You dont have javascript enabled! Please enable it! সুনামগঞ্জ সুনামগঞ্জের শ্রীরামসি গ্রামে হত্যা লুণ্ঠনে অভিযুক্ত আহমদ এখন গণ্যমান্য ব্যক্তি - সংগ্রামের নোটবুক

সুনামগঞ্জ সুনামগঞ্জের শ্রীরামসি গ্রামে হত্যা লুণ্ঠনে অভিযুক্ত আহমদ এখন গণ্যমান্য ব্যক্তি

সালাম মশরুর, সিলেট থেকে ॥ একাত্তরের আগস্টে যে রাজাকার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি গ্রামে ঘটিয়েছিল নারকীয় হত্যাকাণ্ড, চালিয়েছিল লুটপাট, পুড়িয়ে দিয়েছিল মানুষের ঘরবাড়ি, সে এখন সিলেট শহরের বাসিন্দা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি। পাকিদের দালালি করে ও লুটপাট চালিয়ে বিস্তর টাকাপয়সা কামিয়ে সে এখন ভদ্রলােক সেজেছে। ক্ষোভে-দুঃখে এসব কথা বললেন মুক্তিযােদ্ধা সিরাজুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলি ইউনিয়নের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ছাত্রলীগের কর্মী। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। শ্রীরামসি গ্রামে নারকীয় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘৭১-এর ২৯ আগস্ট দু’রাজাকার আসে শ্রীরামসি গ্রামে। তারা স্থানীয় যুবকদের রাজাকার হওয়ার পরামর্শ দেয়। গ্রামের যুবকরা এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করার দু’দিন পরেই ঘটে সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। এই নারকীয় ঘটনার হােতা ছিল পাকিদের দালাল রাজাকার আহমদ। সেই নিয়ে এসেছিল তার সাঙ্গপাঙ্গদের। মুক্তিযােদ্ধা সিরাজুল ইসলাম ভয়াবহ সেই ৩১ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, গ্রামের ভিতরের খাল দিয়ে কিছু নৌকা এসে ভিড়ল শ্রীরামসি। নৌকার ভিতরে পাকি সৈন্য ও তাদের সহযােগী রাজাকার বাহিনীর সদস্য ও দালাল। তাদের নাকি ধারণা ছিল, এ অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর অবস্থান রয়েছে এবং তারা বিনা বাধায় গণহত্যা সম্পন্ন করতে পারবে না। তাই এত সাজ সাজ রব ও প্রস্তুতি। সকাল ১০টায় ‘ তারা গ্রাম প্রায় ঘেরাও করে শান্তি কমিটি গঠনের নাম করে গ্রামবাসীকে এক জায়গায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানায়। গ্রামবাসীরা তাদের ভাঁওতা সম্পর্কে অবহিত ছিল এবং এই আহ্বানে মােটেই সাড়া দেয়নি। ফলে শুরু হলাে নির্যাতন। বহু লােককে অস্ত্রের মুখে ধরে আনা হলাে শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ে।

শুধু গ্রামবাসী নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী এবং ব্যবসায়ীও এঁদের মধ্যে ছিলেন। সমবেত হওয়ার পর  উপস্থিত সবাইকে ভাগ করা হলাে দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে বৃদ্ধ আর কিশাের । যুবক ও প্রৌঢ়রা থাকলেন দ্বিতীয় ভাগে। বিদ্যালয়ের দু’টি কক্ষে ঢােকানাে হলাে দু’টি গ্রুপকে। শুরু হলাে প্রথম গ্রুপের সাথে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা। তারা জানতে চাইল পাকিস্তানবিরােধীদের নাম। কিন্তু বৃদ্ধরা কোন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হলেন না। সশস্ত্র হায়েনারা তখন ব্যর্থ হয়ে চলে আসে দ্বিতীয় কক্ষে। বেঁধে ফেলল ঐ গ্রুপের সকল দামাল ছেলেকে। তাদের আবার ভাগ করা হলাে দু’টি দলে এবং নিয়ে গেল দুটি বাড়িতে। প্রথম দলকে নিয়ে গেল রসুলপুর পাড়ার মােছলেম উল্লার বাড়িতে।  সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাল সবাইকে। এর আগেই তাদের হাত বেঁধে ফেলা হয়েছে। সবাই বুঝল কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা স্বাধীনতার বলি হতে যাচ্ছে। কেউ কেউ প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করল শেষ বারের মতাে। ৬ জন নিজেদের মুসলিম লীগের লােক বলে প্রাণ ভিক্ষা চায়। সৌভাগ্যক্রমে পাকবাহিনীর এক দালাল ছিল তাদের আত্মীয়। হত্যাকাণ্ডে ঐ দালাল জড়িত থাকায় মুক্ত হয়ে গেল ওই ৬ বন্দী। তবে শর্ত থাকল, সমস্ত বাজার তাদের নিজেদের উদ্যোগে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হবে। অবশ্য মুক্ত হবার পর সে শর্ত পূরণ না করে সুযােগ বুঝে পালিয়ে যায় তারা। এই সময়ে অতিকষ্টে বন্ধনমুক্ত হয়ে। পালিয়ে বাঁচেন জওয়াহিদ চৌধুরী, হুসিয়ার আলী, ডাঃ আব্দুল লতিফ প্রমুখ । কিন্তু যারা পালাতে পারল না, পাক সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে লুটিয়ে পড়ল তাদের অনেকেই। অন্যদিকে নজির মিয়ার পুকুরপাড়ে দ্বিতীয় গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত যাদের নেয়া হয়েছিল তাদের বুক লক্ষ্য করে একইভাবে গুলি ছােড়া হলাে।

ফলে এখানেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বহু লােক। উভয় গ্রুপে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা হলাে ছফিল উদ্দিন (দীঘিরপাড়), আব্দুল লতিফ (ডাকঘরের নৈশপ্রহরী) ও তপন চক্রবর্তী (নিহত তহসিলদারের পুত্র) লন্ডন প্রবাসী আলকাছ মিয়া (চাদ বােয়ালিয়া) প্রমুখ। একদিকে চলছে ওই গণহত্যা, অন্যদিকে গ্রামের বুক চিরে প্রবাহিত খাল দিয়ে যাতায়াতকারী নৌকাগুলাে থামিয়ে এর আরােহীদের আটক করা হচ্ছে। চলছে। হত্যাকাণ্ড। এর পর পাকিবাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসররা আসে বাজারে। লুটপাট চালায় বাজার এবং এখানকার বিশিষ্ট বাড়িগুলােতে। শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ও তাদের লুটপাটের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এত কিছুর পরও সন্তুষ্ট হলাে না পিশাচরা। মিটল না তাদের ধ্বংসযজ্ঞের সাধ। আগুন ধরিয়ে দিল বাজার ও গ্রামে। এখানেও থামল না বর্বর পশুদের অভিযান | হত্যা করল নৌকা থেকে আটক করা পুরুষ। যাত্রীদের। লাশগুলাে ভাসিয়ে দিল তারা খালের জলে। তাই শ্রীরামসি গ্রামে কতজনকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক সংখ্যা বের করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আজও নিশ্চিতভাবে কেউ সে সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেনি। এ দিন কিন্তু গ্রামে কোন লােক থাকেনি। পর দিনও ভয়ে ফিরল না তারা। গ্রামজুড়ে তখনও টহল চলছে পাক সেনাদের। গ্রামের অবশিষ্ট বাড়িগুলােতেও তারা আগুন ধরিয়ে দিল। ঐ দিনও শহীদদের লাশগুলাে পড়ে থাকল। এর পরদিন আশপাশের কিছু লােকজন সাহস সঞ্চয় করে এলাে শ্রীরামসি।

শনাক্ত করল কিছু লাশ। ডেকে আনল তাদের আত্মীয়স্বজনদের। কবরস্থ করল তাদের দীঘিরপাড় নামের গােরস্তানে। যাদের লাশ শনাক্ত করা হয়েছিল তাদের কয়েকজন হলাে, (১) শহীদ ছাদ উদ্দিন। আহমদ, হেডমাস্টার শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়। (২) শহীদ মাওলানা আব্দুল হাই, হেড মাওলানা শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়, (৩) শহীদ সত্যেন্দ্র বাবু, তহসিলদার, পীরেরগাঁও। (৪) শহীদ ইয়াহিয়া, সহকারী তহসিলদার পীরেরগাঁও। (৫) শহীদ আব্দুল বারী, প্রাক্তন ইউপি সদস্য। (৬) শহীদ ফিরােজ মিয়া (প্রবাসী), কাদিরপুর, শ্রীরামসি। (৭) শহীদ এখলাছুর রহমান, দীঘিরপাড়, শ্রীরামসি। (৮) শহীদ সামছু মিয়া (গেদু), সাতহাল, শ্রীরামসি। (৯) শহীদ আব্দুল জলিল, সাতহাল, শ্রীরামসি (১০) শহীদ আলা মিয়া, সাতহাল, শ্রীরামসি (১১) শহীদ ওয়ারিচ মিয়া, সাতহাল, শ্রীরামসি (১২) শহীদ ছুয়াব মিয়া, সাতহাল, শ্রীরামসি (১৩) শহীদ আব্দুল লতিফ, সাতহাল, শ্রীরামসি (১৪) শহীদ রইছ উল্লা, সাতহাল, শ্রীরামসি (১৫) শহীদ মানিক মিয়া, সাতহাল, শ্রীরামসি। (১৬) শহীদ দবির মিয়া, আব্দুল্লাপুর। (১৭) শহীদ মরম আলী, গদাভাট। (১৮) শহীদ মন্তাজ আলী। (১৯) শহীদ মজিদ মিয়া, রসুলপুর । (২০) শহীদ নজির মিয়া, রসুলপুর । (২১) শহীদ সুনু মিয়া, রসুলপুর। (২২) শহীদ ডাঃ আঃ মন্নান, শ্রীরামসি বাজার। (২৩) অজ্ঞাতনামা দর্জি, (২৪) শহীদ ছামির আলী, পশ্চিম শ্রীরামসি, (২৫) শহীদ রপু মিয়া, ঐ, (২৬) শহীদ রুস্তুম আলী, ঐ, (২৭) শহীদ আছা মিয়া, ঐ, (২৮) শহীদ তৈয়ব আলী, ঐ (২৯) শহীদ রােয়াব আলী, ঐ (৩০) শহীদ থফাজ্জল আলী, ঐ। (৩১) শহীদ মছদ্দর আলী, ঐ। (৩২) অজ্ঞাতনামা শিক্ষক, শ্রীরামসি প্রাইমারী স্কুল। (৩৩) অজ্ঞাতনামা পােস্ট মাস্টার, শ্রীরামসি ডাকঘর, (৩৪) অজ্ঞাতনামা ডাকপিয়ন, শ্রীরামসি ডাকঘর। (৩৫) শহীদ মােক্তার মিয়া (প্রবাসী) চকসিপুর। (৩৬) দোকান সহকারী। শ্রীরামসি বাজার, (৩৭) শহীদ আঃ মান্নান, হাবিবপুর, জগন্নাথপুর। (৩৮) শহীদ নূর মিয়া, পিতা তৈয়ব আলী । (৩৯) শহীদ জহুর আলী, পিতা রশিদ উল্লা। মুক্তিযােদ্ধা সিরাজুল আরও জানান, স্বাধীনতার পর রাজাকার আহমদ ও আরও ২৫/৩০ জনকে আসামী করে মামলা করেছিলেন চাদ বােয়ালিয়া গ্রামের আবদুস সােবহানের পুত্র আলাউদ্দিন। তখন আসামীরা গা ঢাকা দেয়। এসে আস্তানা গাড়ে সিলেট শহরে। এদিকে তদ্বিরের অভাবে মামলাটিও অচল হয়ে যায়। এখন এ রাজাকাররা সমাজে প্রতিষ্ঠিত।

জনকণ্ঠ। ২২-০১-২০০১

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন