লালমনিরহাট লালমনিরহাটে ১১৯ জনকে খুঁচিয়ে হত্যার নায়ক হাসান শাহীদ মঞ্জু এখন জাতীয় পার্টি নেতা
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ ‘৭১-এর ৯ নবেম্বর বড়বাড়ী ডাকবাংলার মাঠে ১১৯ জনকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যার নায়ক পাকি সেনাদের দোসর রাজাকারের ক্যাপ্টেন হাসান শাহীদ মঞ্জু এখন লালমনিরহাট জেলা জাতীয় পার্টির (মিজান-মঞ্জ) আহ্বায়ক। পেশায় একজন এ্যাডভােকেট। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় হাসান শাহীদ মঞ্জু রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল। সে ছিল ওই অঞ্চলের রাজাকারদের প্লাটুন কমান্ডার। তাকে পাকি সেনারা ক্যাপ্টেন র্যাঙ্ক প্রদান করেছিল। সে খাকি পােশাকে কাঁধে ৩টি স্টার লাগিয়ে গাড়ি নিয়ে দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করত। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রত্যক্ষদর্শী জনৈক ব্যক্তি বলেন, তার দায়িত্ব ছিল রাজাকার ও আলবদর বাহিনী সংগঠিত করা। সে জেলা সদরে অবস্থিত রেলওয়ে ট্রেনিং স্কুলে পাকি ক্যাম্পে রাজাকারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিত। ১৯৭১ সালে রাজাকার হাসান শাহীদ মঞ্জু ছিল আতঙ্কিত একটি নাম। সে সময় এই রাজাকার কমান্ডার মঞ্জু ক্যাপ্টেন নামেই ছিল পরিচিত। ১৯৭১ সালের ৯ নবেম্বর জেলা সদরের বড়বাড়ী ইউনিয়নের ডাকবাংলা মাঠে ১১৯। জনকে এ্যাডভােকেট হাসান শাহীদের নেতৃত্বে হত্যা করে রাজাকার ও পাকি সেনারা। তাদের পাখির মতাে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী। তৎকালীন সময়ে নবম শ্রেণীর ছাত্র বর্তমানে লালমনিরহাট মােটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাবুল হাবিব লাভলু জনকণ্ঠের এ প্রতিনিধিকে জানান, সেদিন ছিল ৯ নবেম্বর ‘৭১। পাকি সেনারা স্থানীয় লােকজনের সঙ্গে আমাকে ও আমার পিতা আবুল কাসেমকে ধরে নিয়ে যায় বড়বাড়ী ডাকবাংলা মাঠে। গিয়ে দেখি, ইতােমধ্যে। প্রায় শতাধিক লােককে সেখানে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের ডাকবাংলার মাঠে। সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। যারা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের মধ্যে। আমি এ্যাডভােকেট হাসান শাহীদ মঞ্জুকে চিনতাম। আমি তার কাছে আমার পিতার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন আমার চোখের সামনেই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল আমার পিতাকে।
আমার পিতা ছিলেন পাঙ্গারানী লক্ষ্মী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তা ছাড়া তিনি ছিলেন বড়বাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের খেতে দিয়েছিলেন। আমার বাবাকে হত্যার পর এই রাজাকারের কমান্ডার হাসান শাহীদ ম কুড়িগ্রামের রাজাকার ক্যাম্পে আমাকে আটক রেখেছিল। সেদিন আমার বাবার সঙ্গে রাজাকার হাসান শাহীদ মঞ্জু ও পাকি সেনারা ঐ ডাকবাংলার মাঠে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রাখা ১১৯ জনকে হত্যা করেছিল। এদের মধ্যে তৎকালীন রংপুর কারমাইকেল কলেজের ছাত্র সংসদের জিএস মােক্তার এলাহীও ছিলেন। ডাকবাংলার মাঠে শহীদ মােক্তার এলাহীসহ গণহত্যার শিকার সকলের গণকবর রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর শহীদ আবুল কাসেমের পুত্র আসাবুল হাবিব লাভলু তাঁর পিতাকে হত্যা করার দায়ে রাজাকার কমান্ডার হাসান শাহীদ মঞ্জুর বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন। সেই মামলায় ১১৯ জনকে গণহত্যার নেতৃত্বের হাসান শাহীদ মঞ্জুর নাম রয়েছে। সে ছিল প্রধান আসামী। কিন্তু হত্যার বিচার হয়নি। সে এখন জেলা শহরের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। রাজাকারের কমান্ডার হাসান শাহীদ। মঞ্জুর সমাজসেবী হিসাবেও এখন পরিচিতি রয়েছে।
হাসান শাহীদ মঞ্জুর বক্তব্য
‘আমি ১৯৭১ সালে কোন বিতর্কিত ভূমিকা পালন করিনি। লালমনিরহাট জেলা সদরের বড়বাড়ী ইউনিয়নে ১৯৭১ সালের ৯ নবেম্বর পাকবাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তার। সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমিও একজন মুক্তিযােদ্ধা। আমি ১৯৭১ সালের ২৭ নবেম্বর কালীগঞ্জ থানার মােহালী গ্রামে তৎকালীন সিও ডেপঃ মােহাম্মদ আলী সাহেবের বাড়িতে। আমার বাবা-মার খোঁজ করতে গিয়ে পাকি সেনাদের হাতে ধরা পড়ি। সেদিন থেকে আমাকে ভােটমারী রেলওয়ে স্টেশনে মালগাড়িতে বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। আমাকে ধরিয়ে দেয়ার পিছনে কুখ্যাত রাজাকার হােসেন আলী মাওলানা ও প্রয়াত রাজাকার মন্টু গাজীর হাত ছিল।’ প্রত্যক্ষদর্শী আসাবুল হাবিব লাভলুর বক্তব্য ‘আমি নিজে সেদিন (৯ নবেম্বর) ‘৭১ সালে দেখেছি। বড়বাড়ী ডাকবাংলা মাঠে রাজাকারের কমান্ডার হাসান শাহীদ মঞ্জু আমার বাবা শহীদ আবুল কাসেম, তকালীন রংপুর কারমাইকেল কলেজের জিএস মােক্তার এলাহীসহ নিরীহ ১১৯ গ্রামবাসীকে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ব্যাপারে আসাবুল হাবিব বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছিল। যার নং লাল-থানা-কেস নং ১৯, তাং ২১/০৩/১৯৭২, ইউএস ১৪৯/৩০২/৩৮০ বিপিসি। এ হত্যা মামলার প্রধান আসামী ছিল রাজাকার হাসান শাহীদ মঞ্জু। লাভলু আরও জানান, সেদিন এই মঞ্জু আমাকে কুড়িগ্রামে রাজাকার ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল।
জনকণ্ঠ। ০৩-০৪-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন