You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানিকগঞ্জ

রশিদবাহিনীর কথা মনে করে শিবালয়ের তেওতা গ্রামের মানুষ এখনও শিউরে ওঠে

সাব্বিরুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ থেকে ॥ রাজাকার রশিদ ও তার বাহিনীর কথা মনে করে তেওতা গ্রামের লােকজন এখনও আতঙ্কে শিউরে ওঠে। ১৯৭১-এ শিবালয় থানার ঐ গ্রামে রশিদ বাহিনীর হাতে চৌদ্দজন নিরীহ গ্রামবাসী জীবন দিয়েছিল। এদের | অধিকাংশের লাশ পাওয়া যায়নি | গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনা নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। একটু অবস্থাপন্ন পরিবার হলেই রাজাকারদের হাতে লুটপাটের শিকার হয়েছে। বড় অঙ্কের চাঁদা দিয়েও বাঁচতে পারেনি অনেকে। রশিদ বাহিনীর প্রধান রশিদ মারা গেলেও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকে এখনও বেঁচে আছে। এদেরই একজন বন্দে আলী এখন এলাকার মস্ত পীর। অথচ ঐ পীর বন্দে আলীর বাল্যবন্ধু সুনীল কুমার সন্ন্যাসীর কাকা কানাইলাল সন্ন্যাসীকে হত্যার পিছনে রশিদ। বাহিনীর প্রধান সহযােগী ছিল সে। সেদিনের কথা মনে করে এখনও আতঙ্কে কেঁপে ওঠে সুনীল। ১৯৭১ সালের ২৮ নবেম্বর সকাল দশটায় সুনীলের তিন ভাই অনিল, বাদল। ও মহেন্দ্রকে তেওতা বাজারে দোকান থেকে রাজাকাররা ধরে রশিদের পানসী নৌকায়। বন্দী করে। খবর পেয়ে সুনীল গা-ঢাকা দেয়। সেই সময়ের ৭শ’ টাকা চাঁদা দিয়ে তিন | ভাইকে বাবা-কাকারা ছাড়িয়ে আনে। কিন্তু ঐ দিন রাতেই আবার হানা দেয় রশিদ বাহিনী। এবার সুনীলের বাবা ও কাকা কানাইলালকে ধরে নিয়ে যায়। পরিবারের মেয়েছেলেদের কান্নাকাটি, হাতে-পায়ে ধরায় বাবাকে ছেড়ে দিলেও কাকা কানাইলালকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় রাজাকাররা বলেছিল, ‘এ ব্যাটার ছেলেমেয়ে নাই, এটাকেই। খতম কর।’ কাকার লাশও পায়নি সুনীলেরা। কাকাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরপরই শুরু হয় বাড়িতে লুটপাট।

নেতৃত্ব দেয় সুনীলের বাল্যবন্ধু আজকের পীর বন্দে আলী। সুনীলের মা চোখভরা জল নিয়ে দেখেছিল যাকে পুত্রস্নেহে নিজের ছেলের সাথে ভাত। বেড়ে খেতে দিয়েছে সেই ছেলেটার রুদ্রমূর্তি। ঐ বন্দে আলীর হাতে-পায়ে ধরেও ভাইয়ের প্রাণ বাঁচাতে পারেনি মনিন্দ্র কুমার সরকার। ভাই সুবল চন্দ্রকে মুক্তিবাহিনীর সহযােগী হিসাবে পাকি মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল ঐ বন্দে আলী আর সামসু দারােগা। বন্দী সুবল চন্দ্রকে রশিদ রাজাকারের পানসীতে করে তেওতা থেকে শিবালয় এনে তুলে দিয়েছিল ঐ দুই ঘাতক । ভাইকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে প্রায় পাঁচ কিলােমিটার রাস্তা দৌড়ে ছােট্ট মনিন্দ্র এসেছিল শিবালয়ে । থানায় নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছিল। ভাইয়ের প্রাণভিক্ষা চেয়ে বন্দে আলীর পা জড়িয়ে ধরেছিল। একটা শিশুর আর্তিতে মন গলেনি বন্দে আলীর। ভাইয়ের লাশটিও পায়নি মনিন্দ্রর পরিবার। রাজাকার রশিদ বাহিনীর আরেক দোসর মহম্মদ আলী ফজলু এখন হাজী। হজ করে, দাড়ি রেখে, লেবাস পাল্টিয়ে বহালতবিয়তেই আছে। বিয়ে করেছে তিনটি। ‘৭১ সালে এই নরঘাতক তেওতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ডাক্তার অজিত কুমার চক্রবর্তী হত্যার প্রধান নায়ক।

শহীদ রতন ও তার পরিবার মানিকগঞ্জ শহর থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল ডাক্তার অজিত কুমার চক্রবর্তীর বাড়িতে। পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে রতন বিশ্বাস ছিল সকলের পিরচিত। আর সেই রতনের পরিবারকে আশ্রয় দেয়ার অপরাধে প্রাণ দিতে হয়েছে। অজিত কুমারকে। হাত-পা বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় ডাঃ অজিতকে যমুনা নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়। জানা গেছে, এর পরও কোনভাবে তিনি নদীর পাড়ে উঠে এসেছিলেন, কিন্তু ঘাতকরা আবার তাঁকে নদীতে ফেলে দেয়। ডাঃ অজিতকে হত্যা করার পিছনে প্রধান হােতা ছিল আজকের হাজী মহম্মদ আলী ফজলু। তার দৃষ্টি ছিল ডাঃ অজিতের কিছু সম্পত্তির ওপর। ‘৭১ সালে ঐ সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এখন ঐ সম্পত্তি ভােগ করছে সেই রাজাকার ফজলু। শহীদ রতনকে আশ্রয় দিয়ে ডাঃ অজিত প্রাণ দিলেও রতন কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। রাজাকারদের হাত থেকে। রতনসহ তেওতা গ্রামের গােপাল সরকার ও সুভাষ পাঠককে রাজাকাররা হত্যা করেছিল নদীতে হাত-পা বেঁধে চুবিয়ে। এদের ধরিয়ে দিয়েছিল রশিদ বাহিনী ও তার সঙ্গী বন্দে আলী, ফজলু, গােলাপ খা, চান্দু, নাকারি । তেওতা গ্রামের লােকজনের সাথে আলাপকালে বর্তমানে শিবালয় থানা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় এক নেতার প্রতি ইঙ্গিত করে তারা জানিয়েছে, সে ছিল রশিদ বাহিনীর সদস্য। ভয়ে ঐ লােকের নাম উচ্চারণ করেনি কেউ। তবে যতদূর জানা গেছে, তার নামের সংক্ষিপ্ত রূপ দাড়ায় আঃ হাঃ।

জনকণ্ঠ ॥ ২৬-০২-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!