You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজাকারের ওসি ইব্রাহীম যশােরের খাজুরা ক্যাম্পে টুকরা টুকরা করে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করেছে

ফখরে আলম, যশাের থেকে ॥ রাজাকারের ওসি ডাক্তার ইব্রাহিম গং যশােরের উত্তরাঞ্চলের খাজুরা ক্যাম্পে টুকরা টুকরা করে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধাকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে মিত্রবাহিনীর ৬ অফিসারকে। স্থানীয় এমএন মিত্র হাইস্কুলের সেই ক্যাম্প থেকে এখনও কেউ কেউ গভীর রাতে মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। স্কুলের টর্চারসেলের পাশে দাড়িয়ে রাজাকারদের নৃশংসতার স্মৃতিচিহ্ন দেখে। বুলেটের ক্ষতের মধ্যে হারানাে স্বজনের মুখ খোজে। যশাের-মাগুরা সড়কের পাশেই খাজুরা বাজার। এ বাজারের পশ্চিমে এমএন মিত্র হাইস্কুল। একাত্তরে এই স্কুলের গবর্নিং কমিটির সেক্রেটারি ছিল ডাক্তার ইব্রাহিম হােসেন। ইব্রাহিম নিজেকে খাজুরার ওসি ঘােষণা করে ২৫ রাজাকার নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তােলে। আর নিজের স্কুলকে বানায় রাজাকার ক্যাম্প। ইব্রাহিমের অন্য পরাজিত রাজাকার সৈনিকরা হচ্ছে- কাঠুরাকান্দি গ্রামের হেকমত আলী, মােসলেম আলী, আমাজাত আলী, লিয়াকত আলী, হাবিবর মােল্লা, ফসিয়ার মােল্লা, যাদবপুর গ্রামের আব্দুর রহমান, মােশারেফ মুন্সী, মথুরাপুর গ্রামের সিরাজ কাজী, সেকেন্দারপুরের সমিরউদ্দিন, হাসান আলী, কৃষ্ণপুরের কাদের ড্রাইভার, হলিহট্টের রুহুল আমিন, চাপাতলার সিদ্দিকুর রহমান, চণ্ডিপুরের নাসির, হাকিম লস্কর, ছােট খুদরার জুলফিক্কারসহ আরও কয়েকজন। সরেজমিন খাজুরা এলাকা ঘুরে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা, শিক্ষক, কৃষক ছাড়াও নানা পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই রাজাকারদের নৃশংসতা সম্পর্কে অনেক গা শিউরে ওঠা কাহিনী জানা গেছে। ইব্রাহিম যুদ্ধের শুরুতে স্কুলের কমনরুমকে টর্চারসেল বানিয়ে এলাকার বরেণ্য ব্যক্তি, মুক্তিযােদ্ধা, নিরীহ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করে। এই টর্চারসেলে কয়েকদিন আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে রাজাকাররা জবাই করে মানুষ হত্যা করেছে। লাশ ফেলে দিয়েছে পাশের চিত্রা নদীতে। এলাকার গণ্যমান্য ডাক্তার আব্দুল কাদের ও লক্ষ্মণ। পুরামানিককে ইব্রাহিম গং প্রথমে হত্যা করে হাত পাকায়। এরপর হত্যা করা হয় মুক্তিযােদ্ধা দুই ভাই ময়েনউদ্দিন ময়না ও আয়েনউদ্দিন আয়নাকে। একাত্তরের এই নরঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধা আজিজ হত্যার কথা স্মরণ করে এখনও কারও কারও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চণ্ডিপুর গ্রামের আজিজকে খাজুরা ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। এরপর কয়েকদিন টর্নারসেলের নির্যাতন শেষে তাকে টুকরা টুকরা করে কেটে রাজাকাররা চিত্রা নদীতে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। এ সময় নরপশুরা আজিজের লিঙ্গ কেটে তার মুখে ভরে দেয়। এই দৃশ্য সে সময় অনেকেই প্রত্যক্ষ করেছে। আরও জানা যায়, ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২২ মুক্তিযােদ্ধা কাঠুরাকান্দি গ্রামের পালবাড়ি ঘাট দিয়ে ফরিদপুর যাচ্ছিল। এ সময় রাজাকারদের সাথী গ্রামের আলী আহমদ।

মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে ফেলে। সে মুক্তিযােদ্ধাদের বলে, সামনে রাজাকার আছে। মিথ্যা কথা বলে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র এক ঘরে আর মুক্তিযােদ্ধাদের অন্য একটি ঘরে আটকে রেখে রাজাকারদের খবর দেয়। পরে ইব্রাহিম গং এসে এদের স্কুলে ধরে নিয়ে যায় । কয়েকদিন নির্যাতন চালিয়ে ২২ মুক্তিযােদ্ধাকে এরা হত্যা করে। স্কুলে বাঙ্কার খুঁড়ে রাজাকাররা ঘাঁটি গেড়েছিল। ৬ ডিসেম্বর এই ক্যাম্প দখল করার জন্য মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে ‘জয় বাংলা’ বলে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানাে হয়। বাঙ্কারের ভিতর থেকে ফন্দি এঁটে রাজাকাররা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দেয় । মিত্র বাহিনীর ৭ অফিসার প্রথমে ক্যাম্পে প্রবেশ করে। আর সাথে সাথে রাজাকাররা গুলি ছােড়ে। ঘটনাস্থলে ৬ অফিসার নিহত হন। এই ঘটনার পর মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক এসে রাজাকারদের সব বাঙ্কার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। রাজাকারদের এই নৃশংসতা সম্পর্কে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল জলিল বলেন, আমি একাত্তর সালেও স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলাম । ইব্রাহিম ডাক্তার স্কুল বন্ধ করে রাজাকার ক্যাম্প চালু করে। স্বাধীনতার পর স্কুলের কমনরুমে জমাটবাধা এক হাঁটু পরিমাণ রক্ত ছিল। তিনি আরও বলেন, ভারতীয় ৬ সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর কারণে স্বাধীনতার আনন্দ আমাদের কাছে ম্লান হয়ে যায়। স্থানীয় শহীদ সিরাজুদ্দিন হােসেন কলেজের শিক্ষক গােপিকান্ত সরকার এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা খুনী রাজাকারদের বিচার চাই। এমএন। স্কুলে তারা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা খাজুরাসহ আশপাশের এলাকার সবাই জানে। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে খাজুরা এলাকা ছিল উল্লেখযােগ্য রণাঙ্গন। এই রণাঙ্গন এলাকার রাস্তার নাম শহীদদের নামে রাখার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ঘাতক ডাক্তার ইব্রাহিম নিখোঁজ রয়েছে। লিয়াকত, হাবীব, ফসিয়ার, আলী আহমদ এই রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে। তবে অন্য রাজাকাররা বহাল তবিয়তে রয়েছে। রাজাকার ওসি ইব্রাহিম নিখোঁজ থাকায় তার ভাষ্য পাওয়া যায়নি। রাজাকার কাদের ও মােশারফের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে তারা কোন মন্তব্য করতে চায়নি।

জনকণ্ঠ ॥ ৩০-০৩-২০০১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!