You dont have javascript enabled! Please enable it! পঞ্চগড় পঞ্চগড়ের ৫ ঘাতক এখন সরকারী বেসরকারী চাকরি নিয়ে সুখেই আছে - সংগ্রামের নোটবুক

পঞ্চগড় পঞ্চগড়ের ৫ ঘাতক এখন সরকারী বেসরকারী চাকরি নিয়ে সুখেই আছে!

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ পঞ্চগড়ের বিশিষ্ট সাংবাদিক মুক্তিযােদ্ধা কাওছার আলী স্মৃতির পাতাগুলাে হাতড়াতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিথর হয়ে পড়েন। চোখ দুটো বার বার মুছতে মুছতে একাত্তরের সেই বীভৎস কাহিনীর স্মৃতিচারণ করেছেন জনকণ্ঠকে দেয়া সাক্ষাতকারে। পঞ্চগড়ের চৌরঙ্গীতে তার দোকানে বসেই কথা হয় এই প্রতিনিধির সঙ্গে। সামনের করতােয়া নদী আর জেলা পরিষদ ডাকবাংলাে দেখিয়ে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে তিনি। জানান, তার বড় ভাই শহীদ আবু আরেফ মােহাম্মদ ইসরাইলকে পাকি সেনা এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সদস্যরা কিভাবে হত্যা করে এই ডাকবাংলােতে। কিভাবে নদীতে ভাসিয়ে দেয় লাশ। সেই বিভীষিকাময় দিনটিতে তিনি বাড়ি ছিলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে শুনেছেন বড় ভাই ও বাবার কাছে। আবু আরেফ মােহাম্মদ ইসরাইল ছিলেন তৎকালীন পঞ্চগড় রাজনৈতিক জেলা শাখা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। পেশায় হােমিও চিকিত্সক ও পঞ্চগড় সদরের টুনিরহাট হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। টগবগে এই যুবকের বয়স সে সময় ৩৮ কি ৩৯ হবে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে মুক্তিযুদ্ধে। সেখানেই তিনি ভারতের হলদিবাড়ী এবং সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের অকড়াবাড়ী এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক বিভীষিকাময় দিনে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার, আলবদর, আলশামসের সংগঠক হাজী ইসমাইল হােসেন (বর্তমানে মৃত) পঞ্চগড়ের স্বাধীনতাকামী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীলনক্সা তৈরি করে।

সে অনুযায়ী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সদস্য মােঃ আজিজার রহমান, মােঃ গােলাম রসুল, মােঃ নুরুন নবী, আব্দুল খালেক মুন্সী, মােঃ নাসির উদ্দীন টুনিরহাট হাই স্কুলে গিয়ে স্কুলের তত্ত্বালীন কেরানি আলতাফ হােসেনকে দিয়ে হলদিবাড়ী থেকে শিক্ষক অনুদানের টাকা গ্রহণের লােভ দেখিয়ে আবু আরেফকে স্কুলে ডেকে আনে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ওঁৎ পেতে থাকা ওরা ৫ জন সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে পঞ্চগড়ের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইসমাইল হােসেনের বাড়িস্থ রাজাকার, আলবদর ও আলশামস কার্যালয়ে। সেখানে মসজিদের বারান্দার খুঁটির সাথে শহীদ আবু আরেফকে বেঁধে রাখে। আবু আরেফ আছরের নামাজ পড়ার জন্য ওজুর পানি চাইলে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস সদস্যরা বদনায় সকলে এক এক করে প্রস্রাব করে তাকে ওজু করতে দেয়। এর পর হাজী ইসমাইলের নির্দেশে ওরা ৫ জন ধরে নিয়ে যায় পাকি সেনাদের সদর দফতর পঞ্চগড় জেলা পরিষদ ডাকবাংলােতে। এর পর পাকি সেনারাসহ রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা শহীদ আবু আরেফকে করতােয়া নদীর ওপর নির্মিত সাবেক লােহার ব্রিজে নিয়ে গিয়ে বন্দুকের নল ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং তার লাশ নদীতে ফেলে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ আবু আরেফের ছােট ভাই মরহুম এসএম হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে উল্লিখিত ৫ রাজাকার, আলবদর ও আলশামসকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সাধারণ ক্ষমার আওতায় আসামীরা খালাস পায়। একাত্তরে সেই রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পাকিরা মিলে পুরাে পঞ্চগড় এলাকার অগণিত স্বাধীনতাকামী এবং বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে।

অভিযােগ রয়েছে, এসব হত্যার নেতৃত্ব দেয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও রাজাকার, আলবদর আলশামসের কমান্ডার হাজী ইসমাইল হােসেন। সে সময় বহু নারীর সম্ভ্রম লুট করে এই হায়েনার দল। তাদের নির্মম ও নৃশংস হত্যার শিকার আরও কয়েকজন স্বাধীনতাকামী, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধার নাম পাওয়া গেছে। এরা হচ্ছেন শহীদ আব্দুস সােবহান, শহীদ ইয়াছিন আলী, মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হারুন-অর-রশীদ, শহীদ মওলানা ইদ্রিস আলী, শহীদ মােঃ কাওসার আলী প্রমুখ। শহীদ আবু আরেফকে পাকি সেনাদের হাতে তুলে দেয়া সেই পাঁচ রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সদস্য স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ সুখেই আছে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে। এদের মধ্যে আজিজার রহমান বিএসসি এখন কলেজিয়েট ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক। গােলাম রসুল পঞ্চগড় সরকারী হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক। মােঃ নাসির উদ্দীন পঞ্চগড় পশু হাসপাতালের হেড ক্লার্ক এবং আব্দুল খালেক মুন্সী মারা গেছে। এদের মধ্যে আরও একজন বর্তমানে ঢাকায় পুলিশ বিভাগে কর্মরত। স্বাধীনতার ৩০ বছরেও শহীদ আবু আরেফসহ পঞ্চগড়ের অন্য শহীদদের নামে আজ পর্যন্ত তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। পালন করাও হয় না এঁদের শহীদ দিবসগুলাে। শুধু শহীদ আবু আরেফের স্মৃতি রক্ষার্থে তার ছােট ভাই মরহুম হাবিবুল্লাহ ও কাওছার আলী ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আরেফ স্মৃতি কাগজঘর’ দিয়ে স্মৃতি ধরে রেখেছেন।

জনকণ্ঠ ॥ ১২-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন