ছিন্ন মস্তক নিয়ে উল্লাসকারী সৈয়দপুরের।। ইজহার আহমেদ এখন জাতীয় পার্টি নেতা
জনকণ্ঠ রিপাের্ট। একাত্তরের সেই বিহারী রাজাকার ইজহার আহমেদ মানুষ জবাই করত অবলীলায়। অবাঙালী অধ্যুষিত সৈয়দপুরের মুক্তিপাগল যুবক নূরা, শহীদুল ও কুদরতকে ধরে স্থানীয় দহলা নামক স্থানে নিয়ে সে নিজে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছিল। শিশুরাও তার রােষানল থেকে সেদিন রেহাই পায়নি। মানুষের দেহবিচ্ছিন্ন মস্তক নিয়ে পাশবিক উল্লাসে মেতে উঠতে তাকে দেখেছেন অনেকে। এ ধরনের বহু হত্যা ও গণহত্যার হােতা সৈয়দপুরের পিস কমিটির সভাপতি কাইয়ুম খান স্বাধীনতার প্রাক্কালে পাকিস্তানে পালিয়ে গেলেও সেই বিহারী রাজাকার ইজহার। আহমেদ এখন সৈয়দপুরের জাতীয় পার্টির নেতা ও কোটিপতি ব্যবসায়ী। তার সেই হত্যাযজ্ঞের দিনগুলাের কথা আজও ভুলতে পারেনি কেউ। সেদিন ছিল ২৩ মার্চ। সৈয়দপুরের বাশবাড়ী এলাকা দিয়ে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধা মাহতাব বাহিনী। কিন্তু ওত পেতে থাকা পাকিসেনাদের বুলেটবর্ষণে শহীদ হন মাহতাব বেগ। সেদিন অনেকেই দেখেছেন মাহতাব বেগের মৃতদেহ থেকে মস্তকছিন্ন করে হাতে নিয়ে উল্লাস করেছিল এই ইজহার আহমেদ। সৈয়দপুরে প্রায় সবার প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন আমিনুল হক গােলাে ডাক্তার । কিন্তু গােলাে ডাক্তার তার জনপ্রিয়তার কারণে চক্ষুশূল ছিল এই ইজহার আহমেদের। পাকিসেনারা গােলাে ডাক্তারকে ভাল জানলেও ইজহারের অভিযােগে পাকিসেনারা তাঁকে (গােলাে ডাক্তার) সামরিক কোর্টে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে গােলাে ডাক্তার ছাড়া পেয়ে যায়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বিহারী ইজহার আহমেদ। একদিন গােলাে ডাক্তারকে নিয়ে যাওয়া। হয় জুট প্রেসের ভিতর। সেখানে তার চোখ উপড়ে, শরীরের অন্যান্য অঙ্গ টুকরা টুকরা করে কেটে উল্লাস করতে করতে তাকে হত্যা করে সেখানেই মাটিচাপা দেয়া হয়। সৈয়দপুরের পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিহারী কাইয়ুম খান। এই কাইয়ুম খানকে সঙ্গে নিয়েই পাকিসেনাদের সহযােগিতায় বাঙালী হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে ইজহার আহমেদ। আর এই দুজনের সঙ্গে রাজাকারের খাতায় নাম লেখায় ময়েজ ঠিকাদার, আসলাম, আক্তার খান, বিলাইচণ্ডির মজিবর চেয়ারম্যান, জসিম উদ্দিন ও বর্তমান খাতা মধুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুল হক, আকবর, নঈম, রুস্তম, একরামুল, সমসের আলী, জাহিদসহ আরও অনেকে। ’৭১-এ এরা সৈয়দপুরে মুক্তিপাগল বাঙালী হত্যাযজ্ঞের নাম দেয় ‘খরচা খাতা’। এই খরচা খাতায় হত্যার শিকার হয় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। বাঁশবাড়ী মহল্লায় আব্দুল ওয়াদুদের একটি পাউরুটি কারখানা ছিল। তার পাউরুটির লেবেল মার্কা ছিল নৌকা। সেই ওয়াদুদ পরিবারের ১০ সদস্যের কাউকে সে সেফটি ট্যাঙ্কে নিক্ষেপ করে, কাউকে ধারালাে অস্ত্র | দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে।
এমনকি পরিবারের ১০ বছরের এক শিশুরও দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে। এই হত্যাযজ্ঞের সময় মার্চের শেষভাগ। তখন ভাগ্যক্রমে এই হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যায় ওয়াদুদের শিশুনাতি রশীদ। সেই রশীদ এখন যুবক। পিস কমিটির চেয়ারম্যান কাইয়ুম গং সৈয়দপুরের নেতৃস্থানীয় বাঙালীদের একটি নামের তালিকা তৈরি করে পাকিসেনাদের হাতে তুলে দেয়। এই সূত্র ধরে পাকিসেনারা গ্রেফতার করে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডাঃ জিকরুল হক, আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ শামসুল হক, ডাঃ বদিউজ্জামান, ন্যাপ নেতা ডাঃ এসএম ইয়াকুব, রেলওয়ে কর্মকর্তা আয়েজ উদ্দিন, বিশিষ্ট সমাজসেবী তুলশীরাম আগরওয়ালা, রামেশ্বর লাল আগরওয়ালা, যমুনা প্রসাদ কেডিয়া, আইয়ুব হােসেনসহ প্রায় দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে। এঁদের গ্রেফতার করা হয় ২৩ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত। পরে এদের রংপুর উপশহর এলাকায় নিয়ে গিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনীর পরাজয়ের আগে পিস কমিটির চেয়ারম্যান বিহারী কাইয়ুম খান। পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। তবে বিহারী রাজাকার ইজহার এসব হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি প্রচুর লুটপাট করে। সে পাকিস্তান না পালিয়ে গা-ঢাকা দেয়। পরে বাঙালীদের হাতে ধরা পড়ে জেলে যায়। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইজহার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন কোণঠাসা অবস্থায় থাকে। পরে ব্যবসা শুরু করে।
এরপর বিএনপিতে যােগ দেয়। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় সে ‘৮৪ সালে সৈয়দপুর পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। বর্তমানে সে জাতীয় পার্টির (এ) রাজনীতিতে সক্রিয়। জানা গেছে, ‘৭১-এ লুষ্ঠিত সম্পদে সে পাকিস্তানের করাচী শহরে করেছে বাড়ি। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছে জাপানে। বন্ধুর স্ত্রীকে ছিনিয়ে এনে বিয়ে করে সৈয়দপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বানিয়েছে। এখন ইজহার আহমেদ ঐ বালিকা বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে থাকে। এই স্কুল চত্বর থেকেই তার বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালিত হয়। স্কুল ক্যাম্পাসে রয়েছে তার বিস্কুট ফ্যাক্টরি, ক্যান্টিন। এছাড়া সৈয়দপুর শহরে সে গড়ে তুলেছে আবাসিক হােটেল গুলজার বাের্ডিং। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তাবানী বেভারেজের সৈয়দপুরের এজেন্সি পেয়েছে সেই রাজাকার ইজহার আহমেদ। ইজহার আহমেদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবারের অনেকে অভিযােগ করে বলেছেন, রাজাকার ইজহার এখনও তাদের গালিগালাজ করে দোর্দণ্ড প্রতাপে বলে “কোই হামারা কুছভি নেহি বিগার স্যাখোঅর্থাৎ কেউ আমার কিছু করতে পারবে না।” অপর এক রাজাকার আসলাম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার শ্রমিক পদ থেকে সম্প্রতি গােল্ডেন হ্যান্ডশেক করে সেই টাকায় কাপড়ের ব্যবসা করছে।
ইজহার আহমেদের বক্তব্য
গত ১৭ মার্চ বিকালে সৈয়দপুরের পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বাসভবনে গিয়ে ইজহার আহমেদের বক্তব্য চাওয়া হলে সে বলে, ‘৭১-এর যুদ্ধের সময় সৈয়দপুরে আমি রিলিফ কমিটির সদস্য ছিলাম। আমি বিহারী হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরােধী ছিলাম না এবং কোন হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ছিলাম না । সৈয়দপুরে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায় মিলিটারিরা। এদের সহযােগিতা করে সেই সময়ের রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান ও সৈয়দপুর জামায়াতের আমির মহম্মদ কাইয়ুম, সদস্য সেলিম খান, মওলানা মতিনসহ আরও অনেকে। এরা সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সফি ও মেজর জাবেদের সহযােগিতায় বাঙালী ধরে এনে। হত্যাকাণ্ড চালায়। এসব হত্যাকাণ্ডের যখন পরিকল্পনা করা হতাে তখন আমি এর বিরােধিতা করি এবং বলি যারা ক্রিমিনাল তাদের হত্যা করুন ভাল মানুষকে নয়। এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আমার চোখের সামনে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল সেটি হলাে সৈয়দপুর বাঁশবাড়ী মহল্লার বিস্কুট ফ্যাক্টরির মালিক ওয়াদুদের পরিবারের ঘটনাটি। আমি এদের বাঁচাতে ব্যর্থ হই। পরে কাইয়ুম ও সেলিম খান পাকিস্তানে পালিয়ে যায় । আর মওলানা মতিন মারা যায়। সৈয়দপুরের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের অভিযােগে আমি জেলে যাই এবং আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পাই। আমি বিএনপি’র রাজনীতি করতাম। এখন জাতীয় পাটির রাজনীতি করি। ‘৭১-এ সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন এরশাদ সাহেব। তখন এরশাদ সাহেবের পদবী ছিল লেঃ কর্নেল। সেই সময় থেকে এরশাদ সাহেবের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক এবং এখনও আছে। যুবলীগ নেতার পাল্টা বক্তব্য। ইজহার আহমেদের বক্তব্যের সূত্র ধরে সৈয়দপুর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক মহসিন বলেন, ইজহার আহমেদ সৈয়দপুরের সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই জড়িত ছিল। আমার বাবা আমিনুল হক গােলােকে জুট প্রেসে ধরে নিয়ে গিয়ে এই ইজহার আহমেদ। নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতার পর বাড়ির পানির ট্যাঙ্কে লুকিয়ে থাকা অবস্থায়। ইজহার আহমেদকে ধরে এনে সৈয়দপুর থানায় দেয়া হলে সে জেলে যায় এবং ‘৭৫এর পর সে জেল থেকে ছাড়া পায়।
জনকণ্ঠ ৫ ২৯-০৩-২০০১
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন