লক্ষ্মীপুর পেয়ারাপুর ক্যাম্পের ঘৃণিত কমান্ডার আবদুল হাই ও জল্লাদ বেলায়েতের নামে আজও লক্ষ্মীপুর আতঙ্কিত
জনকণ্ঠ রিপাের্ট ॥ ‘৭১-এ লক্ষ্মীপুরে পেয়ারাপুর ক্যাম্পের ঘূণিত রাজাকার কমান্ডার। আবদুল হাই ও তার জল্লাদ বেলায়েত হােসেনের নামে আজও সারা লক্ষ্মীপুর আতঙ্কিত। কমান্ডার আবদুল হাই ও জল্লাদ বেলায়েত এবং তাদের পাকি ও এই দেশী দোসররা। কত লােক হত্যা করেছে, কত নারী নির্যাতন করেছে এবং কত বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, কত কোটি টাকার সম্পদ লুট করেছে তার সঠিক সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ণয় করা আজ অসম্ভব। লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকার মুসলিম-অমুসলিম মিলিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যার, কয়েক শ’ বাড়ি লুট ও অগ্নিসংযােগ এবং বহুসংখ্যক নারী নির্যাতনের ঘটনার। সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্যাতনের যন্ত্রণা এবং সামাজিক অপমানে একাধিক নারী। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অথবা পরিচিত এলাকা থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে এবং একাধিক নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। বর্তমানে ‘৭১-এর রাজাকার কমান্ডার আবদুল হাই এক বিত্তশালী জামায়াত নেতা। ঢাকায় জামায়াত কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তার অবস্থান। অপরদিকে জল্লাদ বেলায়েত। হােসেন চট্টগ্রামের বিত্তশালী, প্রতিষ্ঠিত চামড়া ব্যবসায়ী। অভিযােগ রয়েছে, গােলাম আযমের বিশ্বস্ত অনুচর, তথাকথিত মাওলানা আবদুল হাই। ও তার অপর সহকর্মীরা জামায়াত কানেকশন কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের ডলারের বদৌলতে লক্ষ্মীপুরে আগ্নেয়াস্ত্র যােগান দিচ্ছে। তরুণদের শিবির ক্যাডার বানিয়ে শহীদ হলে বেহেশতের লােভ দেখাচ্ছে আর নগদ অর্থের বিনিময়ে এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই ক্যাডার হত্যা করছে মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লােকদের।’ লক্ষ্মীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতাপক্ষের অনেককে নির্মমভাবে হত্যার পিছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে আবদুল হাই তাদের অন্যতম। হুকুমতে পাকিস্তান কায়েম রাখার জন্য আবদুল হাইরা ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে। জামায়াত আর মুসলিম লীগের পক্ষে কাজ করে।
এরপরও নৌকার ঐতিহাসিক বিজয়ে। এরা বিমূঢ় হয়ে পড়ে। নানা ঘাতপ্রতিঘাতের পর ‘৭১-এর ২৫ মার্চ ঢাকায় পাকি সেনাদের গণহত্যার ঘটনায় এরা পুলকিত হয়। অপেক্ষায় থাকে কখন পাকি সেনারা। লক্ষ্মীপুর আসে। একই সময় নজর রাখে কারা জয় বাংলার পক্ষে কাজ করছে। নােয়াখালীর বীর মুক্তিযােদ্ধাদের অসম সাহসিকতার জন্য পাকি হানাদারবাহিনী এক | মাস নােয়াখালী ঢুকতে না পারায় এদের লক্ষ্মীপুর প্রবেশ করাও সম্ভব হয়নি। লক্ষ্মীপুরে খানসেনারা পৌছার পর মাওলানা আবদুল হাইসহ কয়েক নেতা পাকিদের শুভেচ্ছা জানায়। পাকিরা এদের পাকিপ্রেম নিরীক্ষা শেষে একাট্টা হয়ে শুরু করে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতন। লক্ষ্মীপুর থেকে ৬ কিলােমিটার দক্ষিণে লক্ষ্মীপুর-রামগতি পাকা সড়কে পেয়ারাপুর বাজার। বাজারের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে রহমতখালী খাল। বাজারে আবদুল হাইরা ক্যাম্প স্থাপন করে। পেয়ারাপুর বাজার থেকে ১ কিঃমিঃ উত্তরে এনায়েতপুরে আবদুল হাইয়ের বাড়ি। সে এনায়েতপুর মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। আর তার জল্লাদ বেলায়েত হােসেনের বাড়ি কামালপুর গ্রামে। পেয়ারাপুর থেকে ১ কিঃমিঃ দক্ষিণে কামালপুরের মজিবুল্লাহ দরবেশের কুপুত্র এই জল্লাদ বেলায়েত। পাকিদের নিয়ে আবদুল হাই ও বেলায়েত প্রথম অপারেশন চালায় পেয়ারাপুর ক্যাম্প থেকে দেড় কিঃমিঃ দক্ষিণ-পূর্বে আবদুল্লাহপুর গ্রামে।
ঐদিন ছিল ২৩ বৈশাখ, ৭ মে, শুক্রবার। এরা সর্বশেষ অপারেশন চালায় ‘৭১-এর ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। প্রথমদিন, ৭ মে অপারেশনের তিনখানা জলপাই রঙের গাড়ি আবদুল্লাহপুর গ্রামের সড়ক ও জনপথের সড়কে থামে। পাকিদের সঙ্গে আবদুল হাইরা ঝটপট নেমে পড়ে। প্রতিদিনের মতাে আবদুল্লাহপুর গ্রামে ছিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কৃষকরা আউশের ক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছিল; কোন কোন বাড়িতে গাছের কাঁচা-পাকা আম পড়ছিল। আউশের লকলকিয়ে ওঠা সবুজ চারার দিকে তাকিয়ে কৃষক ভাবছিল- এই তাে চারা বড় হবে, আসবে সােনালি ধান। চোখের এই সােনালি স্বপ্ন। মিলিয়ে যায় পাকি ও রাজাকারদের বন্দুকের তপ্ত বুলেটের আঘাতে । প্রথমে লুটিয়ে পড়ে মৃত বঙ্গ চন্দ্র কর্মকারের পুত্র শ্রী চন্দ্র কর্মকার। এর পর একে একে শশী কর্মকারের পুত্র যােগ্যেশ্বর চন্দ্র কর্মকার, যােগ্যেশ্বরের পুত্র পরেশ কর্মকার। বগলা ডাক্তার বাড়ির অনুকূল, তার স্ত্রী মিঠু রানী, নলিনী, সারদা ভৌমিক, ব্রজলাল, কৃষ্ণলাল, ভুবনেশ্বরসহ অনেকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। ৭ মে নিহত শ্রী চরণ কর্মকারের স্ত্রী হতভাগিনী জীবনবালা কর্মকার এবং নিহত যােগেশ্বরের সহােদর জগদীশ কর্মকার চোখের জলে কপাল ভিজিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। এঁরা জানান, সেই ভয়াল দিনে অনুকূল ও তার স্ত্রী মিঠু রানীকে পাকিরা গুলি করে হত্যা করে মজুমদারদের সুপারি বাগানে। এই যুগলকে জল্লাদ বেলায়েত পাকিদের দেখিয়ে দেয়। আবদুল্লাহপুরে সেইদিন কর্মকার বাড়িতে লাশের স্তৃপ পড়েছিল। গভীররাতে এদেরকে মাটিচাপা দিয়ে এলাকার লােকজন ঘরে ফেরার সময় মজুমদারদের বাগানে কান্নার। আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়।
হতচকিত হয়ে বাগানের অভ্যন্তরে দেখে মৃত মাকে জড়িয়ে ধরে কাদছে দুধের শিশু কৃষ্ণ হতভাগা কৃষ্ণ জানে না পাকি ও ওদের এদেশী দোসররা তার বাবা-মাকে চিরতরে কেড়ে নিয়েছে, এই মায়ের দুধ আর কোনদিন সে। পাবে না, মায়ের মুখ সে আর কোনদিন দেখতে পাবে না। এর পর কুখ্যাত রাজাকার আবদুল হাই আর বেলায়েতরা হত্যা করেছে হরমােহন সাহার পুত্র রবীন্দ্রনাথ সাহাকে, বৃন্দাবনের পুত্র হরেকৃষ্ণ মজুমদার, হরকুমারের পুত্র অমৃত মজুমদার, অপর তিন সহােদর খগেন্দ্র দাশ, গােপাল দাশ, নারায়ণ দাশকে। এইদিন এরা আরও হত্যা করেছে মনােরঞ্জন দাশ, নারায়ণচন্দ্র দাশ, শঙ্করচন্দ্র দাশ, বিমলচন্দ্র দাশ আর সুশীলচন্দ্র দাশ ও বেণু সাধুসহ ছত্রিশ জনকে। ধর্মপুর আর ভবানীগঞ্জে বহু ঘরবাড়ি লুট করে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বসতঘরের আগুনে পুড়ে কয়লা করেছে করাতমিস্ত্রি তরিক উল্লাকে। এরা হত্যা করেছে ডাঃ ললিত মজুমদার, ডাঃ সুশীল মজুমদার আর কামালপুরের বীর মুক্তিযােদ্ধা বটু মিয়া, একই গ্রামের লতিফ মাস্টারের পুত্র কালা মিয়া আর ধর্মপুরের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র নারায়ণকে। ধর্মপুরে জগদ্বন্ধু আশ্রমসহ ত্রিশ-চল্লিশটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ভবানীগঞ্জবাজার লুট করে বিজয় কুণ্ডুর বাবা কালাই কুণ্ডু, হরমােহন সাহার পুত্র দীনেশচন্দ্র সাহাকে হত্যা করে। নােয়াখালী শত্রুমুক্ত হয়েছে ‘৭১-এর ৭ ডিসেম্বর। সেই সময় লক্ষ্মীপুর ছিল নােয়াখালীর | একটি থানা। যেদিন নােয়াখালী মুক্ত হয় সেই ৭ ডিসেম্বর খুনী আবদুল হাই ও জল্লাদ বেলায়েতরা একদল রাজাকার নিয়ে বানছা নগরের বারেক মিয়ার ছেলে তােফায়েল এবং একই এলাকার আক্তার, মন্টু, হােসেনসহ অনেককে হত্যা করে। পেয়ারাপুর-রহমতখালী খালে তীব্র স্রোতের মধ্যে এরা অধিকাংশ লাশ ভাসিয়ে দেয়। একইভাবে অনেককে হত্যা করেছে লক্ষ্মীপুর মাদাম ব্রিজের ওপর এবং অনেককে হত্যা করেছে ভবানীগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমে ছাত্তার চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে। এই দু’জায়গায় হত্যা করা লাশ এরা ভাসিয়ে দিয়েছে খালের স্রোতে। সম্প্রতি লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনকালে, বিশেষ করে পেয়ারাপুর, আবদুল্লাহপুর, কামালপুর এবং ধর্মপুরের অনেকে কমান্ডার আবদুল হাই ও জল্লাদ বেলায়েতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং জঘন্য নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তারা জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এরা। আত্মগােপন করে। ‘৭৫-এ বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করে দৃশ্যপটে খন্দকার মােশতাক আসার পর এরা এলাকায় ফিরে এলেও অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অবস্থান করে। আবার চলে যায় অজ্ঞাতস্থানে। একই সূত্র থেকে জানা গেছে, বর্তমানে এদের চেহারা পাল্টে গেছে। চেহারার পরিবর্তন করে মাইক্রোবাসে আবদুল হাই এলাকায় আসে এবং একইদিনে জল্লাদ বেলায়েতও আসতে ভুল করে না। পরে আবার হাওয়া হয়ে যায়। একাধিক সূত্রমতে, আবদুল হাই এখন জামায়াতের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আইএসডি ফোনে বিদেশের সঙ্গে যােগাযােগ করে মােটা অঙ্কের অনুদান হাতে নিয়ে দেশে হুকুমতে পাকিস্তান কায়েম করার দৃঢ়অঙ্গীকার নিয়ে দিন-রাত কাজ করছে। তার সঙ্গে রীতিমতাে যােগাযােগ রক্ষা করছে চট্টগ্রামের বারইয়ার হাটের চামড়া ব্যবসায়ী একাত্তরের জল্লাদ বেলায়েত হােসেন।
আবদুল হাই ও বেলায়েতের স্বজনদের বক্তব্য
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের মােল্লাবাড়ির ছেলে মাওলানা আবদুল হাই। ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পরও সে প্রকাশ্যে বাড়ি আসতে পারছে না। তার বাড়িতে বসবাস করছে তার দুই ছেলে। বড় ছেলে নূরুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রী অর্থাৎ আবদুল হাইয়ের বড় পুত্রবধূ কামরুন নাহার জনকণ্ঠের প্রতিবেদকের অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলেও স্বীকার করেন, তার শ্বশুর আবদুল হাই রাজাকার কমান্ডার ছিল। এই গৃহবধূ আরও বলেন, শুনেছি যুদ্ধের বছর সে হত্যা-লুটপাট করেছে, যার ফলে এলাকাবাসী তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। কামরুন নাহার আরও জানান, তিনি শুনেছেন। লােকজন বলাবলি করেছে আবদুল হাইয়ের ঢাকার উত্তরা না মােহাম্মপুর বাসার পিছনের পানির ট্যাঙ্ক থেকে কয়েক বছর আগে পুলিশ স্টেনগান উদ্ধার করেছে। ‘৮৭ সালে নূরুল ইসলামের সঙ্গে কামরুন নাহারের বিয়ের পর ঘাতক আবদুল হাই প্রকাশ্যে এনায়েতপুর আসেনি বলে কামরুন নাহার জানান। একই সূত্র জানায় কোন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে বারণ আছে। কে বারণ করেছে জানতে চাইলে এই গৃহবধূ নিরুত্তর থাকেন। কেন আবদুল হাই বাড়ি আসে না- উত্তরে কামরুন নাহার বলেন, “হরানের ডরে” (প্রাণভয়ে)। এদিকে আবদুল হাই কমান্ডারের জল্লাদ বেলায়েতের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর থেকে ৭ কিঃমিঃ দক্ষিণে আবদুল্লাহপুর গ্রামে মােবারক বেপারির বাড়ি। কেউ কেউ তার বাবা। মজিবুল্লাহ দরবেশের নামে দরবেশের বাড়ি বলেও তাদের বাড়ির পরিচয় দেয়। জনরােষে বেলায়েতও প্রকাশ্যে বাড়ি আসে না বলে তার সহােদর মুস্তাফিজ জানায়। ‘৭১ সালে মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে বেলায়েত চট্টগ্রামের বিভিন্ন মসজিদে ইমামতি করেছে এবং চট্টগ্রামেও বারইয়ার হাটে চামড়ার ব্যবসা করছে। বলে মুস্তাফিজ জানায়। তবে তার সঠিক ঠিকানা দিতে জল্লাদ সহােদর অপারগতা প্রকাশ করে।
জনকণ্ঠ। ১৮-০৩-২০০১