You dont have javascript enabled! Please enable it!

মৌলভীবাজার কুলাউড়ার সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নায়ক মাহাতাব চৌধুরী এখন সমাজসেবক

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন, মৌলভীবাজার থেকে ॥ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া শহরতলির পুষাইনগরের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হলে কুলাউড়াবাসী আজও শিউরে ওঠে। তারা অভিশাপ দেয় একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকার মাহতাব চৌধুরীকে। সেই রাতে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তখনকার ২০ বছর বয়সী টগবগে তরুণ নদীয়া দাশ। সংসারের দায় মিটাতে যিনি বর্তমানে জুরী পূবালী সিনেমা হলে গেটকীপার  হিসাবে কাজ করছেন। সেদিনের ঘটনার বিবরণ জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অনেক চাপাচাপির পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিনের ঘটনাগুলাে একে একে বর্ণনা করেন। দীর্ঘ ৩০ বছর পর সেই কালরাতের হৃদয়বিদারক। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নদীয়া দাশ বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে চোখের জল মাটিতে। ফেলেন। নদীয়া দাশ বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুতে কুলাউড়ার কুখ্যাত রাজাকার মাহতাব চৌধুরী ও বাতির মেম্বার চৈত্র মাসের ২৫/২৬ তারিখ নাগাদ এলাকার জনগণকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে শান্তি কমিটি গঠনের লক্ষ্যে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পুষাইনগরের নরেশ ঘােষের বাড়িতে বিকাল ৪টায় জড়াে করে। এলাকার প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষ তার কথা সরল মনে বিশ্বাস করে নরেশ ঘােষের বাড়িতে জড়াে হয়।

যার অধিকাংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের । সূর্য পশ্চিম দিগন্তে প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থায়। হঠাৎ করে নরেশ ঘােষের বাড়ির চতুর্দিক পাকি বাহিনী ঘেরাও করে ১৪ নিরীহ লােকের হাত-পা ও চোখ বেঁধে ফেলে। পরে তাদের বস্তার মতাে ট্রাকে ভর্তি করে। এতে অনেকেই আহত হওয়ায় চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে আসে কুলাউড়া হাসপাতালে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মারাত্মক আহত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ নদীয়া দাশ দেখতে পান সামাদ নামের এক কাবুলীকে। সেই কাবুলীর কাছে নদীয়া দাশ দুধ বিক্রি করতেন। তাকে দেখে তিনি কাতরাতে কাতরাতে চলে যান সেই কাবুলীর কাছে। তার কাছে প্রাণভিক্ষা চান। কিন্তু কাবুলী কোন অবস্থাতেই তার কথা শুনতে রাজি নয়। অনেক অনুনয়বিনয়ের পর তাকে রাজি করান এবং হাত-পায়ের বাঁধন খুলে কুলাউড়া হাসপাতালের বারান্দায় তাঁকে বসিয়ে রাখে। রাত ৮টার পর শুরু হয় মাহতাব চৌধুরী, বাতির মেম্বার গংয়ের ইশারায় হত্যাযজ্ঞ। ৩/৪ জনকে এক সাথে দাড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে একে একে হত্যা করা হয় তমছির, উপেন্দ্র ঘােষ, উপেন্দ্র ঘােষের পুত্র নরেশ ঘােষ, হরেন্দ্র মালাকার, গােপী দাশ, দিগেন্দ্র দাশ, চিত্ত দাশ, বিরাই দাশ, নিখিল ঘােষ ও অজ্ঞাত আরও ৩ জনসহ মােট ১৩ জন নিরীহ লােককে। হত্যা নিশ্চিত করার জন্য সেই রাজাকাররা নিহত ব্যক্তিদের গলায় ছুরি বসিয়ে গলা কেটে দ্বিখণ্ডিত করে। এর পর রেলওয়ের পশ্চিম পাশের গার্লস স্কুল সংলগ্ন মাঠে একটি গর্ত করে সবাইকে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়। এর ফাকে নদীয়া দাশ জীবন বাজি রেখে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে। সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুলাউড়া শহর।

ও শহরতলির গ্রামগুলাে ছিল আলবদর, রাজাকার ও তথাকথিত শান্তি কমিটির লােকদের দখলে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের সময় এ চক্র এলাকায় বিভিন্ন সময় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটতরাজ চালায়। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল এই এলাকার জনসাধারণ তাদের কুকীর্তিতে যেন বাধা হয়ে না দাঁড়ায়; এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের | ঘরবাড়ি, মালামাল লুটতরাজ করার জন্য । সেই ‘৭১-এর ঘৃণ্য রাজাকার পাকি বাহিনীর অন্যতম দোসর মাহতাব চৌধুরী এখন কুলাউড়ার বিশিষ্ট সমাজপতি। অভিযােগে বলা হয়েছে যে, তার এ অপকর্ম ঢাকার জন্য কুলাউড়া শহর থেকে এক কিলােমিটার দূরে কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কের পশ্চিম পাশে তার এবং তার স্ত্রীর নামানুসারে মাহতাব-ছায়েরা উচ্চ বিদ্যালয় নামের একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে সমাজসেবক সেজেছে। বর্তমান প্রজন্ম আজও জানে না সেই ঘূণ্য রাজাকারের ‘৭১-এর কুকীর্তির কথা। কিন্তু যারা জানেন তারা আজও তাকে দেখলেই ভৎসনা করেন।

জনকণ্ঠ ॥ ১৬-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!