You dont have javascript enabled! Please enable it! পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মাছিরের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় দারােগা আবদুল কাদেরকে - সংগ্রামের নোটবুক

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে মাছিরের নেতৃত্বে হত্যা করা হয় দারােগা আবদুল কাদেরকে

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ দেবীগঞ্জ থানার এক দারােগাসহ ৯ হিন্দুর হত্যাকারী, সংখ্যালঘুদের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ এবং লুণ্ঠনকারী সেই রাজাকার মাছির উদ্দীন এখন জামায়াত নেতা ও সমাজসেবক। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় দীর্ঘদিন পঞ্চগড় জেলা জামায়াতের আমির হিসাবেও অধিষ্ঠিত ছিল। সে সময় দু’বার সংসদ। নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চগড়ের মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করে। একজন। সামান্য চা-বিক্রেতা মাছির এখন অনেক বিত্তের মালিক। দেবীগঞ্জের গ্রামের বাড়ি ছাড়াও পঞ্চগড় শহরের মােলানী-বােদাপাড়াতেও তার রয়েছে একটি বাড়ি। এখানেই সে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকে। রাজাকার মাছিরের এক ছেলে মধ্যপ্রাচ্যে থাকত। কিন্তু শােনা যায়, সেখানে সে টাকা চুরির দায়ে জেলহাজতে যায়। তার এক জামাই এক সময়ের শিবির নেতা, বর্তমানে পঞ্চগড় জেলা বারের আইনজীবী এবং জামায়াতের লিগ্যাল এ্যাডভাইজরও। দেবীগঞ্জের স্থানীয় সাংবাদিক বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা এনামুল হক জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মাছির এবং তার চেলাচামুণ্ডারা দেবীগঞ্জ এলাকায় অসংখ্য হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে গরু-বাছুর, ধান-চাল, সােনা-রুপা, নগদ টাকা পয়সা লুটপাট করে। এমনকি ঘরের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়। সে সময়ের হত্যাযজ্ঞসহ লুটপাটের ঘটনার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে এই মুক্তিযােদ্ধার চোখ ছলছল করতে থাকে।

তিনি জানান, রাজাকার মাছির স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে এলাকার ২০/২৫ জনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে এবং সেই দলের সে নেতৃত্ব দেয়। এরপর তার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত দেবীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ, অর্থ সম্পদ লুণ্ঠনসহ অসংখ্য হিন্দু যুবতী মেয়ের ইজ্জত হরণ করে। তার এই লােমহর্ষক কর্মকাণ্ডের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে আল্লারাখা নামে এক পাকি সেনা কর্মকর্তার প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠে। তার সহযােগী। রাজাকার অন্য সদস্যরা হচ্ছে হানিফ মাস্টার, শওকত আলী, হামিদার রহমান। বসুনিয়া, রহমান কমান্ডার, আব্দুল আজিজসহ আরও অনেকে। রাজাকার মাছির ও তার চেলাচামুণ্ডাদের ভয়ে দেবীগঞ্জের মাটি কাঁপত। এলাকার লােকজন এখনও তাদের সে হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাটের বর্ণনা করতে গিয়ে আঁতকে ওঠে। রাজাকার মাছিরের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা সে সময় দেবীগঞ্জ থানার দারাগাে আব্দুল কাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডটি ‘৭১-এর এপ্রিল কি মে মাসের দিকে হবে। দারােগা আব্দুল কাদেরের অপরাধ ছিল সে মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা এবং এলাকার হিন্দু পরিবারদের নিরাপত্তা দিয়ে ভারতে যাওয়ার সহযােগিতা করা। এর পর ঐ দিনই ভারত থেকে নিজ গ্রামের বাড়ি সােনাহারে ১৫/২০টি হিন্দু পরিবার ফেরার পথে মাছির ও তার চেলাচামুণ্ডারা করতােয়া নদীর পাড়ে তাদের আটক করে সর্বস্ব লুটপাট করে নেয় এবং এক এক করে ৯ জনকে হত্যা করে।

নিহতরা হলাে (১) ধওলা, পিতা-ধনেশ্বর; (২) কান্দু, পিতা-নেকাই; (৩) উমেষ, পিতা-ভরতচন্দ্র; (৪) ভরতচন্দ্র, পিতা-অজ্ঞাত; (৫) মিটোন, পিতারাঙ্গা; (৬) রাঙ্গা, পিতা-হরিকান্ত; (৭) জলধর, পিতা-বুধারু। বাকি দুজনের নাম পাওয়া যায়নি। এঁদের হত্যার পর এক সাথে একটি গর্তের মধ্যে মাটিচাপা দেয়। যে স্থানটিতে সে সময় তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়েছে বর্তমানে সে স্থানটি করতােয়া নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দেবীগঞ্জের রাজাকার এই মাছিরের লােমহর্ষক ঘটনার তথ্যপ্রমাণ যার কাছে দলিল হিসাবে মজুদ ছিল সেই সফিউল আলম ওরফে সাফদার মাস্টারকেও ১৯৭৬ সালে নৃশংসভাবে হত্যা করে সব তথ্যপ্রমাণ সরিয়ে ফেলা হয়। সাফদার মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের পিছনে মাছিরের হাত রয়েছে বলে এলাকার লােকজনের মুখে শােনা যায়। এলাকার লােকজন জানায়, রাজাকার মাছির স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুদের। যে সমস্ত সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল তার কিছু অংশ স্বাধীনতার পর তার কাছ থেকে। ফেরত নেয়া হয়েছে, যা দেবীগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার কাজে লাগানাে হয়েছে।

মাছিরের বক্তব্য

পঞ্চগড় শহরের সিনেমা রােডের সামনে মাছিরের কাছে স্বাধীনতা যুদ্ধে তার কি ভূমিকা ছিল এবং সামান্য চা-বিক্রেতা থেকে কিভাবে এত ধনসম্পদের মালিক হলেন জানতে চাওয়া হলে সে এ সব বিষয় এড়িয়ে গিয়ে শুধু জানায়, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় সে হিন্দুদের যে সমস্ত সম্পদ লুট করেছে তা পরবর্তীতে স্বাধীন হওয়ার পর হিন্দুদের মাঝে ফেরত দিয়েছে। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সে জানায়, কোন হত্যাকাণ্ডের সাথে সে জড়িত ছিল না। সে সময় সে শান্তি কমিটির একজন সদস্য হিসাবে লােকজনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযােগিতা করেছিল। তবে জনকণ্ঠের ওপর তার প্রচণ্ড ক্ষোভ রয়েছে, যা তার সাথে কথা বলেই বােঝা যায়। জনকণ্ঠের সাংবাদিক। পরিচয় পেয়ে সে আর বেশিক্ষণ থাকেনি। কাজ আছে বলে তাড়াহুড়া করে সটকে পড়ে।

জনকণ্ঠ ০৫-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন