You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঝালকাঠি নলছিটি, দরগাবাড়ি ও চাচৈরে বহু খুন ধর্ষণ ও লুটের নায়ক ইউসুফ আলী এখন ধনাঢ্য ব্যক্তি, বরিশালে সবার দাদু ভাই

কাজী খলিলুর রহমান, ঝালকাঠি থেকে ॥ ঝালকাঠি জেলার নলছিটিবাসী ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ দিনগুলাে আজও স্মৃতি থেকে মুছতে পারেনি। সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী আজ বৃদ্ধ প্রবীণ ব্যক্তিরা সেই ধ্বংসলীলার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আর ক্ষোভ-দুঃখ-ঘৃণা ও বিচারের দাবি করেন সেই সব রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ তথাকথিত পিস কমিটির সদস্যদের, যাদের সহায়তায় বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নলছিটি শহর, দরগাবাড়ি, চাচৈর, মানপাশাসহ বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতনসহ ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সেই রাজাকারদের কয়েকজন আজ সমাজপতি, ধনাঢ্য ব্যক্তি যাদের মধ্যে ইউসুফ আলী খান, মাওঃ গােলাম মােস্তফা, আঃ মালেক মৃধা ও খালেক ফকির অন্যতম। ইউসুফ আলী খানের পিতা আহম্মদ আলী খান ছিল চিহ্নিত রাজাকার। আর তার শ্বশুর আমির গাজী ছিল নলছিটির পিস কমিটির সভাপতি। এ ছাড়াও তার আরেক পরিচয়, সে ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগের সেক্রেটারি । পিতা ও শ্বশুরের সহায়তায় ইউসুফ আলী স্বাধীনতাবিরােধীদের নিয়ে শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তােলে। হত্যা, লুট ও ধ্বংসলীলা চালায় নির্বিঘ্নে। নলছিটি মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদ, ‘৭১-এর চেতনা বাস্তবায়ন সংগঠন, মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলসহ সাধারণ জনতার গণঅভিযােগ, বর্তমান শহরের আমিরালয় ভবন (দ্বিতল বিশিষ্ট) পিস কমিটির হেডকোয়ার্টার হিসাবে ব্যবহৃত হতাে। পিস কমিটির সভাপতি আমির গাজী সেই ভবনে বসবাস করত।

এই ভবনেই সভা-সমাবেশ হতাে, মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, হত্যা, লুট ও অগ্নিসংযােগের নির্দেশ প্রদান করা হতাে। মনােরঞ্জনের জন্য নারীদের ধরে এনে আমােদফুর্তি করত সেই ভবনে। যা আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। তবে সেই ভবনটির যে আজ মালিক, সেই মাওঃ গােলাম মােস্তফাও ঢাকায় অবস্থান করে নেজামে ইসলাম দলের নেতৃত্ব দিয়েছে, বাকিদের সহায়তায় মােহাম্মদপুরে মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়ি। দখল করেছে। সেখানে আজ লেবার পার্টির অফিস গড়ে তুলেছে। এই মােস্তফা এই দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হয়ে এমপি নির্বাচন করেছে । কিন্তু জনগণ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তার জামানত বাজেয়াফত হয়েছে। সে আজ কোটিপতি, ধর্মব্যবসায়ী, আমেরিকায় যাতায়াত করে ধর্মের নামে ব্যবসা পরিচালনা করছে। নলছিটিতে এসে সেই পাকিদের হেডকোয়ার্টারে বসে সে সভা করছে। ১৯৭১ সালের ১১ মে, ১৩ মে, ১৩ নবেম্বর এবং ১৭ নবেম্বর নলছিটিবাসীর নিকট অভিশপ্ত দিন, বীভৎস দুঃসহ স্মৃতি। ১১ মে রাতে পিস কমিটির সভার সিদ্ধান্ত। মােতাবেক থানার তখনকার দারােগা ইউসুফ আলী শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের থানায় ডেকে নেয়। ১২ ব্যবসায়ীকে ২ দিন থানায় আটক রেখে ১৩ মে তামাকপট্টির খালের শেষ মাথায় (সুগন্ধা নদী সংলগ্ন) রশি দিয়ে বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ছিল ইউসুফ আলী খান জানালেন রায়, কার্তিক ব্যানার্জী, কেষ্টমােহন নন্দী, নেপাল কুঁড়ি, শ্যামাকান্ত রায়, অতুল কুঁড়ি, দশরথ কুণ্ডু, সুকুমার বণিক ও ভাসান পােদ্দারকে। দুঃসহ সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে খিতিশ চন্দ্র দত্ত বললেন, আমির গাজীর বৈঠকে তার মেয়েজামাই ইউসুফ আলী খানের। নির্দেশে ওসি থানায় ডেকে নেয়। তার নির্দেশেই সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বাম পাশের বুক ভেদ হয়ে গুলি বের হয়ে যায় খিতিশ দত্তের । সিদ্ধান্ত হয়েছিল যুদ্ধের পরে খিতিশ দত্তের বাড়ি-জায়গা সব ইউসুফ আলী খান পাবে। এ কারণেই তার বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করা হয়নি। ইউসুফ খান ও তার পিতা আহম্মদ খান লুটতরাজের মালামাল দিয়ে শহরে দোকান গড়ে তােলে। ইউসুফ খান কালীবাড়িতে পাকিদের আবাসস্থলে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে দিত। পাকিদের গানবােটে মেয়েদের তুলে দিত। তার সহযােগী রাজাকার এনছান আলী, বজলু মােল্লা, আমির গাজী আজ বেঁচে নেই। ১৩ নবেম্বর পাকিরা চাচৈরে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। সেখানে ১০/১২ মুক্তিযােদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৭ নবেম্বর পরমপাশায় ৪ জনকে হত্যা করে। ইউসুফ আলী খান ও খাটো রবের নির্দেশে পাকিরা নলছিটির নদীর পাড় থেকে শুরু করে শহরের কয়েক শ’ বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। এই এলাকার রাজাকার, আলবদর, আলশামসের দায়িত্বে ছিল খালেক ফকির, আঃ মালেক মৃধা- যারা আজ প্রতিষ্ঠিত। মালেক মৃধা ঢাকার জোয়ার সাহারা ইউনিয়নের রাজাকারের ডেপুটি কমান্ডার ছিল। সে ঐ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের ক্যাশিয়ারকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল। মামলাও হয়েছিল। ওয়ারেন্টও এসেছিল। কিন্তু ‘৭৫-এর পটপরিবর্তনে রাতারাতি মালেক মৃধা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ- বললেন মুক্তিযােদ্ধা আঃ বাছেত লস্কর। ‘৭৫-এর সে কয়েকবার নলছিটি থানা জামায়াতের আমির-নাযেম ছিল। আজ সে প্রতিষ্ঠিত। আরেক রাজাকার আঃ খালেক ফকিরও আজ প্রতিষ্ঠিত। সে সম্প্রতি নলছিটির ঐতিহ্যবাহী মার্চেন্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে প্রথম হয়েছে। কয়েকবার মেম্বরও নির্বাচিত হয়েছে।

অথচ ‘৭১-এ তার ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। মুক্তিযােদ্ধা সুধীর দাস, বাছেত লস্কর আর মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার ইউনুছ মিয়া বলেন, যখন দেখি রাজাকাররা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, নেতৃত্ব দেয়- তখন মনে হয় এ দেশ থেকে তাদের উৎখাতে আরেকবার যুদ্ধ করি। স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকারচক্র ১২৬ জনের লিস্ট করে ধরে নিয়ে হত্যা করে। লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ করেও ক্ষান্ত হয়নি। মাবােনের কথাও ওরা ভাবেনি। ওরা পাকিদের হাতে তুলে দেয় মা-বােনদের। সেই রাজাকারের অন্যতম ইউসুফ আলী খান আজ সবার দাদা ভাই । নলছিটিতে যখন তার ঠাই হলাে না তখন সে আশ্রয় নেয় বরিশালে। বরিশালের হাসপাতাল সড়কে তার দ্বিতল বাড়ি, গাজী মিলনায়তনের কর্তা, অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ের কমিটির সদস্য, অমৃত শিশুকানন কিন্ডারগার্টেনের পরিচালকসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত। বরিশালবাসীর নিকট অতি শ্রদ্ধার পাত্র। তাই তাে শিশু-কিশাের, তরুণযুবক সবাই তাকে দাদু ভাই হিসাবে ডাকে ও চেনে। অথচ বরিশালবাসী জানে না, তারা রাজাকারী করে এ দেশের মানুষ হত্যা করেছে। লুটতরাজ, নারী নির্যাতনের সাথে।

জড়িত ছিল। অথচ আজ সেই রাজাকার যখন যে সরকার আসে তখন সে সরকারের কাঁধে ভর করে কর্মকাণ্ড চালায়। এ প্রতিবেদক তার সাক্ষাতকার নিতে চাইলে বরিশালের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান বললেন, ওনার (ইউসুফ আলী খানের) সম্পর্কে জানতে হলে ডিসিএসপি ও ডিআইজির নিকট থেকে জানুন। দাম্ভিকতার সুরে ইউসুফ আলী খান বললেন, পত্রিকায় লিখুন, এতে কিছু যায়-আসে না। কারণ আমি। আজ যে অবস্থানে আছি। সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করে। তিনি বললেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি বলরাম পােদ্দার একটি চিঠি লিখেছেন, দাদু ভাই ব্যাপারটি দেখবেন। বরিশালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিকরাও নাকি তাকে সম্মানের চোখে দেখেন, শ্রদ্ধা করেন । কিন্তু তারা তাে তার সেই অপকীর্তির খবর। জানেন না। জানেন না স্বাধীনতাযুদ্ধে তার বিতর্কিত ভূমিকার কথা।

জনকণ্ঠ ॥ ০২-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!