You dont have javascript enabled! Please enable it! মানবাধিকারের প্রবক্তা সেজেছে মৌলভীবাজারের মিছির উল্লাহ - সংগ্রামের নোটবুক

মানবাধিকারের প্রবক্তা সেজেছে মৌলভীবাজারের মিছির উল্লাহ

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তরের এক কুখ্যাত রাজাকার এখন মানবাধিকারের প্রবক্তা সেজেছে। বর্তমানে মানবাধিকার বাস্তবায়ন কমিটি মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতির পদটি তার দখলে। জেলায় তাকে সবাই চেনে মিছির উল্লাহ মােক্তার নামে। আগে আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বেশ কিছুকাল যাবত চলছে তার। অবসরজীবন। তবে প্রতিদিনই সন্ধ্যার পর শহরের সৈয়দ সিকান্দর আলী রােডস্থ তার বাসভবনে মৌলবাদীদের ‘মজমা’ বসে। তা ছাড়া সমাজে নিজের পরিচয় লুকিয়ে ‘ভাল। মানুষ’ প্রমাণের জন্য প্রবীণ হিতৈষী সংঘ’ এবং জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান’ নামের দুটি সংগঠন খুলে বসেছে সে। তার পরও স্থানীয় মানুষের কাছে মিছির উল্লাহ মােক্তার তার রাজাকারী মুখােশ ঢাকতে পারেনি। মুখে ধর্মের কথা বললেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি। নেই তার কোন শ্রদ্ধা। মৌলভীবাজার শহরে অবস্থিত হযরত সৈয়দ শাহ জালাল (রঃ)এর অন্যতম সহচর হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রঃ)-এর মাজার বন্ধ করার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে তার প্ররােচনায় কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়। তাকে মৌলভীবাজারবাসী মামলাবাজ হিসাবেও চেনে। মুক্তিযােদ্ধাদের সামান্য অজুহাতে নানাভাবে হয়রানি করে। বীর মুক্তিযােদ্ধা সৈয়দ মহসিন আলী মৌলভীবাজারের পৌর চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় তার নেয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের বিরুদ্ধে সে বেশ। কয়েকটি মামলাও করে।

বীর মুক্তিযােদ্ধা, মৌলভীবাজার আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও প্রবীণ লেখক, এ্যাডভােকেট মুজিবুর রহমান মুজিব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখনীর। মাধ্যমে ‘৭১-এর বিভিন্ন ঘটনার কথা লেখালেখি করায় মিছির উল্লাহ তার ওপর ক্ষেপে যায় এবং বলে এই সমস্ত লিখে জনগণকে পুরনাে কথা মনে করিয়ে না দিলে কি। আপনার মনে শান্তি হয় না। সেই ঘৃণ্য রাজাকারকে মৌলভীবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে তাকে কমিটিতে না রাখায় বিভিন্ন অজুহাতে পূর্তি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে যায়। ‘৭১-এর সেই ঘাতকের এতই প্রভাব যে তার এই সব কুকীর্তির প্রতিবাদ করার সাহস কেউ রাখেনি। যদি কেউ তার প্রতিবাদ করে সে সাথে সাথে বিভিন্ন লােকজন দিয়ে তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে মামলা ঠুকে দিয়ে অনর্থক হয়রানি করে। মৌলভীবাজার শহরে বিপুল ভূসম্পত্তির মালিক মিছির উল্লাহ আজও অভিন্ন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে। এই মিছির উল্লাহ গং নিরীহ দু’জন লােককে ধরে এনে মনু নদীর ব্রিজের ওপর হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ১২ মে সকাল বেলা শহরতলির। হিলালপুর গ্রামে মিছির উল্লাহ গংয়ের নির্দেশে পুরাে হিলালপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। পাক সেনারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় মােঃ উস্তার, সিরাজুল ইসলাম ও তার বৃদ্ধ পিতা। আব্দুল মন্নানকে মােঃ উস্তার মােস্তাফাপুর ইউপি কমিটির একজন বলিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম ছিলেন পুলিশ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা। তার পিতা একজন। বয়ােবৃদ্ধ মানুষ। এই তিন জনকে মৌলভীবাজার শহরে ধরে এনে দিনভর নির্যাতন করা হয়। রাতের বেলা তাদের জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই তিন জনকে ধরে নেয়ার। পর এলাকার শান্তি কমিটির লােকজন তাদের বাড়িঘর লুটপাট করে। তারা পাক বাহিনীর পক্ষ থেকে এদের বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য এক লাখ টাকা দাবি করে।

কিন্তু দেশে যুদ্ধ থাকায় এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে তাদের পরিবার এক লাখ টাকা যােগাড় করতে পারেননি। ফলে মিছির উল্লাহ গং ১৩ মে ভাের বেলা তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মৌলভীবাজার থানার তৎকালীন ওসি তজমুলকে। দিয়ে পুলিশের জীপে মাইক বেঁধে সকাল থেকে সারা শহর মাইকিং করা হয়। মাইকিংয়ের ভাষা ছিল- মৌলভীবাজার শহরের জনগণ পার্শ্ববর্তী মনু ব্রিজের ওপর যেন। হাজির হয়। পাশাপাশি সারা শহরের দোকানপাট, অফিস-আদালত বন্ধ করে। লােকজনকে পাক সেনারা মনু নদীর ব্রিজের ওপর যেতে বাধ্য করে। মনু নদীর ব্রিজের দুই পাশে শত শত লােকসমাগম ঘটলে মাইকযােগে ঘােষণা করা হয়, হিলালপুর গ্রাম থেকে তিন দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে। এরা পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদী। আন্দোলনের সাথে জড়িত। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে তাদের বিচার করা হয়। বিচারের রায়ে ঘােষণা করা হয়, দু’জন রাষ্ট্রদ্রোহীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। বাকি একজনের বয়স বেশি থাকায় তাকে মুক্তি দেয়া হবে। এই ঘােষণার পর পরই পাকি বাহিনীর জীপের ওপর থেকে মােঃ উস্তার ও সিরাজুল ইসলামকে মনু ব্রিজের রেলিংয়ের পাশে। দাঁড় করানাে হয়। প্রথমে মােঃ সিরাজুল ইসলামকে লক্ষ্য করে পাকি ক্যাপ্টেন ইউসুফের নির্দেশে মনু ব্রিজের দুই পাড়ে দাড়িয়ে থাকা শত শত জনতার সামনে দুই রাউন্ড গুলি ছােড়া হলাে। তার পর মােঃ উস্তারের ওপর তিন রাউন্ড গুলি ছােড়া হলাে। সাথে সাথে। দু’জনই মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় মনু নদীর ব্রিজের ওপর ঢলে পড়েন। খুনীরা এঁদের লাশ মনু নদীতে ফেলে দেয়। মনু নদীর প্রবল স্রোতে ভেসে যায় মােঃ উস্তার ও সিরাজুল ইসলামের লাশ।  এঁদের রক্তে লাল হয়ে যায় মনু নদীর পানি। নদীর দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত মানুষ অসহায় অবস্থায় নীরবে অশ্রু ফেলে। মােঃ উস্তারের পিতা। মন্নানকে নিষ্কৃতি দেবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাকি ঘাতক এবং রাজাকাররা কথা রাখেনি। তারা শহরের পার্শ্ববর্তী বড় বাড়ি পাহাড়ে নিয়ে বৃদ্ধ মন্নানকেও গুলিতে হত্যা। করে। রাজাকার মিছির উল্লাহ মােক্তার সম্প্রতি বিদেশে গেছে বেড়ানাের উদ্দেশ্যে, এখনও ফিরে আসেনি।

জনকণ্ঠ ॥ ৩০-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন