You dont have javascript enabled! Please enable it! পাবনা করমজা-বৃশালিখার বহু হত্যা লুটের নায়ক রফিকুন্নবী বাবলু এখন কোটিপতি - সংগ্রামের নোটবুক

পাবনা করমজা-বৃশালিখার বহু হত্যা লুটের নায়ক রফিকুন্নবী বাবলু এখন কোটিপতি

আখতারুজ্জামান আখতার, পাবনা থেকে ॥ সাঁথিয়ার করমজা, বেড়ার বৃশালিখাবাসী। মন থেকে এখনও মুছতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধকালের সেই দুঃসহ দিনগুলাের কথা। তাই আজও তারা ক্ষোভ, দুঃখ ও ঘৃণা প্রকাশ করে সেই সব রাজাকার, আলবদরসহ তথাকথিত “পিস কমিটির সদস্যদের প্রতি, যাদের সহায়তায় পাকি বর্বরবাহিনী করমজা, বৃশালিখা, সােনাতলা, ডেমরা, শহীদনগর (ডাব বাগান), নগরবাড়ীসহ প্রভৃতি এলাকায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতনসহ চালায় ধ্বংসযজ্ঞ। সেই সব রাজাকার, আলবদরদের অন্যতম নেতা রফিকুন্নবী বাবলু এখন সমাজপতি, কোটিপতি। বাবলুর পিতা সিরাজ ডাক্তার ছিল স্থানীয় “পিস কমিটি”র দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা ও ঘৃণিত রাজাকার। বর্তমান জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামীর দক্ষিণ-হস্ত বাবলু তার পিতার সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধকালে আসাদ, আফজালসহ বহু স্বাধীনতাবিরােধী ব্যক্তিকে নিয়ে শক্তিশালী চক্র গড়ে তােলে। গণঅভিযােগ রয়েছে, স্বাধীনতাবিরােধী এই চক্রের নির্দেশ, পৃষ্ঠপােষকতায় ছিল মতিউর রহমান নিজামী। এই রাজাকারচক্র সেদিন বেড়া ও সাঁথিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পাকিদের নিয়ে হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযােগ, নির্যাতন ও লুটপাটে মেতে ওঠে। সিরাজ ডাক্তারের নেতৃত্বে বেড়া বাজারে অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট পরিচালিত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে একবার ধরা পড়ে উত্তম-মধ্যম খেয়ে কোন মতে প্রাণে বেঁচে যায় সে। স্বাধীনতার পরে বাবলু আত্মগােপন করলেও ‘৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং রাজনৈতিক পুনর্বাসনের মাধ্যমে বাবলু আবার জনসমক্ষে চলে আসে। শক্তি অর্জন করে সেই রফিকুন্নবী বাবলু এখন বিপুল বৈত্তবৈভবের মালিক।

ইবনে সিনা ট্রাস্টের সে অন্যতম কর্তা ব্যক্তি। ঢাকায় বহুতল ভবনের মালিক। ভগ্নিপতি এটিএম আজহারুল ইসলাম ঢাকা মহানগর জামায়াত নেতা। বাবলু ঘৃণিত রাজাকার থেকে এখন কোটিপতি। ১৯৭১ সালের ৮ মে এবং ৩ ডিসেম্বর। করমজা ও বৃশালিখা গ্রামের মানুষের কাছে। অভিশপ্ত দিন, বীভৎস দুঃসহ স্মৃতি। ৮ মে খুব ভােরে বাবলু, আসাদ ও আফজালসহ স্থানীয় রাজাকার, আলবদর এবং তথাকথিত পিস কমিটির কতিপয় ঘৃণিত লােকের। সহায়তায় পাকিবাহিনী করমজা গ্রামে প্রবেশ করে। সশস্ত্র দুবৃত্তরা ঘিরে ফেলে। সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মেগা ঠাকুরের বাড়ি ও হালদারপাড়া। মেগা ঠাকুরসহ ঠাকুর। পরিবারের দ্বিজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, করু ভট্টাচার্য, হালদারপাড়ার শশীচরণ হালদার, শান্তি। হালদার, সুরেন্দ্রনাথ হালদার, কার্তিক হালদার, আদু হালদারসহ ৩ জন মুসলমান ফকির। মাহমুদ, ছমির উদ্দিন ও হাবিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতাবিরােধী। রাজাকারচক্র করমজা গ্রামে এছাড়াও চালিয়েছে লুটপাট, অগ্নিসংযােগ এবং নির্যাতন। এ গ্রামেরই গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযােদ্ধা চতুর আলী। একজন সৎ নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক ও বীর মুক্তিযােদ্ধা হিসাবে এলাকায় শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি পর পর ৩ বার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচতি হন। ষাটোর্ধ চতুর আলী জানান, শিমুলিয়া ক্যাম্পে গেরিলা কমান্ডার থাকাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে করমজা গ্রামের হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে গ্রামে এসে জানতে পারি রাজাকার কমান্ডার আসাদ, আফজাল ও আলবদর কমান্ডার লাবলুর নেতৃত্বে করমজা গ্রামে হত্যাকাণ্ডসহ ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, বাবলুর হাতে ছিল স্টেনগান। আসাদ ও আফজাল ছিল আপন ২ ভাই। এরা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে মারা গেলেও বাবলু এখনও রয়েছে বহাল তবিয়তে।

চতুর আলী চেয়ারম্যান আফসােস করে বলেন, যাদের কারণে স্বামীর সামনে স্ত্রী, ভাইয়ের সামনে বােন ধর্ষিত হলাে, মায়ের সামনে ছেলে খুন হলাে- স্বাধীন দেশে তাদের বিচার হলাে । ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী বলেন, আমি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেছি, দেখেছি লুটপাট। বাবলুর নেতৃত্বে সােনাতলা, করমজা, বৃশালিখায় অগ্নিসংযােগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ডেমরায় ২ হাজারের বেশি মানুষকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে। ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরােধীচক্রের সহায়তায় পাকি বর্বরবাহিনী বেড়া বাজার ও বৃশালিখা গ্রামে অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট করে। বৃশালিখা গ্রামে ৭/৮ জনকে হত্যা করা হয় ঐদিন। এদের মধ্যে বীর মুক্তিযােদ্ধা শহীদ সােহরাব আলীর ছেলে আব্দুল লতিফ (তিনিও মুক্তিযােদ্ধা) জানান, বৃশালিখা গ্রামে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞে নেতৃত্ব দেয় বাবলু। তার বাবা সিরাজ ডাক্তার সে সময়ে পিস কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। তার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে বেড়া বাজারে অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট হয়। আবদুল লতিফ জানান, রফিকুন্নবী বাবুল ছিল আমার এক ক্লাস ওপরে। বেড়া বিবি স্কুলে এসএসসি ও বেড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে সে। স্বাধীনতার পর। আত্মগােপন করে এবং ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর বাবলু প্রকাশ্যে। বেরিয়ে আসে। বৃশালিখা গ্রামের আবু সাহিন (৩০) জানান, তার বড় ভাই শামসুল হক রাজাকার পাকিদের নির্যাতনের পর ভুগে ভুগে মারা যায়। পরিবারের সবার কাছে। শুনেছে, বাবলুর নেতৃত্বে নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও ঘরবাড়ি জ্বালানাের কথা। বেড়া। পৌরসভার কমিশনার রওশন আলীও অনুরূপ অভিযােগ করেন। করমজা, বৃশালিখাসহ বেড়া-সাঁথিয়ার মুক্তিযােদ্ধা, কৃষক-শ্রমিক ও শহীদ পরিবারের তথ্য মতে, মুক্তিযুদ্ধকালে মাওলানা নিজামীর নির্দেশেই রফিকুন্নবী বাবলু অত্র এলাকায় স্বাধীনতাবিরােধীদের সংগঠিত করে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আজও সে ধারা। অব্যাহত রেখে অর্জিত স্বাধীনতা নস্যাত করতে এরা তৎপর রয়েছে।

জনকণ্ঠ ॥ ২৪-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন