You dont have javascript enabled! Please enable it! রামগতির করাইতলা ক্যাম্পের ঘাতক মওলানা রেদোয়ান এখন আদম বেপারি - সংগ্রামের নোটবুক

রামগতির করাইতলা ক্যাম্পের ঘাতক। মওলানা রেদোয়ান এখন আদম বেপারি

জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ একাত্তরে রামগতির করাইতলা ক্যাম্পের খুনী রাজাকার কমান্ডারদের নৃশংসতার কথা ৩০ বছর পরও রামগতির মানুষ ভােলনি। পাকি প্রভুদের তুষ্ট করার জন্য এই ক্যাম্পের রাজাকার আর শান্তি কমিটির পিশাচরা মুক্তিযােদ্ধা ও নৌকায় ভােটদানকারীদের অনেককে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছে করাইতলা ক্যাম্পের অদূরে ক্রসবাধের কোলে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে একপর্যায়ে চরম মার খেয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই ক্যাম্পের দেশদ্রোহীরা রামগতি ছেড়ে পালিয়েছিল। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাদের অনেকেই আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। একাত্তরের করাইতলা ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার খুনী মওলানা রেদোয়ান বর্তমানে টঙ্গীর বিত্তবান আদম বেপারী। রেদোয়ানের সহকর্মী রাজাকার মওলানা আবদুল লতিফ এখন স্থানীয় তােরাবগঞ্জ আহম্মদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার, স্থানীয় নিকাহ রেজিস্ট্রার এবং ভবানীগঞ্জের বড় সমবায়ী নেতা। কিছুদিন আগে রাজিয়া বেগম নামে এক গৃহবধূ এই মওলানার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযােগ এনে মামলা দায়ের করেছে। সে এখন করাইতলা ও তােরাবগঞ্জ বাজারে।

কোটি টাকার স্থাবর সম্পদের মালিক। তােরাবগঞ্জের মৃত চৌকিদার মকবুল আহমেদের পুত্র মওলানা লতিফ কিভাবে কোটিপতি হলাে তা কেউ জানে না। করাইতলা রাজাকার ক্যাম্পের আরও কয়েকজন হচ্ছে তােরাবগঞ্জের মৃত ফজলুল হক কারীর পুত্র আশ্রাফ আলী, এলাকার চরমার্টিনের মৃত আনােয়ার আলীর পুত্র নজির আহমদ মাস্টার, একই গ্রামের মৃত আরব আলীর পুত্র মােঃ হােসেন, তােরাবগঞ্জের মৃত সাইদুল হকের পুত্র নুরুল ইসলাম মেম্বর, তােরাবগঞ্জের মৃত ছাইদুল হক ভুয়ার পুত্র খালেক মেম্বর ও তােরাবগঞ্জের ব্যবসায়ী মাহে আলম পাটোয়ারী। আজও এলাকাবাসী তাদের ঘৃণা করে। রামগতি থানার তােরাবগঞ্জের এনায়েত উল্লাহ মুন্সীর পুত্র ভুয়া মওলানা রেদোয়ান গাজীপুর জেলার টঙ্গী কলেজ রােডস্থ আউছপাড়া হাউস বিল্ডিংয়ের। দোতলা বিলাসবহুল ভবনে সমাজপতি সেজে বসে আছে। নােয়াখালীর লক্ষ্মীপুর থানার। দক্ষিণে ছিল উত্তাল মেঘনা। মেঘনার দক্ষিণে রামগতি দ্বীপ। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। মেঘনার বুকে নির্মিত হয় ক্ৰসর্বাধ। লক্ষ্মীপুর থানার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের আবদুল্যাহপুর গ্রাম থেকে রামগতির তােরাবগঞ্জ হয়ে করাইতলা পেরিয়ে চরলরেঞ্জ পর্যন্ত নির্মিত হয় এই ক্ৰসর্বাধ। এই বাঁধের করাইতলায় ছিল একাত্তরের ঘাতক। রাজাকার, কমান্ডারদের ক্যাম্প। করাইতলা রাজাকার ক্যাম্পের কসাইরা একাত্তরে তােরাবগঞ্জের আবদুর রব মাঝির পুত্র মুক্তিযােদ্ধা আলী আহম্মদকে টুকরাে টুকরাে করে কেটে হত্যা করে। তােরাবগঞ্জের আরব আলী মাঝির দুই জোয়ান পুত্র মুক্তিযােদ্ধা ফয়েজ আহমদ ও নজির আহমদ, তােরাবগঞ্জের বসুর ছেলে আবুল খায়ের, চর উভতির আবুল কাদের, কাজীর চরের আলী আহমদের মুক্তিযােদ্ধা পুত্র সাফায়েত উল্যাহসহ অনেককে এই ক্যাম্পের  রাজাকাররা হত্যা করে। এদের নৃশংসতার একটি ছােট নজির চর উভতির তােবারক আলীর দুই জোয়ান পুত্র। শাহজাহান ও সুলতান আহমদ তােরাবগঞ্জ থেকে চরলরেঞ্জ যাওয়ার সময় ২৮ আগস্ট বিকালে করাইতলা রাজাকার ক্যাম্পের ১ কি. মি. উত্তরে থাকতেই ধরা পড়ে স্থানীয় রাজাকারদের হাতে।

তাদের পকেটে পাওয়া টাকায় তুষ্ট হতে না পেরে রাজাকাররা প্রকাশ্য বাঁধের ওপর এক ভাইয়ের সামনে অপর ভাইকে খেজুর গাছ কাটা ছেনি দিয়ে টুকরাে টুকরাে করে কেটে ফেলে । দুই সহােদরকেই তারা মেরে লাশ লাথি দিয়ে ফেলে দেয় ক্রসবাধের পাশে। স্থানীয় কাদির ব্যাপারী ও মুক্তিযােদ্ধা হানিফ সরকারের বাড়ির পাশে এখনও দেখা যাবে তাদের লাশ চাপা দেয়া মাটির টিবি। এই রাজাকাররাই ৩ অক্টোবর ‘৭১ মুক্তিযােদ্ধা মুস্তাফিজ ও আলী আহমদকে পাকি | সেনাদের হাতে তুলে দেয়। নােয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা আন্ডারচর ও কাজীর চরে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের বিশাল শেল্টার।। মুক্তিযােদ্ধাদের বিবিরহাট, চর আলেকজান্ডার, জমিদার হাট আর করুণার হাট থেকে | চাল আটা আর বক ও সিজার্স সিগারেটের সরবরাহ দেয়া হতাে। কিন্তু রাজাকার বা পাকি সেনাদের নির্দেশে চরে মুক্তিযােদ্ধাদের শেল্টারে রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয় । রসদ বন্ধ হওয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়ে করাইতলা রাজাকার ক্যাম্পের ওপর রেকি। করার জন্য পাঠানাে হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধা মুস্তাফিজ ও আলী আহমদকে। এরা দুজন আশ্রয় নিয়েছিল তােরাবগঞ্জ বাজারের দক্ষিণ পাশের তােরাব আলী হাওলাদারের বাড়িতে। রাজাকার ও শান্তি কমিটির নেতা রেদোয়ান, খালেক, আশ্রাফ আলী, নজির। আহমদরা মুক্তিযােদ্ধা মুস্তাফিজ ও আলী আহমদকে ধরে শুধু পাকিদের গাড়িতে তুলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তােরাব আলীদের বাড়িও আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তােরাব আলীদের আন্ডার চরের যে ঘরে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল তাও রাজাকাররা পুড়িয়ে দেয়। মেঘনায় পাকিদের গানবােট চলাচলে নজর রাখা আর উপকূলীয় এলাকার তরুণদের গেরিলা প্রশিক্ষণে ওপারে পাঠানাের কাজ চলাকালে করাইতলা ক্যাম্পের রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের রসদ বন্ধের পাঁয়তারায় ক্ষুব্ধ মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার আর পাকিদের ওপর হামলা চালায়। ১১ অক্টোবরের হামলায় করাইতলা ক্যাম্পের অপর রাজাকার কমান্ডার চরবিকার রফিক ও তার পিতা সুফী আহমদসহ ১৮ জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের ফাদে ধরা পড়ে প্রাণ হারায়। এই যুদ্ধ হয়েছিল রামগতির জমিদারহাট সংলগ্ন উত্তর বাকে।

রাজাকারদের বক্তব্য

একাত্তরের করাইতলা রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার ও বর্তমানে টঙ্গীর কোটিপতি আদম বেপারী রেদোয়ানকে জনকণ্ঠ অফিস থেকে তার ‘৭১-এর হত্যা, লুট, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযােগের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে মওলানা রেদোয়ান এই অপরাধের কথা স্বীকার করে, তবে এর জন্য দায়ী করে এলাকার অপর রাজাকার কমান্ডার রফিককে। রেদোয়ান তার নাম বাবার নাম সবই স্বীকার করে, ‘৭১-এ সে রাজাকার কমান্ডার ছিল তাও অস্বীকার করেনি। অপরদিকে একাত্তরের ৩ অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধা মুস্তাফিজ ও আলী আহমদকে পাকিদের গাড়িতে তুলে দেয়া এবং তােরাব আলীদের বাড়িতে আগুন দেয়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে তােরাবগঞ্জে বর্তমানে আলিশান বাড়ির মালিক খালেক মেম্বর মুখে পাকা দাড়ি নিয়ে বলে, একাত্তরে আমি ছােট ছিলাম । দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন খালেক মেম্বরকে মুক্তিযােদ্ধারা বেত্রাঘাত করতে করতে জেলে পুরেছিল? এই প্রশ্নে খালেক নিরুত্তর থাকে । তােরাবগঞ্জ মাদ্রাসা সুপার আবদুল লতিফ দাবি করে ‘৭১-এ তার বয়স কম ছিল। সে লুটপাট বা রাজাকারী করেনি। চৌকিদার পিতার পুত্র লতিফ এত সম্পদ কোথায় পেয়েছে, প্রশ্ন করলে সে কোন উত্তর দেয়নি।

জনকণ্ঠ ॥ ১৭-০৪-২০০০

সূত্র : সেই রাজাকার – জনকন্ঠে প্রকাশিত রিপোর্টের সংকলন