়ে তার কোমর ভেঙ্গে দিয়েছিল। তার নির্যাতনের কথা মনে করে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ আজও আঁতকে ওঠে। সেই রাজাকার কমান্ডারের বিরুদ্ধে ৩০ বছরেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ‘৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর পরই আবদুল হামিদ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি বনে যায়। গ্রামের বিচার সালিশ থেকে সব অনুষ্ঠানে চলে তার অবাধ যাতায়াত। এর সুবাদে ঐ ইউনিয়নের নুরপুর সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষকতার চাকরি পায়। এই পাষণ্ড রাজাকারের ঐ সময়ের স্বচক্ষে দেখা ঘটনা বর্ণনা করেছেন ‘৭১ সালের দুর্গাপুর হাইস্কুলের সম্পাদক বর্তমানে ঐ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সভাপতি ষাটোর্ধ : আবদুল জলিল সরকার। রাজাকার আবদুল হামিদের নৃশংস হত্যার বিবরণের সময় তিনি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন। বােবা হয়ে যান ক্ষণিকের জন্য। বুকটা ব্যাথায় ভরে যায়। ছােট ভাইয়ের লােমহর্ষক হত্যার কাহিনী বলার সময় বার বার চোখ মােছেন তিনি তাদের অপরাধ ছিল তারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করতেন।
তিনি বলেন, সেদিন ছিল বুধবার, ‘৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভােরবেলা। রাজাকার আবদুল হামিদ তার দলবল নিয়ে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। উদ্দেশ্য ছিল আমাকে হত্যা করা। কারণ ঐ সময় আমি। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পাকি বাহিনীর ম্যাসেজ দিতাম। সেদিন আমি ‘ম্যাসেজ দেয়ার জন্য হেঁটে মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে গিয়েছিলাম কুড়িগ্রামে। আমাকে না পেয়ে আমার পরিবর্তে ছােট ভাই আবদুল মজিদকে বাড়ির আঙ্গিনায় সবার সামনে গুলি করে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি পাষণ্ডের দল। রাসায়নিক পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামে। সে আগুনের লেলিহান শিখা স্থায়ী হয় টানা তিন দিন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় গােড়াই গ্রামের প্রায় চার শ’ ঘরবাড়ি। গােড়াই গ্রামের গুলিখাওয়া নসীর উদ্দিন সবেমাত্র মুক্তিযােদ্ধাদের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন ‘৭১-এ। আজও বেঁচে আছেন তিনি। রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদের কথা বলতে তিনি এখনও ঘৃণায় থুতু ফেলেন। তিনি বলেন, নবজাতক সন্তানকে এক নজর দেখতে এসে ধরা পড়েছিলাম রাজাকার আবদুল হামিদ ও তার সহযােগীদের হাতে। আবদুল হামিদ বন্দুক তাক করে মেরে ফেলার জন্য। মুক্তিযােদ্ধা নসীর উদ্দিন সেদিন তার জীবনের শেষ ইচ্ছা কামনা করেন মা আমেনা বেগমকে এক নজর দেখার। রাজি হয়ে যায় রাজাকারের সশস্ত্র দল। তার মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে এলে রাজাকার আবদুল হামিদ তার দলবল নিয়ে তাকে পাঁচপীর হাইস্কুলের পিছনে ব্রিজের কাছে একটি শিমুল গাছে বাধে। কমান্ডারের নির্দেশে রাজাকার ইসাহাক তাকে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে নসীর উদ্দিনের বাঁধন ছিড়ে যায়। তিনি পুকুরে ‘মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে থাকেন।
রাজাকাররা তাকে মৃত ভেবে ছেড়ে চলে যায়। পরে গ্রামবাসীরা তাকে নিয়ে পৌছে দেয় রৌমারির মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে তিনি নতুন জীবন ফিরে পান। মালভাঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মুক্তিযােদ্ধা আবদুল কাদের ৬ নং সেক্টরের রাধুনী ঘাটের মুক্তিযােদ্ধা ইউসুফ আলী, জেলা মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও মুক্তিযােদ্ধা মঞ্জু মণ্ডল জানান, আবদুল হামিদ একাত্তরে রাজাকার কমান্ডার ছিল। সে তার সহযােগীদের নিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াত কুড়িগ্রাম, উলিপুর, চিলমারীসহ বিভিন্ন শহরে। পাষণ্ড ঐ রাজাকার কমান্ডার ভাল উর্দু বলতে পারত বলেই পাকিবাহিনীর সাথে গাঢ় সম্পর্ক ছিল তার। তারা আরও জানান, তাকে সেদিন সহযােগিতা করেছিল বর্তমান জাতীয় পার্টির এমপি রাজাকার তাজুল ইসলাম চৌধুরী, তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা পনির উদ্দিন, খন্দকার শামসুল হক, ডাঃ বাবর উদ্দিন প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধা ও প্রাক্তন জেলা চেয়ারম্যান রােকন-উদ-দৌল্লা, মুক্তিযােদ্ধা খােকন ঘােষ, গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা আকতারুজ্জামান মণ্ডল জানান, রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ লালমনিরহাট থেকে প্রায় ৩শ’ সশস্ত্র রাজাকার নিয়ে এসে কুড়িগ্রাম-উলিপুর সড়কের পাশে পাঁচপীর রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। সাবক্যাম্প করেছিল অর্জুনের ডেরা, দুর্গাপুর, গােড়াই, পাণ্ডুল, চণ্ডীভান, যমুনা, হাতিয়া প্রভৃতি গ্রামে। হাজার হাজার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। ঐসব গ্রামে কমপক্ষে এক শ’ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছিল।
কুড়িগ্রামের একাধিক মুক্তিযোেদ্ধা সূত্র জানিয়েছে, একাত্তরে এই রাজাকার কমান্ডার ও তার সহযােগীরা বহু মুক্তিযােদ্ধা ও বাঙালীকে ধরে এনে পাঁচপীর স্টেশনের কাছের আম গাছটিতে নিরপরাধ মানুষগুলােকে উল্টা পাশে ঝুলিয়ে মুখে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল। এভাবে বহু নাম জানা-অজানা মানুষ শুয়ে আছে অর্জুনের ডেরা পুলের পাশে এবং পাঁচপীর স্টেশনের কাছে বধ্যভূমিতে। তারা দাবি করেন, ঐসব এলাকায় সরকার। যেন শহীদদের জন্য স্মৃতি ফলক তৈরির ব্যবস্থা নেয় । কুড়িগ্রাম শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুকুল আনসারীর বাবা আবদুল জব্বার আনসারী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ ছিলেন। যুদ্ধকালীন অনেক মানুষকে সাহায্য করেছিলেন, এটিই ছিল তার অপরাধ। বাবার স্মৃতির কথা বলতে কেঁদে ফেললেন। তিনি বললেন, আমি এবং আমার ভাইরা বেশ ছােট। এক সন্ধ্যায় আমাদের সামনেই রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ ও তার সহযােগীরা বাবাকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল। মৃত্যুকালে বাবা চোখ বাঁধা অবস্থায় শুধু কলেমা পড়ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ও এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা এই রাজাকার আবদুল হামিদসহ আরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত রাজাকারের হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি আজও ভুলতে পারে নি। তারা ‘৭১-এর ঐ সব রাজাকারের এখন প্রকাশ্যে বিচার চান। তা না হলে নিরপরাধ ঐসব শহীদের আত্মা শান্তি পাবে না। সারা মুখে গুটি বসন্তের দাগ ষাটোর্ধ রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ মওলানার সাথে কথা হয় উলিপুর উপজেলার ঘােড়াই গ্রামে। রাজাকার কমান্ডার আবদুল হামিদ মওলানার কাছে ‘৭১-এর যুদ্ধকালীন তার ভূমিকার কথা জানতে চাওয়া হলে সে জানায়, সেদিন আমি যা করেছি, তা দেশপ্রেম থেকেই করেছি। দীর্ঘদিন পর আমি এখন আর | ঐ ঘটনাগুলাে মনে করতে চাই না। সে আরও জানায়, এখন মনে হয় সেদিনের কাজগুলাে অন্যায় হয়েছিল আমার। এখন আমি অনুতপ্ত।
জনকণ্ঠ ॥ ০৪-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন