You dont have javascript enabled! Please enable it!

পার্বতীপুরে রেলের বয়লারে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার হােতা নঈম কাজী এখন বিএনপি নেতা

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর থেকে ॥ বয়লার ইঞ্জিনের অগ্নিগর্ভ বয়লারে পুড়ছে জীবন্ত মানুষ। সেই মানুষের হাড় প্রচণ্ড তাপে ফাটছে আর হাড় ফাটার শব্দে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠছে এক পিশাচ। এটি কোন কল্পকাহিনী নয়। বাস্তব ঘটনা। এমন ঘটনা ১৯৭১-এর পার্বতীপুরে একবার নয়, বহুবার ঘটেছে। আর যার নেতৃত্বে এসব ঘটনা ঘটছে সেই নরপিশাচ নঈম কাজী এখন উপজেলা বিএনপির অন্যতম নেতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নঈম কাজী ছিল পার্বতীপুর থানার পিস কমিটির চেয়ারম্যান। ৩ নং রামপুরা ইউনিয়নের কাজীপাড়া নিবাসী এই নরপিশাচের তুলনা বুঝি সে নিজেই। বাংলাদেশের আর কোথাও এত পৈশাচিক, এত নৃশংস ঘটনা ঘটেনি। নঈম কাজীর খুন করার প্রকৃতি ছিল বিচিত্র ধরনের। তবে সবচেয়ে প্রিয় হত্যাকাণ্ড পদ্ধতি ছিল বয়লার ইঞ্জিনে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা। এর নেতৃত্বে ছিল এক বগীবিশিষ্ট একটি ঘাতক ট্রেন এবং একটি বিশাল ঘাতক। বাহিনী। এই ঘাতক বাহিনীর প্রধান ছিল স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ভাগ্নের পরিচয়দানকারী বাচ্চা খান। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, নঈম কাজী, বাচ্চা খান প্রমুখ কোন একটি গ্রামকে টার্গেট করে টার্গেট পয়েন্টে যেত। সাধারণত এরা যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবত তাদের এলাকাকে তারা টার্গেট করত । কয়লাচালিত ২২৮ নং ইঞ্জিনটি ঘাতক বাহিনী টেনে নিয়ে যেত টার্গেট পয়েন্টে। সেখানে জবাই করে হত্যা করা হতাে কিছু মানুষকে। কিছু মানুষকে। ধরে এনে রেল ইঞ্জিনে শুইয়ে রেখে তার ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়া হতাে ঘাতক ট্রেন। আবার কাউকে কাউকে হাত-পা বেঁধে ঘাতক ইঞ্জিনের অগ্নিগর্ভ বয়লারে জীবন্ত নিক্ষেপ করা হতাে। রশি পাওয়া না গেলে ইঞ্জিনের বয়লারে নিক্ষেপ করার আগে ঐ ব্যক্তির।

হাত দুটি কেটে নেয়া হতাে। প্রচণ্ড তাপে খৈ ফোটার মতাে করে ফুটত মানুষের হাড়। আর সেই শব্দ শুনে পৈশাচিক উল্লাসে চিৎকার করে উঠত নঈম কাজী এবং তার দলবল। শােনা যায়, শেষদিকে হত্যার নেশায় এত বেশি উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল নঈম কাজী যে, প্রতিদিন অন্তত ৫ জন করে লােককে এভাবে পুড়িয়ে মারা হতাে। একবার টার্গেট পয়েন্টে গিয়ে কোন লােকজন না পেয়ে ঘাতক বাহিনীরই একজনকে পুড়িয়ে মারে নঈম কাজী। নঈম কাজীর হত্যাকাণ্ডের এমনই এক শিকার পার্বতীপুরের মােজাফফরনগরের ডাক্তার সামসাদ আলী (৪৫)। তার হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন ডাঃ সামসাদের ছােট ভাই মহসীন ও মুক্তিযােদ্ধা আবুল। তাঁরা জানান, একাত্তরের ৯ এপ্রিল রাত ১টায় বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তার সামসাদকে। তার পর দু’হাত কেটে ২২৮ নং ইঞ্জিনের বয়লারে জীবন্ত তাকে নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিল নঈম কাজী। আরেকটি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন মুক্তিযােদ্ধা আবুল। তিনি জানান, নঈম কাজীর নির্দেশে লােকজন দড়িখানা নিবাসী মনিরউদ্দিন (২৬)কে ধরে নিয়ে যায়। তাকে ঝােলানাে হয় গাছে। তার মাথা নিচু করে পা উচুতে নিয়ে কপিকলের সাথে দড়ি দিয়ে আটকে দেয়া হয়। পরে দ্রুতবেগে কপিকল খুলে দেয়া হয়। সজোরে মাথাটি এসে আছড়ে পড়ে মাটিতে। চিৎকার করে ওঠে মনির। এভাবে বার বার আঘাতের ফলে মারা যায় সে। লাশ গাছে ঝুলিয়ে রেখে চলে যায় নঈম কাজীর দল। বাসুপাড়া নিবাসী আজিজার রহমান জানান, তার বড় ভাই আবু বক্কর সিদ্দিককে জবাই করে হত্যা করা হয়। মােঃ হাকিমসহ ৪০ জন পুরুষকে লাইন দিয়ে দাড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়।

এদের লাশ আত্মীয়স্বজনকে ছুঁতেও দেয়া হয়নি। একই জায়গায় পড়ে থেকে পচেছে, শিয়াল-শকুনে খেয়েছে লাশ। তিনি জানান, পার্বতীপুরে এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে নঈম কাজীর ঘাতক দল হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি, পুড়িয়ে দেয়নি ঘরবাড়ি কিংবা নির্যাতন করেনি কোন নারী-পুরুষকে। মনিরউদ্দিন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তার ভাই মােবারক আলী বাদী হয়ে নঈম কাজীকে প্রধান আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সাক্ষীর অভাবে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। নঈম কাজীর বিরুদ্ধে এ রকম মামলা হয়েছিল ৩৫টি। বিভিন্ন কৌশলে। সেসব মামলাকে ধামাচাপা দিয়েছে নঈম কাজী। ঘাতক ইঞ্জিনের ২২৮ নং প্লেটটি সযত্নে সংরক্ষিত আছে মুক্তিযােদ্ধা আবুলের কাছে। মুক্তিযােদ্ধা আবুল কালাম জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঘাতক ট্রেনযােগে ঘাতক বাহিনী মনমতপুরে যায় অপারেশন চালাতে। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরােধ করে, ফলে শুরু হয় সংগ্রাম বা লড়াই । একপর্যায়ে নিজ দলের কয়েকটি লাশ ফেলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ঘাতক বাহিনী। মুক্তিযােদ্ধা আবুল ইঞ্জিন প্লেটটি খুলে নিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে নঈম কাজীর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চাইলে সে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দ্রুত একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যায়। ঘাতক বাহিনীর হাতে যেসব বাঙালী শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিবারের লােকজন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। রাজাকার বাচ্চা খান বিশেষ বিমানে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। কিন্তু নঈম কাজী দীর্ঘদিন পার্বতীপুরের বাইরে থেকে। অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর দেশে ফিরে আসে। এখন সে বিএনপি পার্বতীপুর উপজেলা কমিটির একজন নেতা। তবে এখনও তাকে দেখলে আঙ্গুল উচিয়ে লােকজন। বলাবলি করে, ঐ যে রাজাকার যায়।

জনকণ্ঠ ॥ ০৪-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!