পাবনার হাদল গণহত্যার নায়ক হাসান মৌলভী এখন ওয়াজ করে বেড়ায় দেশ-বিদেশে
আখতারুজ্জামান আখতার, পাবনা থেকে ॥ বয়স পনেরাে কি ষােলাে। দেখতে চাদের মতাে ফুটফুটে। গৌড় বাবুর অতি আদরের মেয়ে। বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠের মধ্যে বাবলা গাছ, এরই নিচে মেয়েটিকে উলঙ্গ করে ৪/৫ পাকি সেনা আদিম উল্লাসে মেতে ওঠে। নেকড়ে যেমন হরিণ শাবককে ক্ষত-বিক্ষত করে ছিন্নভিন্ন করে খায় ঠিক তেমনিভাবে মেয়েটির সবকিছু লুটেপুটে নিয়ে বাবলা গাছের সাথেই বেঁধে মেয়েটিকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চলে গেল ওরা। দূরে লুকিয়ে এ বীভৎস দৃশ্য দেখলাম আমরা। হিংস্র নেকড়ের নখরে ক্ষত-বিক্ষত মেয়েটি পানি পানি করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এটি কোন সিনেমার দৃশ্য নয়, কোন গল্প বা উপন্যাসের কাহিনীও নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, ‘৭১-এ রাজাকার, আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরােধীদের সহায়তায় পাবনার। হাদল গ্রামে যে নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এটি তারই একটি বাস্তব খণ্ডিত চিত্র। প্রায় ৪শ’ নারী-পুরুষ সেদিন হাদলের মাটিতে শহীদ হন। আগুনের লেলিহান শিখায় নিমিষে ভস্মীভূত হয় পুরাে গ্রাম। একই সাথে চলে ধর্ষণ ও লুটপাট। সে এক অবর্ণনীয় দুঃসহ বেদনার্ত কাহিনী। এই হাদল গণহত্যায় পাকি বর্বর বাহিনীর সহায়তায় স্বাধীনতাবিরােধীদের সেদিনের মূল নায়ক ছিল মৌলানা আবুল হাসান হাদলী ওরফে হাসান মৌলভী । সে এখন পীরের লেবাসে দেশ-বিদেশে ওয়াজ নসিহত করে বেড়ায়। পাবনা শহর থেকে আনুমানিক ৩০ কিলােমিটার উত্তরে ফরিদপুর উপজেলার এক নিভৃত। পল্লীর নাম হাদল। এককালের বিত্তবৈভবে সমৃদ্ধিশালী হিন্দু-মুসলমানদের বসতি। যােগাযােগ ব্যবস্থা অত্যন্ত মান্ধাতা আমলের। গােলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গােয়াল ভরা গরু ছিল মানুষের। জারি-সারি ভাটিয়ালি গান, যাত্রা প্রভৃতি নিয়ে সুখের সীমা ছিল না যেন হাদলবাসীর। কিন্তু একদিন কালরাতের ভােরে ঘুমন্ত মানুষের কোন কিছু জানার আগেই দেশীয় রাজাকার, আলবদরসহ স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের সহায়তায় পাকি বর্বর বাহিনীর মেশিনগানের গুলি হাদলবাসীর সব সুখ সব আশা কেড়ে নেয়।
গ্রামবাসীরা জানান, বাংলা সালের সেদিন ছিল ৮ জ্যৈষ্ঠ। ভােরে ঈশ্বরদী থেকে ভাঙ্গুড়া হয়ে কয়েক শ’ পাকি সেনা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হাদল গ্রামে প্রবেশ করে এবং পুরাে গ্রাম ঘিরে ফেলে। তারা গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্কার কেটে মেশিনগান তাক করে অবস্থান নেয়। স্থানীয় পিস কমিটির চেয়ারম্যান, কুখ্যাত রাজাকার মৌলনা আবুল হাসান হাদলী ওরফে হাসান মৌলভীর পরিকল্পনা অনুযায়ী অন্য রাজাকারদের সহায়তায় পাকি বাহিনীকে হাদল গ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেদিন হাসান মৌলভীর নেতৃত্বে জাহিদ, নইমদ্দি, রজব কারিকর, মেনহাজ আলী, আজিজল মৌলভীসহ বেশকিছু ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত হয় পিস কমিটি। দুর্গম এলাকা বলে বর্ষায় নৌকা এবং শুকনাে মৌসুমে হাটা ছাড়া হাদল গ্রামে আসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। এই কুখ্যাত রাজাকারচক্র পাকি বাহিনীকে হাদল গ্রামে প্রবেশের জন্য ম্যাপ করে দেয়। রাজাকার জাহিদ পাকি। বাহিনীকে এ ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য সহযােগিতা করে বলে যারা বেঁচে আছেন তারা জানান। এই স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকি বাহিনী হাদল গ্রামে প্রবেশ করলে তারা আনন্দে মেতে ওঠে। যােগাযােগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় হাদল গ্রাম। সেদিন অনেকের কাছেই নিরাপদ আশ্রয় হিসাবে মনে হয়েছিল। এজন্য পাবনা, ঈশ্বরদী, নাটোরসহ বিভিন্নস্থান থেকে হিন্দু-মুসলমান এ গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। এ গ্রামের তুফান বাবুর বাড়ি থেকে কালিকাপুর গ্রামের দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত প্রায় ১ কিলােমিটার বিস্তৃত হিন্দু বসতি। সবাই ধনাঢ্য। পাকি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসরদের সহায়তায় হিন্দু অধ্যুষিত পাড়াটি ঘিরে ফেলে। পূবাকাশে সূর্য ওঠার সাথে সাথে শূন্যে একটি আলাের বিচ্ছুরণ দেখা দেয় এবং তখনই মেশিনগান থেকে মুহুর্মুহু গােলাবর্ষণ হতে থাকে।
হাসান মৌলভী তার দোসরদের নিয়ে পুরাে এলাকায় মেতে ওঠে লুটপাটে এবং আগুন দিয়ে পুরাে এলাকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই প্রাণে বাচতে ছােটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু শেষ চেষ্টা করেও সেদিন পাকি বাহিনী এবং হাসান মৌলভীর লােকদের হাত থেকে অনেকেই আর বাঁচতে পারেনি। মেশিনগানের গুলিতে পাখির মতাে মানুষ মরতে থাকে। হাসান মৌলভী এ সময় ঘােষণা দেয়তােমাদের সােনাদানা- টাকাপয়সা যা আছে তা পিস কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। এই বলে সে ডাক্তার শরৎ চন্দ্র সাহা, সতেন্দ্র নাথ সাহা ও বিনয় কুমার সাহাসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে ৩৬ কলস সােনার গহনা লুট করে নেয়। হাসান মৌলভীর লােকদের সহায়তায় পাকি বাহিনী হিন্দুদের ধরে এনে কাপড় তুলে হিন্দু-মুসলমান। শনাক্ত করার পর হিন্দুদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যারা বাঁচার জন্য এসেছিলেন তাদের মধ্যে পাবনা আরএম একাডেমীর শিক্ষক প্রাণকৃষ্ণ সাহা, অশােক সাহা, সুবল সাহা, নাট্যাভিনেতা পরেশ সাহা, রাখাল বসাক প্রমুখকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। হালদার পাড়ার কৃষ্ণ হালদারের (৮০) ২ ভাই প্রিয় ও বিশ্বনাথ এবং ভাতিজা লক্ষ্মী ও জেঠা হারান, সুনীল হালদারের বাবা বদ্দিশ্বর, শংকর হালদারের মা কমলা বালা, মধু সাহা, সত্য সাহার ছেলে সুবল, কাজলা সাহা, তারাপদ, শ্রীপদ, উৎপলের বাবা বটু সাহা, কাশেম আলী, মােঃ ছবেদ উল্লা, মােঃ আলী সরকারের বাড়িতে আশ্রিত অজ্ঞাতনামা মজিবর গাছিসহ ৪শ’ মানুষকে পাখির মতাে গুলি করে হত্যা করা হয়। যারা সব হারিয়ে এক সাগর বেদনা বুকে ধারণ করে এখনও বেঁচে আছেন তারা। অতীতের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে এখনও ভয়ে আঁতকে ওঠেন। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে নেন। ভয়ে কথা বলতে চান না। অনেক বুঝিয়ে এবং সান্ত্বনা দিয়ে সেদিনের সেই দুঃসহ দিনগুলাের কথা জিজ্ঞাস করতেই তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অনেকেই স্বজনদের কথা মনে করে বুক। চাপড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন।
এ সময় হালদারপাড়ার কৃষ্ণ হালদার (৮০) বলেন, ধড়ে জান নিয়ে কোনমতে বেঁচে আছি। নতুন করে জ্বালা বাড়িয়ে লাভ কি? অগণিত লাশের সৎকার করে এখনও বেঁচে আছেন হরেন চন্দ্র। তার ভাষায় কিয়ামত হয়েছিল সেদিন হাদলে। বড় ভাই বটু সাহাকে হারিয়ে কালিদাস সাহা কিভাবে প্রাণে বাঁচেন সেদিনের সে স্মৃতি মন্থন করে আজও তিনি চোখের জল ফেলেন, থমকে দাড়ান। বর্তমানে পাবনা সরকারী মহিলা কলেজের রসায়নের শিক্ষক কালিদাস সাহা তার এক ভাই ও ভাতিজাকে নিয়ে ৮ জ্যৈষ্ঠ ভােরে যখন পুরাে এলাকায় চলছিল কিয়ামতের আজাব, তখন পার্শ্ববর্তী পাড়ার কায়েম উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কায়েম উদ্দিনের স্ত্রী ৩ জনকে ঘসির মাচায় দেহ ঘসিতে (শুকনাে গােবরের জ্বালানি) ঢেকে মুখের ওপর তালপাতা ও খড়কুটা দিয়ে ঢেকে রাখেন। দুপুর নাগাদ পাকি বাহিনী ও হাসান মৌলভীর দস্যুরা চলে গেলে ৩ জনকে এই দুর্বিষহ আশ্রয় থেকে বের করে আনা হয়। হাসান মৌলভীর বাহিনী স্বাধীনতার কিছুদিন পরেও হাদল গ্রামে নির্মম নির্যাতন চালায়। বলে গ্রামবাসীরা অভিযােগ করেন। জগবন্ধু সাহা ওরফে তুফান বাবু ও তার ছেলে কোমলকে লুট করা গরু এবং মালামাল ফেরত দেয়ার কথা বলে রাজাকার আজিজল মৌলভীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের মাটিতে শুইয়ে বাঁশ দিয়ে বেলনে রুটি বানানাের মতাে করে পেষা হয়। তুফান বাবু এ নির্যাতনের পর ভুগে ভুগে মারা যান এবং তার ছেলে দেশ ছেড়ে চলে যায়। হাদল গ্রামে রাজাকার চক্রের সহায়তায় পাকি বাহিনী হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি মেতে ওঠে ধর্ষণে। অনেক যুবতী মেয়ে এবং গৃহবধূ পাকিদের হাতে নির্যাতিত হয়। গৌড়বাড়ির এক তরুণীকে আদিমযুগের কায়দায় নির্যাতন করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তথ্য দেন, এলাকাবাসী। লােকলজ্জার ভয়ে কেউ দেশ ছেড়ে চলে যায়, কেউ আত্মহত্যা করে এবং অব্যক্ত বেদনা নিয়ে এখনও কেউবা নীরবে ডুকরে ডুকরে কাঁদে। হাদল গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং লুটপাট ও ঘরবাড়ি জ্বালানাের নায়ক, কুখ্যাত রাজাকার হাসান মৌলভী এখন পীর সেজে দেশ-বিদেশে ওয়াজ নসিহত করে বেড়ায় । ‘৭০-এ স্বাধিকার আন্দোলনের সময় সারা দেশে যখন মুক্তির পক্ষে গণজোয়ার তখনও এই কুখ্যাত রাজাকার হাসান মৌলভী জামায়াতে ইসলামীর টিকিটে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়।
তবে সে শুধু পরাজিত হয়নি তার নাকি জামানতও বাজেয়াফত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অনেক রাজাকার মারা গেলেও এই হাসান মৌলভী এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং চান্দাই গ্রামে আত্মগােপন করে থাকে। ‘৭৫এর পর সে আবার প্রকাশ্যে আসে। চাটমােহরে জবতলা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসাবে ২ বছর চাকরি করে। তারপর ঢাকায় গিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করে। সেখান থেকে কিছুদিন পর এলাকায় এসে পীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখন সে দেশ-বিদেশে ওয়াজ নসিহত করে। পাবনার মানুষের কাছে হাদল গণহত্যা এক দুর্বিষহ এবং বেদনার্ত অধ্যায়। প্রতিবছর স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে হাদল গণহত্যার স্মৃতিমন্থন করে বক্তারা চোখের পানি ফেলেন। ঘৃণায় থুথু ফেলেন সেইসব রাজাকারদের প্রতি যারা এই নারকীয় কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। পাবনার আবালবৃদ্ধবনিতা কুখ্যাত হাসান মৌলভী ও তার দোসরদের ফাঁসি দাবি করেন।
হাসান মৌলভীর খাদেম ও ছেলের বক্তব্য
হাদল গণহত্যাসহ নারকীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে হাসান মৌলভীর বক্তব্য জানার জন্য তার বাড়িতে যাওয়া হয়। হাসান মৌলভীর ছেলে ইসমাইল হােসেন। এবং খাদেম হােসেন আলী মােল্লা জানান, হুজুর বাড়িতে নেই। তিনি ২ মাসের ভিসা নিয়ে ওয়াজ করতে ইন্ডিয়া গেছেন। সেখানে ১২ বৈশাখ পর্যন্ত কর্মসূচী আছে। এ সময় খাদেমকে হাদল গণহত্যার সাথে তার হুজুরের জড়িত থাকার কথা বলা হলে তিনি। জানান, হুজুর কোন মুসলমানের ক্ষতি করেননি। পাক বাহিনী হুজুরকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিল “মালাউন কা মােকাম কাহা হ্যায়” তখন তিনি হিন্দুদের বাড়িঘর শুধু দেখিয়ে দিয়েছিলেন। রাজাকার রজব কারিকর এখন ৮০ বছরের বৃদ্ধ। হাদল গণহত্যায় তার জড়িত থাকার কথা বলা হলে সে সব অস্বীকার করে। রাজাকার জাহিদকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জনকণ্ঠ ॥ ১২-০৪-২০০০
সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন