You dont have javascript enabled! Please enable it!

পঞ্চগড়ের আনােয়ার কসাই নিখোঁজ ॥ ভুয়া মুক্তিযােদ্ধা সায়েদারের মিরপুরে সুরম্য অট্টালিকা

জনকণ্ঠ রিপােট ॥ মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর নৃশংসতার কথা পঞ্চগড়বাসী এখনও ভুলতে পারেনি। স্বাধীনতার ৩০ বছরেও অনেকে ভুলতে পারেনি শহরের  ওপর দিয়ে প্রবাহিত করতােয়া নদীর তীরে অবস্থিত সেই পঞ্চগড় থানা মাঠের  বীভৎস দিনগুলাের কথা। স্বাধীনতাকামী, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যরা তুলে দিত পাকি সেনাদের হাতে। এরপর পাকি সেনারা ও তাদের দোসররা মিলে প্রকাশ্য | দিবালােকে সেই থানা মাঠে স্বাধীনতাকামী, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে এক এক করে মুরগির মতাে জবাই করত। তাদের লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখত থানা মাঠসংলগ্ন আব্দুল আউয়ালের সে সময়ের পরিত্যক্ত বাড়ির উঠানে। এমনই এক নরপশু ঘাতক রাজাকার আনােয়ার কসাই। সে মানুষ জবাই করতে খুব আনন্দ পেত বলে এলাকায় এখনও ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। তাই তার নামের সঙ্গে তখন থেকেই এই কসাই শব্দটা যােগ হয়েছে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যরা তাকে আনােয়ার কসাই বলে ডাকত সে সময়। সেই আনােয়ার কসাই স্বাধীনতার পর আত্মহত্যা করেছে, না কোথাও পালিয়ে গিয়ে আত্মগােপন করে আছে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট তথ্য কেউ জানাতে পারেনি। তবে পঞ্চগড়ের অনেক বয়সী লােক আজও আনােয়ার কসাই নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। সে এতই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির ছিল যে বর্ণনা করতে গিয়ে অনেকেই চোখের পাতা এক করতে পারেননি।

এ অঞ্চলের অগণিত স্বাধীনতাকামী, বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযােদ্ধাকে সেই আনােয়ার কসাই মুরগির মতাে জবাই করত। আর এ কাজে সহায়তা করত রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্য সায়েদার রহমান, আজিজার রহমান, নুরুন নবী, নাসির উদ্দীন, গােলাম রসুল, আব্দুল খালেক মুন্সি, টুনিরহাটের আব্বাস আলী, আব্দুল হাকিম, আবু তালেব, ঘটবরের জহুরুলসহ আরও অনেক ঘাতক। জনকণ্ঠের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় পঞ্চগড় পৌর কমিশনার মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল কাদেরের তার রৌশনাবাগস্থ নিজ বাসভবনে। কিভাবে তার বাবাকে রাজাকার ও তাদের দোসর পাকি সেনারা হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দিয়ে পুঁতে রেখেছে এবং তাদের বাড়ি লুটপাট করেছে তার নিজের চোখে দেখা সেই বীভৎস দিনের কাহিনীগুলাে একের পর এক বলে যান জনকণ্ঠকে দেয়া সাক্ষাতকারে। সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা বলতে গিয়ে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল কাদের। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পাকি সেনা ও রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যদের ভয়ে স্বাধীনতাকামী ও বুদ্ধিজীবীরা পঞ্চগড় শহর ছেড়ে সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে পরিবার-পরিজনসহ আশ্রয় নেন। মুক্তিযােদ্ধা কাদেরের বাবাও আশ্রয় নিয়েছিলেন সদর উপজেলার বড়দহ গ্রামের পরিত্যক্ত এক হিন্দু বাড়িতে। সেখান থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করতেন এবং যােগাযােগ রাখতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখার খবরটি রাজাকার, আলবদর, আলশামস সদস্যরা জেনে যায়। তারা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মরহুম হাজী ইসমাইলের নীলনক্সা অনুযায়ী বড়দহ গ্রামে হামলা চালায়।

দিনটি ছিল ‘৭১-এর ২৩ এপ্রিল বুধবার বেলা আনুমানিক ১১টা। পাকি সেনাদের একটি জলপাই রঙের জীপ গাড়িতে রাজাকার সায়েদার রহমান, আজিজার রহমান, আনােয়ার কসাইসহ তাদের চেলা-চামুণ্ডারা মুক্তিযােদ্ধা কাদেরের বাবা ইদ্রিস আলীকে গাড়িতে উঠিয়ে চোখ-মুখ বেধে ধরে নিয়ে আসে পঞ্চগড় থানায়। খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধা কাদেরও পিছনে পিছনে ছুটে আসে থানায়। থানা মাঠে আরও কয়েকজনের সঙ্গে তার বাবাকেও চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পাকি মেজর আনােয়ার হােসেন নিয়াজী মাঠে এলে রাজাকার সায়েদার রহমান মেজর নিয়াজীর কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলার পর নিয়াজী কাদেরের বাবা ইদ্রিস আলীকে জবাই করার জন্য আনােয়ার কসাইকে নির্দেশ দেয়। এরপর তাঁর বাবার লাশ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে থানা মাঠসংলগ্ন আব্দুল আউয়ালের পরিত্যক্ত বাড়ির উঠানে মাটি চাপা দেয়। বাবার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে আব্দুল কাদের তৎক্ষণাৎ মাটি ছুঁয়ে শপথ নেয় মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার ৩০ বছরেও তার বাবার। হত্যার বিচার হয়নি। তাই তিনি বর্তমান সরকারের কাছে বাবার হত্যার বিচারের দাবি জানান। নরঘাতকদের হাতে এ রকম আরও দু’টি নৃশংস ঘটনার বর্ণনা। দিয়েছেন পঞ্চগড় রাজারপাটডাঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পের নিবাসী মুক্তিযােদ্ধা তমিজ উদ্দিন প্রধান ও পঞ্চগড় মুক্তিযােদ্ধা সংসদের সদস্য বাবুল হােসেন।

তমিজ উদ্দিনের বাবা আছাম উদ্দিন প্রধানকেও সেই রাজাকার বাহিনী হাড়িভাষা গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে এসে পঞ্চগড় থানা মাঠে আনােয়ার কসাইকে দিয়ে মুরগির মতাে জবাই করে । ঠিক অনুরূপ বাবুল হােসেনের চাচা ইনসাফ আলীকেও পাকি। সেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। সেই ঘাতক রাজাকার সায়েদার রহমান স্বাধীনতার পর পুলিশ বাহিনীতে চাকরি নিয়ে বেশ সুখেই আছে। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে বিলাসবহুল সুরম্য অট্টালিকা গড়ে তুলেছে। শােনা যায়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ঘাতক পঞ্চগড় থেকে পালিয়ে গিয়ে কিছুদিন আত্মগােপন করে থাকে। এরপর মুক্তিযােদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট যােগাড় করে ১৯৭২ সালে পুলিশ বাহিনীতে যােগ দেয়। পুলিশ। বিভাগে চাকরির সুবাদে রাজাকার সায়েদার কালাে টাকার পাহাড় গড়ে তােলে। এখনও পাকি চিন্তা-চেতনা ও আদর্শে সেই রাজাকার সায়েদার স্বাধীন দেশের মাটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে বীরদর্পে। এখনও তার সেই পুরনাে রাজাকারী খাসলত বদলায়নি। পঞ্চগড় শহরের সিংপাড়ায় শহীদ মুক্তিযােদ্ধা হবিবর রহমান পরিবারের জমি। জোরপূর্বক গ্রাস করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তার পুলিশী দাপটে এই শহীদ মুক্তিযােদ্ধা পরিবারটি বর্তমানে ভয়ে তটস্থ অবস্থায় দিনযাপন করছে। পঞ্চগড় মুক্তিযােদ্ধা সংসদ এই শহীদ পরিবারটির সাহায্যে এগিয়ে আসার কারণে সেই রাজাকার সায়েদার আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে।

জনকণ্ঠ ॥ ০৬-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!